সেই কুয়াশা ১.৫

পাঁচ

হলওয়েতে পায়ের শব্দ শুনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মাসুদ রানা। দরজার পাশে গিয়ে পিপহোলে চোখ রাখল। সাদামাঠা চেহারার একজন পুরুষ হেঁটে গেল সামনে দিয়ে, থামল না পলকের জন্যও। হোটেলের সাধারণ গেস্ট, আর কিছু না। চেয়ারে ফিরে গিয়ে শরীর এলিয়ে দিল ও। দৃষ্টি নিবদ্ধ করল সিলিঙে। ডুবে গেল চিন্তার সাগরে।

মাসখানেক হলো আমেরিকায় এসেছে ও। অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটনের অনুরোধে নুমার একটা ছোট অভিযানে অংশ নিয়েছে; সেটা শেষ হবার পর বেরিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে রানা এজেন্সির শাখাগুলো পরিদর্শন করবার কাজে। মোটামুটি নিরুপদ্রবে কেটে যাচ্ছিল সময়, হঠাৎ মেজর জেনারেল রাহাত খানের ফোন ওলটপালট করে দিয়েছে সবকিছু। ওর সাহায্য চাইছে প্রতিভাবান বিজ্ঞানী কুয়াশা, দেখা করতে চাইছে!

মনসুর আলী ওরফে কুয়াশা সম্পর্কে সবই জানা আছে রানার। তার প্রতিভা এবং মহত্ত্বের কদর করে ও। লোকটা অপরাধী হতে পারে, কিন্তু তার কর্মকাণ্ডে কখনও নিরীহ-নিরপরাধ মানুষের ক্ষতি হয় না। বরং অজানা-অচেনা মানুষের বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে মুহূর্তের জন্য কুণ্ঠা করে না কুয়াশা। সেজন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতেও দ্বিধা নেই তার। অপরাধ করে শুধুমাত্র বিজ্ঞানের স্বর্থে, পৃথিবীর উপকারের জন্য… মহান লক্ষ্য নিয়ে। অদ্ভুত একজন মানুষ, এক ধরনের শ্রদ্ধা রয়েছে রানার তার প্রতি। সম্মান করে বললেও সম্ভবত বাড়িয়ে বলা হবে না। তাই মেজর জেনারেল রাহাত খানের অর্ডারটা শুরুতে একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল ওকে।

বিসিআই চিফের পরিষ্কার নির্দেশ—যে করে হোক, কুয়াশাকে আটকাতে হবে; নিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশে। লোকটার যদি কিছু বলার থাকে, সেটা দেশে পৌঁছনোর পর শোনা যাবে। বুড়োর অবাধ্য কোনোদিন হয়নি রানা, তাই দ্বিধা ঝেড়ে ফেলেছে। আপাতত কুয়াশাকে করজায় নেয়া রানার একমাত্র লক্ষ্য। সেটা নিশ্চিত করবার জন্য নির্ধারিত সময়ের দু’দিন আগে নেব্রাস্কা অ্যাভিনিউয়ের হোটেল এক্সেলসিয়রে এসে উঠেছে ও। কুয়াশার ফাইল ভালমত স্টাডি করে নিয়েছে রানা, কোন পদ্ধতিতে সে কাজ করে, তা বুঝে নিয়েছে। স্ট্র্যাটেজিস্ট হিসেবে তার কোনও তুলনা হয় না, এক অর্থে ম্যাজিশিয়ানও বলা চলে প্রতিভাবান বিজ্ঞানীটিকে। চমক দেখানোয় ওস্তাদ। ওকে পরাস্ত করতে হলে কয়েক পা এগিয়ে থাকতে হবে। আগেভাগে হোটেলে এসে ওঠা সে-পরিকল্পনারই অংশ।

কুয়াশা যে সরাসরি দেখা করবে না ওর সঙ্গে, এ-ব্যাপারে রানা মোটামুটি নিশ্চিত। হ্যাঁ, একটা পর্যায়ে নিশ্চয়ই মুখোমুখি হবার প্ল্যান আছে লোকটার; কিন্তু তার আগে প্রতিপক্ষকে একেবারে নিরস্ত্র এবং অসহায় করে নেবে, যাতে ওকে আটকাবার ক্ষমতা না থাকে রানার। শুধুমাত্র তখনই নিজের চেহারা দেখাবে এ-কাজ করা সম্ভব রানাকে ফাঁদে ফেলে। শেষ মুহূর্তে নয়, পুরো পাঁচ-পাঁচটা দিন আগে এক্সেলসিয়র হোটেলের নাম দিয়েছে সে এ-কারণেই এখানেই রানাকে কবজা করবার প্ল্যান করেছে কুয়াশা। সন্দেহটা গাঢ় হবার পিছনে প্রচুর যুক্তি আছে।

নেব্রাস্কা অ্যাভিনিউয়ের এই হোটেলটা একেবারে ছোট, এখানে কুয়াশার ট্রেস পেতে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি রানাকে। সামান্য কিছু টাকা খরচ করেছে হোটেল-কর্মচারীদের পিছনে; তাতেই জেনে গেছে, ছড়িঅলা এক ভারতীয় ভদ্রলোক অতীতে একাধিকবার এসেছে এ-হোটেলে। তিনতলায়, দুইশ’ এগারো নম্বর রুমে সবসময় ওঠে সে। কক্ষটার বিশেষত্ব বুঝতে কষ্ট হয়নি রানার। জানালা দিয়ে পুরো নেব্রাস্কা অ্যাভিনিউ আর আশপাশের আরও দুটো রাস্তা দেখা যায় ওখান থেকে। পিছনের জানালা আর কার্নিশ ধরে খুব সহজে পৌঁছনো যায় ফায়ার-এস্কেপেও। আগেভাগে পুলিশের গাড়ি দেখতে পাওয়া, এবং দ্রুত সটকে পড়া—দুটোর জন্যই দুইশ’ এগারো আদর্শ।  

কুয়াশা যে থাকার জন্য এ-কামরাকে বেছে নেবে, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, আগামী উনিশ তারিখের জন্য রুমটা ইতোমধ্যে বুক করে রেখেছে জনৈক ব্যক্তি। কুয়াশা ছাড়া আর কে? এত সহজে তার খোঁজ পাওয়া যাবার অর্থ একটাই—সে চাইছে, নির্ধারিত তারিখে রানা হানা দেবে ওখানে… ওর পাতা ফাঁদে। কামরায় ঢুকে দেখা যাবে, কুয়াশা নয়, অন্য কেউ অপেক্ষা করছে ওখানে। একজন ডিকয়। যাকে দেখে চমকে যেতে হবে ওকে। আশপাশে লোক রাখবে কুয়াশা, হতচকিত রানার উপর হামলা করবে তারা, আটকে ফেলবে। সুন্দর কৌশল। নিজে ঝুঁকি নেবে না, কিন্তু ঠিকই কার্যোদ্ধার হয়ে যাবে এতে।

রানা জানে, কুয়াশাকে পরাস্ত করতে হলে তছনছ করতে হবে এই পরিকল্পনা। নিজেকে প্রতিপক্ষের হাতের পুতুল নয়, বরং প্রতিপক্ষকে নিজের হাতের পুতুলে পরিণত করতে হবে। যাদেরকে মিডল-ম্যান হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে কুয়াশা, তাদেরকে ছেঁটে ফেলতে হবে ক্যানভাস থেকে। কাজটা খুব একটা কঠিন হবার কথা নয়। নিজস্ব লোক বলতে কেউ নেই কুয়াশার, যাদেরকেই ব্যবহার করার প্ল্যান করুক, ভাড়া করা লোক হবে। আনুগত্য নামক জিনিসটা থাকে না ভাড়াটে লোকের ভিতর, সামান্য চেষ্টাতেই তাদেরকে ত্যক্ত করে সরিয়ে দেয়া সম্ভব। যখন অন্যের মাধ্যমে কার্যোদ্ধার করার উপায় থাকবে না, বাধ্য হয়ে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে কুয়াশাকে। নিজেকেই হাজির হতে হবে খেলার মাঠে। আর তখনই তাকে ঘায়েল করবে রানা।

তাই ছদ্ম-পরিচয়ে উল্টোদিকের দুইশ’ তেরো নম্বর কামরাটা ভাড়া নিয়েছে রানা। দু’দিন আগেই এসে উঠেছে ওখানে, কুয়াশার ঠিক করে দেয়া সময়ের অনেক আগে। নিশ্চয়ই এমনটা আশা করবে না সে। নিয়মমাফিক নজর রাখছে রানা করিডোরে দেখা যাক, কে এসে ওঠে দুইশ’ এগারো নম্বর রুমে। তারপর ব্যবস্থা নেবে ডিকয়কে সরিয়ে দেবার।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। ক্লান্তি বোধ করছে। গত দু’দিন থেকে ঠিকমত ঘুমাতে পারেনি। নজর রাখতে হচ্ছে চারপাশে, সেই সঙ্গে থাকতে হচ্ছে অতিমাত্রায় সতর্ক। এই বিশেষ মিশনে সম্পূর্ণ একাকী কাজ করতে হচ্ছে ওকে। কারও সাহায্য নিতে পারছে না, সে-রকমই নির্দেশ পেয়েছে বিসিআই চিফের কাছে। আমেরিকানদেরকে কিছুতেই জানতে দেয়া যাবে না কুয়াশার উপস্থিতির কথা। নইলে ওরাই প্রতিভাবান বিজ্ঞানীটিকে নিজেদের কবজায় চেবার চেষ্টা করবে।

ওয়াশিংটনে আসবার আগে নিজের ট্রেইল লুকানোর জন্য কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে রানা। রাহাত খান যখন ফোন করেন, তখন ও ছিল ফ্লোরিডায়… কী ওয়েস্টে। ওখান থেকে ভার্জিন আইল্যাণ্ডে যাবার জন্য ছোট একটা বিমান চার্টার করেছে, সেখানে হোটেল বুকিং দিয়েছে। এয়ারপোর্টেও গিয়েছিল, কিন্তু বাথরুমে গিয়ে পরিচয় অদল-বদল করে নিয়েছে রানা এজেন্সির একজন অপারেটরের সঙ্গে : রানা সেজে সে উঠেছে চার্টার করা বিমানে; আর আসল রানা ছদ্ম-পরিচয়ে উঠে পড়েছে ওয়াশিংটন-গামী ডমেস্টিক ফ্লাইটে। সহজে এ-চাতুরি ধরা পড়বার কথা নয়। তারপরেও কখন কী ঘটে যায়, তার ঠিক নেই। শুধু কুয়াশাকে নিয়ে নয়, আমেরিকান ইন্টেলিজেন্সকে নিয়েও কিছুটা দুশ্চিন্তায় ভুগছে ও।

উঠে দাঁড়াল রানা। না, এখন আর দুশ্চিন্তার সময় নেই। আজ উনিশ তারিখ। মাহেন্দ্রক্ষণ ঘনিয়ে আসছে। খুব শীঘ্রি কাজে  নামতে হবে ওকে। চিন্তাটার সঙ্গে তাল মিলিয়েই যেন বাইরে শোনা গেল কলরব। এগিয়ে গিয়ে আবার পিপহোলে চোখ রাখল রানা। সুবেশী, সুন্দরী এক যুবতী দাঁড়িয়ে আছে দুইশ’ এগারো নম্বরের দরজায়। হোটেলের বেলবয় রয়েছে সঙ্গে, মেয়েটির লাগেজ তার কাঁধে। সুটকেস নয়, ট্রান্স-আটলাণ্টিক ফ্লাইটে আসা ব্যাগেজও নয়; স্রেফ একটা ওভারনাইট ব্যাগ।

মুচকি হাসল রানা। এসে গেছে ডিকয়। কুয়াশার ভাড়া করা শকুনরাও নিশ্চয়ই চক্কর দিতে শুরু করেছে আশপাশে। মাঠে নেমেছে ধূর্ত মানুষটা। শুরু হয়েছে খেলা।

রুমের ভিতরে ঢুকে গেল সুন্দরী আর বেলবয়। রানা ফিরে এল বিছানার কাছে। বেডসাইড টেবিল থেকে তুলে নিল টেলিফোনের রিসিভার। ডায়াল করল রানা এজেন্সির আর্লিংটন শাখায়… শাখা-প্রধান তিশা ইসলামের কাছে। কল রিসিভ হবার সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘কিচ্ছু বোলো না, চুপচাপ শুনে যাও কী করতে হবে।

রানার গলা চিনতে পেরেছে তিশা। মৃদুস্বরে বলল, ‘জী, বলুন।’

‘নেব্রাস্কা অ্যাভিনিউয়ের এক্সেলসিয়র হোটেলে ফোন করবে তুমি… পনেরো-বিশ মিনিট, কিংবা আধঘণ্টা অন্তর অন্তর। দুইশ’ এগারো নম্বর রুমে কানেকশন চাইবে। একটা মেয়ে ধরবে ফোন। তাকে বলবে আমাকে ফোন দিতে, ঠিক আছে?’

‘আপনি থাকছেন ওখানে?’

‘না।’

‘তা হলে বার বার ফোন করব কেন?’

‘প্রশ্ন করতে মানা করেছি না তোমাকে?’ মৃদু ভর্ৎসনা করল রানা। ‘তারপরেও করেই যখন ফেলেছ, তা হলে শোনো। ওই মেয়েকে বিরক্ত করবে তুমি। অতিষ্ঠ করে ফেলবে। ক্লিয়ার?’

‘জী। ওই মেয়ে কী ক্ষতি করেছে আপনার, জানতে পারি?’

‘কিছুই না। ইন ফ্যাক্ট, ও আমাকে চেনেই না। কিন্তু যে আমাকে চেনে, সে ঠিকই বুঝে নেবে এই ফোনের অর্থ। আর কোনও কথা নয়। আমি রাখছি।’

রিসিভার নামিয়ে রাখল রানা।

.

এক্সেলসিয়র হোটেলের উল্টোপাশে, অন্ধকার গলির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে কুয়াশা। দেয়ালে হেলান দিয়ে হাত-পা ঝাড়া দিল, মাথা এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে হালকা এক্সারসাইজ করে নিল ঘাড়ের। টেনশন দূর করতে চাইছে, সেইসঙ্গে চাইছে শরীরে চেপে বসা ক্লান্তিতে তাড়াতে টানা তিনদিন জার্নি করতে হয়েছে ওকে। বিমানে উড়েছে আঠারো ঘণ্টা, ড্রাইভ করে যেতে হয়েছে বিভিন্ন শহর আর গ্রামে, দেখা করতে হয়েছে বিশ্বস্ত লোকজনের সঙ্গে, তাদের কাছ থেকে জোগাড় করতে হয়েছে ভুয়া কাগজপত্র, যা দিয়ে তিন-তিনটে ইমিগ্রেশন পয়েন্ট নির্বিঘ্নে পার হওয়া যায়। মস্কো থেকে এথেন্স, এথেন্স থেকে লণ্ডন, লণ্ডন থেকে নিউ ইয়র্ক ওখান থেকে শেষ বিকেলের একটা ফ্লাইট ধরে ওয়াশিংটনে পৌঁছেছে ও।

খাটাখাটনি গেলেও একটা সন্তুষ্টি কাজ করছে মনের ভিতর। ঠিকমত ছক সাজাতে পেরেছে, জায়গামত বলতে পেরেছে লোক। উঁচু শ্রেণীর এক পতিতাকে ভাড়া করেছে ডিকয় হিসেবে, তার উপর নজর রাখছে দু’জন লোক আর একজন বয়স্কা মহিলা 1 হোটেলের ভিতরে অবস্থান নিয়েছে সবাই। চমৎকার আয়োজন, রানাকে এর ভিতর পা দিতেই হবে। হোটেলের সবক’টা প্রবেশপথ কুয়াশার সার্ভেইলান্সে রয়েছে। রানা যেদিক দিয়েই  আসুক, দেখতে পাবে। একটা করে খুদে ওয়াকি-টকি রয়েছে সবার কাছে, রানাকে দেখামাত্র অ্যালার্ট করে দেবার জন্য। ওয়াকি-টকিগুলো কুয়াশা কিনেছে ফিফথ্ অ্যাভিনিউয়ের মিতসুবি কমপ্লেক্স থেকে।

মাসুদ রানাকে কোনও ভাবেই খাটো করে দেখছে না কুয়াশা। কোনও ফাঁদই যে ওর জন্য নিখুঁত নয়, সেটা ভাল করে জানে। কিন্তু কৌতূহলের সামনে সবাই অসহায়। তা ছাড়া বহুদিন থেকেই বিসিআই কুয়াশাকে নাগালের মধ্যে পাবার চেষ্টা করছে। এমন পরিস্থিতিতে হোটেলে হাজির না হয়ে উপায় নেই রানার কুয়াশার কামরা সহজে চিনে নিতে পারবে সে, ওখানে যে একজন মেয়ে থাকছে, তা-ও জানতে পারবে। সন্দেহ নেই, মেয়েটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য যাবে ও। ভাড়া করা লোকদুটো হামলা চালাবে ওখানে, রানাকে বন্দি করবে।

প্ল্যানের এই অংশটা নিয়ে একটু দ্বিধা আছে কুয়াশার। রানাকে কবজা করার জন্য মাত্র দু’জন লোক কখনোই যথেষ্ট নয়। তা ছাড়া এরা সেই অর্থে প্রফেশনাল নয়, রাস্তার গুণ্ডাই বলা চলে। এ-দুর্বলতা ঢাকার জন্যও রেখেছে বয়স্কা মহিলাটিকে। সে-ই কুয়াশার গোপন অস্ত্র, সত্যিকার একজন প্রফেশনাল। অথচ দেখে বোঝার কোনও উপায় নেই। আপাতদৃষ্টিতে সৌম্য চেহারার এক ভদ্রমহিলা, আসলে সে প্রাক্তন আইরিশ বিপ্লবী, জাত-খুনি। আন-আর্মড কমব্যাট, আর সব ধরনের অস্ত্র ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত। বহুদিন আগে এক বিপদের সময় কুয়াশা সাহায্য করেছিল এই মহিলাকে, সেই থেকে কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ। সাহায্য চাইতেই রাজি হয়ে গেছে। তাকে পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করার একটাই কারণ—রানাকে সামাল দেয়া। নিজের শারীরিক ক্ষমতা নিয়ে মোটেই সন্দেহ নেই কুয়াশার; তবে এ-ও জানে, রানা যদি খেপে যায়, তার সঙ্গে লড়াই করে পেরে উঠবে না ও। কিন্তু এই মহিলা পারবে। তার সে-ক্ষমতা আছে। আর কেউ না পারলেও এই মহিলা রানাকে পরাস্ত করতে পারবে। সবচেয়ে বড় কথা, বয়স্কা একজন মহিলাকে কখনোই সন্দেহ করবে না রানা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘায়েল হয়ে যাবে।

সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন। এখন অপেক্ষার পালা। দেখা যাক, রানা তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখে কি না। সফল হবে, তা ভাবছে না কুয়াশা। ব্যর্থ হবে, তা-ও না। কী ঘটবে সেটা সময়ই বলে দেবে।

.

ঝন ঝন করে বেজে উঠল টেলিফোন। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে রিসিভার তুলল সিআইএ-র বড় কর্মকর্তাটি, কানে ঠেকাল। অন্য পাশ থেকে ভেসে এল তার চিফ অ্যানালিস্টের কণ্ঠ।

‘সুসংবাদ, স্যর। মাসুদ রানার ট্রেস পাওয়া গেছে।‘

‘কোথায়?’

‘ফ্লোরিডা কীজ থেকে একটা চার্টার করা বিমানে উঠেছে ও দু’দিন আগে। দুটো স্টপেজে থেমে আগামীকাল ভার্জিন আইল্যাণ্ডে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে।’

‘কোথায় পেয়েছ এই ইনফরমেশন?’

‘শার্লট এমিলির হোটেলে আগামীকাল ওর বুকিং আছে।’

‘কে করিয়েছে বুকিং?’

‘ওভারসিজ কল পেয়েছে ওরা আমেরিকা থেকে। রানা আগামীকাল সকাল নাগাদ পৌঁছুবে বলে জানানো হয়েছে ওদেরকে।’

‘ফোনের উৎস?’

‘রানা এজেন্সির ফ্লোরিডা শাখা। কী ওয়েস্টে আমাদের লোক  ইতোমধ্যে এয়ারপোর্টে চলে গেছে। সমস্ত চার্টার লগ চেক করে দেখবে সে।

ভুরু কোঁচকাল সিআইএ কর্মকর্তা। ভার্জিন আইল্যাণ্ড? ওখানে কী কাজ রানার? কুয়াশার সঙ্গে দেখা করবে ওখানে? জিজ্ঞেস করল, ‘ভার্জিন আইল্যাণ্ডে কোনও শাখা আছে রানা এজেন্সির?’

‘জী না, স্যর।’

‘তা হলে কেন যাচ্ছে ওখানে?’

‘এজেন্সির ফ্লোরিডা শাখায় ফোন করে ডিরেক্টরকে চেয়েছিলাম। ওরা বলল, মি. রানা ছুটি কাটাতে গেছেন।’

কপালের ভাঁজ গভীর হলো সিআইএ কর্মকর্তার। ছুটি কাটাতে যাবে মাসুদ রানা? কুয়াশার সঙ্গে দেখা না করে? অসম্ভব! আর দু’জনের যোগাযোগের জায়গা যদি ভার্জিন আইল্যাণ্ড হয়, সেটা তো গোপন রাখার কথা। উঁহু, গোলমাল আছে কোথাও।

‘রানা এজেন্সির অন্যান্য শাখার টেলিফোন লাইন ট্যাপ করতে বলেছিলাম তোমাকে,’ বলল সিআইএ কর্মকর্তা। ‘সেটার কী খবর?’

‘সমস্ত ট্রান্সক্রিপ্ট জমা আছে আমার কম্পিউটারে,’ বলল অ্যানালিস্ট। ‘কিন্তু ওগুলোয় চোখ বোলাইনি। দরকার তো নেই, রানার খোঁজ তো বের করে ফেলেছি….

‘তুমি একটা গর্দভ!’ গাল দিয়ে উঠল সিআইএ কর্মকর্তা। ‘তাই এমন কথা ভাবছ! এক্ষুনি চেক করো সব। রানা মোটেই ভার্জিন আইল্যাণ্ডে যায়নি। ভুতুড়ে একটা ট্রেইল ওটা—আমাদেরকে বোকা বানানোর জন্য। সবকিছু দেখে রিপোর্ট করো আমাকে।

রাগী ভঙ্গিতে রিসিভার নামিয়ে রাখল সে। মেজাজ খাট্টা হয়ে গেছে। অবশ্য অ্যানালিস্টকে পুরোপুরি দোষারোপও করতে পারছে না। আসল ঘটনা কিছুই জানা নেই বেচারার। রুটিন কাজের মত মাসুদ রানার খোঁজ বের করতে বলা হয়েছে তাকে। গাদা গাদা টেলিফোন ট্রান্সক্রিপ্টে চোখ বোলাবে কেন?

পায়চারি শুরু করল সিআইএ কর্মকর্তা। অস্থিরতা চেপে বসেছে মনে। না, মাসুদ রানা বা কুয়াশাকে নিয়ে দুর্ভাবনা নেই তার। দুর্ভাবনা ফেনিসের নেতাকে নিয়ে। যদি কোনোভাবে দুই বাঙালি তার হাত গলে পালায়, তা হলে মুখ দেখানো যাবে না নেতার সামনে। কঠিন শাস্তি পেতে হবে।

তাড়াতাড়ি ফোনের রিসিভার তুলে নিল সে। রিং করল নিজস্ব ব্ল্যাক অপস্ টিমের লিডারের কাছে।

‘একটা হিট টিম চাই আমি,’ চাহিদা জানাল সিআইএ কর্মকর্তা। ‘চারজনের টিম। ফুললি ইকুইপড়। দু’জন টার্গেটকে খতম করতে হবে।’

‘ঠিক আছে,’ ওপাশ থেকে জানানো হলো। ‘টার্গেটের ডিটেইলস্ বলুন।’

‘ই-মেইলে পাঠিয়ে দিচ্ছি এসব, তুমি টিম রেডি করো।’

‘কখন পাঠাতে হবে ওদেরকে? কোথায়?’

‘এখুনি রেডি করে ওদেরকে। লোকেশন আমি একটু পরে জানাচ্ছি…’

কথা শেষ হলো না। ইয়ারপিসে বিপ বিপ ধ্বনি শোনা গেল—দ্বিতীয় লাইনে আরেকটা কল এসেছে। ‘হোল্ড অন,’ ব্ল্যাক অপসের লিডারকে বলল সিআইএ কর্মকর্তা। বোতাম টিপল অন্য

কলারের সঙ্গে কথা বলার জন্য।

‘জরুরি একটা ব্যাপার জানাবার জন্য ফোন করলাম, স্যর, ‘ শোনা গেল চিফ অ্যানালিস্টের কণ্ঠ।

‘কী সেটা?’

‘রানা এজেন্সির আর্লিংটন শাখায় একটা ইররেগুলারিটি লক্ষ করেছি। গত কয়েক ঘণ্টায় ওখান থেকে নেব্রাস্কা অ্যাভিনিউয়ের একটা হোটেলে, নাম এক্সেলসিয়র, অনেকবার ফোন করা হয়েছে। প্যাটার্নটা অদ্ভুত। একটা কলও দশ-বিশ সেকেণ্ডের বেশি নয়।

‘কী কথা হচ্ছে ফোনে?’

‘জানা নেই, স্যর। ব্রাঞ্চ চিফ তার এনক্রিপ্টেড লাইনের ফোন ব্যবহার করছে, কথা বোঝার উপায় নেই।’

‘তাতে ঘোড়ার ডিম কী লাভ হচ্ছে আমাদের?

‘এনক্রিপ্টেড ফোন, স্যর। একটা কিছু গোপন করছে ওরা, তাই না? রহস্য আছে এতে।’

আচমকাই মুড বদলে গেল সিআইএ কর্মকর্তার। ‘নাইস জব, ম্যান।’ প্রশংসা করল সে। ‘ছুটি নিতে পারো তুমি।’ বোতাম টিপে ফিরে গেল ব্ল্যাক অপস টিমের লিডারের কলে!

‘লোকেশন পাওয়া গেছে, খুশি খুশি গলায় বলল সিআইএ কর্মকর্তা। ‘ওয়াশিংটনেই… নেব্রাস্কা অ্যাভিনিউয়ে পাঠাও তোমার টিম। হোটেল এক্সেলসিয়রে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *