সেই কুয়াশা ১.১৪

চোদ্দ

পাহাড়ি পথ ধরে দ্রুত এগোল ওরা তিনজন, ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ল অবারিত মাউন্টেইন রেঞ্জের ভিতরে। যত এগোচ্ছে, ততই দুর্গম হয়ে উঠছে পথ। পায়ের তলায় এবড়ো-খেবড়ো মাটি, সামনে ঘন জঙ্গল, উঁচু-নিচু রাস্তায় হাঁটতে জান বেরিয়ে যাবার জোগাড়। নকল পায়ে এ-অত্যাচার আর সহ্য হচ্ছে না কুয়াশার, ছড়ি ব্যবহার করতে হচ্ছে ওকে। চলার গতি কিছুটা কমে গেছে তাতে।

অন্ধকারে দিশে পাওয়া ভার, তবে কুকুরটা থাকায় নিশ্চিন্তে এগোতে পারছে ওরা। জ্বলজ্বল করছে প্রাণীটার চোখ, নির্বিঘ্নে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। রওনা হবার আগে তাকে রানা-কুয়াশার গন্ধ শুঁকিয়ে নিয়েছে মেয়েটা, বুঝিয়ে দিয়েছে—দুই নবাগত তাদের বন্ধু।

এই কুকুরটাকেই পাহাড়ি ঢালে দেখেছিল কি না, সন্দেহ হচ্ছে রানার। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল সে-কথা।

‘হতে পারে,’ জবাব এল। ‘অনেকক্ষণ থেকেই ওখানে ঘুরছিলাম আমরা। ওকে ছেড়ে দিয়েছিলাম গন্ধ খোঁজার জন্য। তবে আমাকে ছেড়ে বেশিদূর কখনোই যায়নি ও।

‘আমাকে আক্রমণ করার সম্ভাবনা ছিল?’

উঁহুঁ। মানে… যদি ওর গায়ে হাত তুলতে আর কী… বা আমার গায়ে।’

মাঝরাত পেরিয়ে যাবার পর মোটামুটি সমতল একটা এলাকায় পৌঁছল ওরা। কোমর পর্যন্ত ঘাস জন্মেছে ওখানে, বাতাসে দুলছে এদিক-ওদিক। সমভূমির ওপাশে আবার শুরু হয়েছে পাহাড়ের সারি, গায়ে ঘন অরণ্য। আকাশে মেঘের আনাগোনা কমে গেছে, নির্বিঘ্নে মুখ দেখাতে পারছে চাঁদ। কোমল আলোয় স্নান করিয়ে দিচ্ছে পর্বতমালাকে। মাথা ঘুরিয়ে কুয়াশার দিকে তাকাল রানা, ওর মতই দশা—ঘামে ভিজে গেছে শার্ট, হাঁপাচ্ছে। অথচ ঠাণ্ডা বাতাস বইছে সমভূমির উপর দিয়ে।

ওদের অবস্থা লক্ষ করে মেয়েটা বলল, ‘এখন একটু বিশ্রাম নিতে পারি আমরা।’ কয়েকশ’ গজ দূরের একটা অন্ধকার জায়গার দিকে আঙুল তুলল, কুকুরটা ও-দিকে ছুটে গেছে। ‘ওখানে একটা গুহা আছে। বেশি বড় না, তবে তিনজনের জায়গা হয়ে যাবে।’

‘তোমার কুকুর তো মনে হচ্ছে আগেও গেছে ওখানে,’ মন্তব্য করল কুয়াশা।

হাসল মেয়েটা। ‘ও চাইছে আমি আগুন জ্বালি। বৃষ্টির সময় মুখে করে শুকনো ডাল নিয়ে আসে আমার কাছে। আগুন ওর ভারি পছন্দ!

একটু পরেই জায়গামত পৌঁছে গেল ওরা। গুহাটা পাহাড়ি ঢালের গোড়ায়। গভীরতায় দশ ফুটের বেশি হবে না, উচ্চতায় ছ’ফুট। ভিতরে ঢুকল ওরা।

কুয়াশা লক্ষ করল, পুরনো অগ্নিকুণ্ডের আধপোড়া লাকড়ি এখনও পড়ে আছে ভিতরে। তাই জিজ্ঞেস করল, ‘আগুন জ্বালব?’

‘ইচ্ছে হলে জ্বালুন। উচেলো খুব খুশি হবে।’

‘উচেলো!’ ভুরু কোঁচকাল কুয়াশা। মানে, পাখি?’

‘মাটির উপর দিয়ে পাখির মতই উড়ে বেড়ায় ও, সেনিয়র।‘

কাঁধ ঝাঁকিয়ে আগুন জ্বালানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়ল কুয়াশা।

রানা মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি চমকার ইংরেজি বলো, কোথায় শিখেছ?’

‘ভেসকোভাতো-র কনভেন্ট স্কুলে পড়েছি আমি,’ জানাল মেয়েটা। ‘আমার মত যারা গভর্নমেন্ট প্রোগ্রামে ঢুকতে চায়, তাদেরকে ওখান থেকে ইংরেজি আর ফ্রেঞ্চ শিখে নিতে হয়।’

ম্যাচের সাহায্যে আগুন জ্বেলে ফেলল কুয়াশা। ছোট অগ্নিকুণ্ড থেকে ছড়াতে শুরু করল তাপ, আলোকিত হয়ে উঠল গুহা। ঠাট্টা করে রানা বলল, ‘আপনি আগুন লাগানোয় ওস্তাদ, রীতিমত প্রতিভাবান বলা যায়। পুরো জঙ্গলে যেভাবে আগুন লাগিয়ে দিলেন…’

‘খুব সাধারণ প্রতিভা ওটা,’ হাসল কুয়াশা।

টুপি খুলে ফেলেছে মেয়েটা, মাথা ঝাঁকিয়ে ছড়িয়ে পড়তে দিল ঘন কালো কেশ। ওর দিকে তাকাতেই রানার হৃৎপিণ্ড যেন একটা বিট মিস করল। মুহূর্তের জন্য মুগ্ধতায় স্থবির হয়ে গেল ও। তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে। বয়স বেশি নয়, বিশ থেকে পঁচিশের মধ্যে হবে। অপূর্ব কেশরাজি! বাদামি, আয়ত দুই চোখ যেন ডানা মেলছে আকাশে। নিখুঁত চোয়াল, নাকটা বুঝি পাথর কুঁদে বানিয়েছে কোনও ভাস্কর, তার নীচে ফোলা ফোলা দুই ঠোঁট হেসে উঠবে যে-কোনও মুহূর্তে। কোনও ধরনের সাজ নেয়নি, তারপরেও অপ্সরার মত লাগছে। জীবনে অনেক সুন্দরী দেখেছে রানা, কিন্তু আজ রাতে… কর্সিকার এই পাহাড়ি গুহার মাঝে এই মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে, এর নখেরও যোগ্য নয় কেউ। হয়তো পরিবেশের জন্য এমন অনুভূতি হচ্ছে, তবু ওর মনে হলো—লম্বা ছুটি নিয়ে বিধাতা বুঝি মাঝে-মধ্যে এমন নারীই সৃষ্টি  করেন!

‘কী দেখছ?’ হঠাৎ মেয়েটির প্রশ্নে সচকিত হয়ে উঠল রানা।

‘কিছু না,’ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল ও। ‘তুমি গভর্নমেন্ট প্রোগ্রামে ঢুকেছিলে?’

‘যতদূর পারা যায় আর কী।’

‘কতদূর সেটা?’

‘বোনিফাসিয়ো-র স্কুলা মিডিয়া। বাকিটা অন্যদের সাহায্য নিয়ে সেরেছি। ফোণ্ডেস-রা পড়াশোনার খরচ দিয়েছে।’

‘ঠিক বুঝলাম না।’

‘ইউনিভার্সিটি অভ বোলোগনা-র গ্র্যাজুয়েট আমি, সেনিয়র। সেইসঙ্গে আমি একজন কম্যুনিস্তা… কথাটা আমি গর্ব নিয়ে বলি।’

‘সাবাস!’ বাঁকা সুরে বিদ্রূপ করল কুয়াশা।

‘হাসবেন না, সেনিয়র,’ একটু আহতস্বরে বলল মেয়েটা। ‘কমিউনিজমের দিন এখনও শেষ হয়ে যায়নি। ওটাই দেশ চালানোর সঠিক পন্থা। দেখবেন, একদিন এই কমিউনিজমের সাহায্য নিয়েই ইটালিকে দাঁড় করাব আমরা। অরাজকতা আর অস্থিরতার অবসান ঘটবে, শেষ হবে খ্রিস্টানদের অনাচার।’

‘বোকার রাজ্যে বাস করছ তুমি,’ বলল রানা।

‘না, সেনিয়র। যদি সতর্ক থাকি, তা হলে কেউ আমাদেরকে হাতের পুতুল বানাতে পারবে না। কমিউনিস্ট হিসেবেই স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারব আমরা।’

‘শুভকামনা রইল।’

পরিবেশটা গুমোট হয়ে উঠল এরপর। ঠাট্টায় সম্ভবত অপমানিত হয়েছে মেয়েটা, গুটিয়ে নিল নিজেকে। জানা গেল, তার নাম সোনিয়া। কুয়াশা জিজ্ঞেস করল, কেন ওর মত একজন রাজনীতি-সচেতন বিপ্লবী বোলোগনা ছেড়ে কর্মিকার পাহাড়ে ফিরে এসেছে। সংক্ষেপে ও শুধু বলল, দাদীর সঙ্গে কিছুদিন কাটাবার জন্য।

‘তোমার দাদী সম্পর্কে বলো,’ অনুরোধ করল রানা।

‘যা বলার, তা উনিই বলবেন তোমাদেরকে,’ কাঠখোট্টা গলায় বলল সোনিয়া। উঠে দাঁড়াল। ‘আমাকে যতটুকু জানাতে বলেছেন, তা বলেছি তোমাদেরকে।

তুমি শুধু বলেছ, ওঁর নাম ভিলা বারেমির রক্ষিতা।’

‘এটুকুই বলার কথা আমার, নইলে ওই জঘন্য নাম কিছুতেই উচ্চারণ করতাম না। যাক গে, যথেষ্ট বিশ্রাম হয়েছে। ওঠো এবার। আরও প্রায় দু’ঘণ্টা হাঁটতে হবে আমাদেরকে।’

.

দু’ঘণ্টা নয়, সোয়া দু’ঘণ্টা পর পাহাড়ের উপরে এক সমতল মালভূমিতে উঠে এল ওরা। নীচের উপত্যকার মেঝে থেকে জায়গাটার উচ্চতা প্রায় সাড়ে চারশো ফুট। বেশ বড়, দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে প্রায় এক একর জায়গা। চাঁদের আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, তাতে আলোকিত হয়ে উঠেছে গোটা মালভূমি। পরিষ্কার দেখা গেল সব। ঠিক মাঝখানটায় মাথা তুলে রেখেছে একটা পুরনো আমলের ফার্মহাউস, পাশে গোলাঘর। চারদিকে শাক-সবজির খেত। জলপ্রবাহের কুলুকুলু ধ্বনি কানে এল, খুব কাছে কোথাও বইছে একটা ঝর্ণা।

‘ভারি সুন্দর তো!’ মুগ্ধ কণ্ঠে বলে উঠল কুয়াশা।

‘গত পঞ্চাশ বছর থেকে এটাই দাদীর দুনিয়া,’ গম্ভীর গলায় বলল সোনিয়া।

‘এখানে জন্ম হয়েছে তোমার?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘এখানেই বড় হয়েছ?’

‘না,’ নেতিবাচক জবাব দিল মেয়েটা, ব্যাখ্যা করল না।  ‘এসো, দাদী অপেক্ষা করছে। দেখা করবে তোমরা ওঁর সঙ্গে।’

‘এত রাতে?’ কুয়াশা একটু অবাক হলো।

‘দাদীর কাছে রাত-দিন বলে কিছু নেই। আমাকে বলেছেন, তোমরা পৌছুনোমাত্র ওঁর কাছে নিয়ে যেতে। চলো।’

ফার্মহাউসের সামনের কামরায়, ফায়ারপ্লেসের সামনে পিঠ-উঁচু চেয়ারে বসা বৃদ্ধাটির জন্য রাত-দিন বলে কিছু নেই কেন, তা বুঝতে কষ্ট হলো না। অন্ধ তিনি—মণি বলে কিছু অবশিষ্ট নেই চোখে, পুরোটাই ঘোলা কাঁচের মত এক বস্তু, উদ্দেশ্যহীনভাবে সারাক্ষণ ঘুরছে এদিক-ওদিক। তীক্ষ্ণ চেহারা, বয়স আন্দাজ করা কঠিন—নব্বুই হতে পারে… একশো, কিংবা তার বেশি হলেও অবাক হবার কিছু নেই। কালের ভারে জর্জরিত চামড়া, কেমন যেন কালচে ফুটকি পড়ে গেছে… তারপরেও আঁচ করা যায়, এককালে অপূর্ব রূপসী ছিলেন বৃদ্ধা। কথা বলেন খুব নিচু স্বরে—শুধু কান খাড়া করে রাখলে চলে না, তাকিয়ে থাকতে হয় ঠোঁটের দিকেও। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, কথাবার্তায় কোনও দ্বিধা বা জড়তা নেই। দুই আগন্তক হাজির হওয়ামাত্র জানালেন, মৃত্যু তাঁর দুয়ারে কড়া নাড়ছে, চিরনিদ্রায় যাবার আগে অনেককিছু বলার আছে তাঁর। এই বাস্তবতা তাঁর চিন্তাচেতনাকে জাগিয়ে তুলেছে।

ইটালিয়ানে কথা বললেন বৃদ্ধা, তবে বাচনভঙ্গি অনেক পুরনো আমলের। শুরুতেই পরিচয় জানতে চাইলেন দুই আগন্তুকের। হিস্টোরিয়ানের কাভারটা ধরে রাখল কুয়াশা, মিলানের অ্যাকাডেমিক ফাউণ্ডেশনের কাহিনি শোনাল; বোঝাল, কর্সিকার ইতিহাস সম্পর্কে সংগঠনটা আগ্রহী। রানা নিজের পরিচয় দিল ওর সহকারী হিসেবে। ফেনিসের ফাইল স্টাডি করে এসেছে ও কাউণ্ট বারেমি সম্পর্কে বিভিন্ন রকম তথ্য জানিয়ে গবেষক হিসেবে নিজেদের পরিচয় দৃঢ় করবার প্রয়াস চালাল।

চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইলেন বৃদ্ধা, যেন দু’জনের বক্তব্য অন্তস্থ করে নিচ্ছেন। শেষে নড়ে উঠলেন তিনি, গালের উপর পড়ে থাকা একগোছা সাদা চুল সরালেন হাত দিয়ে। বললেন :

‘তোমরা দু’জনেই মিছে কথা বলছ। দ্বিতীয়জন তো আমাকে বোকা বানাবার জন্য এমন সব হাস্যকর কথা বলছে, যা পোর্তো ভেচিয়োর বাচ্চারাও জানে।’

‘পোর্তো ভেচিয়োতে হয়তো এসব জানা কথা, মৃদু প্রতিবাদ করল রানা, ‘কিন্তু মিলানে নয়।’

‘বুঝেছি কী বলতে চাইছ। কিন্তু তোমরা কেউই মিলানের লোক নও।

‘সে-কথা অস্বীকার করছি না,’ কুয়াশা বলল। আমরা ওখানে স্রেফ কাজ করি। আসলে আমরা বিদেশি, উচ্চারণ শুনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন সেটা।’

অত-শত বুঝতে পারছি না। শুধু এটুকু বুঝতে পারছি, তোমরা মিথ্যেবাদী। অবশ্য… কিছু এন্সে-যায় না তাতে, ভয়ের কিছু নেই তোমাদের।’

চকিতে দৃষ্টি বিনিময় করল রানা-কুয়াশা। আড়চোখে তাকাল সোনিয়ার দিকে। জানালার কাছে একটা তোষকের উপর বসে আছে মেয়েটা। পাশে গুটিসুটি মেরে আছে উচেলো।

‘এসে-যায় না মানে!’ বলল রানা। অবশ্যই এসে যায়। আমরা চাই আপনি খোলামনে কথা বলুন। আমাদেরকে মিথ্যেবাদী ভাবলে নিশ্চয়ই সেটা করবেন না?’

‘করব,’ শান্তস্বরে বললেন বৃদ্ধা। ‘কারণ স্বার্থান্বেষী মানুষের মত মিথ্যে বলছ না তোমরা। কথা শুনে বুঝতে পারছি, বিপজ্জনক লোক… কিন্তু লোভী নও। ব্যক্তিগত কোনও স্বার্থে আমার পাদ্রোনি-র ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছে না। ঠিক বলেছি?’

অবাক হয়ে গেল রানা। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘কীভাবে বুঝলেন?’

বৃদ্ধার শূন্য দৃষ্টি স্থির হলো ওর মুখের উপর, মনে হলো যেন দেখতে পাচ্ছেন ওকে। বললেন, ‘তোমাদের গলার স্বর… বুঝতে পারছি, তোমরা বিচলিত। হয়তো বা ভয়ও পাচ্ছ।’

‘ভয় পাবার কিছু আছে কি?’ জানতে চাইল কুয়াশা।

‘নির্ভর করছে তোমরা কী বিশ্বাস করো, তার ওপর।’ বললেন বৃদ্ধা।

‘আমাদের বিশ্বাস, ভয়ানক একটা কিছু ঘটছে তলে তলে। কী সেটা, কেন ঘটছে—তার কিছুই জানি না। ব্যস… আপাতত এটুকুই শুধু বলতে পারি আপনাকে।’

কী জানো তোমরা, সেনিয়র?

আরেকবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করল রানা-কুয়াশা। সোনিয়া যে ওদের কথাবার্তা শুনছে, এ-ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠেছে। রানা বলল, ‘জবাব দেবার আগে… আমার মনে হয় আপনার নাতনি এখানে না থাকলে ভাল হয়।’

‘না!’ সোনিয়া এত জোরে চেঁচিয়ে উঠল যে, কুকুরটা ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল

‘আমার কথা শোনো, নরম গলায় বলল রানা। ‘পথ দেখিয়ে দুজন অচেনা মানুষকে দাদীর কাছে নিয়ে এসেছ… এর জন্য কেউ দোষ দিতে পারবে না তোমাকে। কিন্তু এখন যদি বসে থাকো এখানে, নিজেকে জড়িয়ে ফেলবে আমাদের সঙ্গে… পুরো ব্যাপারটার সঙ্গে। খুবই বিপজ্জনক হবে সেটা, বিশ্বাস করো! তোমার ভালর জন্যই বলছি কথাটা।’

‘চলে যা, সোনিয়া,’ সুর মেলালেন বৃদ্ধা। ‘এদেরকে ভয় পাবার কিছু নেই আমার, তুইও নিশ্চয়ই ক্লান্ত। উচেলো-কে নিয়ে গোলাঘরে চলে যা… বিশ্রাম নে।’

কয়েক মুহূর্ত ফোঁস ফোঁস করল সোনিয়া, তারপর উঠে দাঁড়াল। ‘ঠিক আছে, যাচ্ছি আমি। তবে উচেলো এখানেই থাকবে।’ কথাটা বলেই ঝট্ করে শটগান তাক করল দুই অতিথির দিকে। ‘তোমাদের অস্ত্রগুলো বের করো, সেনিয়র। মেঝেতে ফেলে ছুঁড়ে দাও আমার কাছে। যতক্ষণ এখানে আছ, ওগুলো আমার জিম্মায় থাকবে।

‘তার কোনও দরকার আছে?’ বিরক্ত গলায় বলল রানা, পরমুহূর্তে সিঁটিয়ে গেল। কুকুরটা হিংস্র ভঙ্গিতে গরগর করছে, ওর দিকে লাফ দিতে প্রস্তুত।

‘থাক, দিয়েই দাও,’ বলল কুয়াশা। ‘এতে যদি শান্ত হয়!’ নিজের পিস্তল বের করে মেঝেতে রাখল, পা দিয়ে ঠেলে পাঠিয়ে দিল সোনিয়ার কাছে। শ্রাগ করে রানাও একই কাজ করল।

হাঁটু গেড়ে সাবধানে অস্ত্রদুটো কুড়িয়ে নিল সোনিয়া, লুপো-র ব্যারেল নড়চড় করল না। বলল, ‘আমি জেগে থাকব। তোমাদের কথা শেষ হলে দরজা খুলে আমাকে ডাক দিয়ো। আমি তখন উচেলোকে ডাকব। ও যদি না বেরোয়, তা হলে তোমাদের কপালে খারাবি আছে। তোমাদেরকে তোমাদের পিস্তল দিয়েই খুন করব আমি।’

দরজা’ খুলে বেরিয়ে গেল ও।

‘বড্ড জেদি মেয়ে!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন বৃদ্ধা। ‘গিলবার্তো বারেমির রক্ত! আরও কয়েক রকম রক্ত মিশে আছে : শিরায়, কিন্তু ওটার প্রভাব যায় না কিছুতেই।’

‘ও কাউণ্ট বারেমির নাতনি?’ ভুরু কোঁচকাল কুয়াশা।

‘প্রপৌত্রী,’ বললেন বৃদ্ধা। ‘আমার নাতির মেয়ে। কিন্তু ওর দাদার জন্ম হয়েছিল পাদ্রোনি এক কিশোরী রক্ষিতার সঙ্গে শুয়েছিলেন বলে।’

‘ভিলা বারেমির রক্ষিতা…’ রানা বলল। ‘আপনি?’

হালকা একটা হাসি ফুটল বৃদ্ধার ঠোঁটে। হাত তুলে আবার চুল সরালেন গালের উপর থেকে। ক্ষণিকের জন্য মনে হলো অন্য কোনও জগতে হারিয়ে গেছেন। স্বপ্নালু কণ্ঠে বললেন, ‘বহু… বহু বছর আগের কথা সেটা। সে-সময়ের কথা বলব তোমাদেরকে গলা খাঁকারি দিলেন। ‘তবে তার আগে তোমাদের সত্যিকার পরিচয় জানতে চাই।’

চোখে চোখে কথা হলো রানা-কুয়াশার, বৃদ্ধার সঙ্গে লুকোচুরি করে লাভ নেই আর। তাতে নিজেদেরই ক্ষতি। সত্যি কথাই বলবে বলে ঠিক করল ওরা।

‘আমার নাম মনসুর আলী… তবে কুয়াশা নামে সবাই চেনে আমাকে,’ বলল কুয়াশা। ‘আমি একজন বিজ্ঞানী এবং সত্যান্বেষী।

‘আর তুমি?’ রানার দিকে মুখ ঘোরালেন বৃদ্ধা।

‘আমি মাসুদ রানা, রানা বলল। ‘বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এজেন্ট। সোজা কথায়… স্পাই। আমরা দু’জনেই বাঙালি।’

‘তা-ই?’ গম্ভীর হয়ে গেলেন বৃদ্ধা। ‘আমি বুড়ো মানুষ, থাকিও একা; রেডিও-র খবর শোনা ছাড়া দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারছি, কর্সিকায় আমার পাদ্রোনির খোঁজে দু’জন বাঙালির উপস্থিতি খুবই অস্বাভাবিক। তার ওপর তোমরা দু’জন দুই জগতের মানুষ!’

‘হ্যাঁ, কথাটা সত্যি,’ একমত হলো কুয়াশা।

‘পরিস্থিতি আসলে এমনই গুরুতর যে, আমাদেরকে একাট্টা হতে হয়েছে,’ যোগ করল রানা।

‘সব খুলে বলো আমাকে,’ হুকুম দিলেন যেন বৃদ্ধা

চেয়ার টেনে তাঁর একটু কাছে গিয়ে বসল রানা। ফাইলে পড়া তথ্যগুলো স্মরণ করল। বলল, ‘যদ্দূর জানা গেছে, উনিশশো ত্রিশ থেকে চল্লিশের মাঝামাঝি কোনও একটা সময়ে কাউণ্ট গিলবার্তো বারেমি তাঁর বিশ্বস্ত কিছু মানুষকে খবর দিয়ে ডেকে আনেন নিজের এস্টেটে। কারা সেই লোক, বা কোত্থেকে তারা এসেছিল, তা জানা যায়নি। তবে নিজেদের একটা নাম দেয় ওরা…’

তারিখটা ছিল চৌঠা এপ্রিল, উনিশশো ছত্রিশ,’ বাধা দিয়ে বললেন বৃদ্ধা। ‘নিজেরা নাম দেয়নি, আমার পাদ্রোনি-ই ঠিক করে দিয়েছিলেন সেটা– কাউন্সিল অভ ফেনিস… ফিনিক্সের কাউন্সিল যা হোক, বলে যাও।’

‘আপনি ছিলেন ওখানে?’

‘আগে তোমার কথা শেষ করো।

ক্ষণিকের জন্য সংবিৎ হারাল রানা—এমন একটা ঘটনা নিয়ে কথা বলছিল, যেটা বহু বছর থেকে আলোচনা আর কল্পনার বিষয়বস্তু হয়ে আছে। কোনও রেকর্ড নেই এর, নেই সাক্ষী বা তথ্য-প্রমাণ। অথচ এই বৃদ্ধা চোখের পলকে নির্দিষ্ট সাল-তারিখ বলে দিলেন!

‘সেনিয়র?’

‘দুঃখিত,’ তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিল রানা। ‘তো যা বলছিলাম, পরবর্তী প্রায় দুই দশক ধরে কাউণ্ট বারেমি এবং তাঁর কাউন্সিল বিতর্কের বিষয়বস্তু হয়ে থেকেছে…

সহজ ভাষায় ফেনিস সম্পর্কে যা যা জানে খুলে বলল ও। এ-ও জানাল, বিশেষজ্ঞরা সংঘটাকে স্রেফ মিথ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

‘তুমি কী বিশ্বাস করো, সেনিয়র?’ ওর কথা শেষ হলে বললেন বৃদ্ধা। ‘এ-প্রশ্নটা শুরুতেই তোমাদেরকে করেছি আমি।’

‘কী বিশ্বাস করব, জানি না,’ বলল রানা। ‘তবে চারদিন আগে আমার খুব প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় একজন মানুষের প্রাণনাশ করবার চেষ্টা চালানো হয়েছে। এখনও তিনি মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। ফেনিস সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছিলেন তিনি, সম্ভবত ওটাই তাঁর অপরাধ।‘

‘মাত্র চারদিন আগে?’ বললেন বৃদ্ধা। ‘কিন্তু তুমি তো বলছিলে ওরা মাত্র বিশ বছর সক্রিয় ছিল। এরপর কী ঘটেছিল? মাঝে তো অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে।’

‘আমরা যদ্দূর জানি…. আর যদ্দূর আন্দাজ করতে পারি, তা হলো—কাউণ্ট বারেমির মৃত্যুর পর কর্সিকা থেকে ছড়িয়ে পড়ে ফেনিস। বার্লিন, লণ্ডন, প্যারিস, নিউ ইয়র্ক-সহ দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে কাজ চালিয়ে যায় ওরা। তবে পঞ্চাশের দশকের। মাঝামাঝি থেকে থিতিয়ে আসে ওদের কর্মকাণ্ড, ষাটের দশক যখন শুরু হলো, তখন থেকে আর চিহ্ন পাওয়া যায়নি ওদের।’

অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঠোঁট বেঁকে গেল বৃদ্ধার। ‘বলতে চাইছ, এতদিন পর আবার বাতাস থেকে উদয় হয়েছে ওরা?’

‘ব্যাপারটা সে-রকমই দেখাচ্ছে,’ বলল রানা। ‘আমার সঙ্গী ওটা ভালমত ব্যাখ্যা করতে পারবে।’

কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল কুয়াশা। বলল, ‘গত কিছুদিনে আমেরিকা এবং রাশায় দু’জন গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব খুন হয়েছেন। দু’জনেই ছিলেন শান্তিকামী; অরাজকতা এবং অস্থিরতার ঘোর বিরোধী। একটা খুনের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছি আমি, তাতে জানতে পেরেছি—ফেনিসের সদস্য হতে রাজি না হওয়ায়…. ফেনিসের ব্যাপারে মুখ খোলার চেষ্টা করায় খুন করা হয়েছে ওই দু’জনকে। যে-লোক আমাকে এই তথ্য দিয়েছে, সে খুবই বিশ্বাসযোগ্য। অপরাধ জগতের খোঁজখবর তার চাইতে বেশি আর কেউ জানে না…’

‘ঠিক কী বলেছে সে তোমাকে?’ জিজ্ঞেস করলেন বৃদ্ধা।

‘বলেছে যে, ফেনিসের কাউন্সিল আজও টিকে আছে। ধ্বংস হয়নি ওরা, আণ্ডারগ্রাউণ্ডে চলে গিয়েছিল বহু বছরের জন্য। সেখান থেকে ধীরে ধীরে প্রসারিত করেছে নিজেদেরকে, সারা দুনিয়ার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুগুলোতে নিজস্ব চর ঢুকিয়েছে। ওর মতে গত কয়েক বছরে যত ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, সবকিছুর পিছনে মদদ ছিল ফেনিসের। ওরা নাকি এখন আর টাকার বিনিময়ে মানুষ খুন করছে না, করছে নিজেদের ইচ্ছা অনুসারে… নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য।’

‘কী সেই লক্ষ্য?’

‘জানে না ও। শুধু জানে, দুষ্ট এক ক্ষতের মত সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে ফেনিস। কিন্তু কীভাবে তাকে দমন করা যাবে, কার কাছে গেলে তথ্য পাওয়া যাবে… এসবের কিছুই বলতে পারেনি আমাকে। যদ্দূর বুঝতে পেরেছি, ফেনিসের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা কখনও মুখ খোলার সুযোগ পায় না।’

‘তারমানে কাজে লাগার মত কিছুই তোমাকে বলেনি সে?’

‘স্রেফ একটা ধারণা… কর্সিকায় আসতে বলেছে আমাকে এখানে নাকি জবাব পাওয়া যেতে পারে। ওর কথা বিশ্বাস করেছি আমি… এই যে, আমার বন্ধু রানাকে নিয়ে এসেছি ব্যাপারটা যাচাই করতে।’

‘তোমার বন্ধু কেন এসেছে, তা তো জেনেছি। ওর শ্রদ্ধেয় এক মানুষের উপর হামলা চালানো হয়েছে। কিন্তু তুমি এসেছ কেন?’

‘একই কারণ, ম্যা’ম। রাশায় যিনি খুন হয়েছেন, তাঁকে আমি খুব শ্রদ্ধা করতাম।’

নীরবতা নেমে এল কামরায়। কী যেন ভাবলেন বৃদ্ধা, তারপর ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘পাদ্রোনি ফিরে এসেছেন!’

‘ব্যাখ্যা করুন কথাটা,’ বলল কুয়াশা। ‘আমরা তো কিছুই রাখঢাক করিনি আপনার কাছে।’

‘তোমাকে যে-লোক এতসব কথা বলেছে, সে কি বেঁচে আছে?’ জিজ্ঞেস করলেন বৃদ্ধা। মনে হলো জবাবটা জানা আছে তাঁর।

‘না,’ বিস্মিত গলায় বলল কুয়াশা। ‘আমার সঙ্গে কথা শেষ হবার আগেই খুন করা হয় ওকে। আমি কোনোরকমে পালিয়ে বেঁচেছি।’

‘ওকে কি আতঙ্কিত মনে হয়েছে তোমার কাছে?’

‘হ্যাঁ… কিন্তু এসব প্রশ্ন কেন?’

‘আমার পাদ্রোনি ওর মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিলেন।

‘মাফ করবেন, তবে ওই লোক কাউণ্ট বারেমিকে চিনত বলে মনে হয় না।’

‘পাদ্রোনিকে না চিনুক, তাঁর শিষ্যদেরকে তো চিনত! ওটাই যথেষ্ট। শিষ্যদের মাঝেই বেঁচে আছেন তিনি। ওদের জন্য তিনি ছিলেন যিশু… আর যিশুর মত শিষ্যদের জন্য তিনিও জীবন দিয়েছিলেন।

‘আপনার পাদ্রোনিকে ঈশ্বর ভাবত ওরা?’ চমকে উঠল রানা।

ঈশ্বর… নবী… স-অ-ব! অন্ধ বিশ্বাস ছিল ওদের।’ জানালেন বৃদ্ধা।

‘কীসের বিশ্বাস?’

‘এ-ই যে, একদিন ওরা পৃথিবীর মালিক হবে। প্রতিশোধ নেবে আমার পাদ্রোনির হয়ে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *