সেই কুয়াশা ১.১৯

উনিশ

ইটালিয়ান উপকূলের দিকে ধীরগতিতে এগোচ্ছে ট্রলার। সাগর উত্তাল, ঢেউয়ের সঙ্গে অবিরাম যুদ্ধ করছে ছোট জলযান। বাস্তিয়া থেকে রওনা হবার পর কেটে গেছে পুরো সতেরো ঘণ্টা। সন্ধ্যা নামতে দেরি নেই। সূর্য ডুবে গেলেই একটা লাইফবোটে করে নামিয়ে দেয়া হবে রানা আর সোনিয়াকে, ওটাই তীরে নিয়ে যাবে ওদেরকে।

শ্লথগতির এই যাত্রায় একটা লাভ হয়েছে রানার—যথেষ্ট সময় পেয়েছে সোনিয়ার সঙ্গে সখ্য গড়বার, ওর ব্যাপারে জানবার। ইতোমধ্যে জানা হয়ে গেছে, সোনিয়ার পিতা… পিয়েরে মাযোলা… ছিলেন নাবিক, ফ্রেঞ্চ মেইনল্যাণ্ডে গিয়ে প্রেমে পড়েছিলেন ওর ফরাসি মায়ের। পরে বিয়ে করে ফিরে এসেছিলেন কর্সিকায়; থিতু হয়েছিলেন ভেসকোভাতোয়।

‘তা হলে তুমি কনভেন্ট স্কুলে ফ্রেঞ্চ শিখেছ কেন?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছে রানা। মায়ের কাছ থেকেই তো শিখতে পারতে।’

‘পারতাম, কিন্তু শিখিনি,’ হাসতে হাসতে বলেছে সোনিয়া। ‘বাবার ইটালিয়ান নিয়ে সারাক্ষণ খোঁটা দিতেন মা, তাই ওঁকে রাগাবার জন্য স্কুলে গিয়ে ফ্রেঞ্চ ক্লাস করেছি।’

অদ্ভুত এক পরিবর্তন এসেছে মেয়েটার ভিতর-পোর্তো ভেচিয়োর কথা যেন ভুলেই গেছে। হাসছে সারাক্ষণ এটা-সেটা নিয়ে। কৃত্রিম নয়, সত্যিকার হাসি—ওর আনন্দে উচ্ছল চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় সেটা। বিশ্বাস করা মুশকিল, এই মেয়েই কর্সিকার পাহাড়ে কী কঠোর রূপ নিয়ে হাজির হয়েছিল ওর আর কুয়াশার সামনে, ওদেরকে হুমকি দিচ্ছিল লুপো শটগান হাতে নিয়ে।

‘তুমি বন্দুক চালাতে শিখেছ কোথায়?’ একসময় প্রশ্ন করল রানা।

‘কী আর বলব! একটা বয়সে মানুষ খানিকটা পাগল হয়ে যায় না? আমিও হয়েছিলাম—ভাবতাম, ভায়োলেন্স ছাড়া সমাজকে বদলাবার কোনও উপায় নেই। ব্রিগেট রোজ-এর বদমাশগুলো সেই সুযোগ নেয়, আমাকে ভর্তি করে নেয় ওদের দলে…’

‘ব্রিগেট রোজ!’ চমকে উঠল রানা। ‘কী সর্বনাশ! তুমি রেড ব্রিগেডে ছিলে?’

মাথা ঝাঁকাল সোনিয়া। ‘মেডিসিনা-য় ওদের একটা ক্যাম্পে কয়েক সপ্তাহ কাটিয়েছি আমি – অস্ত্র চালাতে শিখেছি, দেয়াল রাইতে শিখেছি; কীভাবে বেআইনী জিনিসপত্র পাচার করতে হয়, তা শিখেছি… অবশ্য কোনোটাতেই খুব একটা ভাল করতে পারিনি। ধীরে ধীরে ঝোঁক কেটে যেতে শুরু করল। এরপর একদিন একটা ছেলে… আমারই মত নতুন এক রিক্রুট… মারা পড়ল ক্যাম্পে। ক্যাম্প লিডার বলল, ট্রেইনিং অ্যাকসিডেন্ট; আসলে তা নয়। কোনও ধরনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ছাড়া ছুরি-বন্দুক হাতে মানুষকে ছেড়ে দিলে এসব তো ঘটবেই! আমার কোলে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল ছেলেটা, ক্ষত থেকে রক্ত পড়ছিল অনবরত, আতঙ্ক আর দুঃখ ভর করেছিল ওর দু’চোখে। কিছু করতে পারিনি ওর জন্য। সহ্য হয়নি সে-কষ্ট। বুঝতে পেরেছিলাম, অস্ত্রের ভাষা শিখতে পারব না আমি  কোনোদিন। সে-রাতেই ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসি।’

‘সেদিন রাতে লুপো হাতে পাহাড়ে যে-ভাবে কথা বলছিলে, তাতে তোমাকে এতটা নরম বলে মনে হয়নি আমার কাছে,’ রানা

মন্তব্য করল।

‘ওটা অভিনয় ছিল, সেনিয়র,’ বলল সোনিয়া। ‘অন্ধকারে আমার,চোখ দেখতে পাওনি, তা হলেই বুঝে ফেলতে সব।

কথাটা বিশ্বাস করল রানা।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সোনিয়া। তারপর বলল, ‘একটা ব্যাপারে এখনও আমাদের মধ্যে ফয়সালা হয়নি, সেনিয়র।’

‘কীসের কথা বলছ?’ জানতে চাইল রানা।

‘আমার ভবিষ্যৎ। কর্সিকা থেকে বেরিয়ে এসেছি, এবার কী করবে তুমি আমাকে নিয়ে?’

‘তোমার কী ধারণা?’ পাল্টা প্রশ্ন করল রানা।

‘জানি না। কিন্তু এখন পর্যন্ত তোমাদের সব কথা শুনেছি আমি, পালাইনি। এখনও যদি আমাকে বিশ্বাস করতে না পারো…’

‘পালাওনি কেন?’ বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করল রানা।

ভয়ে। তোমরা দুই বন্ধু মোটেই সাধারণ মানুষ নও। আচার-আচরণে ভদ্রলোক, তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু দু’জনের ভিতরেই নিষ্ঠুরতার আভাস পেয়েছি আমি।’

‘তাতেই বাধা পেয়েছ?’

হ্যাঁ। মনে হচ্ছিল পালাবার চেষ্টা করলেই তোমার বন্ধু আমাকে গুলি করে মারবে।’

‘ওটা তোমার মনের ভুল। আমাদের সঙ্গে তুমি সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিলে।’

‘এখনও কি আমি নিরাপদ? যদি কথা দিই, কাউকে কিছু বলব না, তা হলে তুমি আমাকে যেতে দেবে?’

‘কোথায় যাবে?’

‘বোলোগনা। ওখানে কাজ জুটিয়ে নিতে পারব আমি।’

‘কী ধরনের কাজ?’

উল্লেখ করার কিছু না। ইউনিভার্সিটির রিসার্চার হিসেবে যোগ দিতে পারব। আগেও করেছি ও-কাজ। বইপত্র ঘেঁটেঘুঁটে প্রফেসরদের জন্য বিভিন্ন তথ্য জোগাড় করতে হয়, ওঁরা সেসব থেকে নিজেদের আর্টিকেল তৈরি করেন।’

‘রিসার্চার?’ মুচকি হাসল রানা। ‘বেতন কেমন পাও?’

‘চলে যায় কোনোমতে। কিন্তু ওসব নিয়ে তোমার মাথাব্যথা কীসের? আমাকে বোলোগনায় যেতে দেবে কি না বলো।’

বুঝতে পারছি, বেতন ভাল না। ও-পেশায় ফিরে যাবার দরকার কী?’

‘কাজটা আমার পছন্দের,’ জবাব দিল সোনিয়া। ‘তা ছাড়া বাঁধাধরা রুটিন অনুসরণ করতে হয় না। যখন খুশি কাজ করলাম, যখন খুশি অন্য কিছু নিয়ে মেতে রইলাম।’

মানেটা দাঁড়াচ্ছে, তুমি একজন স্বাধীন ফ্রিল্যান্সার, খেয়াল-খুশিমত ব্যবসা করছ,’ বাঁকা সুরে বলল রানা। ‘পুঁজিবাদের মূলে কিন্তু ওটাই!’

‘ফালতু কথা বলছ তুমি!’ তেতে উঠল সোনিয়া। ‘আমার প্রশ্নকে এড়িয়ে যাচ্ছ বার বার।’

‘কী প্রশ্ন?’

‘আমাকে তুমি যেতে দেবে কি না? বিশ্বাস করবে আমাকে, নাকি তোমার অসতর্কতার জন্য তক্কে তক্কে থাকতে হবে… যাতে পালাতে পারি?’

‘ও-ধরনের চেষ্টা না করাই উচিত হবে,’ শান্ত গলায় বলল রানা। ‘শোনো, তোমাকে আমি অবিশ্বাস করি না। কিন্তু একটু আগেই তো বললে, এখন পর্যন্ত পালাবার চেষ্টা করোনি প্রাণের ভয়ে; তারমানে আমাদের উপর একবারও আস্থা রাখোনি তুমি… থেকেছ শুধুই ভয় পাবার কারণে। এখন নিজেই বলো, ছাড়া পাবার পর যে মুখ বন্ধ রাখবে, সে-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হব কীভাবে? আমার উপর আস্থা রাখোনি তুমি…. আমি কী করে আস্থা রাখব তোমার উপরে?’

ক্ষণিকের জন্য মুখের ভাষা হারাল সোনিয়া। নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল ডেকের দিকে—ট্রলারের নাবিকরা লাইফবোট নামানোর তোড়জোড় শুরু করেছে। একটু পর ও বলল, ‘তারমানে কি তীরে পৌঁছে আমাকে খুন করবে তুমি? ওটা ছাড়া তো আমার মুখ বন্ধ রাখার আর কোনও উপায় নেই।’

‘রাজে কথা বোলো না। অমন ধারণা মাথায় এল কেন তোমার?’

‘আর কী বিকল্প আছে আমার?’

আমি তোমাকে একটা কাজ দিতে চাই।’

‘তোমার কাছে কাজ চাই না আমি, সেনিয়র। শুধু মুক্তি চাই!’

‘সময় এলে তা-ও পাবে।‘

লাইফবোট নামিয়ে ফেলেছে নাবিকরা। ডাফল ব্যাগ আর হ্যাভারস্যার নিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। হাত বাড়িয়ে দিল সোনিয়ার দিকে। ‘চলো, যাবার সময় হয়েছে।’

হাত ধরল না সোনিয়া। উঠে দাঁড়াল, কিন্তু রানার দিকে ফিরেও তাকাল না।

.

তীরে নেমেই একটা ট্যাক্সি ভাড়া করল রানা, রোমে যাবে। দূরের গন্তব্যের কথা শুনে ড্রাইভার শুরুতে একটু গাঁইগুই করছিল, কিন্তু ওর হাতে ডলারের তাড়া দেখতে পেয়ে মত পাল্টাল। পথে একটা খাবারের দোকানের সামনে পনেরো মিনিটের বিরতি নিল ওরা, ডিনার সারল, তারপর আবার উঠে পড়ল ট্যাক্সিতে। রাত আটটা বাজার খানিক আগে পৌছে গেল রাজধানীর উপকণ্ঠে। রাস্তাঘাটে তখনও মানুষের ভিড়, দোকানপাটে চলছে শেষ মুহূর্তের কেনাবেচা।

‘গাড়ি থামাও,’ পোশাকের একটা দোকান দেখতে পেয়ে ড্রাইভারকে বলল রানা। ইঞ্জিন বন্ধ কোরো না, আমি যাব আর আসব।’

‘কোথায় যাচ্ছ?’ জানতে চাইল সোনিয়া।

‘তোমার জন্য কাপড় কিনতে, ইশারায় ওর পরনের ফিল্ড জ্যাকেট আর ট্রাউজার দেখাল রানা। এ পোশাকে ভাল কোনও দোকানে ঢুকতে পারবে না।

পাঁচ মিনিট পরেই ফিরে এল ও। হাতের ব্যাগে ডেনিম স্ন্যাকস্, সাদা ব্লাউজ আর একটা উলের সোয়েটার। সোনিয়ার হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘সাইজ-টা আন্দাজ করে নিতে হয়েছে। একটু এদিক-ওদিক হলে কিছু মনে কোরো না। চটপট পরে ফেলো এগুলো।’

‘এখানে?’. চোখ কপালে তুলল সোনিয়া। ‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?’

‘লজ্জা-শরমের কথা ভুলে যাও কিছুক্ষণের জন্য,’ বলল রানা । ‘আমি অন্যদিকে তাকাচ্ছি। হাতে সময় নেই, দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাবার আগেই তোমাকে নিয়ে কেনাকাটা সারতে হবে আমাকে। এগুলোয় হবে না, আরও জামাকাপড় দরকার তোমার।’ ড্রাইভারের দিকে ফিরল, রিয়ারভিউ মিররে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে সে। ‘অ্যাই, গাড়ি চালাতে শুরু করো!’ ধমকে উঠল ও। ‘আবার যদি পিছনে তাকাতে দেখি, চোখ গেলে দেব।’

ব্যতিব্যস্ত হয়ে ট্যাক্সিকে আগে বাড়াল ড্রাইভার। ডাফল ব্যাগ থেকে একটা জ্যাকেট বের করে গায়ে চড়াল রানা, জানালা দিয়ে চোখ ফেরাল বাইরে। পাশে সোনিয়াও দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে কাপড় বদলাতে শুরু করেছে। খাকি ট্রাউজার খুলে ফেলে ডেনিম পরল, চকিতের জন্য চোখের কোণ দিয়ে ওর সুগঠিত পা-জোড়া দেখতে পেল রানা; নিজেকে সংবরণ করার জন্য বন্ধ করে ফেলল দু’চোখ।

ফিল্ড-জ্যাকেট আর শার্ট খুলে ব্লাউজ পরল সোনিয়া, উপরে সোয়েটার। বলল, ‘এবার মাথা ঘোরাতে পারো, সেনিয়র।

সোজা হয়ে মেয়েটার দিকে তাকাল রানা। ঢোক গিলল সঙ্গে সঙ্গে। নতুন পোশাকে আবেদন বেড়ে গেছে সোনিয়ার। সোয়েটার একটু আঁটসাঁট হয়েছে, উঁচু হয়ে আছে যুগল স্তন। চোখ আটকে যাচ্ছিল ওদিকে, নীরবে নিজেকে শাসন করে দৃষ্টি তুলল উপরদিকে।

‘দ্যাটস্ বেটার,’ বলল ও। ‘এখন আর পাহাড়ি মেয়ের মত লাগছে না তোমাকে।

‘শুনে খুশি হলাম। কিন্তু তোমার পছন্দ ভাল না। আমি হলে এ-পোশাক কিছুতেই কিনতাম না।’

‘ইচ্ছে হলে ঘণ্টাখানেক পরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ো এগুলো… অন্য পোশাক কেনা হয়ে গেলে।’ ড্রাইভারের দিকে ফিরল রানা। ‘ভিয়া কণ্ডোট্টি-তে চলো। ওখানেই ভাড়া মিটিয়ে তোমাকে ছেড়ে দেব আমরা।’

.

ভিয়া কণ্ডোট্টি-র ক্লোদিং স্টোর-টা বিশাল, একেবারে প্রথম শ্রেণীর। ধনী ক্রেতা ছাড়া আর কারও আনাগোনা নেই ওখানে। বলা বাহুল্য, এমন দোকানে আগে কখনও পা রাখেনি সোনিয়া; তারপরেও ভিতরে ঢুকে নিজেকে সংযত রাখল ও। প্রশংসনীয় একটা গুণ, শিরায় বইতে থাকা অভিজাত রক্তের প্রমাণ। বাস্তিয়ার মদ্যশালায় এই আভিজাত্যই লক্ষ করেছে রানা।

সিল্কের একটা ড্রেস, সেইসঙ্গে চওড়া ব্রিমের একটা সাদা হ্যাট: আর হাই হিল জুতো পছন্দ করল সোনিয়া। ফিটিং রুমে ঢুকে পরল ওগুলো। বেরিয়ে এসে রানাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন লাগছে?’

‘খুব সুন্দর!’ ওর দিকে তাকিয়ে হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হয়ে গেল রানার।

‘তা তো বটেই। কিন্তু দাম দেখেছ? এই টাকা দিয়ে পোর্তো ভেচিয়োর এক পরিবারের পুরো মাস চলে যাবে। না বাবা, এত দামি কাপড়চোপড়ের দরকার নেই। চলো অন্য কোথাও যাই।’

‘ঘোরাঘুরির সময় নেই। আরও দু’চারটে ড্রেস বাছাই করো… আর আণ্ডারওয়্যার। তারপর আবার -তোমার জন্য ব্রাশ-টুথপেস্ট, মেকআপ, চিরুনি… এসব কিনতে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি করো।’

‘তাই বলে এত খরচ করবে?’

‘খরচ নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। জলদি হাত-পা চালাও।’

কেনাকাটা শেষে ভিয়া সিস্টিনার একটা বুদ থেকে পিয়াজা নাভোনা-র এক রুমিং হাউসে ফোন করল রানা, কামরা চাইল। ওখানকার বৃদ্ধ বাড়িঅলা আর তাঁর স্ত্রী ওর পূর্ব-পরিচিত। রোমে এলে মাঝে মাঝে ওখানে ওঠে রানা। জায়গাটা জনবহুল, লোকের ভিড়ে মিশে যাবার জন্য আদর্শ। বার্নিনি ফাউণ্টেইন নামে একটা ঝর্ণা আছে ওখানে; রোমের সাধারণ জনতা, এবং ট্যুরিস্টদের ভিড় লেগেই থাকে সবসময়। প্রচুর আউটডোর ক্যাফে আছে, যে-কোনও একটায় বসে সহজেই নজর রাখা যায় চারপাশে। এ-মুহূর্তে অমন জায়গাই দরকার ওর।

আধঘণ্টার মধ্যে পিয়াজা নাভোনায় পৌঁছুল রানা- সোনিয়া। কামরা পর্যন্ত বাড়িঅলা নিজেই নিয়ে গেল ওদেরকে। ভিতরে ঢুকে তার হাতে খুচরো কিছু টাকা গুঁজে দিল রানা, বিদায় দিয়ে বন্ধ

করল দরজা।

কামরার ভিতর নজর বোলাচ্ছে সোনিয়া। বিল্ডিংটা পুরনো, ছাত তাই অনেক উঁচুতে। জানালাগুলোও অনেক বড়, খুললে তিনতলা নীচে পিয়াজা-র চত্বরের পুরোটা দৃষ্টিগোচর হয়।

দেয়ালের পাশে ঠেস দেয়া সোফায় বসে পড়ল রানা। বিছানার দিকে ইশারা করে সোনিয়াকে বলল, ‘সারাদিনে অনেক ধকল গেছে। শুয়ে পড়ো। বিশ্রাম দরকার আমাদের।’

কথাটা সোনিয়ার কানে গেছে বলে মনে হলো না। শপিং ব্যাগ থেকে সিল্কের ড্রেসটা বের করে নাড়াচাড়া করছে ও। জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, আমাকে এত দামি জামাকাপড় কিনে দিলে কেন তুমি?’

‘আগামীকাল কয়েক জায়গায় যাব আমরা,’ বলল রানা। ‘তাই ভাল পোশাক দরকার হবে তোমার।

‘নিশ্চয়ই বড়লোকী ক্লাব-ট্রাব বা হোটেলের কথা বলছ?’

ঠিক তা না। কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে আমাকে। তুমি সঙ্গে থাকলে ভাল হয়।’

কারণ যা-ই ‘হোক, ধন্যবাদ। এত সুন্দর জামা আগে কোনোদিন পরিনি আমি।’

‘ও কিছু না। সুন্দর মেয়েদের তো সুন্দর পোশাক-ই পরা উচিত।’

অযাচিত প্রশংসা পেয়ে গাল একটু গোলাপি হয়ে উঠল সোনিয়ার। প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য বলল, ‘তুমি কোথায় শোবে?’

‘কিচ্ছু ভেবো না, আমি খাঁটি ভদ্রলোক,’ সোফার উপর চাপড় দিল রানা। ‘আমার জন্য এটাই কাফি।’

বাথরুমে চলে গেল সোনিয়া, পোশাক পাল্টাবে। জুতো-মোজা খুলে রানা আধশোয়া হলো সোফায়।

‘বাতি নিভিয়ে দেব?’ বাথরুম থেকে বেরিয়ে জিজ্ঞেস করল সোনিয়া।

‘দাও।’

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে অন্ধকারে ডুবে গেল কামরা। কাপড়ের খসখসানি শুনল রানা, বিছানায় উঠে পড়েছে সোনিয়া।

‘সোনিয়া?’ কিছুক্ষণ পর ডাকল ও।

‘বলো, সেনিয়র।

‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’

‘কী কথা?’

‘বোলোগনা ছেড়ে কর্সিকায় গিয়েছিলে কেন তুমি?’

‘কেন জানতে চাইছ?’

‘স্রেফ কৌতূহল, আর কিছু না।’

‘বলেছি তো, দাদীকে সঙ্গ দেবার জন্য। কেন, তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না?’

উঁহুঁ। আমার ধারণা, আরও কোনও কারণ আছে। পাহাড়ি ওই এলাকা গা-ঢাকা দেবার জন্য আদর্শ। তুমি কি লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করছিলে?’

‘যদি করিও, তাতে তোমার কী আসে যায়?’

‘অনেক কিছুই আসে যায়,’ গলার স্বর কঠিন হলো রানার। ‘তোমার দায়িত্ব এখন আমার কাঁধে। যদি কোনও সমস্যা থাকে, সেটা খুলে বলতে হবে তোমাকে, যাতে বিপদ মোকাবেলার জন্য তৈরি থাকতে পারি আমি।’

‘চুপ করো!’ হিসিয়ে উঠল সোনিয়া। উঠে বসল বিছানায়। ‘সেধে আমার দায়িত্ব নিয়েছ তুমি! আমি তো চলেই যেতে চেয়েছি!’

‘কোথায় যাবে?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘বোলোগনার ব্যাপারে যা শুনিয়েছ, তা মিথ্যে। কিছুতেই ওখানে যাবে না তুমি—আমি তা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কেন?’ :

‘এসব নিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই না আমি!’ গলার স্বর ভেঙে গেল সোনিয়ার, ফুঁপিয়ে উঠল।

সোফা ছেড়ে বিছানার দিকে এগোল রানা। কাছে গিয়ে হাত রাখল মেয়েটার কাঁধে। নরম গলায় বলল, ‘সব খুলে বলো আমাকে। মন হালকা হবে।’

ভেজা চোখে ওর দিকে তাকাল সোনিয়া। জানালা গলে আসা ম্লান আলোয় চিকচিক করছে ওর গাল বেয়ে নেমে আসা অশ্রু। কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক তাকিয়ে থাকল, তারপর হঠাৎই যেন অনুভব করল, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটির উপর আস্থা রাখা : যেতে পারে। ওকে বিশ্বাস করলে ঠকতে হবে না।

বিছানা থেকে নামল সোনিয়া, জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রানার দিকে পিঠ রেখে বলল, ‘বেশ, সব বলছি তোমাকে। বোলোগনায় আমি ফিরতে পারব না, এ-কথাটা ঠিক নয়। পারব… সত্যি বলতে কী, ফিরতে আমাকে হবেই। নইলে ওরাই আমাকে খুঁজে বের করবে।’

‘কারা?’

‘রেড ব্রিগেডের লোকেরা। ওদের ফাঁকি দিয়ে কেউ বাঁচতে পারে না।‘

‘ভয়টা অমূলক হয়ে যাচ্ছে না?’ ভুরু কুঁচকে বলল রানা। ‘রেড ব্রিগেডের ক্ষমতা এখন আর আগের মত নেই। আশির দশকের শেষে সংগঠনটাকে মোটামুটি ধ্বংস করে দিয়েছে তোমাদের সরকার। যতটুকু এখন অবশিষ্ট আছে, তা খুবই দুর্বল। ছোটখাট টেরোরিস্ট হামলা ছাড়া বেশি কিছু করবার মুরোদ নেই ওদের।’

‘ভুল, সেনিয়র। আবারও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে ওরা… বাইরের দুনিয়া এখনও তা জানে না।’

‘তা-ই? কিন্তু এমন একটা সংগঠন তোমার পিছনে লাগবে কেন? ওদের ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এসেছিলে বলে? সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো থেকে বহু রিক্রুটই পালায়, এ নতুন কিছু নয়।

আমার ব্যাপারটা এখনও তুমি জানো না, সেনিয়র। আমি পালিয়েছিলাম বটে, কিন্তু পরে ধরাও পড়ে গিয়েছিলাম। বন্দি করে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মেডিসিনায়। বিচার করা হয়েছিল ব্রিগেডের লাল আদালতে! সে বড়ই ভয়ানক এক আদালত-সত্যিকার আদালতের মত মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ওখানে। আমার বেলাতেও তা-ই ঘটতে চলেছিল। সামান্য এক রিক্রুট আমি, পালিয়ে গিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলাম ব্রিগেডের সঙ্গে। পুলিশ যদি খোঁজ পেত, তা হলে পুরো সংগঠনের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ত। খুবই গুরুতর অভিযোগ এসব… ‘

‘বাঁচলে কীভাবে?’

‘প্রাণভিক্ষা চাই আমি ওদের কাছে। মিথ্যে কথা বলি—ওদেরকে জানাই যে, খুন হওয়া ছেলেটাকে ভালবাসতাম আমি… ওর কারণে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল, আবেগের বশে বোকামি করে ফেলেছি। বলা বাহুল্য, এসব অনুনয়-বিনয়ে কাজ হবার কথা নয়; কিন্তু আমার বেলায় হলো। ব্রিগেডের এক প্রভাবশালী নেতার কুনজর ছিল আমার উপর। নিজের ‘কামনা চরিতার্থ করার জন্য আমার জীবন বাঁচায় সে, রক্ষিতা বানায় আমাকে। পুরো একটা বছর তার সঙ্গে থাকি আমি, সত্তাহীন একটা প্রাণীর মত… নরকতুল্য পরিবেশে। রাতের পর রাত লোকটার মনোরঞ্জন করতে হয়েছে আমাকে, রাগে আর ঘৃণায় বহুবার চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হয়েছে… কিন্তু পারিনি। প্রাণের মায়ায় সবই সহ্য করে গেছি নীরবে।’ ঘুরে রানার মুখোমুখি হলো সোনিয়া। ‘তুমি জানতে চেয়েছ, সেনিয়র, এখন পর্যন্ত আমি পালাবার চেষ্টা করিনি কেন। সত্যি কথা হলো, এ-ধরনের পরিস্থিতি আমার জন্য নতুন কিছু নয়… মানে, প্রাণ বাঁচানোর জন্য ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করা। বোলোগনায় বন্দি ছিলাম আমি, পোর্তো ভেচিয়োতেও স্বেচ্ছাবন্দি করেছিলাম নিজেকে… আর এখন বন্দি হয়েছি তোমাদের হাতে। তবে জেনে রাখো, সহ্যের শেষ সীমায় পৌছে গেছি আমি। খুব শীঘ্রি পালাবার চেষ্টা করব,

পিছন থেকে চাইলে তুমি গুলি চালাতে পারো; আমি পরোয়া করব না। তোমার দেয়া কাপড়চোপড় ফিরিয়ে নাও, সেনিয়র রানা। আমার পিছনে টাকা-পয়সা খরচ করবার কোনও দরকার নেই।

ওকে বিস্মিত করে দিয়ে মুচকি হাসল রানা। বলল, ‘যাক, অন্তত আত্মহত্যার কথা ভাবছ না! পালাবার কথা বলছ… নিঃসন্দেহে ওটা ভাল লক্ষণ।’

‘তুমি হাসছ?’

‘হাসব না? মেয়েরা শুনেছিলাম সব বুঝতে পারে… অথচ তুমি কিছুই বোঝোনি।’

‘কী বুঝিনি?’

‘আমি তোমাকে গুলি করব না, সোনিয়া… কখনোই না।’

‘মিথ্যে কথা!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল সোনিয়া। তুমি একটা খুনি। ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করতে পারো তুমি! তোমার চোখ দেখেই সেটা বুঝতে পেরেছি আমি।’

‘হ্যাঁ, আমি খুনি,’ শান্ত গলায় বলল রানা। কিন্তু খুন করি শুধুমাত্র প্রয়োজনের তাগিদে-আত্মরক্ষার জন্য, কিংবা দুনিয়াকে মানুষ নামের কিছু কলঙ্কের হাত থেকে মুক্ত করতে। যা হোক, এ নিয়ে তর্কে যাব না তোমার সঙ্গে। কেবল এটুকু বলব, আমার তরফ থেকে কোনও ধরনের ভয় নেই তোমার। পালাবার দরকার হবে না।’

‘কেন?’

‘কারণ তোমাকে আমার প্রয়োজন; একইভাবে আমাকেও তোমার, ‘

‘কীসের জন্য? রেড ব্রিগেডের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করবে তুমি? এটাই বলতে চাইছ?’

‘শুধু রক্ষা না। আমি তোমার জীবনটাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাব, যাতে আর কোনোদিন ভয়ের মাঝে থাকতে না, হয় তোমাকে। কীভাবে সেটা সম্ভব, তা এখুনি বলতে পারছি না। হয়তো সময় লাগবে… কিন্তু আমি আমার কথা রাখব। ‘

‘কেন বিশ্বাস করব তোমাকে?’

‘কারণ আর কোনও পথ নেই তোমার সামনে। নিজেই তো বললে, রেড ব্রিগেড একসময় তোমাকে খুঁজে বের করবে। ততদিন পর্যন্ত কি এভারেই বাঁচতে চাও?’

‘পোর্তো ভেচিয়োতে সহজে আমার খোঁজ পেত না ওরা। অনেকদিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পারতাম ওখানে।’

‘সেটা তো এখন আর সম্ভব নয়। হলেও বা ফিরবে কেন ওখানে? পাহাড়ঘেরা ওই জায়গায় কেন বন্দি করে রাখবে নিজেকেই কী আছে ওখানে? যারা তোমার দাদীকে খুন করেছে, তাদের সঙ্গে ব্রিগেডের খুব কি তফাৎ আছে? দু’দলই মানুষ খুন করে—হয় গোমর রক্ষার জন্য, নয়তো মিথ্যে আদর্শ বাস্তবায়ন করার নামে। বিশ্বাস করো, এদের মাঝে কানেকশন আছে। এই কানেকশনই খুঁজে বেড়াচ্ছি আমি আর কয়াশা। যে করে হোক, ওদেরকে থামাতে হবে, ওরা আমাদেরকে থামাবার আগেই তোমার দাদী সেটা বুঝতে পেরেছিলেন, তাই অনুরোধ করছি—সাহায্য করো আমাদেরকে। নিজেকেও সাহায্য করো!’

‘তোমাদেরকে সাহায্য করার কোনও উপায় নেই আমার।‘

‘কী করতে বলব, তা তো শোনোইনি এখনও।‘

‘শোনার প্রয়োজন নেই। আমি জানি কী চাইছ তুমি। ব্রিগেডের কাছে ফিরে যেতে বলবে আমাকে, তাই না? আমার মাধ্যমে ওদের নাগাল পেতে চাও তুমি।’

‘হয়তো… কিন্তু এখুনি নয়।’

‘অসম্ভব! মরে গেলেও ওদের কাছে যাব না আমি। ওরা মানুষ না, জানোয়ার!’

‘হ্যাঁ… এবং এ-কারণেই ধ্বংস করতে হবে ওদেরকে।’

‘কীভাবে? তুমি আর সেনিয়র কুয়াশা… মাত্র দু’জনে কীভাবে ধ্বংস করবে রেড ব্রিগেডের মত একটা সংগঠনকে?’

‘ওদের কোমর ভেঙে দেব আমরা। যাদের কাছ থেকে পয়সাকড়ি পাচ্ছে ওরা, যাদের কথামত কাজ করছে—তাদেরকে খতম করে দেব। তখন শুধু রেড ব্রিগেড না, দুনিয়ার বহু সন্ত্রাসী সংগঠনই ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে।’

‘তোমার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, সেনিয়র। বলতে চাইছ, রেড ব্রিগেডকে অন্য কেউ চালাচ্ছে? কে সেটা?’

‘ফেনিস নামে একটা গুপ্তসংঘ। এতদিন শুধু গুজব শুনেছি এ-ব্যাপারে, কিন্তু তোমার দাদীর কাছ থেকে প্রথমবারের মত নিরেট কিছু তথ্য পেয়েছি আমরা, যা ধরে ওদের মুখোশ ছিঁড়ে ফেলা যায়। সংঘটার জন্মের সময় উপস্থিত ছিলেন তিনি।’

‘কী তথ্য পেয়েছ?’

‘ফেনিসের প্রতিষ্ঠাতাদের নাম-ধাম …’

বলতে বলতে থমকে গেল রানা। মৃদু একটা শব্দ কানে এসেছে ওর। জানালা দিয়ে বাইরে থেকে ভেসে আসেনি ওটা, এসেছে দরজার ওপাশ থেকে। কাপড়ের খসখসানি, এক পা থেকে অন্য পায়ে ভার বদলেছে কেউ। আড়ি পেতেছে লোকটা! ঠোঁটের কাছে তর্জনী তুলে সোনিয়াকে চুপ থাকার ইঙ্গিত করল ও, নিঃশব্দে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে থাকল, তারপর এক ঝটকায় খুলে ফেলল পাল্লা।

কেউ নেই ওপাশে। খাঁ খাঁ করছে শূন্য হলওয়ে। তাতে স্বস্তি পাবার কিছু নেই। শুনতে যে ভুল হয়নি, সে-ব্যাপারে রানা নিশ্চিত। কেউ একজন আসলেই দাঁড়িয়ে ছিল দরজার বাইরে…. সরে পড়েছে বিপদ টের পেয়ে। গেল কোথায়? বেশিদূর যেতে পারেনি নিশ্চয়ই? কামরা থেকে বেরিয়ে এল ও, লঘু পায়ে হাঁটতে শুরু করল হলওয়ের যে প্রান্তে সিঁড়ি, সেদিকে। একটা হাত ঢুকিয়ে রেখেছে জ্যাকেটের তলায়, মুঠোতে আঁকড়ে ধরে রেখেছে সিগ-সাওয়ারের হাতল, ঝামেলার গন্ধ পেলেই বের করে আনবে।

দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে রানার মাথা। বুঝতে পারছে, ওকে স্পট করে ফেলেছে কেউ। দরজায় আড়ি পেতে কনফার্ম হতে চাইছিল। রাগ হলো ওর- আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল… উচিত ছিল ছদ্মবেশ নেয়া। ভিয়া কণ্ডোট্টির মত জায়গায় যেভাবে আসল চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, তাতে কারও চোখে পড়ে যাওয়াই তো স্বাভাবিক!

গেল কোথায় লোকটা? পালায়নি… পালালে ওকে চোখে চোখে রাখতে পারবে না। তারমানে আশপাশেই কোথাও লুকিয়ে পড়েছে। কোথায়? হলওয়ের ছায়ার মাঝে, নাকি সিঁড়িতে? জানা যাবে শীঘ্রি।

হঠাৎ পিছনে একটা দরজা খোলার আওয়াজ পেল রানা। ঘুরতে ঘুরতে টের পেল, বড্ড দেরি করে ফেলেছে। কামরাটার ভিতর থেকে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এল একটা বিশালদেহী মূর্তি, উঁচু করে রাখা হাত সজোরে নামিয়ে আনল রানার ঘাড়ের উপর। পিস্তলের বাটের সঙ্গে হাড়ের সংঘর্ষের বিচ্ছিরি আওয়াজ হলো। খুলির গোড়া থেকে শুরু করে পুরো মেরুদণ্ডে ছড়িয়ে পড়ল তীব্র ব্যথা। পায়ে কোনও শক্তি পেল না রানা, ভারসাম্য হারিয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেল ও।

.

দপদপে একটা ব্যথা নিয়ে জ্ঞান ফিরল রানার। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। নড়তে গিয়ে টের পেল, ছোট্ট একটা জায়গার ভিতরে আটকা পড়ে আছে ও। হাত তুলতেই স্পর্শ পেল হ্যাঙারে ঝোলানো কাপড়ের—তারমানে ক্লজিটের ভিতরে ঢোকানো হয়েছে ওকে। ব্যথাটা সয়ে নেয়ার জন্য কিছুটা সময় নিথর হয়ে পড়ে রইল, একই সঙ্গে মাথায় বইছে চিন্তার ঝড়। কতক্ষণ অচেতন হয়ে ছিল ও? কবজিতে বাঁধা ঘড়ির লিউমিনাস ডায়ালের দিকে তাকাল—বেশি না, মাত্র বিশ মিনিট। কথা হলো, এভাবে ওকে ক্লজিটের ভিতর ফেলে রেখেছে কেন প্রতিপক্ষ? কোথায় লোকটা? হাত-পা বেঁধে ইন্টারোগেশনের জন্য তৈরি করেনি কেন? রাখেনি কেন দৃষ্টিসীমার ভিতর?

মৃদু একটা চিৎকারের শব্দে সচকিত হয়ে উঠল রানা। ক্লজিটের বাইরে থেকে এসেছে ওটা। নারীকণ্ঠ! সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার হয়ে গেল রহস্যটা। ও নয়, লোকটার টার্গেট সোনিয়া! ওকেই স্পট করেছে ব্যাটা, রানাকে নয়।

শিক্ষামরার ভিতর থেকে রাগী গলা শোনা গেল, ‘মাগী! বেশ্যা! মার্সেই-এ থাকার কথা ছিল তোর… ন’লাখ লিরা নিয়ে। আমাদের লোক পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু তোকেও পাইনি, তোর কন্ট্যাক্টকেও না। কোনও কুরিয়ারই তোর টিকিটি দেখেনি। ‘হারামজাদী কোথায় ছিলি তুই এতদিন? কী করেছিস আমাদের টাকা-পয়সা নিয়ে?

জবাবে গুঙিয়ে উঠল সোনিয়া। পরমুহূর্তে ঠাস করে একটা আওয়াজ হলো, সম্ভবত থাপ্পড় দেয়া হয়েছে। দাঁতে দাঁত পিষল রানা, অবলা একটা মেয়ের গায়ে হাত তোলা হচ্ছে!

পিস্তলটা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে, কিন্তু রানার জ্ঞান যে এত দ্রুত ফিরে আসবে, তা বোধহয় লোকটা আন্দাজ করতে পারেনি। নিচু স্তরের গুণ্ডা বলে মনে হচ্ছে, কাজেকর্মে কাঁচা। প্রতিপক্ষ ওকে অচেতন বলে ভাবছে, কাজেই অবাক করে দেয়ার সুযোগটা নিতে হবে ওকে। উঠে দাঁড়িয়ে শক্তি সঞ্চয় করল রানা, ক্লজিটের দুই পাল্লার মাঝখানে কাঁধ ঠেকিয়ে সজোরে ধাক্কা দিল ও। বাইরে লাগানো ঠুনকো ছিটকিনি সে-প্রেশার সহ্য করতে পারল না, মৃদু শব্দ তুলে উপড়ে এল চৌকাঠ থেকে। বাঘের মত লাফিয়ে ক্লজিট থেকে বেরিয়ে এল রানা। এক পলকে দেখে নিল পরিস্থিতি।

গা গুলিয়ে ওঠার মত দৃশ্য। রানার দিকে পিঠ দিয়ে দু’পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে বিশালদেহী এক ইটালিয়ান। তার সামনে একটা চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে সোনিয়াকে— হাতলের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে দু’হাত, সামনের দু’পায়ার সঙ্গে পা। মুখ জুড়ে কালসিটে পড়ে গেছে, উপর্যুপরি আঘাতের ফলে। বাঁ চোখটা বুজে এসেছে প্রায়, গাল বেয়ে নেমে এসেছে রক্তের ধারা। ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে পরনের পোশাক, স্তনজোড়া উন্মুক্ত। বোঁটার আশপাশে পোড়া দাগ… সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয়া হয়েছে! মাথায় আগুন জ্বলে উঠল রানার। যে-অত্যাচার চালানো হয়েছে মেয়েটির উপর, তার সঙ্গে ইন্টারোগেশনের কোনও সম্পর্ক নেই… স্রেফ স্যাডিজম ছাড়া আর কিছু নয় এটা। –

পিছনে আওয়াজ শুনেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বিশালদেহী সেকেণ্ডের ভগ্নাংশের জন্য তার চোখে চোখ রাখল রানা, তারপরেই বুনো মোষের মত মাথা নিচু করে ডাইভ দিল ও, গুঁতো মারল লোকটার পেটে। ব্যথা পেয়ে গুঙিয়ে উঠল ইটালিয়ান, কয়েক পা পিছিয়ে গেল, কিন্তু তারপরেও দাঁড়িয়ে থাকল পায়ের উপর। রানা ভারসাম্য ফিরে পাবার আগেই ওর বগলের তলায় হাত দুটো ঢুকিয়ে দিল সে, শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আধ পাক ঘোরাল, তারপর অনায়াসে ছুঁড়ে দিল একপাশে।

ধপাস করে মেঝেতে পিঠ দিয়ে পড়ল রানা, পরমুহূর্তে স্প্রিঙের মত লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বুঝতে পারছে, শরীরে প্রচণ্ড শক্তি ধরে লোকটা। গায়ের জোরে নয়, তাকে হারাতে হবে গতি এবং ক্ষিপ্রতা দিয়ে। সমস্ত ব্যথা ভুলে থাকার চেষ্টা করল ও, ছুটে গেল ইটালিয়ানকে লক্ষ্য করে। নীচ থেকে উপরদিকে ঘুসি চালিয়ে ব্যাটার চিবুকে লাগাতে পারল, দেখতে পেল থেঁতলানো মাংস থেকে রক্ত বেরিয়ে আসছে। ঘুসিটা প্রচণ্ড ছিল, অন্য কোনও লোক হলে সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারাত। কিন্তু ইটালিয়ান দৈত্য অন্য ধাতে গড়া। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে রক্ত মুছল নির্বিকারভাবে, তারপর দু’হাত মুঠো পাকিয়ে রানার দিকে এগোল… বক্সারের মত মাথা নিচু করে। নিজের উপর প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস খালি হাতেই পুঁচকে লোকটাকে খতম করতে পারবে বলে ভাবছে, তাই পিস্তল বের করছে না।

পা বাড়িয়ে মাথাটা নিচু করে নিল রানা, ইটালিয়ানের চালানো ঘুসি এড়িয়ে আবার তাকে আঘাত করল পেটের নীচের দিকে। অনুভব করল ওর মুঠো মাংসের ভিতর ঢুকে হাড়ে ধাক্কা খেলো। পরমুহূর্তে ছিটকে পিছন দিকে পড়ল রানা, লোকটার দ্বিতীয় ঘুসিটা বুকে লেগেছে। ওর মনে হলো, বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা ছাতু হয়ে গেছে। এত জোরাল ঘুসি আগে বোধহয় কখনও খায়নি।

কয়েক মুহূর্ত পড়ে থাকল রানা, ব্যথায় চোখে অন্ধকার দেখছে। যেন কুয়াশার ভেতর রয়েছে ও, অনেক কষ্টে হাঁটুর উপর সিধে হলো। টলতে টলতে দাঁড়াতেও পারল, শেষ একবার চেষ্টা করে দেখতে চায়।

পা বাড়িয়ে সামনে চলে এল ইটালিয়ান। প্রথম দুটো ঘুসি ঝট করে মাথা সরিয়ে নিয়ে এড়িয়ে যেতে পারল রানা। তৃতীয় ঘুসিটা এক পা পিছিয়ে দিল ওকে। তবে পড়ে যায়নি, থামেওনি, আঘাত সামলে সামনে বাড়ল। ইটালিয়ান লক্ষ করল, রানা শুধু আক্রমণ ঠেকাচ্ছে, পাল্টা আঘাত করতে চাইছে না। রানার উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে পিছাতে শুরু করল সে।

ভঙ্গিটা রানার আত্মরক্ষার, তবে সামনে বাড়ছে; আর আক্রমণের ভঙ্গি নিয়ে পিছু হটছে ইটালিয়ান। কামরার ভিতরে চক্কর দিচ্ছে ওরা। রানার চেহারায় অতি সতর্ক বা ভয় ভয় ভাব রয়েছে, সেটা দেখে দৈত্য ভাবতেও পারেনি হঠাৎ এমন লাফ দেবে ও। কাজেই তাকে খানিকটা অসতর্ক অবস্থায় পেয়ে গেল রানা, প্রথম লাফেই নাগালের মধ্যে চলে এল তার লম্বা গলাটা। প্ৰথমেই ডান কনুই ভাঁজ করে কারাতে চপ মারল রানা লোকটার কণ্ঠনালীর উপর, পরমুহূর্তে টিপে ধরল গলটা দুই হাতে! এতক্ষণ পাঁয়তারা কষছিল’ রানা বক্সারের দুর্বল জায়গাটার নাগাল পেতে।

ধরার পর আর ছাড়ায় কার সাধ্য। গায়ে যতই জোর থাকুক, কনুই চালিয়ে বা ঘুসি মেরে কোনও লাভ হলো না ইটালিয়ানের। রানা যেন প্রতিজ্ঞা করেছে, যত আঘাতই আসুক, গলাটা কোনও অবস্থাতেই ছাড়বে না। দু’হাত দিয়ে শ্বাসনালীটা শক্ত করেই ধরেছে ও, সেই সঙ্গে বাম হাঁটু চালাল দৈত্যের ঊরুসন্ধি আন্দাজ করে। গুঙিয়ে উঠল লোকটা, ছটফট করছে ব্যথায়। ধীরে ধীরে একটা আতঙ্ক ভর করল ওর চোখে, দুর্বল হাতে এখন গলাটা মুক্ত করতে চাইছে ইটালিয়ান। রানার দুই কবজি ধরে নীচের দিকে টান দিচ্ছে সে।

সুযোগ পেল রানা লোকটার গলায় চাপ বাড়াবার। এতক্ষণ গলা ধরে ঝুলে ছিল, এবার পায়ের উপর শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঘৃণা আর আক্রোশ থেকে উৎসারিত প্রবল আসুরিক শক্তি অনুভব করছে দুই হাতে। ইটালিয়ানের গলা বুজে গেছে, বাতাসের অভাবে হাঁসফাঁস করছে সে। এমন সহজ একটা কৌশলে দুর্বল প্রতিপক্ষ তাকে কাবু করে ফেলছে, এ যেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না। শুধু যে আতঙ্কে, তা নয়, বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে তার চোখ জোড়া। দুর্বল হয়ে পিছন দিকে হেলে পড়ছে সে, আর সেটা অনুভব করে রানার হাতে যেন আরও জোর এসে যাচ্ছে। মনে হলো এক সময় কোটর ছেড়ে লোকটার চোখদুটো বেরিয়ে আসবে। শিরদাঁড়া বাঁকা হয়ে যাচ্ছে তার, তারপর শুয়ে পড়ল মেঝেতে। রানা চেপে বসল ওর বুকের উপর।

অক্সিজেনের অভাবে ঝাঁকি খেতে শুরু করল বিশাল শরীরটা। তারপর আস্তে আস্তে স্থির হয়ে গেল। গলাটা ছেড়ে দিল রানা। টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়াল রানা।

মাতালের মত লাগছে রানাকে, ঘন ঘন হাঁপাচ্ছে, টলতে টলতে এগিয়ে গেল প্রায়-অচেতন সোনিয়ার দিকে। কাঁপা কাঁপা হাতে খুলতে শুরু করল ওর হাত-পায়ের বাঁধন। কী ঘটছে সে সম্পর্কে সচেতন নয় সোনিয়া, দুর্বল ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, ফিসফিসিয়ে অনুনয় করল ওকে আর ব্যথা না দেবার জন্য। পাঁজাকোলা করে ওকে বিছানায় নিয়ে গেল রানা। চাদর দিয়ে ঢেকে দিল অনাবৃত দেহ। পাশে বসে হাত বুলিয়ে দিল মাথায়।

‘কোনও ভয় নেই,’ নরম গলায় বলল ও। ‘লোকটা আর ক্ষতি করতে পারবে না তোমার।’

আচমকা উঠে বসল সোনিয়া। শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরল রানাকে, মুখ গুঁজল বুকে। হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মত কাঁপছে পুরো শরীর। কাঁদছে একই সঙ্গে। বিড়বিড় করে বলল, ‘আমাকে বাঁচাও, রানা। এই দুঃস্বপ্নের হাত থেকে মুক্তি দাও আমাকে!’

অনেককিছুই জানার আছে ওর কাছ থেকে, বুঝতে পারছে রানা। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের সময় নেই এখন। আগে মেয়েটার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যবস্থা করতে হবে মেঝেতে পড়ে থাকা লাশটারও। এখুনি বেরিয়ে পড়তে হবে রুমিং হাউস থেকে… নতুন কোনও শত্রু উদয় হবার আগে। একটু ভেবে দেখল রানা—উপায় নেই, রানা এজেন্সির রোম শাখার সাহায্য এ-মুহূর্তে নিতেই হবে ওকে। শাখাপ্রধান ভূষণের মাধ্যমে ডেডবডি সরাতে হবে, এজেন্সির নিজস্ব ডাক্তারের কাছেও নেয়া যাবে সোনিয়াকে রানা।

মেয়েটার বাহুবন্ধন থেকে সাবধানে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *