সেই কুয়াশা ১.১৬

ষোলো

ভোরের কুয়াশা মিলিয়ে যেতেই পাহাড়ের আড়াল থেকে হেসে উঠল সূর্য, সোনালি রোদে স্নান করিয়ে দিল ফার্মহাউস আর আশপাশের এলাকাকে।

কিচেন থেকে চা-পাতা খুঁজে নিল কুয়াশা, বৃদ্ধার অনুমতি নিয়ে বানিয়ে ফেলল চা। ধূমায়িত কাপ নিয়ে জানালার পাশে বসল রানা, ফার্মহাউসের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে হারিয়ে গেল আপন চিন্তায় 1

বেশ কিছু খটকার সৃষ্টি হয়েছে ওর মনে। সেগুলোর জবাব পাওয়া দরকার। ফেনিসের উৎপত্তি সম্পর্কে যে-সব থিয়োরি আছে, তার সঙ্গে অন্ধ মহিলাটির ভাষ্যের ফারাক অনেক। সবচেয়ে বড় কথা, এসব কেন ওদেরকে শোনাচ্ছেন তিনি? উদ্দেশ্যটা কী? বৃদ্ধার মোটিভ জানা গেলেই শুধুমাত্র সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে, অদ্ভুত কাহিনিটার কতখানি বিশ্বাস করা যায়।

জানালার দিক থেকে মুখ ঘোরাল রানা, তাকাল ফায়ারপ্লেসের পাশে চেয়ারে বসা বৃদ্ধার দিকে। এক কাপ চা তাঁকেও দিয়েছে কুয়াশা, সেটায় ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছেন… সম্ভবত বহু বছর আগে ভদ্রভাবে চা খাওয়ার এ-নিয়মই শেখানো হয়েছিল তাঁকে। কুয়াশাকে দেখা গেল হাঁটু গেড়ে বসে থাকতে, হাত বোলাচ্ছে মেঝেতে গুটিসুটি মেরে থাকা কুকুরটার গায়ে—বন্ধুত্ব করার খায়েশ। চকিতের জন্য রানার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল।

বৃদ্ধার দিকে এগিয়ে গেল রানা। বলল, ‘আমরা আপনাকে আমাদের নাম জানিয়েছি, সেনিয়রা। কিন্তু আপনারটা এখনও জানতে পারিনি।

‘মারিয়া মাযোলা,’ বললেন বৃদ্ধা। ‘যদি খোঁজ নেয় কেউ, বোনাফাসিয়োর কনভেন্টের পুরনো রেকর্ডে নিশ্চয়ই পাবে এ-নাম। এজন্যেই তো জানতে চাইছ, নাকি? আমার কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য?’

‘জী,’ স্বীকার করল রানা। ‘যদি প্রয়োজন পড়ে আর কী… এবং সুযোগ মেলে।

‘নামটা পাবে ওখানে, নিশ্চিত থাকো। আমার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পাদ্রোনির নামও থাকতে পারে।’

‘বিশ্বাস করছি আপনার কথা, চেক করে দেখার দরকার নেই কোনও,’ উঠে দাঁড়িয়ে বলল কুয়াশা। চোখের ইশারায় রানাকে বোঝাল, বৃদ্ধাকে খুশি রাখার জন্য বলছে কথাটা।

হাসলেন মারিয়া মাযোলা। চোখে না দেখলেও ঠিকই বুঝতে পেরেছেন সব। বললেন, ‘থাক, আমাকে সান্ত্বনা দেবার দরকার নেই। সন্দেহ থাকলে সরাসরিই বলো।’

‘কিছুটা তো আছেই,’ সোজাসাপ্টা গলায় বলল রানা। ‘আমাদের জানা দরকার, কেন আমাদেরকে কাউণ্ট বারেমির কাহিনি শোনাচ্ছেন আপনি। উদ্দেশ্য কী

‘আমার উদ্দেশ্য শুধু সত্যকে প্রকাশ করা, বাছা। আর কিছু নয়। মরার আগে কাউকে জানিয়ে যেতে চাই সব। ভয়ানক সে-কাহিনি আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। একমাত্র আমিই বেঁচেছিলাম ওই পাইকারী হত্যাকাণ্ড থেকে।’

‘আরেকজন লোকও তো ছিল,’ বলল রানা। ‘আর ছিল এক রাখাল ছেলে।’

‘হলঘরে হাজির ছিল না ওরা। জানত না ওখানে কী কথা হয়েছে পাদ্রোনি আর তাঁর অতিথিদের মাঝে। কী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে…’

‘আর কাউকে বলেননি আপনি এসব?’ জিজ্ঞেস করল কুয়াশা।

‘না… কখনোই না।’ জানালেন বৃদ্ধা।

‘কেন?’

‘কাকে বলব? আমার কাছে অতিথি বলতে কেউ আসে না। বাজার-সদাই দেবার জন্য মাঝে-মধ্যে দু-একজন আসে নীচের গ্রাম থেকে। ওদেরকে কিছু বলা মানে বিপদ ডেকে আনা। এমন কাহিনি শুনলে কেউ তো আর মুখ বন্ধ রাখতে পারবে না।’

‘কিন্তু আমার তো মনে হয় ওরা সবকিছুই জানে,’ বলল কুয়াশা।

‘আমি তোমাদেরকে যা বলেছি, তা জানে না।’

‘না জানলে কী গোপন করছে ওরা? আমাকে প্রথমে তাড়াতে চেয়েছিল। রাজি না হওয়ায় খুন পর্যন্ত করতে চেয়েছে।’

একটু যেন অবাক হলেন বৃদ্ধা। ‘সোনিয়া আমাকে এসব বলেনি তো!’

‘আপনার সঙ্গে কথা বলার সময় পেল কোথায় ও?’ বলল রানা!

‘তা অবশ্য ঠিক,’ বিড়বিড় করলেন বৃদ্ধা। কুয়াশার দিকে মুখ ঘোরালেন। ‘গাঁয়ে গিয়ে তুমি ঠিক কী করেছ, বলো তো?’

‘কিছুই না,’ কুয়াশা জবাব দিল। ‘শুধু প্রশ্ন করেছি কাউন্ট বারেমির ব্যাপারে।

উঁহু, আরও কিছু করেছ বা বলেছ। নইলে এত খেপার কথা না ওদের।’

একটু ভাবল কুয়াশা। তারপর বলল, হ্যাঁ… সরাইমালিককে ভয় দেখিয়েছিলাম, লোকজন নিয়ে ফিরে আসব। পুরনো নথিপত্রের সঙ্গে মিলিয়ে ভালমত গবেষণা চালাব কাউন্ট বারেমির বিষয়ে।’

গম্ভীর হয়ে গেলেন বৃদ্ধা। বড্ড ভুল করেছ, বাছা। যে-পথে এসেছ, ফেরার সময় সে-পথে আর যেয়ো না। পথ দেখাবার জন্য সোনিয়াকেও সঙ্গে দিতে পারব না আমি। যদি খোঁজ প্রায়, ওরা কিছুতেই তোমাদেরকে বাঁচতে দেবে না।’

‘আমরা তা জানি,’ বলল রানা। ‘কিন্তু কেন, তা-ই বুঝতে পারছি না।’

‘পাহাড়ের অধিবাসীদের নামে নিজের সমস্ত জমিজমা লিখে দিয়েছিলেন আমার পাদ্রোনি। এ-কারণে সামান্য প্রজা থেকে কয়েক হাজার একর জায়গার মালিক হয়ে গেছে ওরা। বোনাফাসিয়োর আদালত স্বীকৃতি দিয়েছে এর, বৈধ মালিকানার রায় পাবার পর পুরো এলাকায় বিশাল এক উৎসবও হয়েছিল। কিন্তু বাইরের দুনিয়ার কেউ জানে না, এসব সম্পত্তি পাবার জন্য বিরাট এক মূল্য দিতে হয়েছে পাহাড়ের লোকজনকে। সেই মূল্যের খবর যদি প্রকাশ পায় কোনোমতে, আইনের খড়গ নেমে আসবে সবার উপর… আদালত আবার কেড়ে নেবে সব জমি!’

‘কী সেই মূল্য?’ ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল রানা।

জবাব দিলেন না মারিয়া। চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে উঠেছে তাঁর চেহারা, বোধহয় ভাবছেন এলাকাবাসীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা উচিত হবে কি না।

‘প্লিজ, ম্যা’ম!’ অনুরোধ করল কুয়াশা।

ফোঁস করে শ্বাস ফেললেন বৃদ্ধা। বললেন, ‘বেশ, খুলেই বলছি সব। সত্যকে আর কতদিন চাপা দিয়ে রাখব?’

আগের রাতে বলা কাহিনির খেই ধরলেন তিনি।

.

‘পাদ্রোনির মৃত্যুর পর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করল না অতিথিরা।। ছুটল নিজেদের কামরার দিকে। অনড় রইলাম কেবল আমি, ঝুলবারান্দার ছায়ায় লুকিয়ে কাঁপতে লাগলাম থর থর করে, মৃত্যুর। নগ্ন চেহারা দেখতে পেয়ে বমি পাচ্ছিল। কতক্ষণ ওভাবে ছিলাম, তা বলতে পারব না; সংবিৎ ফিরে পেলাম আবার অতিথিদের পায়ের শব্দ শুনে—জিনিসপত্র গুছিয়ে সিঁড়ি ধরে নেমে আসছে ওরা। একটু পরেই ক্যারিজের চাকার আওয়াজ আর ঘোড়ার হ্রেষারব কানে এল। অতিথিদেরকে নিয়ে ভিলা থেকে চলে গেল কোচোয়ান।

‘হামাগুড়ি দিয়ে বারান্দার সঙ্গে লাগোয়া দরজার দিকে এগোতে শুরু করলাম এবার, দাঁড়াবার শক্তি পাচ্ছিলাম না। দৃষ্টিও কেমন যেন ঘোলা ঘোলা লাগছিল। দরজার হাতল ধরে উঠে দাঁড়াতে গেছি, এমন সময় শুনতে পেলাম চিৎকার। কণ্ঠটা একজন বাচ্চার, কিন্তু সেটা অবিশ্বাস্য রকম শীতল এবং কর্তৃত্ব-ভরা।

‘আতুলয়ালমেন্তে! ই প্রেস্তো দেত্তো!’

‘উত্তরের বারান্দা থেকে কাকে উদ্দেশ করে যেন চেঁচাচ্ছে রাখালবালক। ওর কণ্ঠ শুনে ঘাবড়ে গেলাম আরও—কারণ ও একটা শিশু… সেইসঙ্গে একজন খুনি!

‘কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দার দরজা খুললাম। ভিতরের .কামরা পেরিয়ে এগোতে থাকলাম সিঁড়ির দিকে। নীচতলায় নেমে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাব… পালিয়ে যাব এই মৃত্যুপুরী থেকে। কিন্তু ল্যাণ্ডিঙে পৌঁছুবার সঙ্গে সঙ্গে হৈ-হল্লার আওয়াজ শুনে থমকে গেলাম। জানালা দিয়ে চোখে পড়ল আলোর আভা-মশাল হাতে অসংখ্য মানুষ ছুটে আসছে ভিলার দিকে। কিছুক্ষণ পরেই বাড়ির চারদিকের দরজা দিয়ে উন্মত্তের মত ভিতরে ঢুকে পড়ল তারা।

‘নীচে নামা আর হলো না আমার, তাড়াতাড়ি ওপরতলায় ছুটে. চলে গেলাম। কী করব জানি না তখনও, শুধু বুঝতে পারছি—পাগলা জনতার সামনে পড়া চলবে না কিছুতেই। দৌড়াতে দৌড়াতে সেলাই-ঘরে ঢুকে পড়লাম। ভিতরে বীভৎস দৃশ্য-বাড়ির দাসী-বাঁদীদের লাশ পড়ে আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, সবার শরীর রক্তে মাখামাখি, প্রাণহীন চোখগুলো বিস্ফারিত হয়ে আছে। ওপরতলার অন্যান্য কামরাগুলোতেও কমবেশি একই অবস্থা।

‘সিঁড়ির দিক থেকে তখন ভেসে আসছে পায়ের শব্দ আর উত্তেজিত কণ্ঠের চেঁচামেচি। বুঝতে পারছি, আমাকে জ্যান্ত দেখতে পেলে খুন করে ফেলবে ওরা। বাঁচার উপায় নেই। কাঁদতে কাঁদতে কামরার ভিতরে চোখ বোলালাম, আর হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। রক্তে সয়লাব মেঝের মধ্যে গড়ান দিলাম একটা, জামা-কাপড় ভিজিয়ে ফেললাম… মুখেও মাখলাম রক্ত। তারপর চোখ বন্ধ করে মড়ার মত পড়ে রইলাম লাশের মাঝখানে।

‘একটু পরেই স্থানীয় কয়েকজন লোক উদয় হলো সেলাই-ঘরে। সমবেত কণ্ঠে প্রার্থনা করল ওরা, ক্ষমা চাইল ঈশ্বরের কাছে, তারপর ধরাধরি করে একটার পর একটা লাশ নিয়ে যেতে শুরু করল নীচতলায়… বাড়ির আঙিনায়। আমাকেও লাশ ভেবে নিয়ে যাওয়া হলো ওখানে। এক ফাঁকে চোখ খুলে দেখে নিলাম কী ঘটছে। সারা বাড়ি থেকেই লাশ সংগ্রহ করছে এলাকাবাসী, ধীরে ধীরে আঙিনায় বড় হচ্ছে মৃতদেহের স্তূপ। বড় বড় বেশ ক’টা ওয়্যাগন আনা হলো–তাতে করে লাশ সরিয়ে নিতে শুরু করল ওরা। অন্যান্য দাসী-বাঁদীদের সঙ্গে আমিও ঠাঁই পেলাম একটা ওয়্যাগনে।

‘কী এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা সেটা, বলে বোঝাতে পারব না আমার চারপাশে শুধু লাশ আর লাশ… পরিচিত মানুষের প্রাণহীন দেহ! সবাইকে চিনি আমি, তাদের সঙ্গে তিনটে বছর কাটিয়েছি এ-বাড়িতে। চরম অবমাননার সঙ্গে তাদের দেহ এখন স্তূপ হয়ে আছে আমার ডানে-বামে, উপর-নীচে। ভয় আর ঘৃণায় রি রি করছিল সর্বাঙ্গ। বমি আসছিল। চিৎকার ঠেকানোর জন্য নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখেছিলাম পুরোটা সময়। আশপাশ থেকে ভেসে আসছিল লাশ সরানোর কাজে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছিল, তাদের হুমকি-ধমকি—সবাইকে বলে দেয়া হচ্ছিল, ভিলা থেকে কোনও কিছু লুঠ করা যাবে না; কেউ যদি সে-চেষ্টা করে, তা হলে তাকে যোগ দিতে হবে লাশের ভিড়ে। বাড়ির ভিতরেও বেশ কিছু লাশ রেখে যাবার নির্দেশ দিতে শুনলাম—যতটুকু বুঝলাম, জ্বালিয়ে দেয়া হবে ভিলা; আগুন নেভার পর পোড়া লাশ উদ্ধার করা হবে ধ্বংসস্তূপ থেকে, বলা হবে অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছে বাড়ির বেশ কিছু লোক… বাকিরা পালিয়ে গেছে। এতগুলো মানুষের উধাও হয়ে  যাবার চমৎকার ব্যাখ্যা হবে সেটা—কেউই নিশ্চিত হতে পারবে না, ঠিক কারা মারা গেছে আর কারা নিখোঁজ।

‘যা-হোক, খানিক পরে চলতে শুরু করল ওয়্যাগন। মসৃণ রাস্তা ধরে চলল কিছুক্ষণ, তারপর নেমে পড়ল খোলা প্রান্তরে। রুক্ষ, বন্ধুর পথে লাশে ভরা ভারী ওয়্যাগন টানতে বেশ বেগ পেল ঘোড়াগুলো, কিন্তু পিঠে চাবুক মেরে ওদেরকে চলতে বাধ্য করল কোচোয়ান। ঝাঁকি খেতে খেতে এগোতে থাকলাম আমরা। সহ্যের প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি আমি তখন, নিজের মৃত্যুকামনা করছি… একেকবার ইচ্ছে হলো চেঁচিয়ে উঠি, পারলাম না কেবল প্রাণের ভয়ে। বিড়বিড় করে ঈশ্বরের কাছে প্ৰাৰ্থনা করলাম—মুক্তি চাইলাম এই দুঃস্বপ্নের হাত থেকে। এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।

‘কতটা সময় সংজ্ঞাহীন ছিলাম, জানি না; তবে চেতনা ফিরলে টের পেলাম, থেমে গেছে ওয়্যাগন। লাশের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলাম বাইরে। চাঁদের আলোয় দেখলাম, জঙ্গলে ছাওয়া কতগুলো পাহাড়ের মাঝখানে পৌঁছেছি আমরা। জায়গাটা অপরিচিত, আগে কখনও দেখিনি; আন্দাজ করলাম—ভিলা বারেমি থেকে বহুদূরে নিয়ে আসা হয়েছে আমাদেরকে। ওয়্যাগনের সঙ্গে আসা লোকজনের ভারী শ্বাস-প্রশ্বাস কানে এল-মাটি খুঁড়ছে ওরা।

‘ঘণ্টাখানেক পর শুরু হলো দুঃস্বপ্নের শেষ অংশ। ওয়্যাগন থেকে নামিয়ে সব লাশ ছুঁড়ে ফেলতে শুরু করল ওরা সদ্য-খোঁড়া গর্তের ভিতর—ওটা আসলে গণকবর! চ্যাংদোলা করে একটু পর আমাকেও ছুঁড়ে ফেলা হলো ওখানে। ভিতরে আছাড় খেয়ে ব্যথা পেলাম খুব; কিন্তু আওয়াজ করলাম না একটুও। বোধবুদ্ধি ততক্ষণে ভোঁতা হয়ে গেছে—দেখছি সবই, তবে অনুভব করছি না কিছুই। পাগল যে হয়ে যাইনি, তা-ই ঢের।  

‘কবরটা বিশাল, মনে হলো একটা বৃত্তের মত খোঁড়া হয়েছে। সব লাশ ফেলে দেবার পরও পুরোটা ভরল না। বাইরে থেকে ভেসে আসছিল কথাবার্তার আওয়াজ—কেউ কাঁদছে, কেউ বা ডেকে চলেছে ঈশ্বরকে…. ক্ষমা চাইছে কৃতকর্মের জন্য। কয়েকজন দাবি জানাল ধর্মীয় রীতি মোতাবেক শেষকৃত্য করবার জন্য, কিন্তু অন্যেরা রাজি হলো না তাতে। শেষকৃত্য করাতে হলে পাদ্রী ডেকে আনতে হবে… এত সময় কোথায়? পাদ্রী যে মুখ বন্ধ রাখবে, তার-ই বা নিশ্চয়তা কী? না, এ হবার নয়।

‘লম্বা-চওড়া এক ভাষণ দিতে শুনলাম একজনকে। সে সবাইকে বোঝাল, নিজেদের মঙ্গলের জন্য… ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মঙ্গলের জন্য গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে ওদেরকে। এই গোপনীয়তাই পাহাড়ি এলাকার কয়েক হাজার একর জমির মূল্য, যা ওদেরকে দিয়ে গেছেন মহান পাদ্রোনি। মরার আগে বলে গেছেন তিনি—যদি কোনোদিন সত্যি ঘটনা ফাঁস হয়, তা হলে সব হারাবে ওরা, সরকার কেড়ে নেবে পুরো সম্পত্তি। তাই দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে বাঁচতে চাইলে এ-মূল্য চুকাতেই হবে ওদেরকে। যা ঘটে গেছে আজ রাতে, তা সীমাবদ্ধ রাখতে হবে নিজেদের মাঝে; কিছুতেই বাইরের কাউকে জানতে দেয়া যাবে না ওদের গোমর।

‘ভাষণে কাজ হলো, নীরব হয়ে গেল লোকজন। কোদাল দিয়ে গর্তের ভিতর মাটি ফেলতে শুরু করল ওরা। অন্ধকারে সাবধানে হাত নাড়লাম আমি, মুখের উপর মাটি পড়লেই একটু একটু করে সরিয়ে দিতে লাগলাম, যাতে শ্বাস নিতে পারি। শেষ পর্যন্ত নাক বরাবর সামান্য একটা ফুটো রাখতে পারলাম পুরো গর্ত ভরে যাবার পরও। সারা শরীর মাটিচাপা পড়ার পরেও বেঁচে গেলাম এই কারণে।

‘কবরের ভিতরে কয়েক ঘণ্টা রইলাম আমি, তারপর কেঁচোর মত মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে। শরীরে ঠাণ্ডা বাতাসের স্পর্শ পেয়ে কেঁদে ফেললাম হু হু করে, বিশ্বাস হতে চাইছিল না—অমন একটা নরকযজ্ঞের পরও বেঁচে আছি। আশপাশে তাকালাম, কেউ নেই কোথাও। গর্তটা মাটিচাপা দেবার পর চলে গেছে সবাই। উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলাম উদ্দেশ্যহীনভাবে বেঁচে আছি বটে, কিন্তু জীবন তছনছ হয়ে গেছে আমার। পাহাড়ি এলাকায় আর ফিরে যাবার উপায় নেই, গেলেই খুন হয়ে যাব।

‘কী করব, ভেবে পেলাম না। উপকূলের দিকে যেতে পারি, পাদ্রোনির বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব আছেন ওদিকে; কিন্তু লাভ কী? আমার কথা বিশ্বাস করবেন কেন তাঁরা? কেন আশ্রয় দেবেন? সামান্য এক রক্ষিতা আমি, এতদিন পাদ্রোনির সহচরী ছিলাম বলে অবাধ চলাফেরা করতে পেরেছি, এখন হয়তো ঢুকতেই পারব না ওসব বাড়িতে।

‘হঠাৎ মনে পড়ে গেল জোনজা-র এক এস্টেটের আস্তাবল রক্ষকের কথা। খুব ভালমানুষ; যতবার ওখানে গেছি, তার কাছ থেকে ভাল ব্যবহার পেয়েছি আমি। কখনও খারাপ দৃষ্টিতে তাকায়নি আমার দিকে, বরং সমীহ এবং নীরব ভালবাসা প্রকাশ পেতে দেখেছি তার চোখে। সাতপাঁচ ভেবে বুঝতে পারলাম, ওই লোকই আমার একমাত্র ভরসা। তাই সে-দিকে যাত্রা করলাম।

‘এরপরের ঘটনা আর বিস্তারিত শোনানোর প্রয়োজন মনে করছি না। সংক্ষেপে শুধু এটুকু জানাই, জোনজা-র ওই আস্তাবল রক্ষক আশ্রয় দেয় আমাকে, তাকেই কিছুদিন পরে বিয়ে করি আমি। আমার পেটে পাদ্রোনির সন্তান ছিল, কিন্তু তাই বলে কোনোদিন আমার অমর্যাদা করেনি সে। বরং অন্যের সন্তানকে নিজের সন্তানের মত ভালবেসেছে, সারাজীবন বুকে আগলে রেখেছে আমাকে আর আমার বাচ্চাকে। ভেসকোভাতো-র উত্তরে চলে গিয়েছিলাম আমরা, পাহাড়ি লোকজনের নাগালের বাইরে, সেখানেই কাটিয়েছি বহু বছর। বুকের ভিতর চাপা দিয়ে রেখেছি ভয়াল সেই রাতের কথা, আমার স্বামী ছাড়া কোনোদিন কাউকে খুলে বলিনি সে-সব। ও-ও ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পেরে গোপন রেখেছিল সবকিছু। আসলে… মুখ খুলে লাভ-ও ছিল না কোনও। যারা মারা গেছে, তাদেরকে তো আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। আর দুই খুনি… অচেনা সেই কোচোয়ান আর রাখালবালক… দু’জনেই পালিয়ে গিয়েছিল কর্সিকা ছেড়ে।

‘যা হোক, এই-ই ছিল আমার কাহিনি। যা জানি, তার সবই খুলে বলেছি তোমাদেরকে। এখন যদি কোনও প্রশ্ন থাকে, করতে পারো। তবে মনে হয় না নতুন আর কিছু জানাতে পারব তোমাদেরকে।‘

.

মারিয়া মাযোলার কথা শেষ হলে নীরবতা নেমে এল কামরায়। কিছুক্ষণ কোনও কথা বলল না কেউ, তারপর উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। খালি হয়ে যাওয়া কাপে চা ঢালতে ঢালতে বিড়বিড় করল, ‘পার নস্ত্রো সার্কোলো!’ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল রানার দিকে ‘পঁচাত্তর বছর পেরিয়ে গেছে, তাও ওই গণহত্যার কাহিনি লুকানোর জন্য মানুষ খুন করতে চাইছে পাহাড়ি লোকেরা!’

‘পার্সোনা?’ বলে উঠলেন বৃদ্ধা। বাংলায় কথা বলেছে কুয়াশা, সেটা বুঝতে পারেননি।

‘দুঃখিত,’ বলে তাঁর দিকে ফিরল কুয়াশা। ইটালিয়ানে পুনরাবৃত্তি করল কথাটার।

‘এতে অবাক হবার কিছু নেই,’ বললেন বৃদ্ধা। ‘বংশ-পরম্পরায় ভিলা বারেমির গোমর রক্ষা করছে ওরা। একেবারে অশিক্ষিত ওরা, জমি হারানোর ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছে পুরো দুটো প্রজন্ম ধরে। বাকি দুনিয়ার কাছ থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে এ-কারণেই।’

‘ওই জমি কেড়ে নেবার মত কোনও আইন আছে বলে মনে হয় না আমার,’ বলল রানা। ‘কোনোকালেই ছিল না। কাউকে খুন করেনি ওরা, শুধু লাশ লুকিয়ে ফেলেছে—এটুকুই ওদের অপরাধ। গণহত্যার তথ্য গোপন করায় বড়জোর দু’চারজনের জেল হতে পারে… মানে, যদি কেউ এখনও বেঁচে থাকে আর কী।’

‘কী বলছ! এতবড় একটা ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছে ওরা… ঈশ্বরের চোখে ওটা কতবড় অপরাধ, তা জানো?’

‘সেটা ভিন্ন আদালত,’ কাঁধ ঝাঁকাল রানা। প্রসঙ্গ বদলাল। ‘আপনি এখানে ফিরে এসেছেন কবে?’

‘অনেকদিন পর। একেবারে বুড়ো হয়ে… চোখের দৃষ্টি চলে যাবার পর।’

‘কেন ফিরেছেন?’

ফেরার মত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল বলে।’

‘ওটা কোনও জবাব হলো না। আপনাকে আরেকটু ব্যাখ্যা করতে হবে। আপনাকে ওরা ফিরতে দিল কেন?’

‘ভুল একটা ধারণা প্রচলিত আছে এলাকাবাসীর ভিতর। ওরা মনে করে, পাদ্রোনি আমাকে বাঁচতে দিয়েছিলেন—খুনোখুনি শুরু হবার আগেই আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দূরে। আমাকে ওরা ভয় পায়… ঘৃণা করে। নিজেরা বলাবলি করে—আমাকে আসলে বাঁচিয়ে রেখেছেন স্বয়ং ঈশ্বর… ওদের পাপের স্মারক হিসেবে। ভিলা বারেমির অন্ধ রক্ষিতার মাধ্যমে তিনি ওদেরকে সেই কালো রাতের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। বুঝতে পারছ ব্যাপারটা? সর্বশক্তিমানের আশীর্বাদপুষ্ট মানুষ বলে ভাবে ওরা আমাকে … তাই কোনও ক্ষতি করার সাহস পায় না। এলাকায় ফিরতে চাইলে বাধা দেবে কীভাবে?

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কুয়াশা জিজ্ঞেস করল, ‘কতটা ভয় করে ওরা আপনাকে? এই যে… ওদের গোমর ফাঁস করে দিলেন আমাদের কাছে… এটা জানার পরেও কি চুপ করে থাকবে ওরা?

‘মনে হয় না। তবে ভয়ের কিছু নেই। তোমরা যে আমার কাছে এসেছ, তা জানার উপায় নেই ওদের। জানলেই বা কী এসে-যায়? এমনিতেই আমার আয়ু ফুরিয়ে এসেছে, মৃত্যুকে দুটো : দিন এগিয়ে আনার চেয়ে বেশি কিছু তো করার ক্ষমতা নেই ওদের।

‘এজন্যেই এত বছর পর মুখ খুললেন?’

হ্যাঁ। মরতে চলেছি আমি, যাবার আগে কাউকে সব খুলে বলার ইচ্ছে ছিল। হয়তো কোনও বিচার পাবে না ভিলা বারেমিতে খুন হওয়া হতভাগ্য মানুষগুলো, কিন্তু বিবেকের তাড়না অগ্রাহ্য করতে পারছিলাম না। তাই গাঁয়ের বাজার থেকে ফিরে এসে সোনিয়া যখন জানাল, একজন মানুষ পাদ্রোনির ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছে নীচে, তখন ওকে তাড়াতাড়ি পাঠালাম তাকে ডেকে আনার জন্য।

‘কেন… তা বলেননি? এ-কাহিনি তো ওর মাধ্যমেও ফাঁস করতে পারতেন দুনিয়ার সামনে।

‘না! প্রশ্নই ওঠে না!’ গলা একটু চড়ে গেল মারিয়া-র। ‘বাচ্চা মেয়ে… ভিলা বারেমির গোমর জানার সঙ্গে সঙ্গে ওর একগাদা শত্রু সৃষ্টি হয়ে যাবে। কীভাবে বাঁচাবে ও নিজেকে? কথা দাও, সেনিয়র, কিছুতেই আমার নাতনিকে এর সঙ্গে জড়াবে না তোমরা।’

‘একটুও চিন্তা করবেন না,’ আশ্বস্ত করার সুরে বলল কুয়াশা। ‘সোনিয়াকে বিপদে ফেলার কোনও ইচ্ছে নেই আমাদের। সেজন্যেই কাল রাতে ওকে কামরা থেকে চলে যাবার জন্য বলেছি।’

‘ধন্যবাদ,’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন বৃদ্ধা।

‘কিন্তু এত বছর পর এ-সব কথা আমাদেরকে খুলে বললেন কেন?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘শুধুই কি বিবেকের তাড়না? নাকি আরও কিছু আশা করছেন আপনি?

‘কী জানি!’ কাঁধ ঝাঁকালেন মারিয়া। ‘হয়তো চাইছি, লোকে কৌতূহলী হয়ে উঠুক। উত্তাল ঢেউয়ের তলায় উঁকি দিয়ে দেখুক, কীসে অশান্ত করে তুলছে পানিকে!

কাউন্সিল অভ ফেনিস?’ ভুরু কোঁচকাল কুয়াশা। ‘এখনও কীভাবে টিকে থাকে ওরা? কাউন্সিলের সদস্যরা যদি বেঁচে থাকেও… থাকার সম্ভাবনা খুবই কম… একেকজনের বয়স একশোর উপরে হয়ে যাবে।’

‘ঠিক একই কথা আমিও ভেবেছি,’ মাথা দোলালেন মারিয়া। ‘কিন্তু তারপরেও ওদের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারছি না। রেডিওতে নিয়মিত খবর শুনি আমি, সেনিয়র। টের পাই, পাদ্রোনির ভবিষ্যদ্বাণী ফলতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে পুরো পৃথিবী তলিয়ে যাচ্ছে অশান্তি আর বিশৃঙ্খলার অতলে… যেমনটা তিনি চেয়েছিলেন। এ কিছুতেই কাকতালীয় হতে পারে না, নিশ্চয়ই ফেনিসের হাত আছে। কিন্তু কীভাবে? ভেবে ভেবে হয়রান হচ্ছি, এমন অবস্থায় রেডিওতে একদিন একটা কণ্ঠ শুনলাম… শীতল কণ্ঠ, ঝোড়ো বাতাসের চেয়ে ভয়ানক এক ‘কণ্ঠ…. সে-কণ্ঠ আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল বহু বছর আগে—ভিলা বারেমির সেই ঝুলবারান্দায়! মনে পড়ে গেল পাদ্রোনি কী বলেছিলেন। তোমরা, আর তোমাদের পরের প্রজন্মগুলো কাউন্সিল অভ ফেনিসের মাধ্যমে সে-কাজ করবে, যা আমার পক্ষে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়!’

দম নেবার জন্য একটু থামলেন বৃদ্ধা। উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন তিনি। সুস্থির হয়ে বললেন, ‘মানেটা বুঝতে পারছ তোমরা? আসল কাউন্সিল এখন আর নেই, কিন্তু তাদের পরের প্রজন্ম আছে। ওরাই চালিয়ে যাচ্ছে পাদ্রোনির কাজ… আর ওদেরকে নেতৃত্ব দিচ্ছে সেই মানুষ, যার কণ্ঠ ঝোড়ো বাতাসের চেয়ে ভয়ঙ্কর!’

আবারও থেমে গেলেন তিনি। শীর্ণ হাত বাড়িয়ে পাশ থেকে টেনে নিলেন নিজের ছড়ি, সেটায় ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘তালিকা… তালিকাটা তোমাদের দরকার হবে, সেনিয়র!’

‘কীসের তালিকা?’ জানতে চাইল রানা।

‘ভিলা বারেমির অতিথিদের তালিকা। ভয়াল সে-রাতে আমার – গাউনের পকেটে ছিল ওটা, অতিথিদের নাম-ঠিকানা মুখস্থ করার জন্য রেখেছিলাম সঙ্গে… পাদ্রোনিকে খুশি করবার জন্য। আজও ওটা আছে আমার কাছে, নষ্ট হতে দিইনি।’ মেঝেতে ছড়ি ঠুকে ঠুকে দেয়ালের একটা শেলফের সামনে গেলেন বৃদ্ধা। নীচের তাক হাতড়ে একটা বয়াম নামালেন। সেটার মুখ খুলে ভিতর থেকে বের করে আনলেন এক টুকরো কাগজ-বয়সের ভারে হলুদ হয়ে গেছে। বাড়িয়ে ধরলেন রানা-কুয়াশার দিকে। ‘এই নাও… এটা আজ থেকে তোমাদের। উনিশশো ছত্রিশের চৌঠা এপ্রিলে কারা এসেছিল আমার পাদ্রোনির সঙ্গে দেখা করতে, তা জানতে পারবে এ-থেকে।’

তড়াক করে লাফিয়ে উঠল দু’জনে। প্রায় ছুটে এসে কাগজটা  নিল রানা। বলল, ‘দারুণ একটা কাজ করেছেন, ম্যা’ম।’ ভাঁজ খুলে ভিতরের লেখাগুলো পড়ল ও, সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে গেল। ‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল কুয়াশা। ‘নাম নেই ওতে?’

‘আছে,’ বলল রানা। ‘স্প্যানিয়ার্ডের নামটা বাদ দেয়া যেতে পারে, কিন্তু বাকি চারটার মধ্যে দুটো নাম খুবই পরিচিত। এত বিখ্যাত মানুষ এঁরা… বিশ্বাস করা মুশকিল! ‘

‘কই, দেখি?’

কুয়াশার হাতে কাগজটা দিল রানা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ওর কপালেও ভ্রূকুটি দেখা দিল। বলল, ‘অ্যানালাইজ করে দেখা দরকার—নামগুলো সত্যিই পঁচাত্তর বছর আগে লেখা কি না।’

আমার তো মনে হচ্ছে না এতে কোনও কারসাজি আছে।’

‘তাই বলে এমন দুজন মানুষ…’

‘কোনও সমস্যা, সেনিয়র?’ বলে উঠলেন মারিয়া।

‘না, না, সমস্যা না,’ তাড়াতাড়ি বলল রানা। ‘আসলে… এর মধ্যে দুটো নাম আমরা চিনতে পারছি। এঁরা খুবই বিখ্যাত মানুষ।’

‘ ‘কিন্তু এদের কেউই আসল লোক নয়, সেনিয়র। সব তো বলেছি তোমাদেরকে—এরা আমার পাদ্রোনির শিষ্য। কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকারী অন্য আরেকজন! সে-ই নিয়ন্ত্রণ করছে শিষ্যদেরকে… পথ দেখাচ্ছে।’

‘কী বলছেন এসব! কে সে?’

জবাব দেবার সুযোগ পেলেন না মারিয়া। তার আগেই কুকুরটা গরগর করে উঠল। থমকে গেলেন তিনি। বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াল কুকুরটা, অস্থির ভঙ্গিতে ছুটে গেল দরজার কাছে, গরগরানি থামেনি।

‘দরজা খোলো!’ চাপা গলায় হুকুম দিলেন বৃদ্ধা। ‘তারপর ডাকো আমার নাতনিকে। জলদি!’

‘ক্… কী হয়েছে?’ রানা বিস্মিত।

‘একদল লোক আসছে এদিকে! ঢাল বেয়ে উঠে আসছে ওরা। উচেলো ওদের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে!’

দরজার দিকে ছুটে গেল কুয়াশা।

‘কতদূরে ওরা?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘বেশিদূরে না। এসে পড়বে খুব শীঘ্রি।’ বললেন বৃদ্ধা। দরজা খুলে ডাক দিল কুয়াশা। ‘সোনিয়া! তাড়াতাড়ি এখানে এসো!’

গরগরানি বেড়ে গেছে উচেলোর, রীতিমত দাঁত খিঁচাচ্ছে এখন। টান টান করে রেখেছে শরীর, শত্রুকে দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিচেনের কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল রানা, একটা কাঁচা লেটুস পাতা নিল সবজির পাত্র থেকে, ওটাকে ভাঁজ করে ভিতরে লুকিয়ে ফেলল হলদেটে কাগজটা।

‘এটা আমার পকেটে রাখছি, কুয়াশাকে বলল ও।

‘রাখো,’ কুয়াশা বলল। ‘নামগুলো মুখস্থ করে নিয়েছি আমি।’ দৌড়ে খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকল সোনিয়া। ডাক শুনেই ছুট লাগিয়েছে, ফিল্ড জ্যাকেটের বোতাম লাগাতে পারেনি ঠিকমত। তবে ক্রুশো, শটগানটা আনতে ভোলেনি। জ্যাকেটের দু’পাশের পকেটের ভিতর বেঢপভাবে ফুলে আছে রানা-কুয়াশার পিস্তল।

‘কী ব্যাপার?’ ভিতরে ঢুকেই জানতে চাইল সে।

‘তোমার দাদী বলছে, একদল মানুষ আসছে এখানে। কুকুরটা ওদের আওয়াজ শুনতে পেয়েছে।’ বলল কুয়াশা।

‘ঢাল ধরে আসছে ওরা,’ যোগ করলেন মারিয়া। ‘বড়জোর নয়শ’ কদম, তার রেশি না।’

 ‘কেন আসছে এখানে?’ সোনিয়া কিছু বুঝতে পারছে না। ‘কী চায়?’

‘গতকাল ওরা তোকে দেখতে পেয়েছিল? বা উচেলোকে?’

‘দেখেছে তো নিশ্চয়ই, কিন্তু ‘আমি কোনও কথা বলিনি ওদের কাজে বাধাও দিইনি। তারপরেও কেন…

‘এর আগের দিনও দেখেছিল,তোকে, তাই না?’

‘হ্যাঁ। গাঁয়ের বাজারে গিয়েছিলাম জিনিসপত্র কিনতে।’

‘ওখানেই খটকা লেগেছে ওদের,’ বললেন মারিয়া। ‘পর পর দু’দিন কেন গিয়েছিস নীচে? তা ছাড়া ওরা পাহাড়ি মানুষ… ট্র্যাকিঙে ওস্তাদ। নিশ্চয়ই মাটিতে তোদের তিনজনের পায়ের ছাপ দেখেছে। না, আর ঝুঁকি নেয়া যায় না। চলে যেতে হবে তোদের সবাইকে! দুই বিদেশি… সেইসঙ্গে তোকেও!’

‘না, দাদী!’ প্রতিবাদ করল সোনিয়া। ‘তোমাকে ফেলে যাব না আমি। আসতে দাও ওদেরকে। বলব, বিদেশিরা আমার পিছু নিয়েছিল। এখানে এসেছিল বটে, কিন্তু তাড়িয়ে দিয়েছি আমরা ওদেরকে। কোনও কথা বলিনি।’

ওর কথা না শোনার ভান করলেন বৃদ্ধা। রানা-কুয়াশার দিকে ফিরলেন। ‘যা খুঁজছিলে, তা পেয়ে গেছ। এখন আমার অনুরোধ রাখো। আমার নাতনিকে নিয়ে পালাও এখান থেকে।’

‘আর আপনি?’ বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করল কুয়াশা।

‘আমার জন্য ভেবো না। আমাকে ভয় পায় ওরা, কোনও ক্ষতি করবার সাহস পাবে না।’

মিথ্যে বলছেন বৃদ্ধা, কথা শুনেই বুঝতে পারল রানা-কুয়াশা দ্বিধায় পড়ে গেল দু’জনে।

‘প্লিজ… আমার কথা শোনো,’ অনুনয় করলেন মারিয়া। ‘আমার নাতনিকে বাঁচাও! সময় তো আমার এমনিতেই ফুরিয়ে এসেছে, কিন্তু ওর সামনে সারাটা জীবন পড়ে আছে। ‘কী করবে?’ রানাকে জিজ্ঞেস করল কুয়াশা।

‘ওঁর কথা শোনা আমাদের কর্তব্য,’ বলল রানা।

পরমুহূর্তে ছোঁ মেরে শটগানটা কেড়ে নিল সোনিয়ার হাত থেকে।

‘না!’ চেঁচিয়ে উঠল সোনিয়া। ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল রানার উপরে, পারল না পিছন থেকে কুয়াশা ওকে জাপটে ধরে ফেলায় জ্যাকেটের পকেট থেকে নিজেদের পিস্তলদুটোও বের করে নিল রানা। ‘কী করছ তোমরা!’

‘এ-সময়ে তোমার হাতে বন্দুক-পিস্তল থাকা ঠিক না,’ রানা বলল। ‘ঝামেলা কোরো না। দাদীর কথা শোনো। চলো আমাদের সঙ্গে।’

দরজার বাইরে গিয়ে ঘেউ ঘেউ শুরু করল উচেলো। দূর থেকে ভেসে আসছে মানুষের উত্তেজিত হৈচৈ। চেঁচামেচি করে ফার্মহাউসের উপর হামলা করার কথা বলছে তারা।

‘যাও!’ চেঁচালেন মারিয়া।

‘এগোও!’ ধাক্কা দিয়ে সোনিয়াকে হাঁটতে বাধ্য করল কুয়াশা। ‘ওরা চলে যাবার পর আবার ফিরে আসব আমরা,’ বৃদ্ধাকে বলল রানা।

‘দরকার নেই, বাছা,’ বললেন মারিয়া মাযোলা, ‘আমার কথা শেষ। নামের তালিকাও দিয়েছি তোমাদেরকে। ওটার সাহায্যেই পাদ্রোনির শিষ্যদেরকে খুঁজে বের করতে পারবে তোমরা। তবে হ্যাঁ… যদি ফেনিসের শিকড় খুঁজে পেতে চাও, তা হলে শিষ্যদের পথ-প্রদর্শককেও খুঁজে বের করতে হবে তোমাদের।’

‘কার কথা বলছেন?’

‘ওই যে, যার কণ্ঠ ঝোড়ো বাতাসের চেয়ে ভয়ঙ্কর! বহু বছর আগে ভিলার উত্তরের বারান্দায় শুনেছিলাম সে-কণ্ঠ… আবার শুনেছি কিছুদিন আগে। বয়স বেড়েছে, স্বর বদলেছে, কিন্তু বদলায়নি কথা বলার ভঙ্গি। আজও ওই কণ্ঠ সে-রাতের মতই নিষ্ঠুর… কর্তত্ব-ভরা!’

‘আপনি কি বলতে চাইছেন…’

’হ্যাঁ,’ বাধা দিয়ে বললেন অন্ধ মহিলা, ‘আমি রাখালবালকের কথা বলছি। আজও বেঁচে আছে সে। সে-ই চালাচ্ছে পাদ্রোনির শিষ্যদেরকে। যাও, খুঁজে বের করো ওকে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *