নাম তার রুবাই
তোমার নাম কী?
রুবাই।
বয়স কত?
সাত-সাত-সাত-সাত…
মনোতোষবাবু অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকানোর আগেই রোবোট্রনিকসের মালিক ইফতিকার রহমান ওটার বাঁ কানের পেছনে চুলের মধ্যে হাত দিয়ে সুইচটা অফ করে দিলেন। তারপর একটু অন্যমনস্কভাবে ধরা গলায় বললেন, অনেকদিন ফেলে রেখেছিলাম, তাই একটু যান্ত্রিক গোলযোগ হয়েছে। তবে সফ্টওয়্যারে তো অনেক কিছুই বদলে নিয়ে নতুন করে প্রোগ্রামিং করতে হবে।
কম্পিউটার আর রোবোর ব্যবসায়ে ইফতিকার রহমান প্রচুর অর্থের মালিক হলেও তাঁর ব্যবহার যেমন সুন্দর, তেমনি আন্তরিক। তবে কয়েক বছর হল তাঁর সেই মিষ্টি হাসিটা যেন একটু ক্লান্তি-মাখা, চোখেও কিছুটা বিষণ্ণ ও অন্যমনস্ক দৃষ্টি।
মনোতোষবাবু বললেন, আপনাকে তো সবই বলেছি, মিস্টার রহমান। আমার মেয়ের বয়স নয় বছর। একটা ঘটনায় সে পঙ্গু। অবশ্য কৃত্রিম পা দিয়ে সে অভাব অনেকটা পূরণ করা হয়েছে। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হতে একটু সময় নেবে। তত দিন তাকে সর্বক্ষণ সঙ্গ দেওয়ার জন্যে তারই সমবয়সি একজন বন্ধু দরকার। আমার বন্ধু ডাক্তার তপন মাইতির কাছে আপনার ওই বিশেষ রোবোটার কথা শুনে অনেক আশা নিয়ে এসেছি। তবে আমার মেয়ে একটু জেদি ধরনের। সঙ্গীর ওপর চোটপাট করতে পারে। এমনকী কিল-চড়ও মেরে দিতে পারে। এটুকু অত্যাচার তাকে সহ্য করতে হবে। উলটে রাগ দেখানো বা আঘাত করা চলবে না। মেয়ের সবরকম ফাইফরমাশ খাটতে হবে। আমি আর ওর মা দু জনেই অফিসে যাই। সে সময়টা ওর দেখাশোনা করতে হবে। তার সঙ্গে খেলতে হবে। সাধারণ রোবো এতটা পারবে না। কারণ তাদের মন বলে পদার্থ নেই, যা কিনা আপনার এই রোবোর আছে। আপনিই তো বলেছেন, ঝিনুকে মুক্তোর সৃষ্টির মতো রোবোর মধ্যেই মনের সৃষ্টি হয়ে যায়। তবে মিস্টার রহমান, রোবোটাকে মেয়ে করতে হবে। বয়সও সাত থেকে দু-বছর বাড়িয়ে নয় করুন। আমার মেয়ের সমবয়সি। নাম দিন–পিংকি।
ইফতিকার রহমান মৃদু হাসলেন। তার জন্যে বেশি সময় লাগবে না। ধরুন, দিন তিনেক। গলার স্বরের কোনও পরিবর্তন করার দরকার নেই, সাত বছর বয়সের ছেলের গলা নয় বছরের মেয়ের গলা বলে চালালে খুব বেমানান শোনাবে না। ভয়েস ফ্রিকোয়েন্সির কোয়ালিটি সামান্য অ্যাডজাস্ট করে দেব। পোশাকটা বদলে দেব আর মাথাটাকেও। আর মিস্টার চৌধুরী, আমি তো বলেইছি, রুগ্ণ আর প্রতিবন্ধী নিঃসঙ্গ ছেলেমেয়েদের জন্যেই এই রোবো আমি রেখেছি। ভাড়াও নিই নামমাত্র। আর যাকে-তাকে দিইও না। শুনলে হাসবেন, এর ওপর আমার এক বিশেষ ক্ষমতা আর দুর্বলতা আছে। তাই আমি একে ভাড়া দিয়েও মাঝে মাঝে নিজে থেকেই দেখে আসি, যা অন্য রোবোর বেলায় করি না।
তারপর রোবোটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে ইফতিকার রহমান বললেন, এর মধ্যে যে মন সৃষ্টি হয়েছে, সেটা ছোট ছেলেমেয়েদের জন্যে মমতায় ভরতি, বিশেষ করে, সে যদি হয় অসুস্থ। শিশুদের সব অত্যাচার এ সহ্য করে। আবার মাঝে মাঝে ছোটখাটো খুনশুটিও করে, বন্ধুকে খেপায়। মানুষ-বন্ধু যেমন করে। নইলে দেখতেন, আপনার মেয়েরই একঘেয়ে লাগত। সে চায় বন্ধু, জো-হুঁজুর দাসী নয়। একে বন্ধ করে দেওয়ার সুইচটা করে দেব ডান কানের পেছনে। বাঁদিকের সুইচটা আগের এই স্টোরেজের জন্যে থাকবে। ওটাকে অন করবেন না। ডানদিকের সুইচটাকে আবার খুব প্রয়োজন ছাড়া অফ করবেন না। এই সুইচের ব্যাপারটা অবশ্য আপনার মেয়েকে বলবেন না।
তিন দিন পরে রোবোট্রনিকসে এসে মনোতোষবাবু দেখলেন, রোবোটা শোকেসে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক যেন তাঁর মেয়ে টুকির সমবয়সি একটি মেয়ে। দুষ্টু হাসি হাসি মুখ। ভেনট্রিলোকুইজমের কথা-বলা পুতুলের মতন। ইফতিকার রহমান ওটাকে বের করে এনে সুইচ অন করে জীবন্ত করে দিলেন। তারপর মনোতোষবাবুকে ইঙ্গিত করলেন প্রশ্ন করতে।
মনোতোষবাবু আগের দিনের প্রশ্নই করলেন, তোমার নাম কী?
রোবো হেসে উত্তর দিল, পিংকি।
বয়স কত?
নয় বছর।
তোমার বন্ধুর নাম জানো?
সে আবার হেসে রিনরিনে গলায় উত্তর দিল, হ্যাঁ, টুকি সোনা।
মনোতোষবাবু মিস্টার রহমানের দিকে চেয়ে হাসলেন। রহমান ছোটদের মনস্তত্ত্ব ভালোই বোঝেন, তাতে সন্দেহ নেই। টুকি পিংকিকে পেয়ে খুবই খুশি হবে।
তিনি রহমানকে জিজ্ঞেস করলেন, কী কী খেলা শিখিয়েছেন একে?
রহমান বললেন, ছোট মেয়েরা যেসব খেলা খেলে। এক্ষেত্রে যাতে বেশি দৌড়োদৌড়ি করতে না হয়, এরকম সব খেলাই ও জানে। ওকেই জিজ্ঞেস করুন-না।
মনোতোষবাবু জিজ্ঞেস করতেই পিংকি মহা উৎসাহে সুর করে বলতে থাকে, আগডোম বাগডোম খেলা নানা, সাহেববাবুর বৈঠকখানা। ইকড়ি মিকড়ি বাগাডেল, রং মেলানো লুডোর খেল। কে মেরেছে বোলো না, বলে দিলে খেলব না। রাজার খবর আইল, একটি বালিকা চাইল। ফলে ফল ফুলটি, একটি তুলে দুটি…
হয়েছে, হয়েছে। রহমান সাহেবের ধমক খেয়ে থতমত খেয়ে চুপ করে গেল পিংকি।
পিংকিকে পেয়ে টুকি তো খুব খুশি। দেখে মনোতোষবাবু আর তাঁর স্ত্রী-র মনও আনন্দে ভরে গেল। টুকির হুকুম তো লেগেই আছে। পিংকি, এক গ্লাস জল এনে দে।… পিংকি, চুল আঁচড়ে দে।.. পিংকি, লুডো নিয়ে আয়, খেলব। পিংকিও মহা উৎসাহে সব হুকুম পালন করছে।
বেশ চলছিল। গোল বাধল পরের রবিবার। দুপুরে একটা ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে মনোতোষবাবুর তন্দ্রামতন এসেছে। টুকির মা খাটে শুয়ে মিনি টিভি-টা পাশে নিয়ে দেখছিলেন। এমন সময় টুকির ঘরে চ্যাঁচামেচি শুনে দু-জনেই তড়াক করে উঠে পড়লেন। পাশের ঘরে গিয়ে দেখলেন, টুকি পিংকিকে কী বলছে, আর পিংকি দুষ্টু-দুষ্টু মুখ করে শুধু না–না বলে যাচ্ছে।
বাবা-মা-কে দেখে টুকি উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, দ্যাখোনা বাবা, দ্যাখো-না মা, পিংকিটা কী জোচ্চুরি করছে। আমি নিজে দেখেছি, ওর তিনটে খুঁটিই ঘরে ছিল। আমি যখন চাল দিচ্ছি, তখন চুপ করে একটা বের করে দিয়েছে। ওরকম চোট্টার সঙ্গে আমি খেলব না।
পিংকি মৃদু প্রতিবাদের সুরে বলল, না মেসো, না মাসি…
মনোতোষবাবু তখনকার মতন দু-জনকে থামিয়ে তক্ষুনি ইফতিকার রহমানকে টেলিফোন করলেন। সব শুনে মিস্টার রহমান হাসতে হাসতে বললেন, আপনাকে তো বলেইছি, রোবোটাকে একটি মানবশিশুর মতন স্বাভাবিক করার জন্যে ওর মধ্যে কিছু শিশুসুলভ দুষ্টু বুদ্ধি ফিড করে দিয়েছি। নইলে দেখবেন, আপনার মেয়েরই ভালো লাগবে না ওরকম হাবাগোবা সঙ্গী পেয়ে। তবে সিক্রেটটা আপনাকে বলছি। লুডো খেলায় প্রতি তিনবারের খেলার ছয় নম্বর চাল দেওয়ার সময় ও জোচ্চুরি করবে। ধরা পড়লে আপনার মেয়েকে বলবেন কাঁধে ছোট করে একটা চাপড় দিতে। তাহলেই অপরাধ স্বীকার করে বলবে, আর কখনও করব না দিদিমণি।
সমস্যাটা মিটল তখনকার মতো।
কিছু দিন পরে অফিস থেকে ফিরেই মনোতোষবাবু স্ত্রীর কাছে শুনলেন, আবার দু জনে লেগেছিল। এবার যাকে বলে চুলোচুলি। পিংকির লম্বা নাইলনের চুল আর টুকির ছোট বব-করা চুল। সপ্তাহে একবার পিংকি টুকির সঙ্গে ছোটখাটো ঝগড়া করে। ইফতিকার রহমান বলেন, ভাব হওয়ার পরে নাকি বন্ধুত্ব আরও বেড়ে যায়, তাই সাময়িক আড়ি করার এই ব্যবস্থা। সে দিন পিংকি নাকি ছড়া কেটে বলেছিল, লম্বা চুল গোলাপ ফুল, ছোট চুল খুঁটের গুল। তা-ই শুনে টুকি রেগে গিয়ে পিংকির চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলার জোগাড় করে। তার মা এসে কাঁধে চাপড় মেরে পিংকির দুষ্টুমি বন্ধ করেন। তাতেও নাকির টুকির রাগ যায় না। শেষে মা টুকিকে একটা আইসক্রিম কিনে দিলেন। পিংকিকে দেখিয়ে দেখিয়ে আইসক্রিমটা খাওয়ার পর টুকির রাগ পড়ল। তারপর অবশ্য আবার দু জনে ভাব।
সে দিনই মাঝরাত্তিরে টুকির ভয়ার্ত গলা শুনে মনোতোষবাবু আর তাঁর স্ত্রী দুজনেই ঘুম থেকে ধড়মড় করে উঠে টুকির ঘরে এলেন। টুকি বলল, দ্যাখোনা মা, পিংকি কী সব আবোল-তাবোল বকছে। বাথরুমে যাব বলে ওকে ডেকেছি একটু দাঁড়ানোর জন্যে। ও উঠেই বলল, কী বলছ পাপুবাবু, কবিতা শুনবে?… আচ্ছা, আমার নাম কি পাপু? আমি কি ছেলে, যে, বাবু বলবে? আমার নাম টুকি। ওর নাম পিংকি।
পিংকি হেসে বলল, দুর বোকা ছেলে! আমি তো তোমার বন্ধু রুবাই। শোনো, কবিতা বলছি– হ্যাংলা হাতি চ্যাংদোলা,
শূন্যে তাদের ঠ্যাং তোলা।
মক্ষীরানি পক্ষীরাজ
দস্যি ছেলে লক্ষ্মী আজ।
আদিমকালের চাঁদিম হিম,
তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম।…
বেগতিক দেখে মনোতোষবাবু পিংকির ডান কানের পেছনে চুলের মধ্যের সুইচটা অফ করে দিলেন। তাতেও কোনও ফল হল না। পিংকি দ্বিগুণ উৎসাহে বলতে লাগল, ও–গল্প শুনবে? তা-ই বলো। কোন গল্প বলব? অলখচোরা সিদ্ধ বাঁটুল? না, হিমশুভ্রা আর সাত বামন?
মিস্টার রহমানের কথাটা মনে পড়ল মনোতোষবাবুর। তবে কি কেউ বাঁদিকের সুইচটা চালু করেছে? হাত দিয়ে দেখলেন, তাঁর সন্দেহ ঠিকই। এবারে ওই সুইচটা অফ করে ডানদিকেরটা চালু করলেন। মুহূর্তে পিংকি ফিরে এল। বলল, কী বলছ টুকিদিদি বাথরুমে যাবে?
পরদিন সকালেই ইফতিকার রহমান স্বয়ং মনোতোষবাবুর বাড়িতে এসে হাজির। সলজ্জভাবে বললেন, কাল রাত্তিরে রোবোটাকে স্বপ্নে দেখলাম। তাই একবার দেখতে এলাম। ও আর কোনও গোলমাল করেনি তো চৌধুরী?
মনোতোষবাবু হাসতে হাসতে কাল বিকেলের ঝগড়ার কথা বললেন। রাত্তিরের ঘটনাটাও।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন ইফতিফার রহমান। একটা ধূসর মেঘ যেন তাঁর মুখে দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। তিনি ধীরে ধীরে বললেন, টুকি ওর চুল ধরে টানার সময় হয়তো বাঁদিকের সুইচটা অন হয়ে যায়। বাঁদিকের ব্রেনটা আমি নষ্ট করে ফেলিনি। কারণ ওটাতে আমার ছেলের স্মৃতি জমে আছে। পিংকি আগে যখন রুবাই ছিল, সে ছিল আমার ছেলে পাপুর সঙ্গী। পাপু মাত্র সাত বছর বয়সেই মারা যায় লিউকোমিয়াতে। সে-ও আজ পাঁচ বছর হতে চলল।
নীচের দিকে চেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে হয়তো ছেলের কথাই ভাবতে থাকেন তিনি। মনোতোষবাবু আর তাঁর স্ত্রী-ও কথা হারিয়ে ফেলেছেন। চারপাশের আবহাওয়াটাই যেন ভারী হয়ে উঠল।
টুকিও যে ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেটা কেউ লক্ষ করেননি এতক্ষণ। সে খটখট শব্দ করে দ্রুত ঘরে ঢুকে গেল। রোবোটাকে সঙ্গে করে নিয়ে এল বাইরে। তারপর তার বাঁ কানের পেছনে চুলের মধ্যে পাগলের মতন কী খুঁজতে খুঁজতে বলে উঠল, বাবা। আমার রুবাইভাইকে এনে দাও। ভাই আমাকে কবিতা শোনাবে, গল্প শোনাবে, পাপুভাইয়ের কথা বলবে। চুল আঁচড়ানো, বিছানা পরিষ্কার করা–এগুলো আমি নিজেই করতে পারব। আর আমি ভাইটির সঙ্গে কখনও ঝগড়া করব না। কখনও না–কক্ষনো না। [ঝালাপালা গল্প বার্ষিকী, ১৩৯৫]