গল্প - রেবন্ত গোস্বামী
ছড়া - রেবন্ত গোস্বামী
সাক্ষাৎকার

সুমন

সুমন

০১.

এক চাকা-লাগানো চেয়ারটা চালিয়ে ঘর থেকে বাইরে রেলিং-ঘেরা টানা বারান্দাটায় এসে অনিকেত দেখল, সুমন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে। বুঝতে পারল, সুমনের মনের যে ভাবান্তর ইদানীং দেখা দিয়েছে, সেটা দিন দিন বেড়েই চলেছে। অনিকেত ডাকতেই সুমন পেছন ফিরল। তাকে দেখে লজ্জা পেয়ে কাছে এল। বলল, তুই আবার নিজে নিজে চেয়ার ঠেলে এলি কেন? আমাকে ডাকলেই তো পারতিস।

অনিকেতের অভিমান হল প্রথমে। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিল সে। ভাবল, কার ওপর সে অভিমান করছে। একটা

সে বলল, তুই যে সবসময় মন খারাপ করে থাকিস, সেটা আমি এই ক্ষীণ দৃষ্টিতেও বুঝতে পারি, সুমন। দুর্ঘটনায় আজ আমি পঙ্গু। চোখের দৃষ্টিও প্রায় নেই বললেই চলে। বাবা-মা-বোন সবাই মারা গেল সেই দুর্ঘটনায়। সাত্যকি জেঠুর চেষ্টায় আমি বাঁচলাম। অনাত্মীয় অসহায় আমাকে নিজের বাড়িতে এনে রাখলেন। কিছুকাল পরে হয়তো দেখতেও পাব, চলতেও পারব। কিন্তু ফিরে পাব কি বাবা-মা আর বোনটিকে! আমার মন খারাপ না হয়ে হচ্ছে তোর। আমার মন ভালো রাখার জন্য সাত্যকিজেঠু সর্বক্ষণের সঙ্গী করে তোকে আমার কাছে রেখেছেন। কিন্তু সে আমার মন ভালো করবে কী? নিজেই সে

অনিকেত চুপ করল। সুমন তার হাত দুটো ধরে বলল, কিছু মনে করিস না ভাই। আর কখনও আমি তোকে ছেড়ে দূরে থাকব না। তবে আমার কথাটাও একবার ভাবলে তুই আমার ওপর রাগ করে থাকতে পারবি না। তোর মনে তোর বাবা-মা-বোনের স্মৃতিটুকু আছে। কিন্তু আমি মনে করতে পারছি না আমার বাবা-মা-র কথা। ভাইবোন ছিল কি না বা আছে কি না তা-ও জানি না। দু-বছর আগের কোনও কথাই আমার মনে নেই। অথচ সাত্যকিজেঠু বলেন আমার বয়স তোর সমান, অর্থাৎ আঠারো হবে।

অনিকেত বলল, তোরও জীবনে আমার মতন কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছিল। তাতে শারীরিক ক্ষতি যত-না করেছে, মস্তিষ্কের ক্ষতি করেছে তার চাইতে বেশি। সম্পূর্ণ স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে। সাত্যকিজেঠু অনেক চেষ্টা করেছেন তোর বাবা-মা-র খোঁজ করতে। টেলিভিশনে, কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন তোর ছবি দিয়ে। কিন্তু কোনও সাড়া পাননি। হয়তো দুর্ঘটনায় তুই ছাড়া সবাই মারা গিয়েছেন। আর স্মৃতি হারিয়ে তুই ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছিলি অনেক দূরে। পুলিশ বিভাগের সম্মতি নিয়ে সাত্যকিজেঠু তোকে এখানে এনে রেখেছেন। তবে চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন এখনও। একদিকে তোর আত্মীয়স্বজনের খোঁজে, অন্যদিকে তোকে সুস্থ করার।

সুমন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বিরস মুখে বলল, সাত্যকিজেঠু কীভাবে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, জানি না। আমার চোখে তা একদিনও পড়েনি। নইলে একবিংশ শতকে এরকম বিজ্ঞানসম্মত দক্ষ পুলিশ বিভাগ।

অনিকেত রাগত স্বরে তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল, তুই কী বলছিস, সুমন! সাত্যকিজেঠু সম্বন্ধে এ কথা বলতে পারলি? তিনি কি চান না যে, তুই তোর নিজের বাড়ি ফিরে যাস! তুই যাতে স্মৃতি ফিরে পাস, তোর পাকস্থলী যাতে সুস্থ হয়ে ওঠে, তার জন্যে কত বড় বড় ডাক্তার বাড়িতে এনে দেখাচ্ছেন, সে তো তুই জানিস।

সুমন ভারাক্রান্ত মনে বলল, বাবার কথা আমার মনে নেই। কিন্তু সাত্যকিজেঠুর কাছ থেকে যে স্নেহ পেয়েছি, তাতে বাবার ধারণা কিছু পাই। আচ্ছা অনু, সাত্যকিজেঠু তোকে যেমন রক্-ডাক্তার দিয়ে দেখান, আমার বেলায় তা করেন না কেন? শুধু তাঁর পরিচিত মানুষ-ডাক্তারই আমাকে দেখেন।

অনিকেত বলল, র-ডাক্তার মানে রোবট চিকিৎসকের কথা বলছিস? সাত্যকিজেঠুর ধারণা, ওরা মনের চিকিৎসা ঠিকমতো করতে পারে না। হাজার হোক, যন্ত্র তো?

সুমন আনমনে বলতে থাকে, সাত্যকিজেঠু আর তুই বলিস, আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অথচ গত দু-বছরের সব খুঁটিনাটি আমার মনে আছে। দু-বছরের যে কোনও তারিখে কী বার ছিল, আমাকে জিজ্ঞেস কর, আমি বলে দেব। গত বছর শীতে সবচেয়ে ঠান্ডা পড়েছিল চোদ্দোই জানুয়ারি–আট দশমিক নয় সেলসিয়াস। ভোর তিনটে তেরো মিনিটে। সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে–

অনিকেত তাকে থামানোর চেষ্টা করে বলল, সুমন, তোকে বলেছি–

অনিকেতের কথা কানে গেল না সুমনের। সে সামনের দিকে তাকিয়ে একমনে বলে যেতে লাগল, তা ছাড়া, যে-কোনও বিষয়ে যা জেনেছি, কিছু ভুলিনি। যেমন ধর, যন্ত্রপাতি সমেত ভারতের প্রথম উপগ্রহ আর্যভট্টর ওজন ছিল তিনশো ষাট কিলোগ্রাম। শুধু উপগ্রহটির ওজন অবশ্য তার সিকি ছিল–নব্বই কিলোগ্রাম। লেসার শব্দটার পুরো অর্থ হল লাইট অ্যামপ্লিফিকেশন বাই স্টিমুলেটেড এমিশন অব রেডিয়েশন। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির জন্ম ১৪৫২ খ্রিস্টাব্দে। মৃত্যু সাতষট্টি বছর বয়সে ১৫১৯-এ। তাঁর মোনালিসা ছবিটি লম্বায় তিন ফুট, চওড়ায় আড়াই ফুট। ক্যালশিয়ামের পারমাণবিক ওজন চল্লিশ দশমিক শূন্য আট। মস্তিষ্কের পেছনের ছোট অংশের নাম সেরিবেলাম আর ওপরের বড় অংশের নাম সেরিব্রাম। মালকোশ রাগে রে আর পা–এই দুটো স্বর বাদ। জীর্ণ পোশাক পরিত্যাগ করে নতুন পোশাক পরার মতো আত্মা এই দেহ ত্যাগ করে–ইত্যাদি ইত্যাদি বড় বড় কথা আছে গীতার সাংখ্যযোগে বাইশ নম্বর শ্লোকে। আব্রাহামের পুত্র আইজ্যাক, তার পুত্র জ্যাক, তস্য পুত্র জুডাস আর তার ভ্রাতৃগণ। আজানের মন্ত্রের অর্থ–ওহে যে যেখানে আছ–

চেয়ারের হাতলে ঘুসি ঠুকে প্রচণ্ড স্বরে ধমক দিয়ে অনিকেত বলল, সুমন, আমি জানি তুই মহাপণ্ডিত। আমি কিছুই শিখতে পারিনি। দুর্ঘটনার পরে সব পড়াশোনাও বন্ধ। তা-ই বলে আমাকে ছোট করার জন্যে

সুমন লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে বলল, না রে অনু, আমি তোকে শুধু বলতে চাইছিলাম, সব কিছু যখন মনে রাখতে পারি, তবে কেন মন থেকে মুছে গেল জীবনের প্রথম ষোলোটা বছর?

অনিকেত সুমনকে শান্ত করার জন্য পিঠে হাত রেখে বলল, সাত্যকিজেঠু তো বলেছেন তোকে, এটা এক ধরনের প্যারামনেশিয়া। জীবনের কিছু অংশ মুছে যায় আমার বাঁ চোখের দৃষ্টির মতন।

অনিকেত জানে, তার নিজের দুঃখের কথার উল্লেখ সুমন সহ্য করতে পারে না।

ঠিক তা-ই। সুমন নিজের কথা ভুলে গিয়ে অনিকেতকে তিরস্কার করে বলল, আবার তুই নিজের পঙ্গুতার কথা তুলছিস? এসব শুনতে আমার বুঝি খুব ভালো লাগে? আচ্ছা বাবা আচ্ছা, আমি আর কখনও নিজের অতীতের কথা তুলব না। অনু, সাত্যকিজেঠু বলেছেন, তুই আস্তে আস্তে সেরে উঠবি। তখন তো আর এই ঘরে আটকে থাকবি না। আমারও প্রয়োজন হবে না। তখন নিশ্চয় আমাকে ছেড়ে চলে যাবি। আমি তো চিরপঙ্গু। হাঁটতে পারলেও রাস্তায় একা যেতে দেন না সাত্যকিজেঠু।

অনিকেত সুমনের পিঠে ছোট্ট চাপড় মেরে বলল, সাত্যকিজেঠু বলেন, তোর এই স্মৃতি নষ্টের ব্যাপারটা তো বাইরের লোকে জানে না। পাছে কেউ তোকে ঠাট্টাবিদ্রূপ করে –বিশেষ করে ছোট ছেলেমেয়েরা, সেটা সাত্যকিজেঠু সহ্য করতে পারবেন না। তবে আমি ভালো হয়ে গেলে, আমার সঙ্গে তুই সব জায়গায় যাবি.. যাক গে ওসব কথা। তুই সেই কবিতাটা আবৃত্তি করে শোনা তো–হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস।

কিছুক্ষণের মধ্যেই কবিতায়-গানে ভেসে গেল এতক্ষণের দুঃখবেদনার ভারী মেঘটা।

.

০২.

 দু-দিন পরে শোয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই রাত্তিরে ঘুম ভেঙে গেল সুমনের। অনিকেতের খাট থেকে সামান্য শব্দ হলেই তার ঘুম ভেঙে যায়। চেয়ে দেখল, অনিকেত গভীর ঘুমে। ঘড়িতে দেখল, রাত মাত্র সাড়ে এগারোটা। সে উঠে দাঁড়িয়ে খোলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে রক্-ট্রাফিক পুলিশ। সারারাত থাকবে। দেখবে, কেউ বেআইনিভাবে গাড়ি চালাচ্ছে কি না। ক্লান্তি নেই, ঘুম নেই, ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই। সুমন ভাবল, তার নিজেরও তো ক্ষুধা-তৃষ্ণা নেই। অনিকেত রোজ খাওয়াদাওয়া করে। কিন্তু সে নিজে মাঝে মাঝে জল পান করলেও শুধু ক্যাপসুল খায়। সাত্যকিজেঠু বলেন, এতেই তার কাজ হবে। দুর্ঘটনায় তার পরিপাকযন্ত্র নষ্ট হয়ে গিয়েছে, তাই অন্য কোনও খাদ্য চলবে না। ঘুমন্ত অনিকেতের দিকে তাকিয়ে সুমন হাসল, ভাবল, পঙ্গুতে পঙ্গুতে মাসতুতো ভাই। রাস্তার ওপারে চোখ পড়তে সুমন দেখল, নিয়ন লাইটে লেখার-সাইকো ক্লিনিক। অর্থাৎ রোবট ডাক্তার দিয়ে মানসিক রোগের চিকিৎসা করা হয়। কত ফি নেয় ওরা?

এ ঘর থেকে টেলিফোন করলে পাছে অনিকেত জেগে ওঠে, তাই পাশে সাত্যকিজেঠুর ঘরে চলে এল সে। সাত্যকিজেঠু এখন গবেষণাগারে। ঠিক রাত একটা পর্যন্ত কাজ করবেন সেখানে।

কম্পিউটার টেলিফোন ডাইরেক্টরিতে ভাস্করাচার্য অ্যাভিনিউয়ের রসাইকো ক্লিনিকের নম্বর বের করা থেকে টেলিফোন করতে কয়েক সেকেন্ড মাত্র লাগল। রোবট রিসেপশনিস্টই ধরল। সুমন জানল, ক্লিনিক রাত একটা পর্যন্ত খোলা থাকবে। ফি কত লাগবে, সেটাও জেনে নিল।

তারপর ঘরে এসে অনিকেতের ড্রয়ার থেকে টাকা বের করে নিয়ে পকেটে রাখল। কাজটা অন্যায় বলে তার মনে হল না। সেরকম কোনও ধারণা তার মনে গড়ে ওঠেনি কোনও দিন। অনিকেত তো তার একাত্ম বন্ধু। টাকাগুলো তার বা অনিকেতের কোনও কাজে লাগে না। তবুও সাত্যকিজেঠু দিয়ে রেখেছেন। বলেছেন, এর একটা মানসিক দিক আছে।

আবার মানসিক! সুমন মনে মনে হাসল। সেই মানসিক ব্যাপারেই তো টাকাটা নিচ্ছে সে।

পায়ে শব্দ না করে সুমন নীচে নেমে এল। সদর দরজার পাশে রোবট দারোয়ান দ্বারিকানাথ দাঁড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। সুমন হাসল–ঘোড়া কোথাকার! শুতে যাওয়ার আগে সাত্যকিজেঠু বোতাম টিপে একে জীবন্ত করে দেবে। এখন জেগে থাকলে আর দেখতে হত না। সুমনকে দেখে চ্যাঁচামেচি শুরু করত–এত রাতে বাইরে যাওয়ার কী দরকার? তুমি কি বাদুড়, না প্যাঁচা–অ্যাঁ? এইসব। সাত্যকিজেঠুর আরেক ঠোঁটকাটা রোবট নরোত্তমের কাছে সে এইসব চাঁচাছোলা বাক্যি শিখছে।

দরজা খুলে সুমন রাস্তায় নেমে পড়ল। আজ প্রথম সে একা একা বাড়ির বাইরে এল। মনের আনন্দে তার গান করতে ইচ্ছে করল। সাত্যকিজেঠুর বিলেতে থাকা নাতনির কাছে শোনা। সেই গানটা–সাত সাগরের ফেনায় ফেনায় মিশে আমি যাই ভেসে দূর দেশে…

ক্লিনিকে ঢুকতেই দেখল, রোবট রিসেপশনিস্ট বসে আছে চেয়ারে। টেবিলে টেলিফোন, কাগজ, পেনসিল। কাগজ-পেনসিল এগিয়ে দিতে সুমন তার নাম লিখল–সুমন গুপ্ত। পদবি জানে না বলে সাত্যকিজেঠু বলেছেন, তবে ওটা নিঃসন্দেহে গুপ্ত। জিজ্ঞেস করল, কত দেরি হবে, মিস্টার রব?।

রোবটটা এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল। তাকে দেখেই ব্যস্ততার ভান করে একটা খাতা খুলে পড়তে লাগল। অনিকেত বলে, অফিসের লোকরাও নাকি এরকম করে বাইরের লোক এলে। একটু পরে সুমনের দিকে চেয়ে রোবট রিসেপশনিস্ট বলল, এখনই দেখানো যাবে, আপনার রোগী নিয়ে আসতে পারেন।

সুমন হেসে বলল, আমিই রোগী, মিস্টার রব। না না, ওরকম উঠে দাঁড়াবেন না। মানসিক রোগী মাত্রই পাগল নয়। আসলে আমি স্মৃতিভ্রংশ…

তার কথা শেষ হল না। রোবটটা আস্তে আস্তে তার দিকে এগিয়ে এল। একটা ধাতুর লাঠি তুলে সুমনের বুকে-মাথায় ছোঁয়াল। তারপর হেসে বলল, আপনি ভুল করছেন। এখানে সবরকম মানসিক রোগের চিকিৎসা হয় ঠিকই, তবে মানুষের। আপনি বরং ইফতিকার রহমানের রোবোট্রনিক্স হসপিটালে নিয়ে যেতে আপনার মালিককে বলুন, মিস্টার রব্য।

সুমনের কান গরম হয়ে উঠল। বলল, আমাকে রব্ বলছেন কেন আপনি? আমি কি আপনার মতন রোবট?

হাতের রডটা তার দিকে এগিয়ে রোবটটা বলল, তবে কি মানুষ? এই দেখুন। আমার মালিক আমাকে মাঝে মাঝে বলেন, হায় রে কলি, কী বা বলি, গরুড় হবেন ফানুস, আর রোবট হবেন মানুষ! আপনারও দেখছি সেই অবস্থা। আরে ভাই, আমিও তো চাই মানুষের মতো আমাদের স্বাধীনতা হোক, সুখ-দুঃখ না কী সব বলে, সেগুলো হোক..

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই সুমন ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এল ডাক্তারখানা থেকে। রাস্তা-বাড়ি সব যেন ভূমিকম্পের মতো দুলছে, তার মনে হল। বুকের মধ্যে ক্যাথোড রশ্মির মতন কী যেন জ্বলে উঠে তার মন থেকে এত দিনের কুয়াশা সরিয়ে দিল। সব পরিষ্কার হল এত দিনে!

দুমদাম করে উঠে এসে সে সোজা গেল সাত্যকি সোমের গবেষণাগারে। পেছন ফিরে তাকে দেখে অবাক হলেন ডক্টর সোম। সুমন অশ্রুহীন চোখে বিকৃত গলায় কান্নার মতো অদ্ভুত আওয়াজ তুলে চেঁচিয়ে উঠল, কেন এত দিন মিথ্যে কথা বলেছেন সাত্যকিজেঠু? আমি একটা রোবট, সে কথা কেন বলেননি? কেন আমার মধ্যে দয়ামায়া, স্নেহ ভালোবাসা, দুঃখ-আনন্দ, বন্ধুত্ব-সমবেদনা এসব ভরে দিয়ে মন সৃষ্টি করেছেন? দয়া করে নষ্ট করে দিন সেটা। দয়া করুন, ডক্টর সোম!–এই বলে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে সাত্যকি সোমের পা। দুটো চেপে ধরল সে।

যন্ত্রের দুঃখ ডক্টর সোমের নিজের মধ্যেও সঞ্চারিত হল। তিনি বুঝতে পারলেন না, কীভাবে সুমন জানতে পারল। তবে কি অনিকেত বলে ফেলেছে কোনও অসতর্ক মুহূর্তে?

মন ঠিক করে ফেললেন তিনি। হ্যাঁ, নষ্ট করে দেবেন সুমনের মানসিক বৃত্তিগুলো। শুধু একটা ছোট্ট প্লাগ খুলে নিলেই হবে। সুমন পরিণত হবে একটা কাঠখোট্টা হুকুম তামিলের অটোম্যাটনেতে–যেমন দরজার পাশে দাঁড়ানো দ্বারিকানাথ।

সরু সন্নার মতন একটা কিছু নিয়ে তিনি এগিয়ে এলেন সুমনের কাছে। ঠিক এই সময় অনিকেতের ঘরে একটা শব্দ হতেই ভেতরের প্রবৃত্তি জেগে উঠল সুমনের। সে ছুটে চলে এল তাদের ঘরে। ডক্টর সোমও পিছুপিছু এলেন।

দেখলেন, অনিকেত খাট থেকে পড়ে গিয়েছে। তিনি এসে তাকে ধরার আগেই সুমন ছুটে এসে তাকে ধরে তুলল। সে ঘরে থাকলে অনিকেত নিজে থেকে উঠতে যেত না– এই চিন্তায় চোখ দুটো অনুতাপে কিছুক্ষণের জন্যে নীল হয়ে গেল। সে অনিকেতকে দু হাতে ধরে বলে উঠল, না, সাত্যকিজেই। সুমনের মনটা থাক। নইলে অনুর সঙ্গী হবে কে? কে তার সুখ-দুঃখ বুঝবে? ভালোই হল রে, অনু। তুই বলতে চাসনি, সাত্যকিজেঠু বলতে চাননি–তবু আমি জেনে গিয়েছি। দু-বছর আগেই আমার জন্ম। তার আগে কোনও অতীত নেই। আমার বাবা-মা-জেই–সবই উনি। আর ভাই বল, বন্ধু বল, সবই তুই। আর আমি কখনও মন খারাপ করব না। আমার ওই প্যারামনেশিয়া সেরে গিয়েছে। কী হল, ওরকম করে তাকিয়ে আছিস কেন অনু? ও কি জেঠু, আপনার চোখে কী হল?

সত্যিই ধরা পড়ে গেলেন সাত্যকি সোম তাঁরই তৈরি রোবটের কাছে। সেই কবে একমাত্র পুত্র আর স্ত্রী-কে হারিয়েছিলেন ডক্টর সোম। আজ এত বছর পরে তাঁর চোখ দুটো আবার হঠাৎ এই মাঝরাতে ঝাপসা হয়ে গেল। কুয়াশাভরা দৃষ্টিতে তিনি দেখলেন, তাঁর তৈরি স-মন রোবট সুমনের মুখ থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে ভেতরের লিউমেন ইউনিটের খুশির আলো।

[শুকতারা, শারদীয়া ১৩৯৬]

সুমন
2 of 3

সুমন

সুমন

সুমন চট্টোপাধ্যায় আজ এই সময় পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় লিখেছেন, যেটির খানিকটা চূর্ণীর ছবি নির্বাসিত নিয়ে। আমি তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না সুমন এই কাজটা করেছেন, লিখেছেন। কারণ নির্বাসিতয় তো আড়ালে হলেও আমি আছি। আমি মানুষটা, যতদূর জানি, এই সময়ে একরকম নিষিদ্ধ। ইদানীং যে দুএকটি লেখা আমি এই সময়ে লিখেছি, তা আমাকে অন্য কেউ অনুরোধ করেছেন লিখতে, সুমন নন। সুমন তখন ছুটিতে ছিলেন। আমার লেখা বই প্রতিবছর প্রতিটি পত্রিকায় পাঠানো হয়, এই সময়েও হয়, প্রকাশক পাঠান। কিন্তু আজ বারো বছর হলো সেসব বইয়ের কোনও রিভিউ কোথাও ছাপানো হয় না। নির্বাসন নামের বইটিও পাঠানো হয়েছিল, যেখানে বর্ণনা করেছি কী করে কলকাতা থেকে, এবং শেষ অবধি ভারতবর্ষ থেকে আমাকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। ওই বইটির সবটাই ফ্যাক্টস। সুমন বইটির রিভিউ করেননি বা কাউকে করতেও দেননি। কিন্তু এখন নির্বাসিতর প্রশংসা করছেন, যে ছবিটায় আছে আমাকে কলকাতা থেকে বের করার কাহিনী, যে কাহিনীর বেশির ভাগটাই ফিকশান। ফিকশানটা অতি সাবধানে করা, তাই ফিকশানটা কোনও হরর স্টোরি হয়ে ওঠেনি। ফ্যাক্টস কিন্তু ভয়ংকর।

সুমন লিখেছেন, দুঃখ করেই লিখেছেন, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আমাকে ভুলে গেছে। ভুলে যদি যায়, তার জন্য দায়ি কিন্তু সাধারণ মানুষ নয়, দায়ি মিডিয়া। আমি, সাদা কথায়, পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়ার বয়কটের শিকার। আমার কিন্তু মনে হয় না, সাধারণ মানুষ আমাকে পুরোপুরিই ভুলে গেছে। এখনও মানুষ আমার বই কেনে। তবে মিডিয়া চেষ্টা করছে মানুষের মন থেকে আমাকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে। এই যে নারীবাদ নিয়ে এত লেখা তিনি ছাপাচ্ছেন তাঁর পত্রিকায়, যাঁরা লিখছেন, তাঁদের অনেকেই দুদশকেরও বেশি আগে বলা আমার কথাগুলোরই পুনরাবৃত্তি করছেন। সুমন কিন্তু তারপরও আমার মত প্রকাশ করার কোনও সুযোগ আমাকে দেবেন না। সম্ভবত বলবেন, আমি বড় বাড়াবাড়ি করি। সুমন বাংলার মানুষকে বলেছেন আমাকে রাজ্য থেকে তাড়ানোর দৃশ্য দেখেও যারা মুখ বুজে ছিল, তারা যেন তাদের সেই মুখ বুজে থাকার লজ্জাটি নির্বাসিত দেখে মোচন করে। ছবিটা দেখলেই কি লজ্জামোচন হবে? সুমন কি আমার লেখা তাঁর এই সময়ে নিয়মিত ছাপিয়ে লজ্জামোচন করার কথা ভাবতে পারেন না?

আচ্ছা, স্বৈরতান্ত্রিক বুদ্ধদেব আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বের করে দিয়েছিলেন, তারপর তো একটি মা মাটি মানুষএর গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এলো, সেই মমতাময় সরকারও কেন আমাকে পশ্চিমবঙ্গে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিলো না, সে ব্যাপারে সুমন একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না কেন? এই প্রশ্নটি একটি বড় প্রশ্ন। যাঁরা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে আমাকে কী করে খুঁটি বানানো হচ্ছে জানেন, তাঁরা জানেন আমাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য একটি সংগঠিত ষড়যন্ত্র পশ্চিমবঙ্গে অনেককাল ধরেই চলছে।

বাংলা স্টেটসম্যান পত্রিকায় আমি প্রতি সপ্তাহে কলাম লিখতাম। রাজ্য ছাড়া হওয়ার পর সেটি বন্ধ করে দেওয়া হল। প্রায়ই আনন্দবাজার আর প্রতিদিনে লিখতাম। সেগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রবিবাসরীয়তে হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়েছে কিছু, সে চন্দ্ৰিলের কারণে। দেশ পত্রিকায় মাঝে মাঝেই লিখতে বলা হতো, সেই পত্রিকায় তো লেখা বন্ধ করা হয়েছেই, এখন ধারাবাহিক ভাবে কুৎসা রটানো হচ্ছে। ঋতুপর্ণ ঘোষ রোববারের জন্য আমি প্রতি সপ্তাহে কলাম লিখবো এ কথা সম্পাদকীয়তে সগর্বে ঘোষণা করেও লেখা ছাপাতে পারেননি। একটি লেখা ছাপানোর পরই আমার লেখা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। বইয়ের দেশ পত্রিকায় কী কী বই বেরোলো তার খবর ছাপা হয়, হাবিজাবি নানা বইয়ের খবরই থাকে, সযত্নে বাদ দেওয়া হয় আমার বই বেরোনোর খবর।

ইংরেজি সাহিত্যের কিছু বিখ্যাত লেখকের নাম উল্লেখ করে সুমন লিখেছেন, আমি ধারে আর ভারে ওদের সমকক্ষ নই। তা নিশ্চয়ই নই। কিন্তু ধার কম হওয়ার পরও আমাকে দেশ এবং রাজ্য থেকে তাড়ানো হয় কেন, সেটা বুঝি না। ভার কম হওয়ার পরও আমার ভার কোনও বাংলাই বইতে পারে না কেন, সেটাও বোধগম্য নয়। যে বইগুলো আমি এ যাবৎ লিখেছি, যে চল্লিশটি বই, সে বইগুলোই যদি বাংলায় না লিখে ইংরেজি ভাষায় লিখতাম, সবই হয়তো অন্যরকম হতো। আর যে বাঙালিরা ইংরেজি ভাষায় লিখে বিখ্যাত হয়েছেন, তাঁরা ইংরেজি ভাষায় না লিখে তাঁদের বইগুলোই বাংলা ভাষায় লিখলে কেউ হয়তো পুছতোও না। সুমনও পুছতেন কি না সন্দেহ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *