তিন
কালো, ঘন, ভারী মেঘে ঢেকে আছে গোটা আকাশ। থমথম করছে চারদিক। দূরে কোথাও গির্জার ঘণ্টা ঢং ঢং করে বেজে উঠল।
মেঘ ডাকছে। মাঝে মাঝে মেঘের সঙ্গে মেঘের সংঘর্ষে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মুহূর্তের জন্যে চোখ-ধাঁধানো আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড, পরমুহূর্তে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে চারদিক।
দুর্যোগপূর্ণ রাত। এমন রাতে সহজে ঘুম আসার কথা নয় কারও চোখে। দীর্ঘদেহী, সুঠাম, দোহারা গড়নের মানুষটিও বুঝি সে-কারণেই জেগে আছে। নিজের কামরার মেঝেতে একটা গদিমোড়া তক্তপোশে বসে আছে সে ধ্যানমগ্ন হয়ে। কোলে একটি সরোদ, টুংটাং আলতো টোকায় উঠছে অপূর্ব সুরলহরী।
কেমন একটা ঘোরের মধ্যে যেন থমকে গেছে সময়। সরোদের মিষ্টি সুরের সঙ্গে কোন্ অতলতলে যেন হারিয়ে যেতে রুদ্র প্রকৃতির গর্জন ছাপিয়ে এই সুর যেন মধুর দোলায় আশ্চর্য এক আন্দোলনের সৃষ্টি করেছে ঘরের পরিবেশে।
তন্ময় হয়ে বাজাচ্ছে মানুষটা।
এই মুহূর্তে তার অন্য কোনও পরিচয় নেই। সে সুরের সাধক। সে প্রতিভাবান সঙ্গীতশিল্পী। নিজেকে বিলিয়ে দেবার এই সূক্ষ্ম শিল্প মাধ্যমকে মানুষটি গ্রহণ করেছে অন্তর দিয়ে। অনেক ত্যাগ, অনেক পরিশ্রমের বিনিময়ে আয়ত্ত করেছে সে এই অপূর্ব সুর সৃষ্টির ক্ষমতা। যন্ত্র নিয়ে যখন সে মেতে ওঠে, তখন পৃথিবীর অস্তিত্বের কথা মনে থাকে না তার। ভুলে যায় তার বিজ্ঞান চর্চার কথা… দেশের কথা… দশের কথা।
শিল্পীর ধর্মই তাই। মানুষটি একনিষ্ঠ সাধক… সার্থক শিল্পী। কিন্তু তার সত্যিকার পরিচয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিরল এক প্রতিভা, দুর্জ্ঞেয় এক রহস্য। পিতৃদত্ত নাম মনসুর আলী, কিন্তু অন্য এক নামে চেনে সবাই তাকে।
কুয়াশা!
মানবকল্যাণে নিবেদিত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন এই কুয়াশা। বহুমুখী প্রতিভা বলতে যা বোঝায় সে ঠিক তা-ই, বিজ্ঞানের একটিমাত্র শাখা নিয়ে পড়ে থাকতে তার মন সায় দেয় না। কুয়াশা আসলে মানুষের অবিশ্বাস্য স্বপ্নগুলো পূরণের জন্যে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। মানুষ একদিন হুবহু তারই মত মানুষ তৈরি করতে পারবে, মানুষের আয়ু হবে কমপক্ষে বিশ হাজার বছর, তারুণ্য ও যৌবন হবে চিরস্থায়ী, আক্রান্ত হবার আগেই শরীর থেকে ক্যান্সার ও এইডস জিন শনাক্ত করা ও বের করে নেয়া সম্ভব হবে, আলোর চেয়ে পাঁচগুণ দ্রুতগতিসম্পন্ন স্পেসশিপে চড়ে মানুষ একদিন এক গ্যালাক্সি থেকে আরেক গ্যালাক্সিতে ঘুরে বেড়াবে, এই গতিই তাকে সুযোগ করে দেবে অতীত থেকে বেড়িয়ে আসার, এমনকী ভবিষ্যৎ দেখে আসারও।
স্বপ্নগুলো যতই অবিশ্বাস্য আর অবাস্তব মনে হোক, এগুলোই কুয়াশার গবেষণার বিষয়। সাধারণ মানুষ হয়তো এ-সব শুনে হেসেই খুন হবে, কিন্তু বিজ্ঞানের নতুন নতুন সম্ভাবনা সম্পর্কে যারা খবর রাখে, তারা জানে আধুনিক মানুষের এ-সব স্বপ্ন একদিন সত্যি সত্যিই পূরণ হতে যাচ্ছে। একদিন মানে অনির্দিষ্ট কাল বোঝায় না। আজ যেটাকে অবাস্তব বা অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছে, আগামী পঞ্চাশ বা একশো বছরের মধ্যে সেটাকে বিজ্ঞানীরা বাস্তব সত্য হিসেবে প্রমাণ করে দেখাবেন। সারা পৃথিবী জুড়েই বিজ্ঞানীরা গবেষণায় মেতে আছেন, সাফল্য পাওয়া স্রেফ সময়ের ব্যাপার মাত্র।
কুয়াশার সঙ্গে আর সব বিজ্ঞানীর পার্থক্য হলো, তার সঙ্গে ওঁদের গবেষণার পদ্ধতি মেলে না। উন্নত দেশের বিজ্ঞানীরা গবেষণার জন্যে সরকার অথবা ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পায়। ওঁদের একেকটা প্রজেক্ট দশ বা বিশ বছর মেয়াদী। কিন্তু কুয়াশা কোথাও থেকে কোনও অর্থসাহায্য পায় না, তাই একদিকে তাকে টাকার সন্ধানে থাকতে হয়, আরেক দিকে খেয়াল রাখতে হয় সম্ভাব্য কত কম সময়ের ভিতর প্রতিটি গবেষণা শেষ করা যায়। টাকা যোগাড় করার জন্য মাঝে-মধ্যে মরিয়া হয়ে ওঠে সে, দেশ-বিদেশের কুখ্যাত ধনীদের বাড়িতে হানা দিয়ে নগদ যা পায় ছিনিয়ে আনে। কিংবা হেরোইন আর ব্রিফকেস ভর্তি টাকা হাতবদল হওয়ার সময় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত উদয় হয়, মানবতার শত্রুদেরকে কাবু করে কেড়ে নেয় সব। কুয়াশার ‘এক্সপেরিমেন্ট’ পদ্ধতিও আলাদা, অনেক সময় গিনিপিগ হিসেবে মানুষকেই ‘মডেল’ হিসেবে গ্রহণ করে সে। এই গিনিপিগ করা হয় বেশিরভাগই অপরাধ জগতের লোকজনকে এক্সপেরিমেন্ট ব্যর্থ হলে তাদের অনেককেই অকালে মারা যেতে হয়। এ-ব্যাপারে কুয়াশা বিবেকের কোনও দংশন অনুভব করে না। কিন্তু আইন তো আর ডাকাতি বা এক্সপেরিমেন্টের নামে মানুষ হত্যা মেনে নিতে পারে না। এখানেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে কুয়াশার বিরোধ। কুয়াশাকে ধরার জন্য, কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে দুনিয়ার বড় বড় সব ল-এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি; আর কুয়াশা তাদের পাতা ফাঁদ এড়াবার জন্যে যত রকম কৌশল আছে সব ব্যবহার করছে।
কুয়াশাকে তাই মরীচিকার সঙ্গে তুলনা করা হয়। হঠাৎ কখন তাকে কোথায় দেখা যাবে কেউ তা বলতে পারে না। অনেক সময় দেখেও চিনতে পারা যায় না। তাকে নিয়ে তাই গুজবেরও কোনও অন্ত নেই। অনেকেরই ধারণা, কুয়াশা অদৃশ্য হতে জানে। গুজব বা রহস্য, যাই বলা হোক, সম্পূর্ণ সত্য হয়তো কোনোদিনই জানা যাবে না, অন্তত কুয়াশা পুলিশের হাতে ধরা না পড়া পর্যন্ত। তবে ধরতে যদি কোনোদিন পারেও, পুলিশ তাকে কতদিন বা কত ঘণ্টা আটকে রাখতে পারবে সেটাও একটা প্রশ্ন বটে।
ইদানীং অবশ্য তেমন একটা শোনা যায় না তার কথা। অনেকদিন হলো গা-ঢাকা দিয়ে আছে ও। সর্বশেষ খবর থেকে জানা যায়: বাংলাদেশেরই কোনও এক দুর্গম এলাকায়, পুরনো … পরিত্যক্ত এক জমিদার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। ওখানেই মাটির নীচে তৈরি করে নিয়েছে ল্যাবরেটরি, সেখানে অক্লান্তভাবে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে ধন্বন্তরী এক ওষুধ আবিষ্কারের জন্য। আদরের ছোট বোন মহুয়া, তার স্বামী বিখ্যাত গোয়েন্দা শহীদ খান, কিংবা শহীদের বন্ধু কামালের সঙ্গে কোনও যোগাযোগই নেই বলতে গেলে। দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন; ওভাবেই থাকত আরও বহুদিন, যদি না আজ সকালে খবরের কাগজটা দেখত।
কপালই বলতে হবে, বাজার-সদাই করবার জন্য পাঁচ মাইল দূরের গ্রামের বাজারে অনুচর পাঠিয়েছিল কুয়াশা। ওখানে চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে সময় কাটাবার জন্য পত্রিকার পাতা উল্টাতে উল্টাতে তার চোখ আটকে যায় আন্তর্জাতিক পাতার একটা ছোট্ট খবরে। মন্দিরের জন্য কিনে আনে সে একটা কাগজ।
সরোদের সূক্ষ্ম তারে শেষ আঁচড় টেনে স্থির হলো কুয়াশা। মিষ্টি মধুর সুর হারিয়ে যেতে শুরু করেছে অবলীলায়। নেমে এল ওর দৃষ্টি। পায়ের কাছে মেলে রাখা হয়েছে পত্রিকার পাতাটা। তাতে কালো অক্ষরে লেখা:
জগদ্বিখ্যাত রুশ বিজ্ঞানী নিহত
এরপর সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে, নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের দিকপাল, ড. ইলিয়া ইভানোভিচ, তাঁর নিজস্ব খামারবাড়িতে আততায়ীর গুলিতে পুত্র-সহ নিহত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত এ-হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে পুলিশ কোনও সূত্র খুঁজে পায়নি। এই মৃত্যুতে পৃথিবী এক বিরল প্রতিভাকে হারাল ইত্যাদি, ইত্যাদি।
খবরের সঙ্গে ছোট্ট করে ড. ইভানোভিচের একটা সাদাকালো ছবি দেয়া হয়েছে। সেটার দিকে তাকালেই বুক টনটন করে উঠছে কুয়াশার, যেন কোনও আপনজনকে হারিয়েছে। অনুভূতিটা নিয়ে অবাক হবার কিছু নেই। ড. ইভানোভিচকে ব্যক্তিগতভাবে চিনত কুয়াশা, তাঁকে পিতার মত সম্মান করত।
বাস্তবে ইলিয়া ইভানোভিচ ছিলেন কুয়াশার গুরু, নিউক্লিয়ার সায়েন্সের সমস্ত খুঁটিনাটি কুয়াশা তাঁর কাছেই শিখেছে। পদ্ধতিগতভাবে বিজ্ঞান শেখেনি ও, যা জেনেছে সব নিজের চেষ্টায়। জীবনের একটা বড় সময় ওকে ছোটাছুটি করতে হয়েছে দেশে হিসেবে জানার্জনের জন্য। বড় বড় বিজ্ঞানীদের দরজায় কড়া নেড়েছে ও অনুরোধ জানিয়েছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার ব্যাপারে ওকে শিক্ষা দেবার জন্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিফল হয়ে ফিরতে হয়েছে। হুলিয়াধারী একজন অপরাধীর জ্ঞানতৃষ্ণা মিটাবার সাহস হয়নি কারও। হাতেগোনা ব্যতিক্রমদের মধ্যে ড. ইভানোভিচ ছিলেন প্রথম সারির তিনজনের একজন। কুয়াশার পরিচয় নিয়ে মাথা ঘামাননি তিনি, সত্যিকার একজন জ্ঞানপিপাসু বিজ্ঞানসাধক হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলেন ওকে। ছদ্মপরিচয় দিয়ে কুয়াশাকে নিজের সহকারী বানিয়েছিলেন, হাতে-কলমে শিখিয়েছেন বহুকিছু। নিপাট ভালমানুষ, সচ্চরিত্র এবং নীতিবান ছিলেন ভদ্রলোক। কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলেছিলেন ওকে। নিজের অজান্তেই ড. ইভানোভিচকে পিতার আসনে বসিয়ে ফেলেছিল কুয়াশা।
সেই মানুষটিই কিনা খুন হয়ে গেছেন! অব্যক্ত এক যন্ত্রণায় বুক দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে কুয়াশার। কিছুতেই মনকে শান্ত করতে পারছে না। পারছে না গবেষণায় মনোনিবেশ করতে। ভেবেছিল সরোদ বাজালে হয়তো কমবে এ-যন্ত্রণা, কিন্তু কমেনি।
না, এভাবে আর বসে থাকা যায় না। তক্তপোশ থেকে উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। ড. ইভানোভিচের হত্যা-রহস্য ভেদ করতে হবে ওকে। নিজ হাতে শাস্তি দিতে হবে পিতৃসম মানুষটির খুনিকে। রাশান পুলিশ যে কিছু করতে পারছে না, তা তো খবরের কাগজেই লিখেছে। যা করার করতে হবে ওকেই। কারণ পুলিশের পদ্ধতিতে এগোবে না কুয়াশা। অন্ধকার জগতের মানুষ ও, অন্ধকার জগতের সূত্র ধরে এগোবে। ড. ইভানোভিচের সঙ্গে বছরখানেক কাটিয়েছে কুয়াশা রাশায়। তখন সে-দেশের অপরাধীদের সঙ্গে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে ও। আজ সময় এসেছে তার সদ্ব্যবহার করার।
সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে। সরোদ তুলে রাখল কুয়াশা। আলমারি থেকে বের করে আনল নিজের কালো পোশাক আর পিস্তল।
.
মস্কো, রাশা। দশদিন পর।
ভারী তুষারপাত হচ্ছে গত ক’দিন ধরে। জনজীবন বিপর্যস্ত। আজ সন্ধ্যায় দমকা হাওয়া বইছে তুষারের বড় বড় ঝাপটা ধীরে ধীরে ঢেকে ফেলছে রেড স্কয়্যারকে। কাল সকাল নাগাদ অন্তত দু’ফুট বরফের স্তর পড়ে যাবে রাস্তাঘাটে।
রেড স্কয়্যার থেকে তিন কিলোমিটার দূরে রয়েছে একটি আবাসিক এলাকা। স্বল্প আয়ের লোকজন থাকে ওখানে। ওখানকার একটা অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে দাঁড়াল ট্যাক্সি। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বেঁটে-খাটো একজন মানুষ নেমে এল। চুল ধূসর। সাধারণ কাপড়চোপড়। বয়স ষাট ছাড়িয়ে গেছে। মুখে বলিরেখা। পরিশ্রান্ত চেহারা। তার ওপর কনকনে শীত। দাঁড়িয়ে থাকতে রীতিমত যুদ্ধ করতে হচ্ছে মানুষটাকে। তারপরেও অভ্যাসবশত চারপাশে নজর বুলিয়ে নিতে ভুলল না। সন্তুষ্ট হয়ে ঢুকে পড়ল বিল্ডিঙের ভিতর। এলিভেটর ব্যবহার করল না, এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে
সিঁড়ির ধাপগুলো শুকনো। ধীরে ধীরে ধাপ বেয়ে উঠতে শুরু করল বৃদ্ধ। প্রতিটি ল্যাণ্ডিঙে থামল, পকেট থেকে টর্চ বের করে আরেক প্রস্থ সিঁড়ির সব ক’টা ধাপ দেখে নিল আলো ফেলে। থাকার কথা নয় অথচ আছে, এই রকম ছায়া খুঁজছে। ছয়তলায় উঠে নিজের দরজার সামনে আবার একবার থামল। এরপর ওপর দিকে উঠে গেছে সিঁড়ি, শেষ মাথায় কেয়ারটেকারের ঘর। টর্চের আলোয় দেখা গেল সাততলায় উঠে যাবার প্রথম প্রস্থ সিঁড়িতে, বাঁকের এদিক পর্যন্ত পায়ের কোনও দাগ নেই। জানে, স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্যে মুরমানকে গেছে কেয়ারটেকার। পকেট থেকে চাবি বের করে তালার ফুটোয় ঢোকাতে যাবে, এমন সময় শিরদাঁড়ার ওপর শক্ত কিছু ঠেকল। পরিষ্কার রুশ ভাষায় কথা বলল পিছনের মানুষটা। উচ্চারণে হালকা বিদেশি টান।
‘সাবধান, মি. ভাদিম। আমার হাতে এটা পিস্তল, গুলি করতে দ্বিধা করব না। কাজেই সাবধান… মরতে চাইলে লাফ-ঝাঁপ দিতে পারেন। নইলে ল্যাণ্ডিঙের আলোটা জ্বালুন। পিছন ফেরার চেষ্টা করবেন না।
বয়স যে দক্ষতায় মরচে ধরিয়ে দেয়, তার প্রমাণ পেল ভাদিম। তার হাতে এই মুহূর্তে পিস্তল থাকা উচিত ছিল, কিন্তু রয়েছে টর্চ। সাধারণ সতর্কতা অবলম্বন করতেও ভুল করে বসে আছে সে। টর্চ ধরা মুঠোটা একটু শক্ত হলো। এটাকেই হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাবার চেষ্টা করবে নাকি? কিন্তু মাথায় চিন্তাটা আসার সঙ্গে সঙ্গে ঝেড়ে ফেলে দিল বৃদ্ধ। পিছনে দাঁড়ানো লোকটা নিজের কাজ বোঝে, ওর শিরদাঁড়ার উপর পিস্তলের মাজল এমন শক্ত ভাবে ঠেকিয়ে রেখেছে, যেন গোলমেলে নড়াচড়ার প্রথম আভাস পাওয়া মাত্র ট্রিগার টিপে দেয়া যায়।
দেয়াল হাতড়ে সুইচবোর্ডটা স্পর্শ করল ভাদিম, বোতাম টিপে ল্যাণ্ডিঙের আলো জ্বালল। কম পাওয়ারের বাল্ব, ম্লান আলো।
‘ভিতরে ঢুকব আমরা,’ বলল লোকটা। পরিণত, পরিশীলিত কণ্ঠস্বর। গলার আওয়াজেই বোঝা যায়, একজন অভিজ্ঞ লোক, কঠিন পাত্র। ‘অস্থির হবার দরকার নেই। ধীরে-সুস্থে তালা খুলুন—খুব সাবধানে। তারপর আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকুন।
ত্রিশ সেকেণ্ড পর ভাদিমের বুক আর পেটের মাঝখানে পিস্তল তাক করে ছোট বেডরুমের ভিতর ঢুকল কালো পোশাক পরা দীর্ঘদেহী লোকটা। একটা পায়ে সম্ভবত সমস্যা আছে তাঁর, ছড়িতে ভর দিয়ে হাঁটছে। তার অনুরোধে বোতাম টিপে বেডসাইড টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালল ভাদিম Į
লোকটা জানতে চাইল, ‘ওভারহেড লাইটটা জ্বাললেন না কেন?’
‘এক সুইচেই দুটো আলো জ্বলে,’ বলল ভাদিম। ‘ওটা নষ্ট হয়ে গেছে।
মাথা ঝাঁকাল লোকটা। আলো জ্বেলে পিছিয়ে গেছে ভাদিম, কিন্তু দরজার কাছ থেকে এগিয়ে এসে দূরত্বটাকে সমান করে নেয়নি প্রতিপক্ষ। ঘরের ভিতর নড়াচড়ার জায়গা একেবারেই কম, তার ওপর লোকটার হাতের পিস্তল এক চুল নড়ছে না, হঠাৎ কিছু করে বসার চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিল ভাদিম। লোকটা স্বাস্থ্যবান, সুদর্শন। বেশ লম্বা… প্রায় ছ’ফুট, চোখদুটো সতর্ক এবং বুদ্ধিদীপ্ত। বয়স ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে। কুচকুচে কালো রঙের হ্যাট আর লেদার কোট পরে আছে। ইঙ্গিতে বসতে বলল বন্দিকে। বিছানার ধারে বসল ভাদিম।
বলল, ‘যদি ডাকাতি করার আশায় এসে থাকো, হতাশ হতে হবে তোমাকে। আমার কাছে টাকাপয়সা বা দামি জিনিস… কিছুই নেই।’
‘আপনি খুব ভাল করেই জানেন, আমি ডাকাত নই।’ শান্ত গলায় বলল লোকটা।
‘তা হলে রাতদুপুরে এটা কী ধরনের রসিকতা, আশা করি তুমি নিজেই সেটা আমাকে ব্যাখ্যা করে বলবে। তার আগে, যদি অনুমতি দাও, গা থেকে কোটটা খুলতে চাই আমি। দেখতেই পাচ্ছ, তুষার লেগে ভিজে গেছে।
মাথা ঝাঁকিয়ে অনুমতি দিল লোকটা, এবার আর সতর্ক করে দিল না। সাবধানে, ধীরে ধীরে কোর্ট খুলল ভাদিম, তার প্রতিটি নড়াচড়া ঠাণ্ডা চোখে লক্ষ করল প্রতিপক্ষ। খুব যে শক্ত করে ধরে আছে পিস্তলটা তা নয়, কিন্তু হাত আর আঙুল এমন আশ্চর্য স্থির হয়ে আছে যে মাজলটা এক চুল নড়ছে না। আগেই লক্ষ করেছে বৃদ্ধ, লোকটার কোটের পকেট থেকে উঁকি দিয়ে আছে একজোড়া রাবারের জুতো। কীভাবে ভিতরে ঢুকেছে, এ থেকে বোঝা যায়। রাস্তার দিকের দরজা খোলার জন্যে নিশ্চয়ই স্কেলিটন কী ব্যবহার করেছে সে, তারপর জুতো খুলে দোর-গোড়ার চাতাল টপকেছে, তুষারে পা ফেলেনি। এমন একজন লোক যার সমস্ত দিকে খেয়াল আছে।
বিছানা ছাড়া ঘরের আরেকটা ভারী ফার্নিচার হলো ওয়ার্ডরোব, অত্যন্ত সাবধানে সেটার বাইরের দিকের একটা হুকে কোটটা ঝুলিয়ে রাখল ভাদিম। কোটটা ঝোলাবার সময় লক্ষ রাখল, একদিকের পকেট যেন বাইরের দিকে থাকে, যেটায় তার পিস্তল রয়েছে।
‘আপনার কোটের ভিতর একটা পিস্তল আছে, মি. ভাদিম, ‘ পিছন থেকে বলল লোকটা। ‘সাবধানে বের করে আনুন ওটা, তারপর ঘরের কোণে ছুঁড়ে ফেলুন।’
এই যা, বুদ্ধিটা কাজে লাগল না। বিড়বিড় করে ভাগ্যকে গালমন্দ করল বৃদ্ধ। একই সঙ্গে মনে মনে প্রশংসা করল প্রতিপক্ষের। নজর বটে লোকটার!
পিস্তলটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দীর্ঘদেহীর মুখোমুখি হলো ভাদিম। কড়া গলায় জানতে চাইল, ‘এসবের মানে কী?’
সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না, পিছিয়ে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াল লোকটা, ধীরে ধীরে শরীরটা ঘোরাল সে, কিন্তু ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে থাকল বৃদ্ধের দিকে। বেডরুম থেকে বেরিয়ে যাবার এই একটাই দরজা, পকেট থেকে চাবি বের করে তালা লাগিয়ে দিল সেটায়। শরীরটা আবার ঘুরিয়ে নিল সে। দরজার কবাটে হেলান দিয়ে বলল, ‘আপনার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে, মি. ভাদিম ….এবং আমি জানি, ঠিকমত প্রেশার সৃষ্টি করতে না পারলে কোনও ইনফরমেশনই দেবেন না আপনি পিস্তল… হুমকি… এসব আপনার মুখ খোলাবার উপলক্ষ্যমাত্র।’
‘কী বলছ আবোল-তাবোল! বিরক্ত গলায় বলল ভাদিম। ‘কীসের ইনফরমেশন? আমি বুড়ো মানুষ, রিটায়ার্ড লাইফ কাটাচ্ছি…’
‘যাক, শুরুটা সত্য কথা দিয়ে করলেন,’ বাধা দিয়ে বলল লোকটা। ‘সত্যিই রিটায়ার্ড আপনি।
‘তুমি জানো, আমি কে?’ ভুরু কোঁচকাল ভাদিম।
‘অবশ্যই,’ মাথা ঝাঁকাল পিস্তলধারী। ‘কর্নেল লিও ভাদিম, রিটায়ার্ড। এক্স-স্পেনাজ, ‘এক্স-কেজিবি। সোভিয়েত আমলে ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটির টপ লেভেলের ইনফরমেশন গ্যাদারার ছিলেন। বলা হতো. আপনার চোখ-কান ফাঁকি দিয়ে একটা হাঁচিও দিতে পারে না কেউ। এমনই ছিল আপনার নেটওঅর্ক। ঠিক?’
বুঝতে পারল ভাদিম, এ-লোক তার ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে এসেছে। অস্বীকার করে লাভ হবে না কোনও। তাই গম্ভীর গলায় বলল, ‘অতীত খোঁচাচ্ছ তুমি। এখন কী চাই?’
‘বলেছি তো, ইনফরমেশন। গত কিছুদিনে খুব ভালমত খোঁজখবর নিয়েছি। আমার কন্ট্যাক্টরা বলেছে, যদি কেউ আমার প্রশ্নের জবাব দিতে পারে, সে কেবল আপনি।
‘হেঁয়ালির মত শোনাচ্ছে তোমার কথাবার্তা। কীসের প্রশ্ন মার? কী এমন জিনিস জানতে চাইছ, যা আমি ছাড়া আর কেউ বলতে পারবে না?’
‘খুব সাধারণ একটা প্রশ্ন—ড. ইলিয়া ইভানোভিচকে কে খুন করেছে?’
‘ড. ইভানোভিচ?’ একটু যেন চমকে উঠল ভাদিম। ‘তা আমি কী করে বলব? পুলিশকে জিজ্ঞেস করো।’
‘কথা ঘোরাবার চেষ্টা করবেন না, মি. ভাদিম,’ কঠিন শোনাল দীর্ঘদেহীর কণ্ঠ। ‘সরাসরি জবাব দিন আমার প্রশ্নের।’
‘জানলে না জবাব দেব! রিটায়ার্ড মানুষ, সেই কবে ইন্টেলিজেন্সের কাজ ছেড়ে দিয়েছি… আমাকে এসব জিজ্ঞেস করার মানে কী?’
‘আপনি শুধু চাকরি ছেড়েছেন, মি. ভাদিম। পেশা ছাড়েননি। ও-পথে একবার পা দিলে কেউ কোনোদিন সরে আসতে পারে না। এখনও আপনি গোটা রাশায় সবচেয়ে বড় তথ্যের ভাণ্ডার। সরকারি দফতরের খবরাখবরই হোক, বা আণ্ডারওয়ার্ল্ডের … সব রয়েছে আপনার হাতের মুঠোয়। প্লিজ, আমাকে ধোঁকা দেবার চেষ্টা করবেন না। ভালয় ভালয় সবকিছু খুলে না বললে আমি কঠোর হতে বাধ্য হব। সে-ধরনের প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি।’
‘টরচার করবে?’
‘প্রয়োজন হলে… হ্যাঁ।’
তীক্ষ্ণচোখে মানুষটার মুখভঙ্গি যাচাই করল ভাদিম। নিশ্চিত হলো, মিথ্যে হুমকি দিচ্ছে না। তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘কে তুমি? কেন এসব করছ?’
‘কুয়াশা আমার নাম। ড. ইভানোভিচ ছিলেন আমার বাবার মত। তাঁর খুনিকে তাই নিজ হাতে শাস্তি দেব বলে ছুটে এসেছি বাংলাদেশ থেকে।
ফ্যাকাসে হয়ে গেল বৃদ্ধের চেহারা। ফিসফিসিয়ে বলল, ‘তুমি… তুমিই কুয়াশা?’
‘আপনি আমাকে চেনেন?’
‘নামে। শুধু আমি না, আরও অনেকেই চেনে,’ বলল ভাদিম। ‘এতক্ষণে… এতক্ষণে সব পরিষ্কার হচ্ছে। এবার বুঝতে পারছি কেন ওরা…’
‘কী বলছেন! কী পরিষ্কার হচ্ছে?
কুয়াশার চোখে চোখ রাখল ভাদিম। ‘আজ সকালে খবর এসেছে আমার কাছে—ড. ইলিয়া ইভানোভিচের খুনের দায়ে তোমার নামে হুলিয়া জারি করতে যাচ্ছে রাশান পুলিশ। একগাদা প্রমাণ নাকি একাট্টা করেছে ওরা।’
‘হোয়াট!’ চমকে উঠল কুয়াশা। ‘আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ! কীসের প্রমাণ? আমি তো খুন করিনি ড. ইভানোভিচকে।’
‘তা জানি আমি,’ বলল ভাদিম। ‘বলির পাঁঠা বানানো হচ্ছে তোমাকে। ইউ সি, ইভানোভিচের সঙ্গে তোমার কানেকশনের ব্যাপারে বহু আগে থেকেই জানি আমরা। ওতে একটু রং চড়ানো হলে দু-চারটা এভিডেন্স পয়দা করতে অসুবিধে হবার কথা নয়। আমি শুধু বুঝতে পারছিলাম না, দুনিয়ায় এত লোক থাকতে তোমাকে কেন ফাঁসাতে চাইছে ওরা। এখন সেটাও পরিষ্কার হয়ে গেছে।’
‘খুনটার ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছি বলে?’
‘একজ্যাক্টলি। নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছ তুমি, কুয়াশা ওরা কিছুতেই তোমাকে ছাড়বে না।’
‘কী বলছেন আপনি, কিছুই বুঝতে পারছি না,’ বিস্মিত গলায় বলল কুয়াশা। ‘কারা আমাকে ছাড়বে না?’
‘কর্সিকানরা।’
‘কর্সিকান মানে?’
‘ফেনিস… মানে ফিনিক্স। গোপন সংঘ। ওদের নিজস্ব লোকজনের বাইরে একমাত্র আমিই সম্ভবত জানি সংঘটার কথা। কিন্তু কোনোদিন সেটা প্রকাশ করার সাহস করিনি। কিন্তু আজ… এখানে এসে তুমি সব গোলমাল করে দিয়েছ, কুয়াশা। কোনও সন্দেহ নেই, এবার আমাকে মরতে হবে। ফেনিস-চক্রের লোকজন কিছুতেই তাদের খবর ফাঁস হতে দেবে না।’
‘আপনার কথাবার্তা আমার কাছে হেঁয়ালির মত মনে হচ্ছে, মি. ভাদিম। কীসের ফেনিস? কীসের গোপন সংঘ?’
উঠে দাঁড়াল ভাদিম। জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকাল। নীরবে কিছু ভাবল কয়েক মুহূর্ত। তারপর ঘুরল কুয়াশার দিকে ‘ঠিক আছে, সবকিছু খুলে বলব তোমাকে। এখন আর গোপন রেখে লাভ নেই কোনও। তুমি-আমি দু’জনেই মরা মানুষ, কুয়াশা। যাবার আগে অন্তত এটুকু জেনে যাও, কী কারণে মরতে চলেছ।’
বৃদ্ধের পাগলাটে কথাবার্তার কোনও আগামাথা খুঁজে পাচ্ছে না কুয়াশা। তবু ধৈর্য ধরার সিদ্ধান্ত নিল। দেখা যাক, কী বলতে চায় লোকটা।
আবার বিছানায় এসে বসল ভাদিম। বলল, ‘কিছুদিন আগে ওয়ার্নার নামে এক জেনারেল খুন হয়েছে আমেরিকায়, এটা জানো?’
মাথা ঝাঁকাল কুয়াশা। ‘হ্যাঁ, শুনেছি। ওদের জয়েন্ট চিফ অভ স্টাফ। কেন?’
‘জেনারেল ওয়ার্নারের খুন, আর ড. ইভানোভিচেরটা… একই দলের কাজ।’
‘ফেনিস না কী যেন বললেন, ওদের?’
‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু কেন?’
‘সঠিক কারণ আমি জানি না। তবে ধারণা করছি, সম্ভবত ওদের দলে যোগ দিতে রাজি হননি ওঁরা; তাই এমন পরিণতি বরণ করে নিতে হয়েছে।’
‘একটা গুপ্তসংঘে যোগ দিতে রাজি হবেন না বলে এমন হাই লেভেলের দু’জন মানুষকে খুন করে ফেলা হবে?’ অবিশ্বাস ফুটল কুয়াশার কণ্ঠে। ‘অ্যাবসার্ড।
‘মোটেই না,’ বলল ভাদিম। ‘সাধারণ কোনও সংঘ নয় ফেনিস। দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে বড়, আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সংগঠন ওরা। নিজেদের লুকিয়ে রাখার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি রকমের সতর্ক। নিজের অবস্থা দেখে কিছু বুঝতে পারছ না? ড. ইভানোভিচের ব্যাপারে খোঁচাখুঁচি করছ, তাতেই তোমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে ওরা। তুমি ওদের সম্পর্কে কোনও ধরনের তথ্যপ্রমাণ পাবার আগেই!’
তা হলে আপনি বেঁচে আছেন কীভাবে?’
‘কারণ এতদিন মুখ বন্ধ রেখেছি আমি। আমাকে থ্রেট বলে মনে করেনি ওরা। কিন্তু জেনারেল ওয়ার্নার আর ড. ইভানোভিচ নিশ্চয়ই কাউকে সব খুলে বলতে যাচ্ছিলেন। বিশেষ করে ইভানোভিচের ব্যাপারটা জানা আছে আমার। রাশান আর্মির একজন কর্নেল আর সরকারি একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে নিজের খামারবাড়িতে দাওয়াত দিয়েছিলেন তিনি। সম্ভবত ফেনিসের ব্যাপারে আলোচনা করবার জন্য। কেউই প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারেনি ওখান থেকে। এর অর্থ পরিষ্কার।
আপনাকে আরও খোলাসা করে সব বলতে হবে, মি. ভাদিম। ওই ফেনিস না ফিনিক্স কী যেন বললেন… কী ধরনের সংগঠন ওরা?’
‘বেসিক্যালি ওরা খুনি। মানুষ খুন করাই ওদের পেশা। রুতে টাকার বিনিময়ে গুপ্তহত্যা চালাত, মাঝে বহু বছরের জন্য গায়েব হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন আবার ফিরে এসেছে… আগের চেয়েও কয়েক গুণ ভয়ঙ্কর হয়ে। পার্থক্য হলো, এখন আর টাকার বিনিময়ে কাজ করছে না ওরা। সব করছে নিজেদের ইচ্ছে অনুসারে। বিচারবুদ্ধিহীন হত্যাকাণ্ড—গুমখুন, প্লেন- হাইজ্যাকিং, বোমা-হামলা… আপাতদৃষ্টিতে কোনও প্যাটার্ন খুঁজে পাওয়া যাবে না এসবের মধ্যে। কিন্তু ভালমত তাকালে বোঝা যায়, কাজের ধারা অত্যন্ত নিখুঁত, এবং হাইলি প্রফেশনাল
‘আপনি টেরোরিজমের কথা বলছেন।’
‘এক অর্থে হ্যাঁ। দুনিয়ার সমস্ত টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশনকে চালায় ওরা—প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে। সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে, অথবা টাকার জোগান দেয়। আল-কায়েদা, বাদের-মেইনহফ, নয়া রেড ব্রিগেড … সবাই ফেনিসের কথামত চলে।’
‘অসম্ভব। দুনিয়াব্যাপী টেরোরিস্টদের কোনও সেন্ট্রাল কন্ট্রোল আছে বলে শুনিনি আমি।’
‘আছে, কুয়াশা… আছে। বিশ্বাস করো, কিংবা না-ই করো। ফেনিসের নেটওয়ার্ক যে কত বড়, আর কত শক্তিশালী, তার কিছুই জানা নেই তোমার। শুধু টেরোরিস্টরা নয়, দুনিয়ার সমস্ত বড় বড় দেশের সরকারে বসে আছে ওদের লোক-আমেরিকা, রাশা, চিন, কোরিয়া, ইটালি, ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড… সবখানে!’
‘ব্যাপারটা পরস্পরবিরোধী হয়ে গেল না?’ ভুরু কোঁচকাল কুয়াশা। ‘যদি বড় বড় সরকার ওদের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তা হলে আবার টেরোরিস্টদেরকে কী দরকার?’
‘ভাল প্রশ্ন, কিন্তু উত্তরটা আমার জানা নেই,’ বলল ভাদিম। ‘ওদের কাজকর্মের কোনও আগামাথা খুঁজে পাইনি আমি কখনও। কী ঘটাচ্ছে, তা জানতে পারছি; কিন্তু কেন ঘটাচ্ছে, তার কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য নিশ্চয়ই আছে ওদের—কী সেটা, একমাত্র ঈশ্বর জানেন।’
সোজা হয়ে দাঁড়াল কুয়াশা। ‘আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, জুজুর ভয় দেখাচ্ছেন আপনি এমন কোনও সংগঠন থাকলে তার ব্যাপারে কানাঘুষো হলেও শোনা যেত এতদিনে। আপনার হাতে কোনও প্রমাণ আছে?’
‘সোভিয়েত আমলে একজন গুপ্তঘাতককে পাকড়াও করেছিল কেজিবি। বুকে গোল একটা উল্কি ছিল তার—ওটাই ফেনিসদের চিহ্ন। লোকটাকে ইন্টারোগেট করেছিলাম আমি, কেমিক্যাল ইনজেক্ট করে পেট থেকে বের করে নিয়েছিলাম সব কথা। সে-বারই প্রথম ফেনিস সম্পর্কে জানতে পারি আমি।
‘সেই লোক এখন কোথায়?
‘কবরে। কেজিবি হেডকোয়ার্টারের ভিতরে… স্পেশাল হোল্ডিং সেলে ঢুকে তাকে জবাই করা হয়। আজ পর্যন্ত খুনির পরিচয় জানা যায়নি।
‘তা হলে ওটাই আপনার প্রমাণ?’ বাঁকা সুরে বলল কুয়াশা। ‘খুন হয়ে যাওয়া একজন গুপ্তঘাতক? এমন হতে পারে না, কেমিক্যালের প্রভাবে প্রলাপ বকছিল লোকটা?’
‘না, কুয়াশা। কারণ শুধু ওকেই নয়, লোকটার গ্রেফতার এবং ইন্টারোগেশনের সঙ্গে জড়িত প্রতিটা মানুষ পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টার ভিতর মারা গিয়েছিল—অদ্ভুত সব অ্যাকসিডেণ্টে!’
‘আপনি ছাড়া।
‘হ্যাঁ, আমি ছাড়া। কারণ নিজস্ব কন্ট্যাক্টদেরকে কাজে লাগিয়েছিলাম আমি, ফেনিসের কাছে খবর পাঠিয়েছিলাম, আমাকে বাঁচতে দিলে ওদের হয়ে কাজ করব। করেছিও তা-ই—ওই বন্দির কাছ থেকে পাওয়া সমস্ত তথ্য চেপে গিয়েছিলাম, ভুয়া একটা রিপোর্ট জমা দিয়েছিলাম বসদের কাছে। যতদিন কেজিবিতে ছিলাম, ততদিন নানা ধরনের তথ্য পাচার করেছি ফেনিসের কাছে।’
চমকে উঠল কুয়াশা। ‘কী বললেন? আ… আপনি ফেনিসের লোক?’
‘ছিলাম,’ ম্লান হয়ে উঠল ভাদিমের চেহারা। ধীরে ধীরে নিজের শার্টের বোতাম খুলল সে, উন্মুক্ত বুক দেখাল কুয়াশাকে। সেখানে একটা বৃত্তাকার উল্কি।
কয়েক মুহূর্তের জন্য নির্বাক হয়ে গেল কুয়াশা। নিজেকে সামলে নিয়ে যখন মুখ খুলতে যাবে, তখুনি একসঙ্গে ঘটে গেল অনেককিছু।
আচমকা বিকট শব্দ করে ভেঙে পড়ল বেডরুমের জানালার কাঁচ, সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁকি খেয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল ভাদিম। চোখদুটো দেখে মনে হলো পিংপং বল, এখনই লাফ দিয়ে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। সাদা শার্টে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে টকটকে লাল রং। চমকে গিয়ে পিছনটা দেখল কুয়াশা। ভাঙা জানালা দিয়ে ছুটে এসেছে বুলেট, বিছানায় বসে থাকা বৃদ্ধের মেরুদণ্ডের হাড় গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
কাত হয়ে বিছানায় পড়ে গেল ভাদিম, সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে ঝাঁপ দিল কুয়াশা। পরমুহূর্তে জানালা ভেদ করে ছুটে এল আরও একটা বুলেট। কুয়াশাকে না পেয়ে বেডরুমের দেয়ালের পলেস্তারা খসাল ওটা।
হামাগুড়ি দিয়ে বিছানার পাশে চলে গেল কুয়াশা, শরীর জাগাল না, শুধু হাত তুলে খামচে ধরল গুলিবিদ্ধ ভাদিমের কোট, টান দিয়ে তাকে নামিয়ে আনল মেঝেতে। আছাড় খেয়ে ককিয়ে উঠল বৃদ্ধ’। ততক্ষণে আরও দু’বার গুলি করেছে আততায়ী। কামরার আসবাবপত্রে আঘাত হেনে কৰ্কশ শব্দ তুলল বুলেট।
মি. ভাদিম! মি. ভাদিম!!’ বৃদ্ধকে ঝাঁকি দিয়ে ডাকল কুয়াশা।
বহুকষ্টে চোখ খুলল রাশান গুপ্তচর। মুখে তিক্ত একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘বলেছিলাম না, আমরা দু’জনেই মরা মানুষ? ফেনিসের লেজে পা দিয়ে কেউ বাঁচতে পারে না।
‘কিচ্ছু হয়নি আপনার,’ বলল কুয়াশা। ‘একটু শক্ত থাকুন, আপনাকে আমি হাসপাতালে নিয়ে যাব।’
‘মিথ্যে আশা দেয়ার প্রয়োজন নেই, কুয়াশা,’ দুর্বল গলায় বলল ভাদিম। ‘আমার সময় শেষ। তোমারও!’
‘না, কিছুই শেষ হয়নি,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল কুয়াশা। ‘যারাই জড়িত থাকুক এর পিছনে, তারা শাস্তি পাবে। আমাকে শুধু বলুন, কীভাবে ফেনিসের নাগাল পাওয়া যাবে?’
‘কর্সিকায় যেতে হবে… মানে, যদি এখান থেকে প্রাণ নিয়ে বেরোতে পারো…’ কষ্টেসৃষ্টে বলল ভাদিম। কেশে উঠল, মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল তাজা রক্ত। রুমাল দিয়ে কুয়াশা রক্তটা মুছে দিলে ফিসফিসাল, কর্সিকায় শুরু হয়েছিল সব। ত্রিশের দশকে… কাউণ্ট গিলবার্তো বারেমির হাতে। সে-ই ফেনিসের জন্মদাতা সে আর তার কাউন্সিল। যদি কোনও সূত্র থাকে, কর্সিকাতেই আছে সেটা। যাও কুয়াশা, আমার জন্য আর সময় নষ্ট কোরো না। যদি পারো, ঠেকাও ওদেরকে…’
বলতে বলতে কেঁপে উঠল বৃদ্ধ, তারপর নিথর হয়ে গেল। পালস চেক করল কুয়াশা, সব শেষ। মারা গেছে রাশান গুপ্তচর। চোয়াল শক্ত হলো ওর।
জানালার ওপাশ থেকে এখনও গুলি হচ্ছে। সম্ভবত রাস্তার উল্টোপাশের বিল্ডিঙে পজিশন নিয়েছে স্নাইপার। দূরে পুলিশের সাইরেনের মৃদু ওঁয়াওঁ-ওঁয়াওঁ শুনতে পেল ও। তাগিদ অনুভব করল, এখুনি সরে যেতে হবে এখান থেকে। ধরা পড়া চলবে না পুলিশের হাতে।
হামাগুড়ি দিয়ে বেডরুমের দরজার কাছে চলে গেল কুয়াশ হাত তুলে নব ঘোরাল, বেরিয়ে এল কামরা থেকে। স্নাইপারের নাগালের বাইরে চলে এসেছে, ঝট্ করে উঠে দাঁড়াল ও দ্রুত পা চালিয়ে বেরিয়ে পড়ল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে। কিন্তু ল্যাণ্ডিঙে পা রেখেই চমকে উঠল। সিঁড়ি ধরে উঠে আসছে ষণ্ডামার্কা দুই লোক। ডানদিকের লোকটার হাতে একটা রেডিও, মুখের কাছে নিয়ে নিচুস্বরে কিছু বলে উঠল। বাঁ দিকের লোকটার ডানহাত পরনের ওভারকোটের ভিতরে। হাতটা বেরিয়ে আসতেই কালো রঙের পয়েন্ট থ্রি এইট ক্যালিবারের অটোমেটিক পিস্তলটা দৃশ্যমান হলো, বিকটদর্শন একটা সাইলেন্সারও লাগানো আছে। দৌড়ে আসছে ওরা।
ভাবনা-চিন্তার সময় নেই, নিজের পিস্তল তুলে লোকগুলোর দিকে একটা গুলি ছুঁড়ল কুয়াশা। ফলাফল দেখার অপেক্ষা করল না, পাশ ঘুরে ছুটল ল্যাণ্ডিঙের অন্যপ্রান্তের দিকে। ওখানে একটা পুরনো আমলের এলিভেটর আছে। বোতামে চাপ দিয়ে আবার গুলিবর্ষণ করল শত্রুদের দিকে। সিঁড়িতে নেমে পড়ে কাভার নিয়েছে ওরা, গুলি লাগানো গেল না। তাতে অবশ্য অসুবিধে নেই, লোকদুটো কাছ ঘেঁষতে না পারলেই হলো।
এলিভেটরের দরজা যখন খুলল, ততক্ষণে ম্যাগাজিন খালি করে ফেলেছে কুয়াশা। দেরি না করে ঢুকে পড়ল ভিতরে। লক্ষ করল, লোকদুটো বেরিয়ে এসেছে, ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে ওর দিকে। ঠেকানোর উপায় রইল না, এলিভেটরের দরজা বন্ধ হয়ে যাবার আগেই ভিতরে ঢুকে পড়ল রেডিওঅলা, পিস্তলধারীও অস্ত্রসহ হাতটা ঢুকিয়ে দিয়েছে দুটো পাল্লার মাঝখানে। নিমেষে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল।
বিদ্যুৎ খেলে গেল কুয়াশার শরীরে। ডানদিকে হেলান দিয়ে বাঁ পা-টা অর্ধচন্দ্রাকৃতিতে সামনের দিকে ছুঁড়ে দিল, শরীর ঘুরে গেল আধপাক। মাঝপথে পা-টা আঘাত করল দরজার ফাঁকে ঢুকিয়ে দেয়া হাতটার গোড়ায় দুপ্ দুপ্ করে পর পর দু’বার শব্দ হলো, এলিভেটরের সিলিঙে ঢুকেছে গুলিদুটো। ছিটকে পিছনে পড়ে গেছে লোকটা। বন্ধ হয়ে গেছে এলিভেটরের দরজা। সেজন্যে থেমে রইল না সময়, উড়ে গিয়ে পড়ল কুয়াশা দ্বিতীয় শত্রুর উপর। ওর কাঁধ রেডিওঅলার তলপেটে আঘাত করল, একহাতে বুক খামচে ধরেছে, অন্যহাতে দেয়ালের সঙ্গে ঠেসে ধরেছে রেডিওধরা হাতটা। হাত থেকে যন্ত্রটা ছিটকে পড়ল মেঝেতে।
পুরো ঘটনা ঘটে যেতে দু’সেকেণ্ডের বেশি লাগল না। রেডিওঅলা এতই অবাক হয়েছে যে আর্তনাদ করতেও ভুলে গেছে। এ-ধরনের প্রতিরোধ আশাই করেনি। লোকটাকে ওর সামনে নিয়ে এল কুয়াশা, বাঁ হাতে পেঁচিয়ে ধরেছে গলা, ডান হাতে প্রচণ্ড জোরে মুচড়ে ধরেছে একটা কান।
‘নীচে ক’জন অপেক্ষা করছে?’ রুশ ভাষায় জিজ্ঞেস করল কুয়াশা। এলিভেটর ইতোমধ্যে গ্রাউণ্ড ফ্লোরের দিকে নামতে শুরু করেছে।
‘নিজেই গিয়ে গুনে দ্যাখ, শুয়োরের বাচ্চা!’
নীচের দিকে চাপ দিয়ে মাথাটা এলিভেটরের ধাতব দেয়ালে ঠুকে দিল কুয়াশা, কানটা গোড়া থেকে অর্ধেক ছিঁড়ে এসেছে। বুকফাটা আর্তনাদ করে উঠল রেডিওঅলা। উপুড় হয়ে লুটিয়ে পতুল মেঝেতে এক ঝটকায় তাকে চিৎ করে দিল কুয়াশা। বুকের উপর হাঁটু রেখে চেপে ধরল মেঝের সঙ্গে। হাঁটুতে হোলস্টারের স্পর্শ পেতেই হাত ঢুকিয়ে একটা রিভলবার বের করে আনল, এটায় সাইলেন্সার লাগানো নেই। ওটার ব্যারেল ঠেকাল প্রতিপক্ষের কপালে।
‘জবাব দাও, নইলে এখুনি খুলি উড়িয়ে দিচ্ছি,’ হিংস্র শোনাল কুয়াশার গলা। ‘ক’জন আছে নীচে?’
এবার ভয় ফুটল লোকটার চেহারায়। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘দু’জন। একজন এলিভেটরের সামনে, অন্যজন বাইরে ফুটপাতে গাড়ির পাশে।
‘কী রকম গাড়ি?’
‘ফোক্সওয়াগেন। ‘
‘রঙ?’ কমে এসেছে এলিভেটরের গতি, পৌঁছে গেছে নীচতলায়।
‘কালো।
‘বাইরের লোকটা… ও কী পরে আছে?’
‘জানি না…
রিভলবারের বাট দিয়ে চাঁদিতে মাঝারি একটা আঘাত করল কুয়াশা। ‘মনে করার চেষ্টা করো!’
‘গ্রেটকোট…… খয়েরি রঙের গ্রেটকোট পরে আছে।’
থেমে গেল এলিভেটর। রেডিওঅলার কোটের গলার ধরে দাঁড় করিয়ে দিল কুয়াশা। খুলে গেল দরজা। বাঁ পাশ থেকে উদয় হলো কালো পোশাকধারী এক লোক, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। রেডিওঅলার কপাল আর কানের পাশ দিয়ে নামতে থাকা রক্তের ধারা লক্ষ করে সতর্ক ভঙ্গিতে এক পা পিছিয়ে গেল। বাঁ হাতটা কোটের পকেটে, বিপজ্জনক ভঙ্গিতে পকেটসহ-ই উঠে যাচ্ছে উপরদিকে। আর একটা সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল!
রেডিওঅলার শরীরটাকে বর্মের মত সামনে ধরে রেখে এলিভেটর থেকে বের হলো কুয়াশা। খুক খুক্ কাশির মত তিনটে শব্দ হলো। শেষবারের মত আর্তনাদ করে উঠল রেডিওঅলা, বুক রক্তাক্ত হয়ে গেছে। তাকে চশমাঅলার দিকে ছুঁড়ে দিল কুয়াশা, প্রাণহীন দেহটার ভারে হুড়মুড় করে পড়ে গেল সে, পিস্তলধরা হাতটা চাপা পড়ল দুই দেহের মাঝখানে।
লোকটার দিকে এগোতে গিয়েও থেমে গেল কুয়াশা। বুঝতে পারল, কেন ব্যাটা পিস্তল বের করেনি, কেন পকেট থেকেই গুলি করেছে। বিল্ডিঙের ভিতরের গণ্ডগোলের আওয়াজ চাপা দেয়া যায়নি। কীভাবে যেন ঝামেলার গন্ধ পেয়ে গেছে আশপাশের লোকজন। বিল্ডিঙের সামনে এখন একটা ছোটখাট জটলা। সদর দরজার কাঁচ ভেদ করে উঁকিঝুঁকি মারছে বেশ ক’টা কৌতূহলী মুখ।
সময় নষ্ট করল না কুয়াশা। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল দরজা ঠেলে জটলার দিকে তাকিয়ে কণ্ঠে আকুতি ফোটাল, বলল, ভিতরে একজন আহত হয়েছে। প্লিজ… সাহায্য করুন।’
হুড়োহুড়ি পড়ে গেল জনতার মাঝে। ছোট দরজা গলে একসঙ্গে বিল্ডিঙে ঢোকার চেষ্টা করছে সবাই—হিরো সাজার ইচ্ছে আর কী। সাবধানে ছায়ায় সরে এল কুয়াশা। চঞ্চল চোখে খুঁজে বের করল ফোক্সওয়াগেনটাকে। ড্রাইভার ভিতরে বসা। খয়েরি রঙের গ্রেটকোট পরনে, কোনও সন্দেহ নেই, ওটাই শেষ বাধা। বিল্ডিঙের সামনে জটলা দেখে লোকটা সম্ভবত আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পায়নি। ঝামেলা টের পেলে সটকে পড়ার ইচ্ছে, তাই ইঞ্জিনও চালু করে রেখেছে!
পিছন থেকে অগ্রসর হলো কুয়াশা, ফোক্সওয়াগেনের রিয়ার- ভিউ আর সাইডভিউ মিরর থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে। হাতে বেরিয়ে এসেছে সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলটা। নিচু হয়ে ড্রাইভারের দরজার পাশে চলে গেল ও, তারপর ঝট্ করে উঠে দাঁড়াল। এতক্ষণে সচকিত হলো ড্রাইভার, মাথা ঘুরিয়ে তাকাল অনাহূত আগন্তুকের দিকে, তবে দেরি করে ফেলেছে সে। পিস্তলের বাট দিয়ে জানালার কাঁচে সজোরে আঘাত হানল কুয়াশা, ভাঙা কাঁচের আঘাত থেকে বাঁচতে মাথা নামিয়ে ফেলল লোকটা, হাত বাড়িয়ে দিল পাশের সিটের দিকে—ওখানে তার নিজের অস্ত্রটা রাখা।
‘খবরদার!’ বুক কাঁপানো স্বরে ধমকে উঠল কুয়াশা। ‘নড়বে না!’
থমকে গেল ড্রাইভার। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছে কুয়াশার দিকে।
‘নামো!’
চকিতে নিজের পিস্তলের দিকে তাকাল ড্রাইভার, হিসেব কষছে—ওটা নিতে পারবে কি না।
‘বোকামি কোরো না,’ বলল কুয়াশা। ‘লক্ষ্মী ছেলের মত নেমে এসো গাড়ি থেকে। ‘
আবার পাশে তাকাল ড্রাইভার, হার মানতে চাইছে না।
গুলি করল কুয়াশা, লোকটার দু’পায়ের মাঝখানে, সিটের গদিতে। ‘পরেরটা কিন্তু বিচি গালিয়ে দেবে,’ হুমকি দিল ও।
সাহস হারিয়ে ফেলেছে, ড্রাইভার, হ্যাণ্ডস্ আপের ভঙ্গিতে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে।
‘ভাগো!’ রাস্তার দিকটা দেখিয়ে দিল কুয়াশা।
মাথা ঝাঁকিয়ে ছুটে পালাল ড্রাইভার। কয়েক সেকেণ্ড তার পিঠের দিকে পিস্তল তাক করে রাখল কুয়াশা, তারপর উঠে বসল ড্রাইভিং সিটে। কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ করল না, হ্যাণ্ডব্রেক রিলিজ করে আগে বাড়ল। রিয়ারভিউ মিররে চশমাঅলাকে দৌড়ে বেরুতে দেখল বিল্ডিং থেকে— হতভম্ব ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে ফোক্সওয়াগেনের দিকে। একটু পরেই বাঁক ঘুরল গাড়ি, লোকটা হারিয়ে গেল দৃষ্টিসীমা থেকে। সাইরেন জোরালো হয়ে উঠেছে, উল্টোদিক থেকে বেশ ক’টা পুলিশ-কার পেরিয়ে গেল কুয়াশাকে। ঘটনাস্থলের দিকে যাচ্ছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে শরীরে একটু ঢিল দিল কুয়াশা। আপাতত ও নিরাপদ, বেরিয়ে এসেছে জাল কেটে। কিন্তু তারপর? পুলিশি ঝামেলা কিংবা হুলিয়া ওর জন্যে নতুন কিছু নয়। সারাজীবন ওসব সামলে কাজ করতে হয়েছে ওকে। কিন্তু কেন যেন মন খুঁতখুঁত করছে লিও ভাদিমের কথাগুলোর ব্যাপারে। বেচারার অকালমৃত্যু প্রমাণ করে দিচ্ছে, ফেনিসের কাহিনি মিথ্যে নয়। সত্যিই আছে ওই সংগঠন, নিজেদের অস্তিত্ব গোপন রাখার জন্য যে-কোনও কিছু করতে পারে।
কিন্তু সত্যিই কি ওরা অমন শক্তিশালী? সত্যিই কি দুনিয়ার বড় বড় সরকার আর সন্ত্রাসীদেরকে নিয়ন্ত্রণ করছে ওরা? যদি তা-ই হয়, এত ভয়ানক একটা সংগঠনকে ঠেকানো যাবে কেমন করে? হঠাৎ করেই নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো কুয়াশার। পরিষ্কার বুঝতে পারছে, অনেক বড় একটা শক্তির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেছে ও। একাকী ওটাকে মোকাবেলা করতে পারবে না, এ-ধরনের অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে লড়াই করবার মত অভিজ্ঞতাও নেই ওর। একজন সঙ্গী দরকার। কিন্তু কে হবে সেই সঙ্গী? এমন কে আছে, যে জেনে-শুনে যুদ্ধে নামবে ফেনিসের মত একটা সংগঠনের বিরুদ্ধে?
একটু ভাবল কুয়াশা। হঠাৎ মুচকি হাসি ফুটল ঠোঁটে। হ্যাঁ, আছে একজন। ওর-ই মত আরেক বঙ্গসন্তান। ন্যায়ের পূজারী, দুঃসাহসী, দুর্ধর্ষ এক বীর। কিন্তু সমস্যা হলো, কুয়াশাকে দেখামাত্র অ্যারেস্ট করবে সে। হাত-পা বেঁধে, বেহুঁশ করে নিয়ে যাবে বাংলাদেশে, দাঁড় করিয়ে দেবে কাঠগড়ায়। তা হলে সাহায্য চাইবে কেমন করে? কীভাবে শোনাবে নিজের কথা?
ঠাণ্ডা মাথায় ছক কাটতে শুরু করল কুয়াশা। কায়দামত পেতে হবে ওই মানুষটাকে, ফাঁদে ফেলতে হবে। বাধ্য করতে হবে ওর সমস্ত কথা শুনবার জন্য। আশা করা যায়, এরপর ওকে সাহায্য করবে সে। কিন্তু কাজটা মোটেই সহজ হবে না কারণ যাকে কুয়াশা ফাঁদে ফেলতে চায়, সে আর কেউ নয় …
বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের মাসুদ রানা!