এগারো
খোলা জানালা দিয়ে ঊর্ধ্বাঙ্গের প্রায় পুরোটাই বের করে দিল কুয়াশা। শরীর ঘুরিয়ে মুখোমুখি হলো সামনের মার্সিডিজের, স্থির হাতে সিগ-সাওয়ার তাক করল ওটার দিকে। নিশানা ঠিক করেই গুলি ছুঁড়তে শুরু করল যন্ত্রের মত। এক সারিতে উইণ্ডশিল্ডের এক মাথা থেকে অন্যমাথা পর্যন্ত বুলেট ঢোকাচ্ছে।
ব্রেকে চাপ দিল মার্সিডিজের ড্রাইভার, বন বন করে হুইল ঘোরাল লাইন অভ ফায়ার থেকে সরে যাবার জন্যে, মাথাও নামিয়ে ফেলল। রিঅ্যাকশনটা যথেষ্ট দ্রুত হলো না, হাজারটা টুকরো হয়ে গেল উইণ্ডশিল্ডের কাঁচ, ছড়িয়ে পড়ল গাড়ির ভিতরে! দ্বিতীয় মার্সিডিজের ড্রাইভার ঠিক পিছনেই ছিল; সামনে কী ঘটছে, দেখতে পায়নি। প্রথম গাড়ির টেইললাইট হঠাৎ করে লাল হয়ে উঠতে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সে। পিছনে থেকে প্রথম মার্সিডিজকে ধাক্কা দেয়ার সময় অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, দেখল ধাক্কা খেয়ে ঘুরে যাচ্ছে গাড়িটা, চোখের পলকে উল্টো দিকে অর্থাৎ তার দিকে মুখ করল সেটা। থেমে গেল দুটো গাড়িই।
‘কাজ হয়েছে!’ খুশি-খুশি গলায় বলল কুয়াশা। শরীর ঢুকিয়ে নিল টয়োটার ভিতরে।
নির্বিকার রইল রানা। বলল, ‘শক্ত হোন, বাঁকের কাছে এসে পড়েছি।’
স্পিড কমাল ও, সরু একটা তুষার ঢাকা পথে ঘুরিয়ে নিল টয়োটাকে। পথটা আঁকাবাঁকা, একের পর এক সরু বাঁক, তারপর আবার চওড়া হয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছেছে পাহাড়ের চূড়ায়।
পিচ্ছিল, অমসৃণ পথ। ভারী গাড়িটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ইঞ্জিনের উপর খুব ধকল যাচ্ছে। স্প্রিংবহুল চেসিস ঝাঁকি খাচ্ছে অনবরত। একবার ডান, পরক্ষণে বামে কাত হয়ে পড়ছে টয়োটা, ঘন ঘন। হঠাৎ একবার প্রচণ্ড ঝাঁকি খেল গাড়ি, রানার মনে হলো চারটে চাকাই শূন্যে লাফ দিয়েছে। মাটিতে নামার পর একদিকে এত. বেশি কাত হয়ে গেল, প্রায় উল্টে যাচ্ছিল। ওদের ভাগ্যের জোরে সিধে হলো আবার। ছ’মিনিট পর জঙ্গলটাকে পিছনে ফেলে এল ওরা। রাস্তার দু’ধারে এখন বড়বড় বোল্ডার আর গভীর তুষার।
বনেটের ভিতর থেকে বাষ্প উঠছে, আগেই দেখেছে রানা। টেমপারেচার গজের কাঁটাও উঠে গেছে ‘হট’ লেখা ঘরে। ‘গাড়ির অবস্থা কাহিল, কুয়াশা, জানাল ও। ‘যে-কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে।’
আরও বড় বিপদ দেখা দিয়েছে,’ শুকনো গলায় বলল কুয়াশা। পিছনের বন্ধুরা ফিরে এসেছে।’
এত ব্যস্ত ছিল রানা, অনুসরণকারীদের খবর রাখার সময় পায়নি। দুর্ঘটনা সামলে নিয়ে দুটো মার্সিডিজই আবার নতুন উদ্যমে টয়োটাকে ধাওয়া শুরু করেছে। ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাবারও অবসর পেল না ও-এক ঝাঁক বুলেটের আঘাতে গুঁড়িয়ে গেল রিয়ার উইণ্ডো, সামনের উইণ্ডশিল্ড ফুটো করে বেরিয়ে গেল ঝাঁকটা। চোখের সামনে তিনটে ফুটো দেখতে পেল রানা, কিনারাগুলো এবড়োথেবড়ো।
‘ধ্যাৎ!’ বিরক্ত কণ্ঠে বলল কুয়াশা।
চুলের কাঁটার মত তীক্ষ্ণ একটা বাঁক নিল রানা, গাড়ি সিধে করার সময় চুরি করে তাকাল ধাওয়ারত মার্সিডিজগুলোর দিকে। দৃশ্যটার মধ্যে বিপদের উপাদান যথেষ্ট পরিমাণেই রয়েছে।
সামনের মার্সিডিজ এঁকেবেঁকে ছুটে আসছে। টয়োটার চাকা তুষারের ওপর গভীর গর্ত তৈরি করেছে, সেই গর্তের ফাঁদে পড়ার কোনও ইচ্ছে নেই ড্রাইভারের, উন্মাদের মত সারাক্ষণ হুইল ঘোরাচ্ছে সে। প্রতিটি বাঁকে পিছলে রাস্তা থেকে সরে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করছে না।
যা দেখল, মোটেও খুশি হতে পারল না রানা। মাঝখানের দূরত্ব দ্রুত কমছে। ওরা মাত্র পঞ্চাশ মিটার পিছনে। পছন্দ হলো না অটোমেটিক রাইফেল হাতে লোকটাকেও, সামনের মার্সিডিজের ভাঙা উইণ্ডশিল্ডের ফাঁক দিয়ে ব্যারেল বের করে ওদের দিকে লক্ষ্যস্থির করার চেষ্টা করছে সে।
‘গেট ডাউন!’ চেঁচাল রানা, হুইলের নীচে মাথা লুকাল, ড্যাশবোর্ডের কিনারা দিয়ে কোনও রকমে দেখতে পাচ্ছে সামনের রাস্তা।
কথাটা মুখ থেকে বেরুতে যা দেরি, টয়োটার গায়ে আঘাত করল এক ঝাঁক বুলেট। গাড়ির ট্রাঙ্কের ডালা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে উড়ে গেল। পরের ঝাঁকটা ফুটো করল ছাদকে। নিজের অজান্তেই মাথা আরও নামিয়ে নিল রানা। পিছনের দরজা থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল কব্জাগুলো, দরজাটাও উড়ে গেল বাতাসে, ডানা মেলে। একটা গাছের সাথে ঘষা খেলো টয়োটা। বৃষ্টির মত ঝরল কাঁচের টুকরো। গা জ্বালাপোড়া অনুভব করল রানা, উপলব্ধি করল—ভাঙা কাঁচের আঘাতে কেটে গেছে শরীরের বিভিন্ন জায়গা। কুয়াশারও একই দশা।
‘সবাই ঠিক আছেন?’ চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল ও।
আমাদের নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না,’ উত্তেজিত গলায় বলল, কুয়াশা। ‘ড্রাইভিঙে মন দাও।’
টয়োটার রেডিয়েটর থেকে বাষ্প এবার সশব্দ প্রতিবাদ জানাচ্ছে। ইঞ্জিনের শক্তি কমছে, টের পেল রানা। সামনে শেষ বাঁক, তারপর চূড়া। গাড়িটাকে ঘোরানোয় মন দিল ও। পিছনের বাম্পারে প্রায় সেঁটে আছে প্রতিপক্ষরা।
অতিরিক্ত উত্তাপে ইঞ্জিনের বেয়ারিংগুলো চিৎকার করছে। আরও এক ঝাঁক বুলেট বামদিকের পিছনের ফোর গুঁড়িয়ে দিল, চ্যাপ্টা করে দিল টায়ারটাকে। টয়োটার পিছনের অংশ রাস্তা থেকে নেমে যেতে চাইছে, ধরে রাখার জন্যে হুইলের সাথে যুদ্ধ করছে রানা। দু’পাশে অসংখ্য বোল্ডার, গাড়ি ধাক্কা খেলে ছাতু হয়ে যাবে আরোহীরা।
হুডের নীচ থেকে নীল ধোঁয়া বেরুতে দেখে রানা বুঝল, মারা যাচ্ছে টয়োটা। রাস্তার কিনারায় পড়ে থাকা একটা পাথরকে এড়াতে পারেনি ও, অয়েল প্যানে খোঁচা লাগায় গর্ত তৈরি হয়েছে, ইঞ্জিনের নীচ থেকে ঝর-ঝর করে ঝরছে তেল। অয়েল প্রেশার গজ দ্রুত শূন্যের ঘরে নেমে এল। পাহাড়চূড়ায় পৌছুনোর আশা ত্যাগ করাই ভাল।
পিছলানো চাকা নিয়ে সামনের মার্সিডিজ শেষ বাঁকটা ঘুরতে শুরু করল। টয়োটার হুইল শক্ত করে ধরে অনবরত ঘোরাচ্ছে রানা। ধাওয়ারত শত্রুদের চেহারায় উল্লাস কল্পনা করতে পারল ও, তারা বুঝে ফেলেছে পালানোর কোনও উপায় নেই শিকারের।
চারদিকে উদ্ভ্রান্তের মত তাকিয়ে আশ্রয়ের কোনও সন্ধান দেখল না রানা। পা সম্বল করে কোথাও বেশিদূর যাওয়ারও প্রশ্ন ওঠে না। রাস্তার একদিকে তুষার আর বোল্ডার, আরেকদিকে ঝপ্ করে নেমে গেছে গভীর খাদ, মাঝখানের সরু রাস্তায় আটকা পড়েছে ওরা। ইঞ্জিন অচল হয়ে পড়ছে, একেবারে দাঁড়িয়ে পড়ার আগেই ঘটে যাবে যা ঘটার।
মরিয়া হয়ে উঠল রানা, গায়ের জোরে যত দূর যায়, চেপে ধরল অ্যাকসেলারেটর, বিড়বিড় করে ডাকল সর্বশক্তিমানকে 1 প্রার্থনার জোরেই কি না কে জানে, হঠাৎ বদলে গেল ইঞ্জিনের আওয়াজ, সামনের চাকাগুলো দেবে গেল তুষারের ভিতর, পরমুহূর্তে ছেড়ে দেয়া স্প্রিঙের মত সামনে লাফ দিল টয়োটা, একবারের চেষ্টাতেই উঠে এল চূড়ায়।
পিছনে নীল ধোঁয়া আর সাদা বাষ্পের মেঘ উঠল, খোলা স্কি রান-এর মাথায় পৌঁছে গেছে ওরা। লক্ষ করল রানা, ওর দিকের ঢালটা রশি দিয়ে আলাদা করে রাখা হয়েছে। বিপজ্জনক বলে এদিকে কাউকে স্কি করতে নিষেধ করা হয়েছে, রশির সাথে ঝুলে থাকা রঙিন বোর্ডগুলোয় তাই লেখা।
‘রাস্তার এটাই শেষ মাথা,’ হতাশ কণ্ঠে বলল কুয়াশা।
উঁহু, রাস্তা এখনও আছে,’ আশ্চর্যরকম ঠাণ্ডা রানার কণ্ঠ। ঝট্ করে ওর দিকে তাকাল কুয়াশা। তারপরেই তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল। ‘তুমি কি ভাবছ… ইয়া মাবুদ, না!’
মার্সিডিজ দুটো পৌঁছে গেল, প্রতিপক্ষ থুতু ছুঁড়লেও ওদের গায়ে লাগবে। টয়োটার দু’পাশে চলে এসেছে প্রায়। হুইলে মোচড় দিল রানা, গাড়িটাকে নামিয়ে দিল স্কি-রানের বিপজ্জনক ঢালে।
জমাট বাঁধা শক্ত বরফের ওপর দিয়ে তীরবেগে নামতে শুরু করল টয়োটা, প্রতি মুহূর্তে আরও বাড়ছে গতি। হুইলটা আলতোভাবে ছুঁয়ে আছে রানা, প্রায় ঘোরাচ্ছেই না। ব্রেকের উপরেও কোনও চাপ দিচ্ছে না। একটু এদিক ওদিক হলেই চরকির মত ঘুরতে শুরু করবে টয়োটা। যদি আড়াআড়িভাবে পিছলাতে শুরু করে, অবধারিত পরিণতি হবে ঘন ঘন ডিগবাজি খাওয়া, পাহাড়ের গোড়ায় পৌঁছুবে কিছু ভাঙা হাড় আর লোহালক্কড়।
ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল টয়োটার আরোহীরা!
বুলেটে ঝাঁঝরা পিছনের চাকার রাবার খসে যাওয়ায় ভাগ্যকে ছোট্ট একটা ধন্যবাদ দিল রানা। চুপসে যাওয়া টায়ার থেকে মুক্ত হয়ে কাঠামোর জোড়া কিনারা বরফের গায়ে ভালভাবে কামড় বসাতে পারছে, ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য পাচ্ছে ও।
স্পিডোমিটারের কাঁটা সত্তরের ঘরে উঠে গেল। এই সময় তুষারের এক ঝাঁক অতিকায় স্তূপ ছুটে আসতে দেখল ও। আলতো স্পর্শে ট্রেইল থেকে সামান্য সরিয়ে দিল রানা গাড়িটাকে, চলে এল মসৃণ বরফে। আপনা থেকেই শরীরের পেশি শক্ত হয়ে গেল, ঝাঁকি খাবার জন্যে তৈরি! এক চুল এদিক-ওদিক হলে ছাতু হয়ে যাবে সবাই ওরা
একপাশে অনেকগুলো তুষার স্তূপ, আরেক পাশে সারি সারি গাছ, মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ। কোনোটার সাথে ঘষা লাগল না, সরু পথ ধরে পরিষ্কার বেরিয়ে এল টয়োটা। চওড়া, বাধাহীন ঢালে বেরিয়ে এসেই ঝট করে পিছন দিকে তাকাল রানা।
প্রথম মার্সিডিজের ড্রাইভার কাণ্ডজ্ঞানের চমৎকার পরিচয় দিল। স্তূপগুলোকে এড়াবার জন্যে টয়োটার ফেলে আসা চাকার দাগ অনুসরণ করল সে। দ্বিতায় মার্সিডিজের ড্রাইভার হয় ওগুলোকে দেখেনি, বা বিপজ্জনক বলে মনে করেনি নিজের ভুল বুঝতে পারল অনেক দেরিতে, ব্যস্ততার সাথে সংশোধনের জন্যে গাড়িটাকে ঘন ঘন ডানে বাঁয়ে ঘোরাল সে। এভাবে তিন কি চারটে স্তূপকে এড়াতে পারল লোকটা, তারপর একটার সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা খেলো। গাড়ির সামনের অংশ তুষারের ভিতরে ঢুকে গেল, উঁচু হলো পিছনটা। নব্বই ডিগ্রি কোণ সৃষ্টি করে ঝুলে থাকল সেটা। তারপর শুরু হলো ডিগবাজি খাওয়া। নিরেট বরফে পড়ল, খাড়া হলো, আবার পড়ল, আবার খাড়া হলো—প্রতিবার গাড়ি থেকে কিছু না কিছু ছিটকে পড়ছে, শুধু আরোহীরা বাদে, কারণ ডিগবাজি খাওয়ায় চ্যাপ্টা হয়ে গেছে বডি, জ্যাম হয়ে গেছে দরজা। গাড়ি থেকে ছিটকে পড়লে আরোহীরা হয়তো প্রাণে বেঁচে যেত।
মাউন্টিং থেকে ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল ইঞ্জিন, ছিটকে জঙ্গলের দিকে চলে গেল। চাকা, ফ্রন্ট সাসপেনশন, রিয়ার-ড্রাইভ ট্রেন, এক এক করে সবগুলো চেসিস থেকে বেরিয়ে ঢাল বেয়ে সবেগে নামতে শুরু করল।
‘একটা খতম!’ খুশি খুশি গলায় বলল কুয়াশা। ‘গুড জব, রানা।’
‘খুশি হবার কিছু নেই,’ দাঁতে দাঁত চেপে বলল রানা। ‘সামনে তাকান।
চমকে উঠল কুয়াশা। ট্রেইলে উঁচু হয়েছে একটা স্কি জাম্প, নেমেছে একশো মিটার দূরে। তুষার ঢাকা র্যাম্প ঠিক কোথায় পাহাড়ের গায়ে মিশেছে, দেখার অবসর নেই রানার। কোনোরকম ইতস্তত না করে স্টার্টিং ড্রপ-অফ-এর দিকে টয়োটার মুখ ঘোরাল ও।
‘লাফ দেবে, না?’ তাজ্জব কুয়াশা প্রশ্ন করল।
‘শক্ত হয়ে বসুন। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারি।’
‘আছে নাকি যে হারাবে?
কমপিটিশনের জন্যে যে ধরনের কাঠামো তৈরি করা হয়, এটা তার চেয়ে অনেক ছোট। তবে র্যাম্পটা টয়োটাকে ধারণ করার জন্যে যথেষ্ট চওড়া, খানিকটা জায়গা পড়েও থাকবে। ক্রমশ উঁচু হয়েছে ঢালটা, তারপর সমতল খানিকটা বিস্তৃতি, সবশেষে দেবে গেছে র্যাম্প, ত্রিশ মিটার এগিয়ে গ্রাউণ্ড-এর বিশ মিটার উপরে হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেছে।
স্টার্টিং গেটের দিকে গাড়ি তাক করল রানা, টয়োটার চওড়া বডির আড়ালে লুকিয়ে রাখল স্কি-জাম্প। সাফল্য নির্ভর করছে সময়জ্ঞান আর প্রয়োজন মত স্টিয়ারিং হুইল ঘোরানোর উপর।
একেবারে শেষ মুহূর্তে, সামনের চাকা স্টার্টিং লাইন পেরোবার আগেই, স্টিয়ারিং হুইলে মোচড় দিল রানা। টয়োটার পিছনটা ঘুরে গেল, চরকির মত পাক খেতে শুরু করে র্যাম্পটাকে এড়িয়ে গেল গাড়ি। টয়োটার আকস্মিক অস্থিরতা লক্ষ করে ঘাবড়ে গেল মার্সিডিজের ড্রাইভার, সংঘর্ষ এড়াবার জন্যে সরলরেখা থেকে সরিয়ে নিল গাড়িকে, স্টার্টিং গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকল নিখুঁতভাবে।
টয়োটাকে সোজা পথে ফিরিয়ে আনার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছে রানা, ঘাড় ফিরিয়ে মার্সিডিজের দিকে তাকাল কুয়াশা। সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কিনারা থেকে নেমে গেল গাড়িটা। মুহূর্তের জন্যে সেটাকে আকাশের গায়ে ডানাবিহীন মোটাসোটা একটা পাখির মত লাগল। র্যাম্পের কিনারা ছাড়ার মুহূর্তে ঘণ্টায় একশো বিশ কিলোমিটার বেগে ছুটছিল ওটা। নীচে পড়ে প্রথমে ওটা চ্যাপ্টা হলো, তারপর গড়িয়ে নামার সময় খুলে খুলে পড়ল একেকটা পার্টস্। পাইন গাছের সারিতে ধাক্কা খাওয়ার আগেই আরোহীরা সবাই ভর্তা হয়ে গেছে।
‘বড় বেশি ঝুঁকি নিয়েছ,’ বলল কুয়াশা। ‘আরেকটু হলে আমরাও আকাশে উড়তাম!’
‘এত ভয় পেলে চলে?’ এই প্রথমবারের মত হালকা হাসি ফুটল রানার ঠোঁটে
র্যাম্প থেকে স্কি-রিসোর্টের বিল্ডিংগুলোর দূরত্ব বেশি নয়। রাতের বেলা বলে স্কিয়ার নেই, তবে রিসোর্টে নাইট শিফটের কর্মচারী আর সিকিউরিট গার্ডেরা আছে। অ্যাকসিডেন্টের আওয়াজ শুনে ছুটে আসতে দেখা গেল ওদেরকে।
টয়োটার হেডলাইট নিভিয়ে দিল রানা। মানুষগুলোর দৃষ্টি এড়িয়ে ভিন্ন একটা পথে রিসোর্টের পার্কিং লটে নিয়ে গেল ভগ্নপ্রায় গাড়িটাকে এবং তিন মিনিটের মধ্যে ওখান থেকে একটা ভ্যান চুরি করল। সবাই দুর্ঘটনায় আহতদের সাহায্য করতে চলে গেছে, কাজটাতে বাগড়া দেবার মত কেউ আর নেই। ভ্যানে করে অ্যাডমিরালকে নিয়ে নিকটস্থ হাসপাতালে পৌঁছুতে লাগল মাত্র দশ মিনিট।
ইমার্জেন্সির নার্সেরা যখন নুমা চিফকে স্ট্রেচারে তুলে তাড়াহুড়ো করে ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে; তখন চার্লির হাত টেনে ধরল রানা। বলল, ‘আমরা আর যেতে পারব না ওখানে। তুমি বাকিটা সামলাতে পারবে তো?’
‘নিশ্চয়ই!’ বলল শোফার। ‘ধন্যবাদ, মি. রানা। আপনি আর আপনার বন্ধু আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন। সম্ভবত অ্যাডমিরালেরও।’
‘তা-ই যেন হয়,’ বিড়বিড় করল রানা। অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় মুখ শুকিয়ে গেছে। ‘তুমি যাও।’
হাত মিলিয়ে হাসপাতালের ভিতর চলে গেল চার্লি।
‘ডাক্তাররা কতদূর কী করতে পারবে, জানি না,’ বলল কুয়াশা। কিন্তু ওখানে ভদ্রলোক নিরাপদ নন। খুনিরা এ-পর্যন্ত চলে আসতে পারে।’
‘জানি,’ বলল রানা। পকেট থেকে সেলফোন বের করে ডায়াল করল নুমার ডেপুটি চিফ জর্জ রেডক্লিফের নাম্বারে। সংক্ষেপে জানাল কী ঘটেছে। শেষে যোগ করল, ‘অ্যাডমিরালকে সরিয়ে নিতে হবে আপনার…. গোপন কোনও জায়গায়, কাকপক্ষীও যেন টের না পায় সেটা কোথায়।
‘আমি এখুনি ব্যবস্থা নিচ্ছি, রানা,’ বললেন রেডক্লিফ। দশ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালে আমাদের নিজস্ব সিকিউরিটি পৌঁছুবে। অ্যাডমিরালের দায়িত্ব এখন আমার। তুমি শুধু খুঁজে বের করো, এসব কারা ঘটালো।’
‘আমি কথা দিচ্ছি, মি. রেডক্লিফ, প্রতিশোধ নেব এর। বিদায়।’
হাসপাতালের সামনে থেকে সরে এল রানা-কুয়াশা। ভ্যানে চড়ে ফিরে চলল ওদের কেবিনের দিকে। অনেকক্ষণ কোনও কথা হলো না দু’জনের মাঝে। শেষে নীরবতা ভেঙে কুয়াশা বলল, আমি বুঝতে পারছি না, ওরা আমাদের খোঁজ পেল কীভাবে? অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের কাছ থেকে আমাদের খবর ফাঁস হবে না বলে গ্যারান্টি দিয়েছিলে তুমি!’
‘তা হয়ওনি,’ বলল রানা। ওঁর গাড়িতে সম্ভবত হোমি ডিভাইস ফিট করে রেখেছিল ওরা। অ্যাডমিরালের পিছু পিছু যেভাবে হাজির হলো, তাতে অমনটাই মনে হয়। ফেনিসের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছেন আজ সারাদিন, নিশ্চয়ই নজরে পড়ে গেছেন ওদের। ওরা তাই ডিভাইস লাগিয়ে রেখেছিল লিমাজিনে।’
‘হোমিং ডিভাইস! তুমি দেখেছ?’
‘খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সময় তো পেলাম না!’
‘আর কোনও ব্যাখ্যা থাকতে পারে না?’ বাঁকা সুরে বলল কুয়াশা। ‘যন্ত্রের বদলে কাজটা তো মানুষেরও হতে পারে।’
‘নিজের উপর গুলি চালানোর জন্য বুঝি খুনিদেরকে ডেকে এনেছেন অ্যাডমিরাল? ওদের এক নম্বর টার্গেট ছিলেন উনি, লক্ষ করেননি?’
‘অ্যাডমিরাল না, ওঁর শোফারের কথা বলছি আমি। একটা গুলিও লাগেনি ওর গায়ে। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক না?’
‘গুলি আমাদের গায়েও লাগেনি,’ যুক্তি দেখাল রানা। ‘ওটা স্রেফ ভাগ্যের ব্যাপার। খামোকা চার্লিকে সন্দেহ করার কোনও মানে হয় না। ও অ্যাডমিরালের অনেক পুরনো লোক।
‘কী জানি, আমার মনটা খুঁতখুঁত করছে।’
‘অবাক হচ্ছি না। কাউকেই বিশ্বাস করেন না আপনি।’
‘সেজন্যেই আজও বেঁচে আছি,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল কুয়াশা ‘যাক গে, অ্যাডমিরালের পিছনে যেভাবে লেগেছিল ওরা, তাতে তো মনে হলো উনি কোনও গোপন খবর জেনে গেছেন তোমাকে বলতে পেরেছেন কিছু?’
‘ফেনিসের সঙ্গে কানেকশন থাকতে পারে, এমন দু’জন সন্দেহজনক লোকের নাম বলতে চেয়েছিলেন। পেরে ওঠেননি।’
‘তারমানে আমেরিকায় কোনও ক্লু পাবার সম্ভাবনা শেষ। কর্সিকাতেই যেতে হবে আমাদের।
‘হুঁ, আর কোনও পথ নেই।’ মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘যেখানে ফেনিসের শুরু, সেখান থেকেই শুরু করতে হবে তদন্ত। যাব আমরা কর্সিকায়, তবে একসঙ্গে নয়। একসঙ্গে থাকলে ঝুঁকি বাড়বে। দু’দিকে ছড়িয়ে পড়লে আমাদেরকে ট্র্যাক করা কঠিন হয়ে যাবে শত্রুদের জন্য।
‘ভাল প্রস্তাব,’ সায় দিল কুয়াশা।
‘কর্সিকার ঠিক কোথায় যেতে হবে, তা জানেন?’
দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে, পোর্তো ভেচিয়োর সামান্য উত্তরে খোঁজ নিয়েছি আমি… ওখানেই কাউণ্ট গিলবার্তো বারেমির জমিদারি ছিল।’
‘ঠিক আছে। ওখানেই আবার মিলিত হব আমরা-আজ থেকে তিন-চারদিন পর… নির্ভর করছে ঘুরপথে কর্সিকায় পৌঁছুতে কতটা সময় লাগবে, তার ওপর। যে-ই ওখানে আগে পৌঁছাক, স্থানীয় যে-কোনও সরাইখানায় উঠবে। তা হলে অন্যজন সহজে খুঁজে নিতে পারবে তাকে। কী বলেন?’
‘আমার কোনও আপত্তি নেই।’ :
‘আমেরিকা থেকে বেরুবার সমস্ত ব্যবস্থা আছে তো আপনার? নাকি সাহায্য লাগবে?’
‘না, সেটা দরকার নেই,’ বলল কুয়াশা। ‘ওসব অ্যারেঞ্জমেন্ট করাই আছে আমার। তোমারও নিশ্চয়ই আছে।’
‘হ্যাঁ।’
আবার নীরবতা নেমে এল ভ্যানের ভিতর।
‘রানা,’ হঠাৎ বলল কুয়াশা, ‘এই প্রথম তোমাকে ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াস হতে দেখছি আমি।’
‘না হয়ে উপায় নেই, কুয়াশা,’ শান্ত গলায় বলল রানা। ‘অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনকে খুন করার চেষ্টা করেছে ফেনিস… আমার পিতৃসম একজন মানুষকে! এরপর আর চুপ করে থাকা যায় না।’
‘ড. ইভানোভিচ-ও অমনই একজন মানুষ ছিলেন আমার কাছে,’ কুয়াশা বলল। আশা করি আমার আবেগটা এবার তুমি বুঝতে পারছ?’
‘পারছি। মস্ত ভুল করেছে ওরা, তার উপযুক্ত প্রতিফলও পাবে। আসুন প্রতিজ্ঞা করি, ওদেরকে জড়-সহ উপড়ে ফেলব আমরা… আপনি আর আমি!’
রানার কাঁধে হাত রাখল কুয়াশা। ‘ঠিক এই কথাটা ভেবেই তোমার সাহায্য চেয়েছি আমি। আমার জগতে স্বাগতম, রানা।’