সেই কুয়াশা ১.২০

বিশ

এগজামিনেশন রুম থেকে বেরিয়ে এসে দরজা টেনে দিলেন ড. রতন চক্রবর্তী। কোলকাতায় আদি বাড়ি, বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে, ত্রিশ বছর ধরে ইটালিতে প্রবাসজীবন কাটাচ্ছেন। শুরু থেকে রানা এজেন্সির রোম শাখার সঙ্গে জড়িত, অপারেটরদের মেডিক্যাল সাপোর্ট দিচ্ছেন। রানা অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে তাঁকে। এমনিতে হাসিখুশি স্বভাবের মানুষ, কিন্তু এ-মুহূর্তে গম্ভীর হয়ে আছেন।  রানার দিকে না তাকিয়েই বললেন, ‘মাইল্ড-সিডেটিভ দিয়েছি মেয়েটাকে, আমার বউ আপাতত সঙ্গে আছে ওর। জ্ঞান ফিরবে খুব শীঘ্রি। তখন দেখা করতে পারবে ওর সঙ্গে।’

‘কেমন আছে মেয়েটা?’ উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইল রানা।

ব্যথায় কাতর, তবে সেটা বেশি ভোগাবে না। মলম লাগিয়ে দিয়েছি পোড়া জায়গাগুলোতে, ওটা লোকাল অ্যানাস্থেটিক হিসেবে কাজ করবে। শুকিয়ে গেলে আবার লাগাতে হবে… কয়েকটা টিউ দিয়ে দিচ্ছি।’ একটা সিগারেট ধরালেন ড. চক্রবর্তী, কথা শেষ হয়নি তাঁর। ‘মুখের কন্টিউশনগুলোয় বরফ ঘষে দিচ্ছি, ফোলা কমে যাবে রাতের ভিতর। কাটাছেঁড়াগুলোও সিরিয়াস কিছু নয়, সেলাইয়ের প্রয়োজন নেই।’

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রানা। ‘যাক, ভয় তা হলে কাটল আমার।’

‘ব্যাপারটা এত সহজ নয়, রানা।’ গম্ভীর ভঙ্গিতে ধোঁয়ার একটা রিং ছাড়লেন ড. চক্রবর্তী। ‘মেডিক্যালি হয়তো সিরিয়াস নয় ও, সামান্য মেকাপ আর বড় সানগ্লাসের সাহায্যে ঢেকে দেয়া যাবে সব আঘাতের চিহ্ন… কিন্তু তাই বলে পুরোপুরি সুস্থ বলব না ওকে।

‘কী বলতে চান?’ ভুরু কোঁচকাল রানা।

জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লেন চক্রবর্তী। ‘কতটা জানো ওর সম্পর্কে?’

‘বলতে গেলে কিছুই না। মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়। কেন?’

‘তোমার জেনে রাখা দরকার, আজ যা ঘটেছে, সেটাই ওর প্রথম অভিজ্ঞতা নয়। পুরনো অত্যাচারের চিহ্ন দেখেছি আমি… কিছু কিছু অত্যন্ত সিভিয়ার।’

‘কী ধরনের চিহ্ন?’

‘সিগারেটের ছ্যাঁকা তো আছেই… আরও আছে বেশ কিছু কাটা দাগ—ওগুলোর প্রত্যেকটাই করা হয়েছে মেডিক্যাল ইকুইপমেন্টের সাহায্যে, খুবই পেশাদার ভঙ্গিতে, অল্প চেষ্টায় সর্বোচ্চ কষ্ট দেবার জন্য।’

‘কতদিনের পুরনো বলে মনে হয় আপনার?’

‘এক-দেড় বছর… তার বেশি না। কয়েক জায়গার টিস্যু এখনও নরম।’

‘কেন এসব করা হয়েছে, কিছু আন্দাজ করতে পারেন?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

সিগারেটে টান দেবার জন্য একটু বিরতি নিলেন চক্রবর্তী। তারপর বললেন, ‘এ-ধরনের পরিস্থিতিতে প্রলাপ বকে রোগী, মেয়েটার বেলাতেও তা-ই ঘটেছে। সেখান থেকেই কিছুটা আইডিয়া করেছি। বিপ্লব, আনুগত্য, আত্মত্যাগ… এসব হাবিজাবি বকছিল। আমার ধারণা, খুবই পরিকল্পিতভাবে ব্রেইনওয়াশ করা হয়েছে এর… কিংবা করার চেষ্টা চালানো হয়েছে।

চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল রানার। ‘ব্রিগাতিস্তি-রা তা হলে ব্রেইনওয়াশে বিশ্বাসী?’

কপালে ভাঁজ পড়ল ড. চক্রবর্তীর। ‘ব্রিগাতিস্তি? মানে রেড ব্রিগেডের সদস্যদের কথা বলছ?’

‘সরি, মনের কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ভুলে যান কী বলেছি, তাতে আপনারই মঙ্গল হবে।’

‘আমি নাহয় ভুলে গেলাম। কিন্তু তোমার বান্ধবীকে. এসব ভোলানো খুব কঠিন হবে। ওর মাথাভর্তি জঞ্জাল গিজগিজ করছে।

যতটা হোপলেস ভাবছেন, ততটা হয়তো নয়,’ বলল রানা। ‘ব্রিগেড ছেড়ে পালিয়ে এসেছে ও।’

‘পুরোপুরি সুস্থভাবে?’ জানতে চাইলেন চক্রবর্তী।

‘শারীরিকভাবে যতটা সম্ভব আর কী।’

‘তা হলে ও একটা ব্যতিক্রম।

‘ব্যতিক্রম হলেই ভাল। কারণ জ্ঞান ফেরার সঙ্গে সঙ্গে ওর সাথে কথা বলতে চাই আমি… খোলসের ভিতরে ফের ঢুকে পড়ার আগে। কিছু একটা লুকাচ্ছে ও, সেটা জানতে হবে আমাকে।’

‘আই সি,’ বললেন ড: চক্রবর্তী। ‘কিন্তু তোমাকে সতর্ক করে দেয়া দরকার, সাইকোলজিক্যালি অত্যন্ত নাজুক অবস্থাতে আছে মেয়েটা। দীর্ঘদিন টরচার চালানো হয়েছে ওর উপর, সেটা ভুলে যেয়ো না।’

‘অস্বীকার করছি না। কিন্তু ওর মুখ খোলানোর জন্য এর কোনও বিকল্প নেই আমার হাতে। আমার ধারণা, মেয়েটার দাদী ও ঠিক একই জিনিস চেয়েছিলেন। সেজন্যেই ওকে তুলে দিয়েছেন আমার হাতে…’ বলতে বলতে থেমে গেল রানা। ড. চক্রবর্তী ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে, কথাগুলোর অর্থ বুঝতে পারছেন না। পারার কথাও নয়। ‘সরি, আপনাকে সবকিছু জানানো সম্ভব নয় এ-মুহূর্তে,’ লজ্জিত গলায় বলল ও।

‘ইটস ওকে,’ মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন চক্রবর্তী। ‘মেডিক্যাল বিষয় ছাড়া অন্য কিছুতে আগ্রহ নেই আমার।’

এগজামিনেশন রুমের দরজা ফাঁক করে উঁকি দিলেন মিসেস চক্রবর্তী। জানালেন, ‘মেয়েটার জ্ঞান ফিরছে।’

‘যাও,’ রানাকে বললেন ডাক্তার। ‘বেশি চাপ দিয়ো না, এটুকুই আমার পরামর্শ।

.

আলতো হাতে সোনিয়ার গাল স্পর্শ করল রানা। ছোঁয়া পেতেই বালিশের উপর মাথা কাত করল মেয়েটা, ঠোটদুটো ফাঁক হলো, বেরিয়ে এল মৃদু গোঙানি। দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। সোনিয়া মাযোলা নামের এই অদ্ভুত তরুণীর রহস্য ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। শুরু থেকে দুর্ভেদ্য এক দেয়াল খাড়া করে রেখেছিল ও রানা-কুয়াশার সামনে, সেটা ভেদ করে উঁকি দেয়া যাচ্ছিল না। পাহাড়ের মাঝে অস্ত্রহাতে দাঁড়িয়ে থাকা সেই নির্ভীক মেয়ে, যার মধ্যে বিন্দুমাত্র রস-কষ লক্ষ্য করেনি; অথচ ট্রলারে উঠে সে-ই পরিণত হয়েছিল প্রাণচঞ্চল এক মানুষে। ইটালির মাটিতে পা দেবার পর আবার হারিয়ে গিয়েছিল চাঞ্চল্য। মেলানো যাচ্ছিল না এই আচরণের পার্থক্য। এখন বুঝতে পারছে, সাগরের বুকের ওই ট্রলার ছিল মেয়েটির জন্য একটা অভয়াশ্রয়, ওখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ মনে হয়েছিল ওর নিজেকে, তাই মেতে উঠেছিল হাসি-ঠাট্টায়। ঠিক যেমন কারাগারের চার দেয়ালের মাঝে বন্দি কয়েদি উপভোগ করার চেষ্টা করে মুক্ত বাতাসকে।

ক্ষত-বিক্ষত মনের মানুষ এভাবেই আচরণ করে। ক্ষতের স্বরূপ জানবার পরে আস্তে আস্তে সবই অনুধাবন করতে পারছে রানা। আর কী-ই বা আশা করা যায় সোনিয়ার কাছ থেকে। জীবনের সবচেয়ে নিচুস্তরে দীর্ঘ একটা সময় কাটিয়েছে বেচারি, পাগল যে হয়ে যায়নি, তা-ই চের

ধীরে ধীরে চোখ খুলল সোনিয়া। ভয়ার্ত ভঙ্গিতে চোখের পাতা পিটপিট করল কয়েকবার, ঠোঁট কাঁপল। কয়েক মুহূর্ত পর যেন চিনতে পারল রানাকে। ভয় মিলিয়ে গেল দৃষ্টি থেকে, আশ্বাস দেবার ভঙ্গিতে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিল রানা।

‘গ্রাৎসি!’ ফিসফিসাল সোনিয়া। ‘ধন্যবাদ, মসিয়ো রানা। ধন্যবাদ: ‘

ওর ঠোঁটের উপর একটা আঙুল রাখল রানা। নরম সুরে বলল, ‘ধন্যবাদ দেবার প্রয়োজন নেই। কী ধরনের অত্যাচার সয়েছ তুমি, তা শুনেছি আমি ডাক্তারের কাছে। এখন বাকিটা বলো। মার্সেইয়ে কী ঘটেছিল?’

দু’চোখে অশ্রু জমল সোনিয়ার। কেঁপে উঠল আবার। ‘না! ওসব জিজ্ঞেস কোরো না!’

‘প্লিজ… আমাকে সব জানতে হবে। ভয় নেই তোমার। আর কোনোদিন তোমাকে ছুঁতে পারবে না ওরা… আমি কথা দিচ্ছি।’

‘কী করে ওরা, তা তো দেখেছ। ওফ্, সেই কষ্ট….’

‘…আর কোনোদিন পেতে হবে না তোমাকে,’ সোনিয়ার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল রানা। রুমাল দিয়ে মুছে দিল চোখের পানি। ‘শোনো, তোমার অবস্থা আমি বুঝতে পেরেছি। কেন পালিয়ে গিয়েছিলে, কেন নিজেকে সভ্যজগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলে… সেসব জেনে গেছি। কিন্তু তুমি বুঝতে পারছ না, ওটা কোনও সমাধান নয়। পালিয়ে, স্বেচ্ছাবন্দির মত বেঁচে থেকে লাভ নেই কোনও। ওটাকে জীবন বলে না। তাই অনুরোধ করছি, সাহায্য করো আমাকে, যাতে ওই পিশাচদের ধ্বংস করে দিতে পারি। আর কিছুর জন্য না হোক, অন্তত প্রতিশোধের জন্য! যা করেছে ওরা তোমার সঙ্গে, তার শাস্তি দেবার জন্য হলেও জ্বলে ওঠো!’

রানার চোখে চোখ রেখে কয়েক মুহূর্ত নীরব রইল সোনিয়া, যেন বোঝার চেষ্টা করল ওকে। হঠাৎই সে টের পেল, সামনের এই যুবকটিকে বিশ্বাস করা যায়। চোখের মণিতে বাসা বেঁধেছে মায়া-মমতা আর আশ্বাস। মনের ভিতর অনুভব করল, এর উপর আস্থা রাখলে কখনও ঠুকতে হবে না। অদ্ভুত এক প্রেরণা অনুভব করল বুকের ভিতর

লম্বা করে শ্বাস ফেলল ও। বিছানায় উঠে বসে নিচু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কী জানতে চাও?’

মার্সেইয়ের ঘটনা,’ বলল রানা। ‘ওই ব্রিগাতিস্তি কীসের কথা বলছিল?’

কথা গুছিয়ে নেবার জন্য একটু অপেক্ষা করল সোনিয়া। তারপর বলতে শুরু করল, ড্রাগ চোরাচালানের কাজে নিয়োগ করা হয়েছিল আমাকে। কুরিয়ারের সঙ্গে যাবার কথা ছিল—তার হয়ে চারদিকে নজর রাখা, সেইসঙ্গে বেশ্যার মত লোকটার মনোরঞ্জন করার জন্য পাঠানো হয়েছিল আমাকে।’ একটু কেঁপে উঠল। ‘চোরাচালানের সময় এ-ধরনের মেয়েদের গুরুত্ব অনেক। দরকার হলে সরকারি লোকজনের কাছে ঘুষ হিসেবে পাঠানো যায় এদেরকে, ডিকয় হিসেবে ব্যবহার করা যায়… নজরদারির জন্যও এরা আদর্শ; কেউ সন্দেহ করতে পারে না। এসব কাজে ট্রেইনিং দেয়া হয়েছিল আমাকে। মুখ বুজে সব সহ্য করেছি; ব্রিগেডকে ভাবতে দিয়েছি; আমার মধ্যে কোনও ধরনের প্রতিরোধ অবশিষ্ট নেই। তাই শেষ পর্যন্ত ফিল্ডে পাঠানো হয় আমাকে। কুরিয়ার লোকটা ছিল এক জানোয়ার, আমাকে বিছানায় নেবার জন্য তর সইছিল না যেন তার। ল্য স্পেজিয়ার বন্দরে যাই আমরা, একটা ফ্রেইটারে চড়ি। ওটাতে করে মার্সেইয়ে যাবার কথা ছিল। জাহাজের নীচদিকের একটা স্টোরেজ রুমে থাকতে দেয়া হয় আমাদেরকে।

‘ওখানে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কুরিয়ার। জাহাজ ছাড়তে তখনও এক ঘণ্টা বাকি, ওকে অনুরোধ করলাম ততক্ষণ অপেক্ষা করতে; কিন্তু কে শোনে কার কথা। জামা-কাপড় ছিঁড়ে আমাকে উদোম করে ফেলল শয়তানটা, রেপ করার চেষ্টা করল। এমনিতেই তার সঙ্গে শুতাম, কিন্তু লোকটা ছিল স্যাডিস্ট, জোর খাটানো ছাড়া মজা পায় না। মেঝের উপর আমাকে ছুঁড়ে ফেলে চড়ে বসল আমার গায়ের উপর, শুরু করল চড়-থাপ্পড় আর ঘুসি। কী যে হয়ে গেল আমার ভিতর… বাধা দিলাম ওকে, তাতে আরও যেন খেপে গেল বদমাশটা। চালাল অকথ্য অত্যাচার। মনে হচ্ছিল বুঝি খুন করে ফেলবে আমাকে। মরিয়ার মত মেঝে হাতড়ালাম, হাতে পেয়ে গেলাম একটা ভাঙা কাঁচের টুকরো। লোকটা আমার শরীরের উপর উপুড় হতেই সেটা ঢুকিয়ে দিলাম তার পিঠে। চিৎকার দিয়ে আমার উপর থেকে সরে গেল সে। ততক্ষণে মাথা খারাপের মত হয়ে গেছে আমার, এলোপাতাড়ি কোপাতে শুরু করলাম ব্যাটাকে। যখন সংবিৎ ফিরল, তখন সর্বনাশ হয়ে গেছে। মরে গেছে লোকটা, তার রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে… মানুষ খুন করেছি আমি…’

ফুঁপিয়ে উঠল সোনিয়া। তাড়াতাড়ি ওকে জড়িয়ে ধরল রানা। বলল, শান্ত হও। যা করেছ, তা আত্মরক্ষার জন্য করেছ। মৃত্যুই প্রাপ্য ছিল লোকটার।

‘আ… আমি কোনও অন্যায় করিনি?’

‘না, একটুও না। আত্মগ্লানি থেকে বাঁচতে চাইলে এটাই প্রথমে বিশ্বাস করতে হবে তোমাকে। একজন মানুষের প্রাণ নিয়েছ তুমি, তবে সেটা নিতান্তই নিজের প্রাণ বাঁচানোর স্বার্থে। এটা একটা যুদ্ধ, সোনিয়া। হয় মারো, নয় মরো—এটাই যুদ্ধের নিয়ম।’

ওর দিকে মুখ তুলে তাকাল সোনিয়া। ‘তুমি এক অদ্ভুত মানুষ, রানা। অকাট্য যুক্তি দেখাচ্ছ… মনে হচ্ছে নিজের বেলাতেও খাটাও এই যুক্তি; কিন্তু গলার স্বর বলছে, যুক্তিটা সবসময় মানতে পারো না।‘

চুপ করে রইল রানা। কিন্তু মনে মনে স্বীকার করল, ভুল বলেনি মেয়েটা। বহু মানুষ মারা পড়েছে ওর হাতে, তাদের সবাই ছিল মন্দলোক, হত্যাগুলোও করতে হয়েছে পরিস্থিতির তাগিদে। কিন্তু মানুষের রক্তে হাত রাঙানোর গ্লানি কি দূর হয়েছে ওই যুক্তি দেখিয়ে? না, হয়নি। প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখে ও, মনকে পীড়া দেয় সেসব স্মৃতি। তবে তা সোনিয়াকে বলা চলে না।‘

‘আমার কথা বাদ দাও,’ বলল রানা, ‘এরপর কী ঘটল?’

‘কুরিয়ারকে খুন করার পরে?’

‘না। তোমাকে ধর্ষণ করতে আসা একটা পশুকে খুন করার পরে।’

কৃতজ্ঞতা ফুটল সোনিয়ার চোখে। বলল, ‘বুদ্ধি খাটালাম আমি। লোকটার পোশাক চড়ালাম নিজের গায়ে—ট্রাউজারের পা গুটিয়ে নিলাম, কোটের ভিতরে ভরে নিলাম নিজের জামা, চুল ঢাকলাম ওর টুপির ভিতরে। তখন রাত নেমে এসেছে, অন্ধকারে কেউ চিনতে পারল না আমাকে। বন্দরের শ্রমিকরা ফ্রেইটারে মালামাল ওঠাচ্ছিল, তাদের সঙ্গে মিশে নেমে গেলাম ডকে।’

‘চমৎকার!’ প্রশংসা করল রানা।

‘কাজটা কঠিন ছিল না, বলল সোনিয়া। ‘কঠিন ছিল ডকে পা ফেলার পরের মুহূর্তটা।’

‘কেন? কী ঘটেছিল?’

‘চিৎকার করতে ইচ্ছে হচ্ছিল। চেঁচিয়ে সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করছিল-আমি মুক্ত! খুব কষ্ট করে ঠেকিয়েছি নিজেকে। এরপরের অংশটা ছিল আরও সহজ। কুরিয়ারের কোটের পকেটে নগদ টাকা ছিল। বাসে চেপে চলে গিয়েছিলাম জেনোয়ায়। নতুন পোশাক আর বিমানের টিকেট কেটে পরদিন দুপুরেই পৌঁছে গিয়েছিলাম বাস্তিয়ায়… মানে কর্সিকায়।

‘ওখান থেকে পোর্তো ভেচিয়োয় চলে গিয়েছিলে?’

‘হ্যাঁ।’

‘তোমার দাদী জানতেন এসব ঘটনা?

কিছুটা। খারাপ অংশগুলো বলিনি ওঁকে। তবে সম্ভবত আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। আমি অবশ্য ওসব নিয়ে মাথা ঘামাইনি। মুক্তি পেয়েছিলাম, সেটাই ছিল আনন্দের ব্যাপার।

‘ওটাকে মুক্তি বলে না, সোনিয়া। সত্যি বলতে কী, একটা কারাগারে ঢুকেছিলে তুমি। চারপাশের পাহাড় ছিল সেই কারাগারের দেয়াল।’

মুখ ঘোরাল সোনিয়া। ‘তাতে কিছু যায়-আসে না। ওভাবে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারতাম আমি। ছোটবেলা থেকে ওই পাহাড় আর উপত্যকাকে ভালবেসেছি আমি।’

‘স্মৃতিগুলোই ধরে রাখো, রানা বলল। ‘আর কখনও ফিরে যেয়ো না ওখানে।’

ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকাল সোনিয়া। ‘তুমি তো বলেছিলে, একসময় ওখানে ফিরতে পারব আমি… যখন দাদীর খুনিরা শাস্তি পাবে!’

‘হয়তো। কিন্তু কবে নাগাদ তা ঘটবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। তার আগে ওখানে ফেরা উচিত হবে না তোমার। সবচেয়ে ভাল হয় যদি কখনোই না ফেরো।’

একটু থামল রানা। ভাবছে। রহস্য এখনও পুরোপুরি পরিষ্কার হয়নি। সোনিয়ার অতীত ইতিহাস সম্পর্কে জানা গেছে, কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হচ্ছে না ওর। মারিয়া মাযোলা নিশ্চয়ই আরও কিছু জানতেন… এমন কিছু, যা ওর তদন্তে সহায়ক হবে। সে-কারণেই সোনিয়াকে পাঠিয়েছেন ওর সঙ্গে। কী সেটা? মেয়েটাকে আরেকটু জিজ্ঞাসাবাদ করবে বলে ঠিক করল।

‘কিছু মনে কোরো না, আরও কিছু প্রশ্ন আছে আমার,’ বলল ও। ‘ড্রাগের চোরাচালান… ওটা ঠিক কীভাবে করা হয়? কুরিয়ারের কথা শুনলাম, সঙ্গে একটা মেয়ে থাকে…. ওরা কি কোনও কন্ট্যাক্টের সঙ্গে দেখা করে?’

‘হ্যাঁ,’ মাথা ঝাঁকাল সোনিয়া। ‘জায়গা আর সময় ঠিক করা থাকে। নির্দিষ্ট একটা পোশাকে মেয়েটাকে থাকতে হয় সেখানে। কন্ট্যাক্ট তার সঙ্গে দেখা করে। কুরিয়ার থাকে পিছনে, মেয়েটার দালাল সেজে। পুলিশ ধরলে এই কাভারই ব্যবহার করা হয়।’

‘তারমানে মেয়েটার মাধ্যমে যোগাযোগ রাখে কন্ট্যাক্ট আর কুরিয়ার। ড্রাগের ডেলিভারিও কি ওভাবেই সারা হয়?’

‘মনে হয় না। আমি তো সত্যিকারভাবে একবারও কাজটা করিনি, তবে যদ্দূর জানি— কন্ট্যাক্ট শুধু ডিস্ট্রিবিউশনের শিডিউল ঠিক করে। তার নির্দেশ অনুসারে সরবরাহকারীর কাছে যেতে হয় কুরিয়ারকে। এক্ষেত্রেও সঙ্গের মেয়েটাকে কাজে লাগানো হয়।’

‘তারমানে যদি কেউ গ্রেফতার হয়, বা ধরা পড়ে… সেটা হবে ওই মেয়ে?’

‘হুঁ। পতিতা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না পুলিশ। ধরা পড়লেও সহজেই তাকে ছাড়িয়ে আনা যায়।’

‘ভাল বুদ্ধি, মাথা দোলাল রানা। মেয়েটা ধরা পড়লেও কুরিয়ার নিরাপদ থাকছে। সরবরাহকারীর কাছে সে নিজেই যেতে পারবে।’:

একটু ভাবল ও। দেয়ালের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, কৌশলটার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু আছে কি না।

‘বেশিরভাগ ঝুঁকিই কমিয়ে আনা হয়,’ যোগ করল সোনিয়া। ড্রাগ আনা-নেয়ার প্রতিটা ধাপেই নিরাপত্তা বজায় রাখে ওরা… মানে, অমনটাই শুনেছি আমার সঙ্গের মেয়েদের মুখে।

‘ঝুঁকি কমিয়ে আনা হয়?’ ভুরু কোঁচকাল রানা।

‘হ্যাঁ। প্রতিটা ধাপেই ফেইল-সেফ সিস্টেম আছে… দরকার হলে মাল ফেলে দেয়া হবে, তাও আসল লোককে কিছুতেই ধরা পড়তে দেয়া হবে না। খুবই অর্গানাইজড ওরা.।’

একটু চমকে উঠল রানা। ধরতে পেরেছে রহস্য। ঝুঁকি কম, লাভ বেশি! এটাই একটা প্যাটার্ন। এই কৌশলেই কাজ করে ফেনিস!

‘সোনিয়া,’ জিজ্ঞেস করল ও, ‘এই কন্ট্যাক্টরা কোত্থেকে আসে?  কীভাবে ব্রিগেডের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওরা?’

‘তা আমার জানা নেই। তবে ড্রাগের ব্যবসা থেকে প্রচুর আয় করে ব্রিগেড। ওটাই ওদের আয়ের মূল উৎস। পুরো সংগঠন চলে ড্রাগ চোরাচালানের টাকা দিয়ে।’

‘শুরুতে নিশ্চয়ই এমন ছিল না? কবে থেকে শুরু হয়েছে এসব, তা বলতে পারো?’

‘কয়েক বছর আগে থেকে। ব্রিগেড যখন নতুন করে বিস্তার শুরু করল।’

‘বিস্তারটা সম্ভবত ওই ড্রাগের টাকা থেকে হয়েছে। কিন্তু সেটার শুরুটা কীভাবে হয়েছে?’

‘শোনা কথাই শুধু বলতে পারি তোমাকে। ইটালিয়ান জেলে বন্দি ছিল রেড ব্রিগেডের কিছু নেতা। তাদের সঙ্গে নাকি রহস্যময় এক লোক দেখা করে, প্রস্তাব দেয় ড্রাগের ব্যবসায় যোগ দেবার। যুক্তি দেখিয়েছিল, এতে ঝুঁকি কম… অন্তত কিডন্যাপিং আর চুরি-ডাকাতির চেয়ে কম তো বটেই। কিন্তু আয় অনেক।’

‘সোজা কথায়,’ বলল রানা, সশব্দে চিন্তা করছে, ‘ওদেরকে সহজ কায়দায় বড় ধরনের ফাইনান্স করতে চেয়েছে সে। দু’চারজন মানুষকে কাজে লাগালেই চোরাই ড্রাগ থেকে লাখ লাখ লিরা কামাই করা সম্ভব। ঝুঁকি কম, লাভ বেশি। খুব বেশি লোকবলেরও প্রয়োজন নেই।’

‘ঠিক ধরেছ,’ সোনিয়া বলল। ‘যতটুকু জানি, ড্রাগ জোগাড়ের সমস্ত কন্ট্যাক্ট ওই লোকের মাধ্যমেই আসে। ওর কারণেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পাচ্ছে রেড ব্রিগেড।’

‘আর সে-টাকায় নিজেদের আসল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে পারছে ওরা,’ চেহারায় কিছুটা রুক্ষতা ভর করল রানার। ‘প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে ভেঙে দেয়ার আন্দোলন— সোজা কথায় টেরোরিজম!’ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ও। ‘ওই লোকটা… ব্রিগেডের নেতাদের সঙ্গে যে দেখা করেছিল… সে কি এখনও যোগাযোগ রাখছে?’

কাঁধ ঝাঁকাল সোনিয়া। এবারও শোনা কথাই বলতে হবে। মাত্র দু’বার তাকে সামনাসামনি দেখেছে নেতারা, এরপর থেকে পালাক্রমে তার প্রতিনিধিরা যোগাযোগ রাখছে। তারাও কিছুদিন পর পর বদলে যায়।’

‘অবাক হচ্ছি না। অনুসরণ করবার মত নির্দিষ্ট কোনও সূত্র রাখা হচ্ছে না। এভাবেই কাজ করে ওরা।’

‘কারা?’

‘ফেনিস।’

বিস্মিত চোখে রানার দিকে তাকাল সোনিয়া। ‘এ-কথা কেন বলছ?’

‘কারণ এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা। সত্যিকার নারকোটিক্স ডিলার-রা কখনও রেড ব্রিগেডের মত উন্মাদদের সঙ্গে নিজেকে জড়াবে না। পুরোটাই আসলে একটা কন্ট্রোলড্ সিচুয়েশন, টেরোরিজমকে ফাইনান্স করার জন্য এক উপলক্ষ্য মাত্র। ইটালিতে রেড ব্রিগেড, জার্মানিতে বাদের-মেইনহফ, মধ্যপ্রাচ্যে আল-কায়েদা… একেক জায়গায় একেক পদ্ধতিতে টাকা জোগানো হচ্ছে, গোপনভাবে। এরা নিজেরাও সম্ভবত জানে না, দুনিয়ায় অরাজকতা ছড়ানোর জন্য ফেনিস ওদেরকে দাবার গুটির মত ব্যবহার করছে। যত দিন যাচ্ছে, ততই শক্তিশালী হচ্ছে সন্ত্রাসবাদীরা; তত বেশি ক্ষয়ক্ষতি মুক্ত পৃথিবীর।

রানার হাত আঁকড়ে ধরল সোনিয়া। মানে কী এর?’

‘পরিকল্পনা অনুসারে এগোচ্ছে ফেনিস, সনাতন সমাজ-ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে শুরু করেছে ধাপে ধাপে। কীভাবে সেটা করা হচ্ছে, তার একটা অংশ আমাকে দেখিয়ে দিয়েছ তুমি বাকিটা আন্দাজ করতে কষ্ট হচ্ছে না। গেরিলা যুদ্ধের কৌশল নিয়েছে ওরা। পুরো পৃথিবীকে ভাগ করেছে ছোট ছোট যুদ্ধক্ষেত্রে, একটা করে অপরাধী-দল সেসব যুদ্ধক্ষেত্রকে ধ্বংস করছে চোরাগোপ্তা হামলার মাধ্যমে। অবিশ্বাস্য!’

‘এ তো নতুন কিছু নয়,’ বলল সোনিয়া। ইন্টেলিজেন্সের সঙ্গে জড়িত তুমি। দুনিয়াজুড়ে সন্ত্রাসের ব্যাপারে আগে থেকেই নিশ্চয়ই আইডিয়া আছে তোমার?’

‘হ্যাঁ,’ বলল রানা, ‘কিন্তু সেসব যে এক সুতোয় গাঁথা, তা জানা ছিল না। পরিস্থিতি অত্যন্ত গুরুতর, সোনিয়া। সাধারণ কোনও অপরাধীর মোকাবেলা করছি না আমরা। এরা বিবেকহীন … সুসংগঠিত। কাজে লাগাচ্ছে ফ্যানাটিক আর উন্মাদদেরকে। যুক্তি মানবে না ওরা, কোনও প্রলোভনে কাজ হবে না! উদ্দেশ্য সফল না হওয়া পর্যন্ত থামবেও না কিছুতেই!’

এটুকু বলে থেমে গেল রানা। অন্ধকারে আলোর রেখা দেখতে পেয়েছে, আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে আসছে ফেনিসের ষড়যন্ত্রের স্বরূপ। কেন একই সঙ্গে অপরাধী-চক্র এবং সরকারি লোকজনকে হাতে রাখছে ওরা, তা বুঝতে পেরেছে। সন্ত্রাসী আর অপরাধীদের মাধ্যমে অরাজকতা সৃষ্টি করা হবে, বিপদে ফেলা হবে বিভিন্ন দেশের সরকারকে। শাসনযন্ত্রের শীর্ষপদে থাকা রাষ্ট্রনায়করা যখন অসহায় হয়ে পড়বেন, যখন ক্ষমতার পালাবদলের জন্য মুখর হয়ে উঠবে জনতা… তখুনি ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হবে ফেনিস কাউন্সিলের সদস্যরা। কাজটাতে তাদেরকে সাহায্য করবে সরকারি লোকেরাই। এভাবেই পৃথিবীর মালিক হবে তথাকথিত নীল রক্তধারী ফিনিক্স-রা-রাজনীতির লেবাস পরে!

সঙ্গিনীর দিকে ফিরল রানা। বলল, ‘আমি মত পাল্টেছি, সোনিয়া। তোমার সাহায্য চেয়েছিলাম আগে, কিন্তু এখন আর চাই না। অনেক ঝড়-ঝাপটা সয়েছ তুমি, এরপর তোমাকে আর বিপদের মাঝে টেনে আনা উচিত হবে না…’

‘তা-ই?’ একটা ভুরু একটু উঁচু করল সোনিয়া। ‘ব্যাপারটা এত সহজ? চাইলে… আর বাদ দিয়ে দিলে?’

‘কেন, তোমার পছন্দ হচ্ছে না সেটা?’

‘তোমার মত মানুষ আমি আগে কখনও দেখিনি, রানা, থমথমে গলায় বলল সোনিয়া। একটু যেন রেগে গেছে, দ্রুত ওঠানামা করছে চাদরে ঢাকা সুগঠিত বুক। মরা একটা মানুষের মাঝে প্রাণ ফিরিয়ে দিলে… তার বুকের ভিতর জাগিয়ে তুললে প্রতিশোধস্পৃহা; অথচ তারপরেই তাকে আবার বলছ সরে দাঁড়াতে!’

‘তোমার মঙ্গলের জন্য বলছি…’ বলার চেষ্টা করল রানা।

‘মঙ্গল!’ ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল সোনিয়া। আবার গা-ঢাকা দিতে হবে আমাকে। ফিরে যেতে হবে আতঙ্কের সেই জীবনে, প্রতিমুহূর্তে আঁতকে উঠতে হবে… এই বুঝি আমার নাগাল পেয়ে গেল খুনিরা! একে তুমি মঙ্গল বলছ? গতকাল তুমিই আমাকে কথা দিয়েছিলে, এসবের ইতি ঘটাবে; আজ সে-কথা ফিরিয়ে নিচ্ছ?’

‘না,’ রানা বলল। ‘তোমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা অবশ্যই করব আমি। টাকা-পয়সা, লুকানোর জায়গা… সবই ঠিক করে দেব। ব্রিগাতিস্তিরা কোনোদিনই আর খোঁজ পাবে না তোমার।’

‘তারপরেও সেটাকে মুক্তি বলা চলে না, রানা। না… যাব না আমি! খেয়ালখুশিমত আমাকে তাড়িয়ে দিতে পারো না তুমি—নিজের সুবিধের জন্য; কিংবা আমাকে করুণা দেখানোর জন্য!’ সোনিয়ার কর্সিকান চোখদুটো জ্বলছে। কী অধিকার আছে তোমার? কোথায় ছিলে তুমি, যখন দিনের পর দিন অকথ্য অত্যাচার চালানো হয়েছিল আমার উপর? ওসব আমি সয়েছি, তুমি নও। কাজেই প্রতিশোধ নেয়ার অধিকার আছে আমার। কেউ তাতে বাধা দিতে পারবে না। যদি দিতেই চাও, আমাকে খুন করতে হবে তোমাকে; কারণ কিছুই আর ঠেকাতে পারবে না আমাকে।’

‘এসব স্রেফ জেদের কথা, সোনিয়া,’ বোঝানোর চেষ্টা করল রানা। ‘বোকামি কোরো না, তুমি এখন মুক্ত। নিজেকে আবার জড়িয়ো না এসবের সঙ্গে।

‘বোকামি আমি করছি না, করছ তুমি! বহুদিন ছিলাম আমি ব্রিগেডের সঙ্গে, তোমাকে সাহায্য করবার মত যোগ্যতা আছে আমার। হতে পারো তুমি বিরাট কিছু, কিন্তু এদেশি সন্ত্রাসীরা কীভাবে কাজ করে, সে-ব্যাপারে আমার মত ইন-ডেপথ নলেজ তোমার নেই।’

‘আমি সরাসরি ব্রিগেডের পিছনে লাগতে যাচ্ছি না, সোনিয়া। ওদের কাজের ধারা জানবার কোনও প্রয়োজন নেই আমার।’

‘তবু আমি তোমার সঙ্গে থাকব। তার মূল্য চুকানোর জন্য যদি শরীর দিতে হয়, তাও দেব!’

থমকে গেল রানা। মেয়েটার কী মাথাই খারাপ হয়ে গেল? শান্ত গলায় ও জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি এত খেপেছ কেন, বলো তো?’

তুমিই আমাকে খেপিয়েছ, রানা। ভীরুর মত বেঁচেছি আমি এতদিন, কিন্তু তুমি আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছ, এভাবে বাঁচা অর্থহীন। অত্যাচারিত যদি মুখ বুজে থাকে, তা হলে আরও শক্তিশালী হতে থাকে অত্যাচারীরা।’

মনে হচ্ছে বড্ড ভুল করে ফেলেছি,’ বিড়বিড় করল রানা।

আরেকটা কারণ আছে,’ না শোনার ভান করে বলে চলল সোনিয়া। ‘আমাদের বিপ্লবকে তুমি ছোট করে দেখেছ, সেটাও মেনে নেয়া যায় না। কমিউনিজমের আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত সবাই মন্দ মানুষ নয়, রানা। পৃথিবীকে বদলে দিয়ে সত্যিকার অর্থে একটা সুন্দর সমাজ গড়তে চায়, এমন আদর্শবাদীর অভাব নেই বিপ্লবীদের মাঝে। ওদেরকে ম্যানিপুলেট করছে একদল ক্ষমতাবান মানুষ, ঠেলে দিচ্ছে সন্ত্রাসের পথে, সারা দুনিয়ার সামনে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে খুনি-উগ্রবাদী হিসেবে। তোমার ভাষায় ওরা ফেনিস কাউন্সিল, আর আমি বলব এটা পুঁজিবাদের আরেক শাখা ছাড়া আর কিছু নয়। সত্যিকার বিপ্লবী হিসেবে ওদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামার অধিকার আমার আছে!’

শান্তভাবে মেয়েটার মুখের ভাব যাচাই করল রানা, কোনও কৃত্রিমতা নেই তাতে। শব্দ করে শ্বাস ফেলে বলল, ‘তোমরা সবাই একরকম! ভাষণ দেয়ায় ওস্তাদ!’

হাসল সোনিয়া, শুকনো হাসি। অষণ ছাড়া আর কোনও হাতিয়ার তো নেই আমাদের হাতে।’ হাসিটা মুছে গেল, সেখানে ভর করল অদ্ভুত এক বেদনার ছাপ। ‘একটা ব্যাপার লক্ষ করেছি আমি,’ বলল ও।

‘কী?‘

‘তোমাকে। অনেক দুঃখ জমা আছে তোমার ভিতরে, সেটা মুখ দেখলেই বোঝা যায়। কারণ কী? নিজের পেশা… জীবন… এসব নিয়ে কি সুখী নও তুমি?’

‘এ-প্রশ্নের জবাব দেয়ার কোনও প্রয়োজন দেখছি না।’

‘প্রয়োজন আছে, রানা। হয়তো তোমার জন্য নেই, কিন্তু আমার জন্য আছে।’

‘কেন?’

‘শুধু আমার প্রাণ বাঁচাওনি তুমি, বেঁচে থাকার লক্ষ্যও ফিরিয়ে দিয়েছ। বিশ্বাস করবে কি না জানি না, কিন্তু সুখ অনুভব করছি আমি। জীবনটাকে আর মূল্যহীন বলে মনে হচ্ছে না। যে-মানুষ আমাকে এই অনুভূতি এনে দিল, তাকে আমি অসুখী দেখতে চাই না। আমারও একটা দায়িত্ব আছে তার প্রতি।’

ভুলে যাও ওসব। কঠিন এই জীবন… কঠিন এ পেশা আমি স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছি। এর জন্য যত দুঃখ-কষ্ট আসুক, তার দায় আমার… শুধুই আমার।’

‘কিন্তু আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই!’

‘প্রেম দিয়ে? ভালবাসা দিয়ে? তার কোনও দরকার নেই, সোনিয়া। সাহায্য যদি করতেই চাও, তা হলে ফেনিসকে ঠেকানোর কাজে সাহায্য করো।’

‘তারমানে আমাকে সঙ্গে রাখছ তুমি?’

হাসল রানা। উপায় কী? নিজেই তো বললে, প্রাণ থাকতে কিছুতেই পিছু হটবে না তুমি। তা ছাড়া… যে-কাজে নামছি, তাতে সঙ্গে একজন মেয়ে থাকলে মন্দ হয় না। জুটি হিসেবে কাভার মেইনটেন করা যাবে।’

খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল সোনিয়ার মুখ। ‘এখন কি তা হলে প্ল্যানটা খুলে বলা যায় আমাকে? রোমে কেন এসেছ তুমি? কী কাজ এখানে?’

‘কেন নয়?’ কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘বিয়াঞ্চি নামে একটা পরিবারকে খুঁজছি আমি।’

‘দাদীর দেয়া তালিকায় পেয়েছ এই নাম?

‘হুঁ। প্রথমটাই। সে-আমলে রোমে ছিল পরিবারটা।’

‘এখনও আছে,’ বলল সোনিয়া, ‘ঠিক রোমে নয়, তবে রোমের খুব কাছে থাকে ওই পরিবারের অন্তত একটা অংশ।‘

বিস্মিত হলো রানা। ‘তুমি কী করে জানো?’

‘রেড ব্রিগেডের কল্যাণে। বিয়াঞ্চি-পাভারোনি পরিবারের একটা ছেলেকে কিডন্যাপ করেছিল ওরা তিভোলির এক এস্টেট থেকে। ওর তর্জনী কেটে পাঠানো হয়েছিল মুক্তিপণের দাবির সঙ্গে। এই তো… খুব বেশি হলে বছরদুয়েক আগেকার কথা।’

আবছা আবছা মনে পড়ল রানার—পেপারে পড়েছিল এই ঘটনা। ইটালির এক ধনী পরিবারের ছেলেকে অপহরণ করেছিল দুষ্কৃতকারীরা, তবে শেষ পর্যন্ত মুক্তিপণ দেয়া হয়নি। টাকাপয়সা ছাড়াই তাকে ছেড়ে দিয়েছিল কিডন্যাপাররা। ব্যাপারটা বেশ রহস্যময় মনে হয়েছিল বলে এখনও ভুলে যায়নি। এরপর বেশ কিছুদিনের জন্য খুনখারাপি বেড়ে গিয়েছিল ইটালির আণ্ডারওয়ার্ল্ডে। বেশ কিছু ব্রিগাতিস্তি মারা পড়েছিল চোরাগোপ্তা হামলায়, সেই রহস্য ভেদ করতে সক্ষম হয়নি পুলিশ। তবে কি প্রতিশোধ নিয়েছিল ফেনিস? কাউন্সিল-সদস্যের আত্মীয়কে অপহরণ করায় খুন করেছিল ব্রিগেডের সদস্যদেরকে?

যত ভাবল, ততই বদ্ধমূল হলো ধারণাটা। হ্যাঁ, রেড ব্রিগেডের কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল ফেনিসের সঙ্গে। তার মূল্যও চুকাতে হয়েছে চরমভাবে। ওদেরকে কঠিন শিক্ষা দেয়া হয়েছে!

সোনিয়ার দিকে চোখ ফেরাল রানা। ‘ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলে তুমি?’

‘উঁহুঁ, আমি তখন মেডিসিনার ক্যাম্পে ছিলাম।’

‘আসলে কী ঘটেছিল, সে-ব্যাপারে কিছু শোনোনি?’

‘কানাঘুষো ছাড়া আর কিছু না। সবাই বলাবলি করছিল, ব্রিগেডের ভিতরে বেঈমানী করেছে কারা যেন। খুব শীঘ্রি তাদেরকে কঠিন সাজা দেয়া হবে, যাতে ভবিষ্যতে অমন দুঃসাহস না দেখায় কেউ। বিয়াঞ্চি-পাভারোনি কিডন্যাপিং নিয়ে খুব বিচলিত মনে হয়েছিল ওখানকার নেতাদেরকে। ওদেরকে বলতে শুনেছি, কাজটা নাকি আসলে ফ্যাসিস্টদের মদদে ঘটেছে।’

‘ফ্যাসিস্ট মানে?’

‘পুরনো এক ব্যাংকার… এককালে বিয়াঞ্চিদের হয়ে কাজ করত। লোকটা সম্ভবত জার্মান।’

‘ব্রিগেডের নাগাল পেল কীভাবে?’

টাকা থাকলে সবই সম্ভব।’

উঠে পড়ল রানা। বলল, ‘যত শীঘ্রি সম্ভব, কাজে নামতে হবে আমাদেরকে। তুমি কি এখন যেতে পারবে আমার সঙ্গে?’

‘নিশ্চয়ই,’ বলে বিছানা থেকে পা নামাল সোনিয়া। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। তাড়াতাড়ি ওকে ধরে ফেলল রানা। সময় দিল ব্যথাটা সয়ে নেবার জন্য। ‘ধন্যবাদ,’ মৃদু কণ্ঠে বলল মেয়েটা

ওকে আস্তে আস্তে দাঁড় করাল রানা। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘অসুবিধে হচ্ছে না তো? আরেকটু বিশ্রাম নেবে?’

জবাব না দিয়ে হাসল সোনিয়া। অত দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে। তোমার বন্ধুর কথা ভাবো। আমাকে কাজে লাগাতে চাইছ, সেটা ও কীভাবে নেবে?

ভালভাবেই নেবে। বিশেষ করে তোমার কাছ থেকে যা যা জানতে পেরেছি, সেগুলো যখন শুনবে। এর মধ্যে হেলসিঙ্কিতে পৌঁছে যাবার কথা কুয়াশার। খুব শীঘ্রি ওর সঙ্গে কথা বলব আমি এখন এসো, আমি তোমাকে পোশাক পরতে সাহায্য করছি।’

‘গতকাল যদি এ-কথা বলতে, কিছুতেই রাজি হতাম না আমি।’

‘আর এখন?’

‘হেল্প মি, রানা।’

(আগামী খণ্ডে সমাপ্য)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *