সেই কুয়াশা ১.৮

আট

ঘাড়ের উপর প্রচণ্ড এক রক্ষা মেরে নিগ্রো খুনিকে অজ্ঞান করে ফেলল কুয়াশা। বাঁধন খুলে এরপর তাকে শুইয়ে দিল মেঝেতে। গা থেকে খুলে নিল জ্যাকেট, গলা থেকে স্কার্ফ। একটা টুপিও পাওয়া গেল জ্যাকেটের ভিতরের পকেটে, ওটা মাথায় দিল ও। চোখে দিল খুনির কালো সানগ্লাস। কয়েক সেকেণ্ডের জন্য নিগ্রোটার সঙ্গী-সাথীকে ধোঁকা দেবার জন্য এ-সাজই যথেষ্ট। হাতের ছড়িটা বাড়তি বোঝা হতে পারত, তবে ওটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে দেয়া যায়। তা-ই করল কুয়াশা। ছড়িটা আসলে বাড়তি সাপোর্ট, ওটা ছাড়াও প্রায় স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে ও; পারে দৌড়ঝাঁপ করতেও। অসুবিধে হয় না একটুও।

রানাকে সতর্ক করে দিয়েও স্বস্তি পাচ্ছে না ও। বুঝতে পারছে, তিন-তিনজন প্রফেশনাল খুনির সঙ্গে কিছুতেই পেরে উঠবে না বিসিআই এজেন্ট। সাহায্য প্রয়োজন হবে ওর। তাই তৈরি হচ্ছে কুয়াশা।

ক্লজিটের কাছে গেল ও। ভিতরে বন্দি নবদম্পতির উদ্দেশে বলল, ‘এখানেই থাকো তোমরা, কোনও আওয়াজ কোরো না। খুব শীঘ্রি হোটেলের লোকজন এসে উদ্ধার করবে তোমাদেরকে। তার আগে যদি হৈচৈ করো, ফিরে আসব আমি। বিপদ হবে তোমাদের। ক্লিয়ার?’

অস্পষ্ট স্বরে কিছু বলল যুবকটি ভিতর থেকে। ইতিবাচক জবাবই হবে। ঘুরে কামরার দরজার দিকে এগোল কুয়াশা। বেরিয়ে এল করিডোরে। দ্রুত পা চালিয়ে পেরিয়ে এল মেইন এলিভেটর, করিডোরের শেষ প্রান্তে সার্ভিস এলিভেটরের সামনে পৌঁছে থামল। দরজার উপরের ইণ্ডিকেটর ‘দুই’-এ স্থির হয়ে আছে। তারমানে এই একজিটের খুনি জায়গামত অপেক্ষা করছে রানার জন্য।

নিজের পিস্তল জ্যাকেটের ডান পকেটে ঢুকিয়ে রাখল কুয়াশা, ডান হাতও ঢোকাল ভিতরে। বাম হাতে টিপে দিল এলিভেটরের বোতাম। দুই নম্বরের আলো নিভে গেল, উপরদিকে উঠতে শুরু করেছে এলিভেটর। স্লাইডিং প্যানেলের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল ও, দরজা খোলার পর ওর চেহারা যেন দেখতে না পায় ভিতরের আরোহী।

কয়েক সেকেণ্ড পর মৃদু আওয়াজ হলো পিছনে-এলিভেটর পৌঁছে গেছে পাঁচতলায়। স্লাইড করে দরজা পুরোপুরি খুলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল কুয়াশা, তারপর পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল। হাতে বেরিয়ে এসেছে পিস্তল। কিন্তু হতাশ হতে হলো ওকে। কেউ নেই ভিতরে। এলিভেটরে উঠে পড়ল ও। তিনতলার বোতাম চাপল।

.

‘স্যর! স্যর!! দুইশ’ তেরোর ওই লোকটা…’ ইয়ারপিসে এখনও শোনা যাচ্ছে অপারেটরের কণ্ঠ। ‘কাউকে পাঠান ওখানে! আমি অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করছি। ওর সম্ভবত হার্ট অ্যাটাক হয়েছে!’

ফোনের লাইন নিথর হয়ে গেল এরপর, ভেসে এল ডায়াল টোন। তবে গোলমাল শুরু হয়ে গেছে নীচতলায়।

দরজার পাশে অবস্থান নিয়েছে রানা, হাতে ওর সিগ-সাওয়ার পিস্তল। ছিটকিনি খুলে দিয়ে অপেক্ষা করছে : মিনিটখানেক পরেই ছুটন্ত পদশব্দ শোনা গেল করিডোরে। কয়েক মুহূর্ত পরে ঝড়ের বেগে কামরায় ঢুকল একজন বেলবয় আর একজন ওয়েইটার।

‘থ্যাঙ্ক গড! দরজা খোলা ছিল…’

কথাটা বলতে বলতে থমকে গেল দু’জনে। পিছনে পিস্তলের হ্যামার টানার শব্দে জমে গেছে। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল ওরা, মুখোমুখি হলো রানার।

‘রিল্যাক্স, কারও কোনও ক্ষতি হবে না,’ ওদের দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে দরজা বন্ধ করল রানা। ‘আমার কথা যদি শোনো আর কী। তুমি…’ বেলবয়ের দিকে ইশারা করল ও। ‘ইউনিফর্মটা খুলে ফেলো। আর তুমি… ওয়েইটার, ফোন করো নীচে অপারেটরকে বলো, ম্যানেজারকে উপরে পাঠাতে। ভয় পাবার ভান করবে, বলবে কিছুই ধরার সাহস পাচ্ছ না। তোমার ধারণা, আমি মারা গেছি। বুঝতে পেরেছ?’

মাথা ঝাঁকাল লোকটা। পিস্তল দেখে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি ফোনের কাছে গিয়ে ডায়াল করল নীচে। ভয় পাবার ভান করতে হলো না, আসলেই ভয় পেয়েছে। অক্ষরে অক্ষরে মেসেজটার পুনরাবৃত্তি করল।

ইউনিফর্ম খুলে ফেলেছে বেলবয়। বাড়িয়ে ধরল রানার দিকে। ওগুলো নিল ও। পরে ফেলল দ্রুত হাতে। ঠিকমত ফিট করল না, তবে কিছু করার নেই এ-মুহূর্তে। ওয়েইটার লোকটা অনেক মোটাসোটা, তার পোশাক রীতিমত ঢলঢল করবে ওর শরীরে।

টুপিটাও।’ বেলবয়ের দিকে হাত বাড়াল ও।

দ্বিরুক্তি না করে মাথা থেকে টুপি খুলে দিল বেলবয়। ওটাও পরল রানা। ভয়ার্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে ওয়েইটার। ফোনে শেষবারের মত আর্তি ছাড়ল, প্লিজ, তাড়াতাড়ি! ম্যানেজারকে আসতে বলো এখানে!’

ইশারায় তাকে রিসিভার নামিয়ে রাখতে বলল রানা। তাকাল বেলবয়ের দিকে। বলল, ‘ক্লজিটটা কোথায়, জানো তো? ঢুকে পড়ো ওখানে।’

একটু দ্বিধা করল বেলবয়। রানা চোখ রাঙাতেই সাহস হারাল। সুড়সুড় করে গিয়ে ঢুকে পড়ল ক্লজিটে। দরজা টেনে দিয়ে ছিটকিনি আটকে দিল রানা। বেলবয়কে বলল, একদম বামে সরে যাও, তারপর টোকা দাও পাল্লায়।’

কয়েক মুহূর্ত পরে মৃদু টুক-টুক শোনা গেল ক্লজিটের পাল্লায়। আদেশ পালন করেছে বেলবয়। ডানদিকটায় একটা গুলি করল রানা। বলল, ‘ওটা বুলেট ছিল। যদি কথা না শোনো, পরের গুলিটা ক্লজিটের বামদিকে ঢুকবে। বুঝতে পেরেছ? যা-ই ঘটুক, ভিতরে চুপচাপ বসে থাকবে তুমি। মুখ দিয়ে একটা শব্দও যেন  না বেরোয়।

‘ও মাই গড!’ হালকা গোঙানি শোনা গেল ভিতর থেকে। তবে রানা নিশ্চিত, ভূমিকম্প হলেও মুখ দিয়ে আর কোনও আওয়াজ বের করবে না লোকটা।

ওয়েইটারের দিকে ফিরল ও। জিজ্ঞেস করল, ‘স্টেয়ারকেসটা কোন দিকে?’

‘এলিভেটরের পাশে,’ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল ওয়েইটার। ‘রুম থেকে বেরিয়ে ডানে ঘুরতে হবে। করিডোরের একেবারে শেষ মাথায়।’

‘আর সার্ভিস এলিভেটর?’

‘ওটাও শেষ মাথায়… তবে বামের করিডোরে।’

‘মন দিয়ে শোনো কী করতে হবে,’ বলল রানা। ‘খুব শীঘ্রি ম্যানেজারের পায়ের আওয়াজ শুনতে পাবে তুমি। একা আসবে না, সঙ্গে আরও লোক থাকবে তার। আমি দরজা খুলে দেয়ামাত্র লাফ দিয়ে রুম থেকে বের হবে তুমি, চেঁচাতে শুরু করবে… যত জোরে পারো! তারপর আমার সঙ্গে দৌড়াতে শুরু করবে করিডোর ধরে

‘ক্রাইস্ট! কী বলব আমি?’

‘বলবে যে, এখানে আর থাকতে চাও না তুমি, পালিয়ে যেতে চাও… এইসব আর কী। মনে হয় না খুব একটা কষ্ট হবে চেঁচাতে।’

‘ক্… কিন্তু কোথায় যাব আমি আপনার সঙ্গে? ঘরে আমার বউ আর দুটো বাচ্চা আছে!

‘খুব ভাল। বাড়িতেই চলে যেয়ো তা হলে।’

‘কী?’

লোকটার চমকে ওঠাকে পাত্তা দিল না রানা। প্রশ্ন করল, ‘লবিতে সবচেয়ে দ্রুত পৌঁছুনো যাবে কোন্ পথে?’

‘আ… আমি জানি না।’

‘ভেবে দেখো। এলিভেটরে তো অনেক সময় লাগার কথা।’

‘সিঁড়ি… সিঁড়ি দিয়ে যেতে হবে।’

‘তা হলে সিঁড়িটাই ব্যবহার কোরো।’

বাইরে পায়ের আওয়াজ আর উত্তেজিত কণ্ঠ শোনা গেল। ধীরে ধীরে জোরালো হচ্ছে। পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স আর ইমার্জেন্সি নিয়ে কথা বলছে তিন থেকে চারজন লোক।

‘সময় হয়েছে।’ বলে এক ঝটকায় রুমের দরজা খুলে ফেলল রানা। ইশারা করল ওয়েইটারকে। ‘বেরোও!’

.

তিনতলায় এলিভেটরের দরজা খুলে যাবার সময় পিছনদিকে সেঁদিয়ে গেল ‌‌কুয়াশা। পিস্তল তাক করে রাখল দরজার দিকে। কিন্তু সতর্কতার প্রয়োজন ছিল না, ওপাশে কেউ নেই। সন্তৰ্পণে করিডোরে বেরিয়ে এল ও। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বোলাল চারদিকে। সামনে দেয়াল ঘেঁষে পড়ে আছে একগাদা ট্রে-টেবিল। তাতে বিভিন্ন রুম থেকে আসা ব্রেকফাস্টের উচ্ছিষ্ট। স্প্রিং লাগানো দুই পাল্লার একটা মেটাল ডোর আছে এই ফ্লোরে, বৃত্তাকার দুটো কাঁচ লাগানো আছে ওতে!

সাবধানে দরজার দিকে এগোল কুয়াশা, কাঁচ ভেদ করে উঁকি দিল অন্যপাশে।

হ্যাঁ, এবার দেখা যাচ্ছে খুনিকে। চশমাঅলা লোক… দুই নম্বর খুনি। ফোন বুদ থেকে একে নিগ্রোর সঙ্গে সঙ্কেত বিনিময় করতে দেখেছে, ও। দুইশ’ তেরো নম্বরে যাবার করিডোরের মোড়ে ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করছে লোকটা, হাবভাবে চাঞ্চল্য লক্ষ করা যাচ্ছে।

ঘড়ি দেখল কুয়াশা। বারোটা ছাব্বিশ। নির্ধারিত পনেরো মিনিট পেরিয়ে গেছে, তাই ব্যাটার এই অস্থিরতা। ডাইভারশন দরকার। আগুন হলে সবচেয়ে ভাল হয়। কাপড় বা কাগজের স্তূপে আগুন ধরিয়ে করিডোরের মাঝখানে ছুঁড়ে দিলে সেটা চমৎকার ডাইভারশন হিসেবে কাজ করবে। ব্যাপারটা রানারও জানা থাকার কথা। কী করছে ও?

জবাবটা পরক্ষণে পাওয়া গেল। করিডোরের ওপাশে খুলে গেল মেইন এলিভেটরের দরজা। কলকাকলি করতে করতে বেরিয়ে এল তিনজন লোক-প্ৰথমজনকে চেনে কুয়াশা, ডে-শিফটের ম্যানেজার। তারসঙ্গে কালো ব্যাগ আর স্টেথোস্কোপ-সহ একজন মোটা মানুষ… ডাক্তার নিঃসন্দেহে; শেষজনের ইউনিফর্ম বলছে, সে হোটেল সিকিউরিটি।

হতচকিত খুনিকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল তারা। করিডোর ধরে এগোতে থাকল রানার কামরার দিকে। চোখ ঘোরাতেই স্টেয়ারকেলের দরজা খুলে যেতে দেখল কুয়াশা, লম্বা-চওড়া একজন লোক বেরিয়ে এল করিডোরে, যোগ দিল চশমাঅলার সঙ্গে। এক নম্বর বুনি দ্বিতীয় মেইন এলিভেটরের দরজা খুলে গেল সেকেণ্ডের ভগ্নাংশের ভিতর, সেখান থেকে দাড়িঅলা তৃতীয় খুনিও বেরিয়ে এল।

তিনজনকে একত্র হয়ে -পরামর্শ করতে দেখল কুয়াশা। হঠাৎ লম্বুর হাতে বেরিয়ে এল একটা গ্রেনেড! প্রমাদ গুনল ও। লোকগুলো মরিয়া। গ্রেনেড ফাটিয়ে খুন করতে চাইছে রানাকে, তাতে দু’চারজন নিরীহ মানুষ মারা গেলেও ক্ষতি নেই! কিছু একটা করা দরকার এখুনি। কিন্তু কী?

হঠাৎ চেঁচামেচির শব্দ শুনে চমকে উঠল কুয়াশা। দুইশ’ তেরো নম্বরের দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে একজন ওয়েইটার। গলা ফাটিয়ে কী যেন বলছে। সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে আচমকা দৌড়াতে শুরু করল সে, সঙ্গে ইউনিফর্ম পরা একজন বেলবয়ও আছে। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হকচকিয়ে গেছে, তিন খুনি তাড়াহুড়ো করে পথ আটকাতে চাইল, কিন্তু তাদেরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল পলায়নরত দুই হোটেল কর্মচারী। একজন ছুটে গেল সিঁড়ির দিকে। অন্যজন ঢুকে পড়ল এলিভেটরের ভিতরে। কেউ সংবিৎ ফিরে পাবার আগেই বন্ধ হয়ে গেল এলিভেটরের দরজা।

‘শিট!’ চশমাঅলাকে চেঁচিয়ে উঠতে শুনল কুয়াশা। ‘দ্যাট ওঅজ মাসুদ রানা!’

তাই তো! চমকে উঠল কুয়াশা। বেলবয়কে কেমন যেন অন্যরকম লাগল না? রানাই ছিল ওটা… সবাইকে বোকা বানিয়ে চোখের সামনে নিয়ে সটকে পড়েছে ও। দারুণ তো!

‘গড ড্যাম ইট!’ খেপাটে গলায় বলে উঠল দাড়িঅলা।

‘না… দাঁড়াও!’ বলে উঠল লম্বু। তাকিয়ে আছে এলিভেটরের কাউন্টারের দিকে। ‘নীচে যাচ্ছে না ও। উপরে যাচ্ছে!’

‘হোয়াট!’

কুয়াশারও আরেক দফা চমকাবার পালা। উপরে যাচ্ছে মানে? রানা তো চাইলে এখন লবি হয়ে অনায়াসে বেরিয়ে যেতে পারে হোটেল থেকে। উপরে যাচ্ছে কেন? জবাবটা আন্দাজ করতে পারল সঙ্গে সঙ্গে। ওর জন্যে যাচ্ছে! রানাকে ওপেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে ও, পারলে পাঁচশ’ পাঁচ নম্বর কামরায় যেতে। সেটার জবাব দিতেই যাচ্ছে রানা!

‘সিঁড়ি দিয়ে যাও!’ উত্তেজিত গলায় দুই সঙ্গীকে বলল দাড়িঅলা। ‘আমি এখান থেকে কাউন্টারে নজর রাখছি। ও কোথায় থামছে, সেটা রেডিওতে জানাব তোমাদেরকে।’

ঝড়ের বেগে স্টেয়ারকেসের দিকে ছুটে গেল দাড়িঅলা আর লম্বু।

‘বের করছি তোমার রেডিওতে জানানো!’ বিড়বিড় করল কুয়াশা।

মেটাল ডোর ঠেলে বেরিয়ে এল ও, দৃঢ় পায়ে হাঁটছে চশমাঅলা খুনির দিকে। পায়ের শব্দে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল লোকটা, পরিচিত পোশাক দেখে ক্ষণিকের জন্য ঢিল পড়ল সতর্কতায়। চেহারার দিকে তাকিয়ে পরমুহূর্তে আবার সচকিত হয়ে উঠল সে। তাড়াতাড়ি তুলতে শুরু করল পিস্তল।

কিন্তু বেচারাকে সেই সুযোগ দিল না কুয়াশা। দশ গজ দূর থেকে হাত বাড়াল সামনে, হাঁটার ছন্দ বিন্দুমাত্র নষ্ট না করে দুপ দুপ শব্দে দুটো গুলি ছুঁড়ল। প্রতিক্রিয়ার কোনও সময়ই পেল না খুনি, লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। নির্বিকার ভঙ্গিতে লাশটাকে টপকে এল কুয়াশা। দ্বিতীয় মেইন এলিভেটরের দরজা খোলা, ঢুকে পড়ল ভিতরে। রওনা হলো ছ’তলার দিকে।

.

বেলবয়ের জ্যাকেট পরে টুপি খুলে ফেলল রানা, ওগুলো ছুঁড়ে ফেলল এলিভেটরের ভেতরটায়। চারতলায় কয়েক সেকেণ্ডের জন্য থামল এলিভেটর। তরুনী এক মেইড সহযাত্রী হলো ওর। হাতভর্তি তোয়ালে। সন্দিহান দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল ওর দিকে, তবে ব্যাপারটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। পাঁচতলায় নেমে গেল সে।

সাততলার বোতাম চাপল রানা। ওটাই হোটেলের টপ ফ্লোর। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে গেল ওখানে। দরজা খুলতেই দু’জন সুবেশী ভদ্রলোক ঢুকল ভিতরে। গেল বছরের লাভ-ক্ষতি নিয়ে আলোচনা করছে। ব্যবসায়ী নিঃসন্দেহে। এক পলকের জন্য তাকাল তারা ওর দিকে। দৃষ্টিতে বিতৃষ্ণা ফুটল। দোষ দিতে পারল না রানা, জঘন্য দেখাচ্ছে ওকে। টকটকে লাল দু’চোখ, মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পোশাকও অবিন্যস্ত।

‘সরি, আমি নামব এখানে,’ বলল রানা। দুই ব্যবসায়ীকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এল এলিভেটর থেকে।

লম্বা করিডোরটা শূন্য, কাউকে দেখা যাচ্ছে না আশপাশে। ডানদিকে একেবারে শেষ প্রান্তে রয়েছে দুই পাল্লার মেটাল ডোর, সার্ভিস এলিভেটরের সামনে। একটা পাল্লা মৃদু কাঁপছে। বেল্টে গোঁজা সিগ-সাওয়ারের বাটে হাত দিল রানা, সতর্ক। বাসন-কোসনের ঝনঝনানি শোনা গেল দরজার ওপাশ থেকে, সার্ভিস-ট্রে নিয়ে যাচ্ছে কেউ। শরীরটায় একটু ঢিল দিল রানা,

শত্রুপক্ষের লোকজন এভাবে শব্দ করবে না।

বামদিকের একটা কামরা থেকে একজন ক্লিনিং লেডিকে বেরিয়ে আসতে দেখল ও—কামরা পরিষ্কার করেছে, ক্লিনিং কার্ট ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে আসছে ওর দিকে। ভুরু কুঁচকে কয়েক সেকেণ্ড মহিলার দিকে তাকিয়ে থাকল ও। নিশ্চিত হলো, সত্যিই ক্লিনিং লেডি; কুয়াশার পাঠানো দ্বিতীয় কোনও খুনি নয়।

ঠোঁট কামড়াল রানা। পাঁচশ’ পাঁচ নম্বর স্যুইটে যেতে হবে ওকে। সরাসরি ছ’তলায় নামেনি, উঠে এসেছে সাততলায়; সরাসরি যেন কুয়াশার ফাঁদে পা দিতে না হয়। পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা অবশ্য ঠিক করেনি এখনও।

ক্লিনিং লেডিকে ব্যবহার করবে কি না, ভাবল একবার। পরমুহূর্তে বাতিল করে দিল আইডিয়াটা। যে চেহারাসুরত হয়েছে ওর, সাহায্য চাইতে গেলে মহিলা উল্টো সন্দেহ করে বসবে ওকে। কী করা যায় তা হলে। মেইন এলিভেটর বা সার্ভিস এলিভেটর ব্যবহার করা যাবে না। হামলার মুখে পড়লে বদ্ধ  জায়গায় কোণঠাসা হয়ে পড়বে। বাকি থাকে সিঁড়ি… শেষ, এবং একমাত্র পথ। সমস্যা হলো, প্রতিপক্ষও আন্দাজ করবে সেটা। একটাই উপায় আছে তার উপর টেক্কা দেবার।

ক্লিনিং লেডি আরেকটা কামরায় ঢুকেছে। বাইরে রয়ে গেছে তার কার্ট। ওদিকে এগিয়ে গেল রানা। কার্ট থেকে কাঁচের দুটো অ্যাশট্রে তুলে নিল, ওগুলো ঢুকিয়ে ফেলল পকেটে। তারপর পা বাড়াল স্টেয়ারকেসের দিকে।

সিঁড়ির ধাপ ধরে সাবধানে নামতে শুরু করল রানা, দেয়াল ঘেঁষে নামছে, খাড়া করে রেখেছে দু’কান। একটু পরেই সিঁড়ির নীচদিক থেকে ভেসে এল পদশব্দ। তাড়াহুড়ো করে উপরদিকে উঠে আসছে কেউ। রেলিঙের কাছে এসে উঁকি দিল ও। পলকের জন্য একটা ছায়া দেখা গেল, দ্রুত উঠে আসছে উপরে।

পকেট থেকে একটা অ্যাশট্রে বের করল রানা, লোকটা এক ফ্লোর নীচে থাকতে ছুঁড়ে দিল এটা দুই রেলিঙের ফাঁক দিয়ে— ছ’তলার ল্যাণ্ডিয়ে কংক্রিটের উপর আছাড় খেয়ে ঝন ঝন শব্দে ভেঙে গেল এটা। ফলাফল দেখার জন্য অপেক্ষা করল না ও, দ্রুত নেমে এল কয়েক ধাপ, দ্বিতীয় অ্যাশট্রে-টাও ছুঁড়ে দিল। আবারও জোর আওয়াজ করে চৌচির হয়ে গেল ওটা। নীচ থেকে ভেসে এল গালাগাল :

ঝপট্ দুই ফ্লোরের মধ্যবর্তী ল্যাণ্ডিঙে নেমে এল রানা। দেয়াল ঘেঁষে শুয়ে পড়ল উপুড় হয়ে। ছ’তলার ল্যাণ্ডিং থেকে ওকে এখন দেখা যাবে না। ও-ও দেখতে পাচ্ছে না জায়গাটা, তবে তাতে অসুবিধে নেই। ভাঙা কাঁচ-ই এখন ওকে সাহায্য করবে।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। একটু পরেই ভারী শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ কানে এল ওর। তার পিছু পিছু ভেসে এল আরেকটা আওয়াজ—অ্যাশট্রের ভাঙা টুকরোগুলোর উপর পা ফেলছে কেউ। জায়গামত লোকটাকে পৌঁছুতে দেবার জন্য একটু দেরি করল ও, তারপরেই ঝট্ করে উঠে বসল।

লম্বা একটা লোক, পরনে ওভারকোট, হাতে একটা অটোমেটিক পিস্তল নিয়ে এগোচ্ছে ছ’তলার স্টেয়ারকেসের দরজার দিকে। চোখের কোণে রানার নড়াচড়ার আভাস পেয়েই পাঁই করে ঘুরল, গুলি করার চেষ্টা করল, কিন্তু রানা অনেক এগিয়ে আছে। একটাই গুলি করল ও, বুলেটের আঘাতে দেয়ালের উপর আছড়ে পড়ল লম্বু। স্থির হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে।

উঠে দাঁড়াল রানা। নামতে শুরু করল সিঁড়ি বেয়ে। আধাআধি যেতেই প্রচণ্ড আওয়াজে কেঁপে উঠল ও, হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল পিস্তলটা। চমকে উঠে নীচে তাকাল; দেখতে পেল, রেলিঙের ফাঁক দিয়ে নীচ থেকে উঁকি দিচ্ছে আরেকজন— বেটেখাটো, মুখভর্তি দাড়ি। এর হাতে আরেকটা অটোমেটিক, ব্যারেল দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। স্রেফ কপাল, লোকটার ছোঁড়া গুলি রেলিঙে বাড়ি খেয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে; রানার শরীরের বদলে আঘাত হেনেছে হাতে ধরা সিগ-সাওয়ারের গায়ে।

সেকেণ্ডের ভগ্নাংশের জন্য স্থির রইল রানা, তারপরেই উল্টো ঘুরে পড়িমরি করে উঠতে শুরু করল সিঁড়ি দিয়ে। পিস্তলটা উঠিয়ে আনার সুযোগ নেই, আগে খুনির নাগাল থেকে সরে যেতে হবে। পিছন পিছন ধাওয়া করে এল দাড়িঅলা। পাঁচতলার ল্যাণ্ডিঙে পৌছেই আবার গুলি ছুঁড়ল। এবারও নিশানা ঠিক থাকেনি, তবে একেবারে ব্যর্থও হয়নি সে।

উরুর পিছনে আঘাত লাগায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল রানা। নাকমুখ ঠুকে গেল সিঁড়ির ধাপে। সড়সড় করে নেমে এল ও কয়েক ফুট। চলৎশক্তি হারাল কিছুক্ষণের জন্য। সিঁড়ি ধরে ওর গায়ের উপর উঠে এল খুনি। এক ঝটকায় চিৎ করল। তারপর পিস্তল তাক করল ওর কপালের দিকে।

‘গুড বাই, মাসুদ রানা!’ মুখে একটা হিংস্র হাসি এনে বলল লোকটা।

চোখ বন্ধ করে ফেলল রানা, পরক্ষণেই ভেসে এল গুলির আওয়াজ। কপাল এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায়নি দেখে আবার চোখ মেলল ও।

হাসি মুছে গেছে দাড়িঅলা খুনির মুখ থেকে। অল্পক্ষণের জন্য স্থির হয়ে রইল, তারপরেই কাত হয়ে পড়ে গেল সিঁড়িতে। দৃষ্টিসীমা পরিষ্কার হয়ে যেতেই দীর্ঘদেহী একটা মূর্তিকে দেখতে পেল রানা। ছ’তলার ল্যাণ্ডিঙের দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে, হাতে উদ্যত পিস্তল, ধোঁয়া বেরুচ্ছে ব্যারেল থেকে।

কুয়াশা!

উঠে এল সে রানার কাছে। জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি ঠিক আছ তো, রানা?’

‘আ… আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন!’ ফিসফিসিয়ে বলল রানা।

‘হ্যাঁ,’ হাসল কুয়াশা। ‘আগেই তো বলেছি, তোমাকে খুন করতে আসিনি আমি। এখন বিশ্বাস হয়েছে কথাটা?’

মাথা ঝাঁকাল রানা।

‘গুড,’ বলল কুয়াশা। ‘এখন ওঠো। পুলিশ আসছে, তার আগেই সরে যেতে হবে আমাদেরকে এখান থেকে। ‘

এতক্ষণে খেয়াল করল রানা, দূরে কোথাও সাইরেন বাজছে। স্টেয়ারকেসের নীচ থেকে হৈ-হল্লা শোনা গেল। হোটেলের লোকজন সম্ভবত উঠে আসছে খোঁজখবর নিতে। কষ্টে-সৃষ্টে উঠে বসল রানা। দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে গেল হুড়মুড় করে।

‘এ কী! তুমি তো দেখছি আহত!’ রক্ত দেখে বলে উঠল কুয়াশা

‘পায়ে গুলি লেগেছে। হাঁটতে পারব বলে মনে হচ্ছে না।’ বলল রানা।

তাড়াতাড়ি রানার ঊরু পরীক্ষা করল কুয়াশা। বলল, ‘সিরিয়াস কিছু না। গুলি বেরিয়ে গেছে মাংস ভেদ করে। ব্যাণ্ডেজ আর ওষুধ লাগালে ঠিক হয়ে যাবে দু’দিনে।’ নিজের রুমাল দিয়ে ক্ষতটা বেঁধে দিল ও। ‘ওঠো এবার। আমি তোমাকে সাহায্য করছি। পালাতে হবে আমাদেরকে।

‘কেন? আমি তো কিছু করিনি।

‘তারপরেও পুলিশ তোমাকে আটক করবে… মানে যতক্ষণ সবকিছু পরিষ্কার না হচ্ছে আর কী! চারজন খুনি ব্যর্থ হয়েছে, তারমানে এই নয় যে, আরও লোক পাঠাবে না ওরা। পুলিশ কস্টডিতে কাউকে বাগে পাওয়া কত সহজ, তা আশা করি বুঝিয়ে দিতে হবে না তোমাকে?’

‘কিন্তু কেন? কেন আমাকে খুন করতে চাইছে ওরা? আপনিই বা আমাকে সাহায্য করছেন কেন?’

‘সবকিছু বলব, কিন্তু এখন নয়। আগে নিরাপদ কোনও জায়গায় যাওয়া দরকার।’ রানাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল কুয়াশা। নিজের কাঁধে ভর দিতে দিল।

‘হোটেল থেকে বেরুনোর সব রাস্তা এতক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে, কুয়াশা,’ শঙ্কিত গলায় বলল রানা।

‘উঁহুঁ,’ মাথা নাড়ল কুয়াশা। ‘একটা রাস্তা এখনও আছে। আমি ছাড়া কেউ জানে না সেটা।’

‘কোথায়?’

‘ছাদে। এই বিল্ডিং আর পাশের বিল্ডিংটার মধ্যে একটা কমন  এয়ার-ডাক্ট আছে। ওটা ব্যবহার করব আমরা। ওপাশের বিল্ডিঙে পৌঁছে গেলে বেরিয়ে পড়তে অসুবিধে হবে না। পিছনের গলিতে গাড়ি আছে আমার।’

‘এয়ার-ডাক্টের কথা কীভাবে জানেন আপনি?’

‘ওয়াশিংটনে এটাই আমার থাকার জায়গা, রানা। কী ধারণা তোমার, সবার চোখ এড়িয়ে কীভাবে আসা-যাওয়া করা যাবে, সেসব না জেনেই সিলেক্ট করেছি হোটেলটা?

আর কিছু বলল না রানা। কুয়াশার কাঁধে ভর দিয়ে উঠতে শুরু করল সিঁড়ি ধরে। ছাদের দিকে যাচ্ছে। ওর নীরবতা লক্ষ করে কুয়াশা বলল, ‘তুমি কি এখনও আমাকে অ্যারেস্ট করার কথা ভাবছ?’

‘হ্যাঁ,’ স্বীকার করল রানা। ‘কিন্তু আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। তার প্রতিদান হিসেবে আর কিছু না হোক, আপনার বক্তব্য শুনব আমি। যা কিছু ঘটে গেল এই হোটেলে, তাতে মনে হচ্ছে সব কথা না শুনলে বিরাট ভুল হবে।’

‘খুব ভাল সিদ্ধান্ত.. হাসল কুয়াশা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *