পাকিস্তানে খুন
পাকিস্তানে খুন কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। সুন্নিরা আহমদিয়া, শিয়া, বেলুচ, খ্রিস্টানদের মারছে। কারও সঙ্গে মতে মিলছে না তো মেরে ফেলছে। এই খুনখারাবির দেশে কোনও কোনও খুনের খবর পড়লে গা কেঁপে ওঠে। দীর্ঘশ্বাস বেরোয়। চোখে জল আসে। পাকিস্তানি খুনীরা দুদিন আগে মেরে ফেললো বহুমুখী প্রতিভার উজ্জ্বল তরুণী সাবিন মাহমুদকে।
সাবিন মাহমুদ অনেক কিছু নিয়ে মাথা ঘামাতেন। মানবতাবাদ, নারীবাদ, মুক্তচিন্তা, আর্ট কালচার। নিজে একটা ক্যাফে খুলেছিলেন, ক্যাফের সঙ্গে ছিল স্পেস। একটা জায়গা, যেখানে মানুষ আসবে, বিভিন্ন বিষয়ে তাদের ভিন্ন মত প্রকাশ করবে। যেখানে আবার চিত্রপ্রদর্শনীও হবে। জায়গাটার নাম দিয়েছিলেন দ্য সেকেন্ড ফ্লোর। নিজে সেতার বাজাতেন। বড় মিউজিক ফেস্টিভ্যালের আয়োজক ছিলেন। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটা দলও গড়ে তুলেছিলেন। এই সাবিন মাহমুদকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে।
সমাজের জন্য ভালো কাজ করলে কিছু না কিছু শত্রু জন্মায়। সাবিন মাহমুদের শত্রু অল্প বিস্তর ছিল। ভ্যালেন্টাইনস ডে করতে দেবে না বলে করাচির মুসলিম মৌলবাদিরা লাফালাফি করলে সাবিন মাহমুদ ওদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। আর বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী মামা আবদুল কাদিরকে তাঁর নিজের গড়ে তোলা দ্য সেকেন্ড ফ্লোরএ কথা বলার সুযোগ দিয়ে জাতীয়তাবাদীদের সেদিন শত্রু বানালেন। মামা আবদুল কাদির হারিয়ে যাওয়া বেলুচদের খোঁজ পাওয়ার জন্য আন্দোলন চালাচ্ছেন। ওই হারিয়ে যাওয়াদের মধ্যে নিজের পুত্রও ছিল। ২০০৯ সালে হারিয়ে যাওয়া পুত্রকে দুবছর পর উদ্ধার করেন। তবে অক্ষত এবং জীবিত অবস্থায় নয়। শরীর ছিন্নভিন্ন, মৃত। পাক আর্মির লোকেরা বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এভাবেই তুলে তুলে নিয়ে মেরে ফেলে। ওদের অভ্যেস আছে কাউকে পছন্দ না হলে মেরে ফেলা। সাংবাদিকরাও অনেকে এভাবে মারা পড়েছে। বেলুচদের ওপর পাক আর্মির অত্যাচারের প্রতিবাদে আবদুল কাদির ১২০০ মাইল হেঁটেছিলেন বেলুচ রাজধানী কেটা থেকে ইসলামাবাদ পর্যন্ত। সরকারের চক্ষুশূল এই ৭৩ বছর বয়সী বৃদ্ধ মামা আবদুল কাদির। সরকার একবার তাঁকে আমেরিকা যেতে দেয়নি, আমেরিকায় মানবাধিকার বিষয়ে এক সেমিনারে অংশ গ্রহণ করার কথা ছিল তাঁর। এ মাসেই লাহোর বিশ্ববিদ্যালয় একটা অনুষ্ঠান বাতিল করে দিতে বাধ্য হয়েছে, যে অনুষ্ঠানে আবদুল কাদিরের অংশগ্রহণ করার কথা ছিল। বেলুচিস্তানকে কথা বলতে দাও- এই বিষয়ে যে সেমিনার হচ্ছিল দ্য সেকেন্ড ফ্লোরে, সেই সেমিনার সম্পর্কে মিডিয়াকে বলে দেওয়া হয়েছিল লেখালেখি না করতে। খুব বেশিদিন আগের ঘটনা নয়, কাদিরকে নিয়ে পাক আর্মির সঙ্গে টিভির সাংবাদিক হামিদ মীর তর্ক করার পর হামিদ মীরকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়।
বেলুচিস্তান আলাদা হয়ে গেলে পাকিস্তানের চলবে না। ওখানকার খনিজপদার্থ পাকিস্তানের দরকার। আর চীনের সঙ্গে বেলুচিস্তানের ওপর দিয়ে করিডোর বানানোর হাজার কোটি টাকার চুক্তিও হয়ে গেছে। কট্টর জাতীয়তাবাদিরা পাকিস্তান আবার বিভক্ত হোক চায় না। পূর্ব পাকিস্তানের আলাদা হয়ে যাওয়া এখনও তাদের অশান্তি দেয়। অনুমান করতে পারি, এই কট্টর জাতীয়তাবাদী কারা। পাক আর্মির ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টিলিজেন্স। নটোরিয়াস আইএসআই।
সাবিন মাহমুদ সবে বেলুচিস্তানের ওপর একটা সেমিনার থেকে বেরোচ্ছিলেন, ওই দ্য সেকেণ্ড ফ্লোর থেকেই বেরোচ্ছিলেন, গাড়িতে উঠবেন, তখনই পাঁচটা বুলেট এসে লাগে ওঁর শরীরে। আমি ঠিক বুঝে পাচ্ছি না, কাদিরকে খুন না করে সাবিনকে কেন খুন করা হয়েছে। কাদিরকে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর কারণেই যদি আততায়ীর রাগ সাবিনের ওপর পড়ে, তবে কাদির বেলুচিস্তানকে আলাদা করতে চাইছে, কাদিরই যত নষ্টের মূল, এই নষ্টের মূলটাকে মেরে ফেললেই তো ল্যাঠা চুকে যেতো, তাকে কোনও অনুষ্ঠানে কেউ আর ডাকতে পারতো না। ৭৩ বছর বয়সের এই বৃদ্ধকে যখন খুশি, যেভাবে খুশি মেরে ফেলা তো আইএসআইএর জন্য মোটেও কঠিন কোনও কাজ নয়।
সাবিন মাহমুদের কথা ভাবছিলাম আর ভাবছিলাম বাংলাদেশের রাজিব হায়দার, অভিজিৎ রায় আর ওয়াশিকুর বাবুর কথা। পাকিস্তানে এখনও গুলি করে মারা হয়। বাংলাদেশে আজকাল মারা হয় কুপিয়ে। অভিজিৎ আর ওয়াশিকুর ইন্টারনেটের মাধ্যমে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছিলেন সমাজ পরিবর্তনের জন্য। সাবিনের স্বপ্ন ছিল ইন্টারনেটের মাধ্যেম সমাজ পরিবর্তন করবেন। মাঠঘাটের অ্যাকটিভিস্টদের না হয় সহ্য হয়, এই ড্রিমারদেরই কিছুতেই সহ্য হয় না প্রতিক্রিয়াশীল রক্ষণশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর। অ্যাকটিভিস্টদের হুমকি দিলে হয়তো মৃত্যুভয়ে পিছিয়ে যাবে। ড্রিমারদের পিছু হঠানো, ভয় পাওয়ানো সম্ভব নয়। ড্রিমাররা তাদের স্বপ্ন ছড়িয়ে দেন অন্যদের মধ্যে। অন্যরাও স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।