সেই কুয়াশা ১.১

এক

রাস্তার মোড়ে সমবেত হয়ে বড়দিনের ভক্তিগীতি গাইছে একদল গায়ক। হাত-পা নাড়ছে সঙ্গীতের তালে। রাস্তার গাড়িঘোড়ার আওয়াজ, পুলিশের সাইরেন আর দোকানপাট থেকে ভেসে আসা নানা ধরনের কোলাহল চাপা পড়ে যাচ্ছে তাদের সম্মিলিত কণ্ঠের তলায়। ভারী তুষারপাত হচ্ছে, তা অগ্রাহ্য করে শেষ মুহূর্তের কেনাকাটায় বেরিয়েছে ব্যস্ত কর্মজীবীরা। ফুটপাতে ঠেলাঠেলি, রাস্তায় যানজট, দোকানে-দোকানে আলোকসজ্জা–বড়দিনের চিরাচরিত দৃশ্য।

গাঢ় রঙের একটা ক্যাডিলাক রাস্তার মোড় ঘুরল, ধীরে ধীরে পেরুতে শুরু করল সমবেত সঙ্গীতশিল্পীদেরকে। শতচ্ছিন্ন পোশাক পরা একজন গায়ক এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে। ছেঁড়া গ্লাভে ঢাকা একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সামনে, সাহায্যের আশায় গলা চড়িয়ে গাইছে গান।

রাগী ভঙ্গিতে হর্ন বাজাল ড্রাইভার, হাতের ইশারায় সরে যেতে বলল ভিখিরি-গায়ককে। কিন্তু পিছনের প্যাসেঞ্জার সিটে বসা মাঝবয়েসী মানুষটা কেন যেন এতটা নির্দয় হতে পারল না। বোতাম টিপে রিয়ার-উইণ্ডোর কাঁচ নামাল সে, খুচরো কিছু টাকা গুঁজে দিল বাড়িয়ে ধরা হাতটাতে।

‘ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন, স্যর!’ চেঁচিয়ে বলে উঠল গায়ক। ‘ইস্ট ফিফটিনথ্ স্ট্রিটের বয়েজ ক্লাবের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আপনাকে। ধন্যবাদ! মেরি ক্রিসমাস, স্যর!’

আশীর্বাদের পাশাপাশি খোলা মুখ থেকে ভকভক করে ভেসে এল সস্তা মদের গন্ধ। বিরক্তিতে ঠোঁট বাঁকাল মাঝবয়েসী আরোহী।

‘জাহান্নামে যাক ক্রিসমাস!’ বিড়বিড় করল সে। তাড়াতাড়ি আবার উঠিয়ে দিল জানালার কাঁচ।

যানজটের মাঝখানে একটুখানি ফাঁকের সৃষ্টি হয়েছে দেখে তাড়াতাড়ি গাড়ি আগে বাড়াল ড্রাইভার। কিন্তু কিছুদূর গিয়েই আবার ব্রেক কষতে বাধ্য হলো। বিশাল এক ভ্যান আচমকা বন্ধ করে দিয়েছে রাস্তা। সখেদে স্টিয়ারিং হুইলের উপর একটা ঘুসি বসাল ড্রাইভার।

‘টেক ইট ইজি, মেজর,’ শান্ত গলায় বলল মাঝবয়েসী আরোহী। ‘উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই কোনও। এমন তো নয় যে রেগে গেলেই দ্রুত পৌঁছুতে পারছ গন্তব্যে।’

‘জী, জেনারেল,’ সসম্ভ্রমে বলল ড্রাইভার, যদিও এ-মুহূর্তে শ্রদ্ধা অনুভব করছে না সে মানুষটির প্রতি।

না, জেনারেলকে এমনিতে অশ্রদ্ধা করে না মেজর কলিন ডেনমোর, কিন্তু আজ রাতের ব্যাপার ভিন্ন। খামখেয়ালির একটা সীমা থাকা উচিত। হতে পারে সে জেনারেলের এইড, কিন্তু ক্রিসমাসের সন্ধ্যায় কাউকে ডিউটির জন্য ডেকে পাঠানো মোটেই মেনে নেয়া যায় না। তাও যদি সেটা কোনও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হতো! ভাড়া করা একটা সিভিল গাড়ি চালাবার জন্য আর কাউকে বুঝি খুঁজে পায়নি লোকটা? পাবে কী করে, যাচ্ছে তো গোপনে ফুর্তি করতে! বিশ্বস্ত এইড ছাড়া আর কাউকে কি সেটা জানতে দেয়া যায়?

না, যায় না। কারণ, জেনারেল যাচ্ছে পতিতালয়ে। ক্রিসমাসের সন্ধ্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ারম্যান অভ জয়েন্ট চিফ অভ স্টাফ যাচ্ছে দেহপসারিণীদের সঙ্গে ফুর্তি করতে! ব্যাপারটা জানাজানি হলে বিরাট কেলেঙ্কারি বেধে যাবে। মেজরকে তাই যেতে হচ্ছে গোপনীয়তা নিশ্চিত করবার জন্য… গোলমাল দেখা দিলে সেটা সামাল দেবার জন্য। রাতভর আমোদ-ফুর্তি করার পর পাঁড় মাতাল হয়ে যাবে জেনারেল, তখন ওকেই দায়িত্ব নিতে হবে তাকে বাড়ি পৌছানোর; দেখতে হবে টাকা-পয়সার দিকটা… পতিতালয়ের কেউ যেন মুখ না খোলে।

গত তিন বছরে বহুবার এভাবে জেনারেলের সঙ্গী হতে হয়েছে মেজর ডেনমোরকে। বিশ্বাস করা কঠিন, জাতির ভয়াবহ মুহূর্তগুলোতে এই মানুষটিই কীভাবে বদলে যায়… হয়ে ওঠে রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে পদস্থ সবার নির্ভরতার প্রতীক। অথচ আজ রাতে তার ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই লোকটার ভিতর সত্যি বলতে কী, মানুষটা গ্রেগরি ওয়ার্নার না হয়ে অন্য কেউ হলে মেজর ডেনমোর রীতিমত প্রতিবাদই করে বসত। হাজার হোক, ছোট পদের অফিসারদেরও পরিবারের সঙ্গে বড়দিন উদযাপনের অধিকার আছে।

কিন্তু জেনারেলের কোনও আদেশ… তা যত উদ্ভটই হোক না কেন… অমান্য করতে পারবে না মেজর ডেনমোর। পারবে না অকৃতজ্ঞ হতে কারণ বহু বছর আগে, উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় গুলিবিদ্ধ হবার এই জেনারেলই তাকে কাঁধে করে বয়ে আমেরিকান লাইনে ফিরিয়ে এনেছিল। তখন ডেনমোর ছিল তরুণ এক লেফটেন্যান্ট, আর ওয়ার্নার ছিল কর্নেল। এই লোকটার কারণেই আজও পৃথিবীতে শ্বাস ফেলছে মেজর ডেনমোর। কিছুতেই সে-উপকারের প্রতিদান দেয়া সম্ভব নয়। জেনারেল যা-ই করুক না কেন, সব মুখ বুজে মেনে নিতে হবে তাকে।

পার্ক অ্যাভিনিউ-এ পৌঁছে উত্তরমুখী পথ ধরল ক্যাডিলাক I এদিককার রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা। ক্লাচ থেকে পা সরিয়ে অ্যাকসেলারেটরে চাপ বাড়াল মেজর। হু হু করে গতি বেড়ে গেল গাড়ির। অল্প সময়ে পেরিয়ে এল পনেরো ব্লক দূরত্ব। পার্ক আর লেক্সিংটনের মাঝামাঝি, সেভেন্টি ফার্স্ট স্ট্রিটের একটা ব্রাউনস্টোনের বিল্ডিঙের সামনে পৌঁছে গেল একটু পর।

রাস্তার পাশে ফাঁকা একটা জায়গায় গাড়ি পার্ক করল মেজর। তার সঙ্গে কোনও কথা বলল না জেনারেল। দরজা খুলে শান্ত ভঙ্গিতে নেমে গেল গাড়ি থেকে। বিল্ডিঙের সামনের চওড়া সিঁড়ি ধরে উঠে গেল সদর দরজার দিকে। পাল্লার উপরে পুরনো আমলের একটা ভারী কড়া ঝুলছে। ওটা নাড়তেই একহারা, দীর্ঘদেহী এক মহিলা দরজা খুলল। টকটকে লাল রঙা সিল্কের একটা গাউন পরে আছে, গলায় দামি ডায়মণ্ড নেকলেস। ড্রাইভিং সিটে বসে জেনারেলকে মহিলাটির সঙ্গে ভিতরে ঢুকে যেতে দেখল মেজর। মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রাতের ঠাণ্ডা বাতাস খাওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই এখন। কপাল ভাল হলে হয়তো ঘণ্টাতিনেক পর আবার খুলে যাবে দরজাটা, নেশাতুর জেনারেলকে নিয়ে আসার সঙ্কেত দেয়া হবে তাকে। কপাল খারাপ হলে রাতভরও অপেক্ষা করতে হতে পারে।

পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে স্ত্রী-র নাম্বারে ডায়াল করল ডেনমোর। আরেক দফা ক্ষমা চাইতে হবে ক্যারোলিনের কাছে… ক্রিসমাসের সন্ধ্যায় ওকে এভাবে একা ফেলে আসার জন্য। শালার জেনারেল, বিড়বিড় করল মেজর, তার জন্য কোনদিন না জানি ওর নিজের সংসারই তছনছ হয়ে যায়!

.

পিছনে দরজা বন্ধ হয়ে যেতেই হলওয়ের আলো-ছায়ার মাঝে জেনারেলকে জড়িয়ে ধরল দীর্ঘাঙ্গী মহিলা। গালে চুমু খেয়ে মদির গলায় বলল, ‘হাই গ্রেগ! ডার্লিং… তোমাকে খুব মিস করেছি আমরা। এতদিন আসোনি কেন?’

‘এতদিন কোথায়?’ বলল জেনারেল। ‘মাত্র তো দু’সপ্তাহ।’

ইউনিফর্ম-পরা একজন কমবয়েসী মেইড এগিয়ে এল, ওভারকোট খুলতে সাহায্য করল তাকে। ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটাকে দেখল জেনারেল—আগে দেখেনি, নতুন এসেছে নিশ্চয়ই। দেখতে-শুনতে চমৎকার। জেনারেলের চোখে লোভী দৃষ্টি ফুটল।

ব্যাপারটা লক্ষ করে হেসে উঠল দীর্ঘাঙ্গী মহিলা। বলল, ‘ও এখনও তোমার জন্য তৈরি নয়, ডার্লিং। দু-এক মাস সময় দরকার সবকিছু শিখে নেবার জন্য।’ জেনারেলের হাতের ভাঁজে হাত ঢুকিয়ে দিল। ‘এসো, তোমার জন্য আলাদা ব্যবস্থা রেখেছি আমি।’

দোতলার বিশাল একটা কামরায় অতিথিকে নিয়ে গেল মহিলা। ভিতরটা রঙিন, মোলায়েম আলোয় আলোকিত। জানালায় ভারী পর্দা, মেঝেতে পুরু গালিচা। দামি আসবাবপত্র শোভা পাচ্ছে ঘর জুড়ে ঠিক মাঝখানে রয়েছে বড়-সড় একটা বিছানা, তার পাশে নতমুখে দাঁড়িয়ে সুন্দরী দুটি মেয়ে।

ভুরু কোঁচকাল জেনারেল। ডানদিকের আমেরিকান মেয়েটি পরিচিত, আগেও বেশ ক’বার তার শয্যাসঙ্গিনী হয়েছে। কিন্তু অন্য মেয়েটাকে এই প্রথম দেখছে। বিদেশি নিঃসন্দেহে, গায়ের চামড়া ল্যাটিনোদের মত বাদামি। মাথায় কুচকুচে কালো কেশ… খোঁপা করে রাখা হয়েছে। পরনে সাদা লিনেনের ফিনফিনে আলখাল্লা… প্রায় স্বচ্ছ-ই বলা চলে; তলায় সুগঠিত শরীরের প্রতিটি আঁক-বাঁক প্রকট হয়ে উঠেছে

দীর্ঘাঙ্গী মহিলার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল জেনারেল।

‘নতুন মেয়ে… গ্রিক,’ ফিসফিসিয়ে বলল মহিলা। ‘সপ্তাহখানেক হলো যোগ দিয়েছে আমার এখানে, কিন্তু কাজের বাহার দেখে চমকে গেছি। এনজয় করবে তুমি, প্রমিজ!’

নিঃশব্দ হাসি ফুটল জেনারেলের ঠোঁটে। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল নতুন মেয়েটির ব্যাপারে।

দীর্ঘাঙ্গী মহিলাটিও হাসল। পায়ে পায়ে পিছিয়ে গেল সে, বেরিয়ে গেল কামরা থেকে। দরজা টেনে দিল।

আধঘণ্টার মধ্যেই অন্য এক জগতে চলে গেল জেনারেল। পুরো কামরা ভরে গেল আফিমের মেঘ আর দামি মদের গন্ধে। সম্পূর্ণ উদোম হয়ে বিছানায় শুয়ে গোঙাতে থাকল সে। মেয়েদুটিও বিবস্ত্র হয়ে গেছে, প্রজাপতির মত তাদের হাতগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে জেনারেলের সারা শরীরে, ছড়িয়ে দিচ্ছে সুখের আবেশ। ঘোর লাগা অবস্থাতেও মনে মনে গ্রিক মেয়েটির প্রশংসা করল জেনারেল। সত্যি, কাজ জানে বটে! ক্ষণে ক্ষণে চরম পুলক এনে দিচ্ছে, কানের কাছে ফিসফিসিয়ে অবিরাম কী যেন বলছে গ্রিক ভাষায়। অর্থ বোঝা না গেলেও শরীরে শিহরণ তুলছে তার মদির কণ্ঠ।

হঠাৎ সোজা হয়ে বসল গ্রিক মেয়েটি, বিছানা থেকে নামতে নামতে ইশারায় বাথরুম দেখাল সঙ্গিনীকে। মাথা ঝাঁকিয়ে তাকে যেতে ইশারা করল আমেরিকান মেয়েটি। দ্বিতীয়জনের অভাব পূরণ করার জন্য উঠে পড়ল জেনারেলের শরীরের উপর, ঠোঁট ডুবিয়ে দিল তার ঠোঁটে, চুমু খেতে শুরু করল ক্ষুধার্ত ভঙ্গিতে।

দু’জনে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল, খেয়াল করল না—মাত্র এক মিনিট পরেই আবার বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে গ্রিক মেয়েটি। এখন আর নগ্ন নয় সে, গাঢ় রঙের একটা টুইডের কোট পরে নিয়েছে, উঁচু হুড দিয়ে ঢেকে ফেলেছে মাথা। ছায়ার মাঝে কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল মেয়েটা, তারপর সন্তর্পণে এগিয়ে গেল জানালার দিকে। কাছাকাছি পৌঁছে একহাতে একটা পর্দার কিনার মুঠো করে ধরল, বড় করে শ্বাস নিয়ে এক ঝটকায় সরিয়ে দিল পর্দাটা।

সঙ্গে সঙ্গে জানালায় বিকট শব্দ হলো। কাঁচ আর পাল্লা ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়ল লম্বা একজন মানুষ, র‍্যাপলিং করে ছাদের উপর থেকে নেমে এসেছে সে। পরনে কুচকুচে কালো পোশাক, মুখ ঢেকে রেখেছে স্কি-মাস্ক দিয়ে। হাতে ভয়ঙ্করদর্শন একটা পিস্তল। সাইলেন্সার লাগানো।

চমকে উঠে জেনারেলের উপর থেকে বিছানায় চিৎ হয়ে পড়ল আমেরিকান মেয়েটি, লোকটাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল আতঙ্কে। কিন্তু চিৎকারটা হলো ক্ষণস্থায়ী। আততায়ীর পিস্তলের এক গুলিতে নিথর হয়ে গেল সে।

হতভম্বের মত খুনির দিকে তাকাল জেনারেল। ‘মাদকের নেশায় ঠিকমত কাজ করছে না মাথা। ফিসফিসিয়ে জানতে চাইল, ‘হু দ্য হেল আর ইউ?’

জবাব না দিয়ে আবার ট্রিগার চাপল আততায়ী… পর পর তিনবার মৃদু শব্দের সঙ্গে জেনারেলের বুক, পেট আর মাথা ফুটো হয়ে গেল রক্তে ভেসে যেতে শুরু করল বিছানা।

নির্বিকার ভঙ্গিতে গ্রিক মেয়েটার দিকে ফিরল খুনি। ‘মক্ষীরানী কোথায়?’

এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে ধরল মেয়েটা। জানাল, ‘নীচতলায়, ডানদিকের অফিস কামরায় পাবে ওকে। লাল ড্রেস পরেছে, গলায় ডায়মণ্ডের নেকলেস।’

মাথা ঝাঁকিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল খুনি। পিছু পিছু গ্রিক মেয়েটা।

.

অপ্রত্যাশিত শব্দে সচকিত হয়ে উঠল মেজর ডেনমোর। চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেছে। ব্রাউনস্টোনের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে কান পাতল সে। ভিতর থেকে চেঁচামেচির শব্দ ভেসে আসছে… না, চেঁচামেচি না। চিৎকার… আতঙ্কিত চিৎকার! বহুকণ্ঠের!!

কিংকর্তব্য ঠিক করার আগেই ঝট্ করে খুলে গেল সদর দরজা। ভিতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল দুটো ছায়ামূর্তি। একজন নারী, অন্যজন পুরুষ। পুরুষটির হাতে একটা পিস্তল, ঝড়ের বেগে সিঁড়ি টপকে নীচে নামতে নামতে কোমরের বেল্টে গুঁজে ফেলল অস্ত্রটা। পেভমেন্টে নেমেই সঙ্গিনীকে নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করল।

খোলা দরজা দিয়ে এখন ভালমত ভেসে আসছে চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজ। বুকের ভিতর সতর্কঘণ্টা বেজে উঠল মেজরের। হাত বাড়িয়ে গ্লাভ কম্পার্টমেণ্ট খুলে ফেলল সে। বের করে আনল নিজের সার্ভিস রিভলবার। ওটা হাতে নিয়ে গাড়ি থেকে নামল। ছুটল বাড়ির দিকে।

একেক লাফে দু’তিনটে করে ধাপ পেরুল মেজর, সিঁড়ি ভেঙে উঠে এল উপরে, সদর দরজা পেরিয়ে ঢুকে পড়ল বাড়ির ভিতর স্বল্পবসনা একদল মেয়েকে দেখতে পেল সামনে। হলওয়েতে ছুটোছুটি করছে তারা। শেষপ্রান্তে উপুড় হয়ে পড়ে আছে দীর্ঘাঙ্গী মহিলাটি। পরনের লাল পোশাক আর রক্ত মিলেমিশে একাকার। মাথার পিছনে একটা বুলেটের গর্ত। সম্ভবত পালাবার চেষ্টা করেছিল, পিছন থেকে তাকে গুলি করেছে খুনি।

পাশ দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিল একটা মেয়ে, খপ্ করে তার হাত চেপে ধরল মেজর। কর্কশ গলায় জানতে চাইল, ‘কোথায় উনি?

‘দ্… দোতলায়!’ কাঁপতে কাঁপতে জানাল মেয়েটি।

ঝট্ করে ঘুরল মেজর। বাড়ির কারুকাজ করা সিঁড়ি ধরে ছুটল দোতলায়। ল্যাণ্ডিঙে পৌঁছে গেল কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে, গতি কমাল না। বাঁয়ে মোড় নিয়ে একটা করিডোরে ঢুকে পড়ল। কামরাটা চেনা আছে তার। প্রতিবার ওই একই কামরায় রাত কাটায় জেনারেল।

দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেই থমকে গেল মেজর ডেনমোর। এই প্রথম মৃতদেহ দেখছে না সে। কিন্তু জেনারেলকে এ-অবস্থায় দেখবে আশা করেনি। বিবস্ত্র, রক্তে রঞ্জিত… পাশে নগ্ন এক পতিতার লাশ-সহ। চরম অসম্মানের মৃত্যু বোধহয় একেই বলে। বমি পেল তার।

মূর্তির মত কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, তা বলতে পারবে না। কিন্তু সংবিৎ ফিরতেই নিজেকে সামলে নিল ডেনমোর। চোয়াল শক্ত করে বেরিয়ে এল কামরা থেকে দরজা টেনে দিয়ে বাইরে থেকে ছিটকিনি আটকাল। করিভোরের ওপাশ থেকে কয়েকটা মেয়ে উঁকি দিচ্ছে! নিকে হুমকির ভঙ্গিতে রিভলবার তাক করল।

চলে যাও এখন থেকে!’ চেঁচিয়ে উঠল মেজর। ‘খবরদার, এদিকে কাউকে দেখতে পেলেই গুলি করব আমি! নীচে গিয়ে সবাইকে জানিয়ে দাও কথাটা।

পড়িমরি করে ছুটে পালাল মেয়েগুলো।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করল ডেনমোর। মেমরিতে রাখা একটা নাম্বারে ডায়াল করল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘হ্যালো…’

.

গম্ভীর মুখে ওভাল অফিসে এসে ঢুকলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। সেক্রেটারি অভ স্টেট আর সিআইএ ডিরেক্টর অপেক্ষা করছিলেন ভিতরে, তাঁকে দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। চুপচাপ নিজের চেয়ারে বসলেন প্রেসিডেন্ট, কিছু বললেন না। অনুমতির অপেক্ষায় মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে থাকলেন দু’জনে, শেষ পর্যন্ত ইতস্তত করে বসে পড়লেন মুখোমুখি।

‘মি. প্রেসিডেন্ট…’ গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে শুরু করলেন সেক্রেটারি অভ স্টেট, কিন্তু থেমে গেলেন প্রেসিডেন্টের বাধা পেয়ে।

‘কী ঘটেছে, তার রিপোর্ট দেবার প্রয়োজন নেই,’ থমথমে গলায় বললেন তিনি। ‘অলরেডি সব জানতে পেরেছি আমি! আপনারা ব্যাপারটা কীভাবে ট্যাকেল করছেন, তা বলুন।

‘নিউ ইয়র্ক পুলিশ কো-অপারেট করছে,’ বললেন সিআইএ ডিরেক্টর। ‘আমাদের কপাল ভাল, জেনারেলের এইড দরজা আটকে পাহারা দিচ্ছিল; আমাদের লোক পৌঁছুবার আগে কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেয়নি। পুলিশ আর প্রেসের লোক ঢোকাবার আগে ক্রাইম সিন ক্লিনআপ করে নিতে পেরেছি আমরা।’

‘এ তো ড্যামেজ কন্ট্রোল!’ অধৈর্য গলায় বললেন প্রেসিডেন্ট ‘ও-ব্যাপারে আমার কোনও আগ্রহ নেই। আমি জানতে চাইছি আপনাদের আইডিয়ার কথা। কী ঘটেছে আসলে? নিউ ইয়র্কের আরেকটা সাধারণ হোমিসাইড এটা, নাকি অন্য কিছু?’

‘অন্য কিছু,’ বললেন সিআইএ ডিরেক্টর। ‘নিঃসন্দেহে। এফবিআই ডিরেক্টরের সঙ্গে আলাপ হয়েছে আমার। সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেছে ওরা। পুরোটাই নিখুঁতভাবে প্ল্যান করা, প্রফেশনাল হিট। চমৎকারভাবে সারা হয়েছে কাজটা, একটা সূত্রও রেখে যাওয়া হয়নি পিছনে। এমনকী পতিতালয়ের মালিক মহিলাকেও খুন করা হয়েছে, যাতে তার কাছ থেকে কোনও তথ্য না পাই আমরা।’

‘কে দায়ী?’ জানতে চাইলেন প্রেসিডেন্ট।

‘বলা কঠিন। বুলেটগুলো পরীক্ষা করা হয়েছে। গ্রাজ-বুরিয়া অটোমেটিক থেকে ফায়ার করা হয়েছে। ওটা রাশান পিস্তল, রাশান ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে। কাজেই কাজটা ওদের হতে পারে…’

‘অসম্ভব!’ প্রতিবাদ করলেন সেক্রেটারি অভ স্টেট। ‘ইতোমধ্যে রাশান অ্যাম্বাস্যাডরের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার ব্যাপারটার আভাস দিতেই কসম কেটে বলেছেন, এর মধ্যে তাঁদের কোনও হাত নেই। কথাটা বিশ্বাস করেছি আমি। জেনারেল ওয়ার্নার রাশান ইস্যুতে বহুবার ওদের পক্ষ নিয়েছেন! ওঁকে খুন করলে ওদেরই ক্ষতি। তা ছাড়া ওই পিস্তল ইয়োরোপের যে-কোনও জায়গায় কিনতে পাওয়া যায় :

‘সেক্ষেত্রে আর কোনও সাসপেক্ট আছে আপনার হাতে?’ সিআইএ ডিরেক্টরের দিকে ফিরলেন প্রেসিডেন্ট।

‘বহু। আল-কায়েদা, চাইনিজ ইন্টেলিজেন্স, নর্থ কোরিয়ান… লিস্ট অনেক লম্বা কাঁধ ঝাঁকালেন ডিরেক্টর। ‘কিন্তু আমাদের হাতে কোনও প্রমাণ নেই। টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশন হলে এতক্ষণে কৃতিত্ব দাবি করত, কিন্তু করেনি। আর ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটি এসব ব্যাপারে কখনও ঢাকঢোল পেটায় না। আমরা এ-মুহূর্তে সম্পূর্ণ অন্ধকারে, মি. প্রেসিডেন্ট।’

‘তা হলে আলোয় আসার ব্যবস্থা নিন!’ রাগী গলায় বললেন প্রেসিডেন্ট। ‘আমাদের জয়েন্ট চিফ অভ স্টাফকে খুন করা হয়েছে! ব্যক্তিগত জীবনে ওর কী বদভ্যাস ছিল, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, দেশের জন্য জেনারেল ওয়ার্নার ছিল এক অমূল্য সম্পদ… সত্যিকার বীর। যে-ই এর পিছনে জড়িত থাকুক, তাকে কিছুতেই পার পেতে দেয়া যায় না। যা খুশি করুন, বাট আই ওয়ান্ট দ্যাট সান অভ বিচ!’

‘ইয়েস, মি. প্রেসিডেন্ট!’ সমস্বরে বলে উঠলেন সেক্রেটারি অভ স্টেট আর সিআইএ ডিরেক্টর। তারপর বেরিয়ে এলেন ওভাল অফিস থেকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *