সেই কুয়াশা ১.১৭

সতেরো

ফার্মহাউস থেকে বেরিয়ে পিছনদিকে ছুটল তিনজনে। সবজি-খেত পেরিয়ে নেমে পড়ল ঢালে, লুকাল ঝোপঝাড়ের আড়ালে। কপাল ভাল, উল্টোদিকের ঢাল বেয়ে উঠতে থাকা লোকগুলোর মনোযোগ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে উচেলোর ক্রমাগত হুঙ্কারে। আবছাভাবে তর্কাতর্কি শুনতে পেল ওরা, কুকুরটাকে গুলি করবে কি না, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেছে হামলাকারীরা। সুযোগ বুঝে তীক্ষ্ণস্বরে শিস দিয়ে উঠল সোনিয়া, উচেলো ছুটে চলে এল সে-ডাক শুনে। মাথায় হাত বুলিয়ে প্রাণীটাকে শান্ত করল মেয়েটা।

পাতার ফাঁক দিয়ে রুক্ষ চেহারার কয়েকজন লোককে মালভূমিতে উঠে আসতে দেখল রানা। সংখ্যায় আটজন … সবাই সশস্ত্র। ওর আর কুয়াশার পক্ষে এতজনকে ঘায়েল করা সম্ভব নয়। লুকিয়েই থাকতে হবে।

বৃদ্ধার কথাগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করল ও। রাখালবালককে খুঁজে বের করতে হবে, যার কণ্ঠ ঝোড়ো বাতাসের চেয়ে ভয়ঙ্কর! সত্যিই কি সেদিনের সেই কিশোর আজকের ফেনিসের নেতৃত্ব দিচ্ছে? বয়স অনেক হয়ে যাবার কথা… পঁচাশি-র কম নয়; বৃদ্ধের কণ্ঠের সঙ্গে বাচ্চা ছেলের কণ্ঠ কীভাবে মেলালেন মারিয়া মাযোলা? শুনেছেনও রেডিও-তে, সামনাসামনি নয়। ভুল করেননি তো?

একটা ব্যাপার পরিষ্কার, অন্ধ মহিলাটির সঙ্গে এখনও অনেক কথা বাকি রয়ে গেছে ওদের। জানতে হবে ঠিক কবে, কোন্ রেডিও স্টেশনে শুনেছেন তিনি সে-কণ্ঠ। কী-ই বা বলছিল মানুষটা? যে-সে তো জাতীয় বেতারে কথা বলতে পারে না, নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কোনও মানুষ ওই বৃদ্ধ। পরিচয় কী তার?

অস্ত্র উঁচিয়ে ফার্মহাউসের দিকে এগোতে দেখা গেল কর্সিকানদেরকে। চারজন বাইরে রইল পাহারা দেবার জন্য, বাকিরা দরজা খুলে ঢুকে পড়ল ভিতরে। একটু পরেই শোনা গেল চেঁচামেচি। মারিয়া মাযোলা রাগী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করছেন অনুপ্রবেশের কারণ, ক্ষিপ্ত স্বরে তার জবাব দিচ্ছে কর্সিকানরা একটু পরেই শোনা গেল চড়-থাপ্পড়ের আওয়াজ, পিছু পিছু ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠলেন বৃদ্ধা। ধীরে ধীরে আওয়াজের তীব্রতা বাড়ল।

ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে ঝোপের আড়াল থেকে উঠে দাঁড়াতে শুরু করল সোনিয়া, সুন্দর মুখটা রাগে লাল হয়ে গেছে। জ্যাকেট খামচে ধরে ওকে টানল কুয়াশা, বাধ্য করল বসে থাকতে। মেয়েটার গলা ফুলে উঠতে দেখল রানা, চেঁচাতে যাচ্ছে। পিছন থেকে ওকে জাপটে ধরল তাই, এক হাতে চেপে ধরল মুখ। যুঝতে শুরু করল সোনিয়া, কিন্তু একচুল আলগা হলো না রানার হাতের  বাঁধন।

‘শান্ত থাকো!’ চাপা গলায় ধমক দিল রানা। ‘চেঁচালে কোনও লাভ হবে না তোমার দাদীর। মাঝখান থেকে ধরা পড়ে যাব আমরা।’

কথাটা কানেই তুলল না সোনিয়া, শরীর মোচড়াচ্ছে সে। ওর কাঁধে একটা হাত রাখল কুয়াশী। নরম গলায় বলল, ‘প্লিজ, বুঝতে চেষ্টা করো। আমরা ধরা দিলেই যে তোমার দাদীকে ছেড়ে দেবে ওরা, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। বরং সবাইকেই খুন করে রেখে যাবে ওরা।’

থেমে গেল সোনিয়া। চোখ পিটপিট করল, বুঝতে পেরেছে কুয়াশার যুক্তি। মুখের উপর থেকে হাত একটু সরাল রানা, কিন্তু পুরোপুরি নয়, খুলল না হাতের বাঁধনও।

‘ওরা দাদীকে মারছে!’ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল মেয়েটা। ‘অসহায়… অন্ধ একটা মানুষ… তারপরেও ওঁর গায়ে হাত তুলছে পিশাচগুলো। কিছু একটা করতে হবে আমাদেরকে।’

‘এ-মুহূর্তে কিছুই করার নেই,’ মাথা নাড়ল কুয়াশা। ‘জমি হারানোর ভয়ে পাগল হয়ে গেছে মূর্খগুলো। ওদের মাথায় এখন কিচ্ছু ঢুকবে না।’

বিস্ময় ফুটল সোনিয়ার চোখে। জমি হারানোর ভয়! মানে?? ‘এসব নিয়ে পরে কথা বলা যাবে,’ রূঢ় কণ্ঠে বাধা দিল রানা। সন্দিহান হয়ে উঠেছে ও। বলল, ‘ঝামেলা হয়েছে কোথাও। বাড়ির ভিতরে এতক্ষণ থাকার কথা না ওদের।

‘হয়তো আমাদের কোনও চিহ্ন খুঁজে পেয়েছে,’ অনুমান করল কুয়াশা।

‘মনে হয় না। কিছু ফেলে আসিনি আমরা।’

‘তা হলে?’

কান পাতল রানা। ফার্মহাউসের ভিতর থেকে এখন আর চড়-থাপ্পড়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। তার বদলে নেমে এসেছে নীরবতা। একটাই অর্থ হতে পারে এর।

‘সর্বনাশ!’ আঁতকে উঠল রানা। ‘কথা বলছেন উনি!’

‘এতে সর্বনাশের কী আছে?’ বলল সোনিয়া। ‘যা খুশি বলুন… শয়তানগুলো দাদীর গায়ে আর হাত না তুললেই হয়!’

কুয়াশা ভুরু কোঁচকাল। ‘কী ভাবছ তুমি, রানা?

মারিয়া চাইছেন না আমরা ফিরে যাই,’ রানা বলল। ‘ফিরে গেলে সোনিয়ার বিপদ হবে। তাই বন্ধ করে দিতে চাইছেন আমাদের ফেরার পথ। লোকগুলোকে বলে দিচ্ছেন, কী কথা হয়েছে আমাদের মধ্যে। এরপর নিশ্চয়ই ভুল পথে পাঠিয়ে দেবেন ওদের, যাতে আমাদেরকে আর খুঁজে না পায় ওরা!?

‘সে তো ভাল কথা।’

‘গড ড্যাম ইট, কুয়াশা! ওরা খুন করবে মহিলাকে!’

ঝট্ করে ফার্মহাউসের দিকে তাকাল কুয়াশা। এতক্ষণে বুঝতে পেরেছ মারিয়া মাযোলার উদ্দেশ্য। আত্মাহুতি দিচ্ছেন তিনি স্বেচ্ছায়… সোনিয়াকে বাঁচাবার জন্য। দাদী মারা গেলে এখানে থাকার আর বাধ্যবাধকতা থাকে না মেয়েটার… চলে যেতে পারবে ও-পাহাড়ের খুনে লোকজনের নাগালের বাইরে।

‘ঠিকই বলেছ তুমি,’ রানাকে বলল ও। ‘ওদের গোমর ফাঁস করে দিয়ে মস্ত অন্যায় করেছেন ভদ্রমহিলা। কিছুতেই ওঁকে বাঁচতে দেবে না ওরা। উনিও তা-ই চাইছেন। নিজের জীবনের বদলে সোনিয়ার জীবন!’

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। হাতে চলে এসেছে নিজের সিগ-সাওয়ার। ‘ঠেকাতে হবে ওদেরকে,’ উত্তেজিত গলায় বলল ও। ‘কিছুতেই খুন হতে দেয়া যাবে না ভদ্রমহিলাকে। এখনও  অনেক কিছু জানার আছে আমাদের!’

সোনিয়া আর কুয়াশাও উঠে দাঁড়াল, ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে ছুটতে শুরু করল তিনজনে। কিন্তু কয়েক পা যাবার সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল শটগানের গগনবিদারী আওয়াজ, সেইসঙ্গে কারও মরণ-আর্তনাদ—দুটোই ভেসে এসেছে ফার্মহাউসের ভিতর থেকে। দাদীর অমঙ্গল আশঙ্কায় চেঁচিয়ে উঠতে চাইল সোনিয়া, কিন্তু ওকে সে-সুযোগ দিল না রানা, জাপটে ধরে ঝাঁপিয়ে পড়ল মাটিতে। পিছু পিছু কুয়াশা। মাটিতে পড়েই মেয়েটার মুখ আবার চেপে ধরল ও।

‘প্লিজ, সোনিয়া… প্লিজ!’ চুপ থাকার জন্য অনুরোধ করল রানা।

সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে মেয়েটার, কথা শুনতে চাইল না। মুক্তি পাবার জন্য খামচি দিতে শুরু করল রানার হাতে।

‘বেহুঁশ করে ফেলো!’ চাপা গলায় বলে উঠল কুয়াশা।

‘না, তার দরকার নেই।’ ফার্মহাউসের দিকে ইশারা করল রানা। ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছে কর্সিকানরা। সত্যিই ভুল নির্দেশনা দিয়েছেন মারিয়া মাযোলা —ওদের দিকে না এসে মালভূমির দক্ষিণ ঢালের দিকে ছুটে চলে গেল ওরা। একটু পরেই হারিয়ে গেল দৃষ্টির আড়ালে।

সোনিয়াকে ছেড়ে দিল রানা। উঠে বসে ফুঁপিয়ে উঠল মেয়েটা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘খুন করো ওদেরকে… খুন করো!’

‘কী লাভ?’ বলল কুয়াশা। ‘ওদেরকে খুন করতে গেলে সময় নষ্ট হবে… নিজেরাই বরং ওদের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যেতে পারি। তোমার দাদীর আত্মত্যাগ বৃথা হয়ে যাবে তাতে।’

‘তা হলে কী করব আমরা?’ কান্না আরও বেড়ে গেল সোনিয়ার।

‘উনি যা চেয়েছিলেন—তোমাকে বের করে নিয়ে যাব এখানকার মৃত্যুফাঁদ থেকে। তারপর খুঁজে বের করব এসবের পিছনে যারা জড়িত, তাদেরকে।’

.

কুকুরটা কিছুতেই ওদের সঙ্গে এল না, পরোয়াই করল না সোনিয়ার হুকুমের। ছুটে চলে গেল ফার্মহাউসের দিকে, ভিতরে ঢুকে অদ্ভুত এক সুরে কুঁই কুঁই করে উঠল। অবলা জানোয়ারটার বিষণ্ণ সে-ডাকে ভারী হয়ে উঠল মালভূমির বাতাস।

‘বিদায়, উচেলো,’ হাহাকারের মত শোনাল সোনিয়ার কণ্ঠ । ‘ভাল থাকিস। কথা দিচ্ছি, ফিরে আসব আমি তোর জন্য। যিশুর কিরে… আসব-ই! যখনই হোক না কেন!

পাহাড়ি ঢাল ধরে নামতে শুরু করল তিনজনে। ঘুরপথে উত্তর-পশ্চিমে গেল—পোর্তো ভেচিয়ো থেকে দূরে সরে গেল যতটা পারে; এরপর আবার দক্ষিণমুখী ট্রেইল ধরে সেইণ্ট লুসির দিকে এগোল। দুপুর নাগাদ ঝর্ণার পাড়ের পাইন গাছটার তলায় পৌঁছুল ওরা। গর্ত থেকে নিজের হ্যাভারস্যাক আর ডাফল ব্যাগ বের করে নিল রানা। তারপর আবার পথে নামল। খুব সতর্কভাবে এগোল ওরা, গাছপালার আড়ালে থাকল সবসময়। খোলা কোনও জায়গা পেরুতে হলে একে একে পেরোয়, কেউ যেন একসঙ্গে দেখতে না পায় তিনজনকে। পথে প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলল না কেউ, কাউণ্ট বারেমির এলাকা থেকে বেৱিয়ে যাবার দিকে একমাত্র মনোযোগ।

অনবরত হাঁটায় ক্লান্তি এল ঠিকই, কিন্তু একদিক থেকে লাভও হলো। রানা লক্ষ করল, সোনিয়া কিছুটা শান্ত হয়ে এসেছে। সারা পৃথিবীতে মারিয়া মাযোলা ওর সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন,  তাঁর মৃত্যুটা বিশাল এক আঘাত। অপরিচিত মানুষের সান্ত্বনা কোনও কাজে আসত না, কিন্তু পথযাত্রার কারণে মন কিছুটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে ওর। ক্ষণে ক্ষণে দাদীর কথা ভেবে ফুঁপিয়ে উঠছে বটে, কিন্তু কোনও ধরনের পাগলামি করছে না। কথা শুনছে ওর আর কুয়াশার।

দিনের আলোয় মেয়েটাকে ভাল করে দেখল রানা। হাঁটাচলার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে—সভ্য-ভদ্র সমাজের মেয়ে ও, অশিক্ষিত পাহাড়িদের কেউ নয়। শটগান চালাতে জানে হয়তো, কিন্তু সত্যিকার ভায়োলেন্সের সঙ্গে পরিচয় নেই বেচারির। কে জানে, হয়তো ঝোঁকের মাথায় যোগ দিয়েছে কমিউনিস্টদের সঙ্গে; কিন্তু আদপে মোটেই বিপ্লবী নয়। সত্যি সত্যি কখনও আন্দোলনে নামলে টের পাবে এই বাস্তবতা।

হঠাৎ থেমে দাঁড়াল সোনিয়া, মনে হলো ভাবনাচিন্তা করে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। রাগী গলায় বলল, ‘না, পালাব না আমি। যা খুশি করো তোমরা, সেনিয়র, কিন্তু আমি ফিরে যাচ্ছি পোর্তো ভেচিয়োয়। ওখানে গিয়ে খুনিগুলোকে ফাঁসিতে ঝোলাব।

‘ভুল করতে যাচ্ছ,’ শান্ত গলায় বলল কুয়াশা। ‘অনেক কিছুই জানো না তুমি।’

‘আমার দাদী খুন হয়েছে… এর বেশি কিছু জানার প্রয়োজন নেই আমার!’

‘ব্যাপারটা এত সহজ নয়,’ রানা বলল। ‘কথা শোনো, পাহাড়ের লোকেরা এখন পাগলা কুকুর হয়ে আছে। যাকে পাবে তাকেই খুন করে ফেলবে। কিন্তু এই উন্মাদনা খুব বেশিদিন টিকবে না। কয়েকদিন কেটে যাবার পর শান্ত হয়ে পড়বে ওরা, ফিরে যাবে নিজেদের রোজকার স্বাভাবিক জীবনে… ভয় আর আতঙ্কে জড়োসড়ো হয়ে। তার আগে কিছুতেই ওখানে ফেরা চলে না তোমার। বিচার-আচার যদি কিছু করতে চাও, তখন কোরো। তোমার দাদী এসব জানতেন, তাই জীবন দিয়েছেন নিজের, আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন তোমাকে, যাতে ততদিন তোমাকে নিরাপদে রাখি আমরা।’

‘কিন্তু কেন? কে তোমরা? এক রাতের পরিচয়… তাতেই তোমাদের উপর এত বিশ্বাস সৃষ্টি হবে কেন দাদীর?’

‘কারণ আমাদের পরিচয় জেনেছেন তিনি…. বুঝতে পেরেছেন কেন এত ঝুঁকি নিয়ে তোমাদের এলাকায় এসেছি আমরা।’:

‘আমিও জানতে চাই। কী এক তালিকা আর রাখাল বালকের কথা বলছিলেন দাদী… সেগুলো কী?’

‘এ-ব্যাপারে যত কম জানবে, ততই তোমার জন্য মঙ্গল, সোনিয়া। এর সঙ্গে কিছুতেই তোমাকে জড়াতে পারব না আমরা।’

রেগে গেল সোনিয়া। ফুঁসে উঠল ক্রুদ্ধ সিংহীর মত। ‘জড়িয়ে তো গেছিই, সেনিয়র। আমার দাদী খুন হয়েছে! কেন… সেটা জানার অধিকার আছে আমার।’

ওর সঙ্গে কথায় না পেরে কাঁধ ঝাঁকাল রানা। সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে নীরবে সাহায্য চাইল। লক্ষ করেছে, ওদের মধ্যে কুয়াশাকে কিছুটা সমীহ করে মেয়েটা।

রানার ইশারা বুঝতে পেরে এক পা এগিয়ে এল কুয়াশা। বলল, ‘ঠিক আছে, সোনিয়া। সব খুলে বলব তোমাকে… কিন্তু এখন নয়। কথা বলার মত পরিস্থিতি নেই এ-মুহূর্তে। যত দ্রুত সম্ভব এই এলাকা থেকে দূরে সরে যেতে হবে আমাদেরকে।’

‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’ জানতে চাইল সোনিয়া।

‘উপকূলের দিকে,’ রানা জানাল। ‘মুরাতো-য় থামব আমরা, ওখানে আমার পরিচিত এক লোক থাকে। ওর সঙ্গে কথা বলার পর যদি বাস্তিয়া পৌঁছুতে পারি, দ্বীপ থেকে বেরিয়ে যেতে অসুবিধে হবে না।’

‘ঠিক আছে, বাস্তিয়া পর্যন্ত যাব আমি,’ বলল সোনিয়া। ‘কিন্তু এরপর যদি সব কথা খুলে না বলো, এক পা-ও আর নড়াতে পারবে না আমাকে।

গটমট করে হাঁটতে শুরু করল ও। পিছন থেকে কয়েক মুহূর্ত ওকে নীরবে দেখল কুয়াশা, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ভাল একটা ঝামেলা জুটল, তাই না?’

‘কিছু করার ছিল না,’ শ্রাগ করল রানা।

মেয়েটার পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করল দু’জনে। কুয়াশা বলল, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ঠিক করে নেয়া দরকার, রানা। অনেক কাজ হাতে, একসঙ্গে করতে গেলে সময় লাগবে প্রচুর। তারচেয়ে দু’জনে দু’দিকে গেলে ভাল হয়। কাজও এগোবে, একসঙ্গে দু’জনকে বাগেও পাবে না ফেনিস। যোগাযোগ রাখার জন্য শিডিউল আর পয়েন্ট অভ কন্ট্যাক্ট ঠিক করে নিতে পারি আমরা এখুনি।’

‘তাড়াহুড়োর কিছু নেই,’ রানা বলল। ‘এখান থেকে বাস্তিয়ার দূরত্ব প্রায় নব্বুই মাইল। কথা বলার অনেক সময় পাওয়া যাবে।’

‘ওর সামনে কথা বলতে চাইছ না বুঝি?’ ইশারায় সোনিয়াকে দেখাল কুয়াশা। ‘যত যা-ই বলো, ও একটা বোঝা ছাড়া আর কিছু নয়। নিজেরা পালিয়ে বেড়াচ্ছি, এ অবস্থায় একটা মেয়ের দায়িত্ব নেব কী করে?

‘না নিয়ে উপায়ও নেই,’ রানা বলল। ‘অন্তত কর্সিকা থেকে বের করে নিয়ে যেতে হবে ওকে। এখানে থাকলে পাহাড়ি লোকজন ঠিকই খোঁজ বের করে ফেলবে ওর।’

‘নাহয় নিলাম-ই দ্বীপের বাইরে। তারপর?

‘সেটা তখন দেখা যাবে।’

‘দেখা যাবে মানে? কিছু ভাবছ না তুমি এ-ব্যাপারে? সত্যি করে বলো তো, মাথায় কী ঘুরপাক খাচ্ছে তোমার?’

‘ছোট্ট একটা খটকা,’ ঘাড় ফিরিয়ে কুয়াশার দিকে তাকাল রানা। ‘প্রশ্নটা কিন্তু মন্দ করেনি সোনিয়া। মারিয়া মাযোলা কেন ওকে পাঠালেন আমাদের সঙ্গে? আমাদেরকে তো চিনতেন-ই না তিনি। যে-পরিচয় দিয়েছি, সেটা মিথ্যে হতে পারত। আমরা মন্দলোক হতে পারতাম…’

‘ওই মুহূর্তে আর কেউ ছিল না তাঁর হাতের কাছে,’ মুক্তি দেখাল কুয়াশা।

‘ওটা কোনও কারণ হতে পারে না। এই পাহাড়-পর্বত আমাদের চেয়ে ভাল চেনে সোনিয়া। একাই পালাতে পারত ও ।

‘ভাবছ কোনও রহস্য আছে এতে?’

‘জানি না,’ মাথা নাড়ল রানা। ‘কিন্তু একটা জিনিস পরিষ্কার, সব প্রশ্নের জবাব না পাবার আগে কিছুতেই ওকে হাতছাড়া করা উচিত হবে না আমাদের।’

.

বাস্তিয়া থেকে প্রায় বিশ মাইল দক্ষিণে ভেসকোভাতো শহর, ওখানে এককালে বাস করেছে সোনিয়া, আশপাশের সমস্ত পথঘাট চেনে, লোকজনের দৃষ্টি এড়িয়ে রানা আর কুয়াশাকে সহজেই নিয়ে যেতে পারল শহরের কাছাকাছি। কোন্ পথে কীভাবে যাবে, তা মেয়েটাকে ঠিক করতে দিল ওরা-কিছুটা স্বাধীনতা পাক ও, নিজেকে তা হলে অচেনা দু’জন মানুষের হাতে বন্দি বলে মনে হবে না। সিদ্ধান্তটার সুফলও পাওয়া গেল—এমন সব গিরিবর্ত আর ভাঙাচোরা ট্রেইল ধরে এগোল মেয়েটা… ওসব পথে কখনও কেউ আসা-যাওয়া করে বলে মনে হলো না। কেউ ওদেরকে দেখে ফেলার ভয় নেই।

‘কনভেন্টের নান-রা পিকনিকের জন্য আমাদেরকে নিয়ে এসেছিল এখানে,’ শুকিয়ে যাওয়া একটা ঝর্ণা দেখিয়ে বলল সোনিয়া। ‘আগুন জ্বেলে রান্না করেছিলাম আমরা, জঙ্গলে ঢুকে চুরি করে সিগারেট টেনেছিলাম… আহ্, কী এক দিন ছিল সেটা!’

স্মৃতিচারণের ঝোঁক চেপেছে মেয়েটার মাথায়। আরেকটু এগোবার পর বলল, ‘এদিককার পাহাড়ের মাঝ দিয়ে সকালবেলা, চমৎকার বাতাস বয়ে যায়। যখন ছোট ছিলাম, প্রতি রোববার বাবা আমাদেরকে নিয়ে সকালবেলা ঘুড়ি ওড়াতেন।’

‘আমরা?’ জিজ্ঞেস করল কুয়াশা। ‘তোমার আরও ভাই-বোন আছে?’

‘এক ভাই আর এক বোন। দু’জনেই আমার বড়… এখনও ভেসকোভাতোয় থাকে। বিয়ে-শাদী করে পরিবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ওরা, আজকাল বলতে গেলে দেখা-সাক্ষাৎই হয় না। ওদের ব্যাপারে বলার মত তেমন কিছু নেই।

‘এখনও এখানে পড়ে আছে কেন? লেখাপড়া করেছে কতদূর??

‘বেশি না, এসবের প্রতি ঝোঁক ছিল না ওদের। সাদাসিধে টাইপের মানুষ—চাষাবাদ আর সংসারধর্মই ওদের জন্য সব। ঝুটঝামেলা পছন্দ করে না। তবে আমরা সাহায্য চাইলে ফিরিয়ে দেবে না।’

‘না, না, তাড়াতাড়ি বলল রানা। ‘সাহায্য চাওয়া তো দূরের কথা, দেখাই করার দরকার নেই।’

‘ওরা আমার আপনজন, সেনিয়র। কেন এড়িয়ে যাব ওদেরকে?’

‘এর দরকার আছে, সোনিয়া।’

‘ওটা কোনও জবাব হলো না। দেখো সেনিয়র, আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ তোমরা। জোর করে পোর্তো ভেচিয়ো থেকে সরিয়ে এনেছ, দাদীর খুনের বিচার পেতে দাওনি। এখন আবার বাধা দিতে চাইছ ভাই-বোনের সঙ্গে দেখা করবার ব্যাপারেও? তোমাদের এ-সব হুকুম মানতে রাজি নই আমি।’

অসহায় চোখে কুয়াশার দিকে তাকাল রানা। আবার মেয়েটা খেপে গেছে ওর উপর। কুয়াশা যদি বুঝিয়ে-সুজিয়ে শান্ত করতে পারে!

‘কেউ তোমাকে হুকুম দিচ্ছে না, সোনিয়া,’ নরম গলায় বলল কুয়াশা। ‘যা বলছি, তা তোমার নিরাপত্তার জন্যই বলছি। বিশ্বাস করো!’

‘আমার তা মনে হয় না। অন্ধ… অসহায়… নিরপরাধ একজন মহিলার খুনের ঘটনা ধামাচাপা দিতে চাইছ তোমরা। কেন?’

‘বললাম তো, তোমাকে বাঁচাবার জন্য। যদি মুখ খোলো, ভয়ানক বিপদ ঘনিয়ে আসবে তোমার মাথার উপর… যাদের সঙ্গে কথা বলবে, তারাও পড়বে একই বিপদে। তা হতে দেয়া যায় না।’

‘আমার দাদীকে খুন করা হয়েছে!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল সোনিয়া।

‘হ্যাঁ,’ স্বীকার করল কুয়াশা। ‘কিন্তু পুরো ব্যাপারটা শুধু এই একজনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নয়। খুব খারাপ কিছু মানুষকে ঠেকাবার জন্য লড়াইয়ে নেমেছি আমরা, তোমার দাদী সাহায্য করেছেন আমাদেরকে। জীবন দিয়েছেন… বিনিময়ে চেয়েছেন তোমার নিরাপত্তা। কী করে সেটা অগ্রাহ্য করব আমরা, বলো?’

কচি খুকির সঙ্গে কথা বলছ না তোমরা,’ রাগতস্বরে বলল সোনিয়া। ‘খুব খারাপ মানুষ বলতে কী বোঝাতে চাইছ? খুলে বলো, আমাকে।‘

চোখে চোখে কথা হলো রানা-কুয়াশার। দুজনেই বুঝতে পারছে, মেয়েটাকে অন্ধকারে রাখার উপায় নেই আর। পুরোটা না হোক, সামান্য হলেও আভাস দিতে হবে ওকে, নইলে ঝামেলা পাকাবে। তাই মুখ খুলল রানা।

‘ওরা একদল খুনি, সোনিয়া,’ বলল ও। দলটা কতবড়, তা জানি না; তবে এটুকু জানি, প্রচুর ক্ষমতা ওদের। আর দশটা সাধারণ খুনিও নয় এরা মানুষ হত্যা করে নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে… বাছাই – করে। এর ফলে সংঘাত সৃষ্টি হয় দুনিয়ার আনাচে-কানাচে—ব্যক্তিগত সংঘাত, রাজনৈতিক সংঘাত এবং আন্তজার্তিক সংঘাত! ওরা রয়ে যায় আড়ালে।’ এটুকু বলে সোনিয়ার প্রতিক্রিয়া দেখল রানা—মনোযোগ দিয়ে কথা শুনছে মেয়েটা। ‘তুমি শিক্ষিত, আধুনিক মেয়ে, সোনিয়া। আমার আর আমার বন্ধুর মধ্যকার সম্পর্কটার গুরুত্ব বুঝতে পারবে। মি. কুয়াশাকে আণ্ডারগ্রাউণ্ডের অত্যন্ত প্রতিভাবান এক ক্রিমিনাল বলতে পারো, সেই সঙ্গে প্রথম সারির একজন বিজ্ঞানী; আর আমি, মাসুদ রানা, আইনের লোক। তারপরেও পরস্পরবিরোধী আমরা একত্র হয়েছি ওই খুনিদেরকে ঠেকানোর জন্য। কারণ, গোটা পৃথিবীর জন্য ওরা এত ভয়ঙ্কর হুমকি যে, তার সামনে আমাদের দু’জনের বিভেদটা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। জটিল এক ষড়যন্ত্র এঁটেছে ওরা, সেটা বানচাল করতে না পারলে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে যুদ্ধ-বিগ্রহ আর অরাজকতার কবলে পড়ে।’

‘তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে রানার মুখভঙ্গি লক্ষ করল সোনিয়া। সন্তুষ্ট হয়ে বলল, ‘সত্যি কথা বলার জন্য ধন্যবাদ, সেনিয়র রানা। কিন্তু এসবের সঙ্গে আমার দাদীর কী সম্পর্ক?’

‘ষড়যন্ত্রটার যখন সূচনা ঘটে, সেখানে উপস্থিত ছিলেন তিনি, ‘ বলল রানা। ‘প্রায় পঁচাত্তর-বছর আগে… ভিলা বারেমিতে।’

‘পঁচাত্তর বছর আগে!’ অবাক হয়ে গেল সোনিয়া। ‘তোমরা বলতে চাইছ, এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে দাদীর পাদ্রোনি… মানে কাউণ্ট গিলবার্তো জড়িত?’

‘শুধু জড়িত না, পুরোটাই তাঁর উর্বর মস্তিষ্কের ফসল। অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাবান লোক ছিলেন তিনি, ফ্রান্স আর ইংল্যাণ্ডে তাঁর সমকক্ষ আর কেউ ছিল না। দেশদুটোর ব্যবসায়ীদের নানাভাবে হেনস্থা করেছেন, তাই সরকারের সঙ্গে জোট বেঁধে ব্যবসায়ীরা তাঁর পতন ঘটায়… খুন করে তাঁর দুই ছেলেকে। এর ফলে পাগল হয়ে যান তিনি, আত্মহত্যা করেন। কিন্তু মরার আগে প্রতিশোধ নেবার জন্য দীর্ঘমেয়াদী এক পরিকল্পনা তৈরি করে রেখে যান একদল শিষ্যের কাছে। কাউন্সিল অভ ফেনিস নাম নিয়ে এরপর থেকে খুনোখুনির ব্যবসায় নামে ওরা। মাঝে বহু বছরের জন্য আণ্ডারগ্রাউণ্ডে চলে গিয়েছিল, কিন্তু এখন আবার ফিরে এসেছে—আগের চেয়ে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে। যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে কাউণ্ট বারেমির ইচ্ছে পূর্ণ হতে দেরি নেই আর। চরম সর্বনাশ ঘটে যাবার আগেই ঠেকাতে হবে ওদেরকে।’ এটুকু বলে থেমে গেল রানা, প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই বলে ফেলেছে। যতকিছু তোমার পক্ষে বোঝা সম্ভব, তা আমি খুলে বললাম, সোনিয়া। ভুল বুঝো না, তোমার দাদীর ব্যাপারে সত্যিই দুঃখিত আমরা। ওঁর খুনিদের শাস্তি চাও তুমি… আমরাও চাই। আশা করি একদিন তা হবেও। কিন্তু এ-মুহূর্তে পাহাড়ি কিছু মূর্খ লোককে শায়েস্তা করার চেয়ে অনেক জরুরি কাজ ‘আছে আমাদের হাতে।’ .

কয়েক মুহূর্ত নীরব রইল সোনিয়া। একটু পর মাথা তুলে সরাসরি তাকাল রানার দিকে। ‘ওদের কোনও গুরুত্ব নেই তোমাদের কাছে… তারমানে আমারও গুরুত্ব নেই, তাই না?’  

‘আমি তা বলিনি।‘

‘ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা কোরো না, সেনিয়র। বুঝতে পারছি, কী করছ তোমরা… কার কাছ থেকে কী তথ্য পাচ্ছ, তা জানতে দিতে চাও না কাউকে। এজন্যেই দাদীর ব্যাপারে কাউকে কিছু বলতে দিচ্ছ না আমাকে। তাতে তোমাদের খবর ফাঁস হয়ে যাবে। যদি কথা না শুনি, হয়তো চিরতরে চুপ করাবে আমাকে!’

‘এসব তোমার ভুল ধারণা। তবে হ্যাঁ, এ-মুহূর্তে তোমাকে ছাড়তে পারব না আমরা।’

‘তারমানে আমি তোমাদের বন্দি?’

‘মোটেই না,’ বলে উঠল কুয়াশা। ‘বরং আমাদের মত তুমিও একই পথের পথিক। ফেনিসের খবর জেনে ফেলায় আমার আর রানার নামে মৃত্যু-পরোয়ানা জারি হয়েছে… অনেকটা তোমারই মত। আমাদের সঙ্গে থাকলেই তোমার জন্য ভাল হবে।’

‘সাহস জোগাচ্ছ, নাকি হুমকি দিচ্ছ তুমি, সেনিয়র?’ ফুঁসে উঠল সোনিয়া।

মেজাজ খিঁচড়ে গেল রানার। এতক্ষণ বোঝানোর পরেও যদি এমন আচরণ করে কেউ, মাথা ঠাণ্ডা রাখা মুশকিল। রূঢ় কণ্ঠে বলল, ‘যা খুশি ভাবতে পারো। কিন্তু আমাদের সঙ্গে থাকছ তুমি।’

‘কতদিন…… বা কতটা সময়, সেনিয়র? আমাকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত কী করবে তোমরা?

‘এখুনি ওসব বলতে পারছি না। সময় এলে দেখা যাবে,’ বলল কুয়াশা। ‘আপাতত বাস্তিয়া পর্যন্ত চলো…. আর আস্থা রাখো আমাদের উপর। নিশ্চিত থাকতে পারো, আমাদের হাতে তোমার কোনও ক্ষতি হবে না।

হতাশায় মাটিতে পা ঠুকল সোনিয়া। কুয়াশার কথা বিশ্বাস করেনি ও।..

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *