সেই কুয়াশা ১.১৮

আঠারো

মুরাতো-য় রানার পরিচিত লোকটা ইটালিয়ান, নাম সালভাতর মাযিনি—বাস্তিয়ার বেশ কিছু ফিশিং বোটের মালিক। তবে তলে তলে সে আসলে আমেরিকার বেতনভুক ইনফর্মার। ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় আশপাশের দেশগুলোর নৌ-কার্যক্রমের উপর নজর রাখে, সেসবের রিপোর্ট পাঠায় ওয়াশিংটনে। বেশ ক’বছর আগেই ওর এই গোমর জানতে পেরেছে রানা, কিন্তু সেটা ফাঁস করেনি I বরং ওকে নিজস্ব কাজে ব্যবহার করছে প্রয়োজনমাফিক। মাযিনিও নিজের কাভার অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে সাহায্য করে আসছে ওকে… : বলা বাহুল্য, খুশিমনে নয়। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটল না।

সরাসরি দেখা করল না রানা, মুরাতো-র একটা দোকান থেকে প্রথমে ফোন করল লোকটাকে। জানাল কী চায়। ওর কণ্ঠ চিনতে পেরেই চেহারায় চরম বিতৃষ্ণা ফুটল মাযিনির। আজকের পরিস্থিতি অতীতের যে-কোনও সময়ের চেয়ে গুরুতর। ইতোমধ্যে আমেরিকায় রানার নামে জারি হওয়া হুলিয়ার খবর পেয়ে গেছে সে, পুরস্কারের অঙ্কটাও জানতে পেরেছে। এ-সময় ওর সঙ্গে নিজেকে জড়ানো মানেই বিপদ।

কিছুটা সময়ের জন্য লোভ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল মাযিনির ভিতর। ইচ্ছে হলো ওর সিআইএ কন্ট্যাক্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে রানাকে ধরিয়ে দিতে। কিন্তু বাস্তববাদী লোক সে, ক্ষণিকের  প্রলোভনকে এড়াতে জানে। তা ছাড়া এক অর্থে ওর পেটে ছুরি ঠেকাল রানা… মধু মাখানো ছুরি! হুমকি দিল, যদি রানার অনুরোধ না রাখে, তা হলে ওর সত্যিকার পরিচয় ফাঁস করে দেয়া হবে। তার অর্থ একটাই—নিশ্চিত মৃত্যু। ওর মত দু’মুখো সাপকে বাঁচতে দেবে না কেউ। এর সঙ্গে মধুটা হলো—কথা শুনলে দশ হাজার ডলার পাবে সে। সাত-পাঁচ ভেবে দেখল মাযিনি-রানাকে ধরিয়ে দেয়ার পুরস্কারের তুলনায় কম হলেও, হাজারদশেক ডলার একেবারে ফেলনা নয়। অন্তত ওটা খরচ করার জন্য জ্যান্ত থাকবে সে। রাজি হয়ে গেল প্রস্তাবে।

সূর্যাস্তের খানিক আগে নিজের ওয়্যারহাউসের সামনে পৌঁছুল মাযিনি, দরজা খুলে ঢুকে পড়ল ভিতরে। প্রথমে ছোপ ছোপ অন্ধকার ছাড়া কিছুই দৃষ্টিগোচর হলো না, হাঁটতে হাঁটতে পিছনের দেয়ালের কাছে গিয়ে থামল সে, হেলান দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল রানার জন্য। দেখতে না পেলেও বুঝতে পারছে, বাঙালি এজেণ্ট আশপাশেই কোথাও আছে। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে মুখে ঝোলাল মাযিনি, দেশলাই দিয়ে আগুন জ্বালতে গিয়ে লক্ষ করল, হাত কাঁপছে। রানার মুখোমুখি হলেই নার্ভাসনেস গ্রাস করে তাকে।

‘তুমি ঘামছ, মাযিনি!’ বাঁ-দিকের অন্ধকার থেকে গম গম করে উঠল পরিচিত কণ্ঠ। ‘দেশলাইয়ের আলোয় তোমার মুখ চকচক করছে। আশা করি কোনও দুঃসংবাদ নিয়ে আসোনি?’

চমকে উঠল মাযিনি, মুখ থেকে খসে পড়ে গেল সিগারেট তবে এক মুহূর্ত পরেই সামলে নিল নিজেকেণ কণ্ঠে মধু মিলিয়ে বলল, ‘রানা! মাই ফ্রেণ্ড! তোমার গলা শুনতে পেয়ে কী যে ভাল লাগছে…’

ছায়া থেকে আবছা আলোর মাঝে বেরিয়ে এল রানা। কাঠখোট্টা,গলায় বলল, ‘আমি তোমার বন্ধু নই… ছিলামও না কখনও। কাজের কথা বলো।’

‘সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তোমাকে শুধু বাস্তিয়ার সাত নম্বর প্রিয়ারে গিয়ে আমার নাম বলতে হবে। তা হলেই একটা ট্রলার তোমাকে ভোরের আলো ফোটার আগে লিভোর্নোয় পৌঁছে দেবে।’

ট্রলারের নরমাল রুট ওটা?’

‘উঁহুঁ। সাধারণত পিয়োম্বিনোয় যায় ওটা। তবে তোমার জন্য বাড়তি ফুয়েলের কোনও চার্জ ধরব না আমি। লোকসান যা হবার আমার হোক।’

‘এত দিলদরিয়া হলে কবে থেকে?’ ভুরু কোঁচকাল রানা।

হেঃ হেঃ করে হাসল মাযিনি। ‘তোমার মত বন্ধুর জন্য একটু যদি উদার হতে না পারি…’

‘ধন্যবাদ,’ বাধা দিয়ে বলল রানা। পকেট থেকে ডলারের একটা বাণ্ডিল বের করল। তবে প্ল্যানে একটু রদবদল হবে। একা নই, আমার সঙ্গে আরও লোক যাচ্ছে। একটার জায়গায় দুটো ট্রলার চাই আমার, আর চাই দুটো স্পিডবোট। একটায় আমি উঠব, অন্যটায় আমার বন্ধু। ট্রলারদুটো অপেক্ষা করবে উপকূল থেকে দু’মাইল দূরে, সাগরের মাঝখানে। পিয়ার থেকে স্পিডবোটে চড়ে ওগুলোয় যাব আমরা, এরপর একটা ট্রলার যাবে উত্তরে, অন্যটা দক্ষিণে। ঠিক কোথায় যাবে, তা আমরা ট্রলারে ওঠার পর জানাব।

‘অনেক বেশি ঝামেলা হয়ে যাচ্ছে,’ কাঁচুমাচু শোনাল মাযিনি গলা। ‘এতসব সতর্কতার দরকার নেই। আমি কথা দিচ্ছি…’

তোমার মুখের কথায় আমার চারআনাও বিশ্বাস নেই, মাযিনি!’

মুখ কালো হয়ে গেল মাযিনির। ‘বেশ, তোমার কথাই সই। কিন্তু যা চাইছ, তার জন্য খরচাপাতি অনেক বেড়ে যাবে আমার।’

‘বাড়তি টাকা চাইছ, এই তো?’

‘ব্যাপারটা তুমি বুঝতে পারছ দেখে ভাল লাগছে।’

‘তা তো বুঝিই!’ বাণ্ডিল থেকে কয়েকটা নেটি আলাদা করল রানা। ‘তোমার কীর্তিকলাপের ব্যাপারে মুখে তালা এঁটে রাখছি আমি-প্রতিদান হিসেবে ওটুকুই যথেষ্ট হওয়া উচিত তারপরেও… আপাতত এই পাঁচ হাজার ডলার রাখো।’

‘রানা… বন্ধু আমার… তুমি বলেছিলে দশ হাজার!’ প্রতিবাদ করে উঠল মাযিনি। ‘পাঁচ হাজারে তো আমার দুই ট্রলার আর দুই স্পিডবোটের ফুয়েলের খরচও মিটবে না। ক্রু-দেরকে টাকা দেব কোত্থেকে? আমার ভাগের কথা নাহয় বাদ-ই দিলাম।’

‘পুরোটা অ্যাডভান্স দেব, এমন কথা তো বলিনি। অর্ধেকটা পাওনা থাকুক… মানে, বাড়তি খরচ ছাড়া আর কী। ওটা কত দিতে হবে?

‘খরচের ব্যাপারে তোমার তো আইডিয়া থাকার কথা। সবকিছুর দাম যেভাবে বাড়ছে…’

‘পনেরো পার্সেন্ট হলে চলবে?’

অন্য কেউ হলে রাজি হতাম না, তবে তোমার কথা আলাদা।‘

‘শুনে খুশি হলাম। তা হলে বাড়তি দেড় হাজার, আর অরিজিন্যাল পাঁচ… মোট সাড়ে ছ’হাজার ডলার পাওনা রইল তোমার।’

‘মরে যাব, বন্ধু!’ আকুতি ঝরাল মাযিনি। ‘এখন যদি টাকা না দাও, পরে কোত্থেকে পাব? এখান থেকে বেরিয়ে তুমি তো দুনিয়ার আরেক প্রান্তে চলে যাবে… খোঁজও পাওয়া যাবে না তোমার।’

‘এত অস্থির হবার কিছু নেই,’ আশ্বস্ত করল রানা। ‘তোমার টাকা মেরে দেবার কোনও ইচ্ছে নেই আমার। সাড়ে ছ’হাজার ডলার আমি তোমার ট্রলারে রেখে যাব… কোন্টায়, তা এখুনি বলছি না। দুটোতেই তল্লাশি চালাতে হবে তোমাকে। ফরওয়ার্ড বাল্ক হেডের তলায়, সেন্টার-স্ট্রাটের ডানে, ডেকের তক্তার নীচে থাকবে টাকাটা। সহজেই খুঁজে পাবে।

‘গুড গড! আমি কেন… বোটের ক্রু-রাও তো খুঁজে পাবে!’

‘ওরা খুঁজতে যাবে কেন? আমি তো কাউকে বলে-কয়ে লুকাতে যাচ্ছি না টাকা।’

তাও ব্যাপারটা বড্ড রিস্কি হয়ে যায়। আমার ক্রু-দেরকে তুমি তো চেনো না। টাকার গন্ধ পেলে আপন মায়ের পেটেও ছুরি ঢোকাতে পারে ওরা। প্লিজ রানা… একটু ভাবো আমার দিকটা!’

‘খামোকাই চিন্তা করছ তুমি, মাযিনি। ট্রলারদুটো হারবারে ফিরলেই টাকাটা বের করে নিয়ো। যদি না পাও, খোঁজ নিয়ে দেখো, ক্রু-দের মধ্যে কার একটা হাত উড়ে গেছে।

‘ডলারগুলোর সঙ্গে বুবি-ট্র্যাপ থাকবে?’ হতভম্ব গলায় জানতে চাইল মাযিনি।

‘ছোট একটা প্লাস্টিক চার্জ,’ জানাল রানা। ‘একটা সেট-স্ক্রু লাগানো থাকবে পাশে—তুমি দেখেছ আগে। ওটা খুলে নিয়ো, তা হলেই আর ভয় নেই। ‘

তিক্ততা জমল মাযিনির চেহারায়—রানার কৌশল ধরতে পেরেছে। ট্রলারে থাকবে টাকা, কাজেই জলযানদুটোর উপর কোনও ধরনের ঝুঁকি নিতে পারবে না সে। সাহস করবে না কাউকে খবর দিতে, তাতে লড়াই বাধার… এবং ট্রলারের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা। ওগুলো যখন হারবারে ফিরবে, ততক্ষণে স্পিডবোট নিয়ে রানা পগার পার হয়ে যাবে। বুদ্ধি বটে বাঙালিটার! হতাশ হয়ে মেনে নিল পরাজয়।

‘ঠিক আছে,’ কাঁধ ঝাঁকাল সে। ‘আজকের রাতের সিগনাল কী হবে?’

‘সিম্পল পর পর দু’বার আলো জ্বালতে বোলো তোমার লোকজনকে। সাড়া না পেলে কয়েক মিনিট পর আবার। যতক্ষণ ট্রলার না থামছে, আলো জ্বেলে যেতে হবে ওদেরকে, যেন স্পিডবোট নিয়ে মাঝ-সাগরে বিপদে পড়েছে।’

‘আচ্ছা, বলে দেব,’ রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছল মাযিনি। ‘আর কিছু?’

উঁহুঁ। তুমি যেতে পারো।

হাঁটতে শুরু করল মাযিনি, ওয়্যারহাউসের দরজার কাছে পৌছে ঘাড় ফেরাল ক্ষণিকের জন্য। রানা আবার মিলিয়ে গেছে অন্ধকারে।

.

পুরো দু’দিন হলো রানা-কুয়াশার সঙ্গে আছে সোনিয়া, কিন্তু এখনও মেয়েটাকে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছে না ওরা। একটা সিদ্ধান্তে আসা দরকার ওর ব্যাপারে, অথচ পারছে না। কী যেন একটা লুকাচ্ছে সোনিয়া, সেটা জানার আগে ওকে হাতছাড়াও করা চলে না। কর্সিকা থেকে বেরুবার পর নিঃসন্দেহে মুক্তি চাইবে ও, ঠেকাবে কী করে? ভাবনা-চিন্তা করে প্রস্তাব দিল রানা, একটা কাজ দেয়া হোক ওকে; সেই কাজের ছুতোয় বাধ্য করবে সোনিয়াকে ওদের সঙ্গে থাকতে। কী কাজ—জানতে চাইল কুয়াশা। জবাবে রানা মেয়েটাকে ওদের দু’জনের মধ্যকার কন্ট্যাক্ট হিসেবে ব্যবহার করতে চাইল। আলাদা হয়ে যাবার পর সরাসরি যোগাযোগ রাখা ওদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, মিডল-পারসন ব্যবহার করতে পারলে ভাল হয়। তা ছাড়া ওদের একজনের কাভার হবার জন্যও বলা যায় ওকে—শত্রুরা দু’জন পুরুষকে খুঁজছে, কোনও জুটিকে নয়। এতে ব্যস্ত রাখা যাবে সোনিয়াকে, ওদের সঙ্গে থাকার একটা যুক্তিও দেখানো যাবে। প্রস্তাবটা ভাল, স্বীকার করল কুয়াশা; কথা হলো, ওকে সঙ্গে রাখা কতখানি নিরাপদ। সন্দেহ নেই; বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে ওদেরকে পদে পদে, তার মাঝে যদি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে মেয়েটা, মহা-বিপদ দেখা দেবে ওর সঙ্গীর জন্য।

এখন পর্যন্ত অবশ্য উদ্বিগ্ন হবার মত কোনও আচরণ করেনি সোনিয়া। রানা-কুয়াশার কথা শুনছে বাধ্য মেয়ের মত। বাস্তিয়াতে নিয়ে এসেছে কোনও ধরনের ঝুট-ঝামেলা ছাড়া। মুরাতো ছাড়ার পরে হাঁটতেও হয়নি ওদেরকে, রাস্তার ধারে হাত তুলে একটা লক্কড়-মার্কা বাস থামিয়েছে ও—দুই সঙ্গীকে নিয়ে উঠে বসেছে তাতে। সামনের দিকের একটা সিটে সোনিয়াকে নিয়ে বসেছে কুয়াশা, রানা বসেছে পিছনে—একা।

বাস্তিয়ায় পৌছুনোর পর রাস্তার ভিড়ের মাঝে মিশে গেল ওরা, এগোল ওঅটরফ্রন্টের একটা মদ্যশালার দিকে। জঘন্য এক জায়গা, রানা গেছে আগে, ভদ্রলোকেরা কখনও পা ফেলে না ওখানে। রাত পর্যন্ত গা-ঢাকা দিয়ে থাকার জন্য চমৎকার। ওদের খোঁজে কেউ মদ্যশালায় ঢুকলেই স্পট করা যাবে।

ভিতরে ঢুকে সোনিয়াকে আলাদা একটা টেবিলে বসাল ওরা, রানা-কুয়াশা বসল একসঙ্গে—একান্তে কথা বলার জন্য। আড়চোখে নজর রাখল সঙ্গিনীর উপর। দেখা যাক, মাতাল প্রণয়প্রার্থীদেরকে কীভাবে সামলায় ও। এ এক ধরনের পরীক্ষা ফিল্ডে ওর উপর কতখানি আস্থা রাখা যায়, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।

উইস্কির অর্ডার দিয়ে রানার দিকে ফিরল কুয়াশা। ‘কী বুঝছ?’

‘শিয়োর না,’ রানা বলল। ‘নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে মেয়েটা, খোলস থেকে কিছুতেই বের করতে পারছি না ওকে।

‘খামোকাই হয়তো সন্দেহ করছ,’ কুয়াশা বলল। ‘মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে আছে ও, এ-অবস্থায় স্বাভাবিক আচরণ আশা করা যায় না কারও কাছ থেকে।’

‘মানসিক এই যন্ত্রণা নিয়েই আমার খটকা। দাদী মারা যাবার আগে থেকেই মনে হয় শুরু হয়েছে ওটা। সভ্যজগৎ ছেড়ে পোর্তো ভেচিয়োর পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিল কেন? শুধুই কি দাদীর সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য? আমার বিশ্বাস হয় না।’

‘অনেকভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় সেটার। পুরো ইটালি জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, চাকরি-বাকরি নেই কোথাও। কাজ না থাকলে পেটে খাবার জুটবে কোত্থেকে? তাই হয়তো দাদীর কাছে গিয়েছিল। অথবা কাউকে ভালবেসে ধোঁকাও খেতে পারে। ঘটতে পারে অনেক কিছুই।’

‘অস্বীকার করছি না। কিন্তু এ-রকম আচরণ করলে কারও উপর বিশ্বাস রাখা একটু মুশকিল হয়ে যায় না?’

দাদীর খুনিদেরকে শাস্তি দিতে চায় ও। আমার তো মনে হয়, দলে ভেড়ানোর জন্য এটুকুই যথেষ্ট।’

উঁহুঁ। ওকে কনভিন্স করতে হবে, পাহাড়ি অধিবাসীদের সঙ্গে ফেনিসের কানেকশন আছে।’

‘তা তো করেইছি আমরা!

‘ওই সময় ওর মাথার ঠিক ছিল না। কী বলেছি না বলেছি… এখন যদি পরোয়া না করে? ঠাণ্ডা মাথায় সব বোঝাতে হবে ওকে।’

‘বোঝাও। মানা করছে কে?’

ভুরু কোঁচকাল রানা। ‘আমি?’

‘আর কে?’ হাসল কুয়াশা। ‘যদ্দূর জানি, মেয়ে পটানোর ব্যাপারে তুমি একটা প্ৰতিভা।’

‘ঠাট্টা করছেন?’

জবাব না দিয়ে মাথা ঘোরাল কুয়াশা। টলতে টলতে মাঝবয়েসী এক লোক এগিয়ে এসেছে সোনিয়ার দিকে। ক্ষণিকের জন্য জ্বলে উঠল মেয়েটা, ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিল ব্যাটাকে।

‘ইম্প্রেসিভ!’ মন্তব্য করল কুয়াশা। ‘আগুনের টুকরো বললে ভুল হয় না। ওকে তোমারই সামলাতে হবে, রানা। এমন মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে পারব না আমি।’

বেশ, ও আমার সঙ্গে যাবে… মানে, যদি রাজি করাতে পারি আর কী।’ কাঁধ ঝাঁকাল রানা। তার আগে আমাদের কাজ ভাগ করে নেয়া দরকার।’ পকেট থেকে মারিয়া মাযোলার দেয়া কাগজটা বের করে আনল ও। ভাঁজ করে মেলে ধরল টেবিলের উপর!

‘কাউন্ট পালমিরো বিয়াঞ্চি, রোম,’ পড়ল কুয়াশা। ‘স্যর নাথান উইটিংহ্যাম, লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড; প্রিন্স আলেক্সেই ভারাকিন, সেইণ্ট পিটার্সবার্গ, রাশা; সেনিয়র হুয়ান গার্সিয়া, মাদ্রিদ, স্পেন; ডেভিড ম্যাহোনি, ম্যাসাচুসেটস্, আমেরিকা।

। এর মধ্যে স্প্যানিশ ভদ্রলোককে খুন করেছিল কাউন্ট বারেমি, কাউন্সিলে যোগ দেয়নি সে। বাকি চারজন হয়েছিল ফেনিসের কর্ণধার। এখন ওদের কেউ বেঁচে আছে কি না সন্দেহ। তবে, অন্তত দু’জনের বংশধর অত্যন্ত বিখ্যাত মানুষ।

নাইজেল উইটিংহ্যাম – ব্রিটেনের ফরেন সেক্রেটারি; আর ডেভিড ম্যাহোনি দ্য থার্ড… ম্যাসাচুসেটস্ -এর সিনেটর। ওদেরকে চেপে ধরা দরকার।

‘এখুনি না,’ রানা মাথা নাড়ল। ‘এ-দু’জনের ব্যাপারে জানি আমরা, কিন্তু বাকিরা? তাদের বংশধর কারা? কোথায় আছে এ-মুহূর্তে? যদি কোনও চমক থাকে এর ভিতর, সেটা আগেভাগেই জেনে নেয়া দরকার। তা ছাড়া… মাত্র দু’জনের ভিতর সীমাবদ্ধ নয় ফেনিস। এমনও হতে পারে, নাইজেল উইটিংহ্যাম আর ডেভিড ম্যাহোনি হয়তো কিছুই জানেন না ফেনিস সম্পর্কে।

‘এ-কথা বলছ কেন?’ ভ্রূকুটি করল কুয়াশা।

‘কারণ এঁদের মত মানুষ কোনও গুপ্তসংঘের সদস্য হবেন বলে বিশ্বাস হয় না। উইটিংহ্যামকে নিষ্কলুষ মানুষ বলে জানে সবাই—যৌবনে সেনাবাহিনীর কমাণ্ডো ছিলেন, বহুবার দেশের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন, প্রচুর পদকও পেয়েছেন সে-কারণে। সত্যিকার বীরযোদ্ধা। ফরেন অফিসেও তাঁর রেকর্ড তুলনাহীন। কৌশলী, বুদ্ধিমান… আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। অত্যন্ত শান্তশিষ্ট স্বভাবের। তাঁর প্রোফাইলের সঙ্গে ফেনিসের কানেকশন একেবারেই মেলে না।’

‘আর ম্যাহোনি?’

‘বস্টনের ব্রাহ্মণ পরিবার বলতে পারেন ওদেরকে। কিন্তু কুলীন সমাজের বেড়া ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন ম্যাহোনি; হয়ে উঠেছেন দরিদ্র, খেটে খাওয়া মানুষের ত্রাতা। রাজনীতির ঘোড়ায় চড়া আধুনিক এক নাইট বলা যায় তাঁকে, সবার ধারণা—আগামী বছরের নির্বাচনে জয়ী হয়ে হোয়াইট হাউসে বসতে চলেছেন তিনি।

‘ফেনিসের লক্ষ্য অর্জনের জন্য এরচেয়ে ভাল পজিশন আর কী হতে পারে?’

‘তা হলে বলতেই হয়, এত বছর ধরে দারুণ এক কাভার মেইনটেন করছেন দু’জনে। ঘটনা যা-ই হোক, এরা কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে না।’

‘ঠিক আছে, রোম আর সেইন্ট পিটার্সবার্গ… মানে, লেনিনগ্রাদ থেকে শুরু করা যাক। বিয়াঞ্চি আর ভারাকিনের বংশধরকে খুঁজে বের করব আমরা।’

‘ওরাই সব নয়। মারিয়া মাযোলা বলেছিলেন, ওদেরকে নিয়ন্ত্রণ করছে আরেকজন।’

যার কণ্ঠ ঝোড়ো বাতাসের চেয়ে ভয়ঙ্কর,’ বিড়বিড় করল কুয়াশা। ‘রাখাল বালক?’

‘এখন আর বালক নেই সে,’ বলল রানা। ‘কী পরিচয় নিয়েছে, কে জানে!’

‘শিষ্যদের পরিবার’ দিয়েই শুরু করব আমরা। ঠিকমত এগোতে পারলে নিশ্চয়ই খোঁজ পাওয়া যাবে ওই রাখাল বালক… থুড়ি, রাখাল বুড়োর!’

রাশায় যেতে পারবেন আপনি? লেনিনগ্রাদে?’

‘পারব। ব্যবস্থা করা আছে আমার… হেলসিঙ্কি হয়ে ঢুকতে অসুবিধে হবে না।’

‘ভাল। হেলসিঙ্কিতে কোথায় উঠবেন?’

‘টোভাস্টিয়ান হোটেলে।’

‘আমি যোগাযোগ করব ওখানে। কী নাম বলব?’

‘আমার আসল নাম… মনসুর আলী। ‘সরোদশিল্পী হিসেবে ওখানকার লোকে চেনে আমাকে।’

‘আসুন তা হলে, আমাদের কোড ঠিক করে নিই,’ বলতে বলতে সোনিয়ার দিকে তাকাল রানা। মোটামুটি ভদ্র চেহারার এক বাস্তিয়ান নাবিকের সঙ্গে কথা বলছে মেয়েটা। বুদ্ধিমতী… বার বার খেপে গেলে যে লোকের মনোযোগ আকর্ষণ করা হবে, তা বুঝতে পেরেছে। মুখে হালকা হাসি ফুটিয়ে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে সে, সাবধানে বজায় রাখছে দূরত্ব, নাবিক যাতে বেশি অগ্রসর হতে না পারে। আচরণে এক ধরনের আভিজাত্য প্রকাশ পাচ্ছে ওর।

‘কী ভাবছ?’ জিজ্ঞেস করল কুয়াশা। ‘ওকে বশে রাখতে পারবে?’

‘খুব শীঘ্রি সেটা জানতে পারব আমরা,’ মৃদুগলায় বলল রানা।  

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *