2 of 3

টুকরো ভাবনা

টুকরো ভাবনা

১.

আমরা ব্যারিকেড দিয়ে, কাঁটাতার লাগিয়ে, দেয়াল তুলে ভাগ করে দিই মাটি, ভাগ। করি মানুষ। এক ভূমিকম্পই আসে আমাদের বুঝিয়ে দিতে যে আসলে আমরা এক মাটির মানুষ।

মানুষ যে কত অসহায় প্রাণী, তা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় সবচেয়ে বেশি বোঝা যায়। বুলড্রেজার যেমন পিঁপড়ের ঢিবিকে পিষে যাওয়ার সময় লক্ষ পিঁপড়েকে মেরে ফেলে, ভূমিকম্পও মানুষকে তেমন পিঁপড়ের মতোমারে। নেপালের ভূমিকম্পে আপাতত ৫ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে,সংখ্যাটা নাকি বেড়ে ১০,০০০ অবধি যেতে পারে।

এই একবিংশ শতাব্দীতে, এই বিজ্ঞানের যুগেও মানুষ প্রকৃতিক বিপর্যয়গুলো ঈশ্বর প্রদত্ত বলে মনে করে। ধ্বসের ভেতর থেকে কেউ বেঁচে বেরোলে বলা হয় এ নাকি ঈশ্বরের মহানুভবতা। সেই একই ঈশ্বর যে ভূমিকম্প দিলো, হাজারো প্রাণ নিয়ে নিলো, হাজারো নিষ্পাপ শিশুর প্রাণ, সে কারণে ঈশ্বরকে দোষ দেওয়া হয় না কেন আমি বুঝি না। গির্জায় প্রার্থনা হচ্ছে। মন্দিরে মন্দিরে দুগর্তদের জন্য পুজোর আয়েজন হচ্ছে। গ্যালন গ্যালন দুধ ঢালা হচ্ছে পুজোয়। দুধ যদি নেপালের শিশুদের দেওয়া হতো, যদি পুজোর বদলে টাকা পয়সা পাঠিয়ে দেওয়া হতো ভূমিকম্প আক্রান্তদের, তবে সত্যিকার লাভ হতো। এইসব প্রার্থনা তো, বারবার প্রমাণিত হয়েছে, যে, চরমভাবে ব্যর্থ।

ভূমিকম্প, শুনেছি, অনেকে নাকি টের পায় না। ভূমিকম্প হয়েছে, আর আমি টের পাইনি, খুব কমই ঘটেছে। টের পাওয়াটা একেক জনের বেলায় একেক রকম। কিছু লোক আছে আবার বেশি টের পায়। ভূমিকম্প না হলেও বলে, ভূমিকম্প। ছোটবেলায় আমার বাবা শিখিয়েছিলেন, ভূমিকম্প হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে, খোলা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে, ভূমিকম্প মানুষকে মারে না, মারে ঘরবাড়ির ধ্বস।

বাবার কথাটা প্রতিবারই স্মরণ করি, যখন ভূমিকম্প হয়। কিন্তু দৌড়ে ঘর থেকে একবারও আমার বেরোনো হয় না। ঘরেই হাঁটাহাঁটি করি আর ভাবি, শুধু শুধু দৌড়োদৌড়ির কী দরকার, এই তো কম্পন থেমে যাচ্ছে বা যাবে। ভূমিকম্প কোনও ক্ষতি করতে পারবে না, এমনভাবে দালানকোঠা বানানো হচ্ছে আজকাল। অবশ্য বানানো হচ্ছে ধনী দেশে। গরিব দেশ ওসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। যেন তেন ভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেই হলো। সে কারণে ধনী দেশে বড় ভূমিকম্প হলেও মানুষ বেঁচে যায়, আর গরিব দেশের ছোট ভূমিকম্পও মানুষকে রেহাই দেয় না। ঠিক এভাবেই বন্যা হলে গরিব দেশে লোক মরে, ধনী দেশ দিব্যি সামলে নেয়। অর্থনৈতিক দারিদ্রই যে সব কিছুর মূলে, তা নয়। চিন্তার দারিদ্র, সতোর দারিদ্রও বড় কারণ। গরিব দেশের মানুষকে গরিব-ধনী কোনও দেশই মূল্যবান বলে মনে করে না! মৃত্যু নিয়ে যারা রাজনীতি করে, তারা মৃত্যু রোধ করতে চায় না।

নাহ, এরপর ভূমিকম্প হলে ঠিক ঠিক ঘর থেকে বেরিয়ে যাবো। খোলা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবো। বাবা যেভাবে শিখিয়েছিলেন। আলসেমি করবো না। অপেক্ষা করবো না। জীবন তো একটাই। জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কী আছে। একে হেলায় হারানোর কোনও মানে নেই। যদি খোলা জায়গায় দাঁড়াবার পর দেখি ভূমিকম্প থেমে গেছে! যাক না। আক্ষেপ করার কী আছে! আমাদের কি খুব বেশি খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে খোলা আকাশ দেখার সুযোগ হয়? মাঝে মাঝে ভূমিকম্প এসে যদি সেই সুযোগটা করে দেয়, মন্দ কী!

ছোটবেলায় আমরা একতলা বাড়িতে থেকেছি। দরজাগুলো হাট করে খোলাই থাকতো বেশির ভাগ সময়। দৌড়ে বাইরে বেরোতে সময় লাগতো না। আজকাল উঁচু উঁচু দালানে বাস করে মানুষ। লিফট ব্যবহার করা যাবে না। হেঁটে হেঁটে তেইশ তলা বা বারো তলা থেকে নামা চাট্টিখানি কথা নয়। এখন তো বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঘরেই মুখ মাথা ঢেকে টেবিলের তলায় চলে যাও, কাঁচের জিনিসপত্তর থেকে দূরে থাকো। অথবা শক্ত দুদেয়ালের কর্নারে দাঁড়িয়ে থাকার। কী জানি, এসবে কতটুকু শেষ পর্যন্ত প্রাণ রক্ষা হয়। এ অনেকটা উড়োজাহাজের আশ্বাসের মতো, দুর্ঘটনা ঘটলে অক্সিজেন মাস্ক পরো, লাইফ জ্যাকেট পরে লাফ দাও, ওই করে কজন লোক আসলে বাঁচে! টেবিলের তলা একা কি কাউকে বাঁচায়, তলায় যেতে হয় মাথায় হেলমেট পরে যাওয়াই হয়তো ভালো, কষ্টেসৃষ্টে মাথাটা বাঁচাতে পারলে, আর খুব অতলে তলিয়ে না গেলে বাঁচার সম্ভাবনাটা হয়তো কিছুটা থাকে। মানুষের জীবন আরশোলাদের জীবনের চেয়েও নড়বড়ে। ভূমিকম্প ঢুমিকম্প কোনও আরশোলাকে এতটুকু কাঁপাতে পারে না।

২.

শুনেছি ভোট কারচুপি হয়েছে বাংলাদেশে। কারচুপি হলেই বা কী হলেই বা কী? সেই তো থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়। যেই বসুক গদিতে, দেশটাকে নষ্ট করা ছাড়া কি তাদের আর কোনও কাজ আছে? মানুষও ঠিক জানে সব দলের চরিত্র এক। মানুষ আসলে ভোট দেয় তাকে যার চরিত্র কিছু কম নষ্ট, যে কিছুটা কম সন্ত্রাসী। আর যারা এর মধ্যে সন্ত্রাসে বেশ হাত পাকিয়েছে, তারা খুব স্বাভাবিকভাবেই সন্ত্রাসে বেশি মদত দেওয়া দলটিকে জেতাতে চায়।

ভোট টোটের নিয়ম বন্ধ করে দিলেই হয়। অ্যানার্কি সৃষ্টি হবে? অ্যানাকি কি চলছে না?একটা সময় দেশের নড়বড়ে অবস্থা দেখে বলতাম, কামাল পাশার মতো একটা সেকুলার ডিক্টেটর চাই। এখন আর বলি না। গণতন্ত্রের বারোটা বেজেছে বলে তো ডিক্টেটরশিপ চাইতে পারি না। তারচেয়ে গণতন্ত্রের নামে দেশে যা হচ্ছে হোক। দেশটা গোল্লায় যাবে, নয়তো ধর্মতন্ত্র দেশটাকে একদিন গিলে খাবে। ধর্মতন্ত্রই দেশকে নিয়ে যাবে একনায়কতন্ত্রের দিকে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ রুখে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে আছে যুগের পর যুগ। এভাবেই বাস করে অভ্যেস হয়ে গেছে। তারা রুখে তো দাঁড়ায়ই না, দেয়ালে পিঠ না থাকলেই বরং বিস্মিত হয়।

৩.

অসুখ হলে মা বাবার জন্য বড় ব্যাকুল হই। আজ সারাদিন জ্বর, গাব্যথা, বমি। সারাদিন চেয়েছি একটি হাত কপাল স্পর্শ করুক। জ্বর দেখুক। জ্বরের ঘোরে বারবার এপাশ ওপাশ করেছি। জ্বর হলে মা কপালে জলপট্টি লাগিয়ে দিত। খাটের কিনারে মাথাটা রেখে, পিঠ আর মাথার তলায় একটা অয়েলক্লথ বিছিয়ে অনেকক্ষণ মাথায় জল ঢালত। জল গুলো বালতিতে পড়ত, সেই বালতির জল আবার মাথায় ঢালত, এইভাবে কতক্ষণ যে মা জল ঢালত! মার কোনো ক্লান্তি ছিল না! জ্বর হলে পাশে বসে গায়ে হাত বুলিয়ে দিত বাবা আর ওষুধ গেলাত। জ্বর হলে আমি উদ্বিগ্ন হইনি কখনো, হয়েছে আমার মা বাবা। আমার অসুখ দ্রুত সারিয়ে তুলত আমার মা বাবা। এখন মা নেই, বাবাও নেই। এখন একা একাই অসুখে ভুগি। কেউ নেই কপাল স্পর্শ করে জ্বর দেখার, গায়ে হাত বুলোবার, কেউ নেই কপালে জলপট্টি দেওয়ার, কেউ নেই মাথায় জল ঢালার। ছোটবেলাটা বড় ফিরে পেতে ইচ্ছে করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *