সেই কুয়াশা ১.২

দুই

‘ইলিয়া ইভানোভিচ!’ বিছানার পাশ থেকে তীক্ষ্ণকণ্ঠে ডেকে উঠলেন বৃদ্ধা মহিলাটি, হাতে একটা ব্রেকফাস্ট ট্রে ধরে রেখেছেন। ‘তুমি এখনও ঘুমাচ্ছ? সেই কখন থেকে ডাকছি… ওঠো বলছি! নইলে কিন্তু মাথায় পানি ঢেলে দেব!’

বালিশে মুখ গুঁজে রেখেছিলেন ড. ইভানোভিচ, স্ত্রী-র ধমকে চিৎ হলেন। আস্তে আস্তে খুললেন চোখ। গোঙানির মত শব্দ করে বললেন, ‘সাতসকালে যন্ত্রণা না করলে হয় না? ছুটি কাটাতে এসেছি এখানে, তোমার রুটিন ফলো করবার জন্য না। ওফ্, মাথাটা ঝিমঝিম করছে।’

‘মাথা ঝিমঝিম করছে নিজেরই দোষে, কাল রাতে অত মদ গিলতে কে বলেছিল? আরেকটু হলে তো লাইটার দিয়ে সিগারেটের বদলে নিজের দাড়িই জ্বালিয়ে দিচ্ছিলে!’

‘হুম! মনে পড়েছে, ইউরি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমার উপর।’ দাড়িতে হাত বোলালেন ইভানোভিচ। একটু উঁচু হয়ে খাটের ব্যাকরেস্টে হেলান দিয়ে বসলেন।

বেডসাইড টেবিলে ট্রে নামিয়ে রাখলেন মিসেস ইভানোভিচ। স্বামীর পাশে বসে বললেন, ‘কপাল ভাল, আমাদের ছেলে তোমার মত কৌতূহলী স্বভাবের হয়নি। তা হলে গালে হাত দিয়ে দেখতে বসে যেত, দাড়িতে আগুন লাগলে কী হয়।’

হেসে ফেললেন ইভানোভিচ। হ্যাঁ, কপাল ভাল বটে। বিজ্ঞানী না হয়ে আমাদের ছেলে সৈনিক হয়েছে।

‘ওঠো এখন। বাইরে কী সুন্দর রোদ উঠেছে… এমন সকালে কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকার কোনও মানে হয় না। নাশতা করে নাও, তারপর আমরা একটু বারান্দায় বসব।’

জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন ইভানোভিচ। হ্যাঁ, সকালটা সত্যিই সুন্দর। বাড়ির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা গাছপালার মাথায় জমে থাকা বরফের মুকুট গলে গলে পড়ছে। দেখতে ভারি ভাল লাগছে।

‘একটা সিগারেট দেবে?’ বললেন তিনি I

‘জুস খাবার আগে না,’ হাত বাড়িয়ে ট্রে থেকে একটা গ্লাস তুলে নিলেন মিসেস ইভানোভিচ। ‘ফ্রিজ-ভর্তি ফলের জুস… কে খাবে ওসব? ইউরি তো তা করছে; বলছে ওগুলো নাকি তোমার দাড়ির আগুন নেভানোর জন্য জমা করেছি।’

‘ছেলে তোমার ভালই রসিক হয়েছে,’ বললেন ইভানোভিচ। তারপর অনুনয় করলেন, ‘প্লিজ, ডার্লিং। একটা সিগারেট… তুমিই নাহয় ধরিয়ে দাও! কথা দিচ্ছি, লাঞ্চের আগে আর চাইব না।

‘তোমাকে নিয়ে আর পারি না!’ বিরক্ত গলায় বললেন মিসেস ইভানোভিচ। তবে ঝুঁকে বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন। একটা সিগারেট গুঁজে দিলেন স্বামীর ঠোঁটে। লাইটার উঁচু করে বললেন, ‘আগুন জ্বালার সময় আবার শ্বাস ছেড়ো না, কাল রাতের অ্যালকোহল তোমার ফুসফুসেও পৌঁছে গেছে বলে আমার ধারণা। শেষে জ্বলেপুড়ে মরবে। রাশার শ্রেষ্ঠ নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্টকে খুন করার অভিযোগে জেলে যেতে হবে আমাকে।’

স্ত্রী-র টিটকিরি শুনে মুখ বাঁকালেন ইভানোভিচ। আমি মরলেও আমার কাজ থেমে থাকবে না। নাহয় পুড়লামই সিগারেটের আগুনে। লাইটার জ্বলে উঠলে সিগারেট ধরালেন। আয়েশ করে তাতে টান দিয়ে ভক ভক করে ধোঁয়া ছাড়লেন। বললেন, ‘তোমার ছেলে কোথায়?’

‘রাইফেল পরিষ্কার করছে। অতিথিরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এসে যাবে বলে শুনেছি। দুপুরে শিকারে যাবার কথা।’

‘ওফো, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম,’ ঝট্ করে পিঠ খাড়া করলেন ইভানোভিচ। একটু করুণ মুখভঙ্গি ফুটল তাঁর চেহারায়। ‘আচ্ছা, আমাকে কি যেতেই হবে?’

‘ছেলের পার্টনার হয়েছ, না গেলে চলবে কেমন করে? সেদিন ডিনারের সময় সবার সামনে তো খুব বড়াই করলে, বাপ-ব্যাটা মিলে সবচেয়ে বড় শিকারটা ঘরে আনবে। এখন কথা ঘোরাতে পারবে?’

‘বড়াই না, আসলে কথাটা, বলেছি বিবেকের দংশনে…. ইউরিকে খুশি করবার জন্য। ছেলেটা বড় হবার সময় আমাকে একেবারেই কাছে পায়নি। সারাজীবন তো আমাকে ল্যাবরেটরিতে মুখ গোঁজা অবস্থায় দেখেছে।

একটু হাসলেন মিসেস ইভানোভিচ। ‘এখন সময় তার প্রায়শ্চিত্ত করবার। তা ছাড়া… খোলা বাতাসে একটু ঘোরাঘুরি করলে সেটা তোমার শরীরের জন্যও ভাল হবে। তাড়াতাড়ি সিগারেট আর নাশতা সেরে নাও। তারপর তৈরি হও শিকারে যাবার জন্য।’

স্ত্রীর হাতে হাত রাখলেন বৃদ্ধ বিজ্ঞানী। ‘হ্যাঁ, এখন মনে হচ্ছে সত্যিই ছুটিতে এসেছি। শেষ কবে তোমাদেরকে নিয়ে কোথাও গেছি, তা মনে পড়ে না।

‘পড়ে না, তার কারণ যাওনি কখনও। তবে তা নিয়ে আমার কোনও অভিযোগ নেই। তোমার মত কর্মঠ মানুষ আমি আর কোথাও দেখিনি।’

কাঁধ ঝাঁকালেন ইভানোভিচ। ‘রাশান আর্মিকে ধন্যবাদ, আমার ছেলেকে শেষ পর্যন্ত ছুটি দিয়েছে।’

‘ও-ই তো ছুটির দরখাস্ত করেছে। তোমার সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটাবার ইচ্ছে ওর।’

‘খুব ভাল। ইউরিকে আমি ভালবাসি। কিন্তু… ওর সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানি না আমি।‘

‘খুব ভাল অফিসার… সবার মুখে তা-ই শুনেছি। ওকে নিয়ে

তোমার গর্ববোধ করা উচিত।’

‘করি না কে বলল? সমস্যা হলো, তেমন কোনও মিল নেই আমাদের মধ্যে। কী নিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলব, তা বুঝি না।’

‘অবাক হচ্ছি না। গত দু’বছরে তোমাদের তো বলতে গেলে দেখাই হয়নি।

ব্যস্ত ছিলাম আমি। কাজে ডুবে গেলে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই… এ-কথা সবাই জানে।’

‘সেসব পুরনো কথা, স্বামীর কাঁধে হাত রাখলেন মিসেস ইভানোভিচ। কিন্তু এখন কোনও কাজ নেই তোমার, আগামী তিন সপ্তাহের জন্য তুমি স্রেফ একজন বাবা এবং স্বামী। পরিবারকে সময় দেবে। প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে যেয়ো না। তাড়াতাড়ি বিছানা ছাড়ো। শিকারে গিয়ে ছেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলবে তুমি।’

‘হাহ্, শিকার! ছেলে আবার ফায়ারিং দেখে খেপে যায় কিনা ভাবছি। গত বিশ বছরে বন্দুক ছুঁয়ে দেখিনি।

‘যা-ই করো, ইউরি কিছুই মনে করবে না,’ নরম গলায় বললেন মিসেস ইভানোভিচ। ‘তোমাকে এতদিন পর কাছে পাচ্ছে, এটাই ওর জন্য সবচেয়ে বড় ব্যাপার।’

.

পুরু তুষার মাড়িয়ে পুরনো আস্তাবলের কাছে পৌছুল লেফটেন্যান্ট ইউরি ইভানোভিচ। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল তিনতলা উঁচু মূল খামারবাড়ির দিকে। সকালের উজ্জ্বল রোদে ঝলমল করছে অ্যাল্যাব্যাস্টারের তৈরি প্রাচীন প্রাসাদোপম বাড়িটা। ঘন গাছপালা আর তুষারের চাদরের মাঝে মাথা উঁচু করে সদম্ভে দাঁড়িয়ে আছে ওটা—-এমন একটা সময়ের প্রতীক হয়ে, যা বহু আগেই পেরিয়ে গেছে।

বিখ্যাত পিতার সন্তান সে। দ্য গ্রেট ইলিয়া ইভানোভিচ বলে সবাই চেনে ওর বাবাকে। পশ্চিমা দুনিয়ার বড় বড় নেতারা এই দুর্দান্ত মেধাবী মানুষটিকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন, তাঁকে ভয় করেন। বলা হয়ে থাকে, মাথার ভিতর সবসময় অন্তত দশ রকম নিউক্লিয়ার ওয়েপনের ডিজাইন নিয়ে ঘোরেন তিনি। একটা মিউনিশন ডিপোতে কয়েক ঘণ্টা কাটাতে দিলেই ইভানোভিচ এমন যে-কোনও বোমা তৈরি করে ফেলতে পারবেন, যা দিয়ে গোটা লণ্ডন, কিংবা ওয়াশিংটনকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া যাবে।

এমনই মানুষ ইলিয়া ইভানোভিচ। সমালোচনা, কিংবা সাধারণ আইনকানুনের ঊর্ধ্বে। আমলাতন্ত্র আমলাতন্ত্র এবং সনাতন রাজনীতির ঘোর বিরোধী, প্রকাশ্যে এমন সব বক্তব্য দেন, যাতে ঝড় ওঠে পুরো দেশে। কিন্তু তারপরেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেবার সাহস পায় না সরকার। এমন জিনিয়াসকে খেপিয়ে দিলে তাতে গোটা রাশার পায়েই কুড়াল মারা হবে।

এ-কারণে সবাই ড. ইভানোভিচের সঙ্গে সখ্য গড়তে চায়। তাঁর সঙ্গে পরিচয় কিংবা ঘনিষ্ঠতা গড়ে আইনের হাত থেকে কিছুটা বাঁচার জন্য একটা ঢাল পাবার চেষ্টা আর কী। এমনিতে এসব সুযোগসন্ধানীদেরকে খুব একটা পাত্তা দেন না ইভানোভিচ, কিন্তু মাঝে মাঝে তার ব্যতিক্রম না ঘটিয়ে উপায়ও থাকে না।

আজ তেমনই একটা দিন। যে-দুই অতিথি ড. ইভানোভিচের খামারবাড়িতে আসছেন, তাঁরা বলতে গেলে জোর করেই নিমন্ত্রণ আদায় করেছেন। একজন হলেন ভিলনিয়াসে ইউরির ব্যাটালিয়নের কমাণ্ডার, অন্যজনের পরিচয় জানা নেই ওর। শুধু শুনেছে, কমাণ্ডারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তিনি, মস্কো থেকে আসছেন ইউরির ক্যারিয়ারকে তুঙ্গে নিয়ে যাবার ক্ষমতা নাকি তাঁর আছে। কথাটা ভাল লাগেনি তরুণ লেফটেন্যান্টের। পিতার পরিচয়ে, কিংবা প্রভাবের জোরে নয়, নিজের যোগ্যতায় জীবনের প্রতিটি ধাপ অতিক্রম করতে চায় ও। সন্দেহ নেই, ওর ক্যারিয়ারের কথা ভেবে দুই অতিথিকে আপ্যায়ন করতে রাজি হয়েছেন ড. ইভানোভিচ—সেটা ইউরির জন্য আরও বিব্রতকর ব্যাপার। ইচ্ছে হয়েছিল মানা করে দেবার জন্য বাবাকে বলতে। কিন্তু পারেনি ওর কমাণ্ডারের প্রতি শ্রদ্ধার কারণে। পুরো রাশান আর্মিতে যদি একজন মানুষেরও ড. ইভানোভিচের ঢাল পাবার দাবি থাকে, সেটা কর্নেল ভ্যাসিলি রোমানভের!

আর্মির ভিতরে চলতে থাকা দুর্নীতির প্রতিবাদে সোচ্চার কর্নেল। কিছুদিন আগে প্রকাশ্যে উচ্চপদস্থ বেশ কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সরকারি অর্থের অপব্যবহার, সাধারণ সৈনিকদের কল্যাণের টাকায় সিনিয়রদের পকেট ভরা  নিয়ে মোটামুটি হৈচৈ শুরু করে দিয়েছিলেন তিনি। ফলাফল হিসেবে ক্যারিয়ার থমকে গেছে কর্নেল রোমানভের; সভ্যজগৎ

থেকে বহুদূরে, ভিলনিয়াসের দুর্গম এলাকায় ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার হিসেবে অলিখিত নির্বাসন দেয়া হয়েছে তাঁকে। গত ছ’মাস থেকে ওখানেই কাজ করছে ইউরি। খুব কাছ থেকে দেখেছে কর্নেলকে, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় ভরে উঠেছে অন্তর। পরিণতির তোয়াক্কা না করে যে-মানুষ নীতির প্রশ্নে অবিচল থাকে, তাকে শ্রদ্ধা না করে উপায় কী? এমন একজন মানুষ, ওর বাবার সঙ্গে একটা দিন কাটাতে চাইলে তাতে আপত্তি জানানো যায় না। নিজের প্রভাব খাটিয়ে কর্নেল রোমানভকে যদি সাহায্য করেন ড. ইভানোভিচ, ক্ষতি কোথায়? ইউরির মন খুঁতখুঁত করছে শুধু দ্বিতীয় অতিথির কথা ভেবে। কে সে? কোত্থেকে আসছে? ‘কী চায় ওর বাবার কাছে?

আস্তাবলের কাছে পৌছে গেছে ইউরি, দরজা খুলে ভিতরে পা রাখল। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে দীর্ঘ করিডোর, দু’পাশে সারি বেঁধে তৈরি করা ঘোড়া রাখার স্টল। এখন অবশ্য সবগুলো খালি। অযত্নে-অবহেলায় কাঠের দেয়াল ভগ্নপ্রায়, সবখানে ঘুণপোকার বাসা। কিন্তু এককালে তেজি, চমৎকার সব ঘোড়া থাকত এখানে। বাতাসে এখনও যেন ভেসে বেড়াচ্ছে সেসব ঘোড়ার হ্রেষারব, খুরের খটখটানি। এখন সব বদলে গেছে—এই খামার… সেইসঙ্গে গোটা দেশ। মহাপরাক্রমশালী সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, নিজের ছায়া হয়ে কোনোমতে টিকে আছে রাশা। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তরুণ লেফটেন্যান্টের বুক চিরে।

করিডোর পেরিয়ে আস্তাবলের শেষপ্রান্তে গেল ইউরি, ওখানে আরেকটা বড় দরজা আছে। সেটা খুলে বেরিয়ে এল আস্তাবলের তুষারাবৃত পিছনদিকটায়।

দূরে কী যেন দৃষ্টি আকর্ষণ করল ওর। চোখ পিটপিট করে তাকাল ওদিকে। বনভূমির কিনারে ট্র্যাক দেখা যাচ্ছে। পায়ের ছাপ… কিন্তু এল কোত্থেকে! মস্কো থেকে নিয়োগ পাওয়া দুই ভৃত্য এখনও বাড়ির ভিতরে, গেমকিপার-রা থাকছে খামারবাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে আলাদা ব্যারাকে। তা হলে এদিকে এল কে?

আনমনে মাথা নাড়ল ইউরি। নাহ্, নিশ্চয়ই ভুল হচ্ছে ওর। পায়ের ছাপগুলো যে মানুষেরই, তা ভাবছে কেন? এদিকটায় বুনো প্রাণীর অভাব নেই। ভালুক বা হরিণ, যে-কোনও জানোয়ার হতে পারে। সকালের রোদে বরফ গলতে শুরু করেছে। কিনার গলে যাওয়ায় হয়তো বা ওসব ছাপই মানুষের ছাপের মত লাগছে।

ব্যাপারটা নিয়ে আর বেশি মাথা ঘামাল না ইউরি। যথেষ্ট প্রাতঃভ্রমণ করেছে। বাড়িতে ফিরে গিয়ে তৈরি হওয়া দরকার। অতিথিরা এসে পড়বেন খুব শীঘ্রি। উল্টো ঘুরে আবার হাঁটতে শুরু করল ও।

.

ঘণ্টাখানেক পর হাজির হলেন কর্নেল রোমানভ আর তাঁর সঙ্গী অযাচিত অতিথি… তাই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি দেখা দেবে, এমন ধারণা করেছিল ইউরি, তবে সেসবের কিছুই ঘটল না। বিখ্যাত বিজ্ঞানীর সামনে কর্নেল রোমানভ শুরুতে কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে ছিলেন, কিন্তু হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে তাঁকে সহজ করে দিলেন ড. ইভানোভিচ। ‘ছেলের ক্যারিয়ার নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, ব্যাপারটা কিছুটা বিস্তৃত করে তুলল ইউরিকে। জুস আর কফি পরিবেশন করা হলো, তাতে চুমুক দিতে দিতে গল্পে মেতে উঠলেন তিনজনে।

অল্প সময়ের মধ্যে মস্কো থেকে আসা কর্নেল রোমানভের সঙ্গীটি আসরের প্রাণ হয়ে উঠলেন। ভদ্রলোকের নাম নিকোলাই প্রুশিন, ক্ষমতাসীন পার্টির লোক, মিলিটারি-ইণ্ডাস্ট্রিয়াল প্ল্যানিঙের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। একই সার্কেলের বেশ কিছু পরিচিত বন্ধুবান্ধব বেরিয়ে পড়ল ড. ইভানোভিচের সঙ্গে আলাপে। তা ছাড়া জানা গেল, বিখ্যাত বিজ্ঞানীটির মত তিনিও মস্কোর আমলাতন্ত্রের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। খুব শীঘ্রি ড. ইভানোভিচ তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলেন, খানিক পর দেখা গেল, প্রুশিনকে তুমি বলে সম্বোধন করছেন। ড্রয়িংরুমে রাজনৈতিক আলোচনার ঝড় উঠল।

‘তুমি একটা জিনিস বটে, নিকোলাই!’ প্রুশিনের একটা মন্তব্য শুনে হাসতে হাসতে বললেন ইভানোভিচ।

‘আপনিও কম যান না,’ পাল্টা হাসি ফুটল প্রুশিনের ঠোঁটে। ‘আমাদের মধ্যে অনেক মিল!’

‘বুঝে-শুনে কথা বলো,’ ইশারায় কর্নেল রোমানভ আর ইউরিকে দেখালেন ইভানোভিচ। ‘আর্মির লোক… আমাদের নামে না রিপোর্ট করে দেয়!’

‘তা হলে ওদের বেতন আটকে দেব আমি। আপনিও একটা ব্যাকফায়ার করবার মত বোমা বানিয়ে দিতে পারবেন।’

হাসিতে ছেদ পড়ল ড. ইভানোভিচের। ‘সত্যি বলতে কী, অমন বোমার কথা বহুবার ভেবেছি আমি। মানে… দেশটা যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল… যখন ধ্বংসের পথে হাঁটছিল সবাই।’

‘ঠিকই বলেছেন,’ সায় দিলেন প্রুশিন। ‘বহু অপচয় করেছি আমরা। টাকাগুলো যদি দেশের কল্যাণে ব্যবহার করা হতো, হয়তো বা মাদার রাশা এভাবে টুকরো টুকরো হয়ে যেত না।’

ক্ষণিকের জন্য নীরবতা নেমে এল ড্রয়িংরুমে। পরিবেশটা ভারী হয়ে উঠেছে।

খানিক পরে গলা খাঁকারি দিয়ে ড. ইভানোভিচ বললেন, ‘থাক, এসব নিয়ে এখন আর কথা না বলাই ভাল। চলো, শিকারে যাই। গেমকিপার-রা অপেক্ষা করছে। বছরের এ-সময়টা নাকি শিকারের জন্য খুবই ভাল। আমার ছেলেকে কথা দিয়েছি, সবচেয়ে বড় শিকারটা উপহার দেব ওকে। প্রস্তুতি নিয়ে এসেছ তো তোমরা?’

‘অবশ্যই,’ বললেন প্রুশিন।

‘কোনও কিছুর অভাব থাকলে আমার কাছ থেকে নিতে পারো-বুট, কোট… কিংবা ভদকা!’

‘খবরদার, বাবা!’ বলে উঠল ইউরি। ‘শিকারে যাবার আগে ড্রিঙ্ক চলবে না।’

রোমানভের দিকে তাকিয়ে হাসলেন ইভানোভিচ। ‘ওকে ভালই ট্রেইনিং দিয়েছেন আপনারা, কর্নেল।’

একটু লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসলেন রোমানভ

‘আপনারা কিন্তু আজ এখানেই থাকছেন, ‘ বললেন ইভানোভিচ। ‘যাবার কথা শুনতে চাই না। মস্কোর আবহাওয়া ভাল, কিন্তু ওখানে এখানকার মত তাজা খাবার পাবেন না।’

‘শুধু খাবার?’ ভুরু নাচালেন প্রুশিন। ভদকা পাওয়া যাবে না?

‘সে আর বলতে!’ হাসলেন ইভানোভিচ। ‘থাকছ তো?’

‘থাকছি, ডক্টর। আপনার সঙ্গে অনেক কথা আছে আমার।

.

রাইফেলের অকস্মাৎ গর্জনে খান খান হয়ে গেল বনভূমির নির্জনতা। দুপুরের গরম রোদ, আর থমকে থাকা বাতাসের মাঝে কেমন ভোঁতা শোনাল আওয়াজটা। আকাশে, আতঙ্কিত ভঙ্গিতে ডানা ঝাপটাতে থাকা বেশ কিছু পাখি নজরে পড়ল, পালাবার  চেষ্টা করছে শিকারীদের নাগাল থেকে। উত্তেজিত কণ্ঠও শুনতে পেল ইউরি, তবে দূরত্বের কারণে কথাগুলো বোঝা গেল না। পিতার দিকে তাকাল ও।

‘ষাট সেকেণ্ডের মধ্যে যদি হুইসেল শোনা যায়, তা হলে বুঝতে হবে, ওরা শিকারের গায়ে গুলি লাগাতে পেরেছে,’ বলল ও।

‘ধ্যাত্তেরি!’ বিরক্ত গলায় বললেন ড. ইভানোভিচ। ‘গেমকিপারগুলো তো দেখি কিছুই জানে না। আমাকে কসম কেটে বলেছে, বনের এ-অংশে… লেকের ধারে সমস্ত শিকার মেলে। সেজন্যেই তো নিজে এদিকে এলাম, আর প্রুশিনদেরকে পাঠালাম অন্যদিকে। আমাদের আগে ওরা শিকার পায় কীভাবে?

‘সে কী!’ বিস্মিত গলায় বলল ইউরি। ‘এভাবে বুঝি হারাবার প্ল্যান করেছ ওঁদেরকে?’

‘অল’স ফেয়ার ইন লাভ অ্যাণ্ড গুঅর,’ দার্শনিকের ভঙ্গিতে বললেন ইভানোভিচ।

শিকারে এসেছি আমরা, যুদ্ধে নয়,’ বলল ইউরি। ভুরু কুঁচকে তাকাল পিতার রাইফেলের দিকে। ‘সেফটি রিলিজ করে রেখেছ কেন, বাবা?’

‘পিছনদিকে খসখসানির মত কী যেন শুনলাম একটু আগে, বললেন ইভানোভিচ। তাই রেডি থাকতে চাই।’

‘কিছু মনে কোরো না, বাবা, টার্গেটের দিকে অস্ত্র তাক করার আগে সেফটি রিলিজ করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এতে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। প্লিজ, অন করো ওটা।’

‘হুম,’ কাঁধ ঝাঁকালেন ইভানোভিচ। তা অবশ্য ঠিক বলেছ। হোচট খেয়ে অ্যাকসিডেন্ট ঘটিয়ে ফেলতে পারি। ঠিক আছে…’ সেফটি ক্যাচের লিভার অন পজিশনে নিয়ে এলেন তিনি।

‘থ্যাঙ্কস, বাবা…’ বলতে বলতে পাই করে ঘুরল ইউরি। বৃদ্ধ বিজ্ঞানী ভুল বলেননি। পিছনে সত্যিই আবার শব্দ হয়েছে। মট্ করে শুকনো ডাল ভাঙার আওয়াজ। নিজের রাইফেলটা একটু উঁচু করে সেফটি রিলিজ করল ও।

‘কী হয়েছে?’ জানতে চাইলেন ইভানোভিচ, উত্তেজনায় দু’চোখ জ্বলজ্বল করছে।

‘শশশ্… ঠোঁটের কাছে আঙুল তুলল ইউরি। গাছপালার ফাঁকফোকরের মাঝ দিয়ে তীক্ষ্ণ নজর বোলাল

‘তা হলে তুমিও শুনেছ ওটা?’ বললেন ইভানোভিচ। মতিভ্রম হয়নি আমার।

অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পরও শব্দের উৎস সনাক্ত করতে পারল না ইউরি। তাই সোজা হয়ে দাঁড়াল। লক্ পজিশনে নিয়ে এল রাইফেলের সেফটি লিভার।

‘কী বুঝলে?’ জানতে চাইলেন বৃদ্ধ বিজ্ঞানী।

‘গাছের মাথায় প্রচুর তুষার জমেছে,’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল ইউরি। ‘সে-ওজনেই হয়তো পাতলা কোনও ডাল ভেঙে পড়েছে। ওই আওয়াজ শুনেছি আমরা।

হতে পারে। কিন্তু একটা আওয়াজ এখনও শুনিনি আমরা… হুইসেলের আওয়াজ। তারমানে প্রুশিন আর তোমার কর্নেল এখনও কিছুতে গুলি লাগাতে পারেনি।’

ইভানোভিচের কথা শেষ হতেই আবার রাইফেলের আওয়াজ শোনা গেল। পরপর কয়েকবার

আবার চেষ্টা করছে ওরা,’ বলল ইউরি। দেখা যাক, এবার হুইসেল বাজে কি না।

বাজল না বাঁশি, তার পরিবর্তে হঠাৎ ভেসে এল আর্তচিৎকার প্রথমে একটা কণ্ঠের, তারপর আরেকটা। যেন মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে কেউ। কেঁপে উঠল পিতা-পুত্র।

‘হা ঈশ্বর! কী ঘটছে ওখানে?’ হতভম্ব গলায় বললেন ইভানোভিচ।

‘কী জানি…’

বাক্যটা শেষ করতে পারল না ইউরি, তার আগেই তৃতীয় চিৎকার শোনা গেল দূরে। দূরত্বের কারণে পুরোপুরি স্পষ্ট নয়, তারপরেও ভয়াল সে-আর্তনাদ আত্মা কাঁপিয়ে দেয়।

চঞ্চল হয়ে উঠল তরুণ লেফটেন্যান্ট। পিতাকে বলল, ‘এখানেই থাকো। আমি দেখে আসছি ব্যাপারটা কী।

‘যাও,’ বললেন ইভানোভিচ। আমিও আস্তে-ধীরে পিছন পিছন আসছি। সাবধানে যেয়ো!

তুষার মাড়িয়ে ছুটতে শুরু করল তরুণ লেফটেন্যান্ট। আর্তনাদের আওয়াজে ভারী হয়ে উঠেছে বনভূমি, তবে এখন তাতে আগের মত জোর নেই। যে বা যারাই চেঁচিয়ে উঠুক, তাদের শক্তি ফুরিয়ে এসেছে। ঘন ঝোপঝাড়ের মাঝ দিয়ে পথ তৈরি করার জন্য রাইফেলের বাট ব্যবহার করল ইউরি। তবে কাজটা পরিশ্রমের। অল্পক্ষণের মধ্যেই ক্লান্তি ভর করল ওর শরীরে। পা ব্যথা করছে, ঠাণ্ডা বাতাস টানার সময় খচ্ করে কী যেন বিঁধছে ফুসফুসে। দৃষ্টিসীমাও কমে এসেছে শ্রান্তির কারণে।

হঠাৎ করে বনের মাঝখানে ছোট্ট একটা ফাঁকা জায়গায় বেরিয়ে এল ও। সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেল মূর্তিমান বিপদকে। বিশাল এক কালো ভালুক, দু’পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মুখ-হাত রক্তে রঞ্জিত, হাঁ করে ভয়ানক গর্জন করছে প্রবল আক্রোশে। প্রাণীটার গায়ে গুলির আঘাত লক্ষ করল ইউরি, সে-কারণেই ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে গেছে ওটা। কয়েক গজ তফাতে তুষারে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে দুটো মানবদেহ, নিঃসন্দেহে এতক্ষণ তাণ্ডব চালাচ্ছিল ওগুলোর উপরে।

লেফটেন্যান্টের উপস্থিতি টের পেয়েই ঝট্ করে ঘুরে দাঁড়াল ভালুক। আক্রমণের ভঙ্গিতে কুঁজো হলো একটু। দেরি করার কোনও মানে হয় না, রাইফেল উঁচু করে গুলি করতে শুরু করল ইউরি, খালি করে ফেলল ম্যাগাজিন। ভারী বুলেটের উপর্যুপরি আঘাতে মাটিছাড়া হলো কালো ভালুক। ধড়াম করে আছড়ে পড়ল কয়েক গজ দূরে। প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল দেহ থেকে।

হাঁপাতে হাঁপাতে পড়ে থাকা দেহদুটোর দিকে এগোল ইউরি। কর্নেল রোমানভ আর প্রুশিন… কোনও সন্দেহ নেই। পোশাক চিনতে পারছে। কাছে যেতেই বমি পেল দৃশ্যটা দেখে।

প্রুশিন মৃত। গলা ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে ভালুক, মাথাটা কোনোমতে আটকে আছে ধড়ের সঙ্গে। কর্নেল এখনও বেঁচে আছেন, কিন্তু তা না থাকার মতই। যে-কোনও মুহূর্তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন। ভালুকের থাবায় মুখমণ্ডল অদৃশ্য হয়েছে তাঁর, প্রচণ্ড

প্রচণ্ড কষ্টে ছটফট করছেন। একটাই করণীয় এ-মুহূর্তে—রাইফেল রিলোড করে বেচারাকে এই অবর্ণনীয় কষ্ট থেকে মুক্তি দেয়া। এভাবে কষ্ট পেয়ে মরা উচিত নয় কারও।

কিন্তু কীভাবে… কীভাবে এই ভয়ানক ঘটনা ঘটল? কিছুই বুঝতে পারছে না ইউরি। রাইফেলের ম্যাগাজিন খুলতে খুলতে তাকাল কর্নেলের দিকে, পরমুহূর্তে চমকে উঠল

রোমানভের ডান হাত… সেটা ইয়ের নীচ থেকে গায়েব হয়ে গেছে! কীভাবে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, তাও পরিষ্কার। হেভি ক্যালিবার বুলেট!

গুলির সাহায্যে কর্নেলের ফায়ারিং আর্ম অচল করে দিয়েছে কেউ। ওই হাতেই রাইফেল চালান তিনি তাড়াতাড়ি প্রুশিনের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল ইউরি। ডান হাত অক্ষত ভদ্রলোকের। কিন্তু বাঁ হাতের তালুটা গুলির আঘাতে চুরমার হয়ে গেছে। সকালের কথা ভাবল লেফটেন্যান্ট—কফি, ফলের জুস, আর চুরুট। সব বাঁ হাতে ধরেছিলেন প্রুশিন ভদ্রলোক বাঁহাতি!

থমকে গেল ইউরি। মানেটা পরিষ্কার, অচল করে দেয়া হয়েছিল দু’জনকে—অরক্ষিত, অসহায় করে দেয়া হয়েছিল। তারপর গুলি করে আহত করা হয়েছে হিংস্র ভালুককে… লেলিয়ে দেয়া হয়েছে ওঁদের উপর।

সৈনিক-সত্তা জেগে উঠেছে ইউরির ভিতর। সাবধানে উঠে দাঁড়াল। রাইফেল রিলোড করে ফেলেছে ইতোমধ্যে, সতর্ক নজর বোলাল চারপাশে। ফাঁদের প্রকৃতি বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। নিখুঁত, নিশ্ছিদ্রভাবে আয়োজন করা হয়েছে পুরো ব্যাপারটার। সকালে আস্তাবলের পিছনে দেখা পায়ের ছাপগুলোর কথা মনে পড়ল। নিশ্চয়ই খুনির পায়ের ছাপ ছিল ওগুলো।

কে লোকটা? সবচেয়ে বড় কথা, কেন এসব ঘটিয়েছে?

আচমকা চোখের কোণে ঝিলিক দিয়ে উঠল কী যেন। সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়েছে ধাতব কিছুর গায়ে। মাটিতে ঝাঁপ দিল ইউরি, গড়ান দিয়ে চলে গেল একটা ওক গাছের পিছনে সন্তর্পণে উঁকি দিল যে-দিকে ঝিলিক দেখেছে, সে-দিকে। একটা উঁচু পাইন গাছের উপর থেকে এসেছে ওটা।

আলোর সঙ্গে দৃষ্টি মানিয়ে আসতেই খুনিকে দেখতে পেল লেফটেন্যান্ট। মাটি থেকে পঞ্চাশ ফুট উপরে, পাইন গাছের দুটো ডালের মাঝখানে পজিশন নিয়েছে লোকটা। পরনে দুধ-সাদা স্নো-পারকা, হুড দিয়ে ঢেকে রেখেছে মাথা। চোখে কালো সানগ্লাস; হাতে রাইফেল, টেলিস্কোপিক সাইট লাগানো আছে ওতে।

তীব্র আক্রোশ আর ঘৃণায় চিৎকার করতে ইচ্ছে হলো ইউরির। লোকটা দাঁত বের করে হাসছে। ওকে উদ্দেশ করে একটা হাতও নাড়ল।

রাইফেল উঁচু করল ইউরি, কিন্তু ট্রিগার টেপার আগেই একরাশ বরফ ছিটকে উঠল ওর কয়েক হাত দূরে। চতুর খুনি গুলি করছে ওকে লক্ষ্য করে, যাতে ওর আড়াল নিতে হয়। দ্বিতীয় বুলেটটা ঠক্ করে বিঁধল ওক গাছের কাণ্ডে। তাড়াতাড়ি আড়ালে সরে আসতে বাধ্য হলো ইউরি। কী করবে বুঝতে পারছে না।

আরেকটা গুলির আওয়াজ হলো। খুব কাছে, তবে পাইন গাছের খুনি ছোঁড়েনি এ-গুলিটা।

‘ইউরি!’ তরুণ লেফটেন্যান্টের নাম ধরে আর্তনাদ করে উঠল কেউ :

চমকে উঠল ইউরি। এ-কণ্ঠ তো ওর বাবার! ভয় আর ক্রোধে অন্ধ হয়ে উঠল ও। হিতাহিত জ্ঞান রইল না।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল ও। পাইন গাছের দিকে একটা গুলি করে ছুটতে শুরু করল পিতাকে সাহায্য করার জন্য। পিছনে গর্জে উঠল আততায়ীর রাইফেল।

পিঠে একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল তরুণ লেফটেন্যান্ট ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে পুরো দেহে। ছুটন্ত অবস্থায় হোঁচট খেল ও, আছড়ে পড়ল বরফের উপর। শরীরের নীচে রক্তে ভেসে যাচ্ছে তুষার।

‘বাবা!’

শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবার আগে ফিসফিসিয়ে এই একটা শব্দই শুধু উচ্চারণ করল ইউরি ইভানোভিচ!

.

ডেস্কের উপর ছড়িয়ে রাখা ছবিগুলোর দিকে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে  আছেন রাশান প্রাইম মিনিস্টার। আঙুলের ভাঁজে আঙুল, টেবিলের উপর দুই কনুই, এতক্ষণ চিবুকটা রাখা ছিল জোড়া মুঠির উপর; এবার আঙুলের ভাঁজ খুলে দু’হাত মেলে দিলেন ডেস্কের উপর সামনে ঝুঁকে এসে শান্ত গলায় বললেন, ‘দুঃখজনক। এমন ভয়ানক মৃত্যু কারও প্রাপ্য হতে পারে না। ড. ইভানোভিচের কপাল ভাল। প্রাণে বাঁচেননি হয়তো, কিন্তু এমন পরিণতি তো বরণ করতে হয়নি ওঁকে।

কামরায় আরও তিনজন মানুষ আছে—দু’জন পুরুষ, একজন মহিলা। নার্ভাস ভঙ্গিতে প্রাইম মিনিস্টারের মুখভঙ্গি দেখছে তারা। প্রত্যেকের হাতে একটা করে খয়েরি রঙের ফোল্ডার। মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না কেউ। প্রাইম মিনিস্টারকে আশ্চর্য রকমের শান্ত দেখাচ্ছে; কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে ওরা জানে, এটা ঝড় আসার পূর্বাভাস।

কয়েক মিনিট নীরবতায় কাটল। তারপর উঠে দাঁড়ালেন প্রাইম মিনিস্টার। ডেস্কের পাশ ঘুরে একেবারে কাছে এসে থামলেন তিন দর্শনার্থীর।

‘জানতে পারি, এমন ঘটনা কী করে ঘটল?’ বললেন তিনি। ‘দেশের সবচেয়ে প্রতিভাবান বিজ্ঞানী…. তাঁকে খুন করতে পারল কীভাবে ওরা? আমরা কি বসে বসে আঙুল চুষছিলাম?’

‘ইয়ে…’ ইতস্তত করে বললেন একজন, তিনি রাশান ইন্টেলিজেন্সের প্রধান, ‘ড. ইভানোভিচের জীবনের উপর কোনও ধরনের হুমকি আছে বলে জানা ছিল না আমাদের।

‘বোকার মত কথা বলছ তুমি, সারিনভ,’ ধমকে উঠলেন প্রাইম মিনিস্টার। ‘অমন লোকের জীবনের উপর সবসময়েই হুমকি থাকে। প্রোটেকশনের ব্যবস্থা করোনি কেন?’

‘আমরা চেয়েছিলাম, মি. প্রাইম মিনিস্টার,’ কাঁচুমাচু গলায় বললেন ইন্টেলিজেন্স চিফ। ‘কিন্তু ড. ইভানোভিচ কিছুতেই দেহরক্ষী রাখতে রাজি হননি। উনি কেমন একগুঁয়ে স্বভাবের মানুষ ছিলেন, তা তো আপনি জানেন…’

‘মানা করলেও কীভাবে গোপনে লোক রাখা যায়, তা কি আমার শিখিয়ে দিতে হবে? মনে হচ্ছে গতকাল ইন্টেলিজেন্সে যোগ দিয়েছ তুমি, সারিনভ।’

মাথা নিচু করে ফেললেন ইন্টেলিজেন্স চিফ।

‘যা হবার, তা তো হয়েই গেছে,’ বলে উঠলেন কামরায় উপস্থিত মহিলাটি। সরকারের উচ্চপদস্থ একজন কূটনীতিক তিনি, প্রাইম মিনিস্টারের ঘনিষ্ঠজন। কারা এ-কাজ করেছে, এবং কেন—সেটা বের করার পিছনে এখন আমাদের মনোযোগ দেয়া দরকার।

‘কোনও সূত্র পেয়েছেন আপনারা?’ দ্বিতীয় পুরুষটির দিকে ফিরলেন প্রাইম মিনিস্টার, তিনি রাশার পুলিশ ফোর্সের চিফ।

‘খুব সামান্য,’ জানালেন ভদ্রলোক। ‘দু’জন খুনি ছিল ওখানে। কোন্ পথে কীভাবে খামারবাড়ির সীমানায় পৌঁছেছিল, সেটা বের করতে পেরেছি। তবে ওদের পরিচয় সম্পর্কে এখনও কিছু জানা যায়নি।’

‘অস্ত্রগুলো?’

‘শেল-কেসিং আর বুলেট পরীক্ষা করে দেখেছি আমরা। সাত মিলিমিটার… ব্রাউনিং ম্যাগনাম, গ্রেড ফোর থেকে ছোঁড়া হয়েছে। আমেরিকান অস্ত্র।

‘বলতে চাইছেন, এই খুনগুলোর পিছনে আমেরিকানদের হাত আছে?’ ভুরু কোঁচকালেন প্রাইম মিনিস্টার।

‘আমি শুধু অস্ত্রের কথা বলছি, স্যর। কে ব্যবহার করেছে, তা জানি না। কিন্তু এ-কথা ঠিক, ড. ইভানোভিচের গবেষণাকে কখনোই আমেরিকানরা ভাল চোখে দেখেনি।’

‘অ্যাবসার্ড!’ প্রতিবাদ করলেন ইন্টেলিজেন্স চিফ। ‘ড. ইভানোভিচের ব্যাপারে কিছু করতে চাইলে আমেরিকানরা সেটা বহু আগেই করতে পারত। এত আয়োজন করে তাঁর ছেলে আর দুই অতিথিকে খুন করতে যেত না।’

—তুমি বলছ, ইভানোভিচ একাই টার্গেট ছিলেন না?’ একটু অবাক হলেন প্রাইম মিনিস্টার।

মাথা ঝাঁকালেন সারিনভ। ‘এর পিছনে আরও রহস্য থাকতে বাধ্য। কর্নেল রোমানভ আর মি. প্রুশিন শুধু হাওয়া খেতে ওখানে গিয়েছিলেন বলে বিশ্বাস হয় না আমার।’

‘সেক্ষেত্রে এখুনি তদন্ত শুরু করো তুমি, সারিনভ,’ গম্ভীর গলায় বললেন প্রাইম মিনিস্টার ‘কী ঘটেছে, তা জানতে চাই আমি… যত শীঘ্রি সম্ভব।’

‘জী, স্যর,’ জবাব দিলেন সারিনভ। ‘আমি এখুনি কাজে নামছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *