সেই কুয়াশা ১.১৫

পনেরো

চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিলেন বৃদ্ধা, তাঁর দৃষ্টিহীন চোখদুটো সেঁটে রইল ছাতের দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচুকণ্ঠে নিজের কাহিনি বলতে শুরু করলেন তিনি।

.

‘বোনাফাসিয়ো-র এক কনভেন্টে আমার সন্ধান পান পাদ্রোনি, টাকা দিয়ে ওখান থেকে কিনে নেন আমাকে। কনভেন্টের মাদার সুপ্রিম আপত্তি করেননি, তাঁর মনে স্থির বিশ্বাস জন্মেছিল- ধর্মকর্ম হবে না কোনোদিন আমাকে দিয়ে, নান হবার তো প্রশ্নই ওঠে না। দুরন্ত স্বভাবের মেয়ে ছিলাম আমি, লেখাপড়া করতাম না মোটেই, কথা শুনতাম না কারও। কনভেন্টে আয়না ছিল না, তারপরেও রাতের বেলা বসে যেতাম জানালার কাঁচের সামনে, ওতেই চেহারার প্রতিফলন দেখে সাজগোজ করবার চেষ্টা চালাতাম। আমার পাল্লায় পড়ে অন্য মেয়েরাও বখে যাচ্ছিল, তাই পাদ্রোনির হাতে আমাকে তুলে দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলেন মাদার সুপ্রিম।

‘বয়স আমার খুব বেশি না তখন, মাত্র পনেরো বছর। কনভেন্ট থেকে মুক্তি পেয়ে নতুন এক দুনিয়ায় প্রবেশ করলাম। রূপায় বাঁধানো চাকা, আর তেজি চার ঘোড়ায় টানা এক ক্যারিজে করে আমাকে নিয়ে আসা হলো পাহাড়ে ঘেরা অপূর্ব সুন্দর এই জায়গায়। স্বাধীনতা আর সুখ কাকে বলে, তা টের পেলাম তখনই। গাঁয়ের যে-কোনও জায়গায় যেতে পারতাম আমি, দোকানে ঢুকে যা-খুশি-তাই কিনতে পারতাম; কোনও বাধা-নিষেধ ছিল না। কনভেন্টে তো নয়ই, বাবা-মা’র কাছে ও এমন স্বাধীনতা পাইনি কোনোদিন। গরীব কৃষক ছিলেন আমার বাবা, মা ছিলেন ধর্মভীরু এক গৃহিণী—মেয়েকে সারাদিন ঘরে বন্দি করে রাখতেন। ঘরে খাবার জুটত না, তাই আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কনভেন্টে। এরপর আর কোনোদিন তাঁদেরকে দেখিনি আমি।

‘যা-হোক, পাদ্রোনি সবসময় আমার সঙ্গে থাকতেন… আগলে রাখতেন আমাকে। যেন তিনি এক সিংহ, আর আমি তাঁর সিংহছানা। আমাকে নিয়ে পুরো এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন তিনি, নিজের সাম্রাজ্য চেনাতেন, নিয়ে যেতেন বনেদি ঘরগুলোয়। সবার কাছে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন নিজের বান্ধবী হিসেবে—কথাটা বলার সময় হাসিতে ভরে উঠত তাঁর মুখ বিপত্নীক ছিলেন তিনি, বয়স চলছিল সত্তর। কিন্তু তারপরেও তাঁর যৌবন যে অটুট আছে, এটাই বুঝি বোঝাতে চাইতেন সবাইকে…. এমনকী নিজের দুই ছেলেকেও। হাজার হোক, অল্পবয়েসী একটা মেয়েকে শয্যাসঙ্গিনী বানানোর ক্ষমতা তো সব বুড়ো মানুষের থাকে না!

‘আমার জন্য শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিল ভিলাতে। উচ্চবংশের রীতিনীতি-চালচলন, সঙ্গীত, অঙ্কশাস্ত্র, ইতিহাস, ফরাসি ভাষা… সোজা কথায় বনেদি পরিবারের মেয়েদের যা যা শেখা দরকার, তার সবই শেখানো হয়েছিল আমাকে। চমৎকার এক সময় ছিল সেটা। মাঝে মাঝে সমুদ্রযাত্রায় যেতাম আমরা-রোম থেকে · জাহাজে চাপতাম; প্ৰথমে যেতাম সুইটজারল্যাণ্ডে, তারপর যেতাম ফ্রান্সে …. প্যারিসে। ওই দু’দেশেই আমার পাদ্রোনির সহায়-সম্পত্তি আর ব্যবসা ছিল, তাঁর দুই ছেলে দেখাশোনা করত ওসবের। মাসছয়েক পর পর গিয়ে সবকিছুর হিসেব নিতেন পাদ্রোনি।

‘টানা তিনটে বছর দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মেয়ে ছিলাম আমি… আমার পাদ্রোনির দয়ায়। কিন্তু এরপরেই সেই সুখের পৃথিবী তছনছ হয়ে গেল। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে ধ্বংস হয়ে গেল সবকিছু, আর কাউণ্ট গিলবার্তো বারেমি পাগল হয়ে গেলেন।

‘খবর জানানোর জন্য প্যারিস আর জুরিখ থেকে লোক এল… এল এমনকী লণ্ডনের বিখ্যাত বিজনেস এক্সচেঞ্জ থেকেও। ওরা, বলল, গত চার মাসে পাদ্রোনির ছেলেরা বোকার মত বেশ কিছু কাজ করেছে, পরিচয় দিয়েছে চরম অদূরদর্শিতার। সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হলো—অসৎ কিছু চুক্তি করেছে তারা; এমন সব লোকজনকে টাকা দিয়েছে, যারা প্রচলিত আইন আর ব্যবসায়িক জগৎকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অন্যায় কাজ করে বেড়ায়। এর ফলে ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড আর সুইটজারল্যাণ্ড সরকার তাদের সমস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে, আটক করে দিয়েছে ব্যাঙ্কে জমিয়ে রাখা সমস্ত টাকা-পয়সাও। সোজা কথায়… জেনোয়া আর রোমে গচ্ছিত কিছু টাকা ছাড়া কাউণ্ট বারেমি নিঃস্ব হয়ে গেছেন।

‘টেলিগ্রাম করে দুই ছেলেকে পোর্তো ভেচিয়োয় ডেকে পাঠালেন পাদ্রোনি, তাদের মুখ থেকে সবকিছু শুনবেন। কিন্তু তার জবাবে যে-সংবাদ এল, তাতে যেন বাজ পড়ল তাঁর মাথায়… স্বাভাবিক হতে পারলেন না আর কোনোদিন।

‘প্যারিস আর লণ্ডন থেকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানাল, তাঁর দুই ছেলেই মারা গেছে—একজন আত্মহত্যা করেছে; অন্যজনকে গুলি করে হত্যা করেছে এমন এক লোক, যে পাদ্রোনির ছোট ছেলের কারণে সর্বস্ব হারিয়েছে। এরপরে আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না আমার পাদ্রোনির, তাঁর সাজানো-গোছানো জগৎ চুরমার হয়ে গেল চারপাশে। ভিলার লাইব্রেরিতে ঢুকে নিজেকে বন্দি করে ফেললেন তিনি, দরজা খুলে খাবার নেবার সময় ছাড়া দেখা পাওয়া যেত না তাঁর… কারও সঙ্গে কথাও বলতেন না। আমার সঙ্গে শোয়াও বন্ধ করে দিলেন, জানালেন—নারীদেহের প্রতি সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। ধীরে ধীরে নিজেকে ধ্বংস করে দিতে লাগলেন পাদ্রোনি… এ এক ধরনের আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছুই না।

‘তারপর… একদিন… প্যারিস থেকে এল এক সাংবাদিক। প্রায় জোর করেই পাদ্রোনির সঙ্গে দেখা করল, সে, কী নাকি জরুরি কথা আছে। অদ্ভুত এক গল্প শোনাল লোকটা… বারেমির ‘ ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের পতন সম্পর্কে রিপোর্ট করতে গিয়ে নাকি জানতে পেরেছে ওসব। সেই গল্প শোনার আগে পাদ্রোনি হয়তো আধ-পাগল ছিলেন, কিন্তু এরপরে পুরোপুরিই উন্মাদ হয়ে গেলেন।

‘সাংবাদিক জানাল, বারেমির পতন আসলে এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের ফসল… সরকারের সঙ্গে মিলে ব্যবসায়ীরা নাকি ঘটিয়েছে ওসব। কূটকৌশল খাটিয়ে পাদ্রোনির দুই ছেলেকে দিয়ে অন্যায় সব চুক্তিতে সই করানো হয়েছে, ব্ল্যাকমেইল করে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। শেষ পর্যন্ত খুন করা হয়েছে ওদেরকে; সরকারিভাবে মৃত্যুর যে-ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, তা সাজানো কাহিনি ছাড়া আর কিছু নয়

‘এসব শুনে থমকে গেলেন পাদ্রোনি। কথাগুলো বিশ্বাসের অতীত। কেন করা হবে এসব? তাঁকে পথে বসানো হয়েছে ভাল কথা… কিন্তু কেন তাঁকে নিঃসন্তান বানাল ওরা?

‘জবাবে একটা শোনা কথা বলল সাংবাদিক : গোটা ইয়োরোপের জন্য একজন পাগলা কর্সিকান-ই যথেষ্ট! তার উত্তরাধিকারীর প্রয়োজন নেই। আর কোনও ব্যাখ্যার প্রয়োজন হলো না, সব বুঝে নিলেন পাদ্রোনি।

‘ইংল্যাণ্ডে রাজা এডওয়ার্ড মারা গেছেন বটে, কিন্তু মরার আগে ফরাসি আর ইংরেজদের মাঝে একগাদা ব্যবসায়িক চুক্তি করে গেছেন। এর ফলে বড় বড় কোম্পানিগুলো একত্র হতে পারবে, একচেটিয়াভাবে ফায়দা লুটতে পারবে ভারত, আফ্রিকা আর সুয়েজ থেকে। কিন্তু আমার পাদ্রোনি ছিলেন কর্সিকান, ইংরেজ আর ফরাসিদের কাছ থেকে ব্যবসা ছিনিয়ে নেয়া ছিল তাঁর অভ্যেস। নিজের কোম্পানি কিছুতেই ওদের সঙ্গে যুক্ত করবার প্রস্তাবে রাজি হননি, বরং ছেলেদেরকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, ওই দুই জাতের প্রতিদ্বন্দ্বীদেরকে যে-কোনও মূল্যে দমিয়ে রাখতে হবে। এডওয়ার্ডের চুক্তিগুলো তাই কোনও কাজে আসছিল না, একচেটিয়া ব্যবসা করতে পারছিল না ইংরেজ আর ফরাসিরা, ক্রমাগত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছিল।

‘আমার পাদ্রোনির জন্য পুরোটাই ছিল এক খেলা, কিন্তু ফরাসি আর ইংরেজদের চোখে তাঁর ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড ছিল অক্ষমণীয় অপরাধ; এর জবাব ওরা দিয়েছিল আরও বড় অপরাধ করে। বাধা দেবার কেউ ছিল না, শাস্তি দেবার কেউ ছিল না…. দু’দেশের সরকারই ছিল ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। যার কাছে টাকা থাকে, তার পায়ের তলায় গড়াগড়ি খায় আইন-আদালত, পুলিশ আর রাজনীতিক থেকে শুরু করে রাজা-বাদশা পর্যন্ত। এই কঠিন সত্যটাই উন্মাদনার জন্ম দিয়েছিল পাদ্রোনির মধ্যে। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ধ্বংস করে দেবেন দুর্নীতিবাজদেরকে—বিভিন্ন দেশের সরকারকে ফেলবেন চরম অরাজক পরিস্থিতির মাঝে, যাতে রাজনৈতিক নেতারা দিশে হারিয়ে ফেলে। তাঁর চোখে ওরাই ছিল আসল অপরাধী… ওদের সাহায্য না পেলে কিছুই করতে পারত না ব্যবসায়ীরা, পাদ্রোনির ছেলেরা বেঁচে থাকত। প্রতিশোধ নেবার একটাই উপায়, সরকারকে বিপদে ফেলে দেয়া, যাতে ব্যবসায়ীরা তাদের রক্ষাকবচ হারায়।

‘“পাগলা কর্সিকান দেখতে চায় ওরা?”’ চেঁচিয়ে উঠেছিলেন পাদ্রোনি। “বেশ, তা-ই দেখাব আমি ওদেরকে!”

‘শেষবারের মত একবার রোমে গেলাম আমরা—সেবার আর ধনী জমিদারের মত রূপায় মোড়া ক্যারিজে চেপে, কিংবা একগাদা চাকরবাকর নিয়ে নয়, বরং খুব সাধারণ সাজে… শুধু আমরা দু’জন। উঠলামও ভিয়া দ্যু মাচেলি-র সস্তা বোর্ডিং হাউসে। বোর্সা ভ্যালোরি-তে কয়েকদিন আসা-যাওয়া করলেন পাদ্রোনি; পড়াশোনা করলেন বিখ্যাত বিভিন্ন পরিবারের ইতিহাস নিয়ে, যারা নানা কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে।

‘কর্সিকায় ফিরে পাঁচটা চিঠি লিখলেন তিনি— পাঁচ দেশের পাঁচজন বিখ্যাত পরিবারের মানুষকে, আমন্ত্রণ জানালেন গোপনে ভিলা বারেমিতে আসবার জন্য। এতে নাকি উপকৃত হবে তারা… তাদের পরিবারের প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে, তার সুবিচার মিলবে। বলা বাহুল্য, একদা-মহান গিলবার্তো বারেমির নিমন্ত্ৰণ অগ্রাহ্য করল না কেউ। এমনিতেই পাদ্রোনির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এই পাঁচজন মানুষ, পাল্টা চিঠি পাঠিয়ে জানালেন—যথাসময়ে হাজির হবেন তাঁরা।

‘অভিথিদের আগমন উপলক্ষ্যে বিশাল আয়োজন করা হলো, ভিলা বারেমিকে সাজানো হলো সুন্দর করে। নতুন রঙ চড়ানো হলো বাড়ির ভিতর-বাইরের প্রতিটা দেয়ালে, বাগানগুলোতে ফোটানো হলো রঙ-বেরঙের ফুল, ঘাস ছাঁটা হলো আঙিনার, আলোকসজ্জা করা হলো। আস্তাবলের সব ঘোড়ার পরিচর্যা করা হলো, তেল মাখিয়ে চকচকে করে তোলা হলো ওগুলোর শরীর। – চাকর-বাকরদের দেয়া হলো নতুন পোশাক, বাড়ির মেঝে করে তোলা হলো আয়নার মত চকচকে। ভিলাকে এমন সুন্দর সাজে সাজতে দেখিনি আমি কখনও, প্রথম দর্শনে স্বপ্নপুরীর মত লাগবে যে-কারও। পাদ্রোনি-ও মনে হলো বদলে গেছেন—ছোটাছুটি করছেন সবখানে, প্রতিটা জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন নিজে, ভুল-ত্রুটি হলে শুধরে দিচ্ছেন নিজের হাতে। প্রাণশক্তি যেন ফিরে এসেছে তাঁর মাঝে, কিন্তু আগের মত নয়। কেন যেন খুব রুক্ষ আর নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছেন। কেউ ভুল করলেই তাকে চাবুকপেটা করতে দ্বিধা করছেন না।

‘ওদেরকে মনে করিয়ে দেয়া দরকার অতীত,’ নিজের আচরণের ব্যাখ্যা দিলেন তিনি আমার কাছে। ‘সবাই ভুলে গেছে ভিলা বারেমির স্বর্ণযুগের কথা।’

‘আমার সঙ্গে আবার শুভে শুরু করলেন পাদ্রোনি, কিন্তু তাতে হৃদয়ের ছোঁয়া রইল না। আমার সঙ্গে শুধু পৌরুষের প্রদর্শনী করেন… জোর খাটান… ভালবাসেন না আগের মত

‘এসব দেখে আশু-ঘটনার আঁচ পাওয়া উচিত ছিল আমাদের… মানে, বাড়ির সবার। তা হলে হয়তো এড়াতে পারতাম বিপদ। এই আমি… পাদ্রোনিকে ভালবাসতাম পিতা আর প্রেমিকের মত… তবুও হয়তো ছুরি বসিয়ে দিতাম তাঁর বুকে।

‘যা হোক, ভয়াল সেই দিন এল-এপ্রিলের চার তারিখ, উনিশশো ছত্রিশ। বিদেশ থেকে জাহাজ এসে পৌঁছুনোর খবর পেলাম আমরা। ঘোড়ায় টানা ক্যারিজ পাঠিয়ে দেয়া হলো সম্মানিত অতিথিদেরকে নিয়ে আসবার জন্য। কী এক দিন সেটা… নববধূর মত সেজেছে ভিলা বারেমি; বাগানে বাজছে  

মিষ্টি-মধুর সঙ্গীত; বড় বড় টেবিল বসানো হয়েছে, তাতে নানা রকম খাবার-দাবার আর পাদ্রোনির সেলার থেকে আনা ইয়োরোপের সেরা মদ!

‘অতিথিদের প্রত্যেককে আলাদা কামরা দেয়া হলো—প্রতিটার সঙ্গে ব্যালকনি আছে। সেখান বসে পাহাড়ি এলাকার অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করা যায়। একজন করে সঙ্গিনীও পেলেন তাঁরা-সারা কর্সিকা দ্বীপ তন্নতন্ন করে খুঁজে বের করা সুন্দরী পাঁচজন কুমারী যুবতী… অতিথিদের মনোরঞ্জন করবে তারা।

‘রাত এলে ভিলার বিশাল হলঘরে নৈশভোজের আয়োজন করা হলো, এমন ভোজ আর কখনও হয়নি ভিলা বারেমির ইতিহাসে। খাওয়াদাওয়া শেষ হলে ভৃত্যরা ব্র্যাণ্ডি পরিবেশন করল, তারপর ওদেরকে রান্নাঘরে পাঠিয়ে দিলেন পাদ্রোনি। বলে দিলেন, ডাক না পেলে সেখান থেকে যেন বের না হয় কেউ সঙ্গীতশিল্পীদেরকেও পাঠিয়ে দেয়া হলো বাগানে, সেখানে বসে গান-বাজনা করবে তারা। আমাদেরকে… মানে, মেয়েদেরকে বলা হলো ওপরতলায় যার যার মনিবের কামরায় গিয়ে অপেক্ষা করতে।

‘মদ খেয়ে চুর হয়ে আছি আমরা মেয়েরা, কিন্তু বাকিদের সঙ্গে পার্থক্য আছে আমার। পাদ্রোনির বান্ধবী আমি, জানি বড় কোনও ঘটনা ঘটতে চলেছে। তিনি আমার পিতা… আমার প্রেমিক… ইচ্ছে হলো অংশীদার হই সেই বিশাল ঘটনার। তা ছাড়া গত তিন বছরে শিক্ষা-দীক্ষা পেয়ে কিছুটা জাতে উঠে গেছি, পাহাড়ি মেয়েদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে মজা পাই না। তাই বাকিরা ‘চলে গেলেও আমি গেলাম না। দোতলা পর্যন্ত গিয়ে আবার চুপিসারে ফিরে এলাম; হলঘরের উপরে, ঝুলবারান্দার রেলিঙের আড়ালে লুকিয়ে দেখতে শুরু করলাম কী ঘটে।

‘লম্বা এক ভাষণ দিতে শুনলাম আমার পাদ্রোনিকে, সব কথার মর্মার্থ বুঝলাম না, তবে এটুকু বুঝলাম — অন্তরের গহীন থেকে দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে প্রতিটা বাক্য উচ্চারণ করছেন তিনি, শ্রোতাদের মগজের গভীরে গেঁথে দিচ্ছেন নিজের বক্তব্য… প্রতিটা নির্দেশ। একেক সময় মনে হচ্ছিল, ঘোরের মধ্যে আছেন তিনি, গলার স্বর গমগম করছিল পুরো হলঘর জুড়ে।

‘অতীতের কথা বললেন তিনি—মহান সেসব মানুষের কথা… যারা ঈশ্বরের কৃপা আর নিজের চেষ্টায় রাজ্য গড়েছিল। ইস্পাতকঠিন হাতে এসব রাজ্য শাসন করত তারা, যাতে তাদের রাজত্ব… তাদের কষ্টের ফসল কেউ ছিনিয়ে নিতে না পারে। কিন্তু সেসব দিন চলে গেছে। সেসব মহান পরিবার আর রাজ্য-প্রতিষ্ঠাতাদের… যাদের উত্তরাধিকারীরা হলঘরে বসে আছে… কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে সব। ন্যায়-নীতিহীন তস্করের দল, আর তাদেরকে প্রশ্রয় দেয়া সরকারেরা মহান পরিবারগুলোকে মিশিয়ে দিয়েছে মাটির সঙ্গে। এভাবে আর চলতে পারে না, কামরায় উপস্থিত সবাইকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে—যেভাবে হোক, নিজেদের পুরনো শৌর্য-বীর্য পুনরুদ্ধার করবে তারা। আর এ-জন্য প্রয়োগ করতে হবে ভিন্ন কৌশল।

‘হত্যা করবে ওরা—সতর্কভাবে, বাছাই করে! দক্ষতা এবং দুঃসাহসের সঙ্গে। হত্যার মাধ্যমে তস্করের দল এবং তাদের রক্ষাকর্তা দুর্নীতিবাজ সরকারগুলোকে খণ্ড-বিখণ্ড করে দেয়া হবে। উপস্থিত শ্রোতারা কখনোই সরাসরি এ-কাজ করবে না, তারা হবে শুধুমাত্র সিদ্ধান্তদাতা… কাকে কখন হত্যা করা হবে, সেটার নির্ধারণকারী। যেখানে সম্ভব, সেখানে দুর্নীতিবাজদের মাধ্যমেই বাছাই করা হবে শিকার, ওদের কথামত… ওদের দেয়া টাকার বিনিময়ে সরিয়ে দেয়া হবে নিজেদের কাঙ্ক্ষিত টার্গেটকে। পুরাণের ফিনিক্স পাখির মত ছাইভস্ম থেকে আবার জন্ম হবে এই মানুষগুলোর, তাই ওরা কাউন্সিল অভ ফেনিস নামে পরিচয় পাবে। দুনিয়ার সমস্ত ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুগুলোতে ছড়িয়ে দিতে হবে নিজেদের কথা— জানাতে হবে, অজ্ঞাত একদল মানুষের উদয় হয়েছে, যারা রক্ত ঝরাতে কুণ্ঠাবোধ করে না; টাকা দিলে তাদের মাধ্যমে যে-কাউকেই কবরে পাঠানো সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা, যারা ফেনিসের কাউন্সিলকে ভাড়া করবে, তাদের পরিচয় কোনোদিনই ফাঁস হবার ভয় নেই। এভাবে দুর্নীতিবাজদের বর্ম ব্যবহার করে ওদেরকেই খতম করার কাজ করে যাবে কাউন্সিল।

‘কিন্তু কীভাবে করা হবে এসব? কাউন্সিল যদি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে, তা হলে কে করবে নোংরা কাজগুলো? অতিথিদের এসব প্রশ্নের জবাবে শত-সহস্র বছর আগে ফারাও সম্রাট আর আরব রাজাদের তৈরি করা খুনিদের কথা শোনালেন পাদ্রোনি। জানালেন, কীভাবে মানুষকে ভয়ানক সব কাজ করাবার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া যায়, স্বেচ্ছায় বা সজ্ঞানে যে-কাজ কিছুতেই করবে না সে। মগজ-ধোলাই করতে হবে তাদের, লোভ দেখাতে হবে পরবর্তী জীবন অনন্ত সুখের… এরচেয়ে বড় প্রেরণা আর কিছু নেই পৃথিবীতে। এভাবে সদস্য যোগাড় করবে ফেনিস… এরাই হবে কাউন্সিলের অস্ত্র, তাদের সৈনিক।

‘বলা বাহুল্য, শুরুতে ফেনিসের ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করবে ক্ষমতাসীনদের মাঝে। অবিশ্বাস করবে ওরা, হয়তো বা ঠেকানোর জন্যও মরিয়া হয়ে উঠবে। এসব পদক্ষেপ দমন করতে হবে কঠোর হাতে। সৃষ্টি করতে হবে ভয়ানক সব উদাহরণের।

‘পরবর্তী কয়েক বছরে নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে হত্যা করা হবে। এদেরকে বাছাই করা হবে চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে; খুন করা হবে এমন সব পদ্ধতিতে, যাতে অবিশ্বাস আর সন্দেহের ঢেউ বয়ে যায়-এক রাজনৈতিক দল লেগে যায় আরেক রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে… এক সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করে আরেক সরকারের বিরুদ্ধে। এর ফলে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে বিশ্বজুড়ে, ঘটবে রক্তপাত… কিন্তু তার মাঝে একটা বার্তা পৌঁছে যাবে সবার কাছে: ফেনিস-এর অস্তিত্ব আছে।

‘ভাষণ শেষ করে অতিথিদের সবার মাঝে হাতে লেখা কিছু কাগজ বিতরণ করলেন পাদ্রোনি। এই পাতাগুলোর মাঝেই লুকানো থাকবে ফেনিসের শক্তি, ভবিষ্যতের নির্দেশনা। ‘কাউন্সিলের সদস্য ছাড়া আর কেউ কোনোদিন দেখতে পাবে না ওগুলো। পাদ্রোনি জানালেন, এই কাগজগুলোই তাঁর শেষ . উইল… উপস্থিত অতিথিরা তাঁর উত্তরাধিকারী।

‘কীসের উত্তরাধিকার? প্রশ্ন করলেন অতিথিরা। পাদ্রোনির জন্য সহানুভূতি আছে তাঁদের, কিন্তু তিক্ত কথা বলতে দ্বিধা করলেন না। ভিলার সৌন্দর্য আর আপ্যায়ন দেখে মুগ্ধ তাঁরা, তবে কাউণ্ট যে নিঃস্ব হয়ে গেছেন, তা তো অজানা নয় কারও! উপস্থিত সবারই কম-বেশি একই দশা। সামান্য জমিজমা ছাড়া তাঁদের কারোই কিছু নেই। ও দিয়ে কালেভদ্রে চোখ-ধাঁধানো নৈশভোজ হয়তো আয়োজন করা সম্ভব, কিন্তু যে বিশাল কাজ করতে চাইছেন পাদ্রোনি, সেসবের খরচ তো মেটানো যাবে না। কোথায় পাবেন তাঁরা টাকা?

‘সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নটার জবাব দিলেন না পাদ্রোনি। তার বদলে জানতে চাইলেন, তাঁর প্রস্তাবের সঙ্গে সবাই একমত কি না। ওঁরা কাউন্সিল অভ ফেনিসের সদস্য হতে রাজি আছেন কি না।

‘একে একে ইতিবাচক জবাব দিতে শুরু করলেন অতিথিরা, একেকজনের কণ্ঠ আগেরজনের চাইতে চড়া… শপথ নিলেন, পাদ্রোনির নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন, তাঁদের পরিবারের প্রতি যে-অন্যায় করা হয়েছে, তার ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ নেবেন। বোঝা যাচ্ছিল, ওই মুহূর্তে পাদ্রোনি ওদের রক্ষাকর্তা এবং ঈশ্বরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

‘দ্বিমত পোষণ করল শুধু একজন। সবশেষ মানুষটা… ধর্মভীরু এক স্প্যানিয়ার্ড, সরাসরি জানিয়ে দিল অস্বীকৃতি। বাইবেল আওড়াতে শুরু করল সে, বলল আমার পাদ্রোনি পাগল হয়ে গেছেন, তাই উচ্চারণ করছেন এসব আবোল-তাবোল কথা। অন্যদেরকে ভুল পথে পরিচালিত করবার চেষ্টা করে তিনি ঈশ্বরের চোখে কত বড় পাপ করছেন, তা উল্লেখ করতেও ভুলল না।

‘পিনপতন নীরবতা নেমে এল হলঘরে। অগ্নিদৃষ্টিতে স্প্যানিয়ার্ডের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন পাদ্রোনি। তারপর থমথমে গলায় বললেন, ‘আমি তোমাদেরকে ভুল পথে পরিচালিত করছি?’

‘অবশ্যই, স্যর,’ বলল লোকটা। ‘আমি এতে কিছুতেই সায় দিতে পারছি না।

‘বীভৎস যে-ঘটনাপ্রবাহ একটু পর শুরু হবে, তার সূচনা ঘটল ওখানে। কোমরের হোলস্টার থেকে রিভলবার বের করে আনলেন পাদ্রোনি, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলি করলেন স্প্যানিয়ার্ডকে। কপালে একটা ফুটো নিয়ে চেয়ার-সহ উল্টে পড়ল লোকটা। বাকি অতিথিরা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন নিহত সঙ্গীর দিকে।

‘প্রাণ নিয়ে ওকে কিছুতেই এখান থেকে যেতে দিতে পারতাম না আমি,’ শান্ত গলায় বললেন পাদ্রোনি।

‘যেন কিছুই ঘটেনি, এমন ভঙ্গিতে আবার যার যার আসনে বসলেন অতিথিরা। সবার চোখ সেঁটে রইল শক্তিমান কাউণ্টের উপরে, যিনি নির্দ্বিধায় যে-কারও প্রাণ নিতে পারেন। কে জানে, হয়তো বা ভয়ও পাচ্ছিলেন ওঁরা। যা হোক, সবাই বসলে আবার কথা বললেন পাদ্রোনি।

‘এখানে উপস্থিত সবাই আজ থেকে আমার উত্তরাধিকারী,’ বললেন তিনি। ‘কারণ তোমরা, আর তোমাদের পরের প্রজন্মগুলো কাউন্সিল অভ ফেনিসের মাধ্যমে সেই কাজ করবে, যা আমার পক্ষে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। বয়স হয়েছে আমার… বুড়ো হয়ে গেছি, মৃত্যু সমাগত। আমার হয়ে তোমরাই ধ্বংস করবে দুর্নীতির ধারক আর রক্ষকদেরকে। তোমরাই ছড়িয়ে দেবে অস্থিরতা আর বিশৃঙ্খলা, আর তার মাধ্যমে মালিক হবে পৃথিবীর। ফিরে পাবে নিজেদের হারানো সাম্রাজ্য… হারানো গৌরব। আমি যা দিয়ে যাব তোমাদেরকে, তার চেয়ে বহুগুণ বড় হবে তোমাদের অর্জন।’

‘ক্…কী দিয়ে যাবেন আপনি আমাদেরকে?’ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন এক অতিথি।

‘আমার লুকানো সম্পদ,’ জানালেন পাদ্রোনি। ‘জেনোয়া আর রোমের ব্যাঙ্কে বেনামে অনেক টাকা রেখেছি আমি, সেগুলো সমান ভাগে ভাগ করে নেবে তোমরা। কীভাবে, এবং কোন্ শর্ত মোতাবেক ওগুলো পাবে, তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে তোমাদের হাতে ধরা কাগজে। আমার সারাজীবনের গোপন সঞ্চয়… তোমাদের কাজ শুরুর জন্য যথেষ্টই হবে সেটা।’

‘তোমাদের কাজ বলছেন কেন?’ একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন আরেক অতিথি। ‘আমাদের বলা উচিত নয় কি?’

‘কাজটা আমাদেরই থাকবে, কিন্তু আমি থাকব না,’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন পাদ্রোনি। ‘কারণ টাকা-পয়সার চেয়েও আরও বড় একটা উপহার আমি দিয়ে যাচ্ছি তোমাদেরকে। গোপনীয়তা! নিশ্চিত থাকো, তোমাদের পরিচয় কোনোদিন কোথাও প্রকাশ পাবে না। আজ রাতের এই সভার কথা সারা পৃথিবীতে একমাত্র  তোমরাই জানবে, আর কেউ না। কী কথা হয়েছে এখানে, তা বলার মত কেউই অবশিষ্ট থাকবে না… এমনকী আমিও না!’

‘মৃদু প্রতিবাদ ভেসে এল অতিথিদের মাঝ থেকে-পাদ্রোনির নিশ্চয়তা পেয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। হাজার হোক, ঘরভর্তি লোক ছিল সেদিন—চাকরবাকর, সহিস-কোচোয়ান, সঙ্গীতশিল্পী, রক্ষিতা… এত লোকের মুখ বন্ধ করা যাবে কী করে?

‘এক হাত তুলে সবাইকে চুপ করালেন পাদ্রোনি। আগুনের মত জ্বলজ্বল করছিল চোখদুটো। শীতল গলায় বললেন, ‘এখুনি তার জবাব পাবে। তোমাদের জন্য এটা একটা শিক্ষাও হয়ে থাকবে—বুঝতে পারবে, সহিংসতার পথ অনুসরণ করা কতটা জরুরি। কখনোই কেন পিছু হটা যাবে না। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য… মহান যে-দায়িত্ব নিয়েছ, তার সাফল্যের জন্য রক্ত ঝরাতেই হবে তোমাদেরকে।’

‘কথা শেষ করে হাত নামালেন পাদ্রোনি, আর তারপরেই ভিলার শান্ত-সমাহিত পরিবেশ বিদীর্ণ হয়ে গেল গুলিবর্ষণের আওয়াজ আর মানুষের মরণ-আর্তনাদে। শুরুটা হলো রান্নাঘরে। শটগানের উপর্যুপরি শব্দে কানে তালা লেগে গেল, কাঁচ ভাঙল, মেঝেতে আছড়ে পড়ল থালাবাসন। পাইকারী হত্যাকাণ্ডের শিকার হলো ওখানে জড়ো হওয়া চাকরবাকররা। দরজা খুলে হলঘরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করল তারা, রক্তাক্ত দেহ নিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল কয়েক পা এগোতেই।

‘এরপর বাগানের পালা। সঙ্গীত থেমে গেল, তার বদলে ভেসে এল একের পর এক চিৎকার আর গুলির আওয়াজ। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভিলার ওপরতলাতেও শোনা গেল মেয়েদের গগনবিদারী আর্তনাদ। পাহাড়ি যুবতীর দল, কয়েক ঘণ্টা আগে পাদ্রোনির নির্দেশে কুমারীত্ব বিসর্জন দিয়েছে, এবার তাঁরই ইচ্ছেয় শিকার হলো ভয়াবহ মৃত্যুর।

‘ঝুলবারান্দায়, ছায়ার ভিতর দেয়ালে শরীর মিশিয়ে দিলাম আমি; জানি না কী করব। কাঁপছি হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মত, অমন ভয় জীবনে কোনোদিন পাইনি। গোলাগুলির আওয়াজ থেমে গেল এক সময়, নেমে এল নীরবতা। কিন্তু আর্তনাদে ভারী পরিবেশের চেয়ে আরও ভয়ানক মনে হলো তা।

হঠাৎ পায়ের আওয়াজ শুনলাম… তিন থেকে চারজন মানুষ দৌড়াচ্ছে… নিশ্চয়ই বন্দুকধারী খুনিরা! সিঁড়ি ধরে নামছে ওরা। আতঙ্কে সিঁটিয়ে গেলাম, বুঝি আমার খোঁজেই আসছে! কিন্তু না, আমার দিকে না, উত্তরের বারান্দার দিকে চলে গেল ওরা, কাজ শেষে সমবেত হলো ওখানে। চকিতে হলঘরের দিকে তাকালাম, চার অতিথি মূর্তির মত বসে আছেন ওখানে, আমার মতই দশা তাঁদের। দৌড়ে হয়তো পালিয়েই যেতেন, যদি না পাদ্রোনি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতেন ওঁদের দিকে।

‘চোখ ফেরাতে না ফেরাতেই আবার গুলি হলো। দ্রুত চারটা শট… পিছু পিছু চারটা কণ্ঠের আর্তনাদ শোনা গেল উত্তরের বারান্দা থেকে। বুঝতে পারলাম, খুনিদেরকেই এবার খুন করল নিঃসঙ্গ আরেক আততায়ী।

‘আবারও নীরবতা নেমে এল ভিলায়

নমে এল ভিলায়। সর্বত্র মৃত্যুর ছাপ-ছায়ায় ছায়ায়… এমনকী দেয়ালে নেচে বেড়ানো মোমবাতির আলোর আভাতেও। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে অতিথিদের উদ্দেশে কথা বললেন পাদ্রোনি।

‘শেষ হয়েছে সব,’ আশ্চর্য রকম শান্ত শোনাল তাঁর কণ্ঠ ‘প্রায় শেষ আর কী। এই টেবিলে যারা আছি, তারা… আর আমার খুব বিশ্বস্ত একজন ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই এ-বাড়িতে। আমার ওই লোক তোমাদেরকে পর্দা-ঘেরা ক্যারিজে  করে নিয়ে যাবে বোনাফাসিয়োতে। ওখানে সাধারণ মানুষের ভিড়ে মিশে যেতে পারবে তোমরা, ভোরের স্টিমার ধরে চলে যেতে পারবে নেপলস্-এ। পনেরো মিনিট সময় পাচ্ছ জিনিসপত্র গুছিয়ে নেবার জন্য, তারপর সবাইকে সামনের দরজায় চাই। নইলে তোমাদেরকে ফেলেই চলে যাবে আমার লোক। ও হ্যাঁ, লাগেজ নিজেদেরকেই বইতে হবে, দুঃখিত।’

‘একজন অতিথি মুখ খুললেন। ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘আর আপনি, কাউণ্ট?’

‘হাসলেন পাদ্রোনি। ‘আমি? সবশেষ শিক্ষা হিসেবে নিজের জীবন বিসর্জন দেব। মনে রেখো আমাকে। আমার পথই তোমাদের পথ! যাও, যোগ্য শিষ্য হও আমার! ধ্বংস করে দাও দুর্নীতির ধারক আর রক্ষকদেরকে!’ বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছেন তিনি ততক্ষণে, চেঁচাচ্ছেন অপ্রকৃতিস্থের মত। ‘ভিতরে এসো!’ কাকে উদ্দেশ করে যেন বলে উঠলেন হঠাৎ করে।

‘ছোট্ট এক ছেলে… বছর দশ-বারো বয়স, পোশাকে মনে হলো স্থানীয় রাখালবালক… দরজা ঠেলে ঢুকল হলঘরে। শীর্ণ দু’হাতে বিশাল এক পিস্তল ধরে রেখেছে। পায়ে পায়ে পাদ্রোনির কাছে এসে দাঁড়াল।

উপর দিকে তাকালেন পাদ্রোনি, বুঝি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন ঈশ্বরের প্রতি। ছেলেটাকে বললেন, ‘যা বলেছি করো!’ তারপর চেঁচালেন, ‘আমার শিষ্যরা, নিষ্পাপ এই শিশু তোমাদেরকে পথ দেখাবে!’

নিষ্কম্প হাতে পিস্তল তুলল রাখালবালক। নির্দ্বিধায় গিলবার্তো বারেমির মাথায় গুলি করল সে।’

এ-পর্যন্ত বলে থেমে গেলেন বৃদ্ধা। দু’চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে। ‘আর পারছি না, বিশ্রাম নিতে হবে আমাকে,’ বললেন তিনি!

মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁর কাহিনি শুনছিল রানা-কুয়াশা, এবার নড়ে উঠল।

‘কিছু মনে করবেন না, ম্যা’ম,’ কুয়াশা বলল। ‘অনেক প্রশ্ন আছে আমাদের। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন তা?

‘থাক,’ বাধা দিল রানা। ‘পরে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *