সাত্যকি সোমের সত্যান্বেষ

সাত্যকি সোমের সত্যান্বেষ

টেলিফোনটা বেজে উঠতে একটু বিরক্ত মুখেই সাত্যকি সোম রিসিভারটা ধরলেন। সকালে এই প্রাতরাশের সময়টুকুই তাঁর একটু আয়েশ করার সময়। কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে হেলানো চেয়ারে কাত হয়ে তাঁর নিজের তৈরি রোবট নরোত্তমের সঙ্গে একটু গল্পগুজব করেন। আগে টেলিফোন এলে নরোত্তমই ধরে কথাবার্তা বলত। কিন্তু এখন নরোত্তমের মাথায় আটকানো কোন ক্যাপসুলের কানেকশন কখন ঢিলে হয়ে থাকে, কে জানে। ভদ্রতা ঢিলে থাকলে তো টেলিফোন ধরেই বলে ফেলত, ডক্টর সোম এখন ব্যস্ত। কাজের কথা থাকলে বলে ফেলুন, রেকর্ড করে নিই। নইলে কেটে পড়ন–মানে, লাইন কেটে দিন। সহনশীলতা ক্যাপসুল ঢিলে হলে রিসিভার তুলেই বলত, ওঃ, সাতসকালেই ক্রিং ক্রিং, একটু শান্তিতে থাকতে দেবেন না, মশাই! এসব দেখে-শুনে সাত্যকি সোম টেলিফোনটা নরোত্তমের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে বলেছেন, যখন-তখন তোর মাথার স্কু ঢিলে হয়ে যায়। তোকে বিশ্বাস নেই। শুনে নরোত্তম ম্লান হাসি হেসে বলেছিল, কর্তার যা ইচ্ছে। আমি পাগল-ছাগল রোবট, ওসব টেলিফোন-ফেলিফোন আমাকে দিয়ে না করানোই ভালো। ডক্টর সোম মুচকি হেসে ভাবলেন, আর যা-ই হোক, অভিমান-এর ক্যাপসুলটা বেশ টাইটই আছে দেখছি।

আজ অবশ্য নরোত্তমের সঙ্গে কথা জমছে না তেমন। নরোত্তমও আঁচ করতে পেরে তাঁকে বিরক্ত করছে না। দু-দিন হল ডক্টর সোমের মনটা বিষণ্ণ হয়ে আছে। তাঁর পরমপ্রিয় মেধাবী ছাত্র পরমভট্টারক উপাধ্যায় হঠাৎ হাসপাতালের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। কয়েকদিন আগে থেকে সে মাথার যন্ত্রণা অনুভব করছিল দেখে সাত্যকি সোমই তাকে বলেছিলেন, মস্তিষ্ক বিশেষজ্ঞ ডক্টর মূষিকবাহন বটব্যালকে একবার দেখাতে। কিন্তু তার মাথা যে এতটা খারাপ হয়েছিল, সেটা তিনি একবারও বুঝতে পারেননি। আত্মহত্যা যে করে, সে মানসিক রোগগ্রস্ত ছাড়া আর কী? তার মৃত্যুর জন্যে সাত্যকি সোমের নিজেকে যেন দায়ী বলে মনে হয়। তাঁর কথাতেই তো পরমভট্টারক ডাক্তার বটব্যালের হাসপাতালে গিয়েছিল।

টেলিফোনটা ধরে ফোনোভিশনের সুইচটা টিপে দিলেন তিনি। এতে কে ফোন করছে, তার ছবি পর্দায় দেখা যাবে। কিন্তু পর্দায় কোনও ছবি এল না। তার মানে যিনি ফোন করছেন, তিনি ট্রান্সভিশনের সুইচ অফ করে রেখেছেন। কিন্তু ক্যানকেনে গলা শুনেই ডক্টর সোম বুঝতে পারেন, টেলিফোনের অন্য প্রান্তে কে আছে। একটু অবাক হলেন তিনি। পরমভট্টারকের ব্যাপারে এইমাত্র ডাক্তার বটব্যালের কথা তিনি ভাবছিলেন। নরোত্তমও বোধহয় বুঝতে পারল ফোনোভিশনে কোনও ছবি না-আসাতে। জোরেই বলে উঠল, মাথা ফাটানো ডাক্তার নিশ্চয় স্যার?

সর্বনাশ! ডক্টর বটব্যাল শুনতে পাবেন যে। নরোত্তমের আপত্তি সত্ত্বেও তাড়াতাড়ি উঠে রোবটটার সুইচ অফ করে দিলেন তিনি।

মস্তিষ্ক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মূষিকবাহন বটব্যালকে নরোত্তম মাথা-ফাটানো ডাক্তার বলে, কারণ তিনি রোজই প্রায় দু-একটা করে ব্রেন অপারেশন করেন। নরোত্তম অবশ্য বলে, যারা মাথা ফাটায়, সেইসব ডাকাত-গুন্ডারাও নিজেদের চেহারা দেখাতে চায় না।

ডক্টর বটব্যালের অবশ্য নিজের চেহারা না-দেখানোর অন্য কারণ আছে। তাঁর মতন কুৎসিত-দর্শন ব্যক্তি খুব কমই আছে। দু-বার প্লাস্টিক সার্জারি করে মুখের চেহারা পালটে নিখুঁত হয়েছেন। আবার কিছু দিন পরেই যে-কে-সেই। দেখে বিখ্যাত প্লাস্টিক সার্জন দেশরাজ জুনেজা অবাক হয়ে বলেছিলেন, আপনার এই রোগটা তো অদ্ভুত। মনে হয়, কুৎসিত ভাবটা রক্তের মধ্যেই আছে। শুনে মুখটাকে আরও বিশ্রী করে মূষিকবাহন চলে এসে বলেছিলেন, দেশরাজকে দেশছাড়া না করলে তাঁর নাম মূষিকবাহন নয়।

সাত্যকি নোম কোনও অজ্ঞাত কারণে মূষিকবাহনকে এড়িয়ে চলেন। তাঁর ওই দু পাশে ছড়ানো দুটো চোখ দেখলে চতুষ্পদ জন্তুর কথা মনে পড়ে। কনুইয়ের পেছনে লোমের গোছা, অথচ মুখে দাড়িগোঁফের চিহ্নমাত্র নেই, এইসব যেন একটা অমানবিক ব্যাপারস্যাপার বলে মনে হয়। নইলে অনেক আপাত-কুৎসিত লোকের সঙ্গে মিশে, কথা বলে আনন্দ পেয়েছেন।

যা-ই হোক, সাত্যকি সোম রিসিভারটা তুলে একটু দ্বিধাগ্রস্তভাবে বললেন, সোম বলছি।

ওপার থেকে ক্যানেস্তারা টিন উত্তর দিল, আমি মূষিকবাহন বলছি। আপনার কাছে কি বাড়তি যান্ত্রিক শ্রবণেন্দ্রিয় আর বাগিন্দ্রিয় আছে, ডক্টর সোম? একটু ধার চাইতাম।

সাত্যকি নোম একটু অবাক হলেন। রোবটের ব্রেনের সঙ্গে লাগানোর জন্যেই এগুলো তাঁর কাছে আছে। মানুষের বাকশক্তি বা শ্রবণশক্তি হারালে তার অন্য ব্যবস্থা আছে। মস্তিষ্ক ছিদ্র করে তার সঙ্গে এই যন্ত্রগুলো যোগ করলে মূক-বধিররা শুনতে, কথা বলতে পারবে ঠিকই, কিন্তু এভাবে এই কৃত্রিম ইন্দ্রিয় বয়ে বেড়ানো শুধু দৃষ্টিকটুই নয়, অসুবিধাজনকও।

সাত্যকি সোমের উত্তর দিতে একটু দেরি হল হয়তো। মূষিকবাহন বুঝতে পেরে বললেন, একটা অদ্ভুত গবেষণা করছি আমি। আপনার যন্ত্র দুটো নিয়ে চলে আসুন-না। দেখে আপনি ইনটারেস্ট পাবেন। আসছেন তো? কখন, বলুন।

সাত্যকি সোমের কাছ থেকে কথা আদায় করে মূষিকবাহন টেলিফোন ছাড়লেন।

যন্ত্র দুটো হাতে নিয়ে বিকেলে ডক্টর বটব্যালের চেম্বারে হাজির হয়ে সাত্যকি দেখলেন, বাইরে বোর্ড ঝুলছে, আজ রোগী দেখা বন্ধ। তাঁর আসবার জন্যে ডক্টর বটব্যাল রোগী দেখাই বন্ধ করে দিলেন এতে বেশ সংকুচিত হলেন তিনি। ভেতরে ডক্টর বটব্যাল তাঁর জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। ঢুকতেই দু-হাত দিয়ে স্বাগত জানালেন। তারপর বললেন, আজ আপনাকে একটা জিনিস দেখাব। আসুন ভেতরে ল্যাবরেটরিতে।

ল্যাবরেটরি মানে মানুষের খুলি, হাড়, বয়ামের তরল পদার্থের মধ্যে সাজানো মস্তিষ্ক এইসব। ডক্টর সোম কেন জানি এসব সহ্য করতে পারেন না। এগুলো দেখে জন্মগত একটা বিবমিষা আর ভীতি এসে তাঁর মনে ভর করে। তাঁর রোবটের শরীরের যন্ত্রপাতি খুললে তো এমন হয় না।

একটা কাচের জারের কাছে নিয়ে গিয়ে তার ভেতরে রাখা মস্তিষ্কটির দিকে আঙুল দেখিয়ে মূষিকবাহন বললেন, এই যে মস্তিষ্কটা দেখছেন, এটা জীবিত আছে। মানে, রক্তপ্রবাহ চালিয়ে ওটাকে আমি জীবিত রেখেছি। এখনও এটা চিন্তা করে চলেছে। এর ক্লান্তি নেই, ঘুম নেই, কারণ রক্তটাকে আমি সবসময়ই বিশুদ্ধ আর তাজা করে রাখছি।

সাত্যকি সোম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মৃতদেহের থেকে মস্তিষ্ক নিয়ে তাকে বাঁচিয়ে ফেলা যায়?

মূষিকবাহন বিশ্রীভাবে হেসে বললেন, যায়। যদি সদ্যোমৃত হয়। আর সে মৃত্যু যদি রোগে ভুগে না হয়।

সাত্যকি সোম বললেন, তার মানে বলছেন, দুর্ঘটনাজাতীয় কারণে মৃত্যু? কিন্তু এ বিষয়ে তো অনেক বিধিনিষেধ হয়েছে এখন। কৃত্রিমভাবে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ লাগিয়ে তাদের প্রায়ই স্বাভাবিকভাবে জীবিত করে ফেলা যায়। তাই দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে আগের মতন চোখ ইত্যাদি তুলে নেওয়া এখন বেআইনি।

মূষিকবাহন আগের মতোই হেসে বললেন, ঠিকই। তবে শারীরিক আঘাত একটা সীমা ছাড়িয়ে গেলে তখন আর কিছু করার থাকে না। তখন নিষেধ নেই। এরও তা-ই হয়েছিল। গাড়ি শরীরের মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছিল।

কোনও এক অজানা নিহত ব্যক্তির জন্যে সাত্যকি সোমের মন করুণায় ভরে গেল। তিনি কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, কিন্তু এই মস্তিষ্ক যে চিন্তা করছে, তার কী প্রমাণ আপনি পেয়েছেন?

মূষিকবাহন হেসে বললেন, প্রমাণের জন্যেই তো এই যন্ত্র দুটো আপনার কাছ থেকে নিলাম। মস্তিষ্কের বিশেষ বিশেষ জায়গায় এই দুটো যোগ করে দেব। একটাতে ও শুনতে পাবে। একটাতে ও কথা বলার শক্তি পাবে। ও দুটো লাগিয়ে পরে আরেকদিন আপনাকে আসতে বলব। হাতেনাতে প্রমাণ পাবেন। বলে দু-পাশে ছড়ানো চোখ দুটোকে যথাসম্ভব কাছাকাছি আনার চেষ্টা করে গর্বিত ভঙ্গিতে সাত্যকি সোমের দিকে তাকালেন মূষিকবাহন।

সাত্যকি সোম বললেন, তবে দর্শনেন্দ্রিয়টাই বা বাদ দিলেন কেন? আমার কাছে যান্ত্রিক চোখও আছে, নেবেন?

যেন আঁতকে উঠেছেন, প্রথমে এমনভাবে না, না করে উঠলেন মূষিকবাহন। পরে আবার একটু চিন্তা করে বললেন, ঠিক আছে, ওটাও একটা নিয়ে আসবেন সে দিন।

দু-দিন পরেই মূষিকবাহনের অনুরোধে সাত্যকি সোম আবার তাঁর চেম্বারে এলেন। মূষিকবাহন যথারীতি তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ও কথা শুনতে আর বলতে পারছে। আপনি জিজ্ঞেস করে দেখুন। তবে একটা অনুরোধ, ওর মনে মৃত্যুর স্মৃতি জাগিয়ে তুলবেন না। নামধাম জিজ্ঞেস করবেন না। কথা দিন।

প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাত্যকি সোম ভেতরে এলেন। মূষিকবাহনের হাতে যান্ত্রিক চোখজোড়া দিলে তিনি সেটাকে টেবিলের ওপর রেখে দিলেন। তারপর সুইচ টিপে মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত যন্ত্র দুটো চালু করে দিলেন মূষিকবাহন।

তারপর তাঁর ইঙ্গিতে সাত্যকি সোম প্রশ্ন করে চলেন। প্রথম প্রশ্ন, আপনি এখন কোথায়? নিখুঁত যান্ত্রিক বাগ্যন্ত্র সুকণ্ঠে বলে উঠল, জানি না। চারদিক অন্ধকার। আমি মৃত? নাকি স্বপ্ন দেখছি? কিন্তু স্বপ্নে তো এত পরিষ্কার চিন্তাশক্তি থাকে না। আমি সব পরিষ্কার ভাবতে পারছি। বেঁচে থাকলে, জেগে থাকলে মানুষ এরকম ভাবতে পারে। তার মানে আমি বেঁচে আছি। দেকার্ত বলেছেন, আমি চিন্তা করছি, অতএব আমি বেঁচে আছি। এই তো সব মনে আছে। পরপর মোগল সম্রাটের তালিকা, বাবর হুমায়ুন আকবর জাহাঙ্গির শাজাহান ঔরঙ্গজেব। আমরা বলতাম, বাবার হইল আবার জ্বর, সারিল ঔষধে। বলে ছোট ছেলের মতো হেসে উঠল মস্তিষ্কটা। তারপর গম্ভীরভাবে বলে চলল, এ টু দি পাওয়ার জিরো ইজ ইকোয়াল টু ওয়ান। ই সমান এম-সি-স্কোয়্যার…।

বিস্ময়ভরা চোখে ডক্টর সোম মূষিকবাহনের দিকে তাকালেন। মূষিকবাহনের চোখেও একটা বিস্ময় ফুটে উঠেছে। বিস্ময়, না ভয়? তাঁর চতুষ্পদসুলভ চোখ দুটোতে সেটা ঠিক বোঝা গেল না।

সাত্যকি সোম কোনওরকমে আরেকটা প্রশ্ন করলেন। চিন্তাশক্তি ছাড়া শারীরিক অনুভূতি আপনার কেমন হচ্ছে?

উত্তর হল: কিছু বুঝছি না। শুধু মাথায় একটা ব্যথা। হাত দিয়ে মাথা টিপতে পারছি না। হাত-পা সব অবশ। বলেই হঠাৎ উলটে প্রশ্ন করল মস্তিষ্ক, আপনি প্রশ্ন করছেন? আপনি কি যমদূত? নাকি ডক্টর বটব্যাল আমাকে অজ্ঞান করে প্রশ্ন করছেন?

প্রচণ্ড চমকে উঠে ডক্টর বটব্যাল যন্ত্র দুটোর সুইচ বন্ধ করে দিলেন। অবাক সাত্যকি সোমও কম অবাক হননি। লোকটা জানল কী করে যে, ডক্টর বটব্যাল এখানে আছেন?

ডক্টর সোমকে প্রায় ঠেলে নিয়েই বাইরের ঘরে এলেন মূষিকবাহন। অ্যাসিস্ট্যান্ট দু কাপ কফি নিয়ে এল। কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে ডক্টর বটব্যাল বললেন, আমি মাঝে মাঝে ওভাবে চিকিৎসা করি ঠিকই। কিন্তু লোকটা জানল কী করে? হয়তো ও জীবিত থাকতে কোনও দিন আমি ওর চিকিৎসা করেছিলাম। অসম্ভব কিছু নয়।

সাত্যকি সোমকে প্রায় নীরসভাবে বিদায় দিলেন তিনি। মস্তিষ্কের কথায় মুষিকবাহনের নামের উল্লেখ আর তাতে মূষিকবাহনের এতটা ভাবান্তর, দুটোই সাত্যকি সোমের কাছে অস্বাভাবিক লাগল।

দু-দিন ধরে নানারকম চিন্তা করলেন তিনি। তৃতীয় দিন ড্রয়ার খুলে কিছু বার করতে গিয়ে তাঁর নজরে পড়ল, যান্ত্রিক চোখের পরকলা দুটো এখানেই পড়ে আছে। চোখে লাগানো হয়নি। কিন্তু কই, এ ব্যাপারে মূষিকবাহন তো তাঁকে কিছু জানালেন না। তবে কি তিনি চোখ দুটো এখনও মস্তিষ্কের সঙ্গে যোগ করেননি? তাঁর মতন গবেষকের এ কাজটা এত সময়ের মধ্যে না-করাটা ডক্টর সোমের কাছে বিস্ময়কর লাগল।

সে দিনই মূষিকবাহনের চেম্বার বন্ধ হওয়ার সময়ের একটু আগে নিজে থেকেই তিনি সেখানে এলেন। পরকলা দুটো ছাড়া অন্য একটা যন্ত্রও তিনি সঙ্গে নিলেন। ডাক্তার শেষ রোগীটিকে দেখছিলেন। সহকারীর কাছে খবর পেয়ে বেশ বিরক্ত হয়েই যেন বললেন, বসতে বলে। এ এক ঝামেলা হল দেখছি। বাইরে থেকেই স্পষ্ট শুনতে পেলেন সাত্যকি সোম।

রোগী দেখা শেষ করে মূষিকবাহন বেরিয়ে এসে কাষ্ঠহাসি হেসে বললেন, কী ব্যাপার? এত সৌভাগ্য আমার, না বলতেই এলেন!

সাত্যকি সোম বললেন, সে দিন যান্ত্রিক চোখের সঙ্গে লেন্স দুটো দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। আপনি বোধহয় চোখ দুটোর কানেকশন করেননি এখনও, তাই জানতে পারেননি। দিন, লেন্স দুটো লাগিয়ে দিই।

চোখ দুটো মস্তিষ্কের কাছে টেবিলেই পড়ে ছিল। চোখে লেন্স দুটো লাগাতে লাগাতে সাত্যকি সোম বললেন, ডক্টর বটব্যাল, দয়া করে আপনার অ্যাসিস্ট্যান্টকে এক গ্লাস জল দিতে বলবেন?

নিশ্চয়, নিশ্চয়, বলতে বলতে মূষিকবাহন পাশের ঘরে গেলেন। একটু পরে নিজেই এক গ্লাস জল নিয়ে এলেন। জল খেয়ে সাত্যকি সোম বললেন, ধন্যবাদ। এখন যাই।

তাঁর নিজের জন্যে সাত্যকি সোম কষ্ট করে এলেন, এতে বেশ সংকুচিত হলেন মূষিকবাহন। ভুল বুঝে তাঁকে তেমনভাবে অভ্যর্থনা করা হয়নি, এই কারণে এবারে সত্যিই লজ্জিত হলেন তিনি। বিদায় জানানোর সময় তাঁর কুৎসিত মুখেও সেই লজ্জা ধরা পড়ল।

বাড়ি ফিরে এসে ল্যাবরেটরিতে টিভিডিয়ো যন্ত্রটার সঙ্গে যুক্ত সংকেতবাঁশিটা ঠিকমতো কাজ করছে কি না, সেটা দেখে নিলেন সাত্যকি সোম! ঠিকই আছে। ট্রান্সমিটারের কাছে কোনও শব্দ হলেই, সেটা যদি মানুষের কণ্ঠস্বর হয়, তাহলেও সিগন্যাল হুইলটা বেজে উঠবে। সেই আওয়াজ বাড়ির যে-কোনও জায়গা থেকেই শোনা যাবে।

কিন্তু অন্য কোথাও থাকার দরকার হল না। ল্যাবরেটরি থেকে বেরোতে যাবেন, এমন সময় বাঁশি বেজে উঠল। দ্রুত ফিরে এসে সাত্যকি সোম টিভিডিয়োটার সুইচ অন করে দিলেন। পরিষ্কার ভেসে উঠল ছবি। টেবিলের ওপর রাখা যান্ত্রিক চোখজোড়া তার দিয়ে যুক্ত করা হয়েছে মস্তিষ্কের এক বিশেষ অংশের সঙ্গে, যে অংশ দিয়ে চোখে দেখার তরঙ্গ মস্তিষ্কে পৌঁছোয়। যান্ত্রিক কান আর মুখ তো যোগ করাই আছে। সামনে মূষিকবাহনের কদাকার মুখ।

মূষিকবাহন বলছেন, তোমার মস্তিষ্ককে বাঁচিয়ে রেখেছি। এই মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয় না। এর শক্তি আরও বাড়াতে কমপিউটারের মতন স্মৃতি লাভ করবে, অথচ স্বাধীন চিন্তারও অধিকারী থাকবে। এর জন্যে কি তোমার গর্ব হয় না? তুমি বৃথা রাগ করছ।

সাত্যকি সোম বুঝলেন, এর আগেই হয়তো একবার মূষিকবাহনের সঙ্গে মস্তিষ্কের কথা হয়ে গিয়েছে। যাই হোক, এখান থেকেই রেকর্ড হোক।

মস্তিষ্ক রেগে গিয়ে বলে উঠল, আজ বুঝতে পারছি আপনার চেহারার মতন আপনিও একটা শয়তান। আমাকে হত্যা করেছেন আপনি। আপনার গবেষণার জন্যে একজন রোগীর প্রাণ নিয়েছেন, যে তার চিকিৎসার জন্য আপনার উপর নির্ভর করেছিল।

মূষিকবাহন বিরক্ত হয়ে বললেন, আঃ! কে বলল তোমার প্রাণ নিয়েছি? এই তো তুমি বেঁচে আছ, কথা বলছ। তা ছাড়া তুমি নিজে থেকেই পড়ে গিয়েছিলে…

কথাটা শেষ হল না। মূষিকবাহন কাঁপতে কাঁপতে সামনের চেয়ারে বসে পড়লেন।

মস্তিষ্ক গম্ভীর কণ্ঠে বলে চলল, ডাক্তার মূষিকবাহন বটব্যাল, আপনি হয়তো জানেন না, আমি সম্মোহন জানতাম। এই চোখ দিয়েও সেটা পারি। আপনি বলুন, আমাকে হত্যা করেছেন কি না। যা ঘটেছিল, বলুন।

মন্ত্রমুগ্ধের মতন মূষিকবাহন বলে চললেন, আমি তোমাকে হত্যা করেছিলাম একটা টাটকা মস্তিষ্ক পাওয়ার জন্যে। অনেকদিন ধরেই এটা পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। সে দিন হাসপাতালের ছাদের ওই অংশটাতে কেউ ছিল না। তোমাকে ডক্টর সোমের কথা জানতে চাওয়ার ছল করে ছাদের নির্জন অংশ দিয়ে হাঁটছিলাম। তারপর কিনারায় আসতেই হঠাৎ পেছন থেকে ধাক্কা দিলাম। বাঁচবার কোনও প্রশ্ন ছিল না। শরীর চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। আঘাতটা যাতে মস্তিষ্কে না লাগে, তার জন্যে তোমার স্কুটার চালানোর হেলমেটটা মাথায় পরতে বলেছিলাম। তুমি ভেবেছিলে, মাথার যন্ত্রণা লাঘব করার জন্যে আমি বলেছিলাম। মর্গে ডাক্তার সচদেবকে বলে সহজেই মস্তিষ্কটা আয়ত্ত করতে পেরেছিলাম। তোমার শোকার্ত বাবা তোমার চোখের সঙ্গে মস্তিষ্কটাও হাসপাতালকে দান করতে অরাজি হননি, পরমভট্টারক–

সাত্যকি সোম নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তাঁর মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে একটি শব্দ মাত্র বেরোল, শয়তান!

পরমভট্টারক! তাকে তিনিই পাঠিয়েছিলেন ডক্টর বটব্যালের কাছে। টিভিডিয়োর সামনের টেবিলে দুই কনুইয়ে ভর রেখে নিজের কপালটা টিপে ধরলেন তিনি।

মস্তিষ্ক কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, আপনার ওপর থেকে সম্মোহন সরিয়ে নিলাম, ডক্টর বটব্যাল। আপনি অপরাধ স্বীকার করেছেন। অবশ্য তাতে আপনার কোনও ক্ষতি হবে না। কেউ আপনার অপরাধের কথা জানতে পারবে না।

আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পরমভট্টারকের মস্তিষ্ক বলল, আমার হৃদ্যন্ত্র নেই। থাকলে নিজের অবস্থা জেনে হয়তো হার্টফেল করতাম। কিন্তু একটা ম্যাজিক দেখিয়ে আমি অনেক ডাক্তারকে অবাক করে দিয়েছি অনেক অনুষ্ঠানে। প্রায় পাঁচ মিনিট হৃৎস্পন্দন বন্ধ করে তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছি। তাঁরা কেউ স্টেথোস্কোপ আমার বুকে চেপে ধরেছেন। কেউ নাড়ি ধরেছেন। না পেয়েছেন হৃৎস্পন্দন, না পেয়েছেন নাড়ির স্পন্দন। আজ সেই ম্যাজিক দেখানোর চেষ্টা করব। ওই স্ট্যান্ডে রাখা কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড আমার ব্রেনের সঙ্গে যুক্ত। কাজেই ওটার ওপর আমার প্রভাব খাটবে। দেখুন, শেষ ম্যাজিক। তারপরে এই মস্তিষ্কটা আপনার ল্যাবরেটরির অন্য বয়ামগুলোতে রাখা মস্তিষ্কের মতোই একটা মৃত মস্তিষ্কে পরিণত হবে।

ডাক্তার মূষিকবাহন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতন উঠে দাঁড়ালেন। বিস্মিত হয়ে দেখলেন, রক্তসঞ্চালন আর বিশুদ্ধিকরণের যান্ত্রিক হৃদ্যন্ত্রের পাম্প মেশিনের ফ্রিকোয়েন্সি কমে যাচ্ছে। মিনিটে ষাট, বিয়াল্লিশ, কুড়ি. ব্যাস। ইলেকট্রনিক এইচ-বি-ডি-ইউ বা হার্টবিট ডিসপ্লে ইউনিটে চতুর্থ মিনিটে আর কোনও সংখ্যাই এল না। এ-ও কি সম্ভব! যন্ত্র পঁচাত্তর বছরের গ্যারান্টিযুক্ত। তিনি একবার এই বোতাম, একবার ওই বোতাম টিপে দেখতে লাগলেন।

কিন্তু তাঁর জন্যে আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ বয়ামের দিকে চোখ পড়তেই তিনি সেটা দেখলেন। অসহায়ের মতন স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে দেখলেন, কীভাবে পরমভট্টারকের মস্তিষ্কটা গলে গলে যাচ্ছে। পচনরোধী ওষুধের অভাবে একটা মৃতদেহের মস্তিষ্কের তিন-চার দিনে যে অবস্থা হয়, কিছুক্ষণের মধ্যেই এই মস্তিষ্কটা সেই অবস্থায় পৌঁছোল।

পরদিনই আবার সাত্যকি সোমের আগমন তাঁর কাছে বিরক্তিকর লাগল। ভাবলেন, ডক্টর সোম হয়তো এই মস্তিষ্কটার ব্যাপারে খুব ইনটারেস্ট পেয়েছেন। কিন্তু তিনি তো জানেন না, এ যাত্রায় তাঁর সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

সপ্তাহের এই দিনটাতে তিনি রোগী দেখেন না। সকালে শুধু একবার হাসপাতালে যেতে হয়। সাত্যকি সোমকে গবেষণাগারে নিয়ে গিয়ে বললেন, কিছু হল না, ডক্টর সোম। যান্ত্রিক গোলযোগে মস্তিষ্কটা নষ্ট হয়ে গেল। আপনার যন্ত্রপাতি আপনাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি।

সাত্যকি সোম ফাঁকা বয়ামটির দিকে তাকালেন, যেমন করে মৃত প্রিয়জনের ফাঁকা ঘরের দিকে লোকে তাকায়। পরমভট্টারকের দ্বিতীয় মৃত্যু তিনি তাঁর টিভিডিয়োর পর্দায় দেখেছেন।

যন্ত্রগুলো হাতে নিয়ে ডক্টর সোম বললেন, আমার আরেকটা যন্ত্রও আপনার এখানে আছে, ডক্টর বটব্যাল। সে দিন যখন আমার জন্যে জল আনতে গেলেন, সেই সময় এটা এখানে রেখে দিয়েছিলাম। এই বলে পাশের কাবার্ডের এক কোণে রাখা মিনি ট্রান্সভিশনটা তুলে নিলেন তিনি। পাঁচ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত শব্দ আর দৃশ্য দুটোই ট্রান্সমিট করতে পারে যন্ত্র। আর ডক্টর সোমের বাসস্থান তো এখান থেকে তিন কিলোমিটার মাত্র।

মূষিকবাহন কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকালেন ডক্টর সোমের দিকে। সাত্যকি সোম বললেন, আপনার সঙ্গে পরমভট্টারকের কথোপকথনের দৃশ্য-শ্রাব্য সবই ধরা আছে আমার ভিসিআর-এ। একজন প্রতিভাবান নিরপরাধ তরুণকে জঘন্যভাবে হত্যার অপরাধের প্রমাণ হিসাবে ওটা পুলিশের হাতে যাবে।

কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন মূষিকবাহন। তারপর হো-হো করে অট্টহাসি হেসে বললেন, সম্মোহিত করে আমাকে দিয়ে কথা বলিয়ে নেওয়া হয়েছে, এ কথা বিশ্বাস করাতে বেগ পেতে হবে না। কাজেই ওটা ধোপে টিকবে না। এরপরে যার মস্তিষ্ক জোগাড় করব, সে আর যা-ই হোক, এসব হিপ্নোটিজম-ফিজুম যেন না জানে, সেদিকে নজর রাখতে হবে।

সাত্যকি সোম স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মূষিকবাহনের কথা শুনে। বুঝতে পারলেন, একটা জীবন্ত মস্তিষ্ক না-পাওয়া পর্যন্ত মূষিকবাহন বিরত হবেন না। আর তার বলি হবে তাঁরই কোনও রোগী। মানসিক রোগগ্রস্ত বা মস্তিষ্কের রোগীর পক্ষে আত্মহত্যা করাটা যে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তা ছাড়া ব্রেন অপারেশনে মৃত্যু তো এখনও হয়। মূষিকবাহন এইসব বানানো কারণে আড়ালে নিরাপদেই থাকবেন।

তাই এবারে মোক্ষম অস্ত্র ছাড়লেন ডক্টর সোম।

মূষিকবাহনের জান্তব মুখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, ডক্টর বটব্যাল, আপনি হয়তো এস-এল-ডি-র নাম শুনেছেন। না, না, এই মিথ্যানিরূপণ যন্ত্র এখন পৃথিবীর সব জায়গার পুলিশ আর আদালতের অপরিহার্য অঙ্গ। ওতে কোনও ভুল হয় না। শতকরা নিরানব্বই ভাগ নির্ভুল। বাকি এক ভাগ, কোন ক্ষেত্রে হয়, সেটাও হয়তো আপনি জানেন। হ্যাঁ, মস্তিষ্কবিকৃত লোকেদের বেলায়। আপনি তার মধ্যে পড়েন কি? আমার এখন সন্দেহ হয়। নইলে এস-এল-ডি যন্ত্রের সামনে আপনার বিবৃতি ধোপে টিকবে না, ডক্টর বটব্যাল।

মুহূর্তের জন্যে রক্তহীন হয়ে গেল মূষিকবাহনের মুখ। নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। তারপর অনুনয়ের ভঙ্গিতে বললেন, গবেষণার খাতিরে ভবিষ্যৎ-মানুষের কল্যাণের স্বার্থে যদি মাত্র একজনের জীবন গিয়েই থাকে, সেটাকে এত বড় করে দেখছেন কেন, ডক্টর সোম? বিশেষ করে, আপনার মতন একজন বিজ্ঞানী?

ডক্টর সোম গম্ভীরভাবে বললেন, এ প্রশ্ন বিচারকের সামনেই না-হয় তুলবেন।

আবার কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে বসে থাকলেন ডক্টর মূষিকবাহন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। বিজ্ঞানের জন্যে আমি প্রাণ দিতে ভয় পাই না। আমি বিচারকের সামনে বলব আমার গবেষণার কথা। ভবিষ্যৎ-মানুষের জ্ঞানভাণ্ডারের জন্যে আমি একটা ব্যাংক করতে চেয়েছিলাম, যাতে থাকবে মেধাবী মস্তিষ্ক। যাদের আয়ু হবে কয়েকশো বছর। তাতে তাদের মেমারি স্টোরেজ বিশাল হবে। সারা দিনরাত তারা জ্ঞান আহরণ করবে পড়াশোনা করে যান্ত্রিক ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে। সাধারণ মানুষের মতন এই মস্তিষ্ক বৃদ্ধ হবে না।

বক্তৃতা বন্ধ করে ডক্টর বটব্যাল যা করলেন, তাতে সাত্যকি নোম অবাক হয়ে গেলেন। যেন এতক্ষণ কিছুই হয়নি, এমনভাবে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক স্বরে বললেন, যাক গে, আপনি আপনার কর্তব্য করবেন নিশ্চয়। আজ আবার চেম্বার বন্ধ বলে কৌটিল্যকে ছুটি দিয়েছি। একটু বসুন, আমি চটপট দু-কাপ কফি করে আনি।

সাত্যকি সোম আপত্তি করতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই মূষিকবাহন ভেতরে ঢুকে গেলেন। সত্যিই দু-মিনিটের মধ্যে দু-কাপ কফি নিয়ে এসে হাজির হলেন তিনি। চেম্বারের পাশেই একটা ছোট্ট কেবিনে গ্যাস স্টোভের সামনে চা-কফির সরঞ্জাম সব আছে।

বাইরে থেকে একটা গন্ধ আসছে কি? সাত্যকি সোম নাক কুঁচকে অনুভব করার চেষ্টা করলেন। মূষিকবাহনকে বললেন, আপনার গ্যাস স্টোভটা বন্ধ করেছেন তো ডক্টর বটব্যাল? একটা গন্ধ আসছে যেন।

ডক্টর বটব্যাল ছুটে ভেতরে গেলেন। ফিরে এসে বললেন, হ্যাঁ, বন্ধই আছে।

 বাইরে থেকে হয়তো আসছে। আমি তো পাচ্ছি না।

কফিপান শেষ করে সাত্যকি সোম উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর মনটা খারাপ হয়ে গেল। তাঁর জন্যেই পরমভট্টারক আজ নেই। আবার যতই পাষণ্ড হোক, মূষিকবাহনের মতন। দেশবিখ্যাত একজন ডাক্তার

মূষিকবাহনের সঙ্গে করমর্দন করে ক্লান্ত স্বরে সাত্যকি সোম বললেন, আমাকে ক্ষমা করবেন ডক্টর বটব্যাল। কিন্তু, আমার বিবেক…

ডক্টর সোমকে কথা শেষ করতে দিলেন না মূষিকবাহন। বিকটভাবে হেসে উঠে বললেন, আপনাকে আর বিবেকের দংশন বেশিক্ষণ ভোগ করতে হবে না, ডক্টর সোম। আর পনেরো মিনিটের মধ্যেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আপনার মৃত্যু হবে। আপনার কফির পেয়ালায় যা মিশিয়েছি, সেটা পোস্টমর্টেমেও ধরা পড়ে না। কার্ডিয়াক ফেলিয়োর, এটাই সকলে বুঝবে। না, বমি করেও কিছু হবে না। ওটা রক্তের সঙ্গে মিশতে কয়েক সেকেন্ড লাগে, অথচ শারীরিক কোনও অস্বস্তিবোধ হয় না। একটু থেমে হেসে মূষিকবাহন বললেন, হ্যাঁ, এস-এল-ডি-র সামনে গেলে হয়তো অপরাধী ধরা পড়ত, কিন্তু এখানে সে প্রশ্নই উঠবে না কারও মনে। কোনও স্বার্থের সংঘাত বা বিদ্বেষ যে আমাদের মধ্যে থাকার কারণ নেই, সে বিষয়ে ওসব কাগজের কাদাখোঁচা পাখিরাও নিঃসন্দেহ।

এ কথা শুনে সাত্যকি সোম কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে মূষিকবাহনের দিকে চেয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, কিন্তু এখানেও যে একটা গন্ডগোল হয়ে গেল, ডক্টর বটব্যাল। আমার কাপে বেশি কফি দিয়েছেন দেখে আমি কাপ দুটো পালটাপালটি করে নিয়েছিলাম, যখন আপনি গ্যাস স্টোভটা দেখতে গেলেন, তখন। এ সময় কফি খাওয়ার অভ্যাস তো আমার নেই।

 এই বলে নমস্কার জানিয়ে উঠে পড়লেন তিনি। ঘর থেকে বেরিয়ে একবার পেছন ফিরে দরজাটা ভেজাতে গিয়ে দেখলেন, ডাক্তার মূষিকবাহন চেয়ারে বসে হাত দুটো প্রাণপণ চেপে ধরেছেন। তেলা মুখমণ্ডলে বিন্দু বিন্দু ঘাম। রাস্তায় নেমে ভারাক্রান্ত মনে সাত্যকি সোম ভাবলেন, হয়তো এটাই ভালো হল। অত বড় একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানীর পক্ষে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় শোনা–বিজ্ঞানী। হিসাবে তিনি নিজেই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারতেন না।

[আনন্দমেলা, ২৭ কার্তিক ১৩৯২]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাত্যকি সোমের সত্যান্বেষ
গল্প - রেবন্ত গোস্বামী
ছড়া - রেবন্ত গোস্বামী
সাক্ষাৎকার

সাত্যকি সোমের সত্যান্বেষ

সাত্যকি সোমের সত্যান্বেষ

টেলিফোনটা বেজে উঠতে একটু বিরক্ত মুখেই সাত্যকি সোম রিসিভারটা ধরলেন। সকালে এই প্রাতরাশের সময়টুকুই তাঁর একটু আয়েশ করার সময়। কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে হেলানো চেয়ারে কাত হয়ে তাঁর নিজের তৈরি রোবট নরোত্তমের সঙ্গে একটু গল্পগুজব করেন। আগে টেলিফোন এলে নরোত্তমই ধরে কথাবার্তা বলত। কিন্তু এখন নরোত্তমের মাথায় আটকানো কোন ক্যাপসুলের কানেকশন কখন ঢিলে হয়ে থাকে, কে জানে। ভদ্রতা ঢিলে থাকলে তো টেলিফোন ধরেই বলে ফেলত, ডক্টর সোম এখন ব্যস্ত। কাজের কথা থাকলে বলে ফেলুন, রেকর্ড করে নিই। নইলে কেটে পড়ন–মানে, লাইন কেটে দিন। সহনশীলতা ক্যাপসুল ঢিলে হলে রিসিভার তুলেই বলত, ওঃ, সাতসকালেই ক্রিং ক্রিং, একটু শান্তিতে থাকতে দেবেন না, মশাই! এসব দেখে-শুনে সাত্যকি সোম টেলিফোনটা নরোত্তমের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে বলেছেন, যখন-তখন তোর মাথার স্কু ঢিলে হয়ে যায়। তোকে বিশ্বাস নেই। শুনে নরোত্তম ম্লান হাসি হেসে বলেছিল, কর্তার যা ইচ্ছে। আমি পাগল-ছাগল রোবট, ওসব টেলিফোন-ফেলিফোন আমাকে দিয়ে না করানোই ভালো। ডক্টর সোম মুচকি হেসে ভাবলেন, আর যা-ই হোক, অভিমান-এর ক্যাপসুলটা বেশ টাইটই আছে দেখছি।

আজ অবশ্য নরোত্তমের সঙ্গে কথা জমছে না তেমন। নরোত্তমও আঁচ করতে পেরে তাঁকে বিরক্ত করছে না। দু-দিন হল ডক্টর সোমের মনটা বিষণ্ণ হয়ে আছে। তাঁর পরমপ্রিয় মেধাবী ছাত্র পরমভট্টারক উপাধ্যায় হঠাৎ হাসপাতালের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। কয়েকদিন আগে থেকে সে মাথার যন্ত্রণা অনুভব করছিল দেখে সাত্যকি সোমই তাকে বলেছিলেন, মস্তিষ্ক বিশেষজ্ঞ ডক্টর মূষিকবাহন বটব্যালকে একবার দেখাতে। কিন্তু তার মাথা যে এতটা খারাপ হয়েছিল, সেটা তিনি একবারও বুঝতে পারেননি। আত্মহত্যা যে করে, সে মানসিক রোগগ্রস্ত ছাড়া আর কী? তার মৃত্যুর জন্যে সাত্যকি সোমের নিজেকে যেন দায়ী বলে মনে হয়। তাঁর কথাতেই তো পরমভট্টারক ডাক্তার বটব্যালের হাসপাতালে গিয়েছিল।

টেলিফোনটা ধরে ফোনোভিশনের সুইচটা টিপে দিলেন তিনি। এতে কে ফোন করছে, তার ছবি পর্দায় দেখা যাবে। কিন্তু পর্দায় কোনও ছবি এল না। তার মানে যিনি ফোন করছেন, তিনি ট্রান্সভিশনের সুইচ অফ করে রেখেছেন। কিন্তু ক্যানকেনে গলা শুনেই ডক্টর সোম বুঝতে পারেন, টেলিফোনের অন্য প্রান্তে কে আছে। একটু অবাক হলেন তিনি। পরমভট্টারকের ব্যাপারে এইমাত্র ডাক্তার বটব্যালের কথা তিনি ভাবছিলেন। নরোত্তমও বোধহয় বুঝতে পারল ফোনোভিশনে কোনও ছবি না-আসাতে। জোরেই বলে উঠল, মাথা ফাটানো ডাক্তার নিশ্চয় স্যার?

সর্বনাশ! ডক্টর বটব্যাল শুনতে পাবেন যে। নরোত্তমের আপত্তি সত্ত্বেও তাড়াতাড়ি উঠে রোবটটার সুইচ অফ করে দিলেন তিনি।

মস্তিষ্ক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মূষিকবাহন বটব্যালকে নরোত্তম মাথা-ফাটানো ডাক্তার বলে, কারণ তিনি রোজই প্রায় দু-একটা করে ব্রেন অপারেশন করেন। নরোত্তম অবশ্য বলে, যারা মাথা ফাটায়, সেইসব ডাকাত-গুন্ডারাও নিজেদের চেহারা দেখাতে চায় না।

ডক্টর বটব্যালের অবশ্য নিজের চেহারা না-দেখানোর অন্য কারণ আছে। তাঁর মতন কুৎসিত-দর্শন ব্যক্তি খুব কমই আছে। দু-বার প্লাস্টিক সার্জারি করে মুখের চেহারা পালটে নিখুঁত হয়েছেন। আবার কিছু দিন পরেই যে-কে-সেই। দেখে বিখ্যাত প্লাস্টিক সার্জন দেশরাজ জুনেজা অবাক হয়ে বলেছিলেন, আপনার এই রোগটা তো অদ্ভুত। মনে হয়, কুৎসিত ভাবটা রক্তের মধ্যেই আছে। শুনে মুখটাকে আরও বিশ্রী করে মূষিকবাহন চলে এসে বলেছিলেন, দেশরাজকে দেশছাড়া না করলে তাঁর নাম মূষিকবাহন নয়।

সাত্যকি নোম কোনও অজ্ঞাত কারণে মূষিকবাহনকে এড়িয়ে চলেন। তাঁর ওই দু পাশে ছড়ানো দুটো চোখ দেখলে চতুষ্পদ জন্তুর কথা মনে পড়ে। কনুইয়ের পেছনে লোমের গোছা, অথচ মুখে দাড়িগোঁফের চিহ্নমাত্র নেই, এইসব যেন একটা অমানবিক ব্যাপারস্যাপার বলে মনে হয়। নইলে অনেক আপাত-কুৎসিত লোকের সঙ্গে মিশে, কথা বলে আনন্দ পেয়েছেন।

যা-ই হোক, সাত্যকি সোম রিসিভারটা তুলে একটু দ্বিধাগ্রস্তভাবে বললেন, সোম বলছি।

ওপার থেকে ক্যানেস্তারা টিন উত্তর দিল, আমি মূষিকবাহন বলছি। আপনার কাছে কি বাড়তি যান্ত্রিক শ্রবণেন্দ্রিয় আর বাগিন্দ্রিয় আছে, ডক্টর সোম? একটু ধার চাইতাম।

সাত্যকি নোম একটু অবাক হলেন। রোবটের ব্রেনের সঙ্গে লাগানোর জন্যেই এগুলো তাঁর কাছে আছে। মানুষের বাকশক্তি বা শ্রবণশক্তি হারালে তার অন্য ব্যবস্থা আছে। মস্তিষ্ক ছিদ্র করে তার সঙ্গে এই যন্ত্রগুলো যোগ করলে মূক-বধিররা শুনতে, কথা বলতে পারবে ঠিকই, কিন্তু এভাবে এই কৃত্রিম ইন্দ্রিয় বয়ে বেড়ানো শুধু দৃষ্টিকটুই নয়, অসুবিধাজনকও।

সাত্যকি সোমের উত্তর দিতে একটু দেরি হল হয়তো। মূষিকবাহন বুঝতে পেরে বললেন, একটা অদ্ভুত গবেষণা করছি আমি। আপনার যন্ত্র দুটো নিয়ে চলে আসুন-না। দেখে আপনি ইনটারেস্ট পাবেন। আসছেন তো? কখন, বলুন।

সাত্যকি সোমের কাছ থেকে কথা আদায় করে মূষিকবাহন টেলিফোন ছাড়লেন।

যন্ত্র দুটো হাতে নিয়ে বিকেলে ডক্টর বটব্যালের চেম্বারে হাজির হয়ে সাত্যকি দেখলেন, বাইরে বোর্ড ঝুলছে, আজ রোগী দেখা বন্ধ। তাঁর আসবার জন্যে ডক্টর বটব্যাল রোগী দেখাই বন্ধ করে দিলেন এতে বেশ সংকুচিত হলেন তিনি। ভেতরে ডক্টর বটব্যাল তাঁর জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। ঢুকতেই দু-হাত দিয়ে স্বাগত জানালেন। তারপর বললেন, আজ আপনাকে একটা জিনিস দেখাব। আসুন ভেতরে ল্যাবরেটরিতে।

ল্যাবরেটরি মানে মানুষের খুলি, হাড়, বয়ামের তরল পদার্থের মধ্যে সাজানো মস্তিষ্ক এইসব। ডক্টর সোম কেন জানি এসব সহ্য করতে পারেন না। এগুলো দেখে জন্মগত একটা বিবমিষা আর ভীতি এসে তাঁর মনে ভর করে। তাঁর রোবটের শরীরের যন্ত্রপাতি খুললে তো এমন হয় না।

একটা কাচের জারের কাছে নিয়ে গিয়ে তার ভেতরে রাখা মস্তিষ্কটির দিকে আঙুল দেখিয়ে মূষিকবাহন বললেন, এই যে মস্তিষ্কটা দেখছেন, এটা জীবিত আছে। মানে, রক্তপ্রবাহ চালিয়ে ওটাকে আমি জীবিত রেখেছি। এখনও এটা চিন্তা করে চলেছে। এর ক্লান্তি নেই, ঘুম নেই, কারণ রক্তটাকে আমি সবসময়ই বিশুদ্ধ আর তাজা করে রাখছি।

সাত্যকি সোম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মৃতদেহের থেকে মস্তিষ্ক নিয়ে তাকে বাঁচিয়ে ফেলা যায়?

মূষিকবাহন বিশ্রীভাবে হেসে বললেন, যায়। যদি সদ্যোমৃত হয়। আর সে মৃত্যু যদি রোগে ভুগে না হয়।

সাত্যকি সোম বললেন, তার মানে বলছেন, দুর্ঘটনাজাতীয় কারণে মৃত্যু? কিন্তু এ বিষয়ে তো অনেক বিধিনিষেধ হয়েছে এখন। কৃত্রিমভাবে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ লাগিয়ে তাদের প্রায়ই স্বাভাবিকভাবে জীবিত করে ফেলা যায়। তাই দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে আগের মতন চোখ ইত্যাদি তুলে নেওয়া এখন বেআইনি।

মূষিকবাহন আগের মতোই হেসে বললেন, ঠিকই। তবে শারীরিক আঘাত একটা সীমা ছাড়িয়ে গেলে তখন আর কিছু করার থাকে না। তখন নিষেধ নেই। এরও তা-ই হয়েছিল। গাড়ি শরীরের মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছিল।

কোনও এক অজানা নিহত ব্যক্তির জন্যে সাত্যকি সোমের মন করুণায় ভরে গেল। তিনি কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, কিন্তু এই মস্তিষ্ক যে চিন্তা করছে, তার কী প্রমাণ আপনি পেয়েছেন?

মূষিকবাহন হেসে বললেন, প্রমাণের জন্যেই তো এই যন্ত্র দুটো আপনার কাছ থেকে নিলাম। মস্তিষ্কের বিশেষ বিশেষ জায়গায় এই দুটো যোগ করে দেব। একটাতে ও শুনতে পাবে। একটাতে ও কথা বলার শক্তি পাবে। ও দুটো লাগিয়ে পরে আরেকদিন আপনাকে আসতে বলব। হাতেনাতে প্রমাণ পাবেন। বলে দু-পাশে ছড়ানো চোখ দুটোকে যথাসম্ভব কাছাকাছি আনার চেষ্টা করে গর্বিত ভঙ্গিতে সাত্যকি সোমের দিকে তাকালেন মূষিকবাহন।

সাত্যকি সোম বললেন, তবে দর্শনেন্দ্রিয়টাই বা বাদ দিলেন কেন? আমার কাছে যান্ত্রিক চোখও আছে, নেবেন?

যেন আঁতকে উঠেছেন, প্রথমে এমনভাবে না, না করে উঠলেন মূষিকবাহন। পরে আবার একটু চিন্তা করে বললেন, ঠিক আছে, ওটাও একটা নিয়ে আসবেন সে দিন।

দু-দিন পরেই মূষিকবাহনের অনুরোধে সাত্যকি সোম আবার তাঁর চেম্বারে এলেন। মূষিকবাহন যথারীতি তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ও কথা শুনতে আর বলতে পারছে। আপনি জিজ্ঞেস করে দেখুন। তবে একটা অনুরোধ, ওর মনে মৃত্যুর স্মৃতি জাগিয়ে তুলবেন না। নামধাম জিজ্ঞেস করবেন না। কথা দিন।

প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাত্যকি সোম ভেতরে এলেন। মূষিকবাহনের হাতে যান্ত্রিক চোখজোড়া দিলে তিনি সেটাকে টেবিলের ওপর রেখে দিলেন। তারপর সুইচ টিপে মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত যন্ত্র দুটো চালু করে দিলেন মূষিকবাহন।

তারপর তাঁর ইঙ্গিতে সাত্যকি সোম প্রশ্ন করে চলেন। প্রথম প্রশ্ন, আপনি এখন কোথায়? নিখুঁত যান্ত্রিক বাগ্যন্ত্র সুকণ্ঠে বলে উঠল, জানি না। চারদিক অন্ধকার। আমি মৃত? নাকি স্বপ্ন দেখছি? কিন্তু স্বপ্নে তো এত পরিষ্কার চিন্তাশক্তি থাকে না। আমি সব পরিষ্কার ভাবতে পারছি। বেঁচে থাকলে, জেগে থাকলে মানুষ এরকম ভাবতে পারে। তার মানে আমি বেঁচে আছি। দেকার্ত বলেছেন, আমি চিন্তা করছি, অতএব আমি বেঁচে আছি। এই তো সব মনে আছে। পরপর মোগল সম্রাটের তালিকা, বাবর হুমায়ুন আকবর জাহাঙ্গির শাজাহান ঔরঙ্গজেব। আমরা বলতাম, বাবার হইল আবার জ্বর, সারিল ঔষধে। বলে ছোট ছেলের মতো হেসে উঠল মস্তিষ্কটা। তারপর গম্ভীরভাবে বলে চলল, এ টু দি পাওয়ার জিরো ইজ ইকোয়াল টু ওয়ান। ই সমান এম-সি-স্কোয়্যার…।

বিস্ময়ভরা চোখে ডক্টর সোম মূষিকবাহনের দিকে তাকালেন। মূষিকবাহনের চোখেও একটা বিস্ময় ফুটে উঠেছে। বিস্ময়, না ভয়? তাঁর চতুষ্পদসুলভ চোখ দুটোতে সেটা ঠিক বোঝা গেল না।

সাত্যকি সোম কোনওরকমে আরেকটা প্রশ্ন করলেন। চিন্তাশক্তি ছাড়া শারীরিক অনুভূতি আপনার কেমন হচ্ছে?

উত্তর হল: কিছু বুঝছি না। শুধু মাথায় একটা ব্যথা। হাত দিয়ে মাথা টিপতে পারছি না। হাত-পা সব অবশ। বলেই হঠাৎ উলটে প্রশ্ন করল মস্তিষ্ক, আপনি প্রশ্ন করছেন? আপনি কি যমদূত? নাকি ডক্টর বটব্যাল আমাকে অজ্ঞান করে প্রশ্ন করছেন?

প্রচণ্ড চমকে উঠে ডক্টর বটব্যাল যন্ত্র দুটোর সুইচ বন্ধ করে দিলেন। অবাক সাত্যকি সোমও কম অবাক হননি। লোকটা জানল কী করে যে, ডক্টর বটব্যাল এখানে আছেন?

ডক্টর সোমকে প্রায় ঠেলে নিয়েই বাইরের ঘরে এলেন মূষিকবাহন। অ্যাসিস্ট্যান্ট দু কাপ কফি নিয়ে এল। কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে ডক্টর বটব্যাল বললেন, আমি মাঝে মাঝে ওভাবে চিকিৎসা করি ঠিকই। কিন্তু লোকটা জানল কী করে? হয়তো ও জীবিত থাকতে কোনও দিন আমি ওর চিকিৎসা করেছিলাম। অসম্ভব কিছু নয়।

সাত্যকি সোমকে প্রায় নীরসভাবে বিদায় দিলেন তিনি। মস্তিষ্কের কথায় মুষিকবাহনের নামের উল্লেখ আর তাতে মূষিকবাহনের এতটা ভাবান্তর, দুটোই সাত্যকি সোমের কাছে অস্বাভাবিক লাগল।

দু-দিন ধরে নানারকম চিন্তা করলেন তিনি। তৃতীয় দিন ড্রয়ার খুলে কিছু বার করতে গিয়ে তাঁর নজরে পড়ল, যান্ত্রিক চোখের পরকলা দুটো এখানেই পড়ে আছে। চোখে লাগানো হয়নি। কিন্তু কই, এ ব্যাপারে মূষিকবাহন তো তাঁকে কিছু জানালেন না। তবে কি তিনি চোখ দুটো এখনও মস্তিষ্কের সঙ্গে যোগ করেননি? তাঁর মতন গবেষকের এ কাজটা এত সময়ের মধ্যে না-করাটা ডক্টর সোমের কাছে বিস্ময়কর লাগল।

সে দিনই মূষিকবাহনের চেম্বার বন্ধ হওয়ার সময়ের একটু আগে নিজে থেকেই তিনি সেখানে এলেন। পরকলা দুটো ছাড়া অন্য একটা যন্ত্রও তিনি সঙ্গে নিলেন। ডাক্তার শেষ রোগীটিকে দেখছিলেন। সহকারীর কাছে খবর পেয়ে বেশ বিরক্ত হয়েই যেন বললেন, বসতে বলে। এ এক ঝামেলা হল দেখছি। বাইরে থেকেই স্পষ্ট শুনতে পেলেন সাত্যকি সোম।

রোগী দেখা শেষ করে মূষিকবাহন বেরিয়ে এসে কাষ্ঠহাসি হেসে বললেন, কী ব্যাপার? এত সৌভাগ্য আমার, না বলতেই এলেন!

সাত্যকি সোম বললেন, সে দিন যান্ত্রিক চোখের সঙ্গে লেন্স দুটো দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। আপনি বোধহয় চোখ দুটোর কানেকশন করেননি এখনও, তাই জানতে পারেননি। দিন, লেন্স দুটো লাগিয়ে দিই।

চোখ দুটো মস্তিষ্কের কাছে টেবিলেই পড়ে ছিল। চোখে লেন্স দুটো লাগাতে লাগাতে সাত্যকি সোম বললেন, ডক্টর বটব্যাল, দয়া করে আপনার অ্যাসিস্ট্যান্টকে এক গ্লাস জল দিতে বলবেন?

নিশ্চয়, নিশ্চয়, বলতে বলতে মূষিকবাহন পাশের ঘরে গেলেন। একটু পরে নিজেই এক গ্লাস জল নিয়ে এলেন। জল খেয়ে সাত্যকি সোম বললেন, ধন্যবাদ। এখন যাই।

তাঁর নিজের জন্যে সাত্যকি সোম কষ্ট করে এলেন, এতে বেশ সংকুচিত হলেন মূষিকবাহন। ভুল বুঝে তাঁকে তেমনভাবে অভ্যর্থনা করা হয়নি, এই কারণে এবারে সত্যিই লজ্জিত হলেন তিনি। বিদায় জানানোর সময় তাঁর কুৎসিত মুখেও সেই লজ্জা ধরা পড়ল।

বাড়ি ফিরে এসে ল্যাবরেটরিতে টিভিডিয়ো যন্ত্রটার সঙ্গে যুক্ত সংকেতবাঁশিটা ঠিকমতো কাজ করছে কি না, সেটা দেখে নিলেন সাত্যকি সোম! ঠিকই আছে। ট্রান্সমিটারের কাছে কোনও শব্দ হলেই, সেটা যদি মানুষের কণ্ঠস্বর হয়, তাহলেও সিগন্যাল হুইলটা বেজে উঠবে। সেই আওয়াজ বাড়ির যে-কোনও জায়গা থেকেই শোনা যাবে।

কিন্তু অন্য কোথাও থাকার দরকার হল না। ল্যাবরেটরি থেকে বেরোতে যাবেন, এমন সময় বাঁশি বেজে উঠল। দ্রুত ফিরে এসে সাত্যকি সোম টিভিডিয়োটার সুইচ অন করে দিলেন। পরিষ্কার ভেসে উঠল ছবি। টেবিলের ওপর রাখা যান্ত্রিক চোখজোড়া তার দিয়ে যুক্ত করা হয়েছে মস্তিষ্কের এক বিশেষ অংশের সঙ্গে, যে অংশ দিয়ে চোখে দেখার তরঙ্গ মস্তিষ্কে পৌঁছোয়। যান্ত্রিক কান আর মুখ তো যোগ করাই আছে। সামনে মূষিকবাহনের কদাকার মুখ।

মূষিকবাহন বলছেন, তোমার মস্তিষ্ককে বাঁচিয়ে রেখেছি। এই মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয় না। এর শক্তি আরও বাড়াতে কমপিউটারের মতন স্মৃতি লাভ করবে, অথচ স্বাধীন চিন্তারও অধিকারী থাকবে। এর জন্যে কি তোমার গর্ব হয় না? তুমি বৃথা রাগ করছ।

সাত্যকি সোম বুঝলেন, এর আগেই হয়তো একবার মূষিকবাহনের সঙ্গে মস্তিষ্কের কথা হয়ে গিয়েছে। যাই হোক, এখান থেকেই রেকর্ড হোক।

মস্তিষ্ক রেগে গিয়ে বলে উঠল, আজ বুঝতে পারছি আপনার চেহারার মতন আপনিও একটা শয়তান। আমাকে হত্যা করেছেন আপনি। আপনার গবেষণার জন্যে একজন রোগীর প্রাণ নিয়েছেন, যে তার চিকিৎসার জন্য আপনার উপর নির্ভর করেছিল।

মূষিকবাহন বিরক্ত হয়ে বললেন, আঃ! কে বলল তোমার প্রাণ নিয়েছি? এই তো তুমি বেঁচে আছ, কথা বলছ। তা ছাড়া তুমি নিজে থেকেই পড়ে গিয়েছিলে…

কথাটা শেষ হল না। মূষিকবাহন কাঁপতে কাঁপতে সামনের চেয়ারে বসে পড়লেন।

মস্তিষ্ক গম্ভীর কণ্ঠে বলে চলল, ডাক্তার মূষিকবাহন বটব্যাল, আপনি হয়তো জানেন না, আমি সম্মোহন জানতাম। এই চোখ দিয়েও সেটা পারি। আপনি বলুন, আমাকে হত্যা করেছেন কি না। যা ঘটেছিল, বলুন।

মন্ত্রমুগ্ধের মতন মূষিকবাহন বলে চললেন, আমি তোমাকে হত্যা করেছিলাম একটা টাটকা মস্তিষ্ক পাওয়ার জন্যে। অনেকদিন ধরেই এটা পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। সে দিন হাসপাতালের ছাদের ওই অংশটাতে কেউ ছিল না। তোমাকে ডক্টর সোমের কথা জানতে চাওয়ার ছল করে ছাদের নির্জন অংশ দিয়ে হাঁটছিলাম। তারপর কিনারায় আসতেই হঠাৎ পেছন থেকে ধাক্কা দিলাম। বাঁচবার কোনও প্রশ্ন ছিল না। শরীর চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। আঘাতটা যাতে মস্তিষ্কে না লাগে, তার জন্যে তোমার স্কুটার চালানোর হেলমেটটা মাথায় পরতে বলেছিলাম। তুমি ভেবেছিলে, মাথার যন্ত্রণা লাঘব করার জন্যে আমি বলেছিলাম। মর্গে ডাক্তার সচদেবকে বলে সহজেই মস্তিষ্কটা আয়ত্ত করতে পেরেছিলাম। তোমার শোকার্ত বাবা তোমার চোখের সঙ্গে মস্তিষ্কটাও হাসপাতালকে দান করতে অরাজি হননি, পরমভট্টারক–

সাত্যকি সোম নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তাঁর মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে একটি শব্দ মাত্র বেরোল, শয়তান!

পরমভট্টারক! তাকে তিনিই পাঠিয়েছিলেন ডক্টর বটব্যালের কাছে। টিভিডিয়োর সামনের টেবিলে দুই কনুইয়ে ভর রেখে নিজের কপালটা টিপে ধরলেন তিনি।

মস্তিষ্ক কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, আপনার ওপর থেকে সম্মোহন সরিয়ে নিলাম, ডক্টর বটব্যাল। আপনি অপরাধ স্বীকার করেছেন। অবশ্য তাতে আপনার কোনও ক্ষতি হবে না। কেউ আপনার অপরাধের কথা জানতে পারবে না।

আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পরমভট্টারকের মস্তিষ্ক বলল, আমার হৃদ্যন্ত্র নেই। থাকলে নিজের অবস্থা জেনে হয়তো হার্টফেল করতাম। কিন্তু একটা ম্যাজিক দেখিয়ে আমি অনেক ডাক্তারকে অবাক করে দিয়েছি অনেক অনুষ্ঠানে। প্রায় পাঁচ মিনিট হৃৎস্পন্দন বন্ধ করে তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছি। তাঁরা কেউ স্টেথোস্কোপ আমার বুকে চেপে ধরেছেন। কেউ নাড়ি ধরেছেন। না পেয়েছেন হৃৎস্পন্দন, না পেয়েছেন নাড়ির স্পন্দন। আজ সেই ম্যাজিক দেখানোর চেষ্টা করব। ওই স্ট্যান্ডে রাখা কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড আমার ব্রেনের সঙ্গে যুক্ত। কাজেই ওটার ওপর আমার প্রভাব খাটবে। দেখুন, শেষ ম্যাজিক। তারপরে এই মস্তিষ্কটা আপনার ল্যাবরেটরির অন্য বয়ামগুলোতে রাখা মস্তিষ্কের মতোই একটা মৃত মস্তিষ্কে পরিণত হবে।

ডাক্তার মূষিকবাহন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতন উঠে দাঁড়ালেন। বিস্মিত হয়ে দেখলেন, রক্তসঞ্চালন আর বিশুদ্ধিকরণের যান্ত্রিক হৃদ্যন্ত্রের পাম্প মেশিনের ফ্রিকোয়েন্সি কমে যাচ্ছে। মিনিটে ষাট, বিয়াল্লিশ, কুড়ি. ব্যাস। ইলেকট্রনিক এইচ-বি-ডি-ইউ বা হার্টবিট ডিসপ্লে ইউনিটে চতুর্থ মিনিটে আর কোনও সংখ্যাই এল না। এ-ও কি সম্ভব! যন্ত্র পঁচাত্তর বছরের গ্যারান্টিযুক্ত। তিনি একবার এই বোতাম, একবার ওই বোতাম টিপে দেখতে লাগলেন।

কিন্তু তাঁর জন্যে আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ বয়ামের দিকে চোখ পড়তেই তিনি সেটা দেখলেন। অসহায়ের মতন স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে দেখলেন, কীভাবে পরমভট্টারকের মস্তিষ্কটা গলে গলে যাচ্ছে। পচনরোধী ওষুধের অভাবে একটা মৃতদেহের মস্তিষ্কের তিন-চার দিনে যে অবস্থা হয়, কিছুক্ষণের মধ্যেই এই মস্তিষ্কটা সেই অবস্থায় পৌঁছোল।

পরদিনই আবার সাত্যকি সোমের আগমন তাঁর কাছে বিরক্তিকর লাগল। ভাবলেন, ডক্টর সোম হয়তো এই মস্তিষ্কটার ব্যাপারে খুব ইনটারেস্ট পেয়েছেন। কিন্তু তিনি তো জানেন না, এ যাত্রায় তাঁর সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

সপ্তাহের এই দিনটাতে তিনি রোগী দেখেন না। সকালে শুধু একবার হাসপাতালে যেতে হয়। সাত্যকি সোমকে গবেষণাগারে নিয়ে গিয়ে বললেন, কিছু হল না, ডক্টর সোম। যান্ত্রিক গোলযোগে মস্তিষ্কটা নষ্ট হয়ে গেল। আপনার যন্ত্রপাতি আপনাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি।

সাত্যকি সোম ফাঁকা বয়ামটির দিকে তাকালেন, যেমন করে মৃত প্রিয়জনের ফাঁকা ঘরের দিকে লোকে তাকায়। পরমভট্টারকের দ্বিতীয় মৃত্যু তিনি তাঁর টিভিডিয়োর পর্দায় দেখেছেন।

যন্ত্রগুলো হাতে নিয়ে ডক্টর সোম বললেন, আমার আরেকটা যন্ত্রও আপনার এখানে আছে, ডক্টর বটব্যাল। সে দিন যখন আমার জন্যে জল আনতে গেলেন, সেই সময় এটা এখানে রেখে দিয়েছিলাম। এই বলে পাশের কাবার্ডের এক কোণে রাখা মিনি ট্রান্সভিশনটা তুলে নিলেন তিনি। পাঁচ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত শব্দ আর দৃশ্য দুটোই ট্রান্সমিট করতে পারে যন্ত্র। আর ডক্টর সোমের বাসস্থান তো এখান থেকে তিন কিলোমিটার মাত্র।

মূষিকবাহন কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকালেন ডক্টর সোমের দিকে। সাত্যকি সোম বললেন, আপনার সঙ্গে পরমভট্টারকের কথোপকথনের দৃশ্য-শ্রাব্য সবই ধরা আছে আমার ভিসিআর-এ। একজন প্রতিভাবান নিরপরাধ তরুণকে জঘন্যভাবে হত্যার অপরাধের প্রমাণ হিসাবে ওটা পুলিশের হাতে যাবে।

কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন মূষিকবাহন। তারপর হো-হো করে অট্টহাসি হেসে বললেন, সম্মোহিত করে আমাকে দিয়ে কথা বলিয়ে নেওয়া হয়েছে, এ কথা বিশ্বাস করাতে বেগ পেতে হবে না। কাজেই ওটা ধোপে টিকবে না। এরপরে যার মস্তিষ্ক জোগাড় করব, সে আর যা-ই হোক, এসব হিপ্নোটিজম-ফিজুম যেন না জানে, সেদিকে নজর রাখতে হবে।

সাত্যকি সোম স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মূষিকবাহনের কথা শুনে। বুঝতে পারলেন, একটা জীবন্ত মস্তিষ্ক না-পাওয়া পর্যন্ত মূষিকবাহন বিরত হবেন না। আর তার বলি হবে তাঁরই কোনও রোগী। মানসিক রোগগ্রস্ত বা মস্তিষ্কের রোগীর পক্ষে আত্মহত্যা করাটা যে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তা ছাড়া ব্রেন অপারেশনে মৃত্যু তো এখনও হয়। মূষিকবাহন এইসব বানানো কারণে আড়ালে নিরাপদেই থাকবেন।

তাই এবারে মোক্ষম অস্ত্র ছাড়লেন ডক্টর সোম।

মূষিকবাহনের জান্তব মুখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, ডক্টর বটব্যাল, আপনি হয়তো এস-এল-ডি-র নাম শুনেছেন। না, না, এই মিথ্যানিরূপণ যন্ত্র এখন পৃথিবীর সব জায়গার পুলিশ আর আদালতের অপরিহার্য অঙ্গ। ওতে কোনও ভুল হয় না। শতকরা নিরানব্বই ভাগ নির্ভুল। বাকি এক ভাগ, কোন ক্ষেত্রে হয়, সেটাও হয়তো আপনি জানেন। হ্যাঁ, মস্তিষ্কবিকৃত লোকেদের বেলায়। আপনি তার মধ্যে পড়েন কি? আমার এখন সন্দেহ হয়। নইলে এস-এল-ডি যন্ত্রের সামনে আপনার বিবৃতি ধোপে টিকবে না, ডক্টর বটব্যাল।

মুহূর্তের জন্যে রক্তহীন হয়ে গেল মূষিকবাহনের মুখ। নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। তারপর অনুনয়ের ভঙ্গিতে বললেন, গবেষণার খাতিরে ভবিষ্যৎ-মানুষের কল্যাণের স্বার্থে যদি মাত্র একজনের জীবন গিয়েই থাকে, সেটাকে এত বড় করে দেখছেন কেন, ডক্টর সোম? বিশেষ করে, আপনার মতন একজন বিজ্ঞানী?

ডক্টর সোম গম্ভীরভাবে বললেন, এ প্রশ্ন বিচারকের সামনেই না-হয় তুলবেন।

আবার কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে বসে থাকলেন ডক্টর মূষিকবাহন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। বিজ্ঞানের জন্যে আমি প্রাণ দিতে ভয় পাই না। আমি বিচারকের সামনে বলব আমার গবেষণার কথা। ভবিষ্যৎ-মানুষের জ্ঞানভাণ্ডারের জন্যে আমি একটা ব্যাংক করতে চেয়েছিলাম, যাতে থাকবে মেধাবী মস্তিষ্ক। যাদের আয়ু হবে কয়েকশো বছর। তাতে তাদের মেমারি স্টোরেজ বিশাল হবে। সারা দিনরাত তারা জ্ঞান আহরণ করবে পড়াশোনা করে যান্ত্রিক ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে। সাধারণ মানুষের মতন এই মস্তিষ্ক বৃদ্ধ হবে না।

বক্তৃতা বন্ধ করে ডক্টর বটব্যাল যা করলেন, তাতে সাত্যকি নোম অবাক হয়ে গেলেন। যেন এতক্ষণ কিছুই হয়নি, এমনভাবে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক স্বরে বললেন, যাক গে, আপনি আপনার কর্তব্য করবেন নিশ্চয়। আজ আবার চেম্বার বন্ধ বলে কৌটিল্যকে ছুটি দিয়েছি। একটু বসুন, আমি চটপট দু-কাপ কফি করে আনি।

সাত্যকি সোম আপত্তি করতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই মূষিকবাহন ভেতরে ঢুকে গেলেন। সত্যিই দু-মিনিটের মধ্যে দু-কাপ কফি নিয়ে এসে হাজির হলেন তিনি। চেম্বারের পাশেই একটা ছোট্ট কেবিনে গ্যাস স্টোভের সামনে চা-কফির সরঞ্জাম সব আছে।

বাইরে থেকে একটা গন্ধ আসছে কি? সাত্যকি সোম নাক কুঁচকে অনুভব করার চেষ্টা করলেন। মূষিকবাহনকে বললেন, আপনার গ্যাস স্টোভটা বন্ধ করেছেন তো ডক্টর বটব্যাল? একটা গন্ধ আসছে যেন।

ডক্টর বটব্যাল ছুটে ভেতরে গেলেন। ফিরে এসে বললেন, হ্যাঁ, বন্ধই আছে।

 বাইরে থেকে হয়তো আসছে। আমি তো পাচ্ছি না।

কফিপান শেষ করে সাত্যকি সোম উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর মনটা খারাপ হয়ে গেল। তাঁর জন্যেই পরমভট্টারক আজ নেই। আবার যতই পাষণ্ড হোক, মূষিকবাহনের মতন। দেশবিখ্যাত একজন ডাক্তার

মূষিকবাহনের সঙ্গে করমর্দন করে ক্লান্ত স্বরে সাত্যকি সোম বললেন, আমাকে ক্ষমা করবেন ডক্টর বটব্যাল। কিন্তু, আমার বিবেক…

ডক্টর সোমকে কথা শেষ করতে দিলেন না মূষিকবাহন। বিকটভাবে হেসে উঠে বললেন, আপনাকে আর বিবেকের দংশন বেশিক্ষণ ভোগ করতে হবে না, ডক্টর সোম। আর পনেরো মিনিটের মধ্যেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আপনার মৃত্যু হবে। আপনার কফির পেয়ালায় যা মিশিয়েছি, সেটা পোস্টমর্টেমেও ধরা পড়ে না। কার্ডিয়াক ফেলিয়োর, এটাই সকলে বুঝবে। না, বমি করেও কিছু হবে না। ওটা রক্তের সঙ্গে মিশতে কয়েক সেকেন্ড লাগে, অথচ শারীরিক কোনও অস্বস্তিবোধ হয় না। একটু থেমে হেসে মূষিকবাহন বললেন, হ্যাঁ, এস-এল-ডি-র সামনে গেলে হয়তো অপরাধী ধরা পড়ত, কিন্তু এখানে সে প্রশ্নই উঠবে না কারও মনে। কোনও স্বার্থের সংঘাত বা বিদ্বেষ যে আমাদের মধ্যে থাকার কারণ নেই, সে বিষয়ে ওসব কাগজের কাদাখোঁচা পাখিরাও নিঃসন্দেহ।

এ কথা শুনে সাত্যকি সোম কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে মূষিকবাহনের দিকে চেয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, কিন্তু এখানেও যে একটা গন্ডগোল হয়ে গেল, ডক্টর বটব্যাল। আমার কাপে বেশি কফি দিয়েছেন দেখে আমি কাপ দুটো পালটাপালটি করে নিয়েছিলাম, যখন আপনি গ্যাস স্টোভটা দেখতে গেলেন, তখন। এ সময় কফি খাওয়ার অভ্যাস তো আমার নেই।

 এই বলে নমস্কার জানিয়ে উঠে পড়লেন তিনি। ঘর থেকে বেরিয়ে একবার পেছন ফিরে দরজাটা ভেজাতে গিয়ে দেখলেন, ডাক্তার মূষিকবাহন চেয়ারে বসে হাত দুটো প্রাণপণ চেপে ধরেছেন। তেলা মুখমণ্ডলে বিন্দু বিন্দু ঘাম। রাস্তায় নেমে ভারাক্রান্ত মনে সাত্যকি সোম ভাবলেন, হয়তো এটাই ভালো হল। অত বড় একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানীর পক্ষে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় শোনা–বিজ্ঞানী। হিসাবে তিনি নিজেই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারতেন না।

[আনন্দমেলা, ২৭ কার্তিক ১৩৯২]