সেই কুয়াশা ১.১০

দশ

কেবিন থেকে সবচেয়ে কাছের ফোন-বুদটা তিন মাইল দূরে। কাঁচা রাস্তা ধরে একেবারে হাইওয়ে পর্যন্ত যেতে হয়। সেলফোনের বদলে ওটাকেই যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিল রানা। এতে ওর অবস্থান ফাঁস হবার ঝুঁকি থাকে না। পুরনো টয়োটা সেডানটা চালিয়ে সকাল সাড়ে ন’টায় ওখানে গেল ও, রিং করল নুমা হেডকোয়ার্টারে, অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের প্রাইভেট নাম্বারে।

কয়েকটা রিং হতেই সাড়া দিলেন অ্যাডমিরাল। রানার কণ্ঠ শুনে উত্তেজিত গলায় বললেন, ‘রানা! কোথায় তুমি?’

‘দুঃখিত, অ্যাডমিরাল। সেটা এ-মুহূর্তে জানাতে পারছি না।’

হুম, বুঝতে পারছি। বড্ড ঝামেলার মধ্যে আছ তুমি, সিআইএ আর এফবিআই পাগলা কুকুর হয়ে গেছে তোমাকে বাগে পাবার জন্য।’

‘ওদেরকে উস্কানি দিচ্ছে কে, সেটা জানেন?

‘উঁহুঁ। পরিস্থিতি গরম হয়ে আছে, তোমার প্রতি আমার দুর্বলতার কথা সবার জানা। নাক গলাবার সুযোগ পাচ্ছি না। তবে চোখ-কান খোলা রেখেছি। কিছু জানতে পারলেই বলব তোমাকে। আসলে ঘটছেটা কী, রানা?’

‘বসের সঙ্গে কথা হয়নি আপনার?’

‘ভোরবেলা ফোন করেছিল, কিন্তু বিস্তারিত ভেঙে বলেনি। তোমার কাছ থেকে জেনে নিতে বলেছে সব।’

‘আপনার সঙ্গে আমার দেখা হওয়া প্রয়োজন, অ্যাডমিরাল 1 আজই। ফোনে সব কথা বলা যাবে না।’

‘নিশ্চয়ই। কীভাবে দেখা করতে চাও?’

‘সেটা পরে বলছি। তার আগে সামান্য খোঁজখবর নিতে হবে আপনাকে। ফেনিস নামে চল্লিশ দশকে একটা গুপ্তসংঘ ছিল, ওটার ব্যাপারে কিছু কি জানা আছে আপনার…

.

সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, রাত ন’টায় দেখা করবেন অ্যাডমিরাল —রক ক্রিক পার্ক-এর পুবপাশে, মিসৌরি অ্যাভিনিউ-এর একজিট থেকে এক মাইল উত্তরে গাড়ি রাখার একটা জায়গা আছে ওখানে, আরোহীরা পায়ে হাঁটা পথ ধরে পার্কের ভিতরে ঢুকতে পারে জায়গাটা থেকে। অ্যাডমিরাল জানিয়ে দিলেন, আসার আগে ফেনিস সম্পর্কে যতদূর সম্ভব তথ্য জোগাড় করে আনবেন। প্রয়োজন ছিল না, তবু তাঁকে সতর্ক থাকার জন্য বলে দিল রানা।

দিনের বাকি সময়টা নিস্তরঙ্গভাবে কেটে গেল। কেবিনের মধ্যেই রইল রানা আর কুয়াশা। কথাবার্তা খুব একটা হলো না ওদের মধ্যে। এখনও পুরোপুরিভাবে বিশ্বাস করতে পারছে না, কেউ কাউকে। এত অল্প সময়ে দুই জগতের দু’জন মানুষের মধ্যে সেটা আসারও কথা নয়। বন্ধুত্ব এবং বিশ্বাস অর্জনের জন্য এখনও অনেক পরীক্ষা দিতে হবে ওদের দুজনকে।

সারাটা দিন বুকশেলফ থেকে নানা ধরনের বই নামিয়ে পড়ল কুয়াশা। রানা বসে রইল রেডিও-র সামনে—কাঁটা ঘুরিয়ে একের পর এক স্টেশনের খবর শুনল। এক্সেলসিয়র হোটেল নিয়ে কোনও সংবাদ প্রচার হয় কি না, সে-দিকে নজর। হলো ঠিকই, কিন্তু খুবই গুরুত্বহীনভাবে। সাধারণ হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবরণ দিল সংবাদপাঠকরা, পুলিশের ধারণা ড্রাগ-রিলেটেড ক্রাইম। তিক্ত একটা হাসি ফুটল রানার ঠোঁটে। ঘটনা ধামাচাপা দেয়ায় ফেনিসের জুড়ি নেই। তিন-তিনজন মানুষ খুন হয়েছে হোটেলে, তারপরেও কোনও রকম আলোড়ন সৃষ্টি হতে দেয়নি!

বিকেল চারটের দিকে নদীর ধারে হাঁটতে বেরুল রানা। কুয়াশাকে ডাকল সঙ্গে যাবার জন্য, কিন্তু রাজি হলো না সে। অগত্যা একাই বেরুতে হলো ওকে। ফিরে এল ঘণ্টাখানেক পর।

রানাকে কেবিনে ঢুকতে দেখে এগিয়ে এল কুয়াশা। বলল, ‘একটু আগেভাগেই রক ক্রিক পার্কে চলে গেলে কেমন হয়? জায়গাটা সার্ভে করে রাখা যাবে, আমাদের অজান্তে কেউ অ্যামবুশ পেতে বসে থাকতে পারবে না।’

‘অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনকে অবিশ্বাস করবার প্রশ্নই ওঠে না,’ মাথা নাড়ল রানা।

‘আমি ওঁর কথা বলছি না। যাদের কাছ থেকে ভদ্রলোক ফেনিসের খোঁজখবর নিচ্ছেন, তাদের কথা বলছি। কীভাবে বুঝব, ওদের কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করবে না?’

‘আমাদের সঙ্গে যে দেখা করতে আসবেন, সেটা, কাউকে বলবেন না অ্যাডমিরাল,’ আশ্বস্ত করল রানা। ‘তবে সতর্ক থাকলে ক্ষতি নেই। ঠিক আছে, পনেরো মিনিটের মধ্যেই রওনা হব আমরা। রাস্তায় একটা ডাইনার পড়বে, ওখানে ডিনার সেরে নেয়া যাবে।’

কথামত বেরিয়ে পড়ল ওরা। লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে সাড়ে সাতটা নাগাদ পৌঁছল রক ক্রিক পার্কের সীমানায়, পার্কিং এরিয়ায়। জায়গাটা শূন্য, আর কোনও যানবাহন নেই। গাড়ি থেকে নেমে পার্কের ভিতর ঢুকে পড়ল দু’জনে। দু’ভাগ হয়ে গিয়ে আশপাশের অনেকখানি এলাকা ভালমত তল্লাশি করল। তবে কোনও মানুষের দেখা পেল না। আজ সন্ধ্যায় বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে, সম্ভবত এ-কারণেই পার্কের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেনি কেউ।

এক ঘণ্টা পর পূর্ব-নির্ধারিত একটা স্পটে আবার মিলিত হলো দু’জনে। রিপোর্ট দেবার ভঙ্গিতে কুয়াশা জানাল, ‘কিচ্ছু দেখিনি আমি। পুরো এলাকা একেবারে ফাঁকা।’

‘হুম, আমারও একই কথা, ঘড়ির লিউমিনাস ডায়ালে চোখ বোলাল রানা। ‘সাড়ে আটটা বেজে গেছে। আমি গাড়ির কাছে যাচ্ছি, আপনি এখানেই থাকুন। অ্যাডমিরাল এলে প্রথমে আমি কথা বলব। তারপর সঙ্কেত দেব আপনাকে।’

‘কীভাবে? পার্কিং লট এখান থেকে অন্তত দুইশ’ গজ দূরে।’

‘ম্যাচ জ্বালব একটা।’

‘গুড আইডিয়া।’

পার্কিং এরিয়ার দিকে হাঁটতে শুরু করল রানা।

ন’টা বাজার দু’মিনিট বাকি থাকতেই হাইওয়ে একজিট ধরে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের লিমাজিনকে। ধীর গতিতে পার্কিং এরিয়ায় ঢুকল বিশাল গাড়িটা, রানার গাড়ির বিশ ফুট তফাতে পৌঁছে থেমে গেল। ড্রাইভিং সিটে শোফার আছে দেখে একটু তটস্থ হয়ে গেল রানা—একজন সঙ্গী নিয়ে এসেছেন অ্যাডমিরাল; তবে মানুষটাকে চিনতে পেরে কেটে গেল ভয়। নাম চার্লি, প্রাক্তন মেরিন সার্জেন্ট–অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের সঙ্গে গত দশ বছর ধরে আছে। শুধু শোফার নয়, নুমা চিফের ব্যক্তিগত দেহরক্ষীও সে। রানার সঙ্গে ভাল পরিচয় আছে। সৎ এবং বিশ্বস্ত বলেই তাকে জানে রানা।

ছায়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল রানা, এগিয়ে গেল লিমাজিনের দিকে। ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে পিছনের দরজার কাছে গেল চার্লি। হাতে একটা ফ্ল্যাশলাইট রয়েছে তার, এক মুহূর্তের জন্য সেটা জ্বেলে আলো ফেলল এগোতে থাকা ছায়ামূর্তির মুখে। তারপর আবার নিভিয়ে ফেলল। ভাল করেই চেনে সে রানাকে।

‘হ্যালো, চার্লি!’ কাছে গিয়ে বলল রানা।

‘নাইস টু মিট ইউ, মি. রানা,’ মুখে সৌজন্যসূচক হাসি ফুটিয়ে বলল চার্লি। ‘অনেকদিন পর দেখছি আপনাকে।

‘হ্যাঁ। নাইস টু মিট ইউ।’

‘অ্যাডমিরাল আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।’ পিছনের দরজা খুলে ধরল চার্লি।

‘জানি। একটা কথা… কয়েক মিনিট পর গাড়ি থেকে নেমে আমি একটা ম্যাচ জ্বালব। ওটা আসলে সঙ্কেত… পার্কের ভিতর থেকে আরেকজন এসে যোগ দেবে আমাদের সঙ্গে।’

‘কোনও অসুবিধে নেই। অ্যাডমিরাল আমাকে জানিয়েছেন, আপনারা দু’জন থাকবেন এখানে।’

‘আমি আসলে তোমার সিগারেট খাওয়ার অভ্যাসের কথা বলছি, চার্লি। আমি বেরুনোর আগে সিগারেট ধরিয়ো না। ম্যাচ জ্বলতে দেখলে ভুল সঙ্কেত পাবে আমার সঙ্গী। অ্যাডমিরালের সঙ্গে একান্তে কিছুটা সময় চাই আমার।

‘আমি যে সিগারেট খাই, সেটা মনে আছে আপনার?’ একটু অবাক হয়ে বলল চার্লি। ‘স্মরণশক্তি বটে! সতর্ক করে দিয়ে ভাল করেছেন। আমি সত্যিই একটা ধরাবার কথা ভাবছিলাম।’

‘সরি, একটু অপেক্ষা করতে হবে।’ বলে লিমাজিনের পিছনের সিটে উঠে পড়ল রানা, হাত দিয়ে টেনে বন্ধ করে দিল দরজা।

গম্ভীর মুখে বসে আছেন অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন। হাতে জ্বলন্ত সিগার। ওকে দেখতে পেয়ে চোখদুটো একটু উজ্জ্বল হলো, হাত মেলালেন আন্তরিক ভঙ্গিতে

আর ইউ ও.কে., মাই সান?’ রানার ঘাড়ের ব্যাণ্ডেজ দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন অ্যাডমিরাল।

‘সিরিয়াস কিছু না,’ জানাল রানা। তারপর বিব্রত কণ্ঠে যোগ করল, ‘সরি, অ্যাডমিরাল। আপনাকে আবার ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি…’

‘কীসের ঝামেলা?’

‘ইয়ে… দু’দিন পর পর একেকটা বিপদে পড়ি, আর সাহায্য চাই আপনার… নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত হন আপনি?’

‘কী যে বলো না! আমার জন্য, নুমার জন্য… এমনকী সারা দুনিয়ার জন্য তুমি অতীতে যতকিছু করেছ, তার তুলনায় তোমার জন্য কী-ই বা করতে পেরেছি আমি? থাক্, বাদ দাও ওসব। কাজের কথায় এসো। কুয়াশা কোথায়?’

‘পার্কের ভিতরে অপেক্ষা করছে, আমি সিগনাল দিলে আসবে। চারপাশে নজর রাখছে ও, খানিক আগে পুরো এলাকায় তল্লাশিও চালিয়েছি আমরা।’

‘ওসবের কোনও দরকার ছিল?’

‘আপনার ফোনে আড়ি পাতা হতে পারে। রিস্ক নিতে চাইনি আমরা।

‘আমার টেলিফোনে কেউ আড়ি পাততে পারে না, রানা। স্পেশ্যালি এনক্রিপ্টেড লাইন ওটা।’

‘তা-ও… সতর্ক থাকা ভাল না? এবার কাজের কথা। কিছু জানতে পেরেছেন আপনি?’

‘ফেনিস সম্পর্কে?’ সিটে হেলান দিয়ে সিগারে টান দিলেন অ্যাডমিরাল। ‘না… এবং হ্যাঁ। না বলছি এই অর্থে যে, গোটা আমেরিকার কোনও ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্কের গত পঞ্চাশ বছরের ডেটাবেজে সংঘটার উল্লেখ নেই। প্রেসিডেন্ট আমাকে গ্যারান্টি দিয়েছেন এর, তাঁকে বিশ্বাস করি আমি। ফেনিসের কথা শুনে উনি বরং চমকে গেছেন, চাইছিলেন ব্যাপারটার তদন্ত করার জন্য এখুনি ব্যবস্থা নিতে। আমি বুঝিয়ে-শুনিয়ে নিরস্ত করেছি তাঁকে যদি প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ কেউ সত্যিই ফেনিসের চর হয়ে থাকে, তা হলে তাঁর জীবনসংশয় দেখা দেবে। এ-মুহূর্তে ও-ধরনের ঝুঁকি নেয়া যায় না।’

‘আমার ব্যাপারে কিছু বলেছেন প্রেসিডেন্টকে?’

‘চেষ্টা করেছি বলার, কিন্তু সুবিধে করতে পারিনি। এফবিআই নাকি অকাট্য প্রমাণ পেয়েছে তোমার অপরাধের, প্রেসিডেন্ট তাই কোনও রকমের তদবির শুনতে রাজি নন।

‘হুম। ফেনিসের ব্যাপারে হ্যাঁ-ও তো বললেন, সেটা কী?’

হার্ড এভিডেন্স নেই, কিন্তু ভাসা ভাসা কিছু আভাস পেয়েছি সংঘটার। ইন্টেলিজেন্স জগতের সবচেয়ে পুরনো পাঁচজন মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। ওদের মধ্যে তিনজন ফেনিস সম্পর্কে জানেন সংঘটা আঘার উদয় হয়েছে শুনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ওরা, ওদেরকে প্রতিহত করার জন্য আগ বাড়িয়ে সাহায্য করতে চেয়েছে। কিন্তু বাকি দু’জনের

দু’জনের প্রতিক্রিয়া একেবারে অন্যরকম—ফেনিসের নাম-ই নাকি শোনেনি ওরা। ব্যাপারটা একেবারে অবিশ্বাস্য-নিরেট তথ্যপ্রমাণ না থাকতে পারে, অন্তত নাম তো জানা থাকার কথা। একটু খোঁচাখুঁচি করতেই রীতিমত দুর্ব্যবহার করেছে ওরা আমার সঙ্গে। খুবই অদ্ভুত আচরণ। বন্ধু মনে করতাম ওদের দু’জনকে, অথচ ফেনিসের প্রসঙ্গ তোলায় আমার প্রতি অসৌজন্য দেখাতে বাধল না ওদের!’

‘এই দু’জনের নাম দিতে পারেন আমাকে?’

‘নিশ্চয়ই…’ বলতে বলতে ভুরু কুঁচকে উঠল অ্যাডমিরালের। তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে লিমাজিনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল রানা—গাছপালার ফাঁক দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে ঝিলিক দিয়ে উঠছে আলো। একের পর এক ম্যাচের কাঠি জ্বালছে কেউ।

কপালে ভাঁজ পড়ল রানার ম্যাচ জ্বেলে সঙ্কেত দেবার কথা ওর, কুয়াশা জ্বালছে কেন? ভাল করে তাকাতেই একটা ছন্দ লক্ষ করল আলোর মধ্যে—মোর্স কোড! তাতে উল্লেখ করা হচ্ছে একটা মাত্র শব্দ— বিপদ!

ঝট করে অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের দিকে ফিরল রানা।

‘কী হয়েছে?’ নুমা চিফের চোখে বিভ্রান্ত দৃষ্টি।

আপনার ফোন লাইনটা আসলে কতখানি নিরাপদ, অ্যাডমিরাল?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট।’ জোর কণ্ঠে জানালেন হ্যামিলটন। ‘কেউ আড়ি পাতার চেষ্টা করলেও সেটা জানতে পারি আমি।’

সুইচ টিপে জানালার কাঁচ নামাল রানা। ডাকল শোফারকে, ‘চার্লি, এদিকে এসো।’ কাছে এলে জানতে চাইল, ‘তোমাদেরকে কেউ ফলো করেছে?’

‘না, মি. রানা,’ মাথা নাড়ল চার্লি। পিছনে সারাক্ষণ একটা চোখ রেখেছি আমি। অ্যাডমিরাল সতর্ক করে দিয়েছিলেন। গাছের ওখানের ম্যাচ জ্বালছে কে? আপনার বন্ধু নাকি?

‘হ্যাঁ। ওর ধারণা, আমরা ছাড়াও আরও লোক হাজির হয়েছে এখানে।

‘অসম্ভব!’ বলে উঠলেন হ্যামিলটন। ‘কেউ ফলো করেনি আমাদেরকে, এই মিটিঙের খবরও ফাঁস হবার উপায় ছিল না। যদি কেউ এখানে এসে থাকে, সেটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আফটার অল, এটা একটা পাবলিক পার্ক।

‘কিছু মনে করবেন না, স্যর, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। কোনও হেডলাইট দেখিনি আমরা, গাড়িও দেখা যাচ্ছে না আশপাশে। যে-ই এসে থাকুক, নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। পার্কে বেড়াতে আসা সাধারণ মানুষের আচরণ নয় ওটা।

‘কিন্তু কীভাবে পৌঁছুল এখানে?’

‘ফলো করার অনেক টেকনিক আছে। আপনার গাড়িতে কোনও ধরনের হোমিং ডিভাইস ফিট করা হয়েছে কি না, রওনা হবার আগে সেটা চেক করে দেখেছেন?’

‘গুড গড!’ আঁতকে উঠলেন হ্যামিলটন। ‘এখন কী করা?’

দরজা খুলে নেমে পড়ল রানা। চার্লিকে বলল, ‘গাড়িতে উঠে ইঞ্জিন চালু করো। আমি হোমিং ডিভাইস সরাবার ব্যবস্থা করছি। তারপর সবাই কেটে পড়ব এখান থেকে। পার্কিং লট থেকে বেরুনোর সময় উত্তরদিকের রাস্তার পাশে একটু থেমো।’

‘আপনার বন্ধুর কী হবে?’

‘ওর জন্যেই থামতে বলছি। দরজা খুলে ধরব আমি, ও যাতে দৌড়ে এসে উঠে পড়তে পারে গাড়িতে।’

‘এক মিনিট, মি. রানা,’ বাধা দিয়ে বলল চার্লি। ‘বিপদ যদি দেখা দেয়, কারও জন্য থামব না আমি। না আপনার জন্য… না আপনার কোনও বন্ধুর জন্য। একটাই দায়িত্ব আমার: অ্যাডমিরালকে রক্ষা করা। অন্য কারও জন্য ঝুঁকি নেয়া সাজে না আমার।’

‘তর্ক কোরো না, চার্লি!’ গরম গলায় বলল রানা। ‘যা করতে বলছি, ভেবে-চিন্তেই বলছি।’

‘ওর কথা শোনো, চার্লি!’ বলে উঠলেন হ্যামিলটন।

‘ইয়েস, স্যর। আপনি যা বলেন।‘

তাড়াতাড়ি লিমাজিনের পিছনে গিয়ে শুয়ে পড়ল রানা, ঢুকে গেল গাড়ির তলায়। হোমিং ডিভাইস ফিট করার জন্য ট্রাঙ্কের তলার অংশটাই সবচেয়ে আদর্শ। চার্লির ফ্ল্যাশলাইটটা নিয়ে এসেছে, ওটা জ্বেলে খুঁজতে শুরু করল জিনিসটা। কয়েক সেকেণ্ড পরেই গর্জে উঠল ইঞ্জিন, ড্রাইভিং সিটে উঠে কথামত স্টার্ট দিয়েছে চার্লি। শব্দটা হবার সঙ্গে সঙ্গে নরক ভেঙে পড়ল চারপাশে।

অন্ধকার ভেদ করে শক্তিশালী একটা আলোকরশ্মি আছড়ে পড়ল অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের বিশাল গাড়িটার উপর। পরমুহূর্তে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে উঠল মেশিনগান। রানা তখনও হোমিং ডিভাইসটা খুঁজে পায়নি; দু’পাশে গাড়ির পিছনের চাকার কর্কশ আওয়াজ শুনল, হুট করে লিখাজিনটা সরে গেল ওর শরীরের উপর থেকে। গুলির প্রথম ধারায় এরই মধ্যে ওটার ডানপাশের কাঁচ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। শরীরে সৃষ্টি হয়েছে বেশ ক’টা ফুটো।

উন্মুক্ত পার্কিং লটের মাঝখানে চিৎ হওয়া অবস্থায় নিজেকে নাঙ্গা মনে হলো রানার। আত্মরক্ষার উপায় নেই, এই বুঝি বুলেটের মুষলধারা ওকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে! কিন্তু বাস্তবে তা ঘটল না। আততায়ী যে-ই হোক, লিমাজিনকে ঠেকানো তার প্রধান লক্ষ্য; ক্রমাগত গুলি ছুঁড়ছে গাড়িটাকে টার্গেট করে।

নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভঙ্গিতে লিমাজিনকে এদিক-ওদিক দোল খেতে দেখল রানা, মুখ ঘুরিয়ে পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য চার্লি যুদ্ধ করছে স্টিয়ারিং হুইল নিয়ে। শেষ পর্যন্ত তীক্ষ্ণ একটা চক্কর খেয়ে ঘুরে গেল বটে, কিন্তু কর্কশ শব্দ তুলে বন্ধ হয়ে গেল ইঞ্জিন। হেডলাইটের আলোয় দু’জন মানুষকে গাড়ির দিকে ছুটে আসতে দেখল রানা, হাতে অটোমেটিক রাইফেল। দেরি করল না ও, গড়ান দিয়ে ফায়ারিং পজিশনে গেল, সিগ-সাওয়ার তাক করে নিমেষে গুলি ছুঁড়ল লোকদুটোকে লক্ষ্য করে।

ভারী বুলেটের আঘাতে ছুটন্ত অবস্থায় হুমড়ি খেল দুই খুনি, মুখ থুবড়ে আছড়ে পড়ল কংক্রিটের উপর। অক্কা পেয়েছে সঙ্গে সঙ্গে।

আরেকদফা গুলিবর্ষণ করল মেশিনগান—দাঁড়িয়ে থাকা লিমাজিনের বামপাশের কাঁচ এবার গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ল। চেসিসটা মোরব্বার মত গর্ত হয়ে যেতে বসেছিল, কিন্তু পিস্তলের একটা সিঙ্গেল শটের শব্দ শোনা গেল, পরমুহূর্তে থেমে গেল মেশিনগানের গর্জন।

ঘাড় ফিরিয়ে গুলির উৎসের দিকে তাকাল রানা। কুয়াশা ছুটে আসছে ওদিক থেকে। চেঁচিয়ে বলল, ‘ব্যাটাকে ঘায়েল করেছি আমি, রানা। তবে আরও লোক আছে ওদের। আমাদের গাড়িটা নিয়ে এসো! পালাতে হবে আমাদেরকে।

ওর কথার সত্যতা প্রমাণের জন্যই যেন দূর থেকে ভেসে এল উত্তেজিত চেঁচামেচির আওয়াজ। একটা গাড়ির ইঞ্জিন জ্যান্ত হয়ে উঠল কোথাও।

ফ্যাল ফ্যাল করে বিধ্বস্ত লিমাজিনের দিকে তাকাল রানা। অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন… কী অবস্থা ওঁর?

রানার মনের কথা পড়তে পারছে কুয়াশা। বলল, ‘আমি দেখছি অ্যাডমিরালকে। তুমি গাড়ি নিয়ে এসো।’

দু’দিকে ছুটল দু’জনে–কুয়াশা লিমাজিনের দিকে, রানা ওদের গাড়ির দিকে। কপাল ভাল, ওটা এখনও অক্ষত আছে। ইঞ্জিন চালু করে সবেগে আগে বাড়ল, ব্রেক কষল লিমাজিনের পাশে এসে। খুলে দিল দরজা।

লিমাজিন থেকে ধরাধরি করে অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনকে বের করে আনল কুয়াশা আর চার্লি। জ্ঞান হারিয়েছেন নুমা চিফ, সারা শরীর রক্তাক্ত, গুলি লেগেছে নিঃসন্দেহে; আঘাত কতটা গুরুতর, তা বোঝা যাচ্ছে না। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো চার্লি অনেকটাই অক্ষত, ভাঙা কাঁচের টুকরোয় শরীরের বিভিন্ন জায়গা কেটে যাওয়া ছাড়া আর কিছু হয়নি। মেশিনগানের সমস্ত গুলি লিমাজিনের প্যাসেঞ্জার সিট লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয়েছে, শোফারকে নিয়ে মাথা ঘামায়নি আততায়ী।

গাড়ির পিছনের সিটে অ্যাডমিরাল-সহ চার্লিকে উঠিয়ে দিল কুয়াশা। নিজে বসল রানার পাশে। নিচু গলায় বলল, ‘মুভ! ভদ্রলোককে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে আমাদের।’

ঘাড় ফেরাল রানা, আর ঠিক সেই সময় ঝোপ-ঝাড় ফুঁড়ে পার্কিং লটে বেরিয়ে এল দুটো মার্সিডিজ। এক সেকেণ্ডের বেশি দেখল না ও, হ্যাণ্ডব্রেক রিলিজ করে মেঝের সাথে চেপে ধরল অ্যাকসেলারেটর, ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এল পার্কিং লট থেকে। ছুটতে শুরু করল হাইওয়ে ধরে

বামদিকের রিয়ারভিউ মিররে তাকাল রানা। মার্সিডিজ দুটো পিছু নিয়েছে, মাত্র তিনশো মিটার দূরে ওগুলো। পরমুহূর্তে দৃশ্যটা চুরমার হয়ে গেল একঝাঁক বুলেট ছুটে এসে আয়নার কাঁচ গুঁড়িয়ে দেয়ায়।

‘মেঝের সাথে সেঁটে থাকো!’ চার্লির উদ্দেশে চিৎকার করল রানা।

সিটের সামনে, মেঝের উপর অ্যাডমিরালকে নিয়ে কুণ্ডলী পাকাল চার্লি। আহত মানুষটাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।

সামনের সিটে কুঁকড়ে যতটা সম্ভব ছোট হয়ে গেছে কুয়াশা। ‘এটার টপ স্পিড কত?’ জানতে চাইল ও।

‘পুরনো আমলের টয়োটা… আশি-নব্বুইয়ের উপরে যাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না।’ জবাব দিল রানা। ‘কেন, পিছনের ওগুলো কী?’

ঝট করে ঘুরল কুয়াশা, দরজার উপর ঝুঁকে উঁকি দিল পিছনে। ‘সামনে থেকে দেখে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কোন্ মডেলের মার্সিডিজ, তবে সম্ভবত থ্রি হান্ড্রেড এস.ডি.এল.।’

‘ডিজেল?’

টার্বো চার্জড ডিজেল, ঘণ্টায় দুশো বিশ কিলোমিটার ছুটতে পারে।’

পায়ের চাপ দিয়ে মেঝের সাথে সেঁটে ধরল রানা ক্লাচ। গিয়ার বদলে পাঁচ নম্বরে দিল। ‘নাগালের বাইরে থাকার চেষ্টা করব। আপনি গুলি ছুঁড়ে ওদেরকে পিছাতে বাধ্য করুন।’

মাথা ঝাঁকিয়ে জানালা দিয়ে শরীর বের করে দিল কুয়াশা এক ঝাঁক গুলি ছুঁড়ল একটা মার্সিডিজকে লক্ষ্য করে। মাজ থেকে মাত্র পাঁচটা বুলেট বেরুল, অ্যামুনিশন ক্লিপ খালি হয়ে গেছে। আরেকটা ক্লিপের সন্ধানে পকেট হাতড়াতে শুরু করল, কিন্তু পেল না। ছোটাছুটির সময় নিশ্চয়ই পড়ে গেছে পার্কে।

‘আমার অ্যামিউনিশন শেষ,’ জানাল ও।

এক হাতে সিগ-সাওয়ারটা বাড়িয়ে ধরল রানা। ‘গুলিতে কাজ হচ্ছে?’

‘হ্যাঁ, কিন্তু ওরা পাল্টা গুলি করছে না কেন, বুঝতে পারছি না। বোধহয় অ্যামিউনিশন বাঁচাচ্ছে।’

‘উঁহুঁ, আমাদেরকে মাঝখানে রেখে স্যাণ্ডউইচ তৈরি করতে চাইছে,’ বলল রানা। ‘যাতে মিস না করে।’ রাস্তার দিকে চোখ, তবে মাথার ভিতর পালানোর পথ খোঁজার কাজ চলছে দ্রুত। বুঝেশুনে ফায়ার করুন। স্পেয়ার ক্লিপ নেই আমার কাছে। চার্লি, তোমার কাছে পিস্তল আছে?’

‘সরি, মি. রানা,’ জানাল অ্যাডমিরালের শোফার কাম দেহরক্ষী। ‘তাড়াহুড়োয় আমারটা লিমাজিনের গ্লাভ কম্পার্টমেন্টে ফেলে এসেছি।’

‘কী করা যায় তা হলে?’ জিজ্ঞেস করল কুয়াশা।

আসার আগে এই এলাকার ম্যাপ স্টাডি করে এসেছে রানা। স্মরণ করল কী দেখেছে। বলল, ‘সামনে একটা স্কি-রিসোর্ট পড়বে। ট্রেইল পাবো ‘রাস্তার পাশে, স্কি রান-এর চূড়ায় উঠে গেছে। পিছনের ওদেরকে যদি কিছুটা সময় আটকে রাখা যায়, তা হলে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে যেতে পারব। গাছপালার ভিতর দিয়ে বেশি জোরে ছুটতে পারবে না ওরা, হয়তো পালাতে পারব ওদেরকে ফাঁকি দিয়ে। হাইওয়েতে থাকলে বাঁচার কোনও আশা নেই।

‘সামনে কতদূর?’

‘পরের বাঁকের কাছাকাছি

‘কিন্তু হাইওয়ে ছাড়লে আমাদের স্পিডও কমবে,’ বলল কুয়াশা। ‘উল্টো বিপদ দেখা দেবে না তো?’

‘এরচেয়ে ভাল কোনও আইডিয়া থাকলে বলতে পারেন।

পিছনদিকে তাকাল কুয়াশা। মাত্র পঁচাত্তর মিটার দূরে শত্রুরা, দূরত্ব প্রতি মুহূর্তে কমছে। বুঝতে পারল, আর কোনও বিকল্প নেই। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, রানা। তোমার প্ল্যানই ফলো করব আমরা। গাড়িকে একটা সরলরেখায় ধরে রাখো, আমি দেখছি ওদের কতটা ক্ষয়ক্ষতি করা যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *