সেই কুয়াশা ১.১২

বারো

একগুঁয়ের মত উঁচু উঁচু ঢেউয়ের সারির বুক চিরে মন্থরগতিতে এগোচ্ছে কাঠের তৈরি পুরনো এক ফিশিং বোট, প্রবল আক্রোশে তাকে ঠেকাতে চেষ্টা করছে রুদ্র সাগর। চাবুকের মত আঘাত হানছে খোলের এখানে-ওখানে, ক্ষণে ক্ষণে নোনা পানির ঝাপটায় ভিজে যাচ্ছে বোটের সর্বাঙ্গ। পাটাতনের উপরে মাছ-ধরা জাল নিয়ে ব্যস্ত জেলেদের সারা শরীরে এখন লবণের প্রলেপ। ভোরের বাতাসে হি হি করে কাঁপছে ওরা।

মাছ ধরার এই কার্যক্রমের সঙ্গে যোগ দেয়নি একজন মাত্র মানুষ। দড়ি টানছে না সে, জাল বা বড়শি ধরছে না; যোগ দিচ্ছে না জেলেদের শাপ-শাপান্ত, কিংবা সস্তা রসিকতাতে। তার বদলে হুইলহাউসের ভিতরে একটা চেয়ার পেতে বসে আছে সে-একহাতে থার্মোস-ভরা কফি, অন্যহাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট, মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে টান দিচ্ছে। পরনে নোংরা, ছেঁড়া পোশাক— ইটালিয়ান, কিংবা ফ্রেঞ্চ প্যাট্রোল বোট উদয় হলে সহজে মিশে যেতে পারবে জেলেদের সঙ্গে। অন্যথায় ওকে নিজের মত থাকতে দিতে হবে, এমনটাই চুক্তি হয়েছে বোটের লোকজনের সঙ্গে। আপত্তি করেনি কেউ, কাজটার জন্য নামহীন এই আগন্তুক এক লাখ লিরা দিচ্ছে… ক্যাপ্টেন পাবে বাড়তি দশ হাজার। গরীব জেলেদের জন্য এ অনেক টাকা! স্যান ভিনসেনজোর এক পিয়ার থেকে মানুষটাকে তুলে নিয়েছে ওরা। পরদিন ভোরে কর্সিকার উদ্দেশে রওনা হবার কথা ছিল, কিন্তু আগন্তুকের নির্দেশে মাঝরাতেই ইটালির উপকূল ত্যাগ করেছে বোটটা।

জেলেদের জানা নেই, রহস্যময় এই আরোহীর নাম মাসুদ রানা।

সিগারেটটা শেষ হয়ে এসেছে, পায়ের তলায় পিষে ওটাকে নেভাল রানা। শেষবারের মত কফিতে চুমুক দিয়ে থার্মোসের মুখ বন্ধ করল। তারপর আড়মোড়া ভাঙল উঠে দাঁড়িয়ে। বেরিয়ে এল হুইলহাউস থেকে। রাতভর অত্যাচারের পর এই প্রথম কিছুটা শান্ত হয়ে এসেছে সাগর। কুয়াশার মাঝ দিয়ে আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে তটরেখা। বিরূপ প্রকৃতিকে পরাস্ত করে বেশ ভালই এগিয়েছে বোট। ক্যাপ্টেনের মতে, খুব শীঘ্রি দেখা পাওয়া যাবে সলেনযারার; তার এক ঘণ্টা পর সেইণ্ট লুসি আর পোর্তো ভেচিয়োর মাঝামাঝি জায়গায় ওকে নামিয়ে দিতে পারবে তারা। ঝামেলার কোনও সম্ভাবনা নেই, পাথুরে উপকূলের মাঝে প্রচুর ইনলেট আছে, বেশিরভাগই নির্জন। ওর যে-কোনও একটায় সবার অলক্ষে ঢুকে পড়তে পারবে বোট।

হুইলহাউসের ভিতর থেকে নিজের হ্যাভারস্যাক নিয়ে এল রানা, ঝুলাল পিঠে। ওটার ভিতরে জামা-কাপড় ছাড়াও কয়েক দেশের ভুয়া পাসপোর্ট, নকল আইডেন্টিফিকেশন আর নগদ টাকা রেখেছে ও। হারিয়ে গেলে, বা চুরি হয়ে গেলে মহা-ঝামেলায় পড়ে যাবে।

‘সেনিয়র!’ ক্যাপ্টেনকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল, ময়লা দাঁত বের করে হাসছে। ইটালিয়ান ভাষায় বলল, ‘এক্কো… সলেনযারা! সি অ্যারিভেরেমো সুবিতো… ট্রেন্তা মিনুতি। নর্দ দি পোর্তো ভেচিয়ো।’

‘বেনিসিমো, ক্যাপিতান,’ পাল্টা জবাব দিল রানা। ‘গ্রাৎসি। ‘প্রেগো!’ বলে হুইলহাউসে ঢুকে গেল লোকটা, বোট চালানোর দায়িত্ব তুলে নিল নিজহাতে।

আধঘণ্টার মধ্যে ডাঙায় পৌঁছুবে রানা—কর্সিকার সেই পাহাড়ি এলাকায়, যেখানে ফেনিসের জন্ম হয়েছে। সংঘটার সৃষ্টির ব্যাপারে কারও মনে কোনও সন্দেহ নেই; কিন্তু পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত ওরা যে ভাড়াটে খুনি সরবরাহ করত-এ-তথ্যটাই প্রশ্নবিদ্ধ। ফেনিস সম্পর্কে বাকি পৃথিবীর জ্ঞান এত কম যে বোঝা মুশকিল—ওদের গল্পের কতখানি সত্যি, আর কতখানি মিথ। ফেনিসের কিংবদন্তি একই সঙ্গে বাস্তব এবং কল্পিত। পুরোটাই এমন এক রহস্যের আবরণে মোড়া, যার উৎস সম্পর্কে জানা নেই কারও। কর্সিকার পাগলাটে কাউণ্ট গিলবার্তো বারেমির ডাকে নাকি গড়ে উঠেছিল এই সংঘ-একাদশ শতাব্দীর হাসাসিন গোত্রকে যেভাবে জন্ম দিয়েছিলেন শেখ হাসান ইবনে আল-সাবাহ। দুটোর মধ্যে এই মিল দেখে সন্দিহান হয়ে উঠতে হয়, হয়তো পুরোটাই এক আধুনিক রূপকথা।

বাস্তবেও কোনও প্রমাণ নেই। আজ পর্যন্ত কোনও আদালতে ফেনিসের বিপক্ষে সাক্ষী দেয়নি কেউ; এমন কোনও খুনি ধরা পড়েনি, যার সঙ্গে সংঘটার যোগাযোগের আলামত পাওয়া গেছে। কেউ যদি কখনও কোথাও স্বীকারোক্তি দিয়েও থাকে, তা জনসমক্ষে আসেনি। যা আছে, তা স্রেফ গুজব… লোকের কানকথা। প্রকাশ্যে কেউ কোনোদিন ফেনিস সম্পর্কে উচ্চবাচ্য করেনি, দুনিয়ার সমস্ত দেশের সরকার আর আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাও আশ্চর্য রকমের নীরব এই বিশেষ সংঘটার অস্তিত্বের বিষয়ে। এই নীরবতাই রানাকে কৌতূহলী করে তুলেছে—ওটা কি  ইচ্ছাকৃত, নাকি জোর খাটিয়ে সবাইকে বাধ্য করা হচ্ছে মুখ বন্ধ রাখার জন্য?

এখন পর্যন্ত যা কিছু ঘটে গেছে, তাতে দ্বিতীয় সম্ভাবনাটাই জোরালো। ওকে আর কুয়াশাকে খুন করার চেষ্টা করেছে ফেনিস, ব্যর্থ হওয়ায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে মিথ্যে দুটো হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে। অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন খোঁজখবর নেবার চেষ্টা করেছিলেন, তাই তাঁর প্রাণের উপরেও হামলা চালানো হয়েছে। কপাল ভাল, বেঁচে গেছেন নুমা চিফ; তবে অবস্থা সঙ্গীন। আমেরিকা ছাড়ার আগে জর্জ রেডক্লিফের সঙ্গে আরেক দফা কথা বলে এসেছে রানা, জানতে পেরেছে—সফল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অ্যাডমিরালের শরীর থেকে গুলি বের করে নিতে পেরেছে ডাক্তাররা, তবে পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত নন তিনি এখনও অপারেশনের পর তাঁকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে অত্যন্ত গোপন এক স্থানে। এমনকী রানার পক্ষেও তাঁর সঙ্গে এখন আর যোগাযোগ করা সম্ভব হবে না। যোগাযোগ করে লাভও নেই, চেতনানাশক দিয়ে রাখা হয়েছে অ্যাডমিরালকে, অন্তত সপ্তাহখানেক পর্যন্ত তাঁর জ্ঞান ফেরানো ঝুঁকিপূর্ণ। তারপরেও কথাবার্তা বলার মত শক্তি ফিরে পেতে অনেক সময় লাগবে। যে-দু’জন মানুষকে তিনি সন্দেহ করেছেন, তাদের নাম আর এক্ষুণি জানা যাবে না।

কর্সিকা-ই এখন একমাত্র ভরসা। ফেনিসের জন্মভূমি থেকে সূত্র সংগ্রহ করতে হবে রানাকে। তাই বিসিআই হেডকোয়ার্টারে সংক্ষিপ্ত একটা রিপোর্ট পাঠানোর পর ছদ্ম-পরিচয়ে আমেরিকা ত্যাগ করেছে ও, লণ্ডন আৰু প্যারিস হয়ে গতকাল পৌঁছেছে স্যান ভিনসেনজো-তে। তিনদিন পেরিয়ে গেছে ইতিমধ্যে, যাত্রার শেষ পর্যায়ে রয়েছে এখন রানা। খুব শীঘ্রি পা রাখবে ভূমধ্যসাগরের মাঝখানে কর্সিকা দ্বীপের মাটিতে।

যাত্রাপথের বড় একটা সময় বিমান আর ফিশিং বোটে বসে বসে কাটানোয় চিন্তাভাবনা করার সুযোগ পেয়েছে রানা, ঠিক করে নিতে পেরেছে আশু-কর্মপদ্ধতি। নিরেট যে-দুটো তথ্য আছে, তার উপর ভিত্তি করেই তদন্ত শুরু করতে হবে ওকে। তথ্যদুটো হলো: গিলবার্তো বারেমি নামে সত্যিই একজন কাউণ্ট ছিলেন, এবং অধীনে একদল লোক ছিল, যারা নিজেদেরকে কাউন্সিল অভ ফেনিস বলে পরিচয় দিত। এর বাইরে নিরন্তর পরিবর্তিত হয়েছে পৃথিবী, দেশে দেশে ঘটেছে ক্ষমতার সহিংস পালাবদল। মানবজাতির ইতিহাসে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নতুন কোনও বিষয় নয়। কিন্তু ওগুলোর পিছনে কারও না কারও হাত থাকে—বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীন সরকারের। সরকার যখন হত্যাকাণ্ডের জন্য খুনি ভাড়া করে, তার পিছনে সূত্র পাওয়া খুব মুশকিল। সফল হবার পর খুনিদের সঙ্গে আলাদা এক বন্ধনও সৃষ্টি হয় নিয়োগকর্তাদের। এভাবেই হয়তো ধীরে ধীরে ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছে ফেনিস।

লণ্ডনে থেমে রানা এজেন্সির মাধ্যমে ফেনিসের ফাইল জোগাড় করে নিয়েছে রানা। ডিটেইলড্ কিছু নেই, তবে ওটা পড়ে নানা ধরনের আইডিয়া এবং গুজবের ব্যাপারে পরিষ্কার একটা ধারণা হয়েছে ওর। আন্তজার্তিক ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটির ছোট্ট একটা অংশ মনে করে, চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকের অসংখ্য রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ফেনিস। সারায়েভো থেকে মেক্সিকো সিটি, টোকিয়ো থেকে বার্লিন… এমন কোনও জায়গা নেই, যেখানে ওরা কাজ করেনি। পঞ্চাশের দশকে কভার্ট ইন্টেলিজেন্সের বিস্তৃতির ফলে সংঘটার বিলুপ্তি ঘটেছে বলে মনে করা হয়। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের জন্য ভাড়াটে খুনির প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল তখন। বড় বড় দেশের সরকার তাদের নিজস্ব ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির ছায়া সংগঠনের মাধ্যমে ঘটাতে পারত ওসব। ফেনিসের বিলুপ্তির পিছনে আরেকটা গুজবও আছে- ওদেরকে নাকি গ্রাস করে নিয়েছে সিসিলিয়ান মাফিয়া।

এ-সবই হচ্ছে মাইনরিটি রিপোর্ট। অফিশিয়ালি ইন্টারপোল, এমআই-সিক্স এবং সিআইএ-র ভাষ্য হলো, ফেনিসের ক্ষমতা সম্পর্কে যা কিছু জানা যায়, তার সবই অতিকথন। ইটালিয়ান এবং ফ্রেঞ্চ রাজনৈতিক মহলের ছোটখাট কিছু ব্যক্তিত্বকে হয়তো হত্যা করেছে ওরা, কিন্তু সেগুলোর একটাও উল্লেখযোগ্য নয়। সংঘটা স্রেফ একজন পাগলাটে মানুষ এবং তার অনুসারীদের সমষ্টি ছাড়া আর কিছু নয়, যারা প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিল না। উগ্রবাদী এমন সংগঠন দুনিয়ায় ভূরি ভূরি পাওয়া যাবে। এদেরকে খামোকাই নাকি বড় করে দেখানোর চেষ্টা করছে দুষ্ট কিছু লোক।

হুইলহাউস থেকে ক্যাপ্টেনের কণ্ঠ ভেসে আসাতে চিন্তায় ছেদ পড়ল রানার।

‘কুইনদিসি মিনুতি!’ চেঁচিয়ে জানাল লোকটা। আনদারে এস্ত্রো কোস্তা।’

‘গ্রাৎসি, ক্যাপিতান,’ ধন্যবাদ জানাল রানা।

‘প্রেগো।’

আবার চিন্তার সাগরে ডুবে গেল রানা। ফেনিস! এ কি সম্ভব? একটা মাত্র সংগঠন কি সারা পৃথিবীর সমস্ত সন্ত্রাসবাদ আর অপরাধ-জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে? সবখানে সৃষ্টি করতে পারে অস্থিরতা?

হয়তো বা পারে। কোনও ধরনের প্রমাণ না থাকার পরেও ওকে এবং কুয়াশাকে যেভাবে দু’দুটো দেশের সর্বোচ্চ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে, তাতে সংগঠনের ক্ষমতার ব্যাপারে কোনও রকম সন্দেহ রাখার অবকাশ নেই। প্রয়াত লিও ভাদিমের কথাই বোধহয় ঠিক-ফিরে এসেছে ফেনিস, নতুন এক কাউন্সিল নিয়ে। এবার ওরা আগের চেয়ে অনেকগুণ ভয়ঙ্কর… অনেকগুণ শক্তিশালী। নির্দিষ্ট কোনও লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে। কী সেটা, জানা নেই; তবে ভাল কিছু যে নয়, তা তো পরিষ্কার। এ-কারণেই ঠেকাতে হবে ওদেরকে নিজেকে এবং কুয়াশাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে, ওদের দুজনের ঘনিষ্ঠ দুই পিতৃসম ব্যক্তিত্বের উপর হামলার প্রতিশোধ নিতে হবে। তার জন্য ভেদ করতে হবে ফেনিস নামের দুর্জ্ঞেয় রহস্যটাকে।

কর্সিকা থেকে জোগাড় করতে হবে প্রথম সূত্র। বহু বছর আগে গিলবার্তো বারেমি যখন সূচনা ঘটায় কাউন্সিলের, কারা ছিল তার সহচর? কোথায় গেছে তারা? জানতে হবে রানাকে। কাউন্সিল অভ ফেনিসের পুরনো সদস্যদের গন্ধ শুঁকে বের করবে ও এখনকার নাটের গুরুকে।

‘আতুয়ালমেন্তে!’ চিৎকার শোনা গেল ক্যাপ্টেনের। ‘ল্য অ্যাক্সেসো রোচিও!’ বনবন করে ঘোরাচ্ছে হুইল। বোটের নাক ঘুরে যেতে শুরু করল সরু এক খালের দিকে। খোলা দরজা দিয়ে রানার দিকে তাকাল সে। ‘অ্যাঙ্কোরা সিঙ্কে মিনুতি, সেনিয়র। ল্য তেরা দি কর্সিকা।’

‘গ্রাৎসি, ক্যাপিতান।’ তৃতীয়বারের মত ধন্যবাদ জানাল রানা।

কর্সিকায় পৌঁছে গেছে ওরা।

.

পাথুরে, পাহাড়ি পথ ধরে ছুটে চলেছে কুয়াশা; ঝোপঝাড়ের আড়াল ব্যবহার করছে নিজের দেহটাকে অনুসরণকারীদের দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে রাখার জন্য। দূরত্ব বাড়াবার কোনও চেষ্টা করছে  না ও, চাইছে না পিছনের লোকগুলো ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাক। তার বদলে ওদেরকে বিভ্রান্তির মাঝে ফেলে ছত্রভঙ্গ করে দিতে চাইছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে ওদের একজনকে বন্দি করার মতলব, তার কাছ থেকে হয়তো অনেক প্রশ্নের জবাব মিলবে।

কর্সিকার ব্যাপারে লিও ভাদিমের ধারণাই ঠিক। পোর্তো ভেচিয়োর উত্তরের এই পাহাড়ি এলাকায় সত্যিই লুকিয়ে আছে রহস্য। দু’দিনেরও কম লেগেছে কুয়াশার সেটা আবিষ্কার করতে। একদল রক্তলোলুপ মানুষ এখন ওকে তাড়া করে ফিরছে পাহাড়ের ভিতর—বাধা দিতে চাইছে রহস্যটা উদ্ঘাটনের কাজে। চার রাত আগে কর্সিকা ছিল স্রেফ একটা অনুমান, ফেনিসের তথ্য পাবার শেষ খড়কুটো। পোর্তো ভেচিয়ো ছিল দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের সামান্য এক শহর, ওর পিছনের পাহাড়গুলো ছিল অজ্ঞাত অঞ্চল। এখন সব বদলে গেছে।

পাহাড়ি অঞ্চলটা এখনও অজ্ঞাত, তবে মানুষগুলোর আচরণে ভয়াবহ এক পরিবর্তন এসেছে। শুরু থেকেই একটু অদ্ভুত লেগেছে ওদেরকে-অন্তর্মুখী, অতিথিবিমুখ। বিদঘুটে এক উচ্চারণে কথা বলে ওরা, আলাপ চালানো মুশকিল, কিন্তু সেটাই ওদের আচরণের একমাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে না। কুয়াশাকে দেখামাত্র সন্দেহের চোখে তাকায় ওরা, ফেনিস বা বারেমি নামদুটো উচ্চারণ করলেই চেহারায় মেঘ জমে। জোরাজুরি করলে কথাই বন্ধ করে দেয়। হাবভাবে মনে হয়, নামদুটো নিষিদ্ধ শব্দ—অচেনা মানুষের সামনে উচ্চারণ করা বারণ।

চারদিন আগে হলে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য ঠেকত কুয়াশার কাছে, কিন্তু এখন প্রত্যক্ষ প্রমাণ রয়েছে ওর কাছে। কাউন্ট গিলবার্তো বারেমির ফেনিস এখানকার পাহাড়ি আদিম জনতার মাঝে পবিত্র এক প্রতীক… বিকল্প এক ধর্ম! কোনও ভুল নেই এতে, কারণ ফ্যানাটিকের মত আচরণ করছে লোকগুলো। ফেনিসের গোমর রক্ষা করার জন্য এরা প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত।

চারদিনে দুনিয়া বদলে গেছে কুয়াশার। শিক্ষিত, আধুনিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আর লড়ছে না ও এখন; লড়ছে প্রাচীন ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী, অতীতের ছায়ায় বসবাসরত গেঁয়ো মানুষের বিরুদ্ধে। এদের চালচরিত্র আর প্রেরণা বোঝা দুষ্কর। তাই মরিয়া হয়ে উঠেছে অনুসরণকারীদের মধ্যে অন্তত একজনকে হাতের মুঠোয় পাবার জন্য।

কুয়াশার ধারণা, তিনজন পিছু নিয়েছে ওর। সামনে, পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত ঢালটা অনেক দীর্ঘ… অনেক চওড়া। পুরোটা ঢাকা পড়ে আছে নানা প্রজাতির গাছপালা, ঝোপঝাড় আর ছোট-বড় পাথরে। ওর খোঁজে চিরুনি-তল্লাশি চালাতে চাইলে ছত্রভঙ্গ হতে হবে ওদেরকে, আর তখুনি একজনকে ঘায়েল করার ইচ্ছে ওর। যদি যথেষ্ট সময় পায়, লোকটার পেট থেকে বের করে নেবে ওর প্রশ্নের জবাব। সাদাসিধে, গেঁয়ো একটা মানুষের উপর অত্যাচার চালাবার কোনও ইচ্ছে নেই ওর; কিন্তু আপাতত এ-ছাড়া আর কোনও পথ খোলা রাখেনি ওরা। গতকাল রাতে ওর দরজায় উদয় হয়েছিল লুপো শটগান-হাতে এক ছায়ামূর্তি, শেল ছুঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল বিছানাটাকে; ভেবেছিল কুয়াশা শুয়ে আছে ওখানে। প্রাণ বাঁচানোর জন্য পালাতে হয়েছে ওকে। মাথায় জ্বলছে আগুন। শটগানঅলাকে হাতে পেলে সবচেয়ে ভাল হয়, প্যাদানি দেয়ার সময় বিবেকের কোনও দংশন অনুভব করবে না ও।

বুনো ফার গাছের একটা ঝাড়ের পিছনে এসে থামল কুয়াশা। নকল পায়ে এত ছোটাছুটি পোষাচ্ছে না, বিশ্রাম দরকার। জিরিয়ে নেবার ফাঁকে নজর বোলাল ও ফেলে আসা পথের দিকে। ঢালের অনেক নীচে জ্বলছে ফ্ল্যাশলাইটের ম্লান আলোকরশ্মি। একটা, দুটো… তিনটে। ছড়িয়ে পড়ল আলোগুলো। একদম বাঁয়ের মানুষটা উঠে আসছে ওর দিকে। আন্দাজ করল কুয়াশা, দশ মিনিট লাগবে লোকটার ফার গাছের কাছে পৌঁছুতে। ততক্ষণ আরাম করা যেতে পারে। একটা গাছের গোড়ায় ধপ্ করে বসে পড়ল ও।

কীভাবে কী ঘটল, সব স্বপ্নের মত লাগছে কুয়াশার। এই তো… দু’দিন আগে, বিকেল পাঁচটায় ও ছিল রোমের লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এয়ারপোর্টে, ছোট একটা বিমান চার্টার করছিল বোনিফাসিয়ো-তে আসবার জন্য। জায়গাটা কর্সিকার দক্ষিণ উপকূলের ডগায়। সন্ধে সাতটায় বোনিফাসিয়ো-তে ল্যাণ্ড করে বিমান, এয়ারফিল্ড থেকে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে সরাসরি চলে এসেছিল ও পোর্তো ভেচিয়োর উত্তরে পাহাড়ি এলাকায়। উঠেছিল স্থানীয় এক সরাইখানায়। গন্তব্যের কথা শুনে ট্যাক্সি ড্রাইভার বেশ অবাক হয়েছিল। জানিয়েছিল, এলাকাটা একেবারেই অনুন্নত, সভ্যতার ছোঁয়া লাগেনি। কী এক অজ্ঞাত কারণে স্থানীয় লোকজন নাকি আধুনিকতাকে এড়িয়ে চলে। তখুনি সতর্ক হওয়া উচিত ছিল ওর।

হয়নি কুয়াশা, বরং যেচে বিপদ ডেকে এনেছে। রানা কখন আসবে, তার ঠিক-ঠিকানা নেই, তাই ভেবেছিল একাই তদন্তের কাজ কিছুটা এগিয়ে রাখবে। রাতের খাওয়া শেষে তাই ও আলাপ জুড়ে দিয়েছিল সরাইমালিকের সঙ্গে।

‘আমি একজন হিস্টোরিয়ান, বলেছিল ও। ‘আপনাদের এই এলাকার এক পুরনো জমিদারের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের জন্য এসেছি। তাঁর নাম কাউন্ট গিলবার্তো বারেমি।’

‘হিস্টোরিয়ান?’ ভুরু কুঁচকে গিয়েছিল সরাইমালিকের। ‘কোন্ ইউনিভার্সিটির সঙ্গে আছেন?’

‘ইউনিভার্সিটি না, প্রাইভেট ফাউণ্ডেশন। তবে আমাদের গবেষণায় সব ইউনিভার্সিটির উপকার হয়।

‘নাম কী ফাউণ্ডেশনের?’

‘অর্গানিয্যাযিয়োন অ্যাকাডেমিকা। রোমে আমাদের অফিস আমার সেকশনের কাজ—ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত সারডিনিয়া আর কর্সিকার বিস্তারিত ইতিহাস সংগ্রহ করা। যদ্দূর শুনেছি… পোর্তো ভেচিয়োর উত্তরাংশ কাউণ্ট বারেমি নিয়ন্ত্রণ করতেন। কথাটা কি সত্যি?’

হ্যাঁ। এখানকার বেশিরভাগ জমির মালিক ছিলেন তিনি, সেনিয়র। খুব ভাল মানুষ… প্রজাদের ভালমন্দের দিকে কড়া নজর রাখতেন।’

‘শুনে খুশি হলাম। কর্সিকার ইতিহাসে তাঁকে একটা জায়গা দিতে চাই। কিন্তু কোত্থেকে যে শুরু করব, তার কিছুই বুঝতে পারছি না।

কথাটা শুনে সন্দেহ জমা হয়েছিল সরাইমালিকের চোখে। তারপরেও নির্বিকার কণ্ঠে সে বলেছিল, ‘শুরু করতে পারেন ভিলা বারেমি-র ধ্বংসস্তূপ থেকে। রাতটা পরিষ্কার, চাঁদ উঠেছে আকাশে। চাঁদের আলোয় খুব সুন্দর লাগে জায়গাটা। আপনি চাইলে পথ দেখাবার জন্য একজন লোক দিতে পারি আমি… মানে, যদি জার্নির কারণে ক্লান্তি বোধ না করেন আর কী! ‘

‘না, না,’ তাড়াতাড়ি বলেছিল কুয়াশা। ‘একটুও ক্লান্ত নই আমি!’

পাহাড়ি এলাকার অনেকখানি ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ওকে… যেখানে ভৌতিক অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এককালের সুসমৃদ্ধ জমিদারির কঙ্কাল। প্রায় এক একর জায়গা নিয়ে গড়া হয়েছিল প্রাসাদোপম বাড়িটা, ভাঙাচোরা দেয়াল আর হেলে পড়া চিমনি ছাড়া কিছুই এখন আর অবশিষ্ট নেই। আগাছার তলায় আঁচ করা যায় বিশাল এক বৃত্তাকার ড্রাইভওয়ের চিহ্ন। বাড়ির দু’পাশ দিয়ে গেছে নুড়ি বিছানো হাঁটাপথ, ফুলের কেয়ারির সীমানাগুলো মুখ ব্যাদান করে রেখেছে জংলা ঘাসের মাঝ থেকে; যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে—এক সময় অপূর্ব এক বাগান ছিল ওখানে।

পাহাড়ি এক সমতলের উপর, চাঁদের আলোয় কাউন্ট বারেমির বাড়ির ধ্বংসস্তূপ দেখে অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়েছিল কুয়াশার। পাগলাটে ওই মানুষটার স্মারকচিহ্ন যেন ওটা—কালের প্রভাবে স্রেফ বাহ্যিক অবয়ব ধ্বংস হয়েছে, কিন্তু ভিতরে লুকিয়ে থাকা অশুভ ক্ষমতা কমেনি একটুও। তার প্রমাণ হিসেবেই যেন পিছনে অচেনা কণ্ঠস্বর শুনেছিল ও, লক্ষ করেছিল—ওর পথপ্রদর্শক ছেলেটা উধাও হয়ে গেছে। তার বদলে উদয় হয়েছিল রুক্ষ চেহারার দুটো লোক, দায়সারা ভঙ্গিতে অভিবাদন জানিয়ে রীতিমত জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দিয়েছিল। প্রায় একঘণ্টা ওকে জেরা করেছে লোকগুলো, বিরক্তিতে একবার মনে হয়েছিল দু’ঘা বসিয়ে ব্যাটাদেরকে বেহুঁশ করে ফেলে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হবে না বলে সব সহ্য করে গেছে কুয়াশা। হিস্টোরিয়ানের গপ্পোটা ধরে রেখেছে ও, কিছুতেই টলেনি। শেষ পর্যন্ত ওকে প্রত্যাশিত উপদেশটাই দিয়েছে ওরা।

‘যেখান থেকে এসেছ, সেখানেই ফিরে যাও, সেনিয়র। জানার মত কিছু নেই এখানে, কেউ কিছু বলতে পারবে না। বহুকাল আগে মহামারী লেগেছিল এই এলাকায়। সে-সময়কার লোকজন মরে সাফ হয়ে গেছে। তোমাকে সাহায্য করবার মত কেউ অবশিষ্ট নেই।’

‘সবাই মরে কীভাবে?’ বলেছিল কুয়াশা। ‘খুঁজলে পুরনো আমলের দু’একজনকে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। আমি চেষ্টা করতে চাই।?

‘খামোকা কষ্ট কোরো না। বলছি তো, কেউ তোমার প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে না। দেখো ভায়া, আমরা সাদাসিধে মানুষ… চাষাভুষো। অচেনা লোক এলে জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটে। চলে যাও তুমি।’

‘পরামর্শটা আমার মাথায় রইল…

‘ওসব শুনতে চাই না। তোমার ভালর জন্যই বলছি, সেনিয়র… ফিরে যাও!

হুমকিটাকে পাত্তা দেয়নি কুয়াশা, ফিরে এসেছিল সরাইখানায়। পরদিন ভোরে আবার গিয়েছিল ধ্বংসস্তূপ দেখতে, তারপর ঘুরতে শুরু করেছিল পুরো এলাকায়। চোখের সামনে যত খামার দেখেছে, সবগুলোতে ঢু মেরেছে, খামারের চাষীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে চেয়েছে কাউণ্ট বারেমি আর ফেনিস সম্পর্কে। জবাব পায়নি কোথাও, অসহযোগিতা এবং চরম বৈরিতা সহ্য করেছে নীরবে। টের পেয়েছে, সারাক্ষণ ওকে অনুসরণ করা হচ্ছে। মানুষের নীরবতা এবং বিচলিত চেহারা লক্ষ করে আরেকটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেছে—শুধু পিছনে নয়, ওর সামনেও লোক আছে। আগেভাগে সবখানে গিয়ে সতর্ক করে দিচ্ছে তাঁরা—ছড়িঅলা আগন্তুকের কাছে যেন কেউ মুখ না খোলে।

সেই রাতে… মানে গতকাল রাতে খাবারের টেবিলে বসে থাকা অবস্থায় সরাইমালিক এগিয়ে এসেছিল ওর দিকে। কাঁচুমাচু মুখে জানিয়েছিল, ‘দুঃখিত, সেনিয়র। আপনাকে এখানে আর থাকতে দিতে পারছি না আমি। কামরাটা আরেকজনের কাছে ভাড়া দিয়ে ফেলেছি।’

ভাবলেশহীন চেহারায় তার দিকে তাকিয়েছিল কুয়াশা। বলেছিল, ‘দুঃখজনক। তবে কামরার দরকার নেই, রাত কাটানোর জন্য স্রেফ একটা আর্মচেয়ার হলেই চলবে আমার। খাট যদি দিতে পারেন তো আরও ভাল হয়। সকালবেলা এমনিতেই চলে যাব বলে ভাবছি। যা খুঁজছিলাম, তা পেয়ে গেছি।’

‘কী সেটা, সেনিয়র?’

শীঘ্রি জানতে পারবেন। আমার পরে আরও লোক আসবে এখানে। প্রপার ইকুইপমেন্ট আর ল্যাণ্ড রেকর্ড-সহ। নিখুঁত … সত্যিকার গবেষণাধর্মী তদন্ত হবে এখানে। যা ঘটে গেছে আপনাদের এলাকায়, তা খুবই ইন্টারেস্টিং! মানে… অ্যাকাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে আর কী।’

ভীত একটা দৃষ্টি ফুটেছিল সরাইমালিকের চোখে। ‘কালই চলে যাবেন? বেশ… রাতটা তা হলে আর বাইরে থাকার প্রয়োজন নেই। কামরায় চলে যান, আমি ম্যানেজ করে নেব।’

এর ঠিক ছ’ঘণ্টা পর শটগান হাতে উদয় হয়েছিল সেই লোক-ব্যারেল কাটা শটগান, স্থানীয়রা একে বলে লুপো… মানে, নেকড়ে। গুলি ছুঁড়েছিল ওর বিছানা লক্ষ্য করে, শপথবাক্যের মত উচ্চারণ করেছিল একটা কথা: ‘পার নস্ত্রো সার্কোলো!’ মানে, আমাদের চক্রের জন্য! তারপর পালিয়ে গিয়েছিল ঊর্ধ্বশ্বাসে। কাপড় রাখার আলমারির ভিতর থেকে সব দেখেছে কুয়াশা। শটগানের গগনবিদারী আওয়াজে সরাইখানায় কোনও আলোড়ন সৃষ্টি হয়নি, কেউ দেখতে আসেনি কী ঘটেছে

এরপর পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। জানালা গলে সরাইখানা থেকে পালিয়ে এসেছে কুয়াশা। পোর্তো ভেচিয়ো-মুখী কাঁচা রাস্তা ধরে এগিয়েছে ও। কিছুদূর যাবার পর রাস্তার পাশে ঝোপের আড়ালে সিগারেটের আগুন দেখেছে। ঘাপটি মেরে কেউ বসে আছে ওখানে, আটকে রেখেছে পথ। রাস্তা ছেড়ে ঝোপঝাড়ের আড়ালে কুয়াশাও ঢুকে পড়েছে তখন, অপেক্ষা করেছে। অপেক্ষা না করে উপায় ছিল না, রানার আসবার কথা। ওই রাস্তা ধরেই আসবে বিসিআই এজেন্ট, তাকে সতর্ক করে দিতে হবে।

পরদিন… মানে আজ বিকেল তিনটে পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে কুয়াশা, রানার চিহ্নও দেখেনি। ওখানে বসে থাকা আর সম্ভব হয়নি রাস্তা ধরে লাঠিসোটা আর আগ্নেয়াস্ত্র হাতে একদল মানুষকে এগোতে দেখায়। বোঝাই যাচ্ছিল, ওকে খুঁজে বের করে চিরতরে মুখ বন্ধ করার জন্য বেরিয়েছে লোকগুলো।

কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে গেছে সার্চ পার্টি, শুরু করেছে, তল্লাশি। পাহাড়ি মাচেটি নিয়ে ঝোপঝাড় কাটতে কাটতে দু’জন ওর ত্রিশ ফুটের মধ্যে চলে এসেছিল। স্রেফ কপাল ভাল থাকায় ওকে দেখতে পায়নি। অগত্যা সরে যেতে হয়েছে কুয়াশাকে, করতে হয়েছে ইঁদুর-বেড়াল খেলা। সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে ধাওয়াকারীদের মাঝে। কখনও একদিকে উদয় হয় ওর পদচিহ্ন, পরক্ষণে আবার ঠিক উল্টোদিকে। এক পর্যায়ে ধাওয়াকারীদের মনে হলো জলাভূমির মত একটা জায়গায় ঘিরে ফেলা গেছে শত্রুকে, ওখানে পৌঁছুনোর পর চমকে উঠে দেখল—কয়েকশ’ গজ দূরে, পাহাড়ি ঢাল ধরে খোলা এলাকার দিকে চলে যাচ্ছে মানুষটা। জলাভূমিতে আসলে যায়-ইনি সে। এভাবে সবাইকে ঘোল খাইয়ে বেড়িয়েছে ও গত কয়েকটা ঘণ্টা।

আঁধার নামার পর কৌশল বদলেছে কুয়াশা, তার ফলশ্রুতিতে বর্তমান অবস্থানে পৌঁছেছে। লুকিয়ে আছে একটা পাহাড়চূড়ার কাছে, ফার গাছের ঝাড়ের আড়ালে। অপেক্ষা করছে ফ্ল্যাশলাইট হাতে এগোতে থাকা নিঃসঙ্গ শত্রুর জন্য। সহজ প্ল্যান অনুসরণ করেছে ও, তিন ধাপে বাস্তবায়িত করেছে সেটাকে। প্রথমে সৃষ্টি করেছে ডাইভারশন। হামলাকারীদের বড় অংশটাকে সরিয়ে দিয়েছে দূরে। এরপর এক্সপোজারের মাধ্যমে ছোট একটা দলকে নিয়ে এসেছে নিজের কাছে। সবশেষে সেপারেশনের মাধ্যমে দলের সদস্যদেরকে বিচ্ছিন্ন করেছে পরস্পরের কাছ থেকে। পরিকল্পনার সফল সমাপ্তি ঘটতে চলেছে খুব শীঘ্রি। দেড় মাইল দূরে, বনের ভিতর থেকে লাফিয়ে ওঠা অগ্নিশিখা তার প্রমাণ। গত এক ঘণ্টায় তিনটে জায়গায় মরা ডাল-পাতা জড়ো করে আগুন জ্বেলে দিয়েছে ও। দাবানলের আতঙ্কে এখন ওগুলো নেভানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সবাই, সত্যিকার অর্থে ধাওয়া – চালিয়ে যাচ্ছে হাতে গোনা কয়েকজন লোক। তাদেরই একজন নিঃসঙ্গভাবে এগিয়ে আসছে ওর দিকে… ওর পাতা ফাঁদে।

ফার গাছের ঝরা পাতার সমুদ্রে শরীর সেঁধিয়ে দিল কুয়াশা, শুয়ে পড়ল উপুড় হয়ে। একটু পরেই পদশব্দ ভেসে এল সামনে থেকে, পৌছে গেছে লোকটা। মাথা সামান্য উঁচু করে উঁকি দিল ও—চেহারা বোঝা যাচ্ছে না, মাঝারি গড়নের একজন মানুষ, দু’হাতে ধরে রেখেছে একটা মান্ধাতা আমলের রাইফেল। গাছের ঝাড়ের ভিতরে ঢুকেই দ্রুত ফ্ল্যাশলাইট ঘোরাল চারদিকে, কিছু দেখতে না পেয়ে আবার এগোতে শুরু করল। লোকটাকে কয়েক গজ এগিয়ে যেতে দিল কুয়াশা, ওর দিকে পিঠ এসে যেতেই নিঃশব্দ বেড়ালের মত উঠে দাঁড়াল, চোখের পলকে পৌঁছে গেল শত্রুর পিছনে, পিস্তলের বদলে হাতে নিয়ে এসেছে ছড়িটা।

আওয়াজ শুনে দ্রুত ঘুরতে শুরু করল লোকটা। ছড়ির বাঁকা অংশটা আটকে একটানে তার হাত থেকে রাইফেল কেড়ে নিল কুয়াশা, তারপর হাত মুঠো করে প্রচণ্ড এক আঘাত হানল সোলার প্লেক্সাসে। বাতাসের অভাবে খাবি খেতে খেতে মাটিতে বসে পড়ল লোকটা, মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে না। লাথি মেরে তাকে চিৎ করল কুয়াশা, চড়ে বসল বুকের উপর। লোকটার কোমরে একটা খাপবদ্ধ ছুরি আছে, সেটা খুলে নিয়ে ফলাটা ঠেকাল প্রতিপক্ষের গলায়।

তুমি আর আমি একান্তে কিছুটা সময় কাটাব, বন্ধু, ইটালিয়ানে বলল কুয়াশা। ‘বেশ কিছু প্রশ্ন আছে আমার, সেগুলোর জবাব দেবে তুমি। যদি ঠোঁটে তালা আঁটো, তোমার ছুরিটাই চালাব তোমার গলায়। চেহারার এমন দশা করব, জন্মদাত্রী মা-ও চিনতে পারবে না লাশটা। বুঝতে পেরেছ কী বলছি?’

আতঙ্কিত ভঙ্গিতে চোখ পিটপিট করল লোকটা।

‘গুড, উঠে দাঁড়াও,’ বুকের উপর থেকে সরে গেল কুয়াশা। ‘খবরদার, আওয়াজ কোরো না।’

একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল দু’জনে। পরমুহূর্তেই মড়মড় শব্দ শোনা গেল খুব কাছ থেকে—শুকনো ডালে পা ফেলেছে কেউ। ঝট্ করে ঘুরে দাঁড়াল কুয়াশা… এবং উপলব্ধি করল, সবাইকে বোকা ভাবা মোটেই উচিত হয়নি ওর। ওকে টেক্কা দেবার মত একজন হলেও আছে চাষাভুষোদের মাঝে। নীচের ঢালে কোনও গাছের ডালে নিজের ফ্ল্যাশলাইট বেঁধে রেখে এসেছে লোকটা, বাতাসের দোলায় নড়েছে আলোকরশ্মি, কুয়াশার কাছে মনে হয়েছে নীচেই বুঝি তল্লাশি চালাচ্ছে লোকটা। বাস্তবে অন্ধকারের আড়াল নিয়ে চেনা পথ ধরে উপরে উঠে এসেছে সে, যেদিক থেকে হামলা আশা করেনি, সেখান দিয়ে উদয় হয়েছে ভূতের মত।

মাটিতে পড়ে থাকা ফ্ল্যাশলাইটের আভায় পরিচিত অবয়বটাকে দ্বিতীয়বারের মত দেখতে পেল কুয়াশা। প্রথমবার দেখেছিল সরাইখানায়… ওর কামরার দরজায়। হাতের লুপো শটগান তখন তাক করা ছিল বিছানার দিকে, কিন্তু ওটা এখন স্থির হয়ে আছে ওর বুক বরাবর।

‘কাল রাতে আমাকে তুমি ফাঁকি দিয়েছ, সেনিয়র,’ বলে উঠল মানুষটা। ‘কিন্তু এখানে সে-সুযোগ পাবে না।

‘তুমি ফেনিসের লোক?’ রাগী গলায় জিজ্ঞেস করল কুয়াশা জবাব দিল না মানুষটা। তার বদলে উচ্চারণ করল তার পুরনো মন্ত্র, ‘পার নস্ত্রো সার্কোলো!’

মরিয়া হয়ে ঝাঁপ দিল কুয়াশা। লুপোর ডাবল-ব্যারেলের বিস্ফোরণের আওয়াজে কেঁপে উঠল গোটা পাহাড়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *