সেই কুয়াশা ১.৭

সাত

বয়স্কা মেইড রুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে খটকার কারণ ধরতে পারল রানা। মহিলার চোখ। সাদাসিধে হোটেল কর্মচারীর দৃষ্টি নেই ওতে, অন্যরকম বুদ্ধিমত্তার ছাপ ফুটে আছে। সেইসঙ্গে মিশে আছে সামান্য ভীতি এবং কৌতূহল। কামরায় তোকার ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছে তার ভিতরে অভিনেত্রী নাকি?

‘বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত, স্যর, রানার ক্লান্ত চেহারা আর রুমের দিকে তাকাল মহিলা। হাঁটতে শুরু করল বাথরুমের দিকে। ‘দু’মিনিটের বেশি নেব না আমি।’

কাঁচা অভিনয়। আইরিশ টান লুকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে  সে, ব্যর্থ হচ্ছে হাস্যকরভাবে। পিছন থেকে হাঁটার ভঙ্গিটা জরিপ করল রানা। না, বয়সের সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না। জীবনের কষাঘাতে জর্জরিত বৃদ্ধার পদক্ষেপ নয়, বরং অনেকটাই চপল বলা চলে। সন্দেহ নেই, এ-বয়সেও নিয়মিত ব্যায়াম করে মহিলা।

কুয়াশার পছন্দ দেখে মুচকি হাসল রানা। বড্ড কাঁচা কাজ করেছে। বোঝাই যাচ্ছে, ভুয়া মেইড। এরচেয়ে সত্যিকার একজনকে ভাড়া করলেই বেশি ভাল করত। অন্তত এভাবে ধরা পড়ে যেত না সে।

‘নতুন তোয়ালে দিয়ে গেলাম, স্যর,’ খানিক পর বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল মহিলা। দরজার দিকে ফিরে যাচ্ছে। ‘বিরক্ত করবার জন্য আরেকবার দুঃখপ্রকাশ করছি।’

হাতের মৃদু ইশারায় তাকে থামাল রানা। সাধারণ মেইড হলে এই ইশারার অর্থ বুঝত না।

‘স্যর?’ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল মহিলা। চোখের মণিতে সতর্কতার ছাপ!

‘কিছু মনে করবেন না,’ হালকা গলায় বলল রানা। ‘আপনি আইরিশ, তাই না? আয়ারল্যান্ডের ঠিক কোথায় আপনার বাড়ি? উচ্চারণটা ঠিক ধরতে পারছি না। উইলো কাউন্টিতে নাকি?’

‘জী, স্যর।’ নিচু গলায় বলল মেইড।

‘দক্ষিণের কাউন্টি ওটা, ঠিক?’

‘হ্যাঁ, স্যর,’ গলার স্বর খাদে নেমে গেছে মহিলার। বাঁ হাতে আঁকড়ে ধরেছে দরজার নব।

‘বাড়তি একটা তোয়ালে দেয়া যাবে?’ বলল রানা। ‘বাথরুমে না, বিছানার উপরে রেখে দিন।’

‘ক্… কী?’ একটু থতমত খেয়ে গেল মহিলা। পরমুহূর্তে সামলাল নিজেকে। ‘হ্যাঁ, স্যর… নিশ্চয়ই।’ তোয়ালে নিয়ে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে।

দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল রানা। ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। বলল, ‘ও.কে., ম্যাডাম। লুকোচুরির খেলা শেষ। তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে আমার…’

ঘুরতে শুরু করেছিল ও, চমকে উঠল পিছনের শব্দ শুনে। কাপড়ের মৃদু খসখসানি, তার সঙ্গে বাতাসে শিস কাটার আওয়াজ। ঝট্ করে নড়ে উঠল রানা, পুরোপুরি রক্ষা পেল না তাতে, ঘাড়ের কাছটায় চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল, কাঁধ ভেসে যেতে শুরু করল রক্তে। ঘাতক বুলেট ওর চামড়া চিরে দিয়েছে।

পাগলের মত হাত চালাল রানা। নাগালের মধ্যে একটা ল্যাম্প পেয়ে সেটা ছুঁড়ে দিল বিছানার দিকে।

সরে গিয়ে ল্যাম্পটাকে ফাঁকি দিল মহিলা। এতক্ষণে তাকে ঠিকমত দেখতে পেল রানা। হাত থেকে তোয়ালের স্তূপ ফেলে নিয়েছে, সেখানে শোভা পাচ্ছে চকচকে একটা সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল। মুখ থেকে খসে পড়েছে ভালমানুষির মুখোশ, বুনো চেহারা আর দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে প্রকাশ পাচ্ছে—এ একজন প্রফেশনাল খুনি।

মেঝেতে ঝাঁপ দিল রানা। সেন্টার-টেবিলের পিছনে গিয়ে আছড়ে পড়ল। উপর দিয়ে ছুটে গেল দ্বিতীয় গুলি। সিগ-সাওয়ারের জন্য কোমরের পিছনটায় হাত দিল ও… নেই! ঝাঁপ দেবার সময় পড়ে গেছে বেল্টের ফাঁক থেকে। এখন ওটা নাগালের বাইরে। এ-নিয়ে মাতম করবার সময় নেই, সেন্টার-টেবিলটার একটা পায়া ধরে উঠে দাঁড়াল ও, বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে ছুটে গেল প্রতিপক্ষের দিকে।

দ্রুত দুটো শট নিল মহিলা, ঘুরন্ত টেবিলে আঘাত করে চলটা ওঠাল বুলেট, রানার গায়ে লাগল না। তৃতীয়বার গুলি করবার  সুযোগ পেল না সে, রানা এসে পড়েছে গায়ের উপর। টেবিল দিয়ে সজোরে আঘাত করল ও। দেয়ালের উপর ছিটকে পড়ল মহিলা। টেবিল দিয়ে ঠেসে ধরল রানা তাকে দেয়ালের সঙ্গে।

‘বাস্টার্ড!’ ব্যথায় গালি দিয়ে উঠল খুনে বুড়ি। হাত থেকে খসে পড়ল পিস্তল।

টেবিল দিয়ে মহিলার হাঁটুর নীচে আঘাত করল রানা, ক্ষণিকের জন্য অচল করে ফেলল। তারপর হাত বাড়াল পড়ে যাওয়া পিস্তলটা তুলে নিতে। অস্ত্রটা হাতে এলে আবার ফিরল প্রতিপক্ষের দিকে, চুল মুঠো করে ধরে হ্যাঁচকা টানে মহিলাকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করল দেয়ালের পাশ থেকে।

টান খেয়ে খুলে এল লালরঙের উইগ, তলা থেকে উঁকি দিল খোঁপা বাঁধা কাঁচাপাকা চুল। পরচুলার জন্য তৈরি ছিল না রানা, তাল হারিয়ে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ খেলে গেল মহিলার শরীরে, জামার ভিতর থেকে বের করে আনল ছুরি-একটা সরু স্টিলেটো। এ-ধরনের অস্ত্রের সঙ্গে পরিচয় আছে রানার- ক্লোজ কমব্যাটে আগ্নেয়াস্ত্রের চেয়ে অনেক বেশি মারাত্মক, ফলায় বিধ মাখানো থাকলে তো আরও। প্রাণঘাতী আঘাতের প্রয়োজন নেই, সামান্য একটা আঁচড়ই যথেষ্ট; নিমেষে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হবে শরীর, কয়েক সেকেণ্ড পর ঢলে পড়বে মৃত্যুর কোলে।

ছুরি বাগিয়ে রানার দিকে ঝাঁপ দিল মহিলা, অভিজ্ঞ নাইফ-ফাইটারের ভঙ্গিতে। আলতো পায়ে এক কদম পিছিয়ে গেল রানা, ছুরি ধরা হাতটা নাগালের মধ্যে আসতেই পিস্তলের বাট দিয়ে সজোরে আঘাত করল কবজির উপরে। ব্যথায় ককিয়ে উঠল মহিলা। থেমে দাঁড়াল, কিন্তু হাত থেকে পড়ল না ছুরি।

‘থামো!’ চেঁচাল রানা। আরেকটু পিছিয়ে গিয়ে পিস্তল তাক করল মহিলার কপাল বরাবর। ‘চারটে শট নিয়েছ। আরও দুটো বুলেট রয়ে গেছে ম্যাগাজিনে। না থামলে খুন হয়ে যাবে!’

হাঁপাতে হাঁপাতে ছুরি নামিয়ে ফেলল মহিলা। দাঁড়িয়ে রইল স্থির, বাকরুদ্ধ অবস্থায়। অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে প্রতিপক্ষের দিকে। রানা আন্দাজ করল, এ-ধরনের পরিস্থিতিতে আগে কখনও পড়েনি মহিলা। সবসময় জয় হয়েছে তার।

‘কে তুমি?’ জিজ্ঞেস করল রানা। বাঁ হাত বাড়িয়ে বিছানা থেকে তুলে নিল তোয়ালে। চেপে ধরল ঘাড়ের ক্ষতের উপর।

‘আমার পরিচয় তুমি কোনোদিনই জানতে পারবে না, বাছা, তাচ্ছিল্যের সুরে বলল মহিলা।

‘তোমার ঠিকুজি-কোষ্ঠি জানার কোনও ইচ্ছে আমার নেই,’ বলল রানা। ‘এমনিতেই জিজ্ঞেস করেছি ওটা। কুয়াশা কোথায়?’

‘কে?’

‘কুয়াশা… মানে যে-লোক তোমাকে ভাড়া করেছে।’

‘কেউ আমাকে ভাড়া করেনি। এখানে এসেছি কৃতজ্ঞতার প্রতিদান দিতে। যার কারণে এসেছি, তার নাম কুয়াশা হলেও হতে পারে। বহু নাম ব্যবহার করে সে। কিন্তু এ-মুহূর্তে ওকে কোথায় পাওয়া যাবে, তা জানি না আমি।’

‘বিশ্বাস করি না। যোগাযোগ আছে তোমাদের। তুমি জিনিস বটে একটা! এভাবে লড়তে শিখেছ কোথায়? কবে?’

‘তোমার জন্মের আগে, বাছা! বেলসেন, ডাচাউ… এমন শত শত ক্যাম্পে। যুদ্ধক্ষেত্রে। আমি একা নই, আরও অনেকেই শিখে নিয়েছে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হয়… কীভাবে প্রতিশোধ নিতে হয়!’

‘সর্বনাশ!’ বিড় বিড় করল রানা। আলুফাস-এর সদস্য এই মহিলা। আইরিশ যুদ্ধের ফসল এক গোপন বাহিনী ওটা। যুদ্ধকালীন সময়ে তরুণী, যুবতী মেয়েদেরকে উঠিয়ে নিয়ে যেত সৈন্যরা; বিভিন্ন ক্যাম্পে বেশ্যার মত ব্যবহার করা হতো ওদেরকে, চালানো হতো অকথ্য নির্যাতন। সেই মেয়েরাই পালিয়ে গিয়ে আলুফাস-বাহিনী গড়ে তোলে। মানবহত্যার ট্রেইনিং নিয়ে যোগ দেয় যুদ্ধে—প্রতিশোধের নেশায়! কুয়াশা ওই বাহিনীর একজন পুরনো সদস্যকে রিক্রুট করেছে! পাগল নাকি? এসব মেয়েদের মধ্যে সাধারণ বিচারবুদ্ধি, কিংবা মানবিক অনুভূতির কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। গোটা পুরুষজাতিকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে এরা, পুরুষ হয়ে এদের কাউকে নিয়ন্ত্রণ করার চিন্তা একমাত্র বোকারাই করতে পারে।

‘শোনো,’ বলল রানা। তোমার সঙ্গে আমার কোনও শত্রুতা নেই। শুধু কুয়াশাকে চাই আমি। আর কিছু না। যদি আমার কথা শোনো, যেতে দেব তোমাকে। কী বলো, রাজি আছ প্রস্তাবে?’

‘কী করতে হবে আমাকে?’ জিজ্ঞেস করল মহিলা।

‘ওর সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করছ তুমি?’

দরজার দিকে ইশারা করল মহিলা। ‘ওপাশের কামরায় ফোন করে ও।

‘কতক্ষণ পর পর?’

‘ঠিক নেই। কখনও দশ মিনিট, কখনও আধঘণ্টা। তবে করবে যে, তাতে সন্দেহ নেই।’

‘গুড।‘

ওকে · হোটেলের ভিতরে ডেকে আনবে তুমি। ডানদিকে সরে এসো। ছুরিটা ফেলে দাও বিছানার উপর।’

‘তুমি আমাকে গুলি করবে না তো?’ সন্দেহ ঘনাল মহিলার চোখে। কারণ, সে-ও চিনেছে রানাকে নিষ্ঠুর খুনি হিসাবে।

‘করতে চাইলে এতক্ষণে করে দিতে পারতাম,’ নরম গলায় বলল রানা। বিশ্বাস অর্জন করতে চাইছে মহিলার। ‘ভয় পেয়ো না। আমার কথা শোনো, কোনও ক্ষতি হবে না তোমার। ছুরিটা ফেলে দাও, তারপর ওপাশের কামরায় যাব আমরা

হাঁটতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। তুমি সম্ভবত আমার পা ভেঙে দিয়েছ।’

‘আমি সাহায্য করছি।’ তোয়ালেটা নামিয়ে ফেলে মহিলার দিকে এগিয়ে গেল রানা। হাত বাড়িয়ে দিল। ‘আমার হাত ধরো।’

ব্যথায় মুখ কুঁচকে বাঁ পা সামনে বাড়াল মহিলা, হাত ধরার ভান করল। পরমুহূর্তে বদলে গেল সবকিছু। শরীরে যেন বিদ্যুৎপ্রবাহ ঘটল তার, নড়ে উঠল বিস্ময়কর দ্রুততায়। চেহারায় ফিরে এল বুনো ভাবটা, দৃষ্টিতে উন্মাদনা।

ভয়ানক গতিতে ছুরির ফলাটা ছুটে এল রানার পেটের দিকে!

.

নিগ্রো খুনিকে অনুসরণ করে এলিভেটরে উঠে এল কুয়াশা। আশপাশে বাঁকি তিনজনকে দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত নিজ নিজ পজিশনে চলে গেছে তারা।

আরও দু’জন মানুষ উঠেছে এলিভেটরে। আমেরিকান একজোড়া কপোত-কপোতী; পরনে দামি পোশাক, সারাক্ষণ জড়িয়ে ধরে রেখেছে পরস্পরকে। দুজনের আঙুলেই বিয়ের আংটি। নব-বিবাহিত 1

নিগ্রো লোকটা একটু জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছে এলিভেটরের পিছনের কোনায়, মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে দেয়ালের প্যানেলের দিকে। চেহারা দেখতে দিতে চায় না কাউকে। খুনোখুনির পরে প্রত্যক্ষদর্শীরা যেন ঠিকমত চেহারার বিবরণ দিতে না পারে পুলিশকে। এতে সুবিধে হলো কুয়াশার, লোকটার নাগালের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল ও। আকস্মিক আক্রমণ চালানো যাবে তাতে।

খিলখিল করে হেসে উঠল মেয়েটা, তার সঙ্গী পাঁচতলার বোতাম চাপল। মৃদুস্বরে ক্ষমা চেয়ে আগে বাড়ল নিগ্রো, তিনতলার বোতাম টিপে ফিরে এল আগের জায়গায়। কাজটা করতে গিয়ে চকিতের জন্য চোখাচোখি হয়ে গেল কুয়াশার সঙ্গে। বিস্ফারিত হয়ে উঠল চোখজোড়া।

এলিভেটরের দরজা বন্ধ হওয়া পর্যন্ত মূর্তির মত স্থির রইল দু’জনে। তারপরেই বিদ্যুৎবেগে জ্যাকেটের ভিতরে হাত ঢোকাল নিগ্রো, পিস্তল বের করে আনার ইচ্ছে। হাতের ছড়ি তুলে তার কবজির জয়েন্টে প্রচণ্ড এক আঘাত হানল কুয়াশা। অস্থিসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার বিশ্রী আওয়াজ হলো। ককিয়ে উঠল লোকটা। নির্দয়ভাবে তার হাঁটুর জয়েন্টে পেনাল্টি কিক ঝাড়ল কুয়াশা, আলাদা করে দিল ওখানকার হাড়ও। হুড়মুড় করে মেঝেতে বসে পড়ল খুনি। মাথার চুল ধরে তার নাক-কপাল ঠুকে দিল কুয়াশা দেয়ালের সঙ্গে, এরপর মেঝেতে শুইয়ে ফেলে একটা হাঁটু তুলে দিল পিঠের উপর। নড়াচড়ার উপায় রইল না নিগ্রোর হাতদুটোও চাপা পড়েছে শরীরের তলায়। এতকিছু ঘটে যেতে সময় লাগল মাত্র আড়াই সেকেণ্ড!

চিৎকার করে উঠল আমেরিকান মেয়েটা। তার সঙ্গীও হতভম্ব হয়ে গেছে।

‘খবরদার!’ ধমকে উঠল কুয়াশা। ‘কোনও আওয়াজ নয়!’ নিজের পিস্তল বের করে নিগ্রোর খুলির পিছনে ঠেকাল। লোকটা দাপাদাপি করতে চাইছে দেখে বলল, ‘নোড়ো না। মগজে বুলেট ঢুকে যাবে তা হলে।

স্থির হয়ে গেল নিগ্রো। ছড়ি ফেলে দিয়ে তার জ্যাকেটের ভিতর থেকে পিস্তল কেড়ে নিল কুয়াশা। মুখ ঘোরাল কাঁপতে থাকা নবদম্পতির দিকে

‘রিল্যাক্স,’ বলল ও। ‘কথা শুনলে তোমাদের কোনও ক্ষতি করব না আমি।’

‘ক্… কী চান আপনি?’ তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করল যুবকটি।

‘তোমাদের রুমে যাব আমরা,’ বলল কুয়াশা। ‘পকেট থেকে চাবি বের করো। এলিভেটর থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিকভাবে হাঁটবে। কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা কোরো না। ঠিক আছে?’

‘জিসাস ক্রাইস্ট!’

‘কুইক! চাবি বের করো।’

যুবকটি আড়ষ্ট হয়ে গেছে, তার পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল মেয়েটা। চাবি বের করে বলল, ‘প্লিজ, আপনার কথামতই হবে সব। আমাদের খুন করবেন না।’

‘কথা দিলাম।‘ সংক্ষেপে বলল কুয়াশা।

তিনতলার ক্ষণিকের জন্য থামল এলিভেটর, কিন্তু দরজা খুলতে দিল না কুয়াশা। মেয়েটাকে বলল ক্লোজ বাটন চেপে ধরে রাখতে। একটু পরে পাঁচতলায় পৌঁছুল এলিভেটর। নিগ্রোকে মেঝে থেকে উঠিয়ে আনল কুয়াশা। ব্যথায় আবার ককিয়ে উঠল সে।

‘সাবধান! একটা শব্দও নয়!’ তার কানের কাছে ফিসফিসাল কুয়াশা। ‘আওয়াজ করলে খুলি উড়িয়ে দেব তোমার। জিন্দেগিতে আর কখনও ককাতে পারবে না তখন।’ দরজা খুলে গেছে। ‘মুভ!’ নির্দেশ দিল ও।

পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে হাঁটতে শুরু করল নবদম্পতি পিছনে নিগ্রোকে নিয়ে এগোল কুয়াশা। গা ঘেঁষে রয়েছে, কৌশলে পিস্তল ঠেকিয়ে রেখেছে লোকটার পেটের সঙ্গে।

করিডোর মোটামুটি ফাঁকা পাওয়া গেল। বৃদ্ধ এক গেস্টের সঙ্গে দেখা হলো কেবল, গম্ভীরমুখে একটা বই পড়তে পড়তে হাঁটছেন। অদ্ভুত মিছিলটার দিকে তাকিয়েও দেখলেন না। মোড় নিয়ে চলে গেলেন অন্য এক করিডোরে।

নবদম্পতির হানিমুন স্যুইটে ঢুকে পড়ল চারজনে। কামরার মাঝখানে একটা চেয়ার এনে তাতে বসানো হলো নিগ্রোকে। বিছানার চাদর পাকিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলা হলো ভালভাবে। এরপর দম্পতির দিকে ফিরল কুয়াশা।

‘ক্লজিটে ঢুকে পড়ো তোমরা। এক্ষুণি।

‘আ… আপনি তো বলেছিলেন…. প্রতিবাদের চেষ্টা করল যুবক।

‘তোমাদের ভালর জন্যই বলছি,’ তাকে বাধা দিল কুয়াশা।

‘যাও!’

দ্বিরুক্তি করল না দম্পতি। দু’জনে ঢুকে পড়ল ক্লজিটের ভিতরে। বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল কুয়াশা। তারপর ফিরে এল খুনির কাছে।

‘কাজটা কীভাবে করতে যাচ্ছ, তা বলার জন্য ঠিক পাঁচ সেকেও দিচ্ছি তোমাকে,’ থমথমে গলায় বলল ও।

কপাল আর নাক থেকে বের হয়ে আসা রক্ত মুখে ঢুকছে নিগ্রোর। থুঃ করে একদলা থুতু ফেলল। কবজি আর হাঁটুর ব্যথা কিছুটা সয়ে এসেছে বোধহয়। শান্ত গলায় বলল, ‘কীসের কথা বলছ, তা আরেকটু পরিষ্কার করতে হবে তোমাকে।’

‘নিশ্চয়ই!’ একটু এগিয়ে গেল কুয়াশা। পিস্তলের সাইটের খোঁচায় চিরে দিল বন্দির গালের অনেকখানি। এরপর পিছনে গিয়ে তার ভাল কবজিটাও ভেঙে দিল মট করে। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল লোকটা। তার মুখের মধ্যে পিস্তলের ব্যারেল ঢুকিয়ে দিল ও। চিৎকার থামিয়ে ফেলল খুনি।

‘এবার পরিষ্কার হয়েছে?’ সকৌতুকে বলল কুয়াশা। ‘নাকি আরও দু’চারটে হাড় ভাঙতে হবে?’

সভয়ে মাথা নাড়ল নিগ্রো।

‘গুড!’ পিছিয়ে এল কুয়াশা। ‘এবার গান গাইতে শুরু করো।’

‘আমার কাজ রানাকে রুম থেকে বের করে আনা,’ ভাঙা গলায় বলল নিগ্রো। ব্যথা সহ্য করার জন্য ক্ষণে ক্ষণে ঠোঁট কামড়ে ধরছে। ‘এরপর বাকিরা ওর ব্যবস্থা নেবে।’

‘তোমার কথায় রানা রুম থেকে বের হবে কেন?’ জিজ্ঞেস করল কুয়াশা।

‘সিআইএ-র ক্রিডেনশিয়াল আছে আমার কাছে। ডিরেক্টরের পক্ষ থেকে একটা চিঠিও নিয়ে এসেছি, মাসুদ রানার সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে দেখা করতে চেয়েছেন তিনি এতে। ভুয়া চিঠি, কিন্তু এই বোঝার উপায় নেই। রানা যদি ফোনে কনফার্ম করতে চায়, তাতেও অসুবিধে নেই। হোটেলের লাইন ইন্টারসেপ্ট করে রেখেছি আমরা। কলটা ডাইভার্ট হয়ে চলে যাবে আমাদের লোকের কাছে। ডিরেক্টরের সেক্রেটারি সেজে মিটিঙের কনফার্মেশন দেবে সে।

‘হুম, রানা রুম থেকে বের হয়ে এল… তারপর?’

‘মোটে তিনটে একজিট আছে তিনতলায়। মেইন এলিভেটর, স্টেয়ারকেস আর সার্ভিস এলিভেটর। সবগুলোতে একজন করে লোক রাখা হয়েছে। রানাকে দেখামাত্র গুলি করবে ওরা। পিছন থেকে আমিও। ক্রসফায়ারে ফেলা হবে ওকে, যাতে কোনোভাবেই বাঁচতে না পারে।’

‘আর ফায়ার এস্কেপ?

‘ওখানে এক্সপ্লোসিভ বসানো হয়েছে। কেউ ওখান দিয়ে নামার চেষ্টা করলে বিস্ফোরণ ঘটবে। যদিও ও-পথে রানার বেরুবার সম্ভাবনা খুবই কম।’

‘প্ল্যান ওলোট-পালোট হয়ে যেতে পারে না? রানা যদি রুম থেকে না বেরোয়?

‘সেক্ষেত্রে সবাই মিলে হামলা করব আমরা। দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ব ওর কামরায়। যত চালুই হোক, চারজনকে কিছুতেই ঘায়েল করতে পারবে না ও।’

‘আই সি! প্ল্যান তো দেখছি শুধু রানার জন্য। আমার ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নিয়েছ?’

‘কিছু না। কারণ আমরা শিয়োর হয়েছিলাম, তুমি এ-হোটেলে নেই। রিসেপশনে তোমার এবং রানার, দু’জনেরই ছবি দেখানো হয়েছিল। শুধু রানা এ-হোটেলে উঠেছে বলে জানানো হয়েছে ওখান থেকে। তাই তোমাকে সেকেণ্ডারি টার্গেট হিসেবে ব্রিফ করা হয়েছে আমাদের। পাওয়া গেলে ভাল, না পাওয়া গেলেও ক্ষতি নেই। তোমার ব্যাপারে পরে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

‘হুম! তোমাদের শিডিউল বলো।’

‘বারোটা বেজে দশ মিনিটে আমি অ্যাপ্রোচ করব রানার কাছে…’

রুমের ডেস্কে শোভা পেতে থাকা অ্যান্টিক ঘড়ির দিকে তাকাল কুয়াশা। বারোটা বেজে এগারো মিনিট। ‘তারমানে ওরা সবাই পজিশন নিয়ে ফেলেছে,’ আনমনে বলল ও।

জানি না। আমি ঘড়ি দেখতে পাচ্ছি না।’

‘তার দরকারও নেই। কতক্ষণ অপেক্ষা করবে তোমার সঙ্গীরা?’

‘পনেরো মিনিট। এরমধ্যে রানা নীচে না নামলে সবাই উঠে আসবে তিনতলায়।’

ঠোঁট কামড়াল কুয়াশা। হাতে সময় নেই একদম। বেডসাইড টেবিলের উপর রাখা টেলিফোনের উপর চোখ পড়ল। রিং দেবে রানাকে? সাবধান করে দেবে? ও কি বিশ্বাস করবে ওর কথা? আর কোনও উপায়ও তো নেই হাতে।

‘চুপচাপ বসে থাকো,’ নিগ্রোকে বলল ও। ‘আমাকে একটা ফোন করতে হবে।’

.

অভিজ্ঞতা, ট্রেইনিং আর উপস্থিত বুদ্ধির কল্যাণে বেঁচে গেল রানা। মহিলার হাতে ছুরিটা ঝিক্ করে উঠেছে দেখে সচেতনভাবে কিছু না ভেবেই সরে গেল ও—নিখাদ রিফ্লেক্স অ্যাকশন। পেট চিরে দিতে পারল না, তাই ছুরিটা তুলে একদিক থেকে আরেক দিকে চালাল মহিলা, রানা সরে না গেলে গলাটা ফাঁক হয়ে যেত। পাগলের মত ট্রিগার চাপল ও পিস্তলের, কিন্তু খালি চেম্বারে খটাস করে পড়ল হ্যামার। চারটা বুলেটই ছিল ম্যাগাজিনে। সেটা জানা থাকায় সুকৌশলে ফাঁদ পেতেছে মহিলা। ছুরি বাগিয়ে ছুটে এল রানার কাছে। আঘাতটা ঠেকাবার জন্যে বাম বাহু তুলল রানা।

ছোটোখাটো এই প্রৌঢ়ার গায়ে এতো শক্তি ভাবা যায় না ওদের দুটো বাহু পরস্পরের সাথে ধাক্কা খেলো, রানার মনে হলো যেন ইস্পাতের একটা রডের সাথে বাড়ি খেয়েছে হাতটা। পিস্তল ছেড়ে দিয়ে হাতটা শক্ত করে ধরে ফেলল ও। গায়ের কাছে ঘেঁষে এসেছে এবার মহিলা, নিজেকে ছাড়াবার জন্য হাত মোচড়াচ্ছে।

নিজেকে ছাড়াতে পারলে ছুরির দ্বিতীয় কোপটা আরেকদিক থেকে মারত সে। এক সেকেণ্ডের জন্যে খুনের নেশায় চকচকে চোখদুটো স্থির হলো রানার চোখে। সামনে বাড়ার জন্য প্রচণ্ড চাপ দিল সে, তারপর অপ্রত্যাশিতভাবে পিছু হটে দ্বিতীয়বার ছুরি চালাবার সুযোগ করে নিল। পুরনো ক্লোজ কমব্যাট ট্রিক, প্রতিপক্ষের শরীরটাকে লেভারেজ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে মহিলা। তার এই ফাঁদে পা দেয়া উচিত হয়নি রানার। ছুরিটা এবার অন্য কায়দায় ধরেছে সে, ফলাটা বেরিয়ে আছে বুড়ো আঙুলের মাথা থেকে, নীচের দিক থেকে উঠে আসবে প্রতিপক্ষের দিকে।

ধীর ভঙ্গিতে এগোল মহিলা, ফণা তোলা সাপের মতো এদিক-ওদিক দুলছে শরীরটা, হঠাৎ করে একদিক থেকে আরেক দিকে সরে যাচ্ছে। তারপর রানার অরক্ষিত বাম পাশটা লক্ষ্য করে ছুরি চালাল সে।

আবার তাকে ঠেকিয়ে দিল রানা, বাম বাহু সামনে বাড়িয়ে, সেই সাথে ডান হাত দিয়ে মহিলার কব্জি ধরার চেষ্টা করল। কব্জিটা নীচের দিকে নামাতে চেষ্টা করল রানা, মোচড় দিল, ব্যথা পেয়ে প্রতিপক্ষ যাতে ছুরিটা ছেড়ে দেয়। কিন্তু রানার একটা আঙুল মুঠোর ভিতর নিয়ে নীচের দিকে টান দিল মহিলা, তার গায়ে এতোই শক্তি রানার ডান হাতটা পিছলে গেল, ওটায় যেন মাখন মাখানো আছে।

এখন আবার একবার এদিক, একবার ওদিক সরার ভান করছে মহিলা। হঠাৎ দু’পা পিছিয়ে গেল সে, ভান করল আরও এক পা পিছাবে, কিন্তু তা না করে লাফ দিল ডান দিকে, শেষে ভান করল বাম দিকে সরে যাবে, কিন্তু তা না গিয়ে চলে এল সামনে, হাঁটু ভাঁজ করে ছেড়ে দেয়া স্প্রিঙের মতো লাফ দিল।

নীচে থেকে আসতে দেখল রানা ছুরিটা, শরীরটা বাম দিকে ঘুরিয়ে নিল ও। মাত্র কয়েক ইঞ্চির জন্যে ওকে ছুঁতে পারল না ছুরির ফলা, ফলার ডগাটা লাগল গিয়ে কামরার দেয়ালে।

রানা তাকে ধরার আগেই একটা দ্রুতগতি ঘূর্ণির মত পিছিয়ে গেল মহিলা, আবার এগিয়ে এল ওর দিকে। মুঠো করা হাতে এখনও ধরে আছে ছুরিটা। আবারও আঘাতটা ঠেকিয়ে দিল রানা, এবার ডান হাত দিয়ে প্রতিপক্ষের কব্জিটা শক্ত করে ধরে ফেলেছে, বাম বাহু দিয়ে নিরেট চাপ দিল মহিলাকে।

শরীরের সমস্ত শক্তি এক করল রানা, তারপর হ্যাঁচকা টান দিল নীচের দিকে। দেয়ালে বাড়ি খেল মহিলার হাত, ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল সে, শিরদাঁড়া বাঁকা করে কুঁজো হয়ে গেল। হাত থেকে খসে পড়ল ছুরি, এখনো হাঁপাচ্ছে আর ধস্তাধস্তি করছে, একটা হাঁটু উঠে আসছে রানার দুই ঊরুর সন্ধিস্থলে।

আঘাতটা খেয়ে চোখে অন্ধকার দেখল রানা, শুনতে পেল আহত পশুর মতো আওয়াজ বেরিয়ে এল নিজের গলা থেকে। কুঁজো হয়ে গেল রানা, ঊরুসন্ধি চেপে ধরে হুড়মুড় করে পড়ে গেল মেঝেতে। দেখল, সাপের মতো এঁকেবেঁকে নীচে নেমে গেল মহিলার একটা হাত ছুরিটা খুঁজছে মেঝেতে। পেয়েও গেল। ওটা বাগিয়ে ধরে ঝাঁপ দিল শিকারের দিকে।

উন্মত্তের মত লাথি ছুঁড়ল রানা, জুতোর তলা আঘাত করল মহিলার হাঁটুর নীচে। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল সে, ব্যালান্স হারিয়ে পড়ে যেতে শুরু করল। গড়ান দিয়ে সরে গেল রানা। পরমুহূর্তে ধড়াম করে মেঝেতে আছাড় খেল মহিলা, গলা চিরে বেরিয়ে এল আর্তচিৎকার কেঁপে উঠল তার সারা দেহ।

আচ্ছন্নের মত পড়ে রইল রানা। শরীরে শক্তি পাচ্ছে না আর। কখন নিজেকে সামলে নিয়ে মহিলা আবার ছুরি চালায়, সে-অপেক্ষা করছে। কয়েক মুহূর্ত পরও যখন কিছু ঘটল না, কাত হলো ও। একই ভঙ্গিতে পড়ে আছে আলুফাস-এর খুনি। শরীরের নীচটা ভেসে যাচ্ছে রক্তে।

তাড়াতাড়ি মহিলার দিকে এগোল রানা। চিৎ করল তাকে। পরিষ্কার হয়ে গেল রহস্য। বেমক্কা আছাড় খাবার সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। রানার জন্য বরাদ্দ করা স্টিলেটো গেঁথে গেছে মহিলার নিজেরই বুকে। প্রাণ হারিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে।

‘দুঃখিত,’ বিড়বিড় করল রানা। আঙুল বুলিয়ে বন্ধ করে দিল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা দু’চোখের পাতা।

টলমল পায়ে উঠে দাঁড়াল রানা। বাথরুমে গিয়ে কল ছাড়ল। ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলল ঘাড়ের ক্ষত। এরপর মেডিসিন কেবিনেট থেকে বের করে আনল ফার্স্ট এইড কিট। অ্যান্টিসেপটিক লাগাল, গজ-তুলো আর টেপের সাহায্যে ঢেকে দিল ক্ষতটা। কামরায় ফিরে এসে ধপ্ করে শুয়ে পড়ল বিছানার কিনারায়।

কতক্ষণ ওভাবে পড়ে ছিল রানা, বলতে পারবে না। সচকিত হয়ে উঠল টেলিফোনের রিং শুনে। উঠে বসল ও, রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল। বলল, ‘ইয়েস?’

‘কুয়াশা বলছি।’ বাংলায় কথা বলল ওপাশের কণ্ঠ।

‘বলুন,’ নির্বিকার রইল রানা।

‘ভালই খেলা দেখিয়েছ তুমি, রানা। তবে এসবের প্রয়োজন ছিল না…’

‘খেলা আপনিও কম দেখাননি, কুয়াশা।’ শান্তকণ্ঠে বলল রানা। ‘আমি ভাবতে পারিনি আপনি আমাকে খুন করার চেষ্টা করবেন। আমাদের মধ্যে এমন কোনও শত্রুতা ছিল না। চিনিই না আমি আপনাকে। ‘

‘খুন! কীসের কথা বলছ?’

‘আইরিশ ওই বুড়ির কথা বলছি। চেনেন নিশ্চয়ই ওকে?’

‘ও… ও… ও কি…

‘মারা গেছে। দুঃখিত, আমার কিছু করার ছিল না। আমি স্রেফ আত্মরক্ষা করেছি।

‘তোমাকে খুন করার জন্য পাঠাইনি আমি ওকে। নিশ্চয়ই তুমি ওকে খেপিয়ে দিয়েছিলে…’

‘হোয়াটএভার, মি. কুয়াশা। আপনার প্ল্যান ব্যর্থ হয়েছে। এখন বলুন, ভালয় ভালয় আমার সঙ্গে দেশে ফিরে যাবেন, নাকি অন্য আর কোনও পথ ধরতে হবে আমাকে?’

‘পরিস্থিতির গুরুত্ব তুমি বুঝতে পারছ না, রানা। আমি নই, কিন্তু তোমাকে খুন করার জন্য সত্যিই লোক হাজির হয়েছে এখানে। তাদের একজনকে আটক করেছি আমি। বিশ্বাস না হলে শোনো!’

নিগ্রোর খুলিতে পিস্তল ঠেকিয়ে রিসিভারটা কানে ধরল কুয়াশা। ইংরেজিতে ধমকে বলল, ‘কথা বলো! কয়জন, আর কেন এসেছ!’

‘হ্যাঁ… চারজন এসেছি আমরা… মাসুদ রানাকে খুন করতে…’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল খুনি।

‘শুনলে তো?’ রিসিভার এবার নিজের কানে ঠেকাল কুয়াশা। ‘আমি তোমাকে সতর্ক করে দেবার জন্য ফোন করেছি, রানা। সবগুলো একজিটে লোক রেখেছে ওরা। এমনকী ফায়ার এস্কেপেও এক্সপ্লোসিভ বসিয়েছে। তুমি এখন ফাঁদের মধ্যে আছ, রানা।

‘এটা আপনার নতুন চাল-ও হতে পারে, কুয়াশা.’ বলল রানা। ‘কীভাবে বুঝব, কোনও অভিনেতার মুখ দিয়ে কথাগুলো বের হয়নি?

‘যদি নিশ্চিত হতে চাও, বসে থাকো নিজের রুমে। পনেরো মিনিটের মধ্যে তুমি যদি নীচে না নামো, তা হলে ওরাই আসবে তোমার কাছে।

আমার ভালমন্দ নিয়ে আপনি হঠাৎ এত উতলা হয়ে উঠলেন কেন, জানতে পারি? আমার বাঁচামরায় কী এসে-যায় আপনার?’

‘অনেক কিছু এসে-বায়, রানা। তোমাকে আমার দরকার।  ভয়ঙ্কর একটা ষড়যন্ত্র চলছে গোটা দুনিয়া জুড়ে, আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ সেটা ঠেকাতে পারবে না।’

‘দুনিয়াজুড়ে ষড়যন্ত্র? সেটা ঠেকাতে চান আপনি?’ খোঁচা দেয়ার ভঙ্গিতে হেসে উঠল রানা। ‘এতটা মানবদরদী হয়ে উঠলেন কবে থেকে? নিজের গবেষণা ছাড়া আর কিছু তো ইম্পরট্যান্ট নয় আপনার কাছে!’

‘মানবদরদী আমি সবসময়ই ছিলাম, রানা,’ গম্ভীর গলায় বলল কুয়াশা। ‘আমার ফাইল দেখে থাকলে এমন কথা বলা উচিত নয় তোমার। আর এই বিশেষ ব্যাপারটার সঙ্গে কীভাবে জড়িত হলাম, তা যদি জানতে চাও, এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হবে তোমাকে।

‘বিশেষ ব্যাপারে আগ্রহ নেই আমার,’ কাটা কাটা গলায় বলল রানা। ‘খাঁচায় ভরে আপনাকে বাংলাদেশে নিয়ে যেতে বলা হয়েছে আমাকে। আপাতত ওটাই আমার লক্ষ্য।

‘যথেষ্ট হয়েছে!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল কুয়াশা। ‘আবোল-তাবোল কথা বলে আর সময় নষ্ট করার ইচ্ছে নেই আমার। তোমাকে সতর্ক করে দেয়া দরকার ছিল, করেছি। আমার দায়িত্ব শেষ। সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে চাইলে এলিভেটর বা স্টেয়ারকেসে নিজের চাঁদমুখটা একবার দেখিয়ে এসো। সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। রুমে বসে থাকলেও ক্ষতি নেই। আর এগারো মিনিট পরে প্রমাণ নিজেই হাজির হয়ে যাবে তোমার দরজা ভেঙে। আমাকে চাও? ছ’তলায় আছি আমি। পাঁচশ’ পাঁচ নম্বর স্যুইটে। যদি বাঁচতে পারো, চলে এসো এখানে। আমি অপেক্ষা করব।’

লাইন কেটে দিল ও।

রানাও নামিয়ে রাখল রিসিভার। চিন্তায় পড়ে গেছে। কতটুকু বিশ্বাস করা যায় কুয়াশাকে? মেইডের বেশে ভয়ঙ্কর এক খুনিকে ওর কামরায় পাঠিয়েছিল লোকটা। কেন? ওকে বন্দি করার জন্য? নাকি হত্যা করার জন্য? উদ্দেশ্য কী কুয়াশার?

চারজন খুনি হাজির হয়েছে হোটেলে, একজনকে নাকি আটক করেছে সে। কথাটা সত্যি, না মিথ্যে? ঘড়ি দেখল রানা। এক মিনিট পেরিয়ে গেছে টেলিফোনের কথোপকথনের পর। কুয়াশার সতর্কবাণী সত্যি হলে আর মাত্র দশ মিনিট আছে ওর হাতে। রুমে থাকলে ফাঁদে পড়ে যাবে। তারমানে বেরিয়ে পড়তে হবে ওকে। ব্যাপারটা কুয়াশার চাল নয়তো? হয়তো কামরার বাইরেই রয়েছে সত্যিকার ফাঁদ। ওখানেই ওকে ফেলতে চাইছে লোকটা।

ব্যাপার যা-ই হোক, রানা বুঝতে পারছে, এখানে চুপচাপ বসে থাকা চলবে না ওর। অবস্থান ফাঁস হয়ে গেছে, ঘাপটি মেরে পড়ে থেকে লাভ নেই কোনও। রুমের মধ্যে বসে থাকলে কুয়াশাকেও পাওয়া যাবে না। বড় করে শ্বাস নিল ও। ঠিক আছে, বেরিয়ে পড়া যাক। যদি সত্যিই খুনির দল অপেক্ষা করে ওর জন্য, তাদেরকে মোকাবেলা করবে ও। তারপর গ্রেফতার করবে কুয়াশাকে। আজ একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে ওকে।

ভুয়া মেইডের লাশটা বাথরুমে নিয়ে গেল রানা। বাথরুমের দরজা আটকে নটা ভেঙে দিল ভারী একটা টেবিল-ল্যাম্পের আঘাতে। ভিতরে ঢুকতে হলে এখন পুরো পাল্লা ভাঙতে হবে। এরপর তোয়ালের সাহায্যে পুরো কামরা থেকে নিজের ফিঙ্গারপ্রিন্ট মুছতে শুরু করল হাতে সময় কম, কাজটা সুচারুভাবে করা গেল না। মনে খুঁতখুঁতানি নিয়ে গায়ে জ্যাকেট চড়াল ও। তারপর বিছানায় বসে ফোনের রিসিভার তুলল, ডায়াল করল হোটেলের সুইচবোর্ড অপারেটরের কাছে।

‘ইয়েস, স্যর।’ শোনা গেল নারীকণ্ঠ।

‘দুইশ’ তেরো থেকে বলছি আমি…’ দুর্বল কণ্ঠে বলল রানা, শ্বাস নিচ্ছে জোরে জোরে। পুরোটাই অভিনয়। ‘আ… আমার সম্ভবত হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। প্লিজ… সাহায্য করুন…’

কথা শেষ না করেই রিসিভারটা ফেলে দিল ও। পা ঠুকে মেঝেতে পড়ে যাওয়ার আওয়াজ করল।

‘স্যর… আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? স্যর!!’ ইয়ারপিসে চেঁচাতে শুরু করল অপারেটর।

ওদিকে ফিরেও তাকাল না রানা। মেঝে থেকে নিজের সিগ-সাওয়ার কুড়িয়ে নিল। গুঁজে রাখল কোমরে। তাকাল হাতঘড়ির দিকে।

আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *