গল্প - রেবন্ত গোস্বামী
ছড়া - রেবন্ত গোস্বামী
সাক্ষাৎকার

জন্মান্তর

জন্মান্তর

ছোট্ট বাক্সটা হাতে নিয়েই বিশু তেড়ে এল যোগেনের দিকে, বলি, এটা কী এনেছিস? বায়োমেট্রি বক্স আনতে বললাম, আর তুই স্কুলের বায়োলজি বক্স এনেছিস! এটা কি মাস্টারমশাই তৈরি করা হচ্ছে, না ছাত্র তৈরি করা হচ্ছে যে, হাতে ধরিয়ে দিবি? আয়, বাক্সের এই ছুরিটা দিয়ে তোর কান পরিষ্কার করে দিই। যা, এটা রেখে দিয়ে বায়োমেট্রি বক্সটা নিয়ে আয়।

যোগেন বাক্সটা নিয়ে ফের ছুটল। স্কোলস্টোরে ওটা রেখেই গেল প্যাথেলস্টোর আলমারির দিকে। বিশু ভাবল, যোগেনের যা বুদ্ধি, তাতে হয়তো বায়োলজি বক্সটা প্যাথেলস্টোরেই রেখে দেবে। এই এক ঝামেলা হয়েছে ওকে নিয়ে।

ঠিক এই সময়ে দরজা ঠেলে কর্মশালায় ঢুকলেন পাপু রোবোটেসৃপোরিয়ামের মালিক ইফতিকার রহমান। সঙ্গে অন্য এক ভদ্রলোক।

বিশু সেদিকে নজর করল না। সে যোগেনের হাত থেকে বক্সটা নিয়ে রোবটের আঙুলে নিক্স লাগাতে লাগাতে যোগেনকে বলল, এবার কার্ডিয়ো ক্যাসেটটা নিয়ে আয়। আবার গানের ক্যাসেটটা আনিস না। কার্ডিয়ো ক্যাসেট!

ইফতিকার রহমান হেসে বিশুর কাছে এসে ডাকলেন, বিশু!

বিশু তড়াক করে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর নীরবে মালিকের নির্দেশের অপেক্ষা করতে লাগল।

ইফতিকার রহমান বললেন, ইনি আমার বন্ধু প্রবাহণ রায়। একটা বিশেষ দরকারে এসেছেন। সেটা পরে বলব। তার আগে বলো, ডাক্তার রোবট তৈরির কাজ কত দূর এগোল?

বিশু সামনের রোবটের গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, কাজ এখনও অসম্পূর্ণ। তবে পঁয়ষট্টি দশমিক সাত পাঁচ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

প্রবাহণ ইফতিকারের দিকে চেয়ে হেসে বললেন, বাব্বা! পাক্কা হিসেব।

ইফতিকার হেসে বললেন, হ্যাঁ। বিশু অঙ্কেও একেবারে এ-ওয়ান টু দি পাওয়ার একশো। তোমার নামটা বিশ্বকর্মা না হয়ে আর্যভট্ট কি ভাস্করাচার্য হলেও হত। কী বলো বিশু?

ওয়ান টু দি পাওয়ার একশো শুনে বিশু হেসে ফেলেছিল। কিন্তু মালিকের বলা নামগুলো সে গণিতবিদ্যায় জানলেও, নিজের নাম বদলাতে সে পারে না। তাই বেরসিকের মতন উত্তর দিল, জানি না।

এদিকে যোগেন হাতে কিছু নিয়ে বিশুর কাছে এসে বলল, কাদিও কাসেৎ। ফরাসি ডাক্তার বোধহয় তার গলায় চিকিৎসা করেছিলেন!

বিশু ভ্রূক্ষেপ করল না। ইফতিকার যোগেনকে বললেন, ওটা থাক এখন।

যোগেন কিন্তু মালিকের কথা কানে নিল না। এই মুহূর্তে বিশুই তার হুকুমকর্তা। অন্য কাউকে সে গ্রাহ্যই করল না। হোক-না সে কারখানার খোদ মালিক। সে আবার বিশুর দিকে ফিরে বলল, এই যে কাদিও

যোগেন! ইফতিকার এবার ধমকে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে যোগেনের যেন সংবিৎ ফিরে এল। সে চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। ইফতিকার প্রবাহণকে বললেন, নাম ধরে ধমক না দিলে কিছু শুনবে না। যোগেন বিশুকে জিনিসপত্র জোগান দিয়ে কাজে সাহায্য করে। বলতে গেলে, তার জন্যেই ওকে যোগেন বলে ডাকা হয়। নইলে ওর আসল নাম বোধহয় রাসভচূড়ামণি। কী বলো বিশু?

রাসভচূড়ামণির অর্থ বিশু বোধহয় জানে না। তবুও সে তার অসুবিধের কথা তুলে বলল, যোগেন থাকাতে কাজ দ্রুত এগোচ্ছে না। কানে ভালো শোনে না। একটা আনতে আরেকটা নিয়ে আসে।

ইফতিকার বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোমার এই রোবট ডাক্তারকে দিয়েই ওর কানের পর্দা বদলে নেওয়া যাবে। যোগেন, এখন তুই দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়া। দরকার হলে ডাকা যাবে।

তাকে নিয়ে কথা হচ্ছে, সেটা যোগেন বুঝতে পারছিল। তবুও মালিকের হুকুমে সে নির্বিকার মুখে দরজার কাছে চলে গেল।

ইফতিকার বিশুকে বললেন, বিশু, তুমি এই রোবট ডাক্তারের ব্যাপারটা এঁকে বুঝিয়ে দাও তো।

বিশু দক্ষ শিক্ষকের মতো প্রবাহণকে বোঝাতে লাগল, এই রোবটটার মধ্যেই থাকবে প্যাথোলজি পরীক্ষার যাবতীয় ব্যবস্থা। তা ছাড়া এটা রোগ নিরূপণ আর তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। প্রেসক্রিপশনের প্রিন্ট-আউটও পাওয়া যাবে। এটার দশটা আঙুলের প্রত্যেকটাতে যে যন্ত্রগুলো লাগানো থাকবে, তাতে কোনওটাতে নাড়ির গতি আর রক্তের চাপ, কোনওটাতে শরীরের তাপমাত্রা, ব্লাড প্রেশার, কোলেস্টেরল, ইসিজি, ইইজি ইত্যাদি সবই পাওয়া যাবে। ব্লাড শুগার ইত্যাদি করতে এখন আর শরীর থেকে রক্ত বার করার দরকার নেই। আঙুলের ডগা দিয়ে শরীর স্পর্শ করলেই হবে। দরকারমতো আঙুলের যন্ত্রটা বদলে পকেট থেকে অন্য যন্ত্র লাগিয়ে নেবে রোবট নিজেই। নানারকম হরমোন ইত্যাদির জন্যে আলাদা আলাদা সুইচ পকেটেই আছে। দরকারমতো সব কিছুরই প্রিন্ট আউট নেওয়া যাবে রোবটের পাশে রাখা এই ডাক্তারি বাক্সের চেরা অংশটা থেকে, বোতাম টিপলেই। বাক্সটা ডাক্তারবাবু নিজেই হাতে করে নিয়ে যাবেন রোগী দেখতে যাওয়ার সময়। আর ডাক্তারের টুপিটাতে আছে মেডিনফোনেট ব্যবস্থা। পৃথিবীর যে কোনও দেশে যে নতুন চিকিৎসাপদ্ধতি আর ওষুধ আবিষ্কৃত হচ্ছে, সেটা প্রতিমুহূর্তেই এসে জমা হচ্ছে এই মস্তিষ্কের কম্পিউটারে–

ইফতিকার বাধা দিয়ে বললেন, ঠিক আছে। এবারে—

কিন্তু শিক্ষকতার নেশা তখন বিশুকে পেয়ে বসেছে। সে সেই ঘরেই বলে চলল, তবে যখন কোনও ওষুধ পরীক্ষিত, উপযোগী আর পার্শ্বক্রিয়াহীন বলে পরিগণিত হবে, তখনই শুধু

এবার বিশুকে থামাতে ইফতিকার একটু ধমক দিয়েই বললেন, বিশু! ব্যাস, ব্যাস।

বিশু থমকে থেমে গেল। ইফতিকার তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, প্রবাহণ এখানে এসেছে এক বিশেষ দরকারে। ওর স্কুলে-পড়া মেয়ের জন্যে একটা গৃহশিক্ষক রোবট দরকার। হয়তো কিছু দিন পরে দিলেও চলত। কিন্তু কালই ও চলে যাচ্ছে দিল্লি। এদিকে স্টকে তো ব্লাংক রোবটের শরীর নেই। আজকালের মধ্যে আসবেও না। তাই ভাবছি–

বিশু প্রমাদ গুনল। সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ডাক্তার রোবটের অনেকখানি করে ফেলেছি, স্যার। এটা খুব জটিল রোবট। মানুষের শরীরে অনেক রোগ, অনেক চিকিৎসাপদ্ধতি। সেটা আবার প্রায়ই নবীকরণ হচ্ছে অধুনাতম আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু গৃহশিক্ষকের প্যাকেজ সহজ, সরল, একঘেয়ে। দুই আর দুইয়ে চার, নয়-এর বর্গ একাশি। এটা হাজার বছর আগেও ছিল, হাজার বছর পরেও থাকবে।

ইফতিকার একটু খোঁচা দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলেন না। বললেন, আর আকবরের বাবা বিন্দুসার, হর্ষবর্ধনের মামা রবার্ট ক্লাইভ–সেটাও। কী বলো?

বিশু লজ্জিতভাবে প্রবাহণকে বলল, অঙ্ক, বিজ্ঞানের বাইরে আমার জ্ঞান শূন্য। তাই স্যার আমাকে ঠাট্টা করেন। তারপর ইফতিকারের দিকে ফিরে বলল, বলছিলাম স্যার, এই ডাক্তার রোবটের কাজটা যখন এগিয়েছে—

ইফতিকার বাধা দিয়ে বললেন, তোমার কথার যুক্তি আছে, বিশু। কিন্তু ও তো কালই চলে যাচ্ছে। ওর মেয়েটা পড়াশোনায়, বিশেষ করে অঙ্কে একটু কাঁচা। আমি ওকে কয়েকটা জায়গার খোঁজ দিয়েছিলাম; কিন্তু ও আবার আর কারও কাছ থেকে রোবোটিউটর নেবে না। তাই বলছিলাম, বিশু, গৃহশিক্ষক রোবট যখন আমাদের হাতে নেইই, তখন আপাতত তুমিই না-হয় ওর মেয়ের পড়াশোনার ভারটা নিয়ে

বিশু আঁতকে উঠে বলল, তা কী করে হয়, স্যার? একটা রোবট টিউটরের কাজ করা আমার মতন লোকের কম্ম নয়। আর ওই যে-ইতিহাস, ভূগোল, বাংলা–এগুলোতে আমার মাথা ওই যোগেনটার মতোই। তা ছাড়া, এই ডক্টোরোবোর কাজটা

ইফতিকার বললেন, কিছু দিন না-হয় আমার ভাইপো তৌফিক কাজটা সামলে নেবে। তোমার মতন চটপটে না হলেও সে-ও তো রোবোট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার। আচ্ছা, গৃহশিক্ষকের প্যাকেজটা এনে দেখাও তো আমাকে।

বিশু হুকুম দিল, যোগেন! গৃহশিক্ষকের সেটটা।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই যোগেন দুটো দেশলাই বাক্সের মতন জিনিস এনে বিশুর হাতে দিল।

বিশু উলটে-পালটে দেখে বলল, একটু দেখে নেওয়া ভালো, স্যার। যোগেন আবার কী শুনে গৃহভৃত্যের প্যাকেজ এনে না দেয়।

তারপর দেখে বলল, না স্যার, ঠিকই আছে। এই যে লেবেল–গৃ-শি।

প্রবাহণ বললেন, আমাকে একটু বুঝিয়ে দেবেন?

 বিশু হেসে বলল, কেন নয়? এই কেসটাতে গৃহশিক্ষকের জ্ঞানভাণ্ডারের স্টোরেজ আছে। একেবারে অ আ ক খ থেকে স্নাতক পর্যায়ের যে-কোনও ছাত্রছাত্রীকে পড়াতে পারার প্রোগ্রাম। আর অন্যটা একটু স্পর্শকাতর ব্যাপার। বলা যেতে পারে, বিশেষ বিশেষ অবস্থায় ব্যবহারযোগ্য। একজন পাঁচ বছরের শিশুকে যে মেজাজে পড়াতে হবে, সেটা নিয়ে একজন কলেজের ছাত্র বা ছাত্রীকে পড়ানোর মতো হলে চলবে না। ছাত্রছাত্রীর বয়স, তার আই-কিউ, এমনকী তার ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শিক্ষকের আচরণ বদলাবে। আপনার মেয়ের বয়স কত হবে, স্যার?

প্রবাহণ বললেন, বারো। এই তো এবার ক্লাস

 বিশু বাধা দিয়ে বলল, এতেই হবে। এই দেখুন, আমি কাঁটা ঘুরিয়ে এখানে দিলাম। এবার দু-এক বছর বেশি-কমে, বা বুদ্ধির হেরফেরে যে পরিবর্তন, সেটা আপনা-আপনিই অ্যাডজাস্ট হয়ে যাবে।

বিশু ইফতিকারের দিকে ফিরে বলল, দেখুন স্যার, কত সরল ব্যাপার! একটা ফাঁকা হার্ড বডিতে ভরে দিলেই হল। আর এই ডাক্তার রোবট। দু-ডজন কেস ভরতে হয়েছে। মানসিক রোগীর জন্যেই কতরকম ব্যবহারগত বৈশিষ্ট্য। অ্যামনেশিয়ায় একরকম, তো সিজোফ্রেনিয়ায় আরেকরকম। আবার প্যারানয়েড রোগীর জন্যে আরেকরকম। সব কেস তো আবার এক ঢাউস বাক্সে ভরতে হয়েছে। আমার তো ঘাম ছুটে গেল।

ইফতিকার হেসে উঠে বললেন, ঘাম! এই এয়ারকন্ডিশন্ড ঘরে আমাদেরই দাঁত লাগছে, আর তোমার ঘাম! বিশুর হাত থেকে গৃ-শি সেট দুটো নিয়ে বললেন, সত্যিই মিটার রঙকে খুবই সুন্দর বানিয়েছ, বিশু। তুমি চলে গেলে আমি কিছু দিন অসহায় হয়ে পড়ব। কষ্টও হবে। যত দূর করেছ, তার বিবরণ তো সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ড করছ। তৌফিককে দিতে হবে। যা-ই হোক, প্রবাহণের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের কথা তো জানো না। তাকে ফিরিয়ে দিতে আরও কষ্ট হবে। বিশেষ করে তিন্নি মামণির জন্যে। মাসখানেকের মধ্যেই অনেকগুলো রোবটের দেহ এসে যাবে। কিন্তু প্রবাহণ দু-মাসের মধ্যে কলকাতায় আসতে পারবে না। কারণ ওকে দেশের বাইরে চলে যেতে হবে বিশেষ কাজে। তাই অন্তত এই ক-মাস তোমাকেই ওর সঙ্গে দিতে চাই এই দায়িত্বটুকু চাপিয়ে।

বিশু মরিয়া হয়ে আরেকবার প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল, কিন্তু তার আগেই ইফতিকার তার পিঠের ওপরে জোরে চাপড় মারলেন। সঙ্গে সঙ্গে বিশুর পিঠের একটি অংশ ফাঁক হয়ে গেল। ইফতিকার তার ভেতর থেকে একটা বাক্স টেনে বের করে ফেললেন। তারপর যোগেনের আনা গৃ-শি সেটটা সেখানে ভরে দিয়ে পিঠের ঢাকনা দিয়ে দিলেন। তারপর প্রবাহণকে বললেন, নামটা আর বিশু রাখা গেল না। নাম রাখা যাক আমাদের স্কুলের সেই আশু মাস্টার, কী বলিস? তিন্নিকে অবশ্য মাস্টারমশাই বলেই ডাকতে বলবি। তৌফিককে দিয়ে আরেকটা বিশু তৈরি করাতে হবে। দাঁড়া, একটু পরীক্ষা করি। আচ্ছা মাস্টারমশাই, আকবরের বাবা বিন্দুসার আর হর্ষবর্ধনের মামা রবার্ট ক্লাইভ। তা-ই তো?

বিশু, বর্তমানে আশু মাস্টার রেগে গিয়ে বললেন, বুড়ো, কী সব ইয়ারকি হচ্ছে? আমার কোনও ছাত্র হলে–যাক সে কথা। বিন্দুসার সম্রাট অশোকের বাবা। আর রবার্ট ক্লাইভ কার মামা, সে জ্ঞান আমার নেই। তবে হর্ষবর্ধনের না, সেটা জানি।

প্রবাহণ ঘাবড়ে গিয়ে ইফতিকারের কানে কানে বললেন, বাব্বাঃ। ভয়ানক রাগি। ওই হাতে মারধর খেলে তিন্নি বাঁচবে না। একটু নরম স্বভাবের করা যায় না? তিন্নিও মাঝে মাঝে এরকম বেখাপ্পা তারপর তাড়াতাড়ি প্রকাশ্যে বললেন, রাগবেন না, মাস্টারমশাই। আমার বন্ধুটা ছেলেবেলা থেকেই এরকম ঠ্যাঁটা।

আশু মাস্টারকে অফ করে দিয়ে ইফতিকার বললেন, না রে, এই রোবোটিউটর মুখেই কড়া। মনে নরম। তা ছাড়া ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে পড়াবার সময় আপনা-আপনিই তার কড়া মেজাজও নরম হয়ে আসবে। বিশুই সে ব্যবস্থা করেছে, দেখলিই তো। পাছে আদর করলে চামড়ায় ব্যথা লাগে তাই ছাত্রছাত্রীদের গা স্পর্শ পর্যন্ত করে না। যদিও হাতে রাবার কোটিং করে দিয়েছি। তিন্নি মা-র জন্যে তুই চোখ বুজে নিয়ে যা।

হুকুমমতো শ্রমিক রোবট যোগেন যখন আশু মাস্টারকে প্যাকিং করতে ব্যস্ত, প্রবাহণ আর ইফতিকার চেম্বারে বসে চা খেতে খেতে ভারাক্রান্ত মনে সামনের টেবিলটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। সেখানে এলোমেলো ছড়ানো রয়েছে নিহত ইঞ্জিনিয়ার বিশ্বকর্মার বক্ষস্থিত মস্তিষ্ক যন্ত্রগুলো।

[শুকতারা, শারদীয়া ১৪০৩]

জন্মান্তর

জন্মান্তর

জন্মান্তর

একটা পা কাটা বলেই ধরা পড়ল, নইলে পড়ত না।

হাতের কাজ হয়েছিল নিখুঁত। পাখির পালকের চাইতেও নরম আর আলগা ছোঁয়ায় পকেট থেকে ব্যাগটা তুলে নিয়েছিল। ট্রামের দরজার সামনে যা ভিড় হয়েছে এবং যেভাবে মানুষ পাগলের মতো ওঠবার চেষ্টা করছে তার ভেতরে কেউ যে ঘুণাক্ষরে টের পেতে পারে এমন আশঙ্কাও মনে জাগেনি। বিকেল সাড়ে ছ-টার সময় ডালহাউসি ফেরত ট্রামের মতো শিকারের এমন অপূর্ব জায়গা আর কী আছে?

আর মাত্র একটা স্টপ এগোতে পারলেই সে নেমে পড়তে পারত। মুহূর্তে মিলিয়ে যেতে পারত যুদ্ধরত কলকাতার উন্মত্ত উদ্দাম জনারণ্যের মধ্যে। তারপরে লালাজির মদের দোকান। তিন-চার বোতলের দাম বাকি পড়েছে, আজকেই মিটিয়ে দিয়ে প্রাণভরে খেয়ে নিতে পারত। আস্তে আস্তে স্তিমিতদীপ কলকাতার ওপর দিয়ে পিঙ্গল রাত্রি আসত ঘনিয়ে। ডাস্টবিন, ডিমের খোলা আর কাঁচা নর্দমার পেঁকো গন্ধ-ভরা গলিতে অবগুণ্ঠিত একটি গ্যাসপোস্টের নীচে বসন্তের দাগলাগা মুখের ওপর সস্তা পাউডারের প্রলেপ লাগিয়ে যেখানে মেহেরজান দাঁড়িয়ে আছে খরিদ্দারের আশায়, টলতে টলতে সেখানে গিয়েও পৌঁছোতে পারত। একটি রাত্রি। কেটে যেত—আকাশ বাতাস পৃথিবীর আকার-অবয়বহীন পিন্ডাকার একটি কবোষ্ণরাত্রি।

যে-কল্পনাটা মনের মধ্যে নীহারিকার মতো ঘুরছিল, পরিপূর্ণ একটা রূপ পাওয়ার আগেই আচমকা খানিকটা ঝোড়ো হাওয়ায় সেটা দিগন্তে মিলিয়ে গেল।

ট্রাম ছুটছিল পুরো দমে। অভ্যস্ত ডান হাতটা পাখির পালকের মতো নরম আলগা ছোঁয়ায় পকেট থেকে স্ফীতকায় ব্যাগটা তুলে নিয়েছিল। কিন্তু লেডিজ সিটের পাশে কোনার ছোটো জায়গাটিতে যে ছোকরা বাবুটি মন দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াচ্ছিল সে হঠাৎ তড়াক করে লাফিয়ে উঠল।

নিলে, নিলে, … পকেটমার…

কে, কে, কই? প্রচন্ড হট্টগোল। ট্রামের দড়িতে টান পড়ল, ঘচাং করে থেমে গেল গাড়িটা।

তখন আর উপায় ছিল না। বিদ্যুদবেগে সেই অবস্থাতেই নীচে লাফিয়ে পড়ল। কিন্তু সেইসঙ্গেই তার ঘাড়ের ওপরেও ঝাঁপিয়ে পড়ল আরও পাঁচ-সাত জন। হাতে হাতে ধরা পড়ল বুলাকিরাম।

ব্যাগের মালিক ছোঁ দিয়ে ব্যাগটা তুলে নিলেন। আধবয়সি প্রৌঢ় লোক, গলাবন্ধ কোটের সঙ্গে জড়ানো সিল্কের চাদর। ইউরোপিয়ান ফার্মের বড়োবাবু।

আশঙ্কায় ভদ্রলোকের মুখ নীল হয়ে গেছে। কী সর্বনাশ! এখুনি পাঁচশো টাকায় ঘা দিয়েছিল শালা!

দেখুন, দেখুন সব ঠিক আছে কি না।

এস্ত-হাতে ব্যাগ খুলে নোটের তাড়াটা দেখে নিলেন ভদ্রলোক।

বুলাকি কী বলবার চেষ্টা করলে, কিন্তু বলতে পারলে না।

চারদিক থেকে নির্বিচারে কিল-ঘুসি আসছে বন্যার মতো।

নিঃসাড় নির্বাক হয়ে পড়ে রইল বুলাকি। এর পরে থানায় যেতে হবে। নাক থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত রাস্তার ধুলোর ওপরে গড়িয়ে পড়তে লাগল।

কিন্তু ভদ্রলোক দয়ালু।

ছেড়ে দিন মশাই, ছেড়ে দিন। ব্যাগ তো পাওয়াই গেছে, এখন আর…

ঘণ্টা বাজিয়ে ডালহাউসি স্কোয়ারের ট্রাম শ্যামবাজারে চলে গেল।

বুলাকি অবশ্য বেশিক্ষণ পড়ে রইল না পথের ধারে। কাঠের পাটায় ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। চড়ের জ্বালায় গাল দুটো চিনচিন করছে। মুখের ভেতরে একটা কেমন নোনতা নোনতা স্বাদ, দাঁত দিয়ে রক্ত পড়ছে নিশ্চয়। নাকের রক্তে বুকের জামাটায় তিন চারটে বড়ো বড়ো ছোপ পড়েছে।

 শা–লা…

বিকৃত মুখে বিড়ির জন্যে পকেটে হাত দিলে বুলাকি। বিড়ি নেই। ব্যাগের সন্ধান করতে গিয়ে ভদ্রবাবুরা বিড়িগুলো সব ছড়িয়ে দিয়েছে পথের ওপর—ধুলোয় বিবর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু সেটাই যথেষ্ট দুঃখের কারণ নয় বুলাকির। মেহেরজানের জন্যে এক শিশি শৌখিন আতর যে কিনেছিল, ওইসঙ্গে সেই শিশিটাও গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে একেবারে।

দিগন্তে বিলীয়মান ট্রামটার দিকে এক বার আগুনঝরা চোখ মেলে তাকাল বুলাকি। আবার

বললে, শা–লা!

আশপাশের ভিড়টা সম্পূর্ণ কাটেনি এখনও। চারদিক থেকে নানা রকমের মন্তব্য কানে আসছে।

অতি বদমায়েস এই ব্যাটারা মশায়। সেদিন পকেট থেকে আমার শেফার্স কলমটা দিব্যি তুলে নিয়ে গেল। পুলিশে দেওয়া উচিত ছিল হারামজাদাকে।

হারামজাদা! বুলাকির রক্ত গর্জে উঠল ফণাতোলা সাপের মতো। সঙ্গে যদি একখানা ছোরা থাকত আর অবকাশটা যদি অনুকূল হত, তাহলে এর জবাব দিতে পারত বুলাকি। কিন্তু সে সময় নয়, সে-সুযোগও নেই। মেছোবাজারের সংকীর্ণ গলির পথে এখনও সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসেনি। এখানে কলকাতার বড়ো রাস্তার ওপরে এখনও দিনের ঝকঝকে আলো ঝলকাচ্ছে। এখানে ঘণ্টা বাজিয়ে চলেছে ট্রাম, ছুটে চলেছে বাস, রিকশা, ট্যাক্সি আর মিলিটারি কনভয়ের সারি।

পকেটের ফুল-কাটা শৌখিন রুমালে নাক-মুখ মুছে নিলে বুলাকি। আড়ষ্ট পায়ে একটু একটু করে এগোতে লাগল। মাথাটা ঘুরছে, কিল-চড়গুলো কিছুমাত্র দয়া করেনি কোথাও। একটু বসা দরকার। একটু চা খেতে পেলেও ভালো হত।

বেলা ডুবে আসছে। কলকাতার বুকে সন্ধ্যা। ঠোঙাপরা আলোগুলো জ্বলে উঠছে একটার পর একটা। হেদুয়ার গাছগুলোতে কাকেরা কোলাহল করছে। পার্কে জনতা, ওখানে বসা চলবে না। একটু নিরিবিলি দরকার, একটু নির্জনতা।

হারামজাদা! কানের ভেতরে তখনও কথাটা যেন ছুঁচের মতো বিঁধছে। বুলাকির রক্ত ফেনিয়ে উঠতে লাগল। মেছোবাজারের দুর্গন্ধ গলিতে যদি ঘনিয়ে আসত ধোঁয়াটে অন্ধকার; যদি বুলাকির কাছে একখানা ছোরা থাকত; যদি ওই ভদ্রবাবুদের এক-এক জন করে সে। পেত…

 শা–লা …

সাপের গর্জনের মতো চাপা আক্রোশটা আবার বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে। কিন্তু আর হাঁটতে পারছে না। কাঠের পা-টা অত্যন্ত বেশি ভারী বলে মনে হচ্ছে। এ পায়েরও জোড়গুলো যেন আলগা হয়ে গেছে সব। আর এত দুঃখের মধ্যেও ভাঙা আতরের শিশিটা থেকে একটা উগ্র গন্ধ যেন তার সর্বাঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। যেন ঠাট্টা করছে বুলাকিকে।

মেহেরজান। চিৎপুরের গলি। ল্যাম্পপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে আছে জাফরান-রং একখানা শাড়ি পরে। রঙিন কাঁচুলির বাহার প্রলোভন জাগিয়ে উঁকি দিচ্ছে পাতলা শাড়ির আড়াল থেকে। আবছা-আলোয়-ভরা মেহেরজানের ঘর। মেজেতে নরম বিছানা পাতা, একরাশ ছোটো-বড়ো বালিশ।

কিন্তু না। অনেক দিন কিছু দেওয়া হয়নি বেচারিকে। ওরও বড়ো কষ্ট। বয়েস হয়ে গেছে, সস্তা পাউডার মেখেও মুখের দাগগুলো ঢাকা পড়ে না। খরিদ্দার দেশলাই জ্বালিয়েই অন্য দিকে এগিয়ে যায়। আক্রার বাজার, কায়ক্লেশে দিন চলে, তবু বুলাকিকে কখনো বিমুখ করে মেহেরজান। ভালোবাসে? কে জানে! কিন্তু ভয় করে বই কী। বাঘের মতো হিংস্র বুলাকি, সাপের মতো ভয়ংকর। একখানা পা নাই বটে, কিন্তু ছোরা চলে নিখুঁত এবং নির্ভুলভাবে। তাই হয়তো বিনা প্রতিবাদেই আত্মসমর্পণ করে, সোহাগের কথা বলে, নিজের হাতে রান্না করে খাওয়ায়।

কিন্তু বুলাকিরও তো একটা ধর্মভয় আছে। সত্যি বড়ো কষ্ট মেহেরজানের। শাড়ি ছিঁড়ে গেছে। পেট ভরে খেতে পায় না যুদ্ধের বাজারে। কুৎসিত মুখ দিনের পর দিন আরও কদর্য হয়ে যাচ্ছে। এ সময়ে যদি বুলাকি ওকে কিছু দিতে পারত—অন্তত একখানা শাড়ি দিয়েও…

পাখির পালকের মতো নরম আলগা ছোঁয়ায় ব্যাগটা চমৎকার হাতের ভেতরে চলে এসেছিল। বেশ পুরু ব্যাগটা, পাঁচশো টাকা ছিল! উঃ, পাঁচশো টাকা! ভাবতেও গায়ের লোমগুলো শিরশির করে উঠল। ওই টাকায় কী হতে পারত এবং কী হতে পারত না! ইস! হাতের মধ্যে এসেও ফসকে গেল, শুধু একটুর জন্যে।

হারামজাদা…

কিন্তু আর চলতে পারছে না। মাথা ঘুরছে। বুলাকি আবার পার্কটার দিকে তাকাল। বড়ো ভিড় ওখানে, ভদ্রলোকের ভিড়। একটু নির্জনতা দরকার বুলাকির, একটু নিরিবিলি।

এ রিকশ…

ঠুন ঠুন করে রিকশাওয়ালা এল।

কাঁহা যাইয়েগা?

রথতলা ঘাট, গঙ্গা।

আট আনা লাগেগা। এক বার বুলাকির সর্বাঙ্গে সংশয়ভরা দৃষ্টি বুলিয়ে নিলে রিকশাওয়ালা।

চলো ভাই চলো। সব ঠিক হো যায়গা।

ঠুন ঠুন ঠুন। রিকশা চলছে। বিডন স্ট্রিট-ঠোঙাপরা আলো, স্বচ্ছ অন্ধকার। হেমন্তের কুয়াশা আর উনুনের ধোঁয়া আকাশে কুন্ডলী পাকাচ্ছে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ। ওখান দিয়ে একটু এগিয়ে মসজিদবাড়িতে ঢুকলেই…

সেই গলি! গ্যাস-পোস্ট। জাফরানরঙা শাড়িপরা মেহেরজান। ঘরের মেজেতে নরম গদি আর তাকিয়া। হাতের মুঠোর মধ্যে পাঁচশো টাকা কেমন অবলীলাক্রমে চলে এসেছিল। উঃ, ভদ্রলোক, ওই ভদ্রলোকদের এক বার হাতে পেলে দেখে নেবে বুলাকি। ছোরার মুখে একটা তাজা কলিজাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতে কতক্ষণ লাগে!

টুন টুন টুন। চিৎপুর দিয়ে রিকশা চলেছে। পথের দু-দিকের রোয়াকে চোখে পড়ছে আরও অনেক মেহেরজানকে। ওদের প্রায় সকলকেই চেনে বুলাকি, বুলাকিকেও ওরা চেনে। কিন্তু সবাই মেহেরজান নয়। খালি-পকেট প্রেমিককে ভালোবাসা বিলোতে রাজি নয় ওরা— ওদেরও বুলাকিরা আছে।

উতারিয়ে।

স্ট্র্যাণ্ড রোডের রেললাইন পেরিয়ে রিকশা চলে এসেছে রথতলা ঘাটে। সামনে অন্ধকার গঙ্গা। দূরে একটা মালগাড়ির ইঞ্জিন দাঁড়িয়ে অকারণে হুশ হুশ করছে।

উতারো ভাই, গঙ্গাজি আ গিয়া।

ঠারো বাপ ঠারো। খোঁড়া আদমি…

কাঠের পা-টা আগে বাড়িয়ে দিয়ে নামল বুলাকি। শরীরটা টাল খেল এক বার। একটুর জন্যে পড়েনি। ভদ্রলোকেরা শরীরে আর কিছু রাখেনি, মেরে একেবারে থ্যাঁতলা করে দিয়েছে।

কোমরের কষি থেকে সাবধানে বুলাকি খুঁজে বার করলে গেজেটা। আড়াই টাকার মতো সম্বল আছে এখনও। আট আনা পয়সা দিয়ে রিকশাওয়ালাটাকে সে বিদায় করে দিলে।

সামনে হেমন্তের গঙ্গা। জোর হাওয়া দিচ্ছে—শীত শীত করতে লাগল। কিন্তু বুলাকির ভালো লাগল, এই হাওয়াটা যেন তার দরকার ছিল। যেন এরই জন্যে এতক্ষণ প্রতীক্ষা আর প্রত্যাশা করে ছিল সে। মাথার ভেতর যে-আগুনটা জ্বলছিল, গঙ্গার বাতাসে তার অনেকটাই যেন নিবে এল।

চারদিকটা প্রায় নির্জন। একে অন্ধকার, তার ওপরে শীতের বাতাস। শুধু গঙ্গার ঘাটে দু একজন লোক বসে আছে, ভালো করে তাদের বোঝা যাচ্ছে না, কয়েকটা ছায়ামূর্তি বলে মনে হচ্ছে। এদিকে বিস্তীর্ণ পোস্তাটা সম্পূর্ণ নির্জন হয়ে আছে। এই শীতের সন্ধ্যায় ওখানে বসে হাওয়া খাওয়ার শখ নেই কারও।

সিঁড়ি দিয়ে বুলাকি নীচে নেমে এল। গঙ্গায় ভরা জোয়ারের টান, জল অনেকখানি ওপরে উঠে এসেছে, ছলছল করে ইটের গায়ে বাজিয়ে চলেছে মিষ্টি জলতরঙ্গ। ওপারে হাওড়ার আলো, দু-তিনটে বড়ো বড়ো কলের চোঙার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। মাঝগাঙে দুটো নারকেলের জাহাজ নোঙর করে আছে, অন্ধকার স্রোতের ওপরে লাল-সবুজ আলোর দীর্ঘায়িত রেশ নাচানাচি করছে।

হাত দুটো জলে ডুবিয়ে দিতেই একটা স্নিগ্ধ ভালোবাসার স্পর্শে যেন বুলাকির সমস্ত শরীরের ভেতরটা আনন্দিত হয়ে উঠল। আঁজলা আঁজলা করে সে ঘোলা গঙ্গাজল খেল, মাথা-মুখ সমস্ত ধুয়ে নিল। অর্ধেক গ্লানি যেন তার কেটে গেছে। গঙ্গার ঠাণ্ডা বাতাসে আশ্চর্য একটা ঘুমপাড়ানি। আঃ!

কী অসম্ভব ভালো লাগছে। কোনোখানে আর এতটুকু যন্ত্রণা নেই—যেন ঘুমিয়ে পড়বে এক্ষুনি। একটা বিড়ি পেলে কাজ দিত; কাছাকাছি চেনা দোকানও আছে, কিন্তু বুলাকির উঠতে ইচ্ছে করল না আর। সিঁড়ির পেছন দিকে পোস্তার দেওয়াল ঘেঁষে বুলাকি লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।

বাতাসে আতর উড়ছে। গন্ধটা শুধু বুলাকির নাকে নয়, মুখের ভেতরেও ঢুকছে, যেন জিভটাকেও মিষ্টি করে তুলছে। স্বপ্নের মতো মনে পড়তে লাগল— মেহেরজান, ডালহাউসি স্কোয়ার থেকে শ্যামবাজারের ফিরতি ট্রাম, সেই পাঁচশো টাকার নোটে-ভরতি মোটা ব্যাগটা, তারপর…

তারপর বুলাকি ঘুমিয়ে পড়ল। নির্জন গঙ্গার ওপর ঘন হতে লাগল রাত্রি, ওপারে হাওড়ার আলোগুলো কৃষ্ণপক্ষের রাত্রির অতলে মিলিয়ে যেতে লাগল একে একে।

ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছিল…

নেশায় বেহুঁশ হয়ে সে মেহেরজানের দোরগোড়ায় এসে পড়েছে। মেহেরজান করেছে কী, কোথা থেকে এক বালতি ঠাণ্ডা জল এনে ওর মাথায় ঢেলে দিয়েছে আর তারসঙ্গে জোর পাখার হাওয়া। শীতে নেশা ছুটে গেছে, ধড়ফড় করে উঠে বসেছে সে।

সত্যিই ধড়ফড় করে উঠে বসল সে। অন্ধকার পোস্তা, অন্ধকার গঙ্গা। রাত কত হয়েছে। কে জানে। আকাশে অল্প অল্প মেঘ করছে, তারা ডুবে গেছে আর গঙ্গা থেকে উঠে আসছে জোর জোলো হাওয়া। নেশা করেনি বুলাকি, মেহেরজানও নয়, শুধু মারের জ্বালায় একটা অবসন্ন নিরুপায় শরীর নিয়ে সে রথতলা ঘাটের পোস্তায় ঘুমিয়ে পড়েছিল।

উঠতে যাবে এমনসময় চমক ভেঙে গেল।

চারদিকে ঘন অন্ধকার, তবু বুলাকির অভ্যস্ত চোখ দেখতে পেল সাদামতো কে একজন সিঁড়ি দিয়ে নিঃশব্দ পায়ে গঙ্গার দিকে নেমে যাচ্ছে। সিঁড়ির পাশে ছায়ার মধ্যে বুলাকি তলিয়ে আছে, সুতরাং তাকে দেখতে পায়নি। রোমাঞ্চিত হয়ে বুলাকি শুনতে পেল সেই মূর্তিটা কাঁদছে। চাপা গলায় আকুল হয়ে কাঁদছে একটি মেয়ে। দ্বিধামন্থর শঙ্কিত পায়ে সে ক্রমেই এগিয়ে চলেছে, এগিয়ে চলেছে গঙ্গার দিকে।

সর্বনাশ!

একটা সম্ভাবনার কথা মনের ভেতর উঁকি দিয়েই বুলাকির স্নায়ুগুলো দিয়ে বিদ্যুৎ বয়ে গেল। মেয়েটা আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে না তো? এই নিশীথ রাত্রে নিরিবিলি গঙ্গার ঘাটে অমনভাবে একটি নিঃসঙ্গ মেয়ে গঙ্গার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কেন? এর অর্থ কী হতে পারে?

খট করে কাঠের পা-টা টেনে বুলাকি উঠে পড়ল। বললে, কে?

মেয়েটি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

কে?

তবু জবাব নেই, যেন একটা পাথরের মূর্তি। বুলাকির মনে হল মেয়েটা থরথর করে কাঁপছে।

বুলাকি এগিয়ে এসে গঙ্গা আড়াল করে মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।

কে তুমি? কী করছ এখানে?

হঠাৎ উচ্ছ্বসিত একটা কান্নার জোয়ার। প্রবল ফোঁপানির সঙ্গে আকুল মিনতি শোনা গেল, ছেড়ে দাও আমাকে। দোহাই তোমার, আমাকে পুলিশে দিয়ো না।

বুলাকি সস্নেহে হাসল। আকস্মিক একটা করুণায় মনটা পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। শুধু খুন নয়, শুধু গুণ্ডামি নয়, শুধু মাতলামি নয়, আজ রাত্রে আশ্চর্যভাবে একটা-কিছু ভালো করবার সুযোগ পেয়েছে বুলাকি। একটা-কিছু মহত্তর—একটা এমন কিছু যা সে জীবনে কখনো করেনি, যা করবার অবকাশ তার কোনোদিন ঘটেনি। বিচিত্র উত্তেজনায় রক্তে দোলা লেগে গেল বুলাকির। এই মুহূর্তে যেন সে নতুন মানুষ হয়ে উঠেছে।

না না, কোনো ভয় নেই মা। আমি পুলিশ নই।

পকেটে বিড়ি নেই, দেশলাইটা আছে। খস করে সেইটেই জ্বালাল বুলাকি। ভীতিবিহ্বল একটা পান্ডুর মুখ চকিতে দেশলাইয়ের আলোয় আভাসিত হয়ে উঠল। কুড়ি-বাইশ বছরের একটি ভদ্রলোকের মেয়ে। গায়ে গয়নার দীপ্তি। সাদা-কাপড়ে-জড়ানো একটা পুঁটলি বুকের ভেতরে আঁকড়ে ধরে আছে। গলায় সোনার হার, ভারী লকেটটা থেকে পলকের জন্যে বুলাকির চোখে একটা ঝিলিক জাগিয়ে কাঠিটা নিবে গেল। নিজের অজ্ঞাতেই বুলাকির মন বলে উঠল—মেহেরজান, অনেক টাকা দরকার, নির্জন গঙ্গার ঘাটে একটি নিঃসঙ্গ মেয়ের এক-গা গয়না, দুখানা লোহার মতো হাতের মুঠি বাড়িয়ে দিলেই…

কিন্তু না না, আজ একটা দুর্লভ মুহূর্ত পেয়েছে বুলাকি। দুর্লভ মুহূর্ত—বুলাকির জীবনে ভালো হওয়ার, ভালো করবার। আজ সে লোভ নিয়ে আসেনি, স্বার্থ নিয়েও আসেনি। এই মেয়েটিকে সে বাঁচাবে—রক্ষা করবে একটা অমূল্য জীবন।

বুলাকি জিজ্ঞাসা করলে, তোমার সঙ্গে ওটা কীসের পুঁটলি মা?

গলার স্বরে মেয়েটি বোধ হয় ভরসা পেয়েছে। দেশলাইয়ের আলোয় আরও দেখতে পেরেছে যে বুলাকি পুলিশ নয়। সন্ত্রস্ত শঙ্কিত স্বরে জবাব দিলে, আমার আমার ছেলে।

একেবারে কচি ছেলে। ওকে নিয়েই ডুবে মরতে যাচ্ছিলে?

অন্ধকারের ভেতরে মেয়েটি যেন শিউরে উঠল, জবাব দিলে না।

বুলাকি বলে, ছি মা, ডুবে মরবে কেন? এর চেয়ে কী আর পাপ আছে? গঙ্গাজিতে ডুবলেও নিস্তার নেই, জিন-পেতনি হয়ে থাকতে হবে। রামচন্দ্রজি যে-জান দিয়েছেন, সে কি নষ্ট করবার জন্যে?

কথাটা বলে নিজের মধ্যেই কৌতুক বোধ করলে বুলাকি। সে ধর্মকথা বলছে, উপদেশ শোনাচ্ছে। বুলাকিরাম, জীবনে এমন বদমায়েশি নেই যা সে করেনি। আজ গঙ্গার ধারে পরম বিস্ময়কর এই মুহূর্তটিতে তার জন্মান্তর হয়ে গেল না কি! দলের লোকেরা একথা শুনলে তাকে বলবে কী?

বুলাকি বললে, শোনো মা, আমিও তোমার ছেলে। আমার কাছে লজ্জা কোরো না। কী দুঃখ তোমার? তোমার স্বামী মাতাল, তোমাকে খুব কষ্ট দেয়, তাই না?

বিহ্বল গলায় মেয়েটি জবাব দিলে, হুঁ।

বুলাকি হেসে উঠল, হেসে উঠল পরম পরিতৃপ্তভাবে। আজ তার জন্মান্তর। শুধু অবিচ্ছিন্নভাবে অন্যায়ই নয়, সে ভালো করতে পারে। শুধু দুঃখ দিতে পারে তাই নয়, দুঃখ মোচনও করতে পারে।

এই দুঃখে তুমি মরে যেতে চাও? ছি ছি! আমার নাম জেনে রাখো মা, আমি বুলাকিরাম, আমি মুরগিহাটার নামদার গুণ্ডা। এককথায় আমি মানুষ খুন করতে পারি।

অন্ধকারের ভেতরে মেয়েটির অস্ফুট আর্তনাদ শোনা গেল।

মিষ্টি করে হাসতে গিয়েও বুলাকি তীব্র কর্কশ গলায় হেসে ফেলল, না না, তোমার কোনো ভয় নেই। আমি তোমাকে মা বলেছি। তোমার স্বামীর নাম আমাকে বলল, এমনভাবে শাসিয়ে দেব যে কখনো তোমার গায়ে হাত তুলতে ভরসা পাবে না। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি।

শীতের হাওয়ায় মেয়েটি কাঁপছে, থরথর করে কাঁপছে। গঙ্গার জলে ঢেউয়ের কলধ্বনি। পোস্তার ওপরে কয়েকটা বিচ্ছিন্ন অন্ধকার গাছের ডালে-পাতায় বাতাস সোঁ সোঁ করছে। ভীত অস্পষ্ট আওয়াজ এল, থাক।

ওঃ, ভয় করছে? আমি গুণ্ডা, হাতের ঠিক নেই, তোমার স্বামীকে হয়তো মেরে বসতে পারি—তাই না? বুলাকি একসারি সাদা দাঁত বার করে বললে, স্বামীর জন্যে এত দরদ, আর তার জন্যেই ডুবে মরতে যাচ্ছিলে মা? মেয়েমানুষ এমনই তাজ্জব জানোয়ারই বটে! নিজের রসিকতায় ঝামা-ঘষার মতো শব্দ করে সে হাসতে লাগল।

মেয়েটি জবাব দিলে না।

আচ্ছা যাক, মায়ের যখন অত ভয়, তখন বাবাকে আমি এ যাত্রা কিছু আর বলব না। কিন্তু আমার ঠিকানাটা জেনে রাখো মা। যখনই বিপদে পড়বে, খবর দিয়ো। যদি জেলে না থাকি, যা পারি আমি করব। বুলাকি ঠিকানাটা বললে। মনে থাকবে তো? মনে থাকবে তো মা?

আশ্চর্য দরদ আর আন্তরিকতা বুলাকির গলায়। নিজের যে-মাকে কোন ছেলেবেলায় হারিয়েছিল, স্মৃতির ভেতরে বহু বার হাতড়েও যার মুখখানা বুলাকি কখনো মনেও করতে পারেনি। নিশীথ রাত্রির মেঘাচ্ছন্ন অন্ধকার গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে আজ তাকেই সে ফিরে পেল না কি! সামনে ভরা ভাটার বিশাল জলস্রোত কলকল করে ছুটে চলেছে, দু-পাড়ে নি :সাড় ঘুমের মধ্যে মূৰ্ছিত হয়ে আছে মহানগরী, আকাশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে লঘু মেঘ বাতাসে উড়ে যাচ্ছে। অন্ধকারের ভেতরে নিজের শরীরটাকে যেমন সে ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না, তেমনি নিজের মনটাকেও কি সে হারিয়ে ফেলল? সে বুলাকিরাম!

তবু অদ্ভুত ভালো লাগছে, অপূর্ব একটা আনন্দে সমস্ত চৈতন্য পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তবু ভালো, আজ নেশা করেনি বুলাকি, নিজের শিরাগুলোকে জ্বালিয়ে রাখেনি দেশি মদের তরল আগুন দিয়ে। তাহলে কী হত কে জানে! দেশলাইয়ের আলোয় ওই সোনার লকেটটার ঝলক আভাসে তাকে সেই কথাই বলে দিয়েছে। নিঃশব্দে একটা নির্বিঘ্ন খুন করে হাওয়া হয়ে যেতে তার কতক্ষণ লাগত! সামনে গঙ্গার খরধারা ছিল, ভোর হওয়ার আগে হয়তো মড়াটা গিয়ে ডায়মণ্ডহারবারেই ভেসে উঠত।

না না, নিজেকে বিশ্বাস নেই। আর দেশলাই জ্বালবে না। প্রশ্রয় দেবে না নিজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা শয়তানটাকে। এই রাত্রিটা বুলাকির জীবনে ব্যতিক্রম। এমন মুহূর্ত কাল আর আসবে না, এমন রাত্রিও না। শুধু কাল কেন, কোনোদিনই হয়তো আসবে না। অনাগত রাতগুলোকে অভ্যস্ত নিয়মে পরিপূর্ণ করে রাখবে জুয়ার আড্ডা, মদের গেলাস, অনেক অনেক অকীর্তি, অনেক মারামারি আর সাপের মতো মেহেরজানের আলিঙ্গন। সেইসব সময়ে, সেইসব মত্ততার অবকাশে যখন একটুখানি নিজের মধ্যে ফিরে আসবে বুলাকি, তখন হয়তো এই রাতটাকে মনে পড়বে, মনে পড়বে তার হঠাৎ-পাওয়া ভালো করে না-দেখা মাকে, মনে পড়বে ক্ষিপ্রগতিতে বয়ে-যাওয়া ধ্বনি-মুখরিত এই নিশীথ গঙ্গাকে, মনে পড়বে অকারণ হাসির মতো আঁধার ডালপালার শনশন সোঁ-সোঁ শব্দটাকে—

বুলাকি যেন আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। নেশা করেনি, তবু এ এক নতুন নেশা, ভালো হওয়ার নেশা; একটা বিচিত্র ব্যতিক্রমের রাতকে চেতনার মধ্যে সঞ্চারিত করে নেবার নেশা।

স্নেহসিক্ত কোমল গলায় সে আবার বললে, মনে থাকবে মা? মনে থাকবে তো?

মেয়েটি মাথা নাড়ল। দেখা গেল শীতে সে কাঁপছে, যেন আর দাঁড়াতে পারছে না।

তাহলে ফিরে চলো। বাড়ি চলো।

মেয়েটি নড়ে না।

চলল, ফিরে চলো।

মেয়েটি তবুও স্তব্ধ।

ভয় করছে? বেশ, আমি তোমায় এগিয়ে দিচ্ছি। আমি বুলাকিরাম, যতক্ষণ সঙ্গে আছি কেউ তোমার গা ছুঁতে পারবে না। তোমাকে মা বলেছি, ছেলে থাকতে তোমার ভাবনা কী?

মেয়েটি দ্বিধা করছে। কেমন বিহবল বোধ করছে, কেমন বিচলিত হয়ে গেছে। ফিরে যেতে তার পা উঠছে না যেন। এবার যেন বুলাকি কেমন একটা নৈরাশ্য অনুভব করলে। এতক্ষণ ধরে কথা বলছে, এমনভাবে আশ্বাস দিচ্ছে, তবু তার মা ভালো করে সাড়া দিচ্ছে না, খুশি হয়ে উঠছে না, একটা পাথরে-গড়া প্রতিমূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে আছে।

আকস্মিক একটা তিক্ততা মনের ভেতর ঠেলে উঠেছিল, বলতে ইচ্ছে করল, তবে মরো গে যাও! কিন্তু নিজেকে সামলে নিলে বুলাকি। আজকের রাতটা সে নষ্ট করতে দেবে না, কিছুতেই এই অপূর্ব মুহূর্তটার সুর কাটতে দেবে না। বুলাকি আবার বললে, চলো চলো।

কিন্তু… একটা জড়িত স্বর।

আর কিন্তু নেই, তোমাকে ফিরে যেতে হবে। কেমন যেন জেদ চেপেছে বুলাকির। চলো মা, চলো। তোমার বাড়িটা আমি দেখব। তুমি নিজে কিছু না বলো, তোমার দুঃখের প্রতিকার আমিই করব।

মড়ার মতো অসাড় পায়ে নিরুপায়ের মতো চলতে শুরু করলে মেয়েটি।

অন্ধকার স্ট্র্যাণ্ড রোড দিয়ে দুজনে এগিয়ে চলল। কেউ কোনো কথা বলছে না। মেয়েটি কী ভাবছে কে জানে! কিন্তু মেয়েটির কথা গুণ্ডা বুলাকি ভাবছে না, তার নিজের মধ্যেই সে তলিয়ে গেছে। কী আশ্চর্য! একটা বিপুল অনুভূতি, যেন জন্মান্তর-বুলাকির জন্মান্তর।

রেললাইনটা পেরিয়ে একটা গলির মুখে মেয়েটি থমকে দাঁড়াল।

কী মা, চলতে পাচ্ছ না? কষ্ট হচ্ছে? আচ্ছা, তোমার ছেলে আমার কোলে দাও। দূরে একটা ল্যাম্পপোস্টের অস্বচ্ছ আলো। তাতে দেখা গেল, মেয়েটি যেন শিউরে উঠল। বুলাকি হাসল, ভয় নেই, ভয় নেই। গুণ্ডার হাত, কিন্তু ছেলে ধরতে পারব। তেমনি জড়িত গলায় মেয়েটি বললে, ঘুমুচ্ছে।

ঘুমোক, জাগাব না। বুলাকি হাত বাড়িয়ে সযত্নে পুঁটলিটা বুকের মধ্যে টেনে নিলে। কাপড়ের ভেতরে একটা নরম শিশুদেহের আভাস পাওয়া গেল।

আবার মেয়েটির অস্পষ্ট স্বর, আমি আগে হাঁটতে পারছি না, ভয় করছে।

বেশ, আমি আগে আগে যাচ্ছি।

বুলাকি চলতে শুরু করলে। গলির পর অন্ধকার গলি।

পরম স্নেহে বুলাকি শিশুটিকে বুকের মধ্যে ধরে রেখেছে, একটু ব্যথা না লাগে, ঘুম না ভাঙে। মনের ভেতরে তেমনি একটা অপূর্ব কৌতুক বোধ করছে সে। নামদার গুণ্ডা বুলাকিরাম ছেলে আগলে নিয়ে চলেছে, অত্যন্ত যত্নে, অত্যন্ত সাবধানে। দলের লোকেরা যখন শুনবে…

না না, কেউ শুনবে না। আজ রাত্রে বুলাকি সম্পূর্ণ আলাদা লোক। আজ তার একটি ব্যতিক্রমের মুহূর্ত। এ তার নিভৃত মনের মধ্যেই লুকোনো রইল।

অন্ধকার গলির মধ্যে কতক্ষণ চলেছে খেয়াল নেই, হঠাৎ মুখের ওপর টর্চের ঝাঁঝালো আলো। কড়া গলায় ধমক এল, কৌন হ্যায়?

সামনে এসে পড়েছে একটা সার্জেন্ট আর দুজন কনস্টেবল।

এই কেয়া হ্যায় তুমারা পাস?

মাইজি কো লেড়কা।

মাইজি? মাইজি কাঁহা?

চমকে বুলাকি পেছন ফিরল। মাইজি নেই, গঙ্গার ঘাটে পরম মুহূর্তে কুড়িয়ে-পাওয়া তার মায়ের চিহ্ন নেই কোথাও। টর্চের আলোয় ঝলকে উঠেছে সরীসৃপের মতো অন্ধকার

শূন্যগলিটা। বুলাকি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না।

উতারো, কেইসা মাইজিকা লেড়কা তুমারা!

বুলাকিকে কিছু করতে হল না, টর্চের আলোয় পাহারাওলারা কাপড়ের মোড়কটা খুলতেই চোখে পড়ল রক্তস্নাত একটি সদ্যোজাত শিশু! শুধু সদ্যোজাত নয়, তাকে গলা টিপে খুন করে ফেলা হয়েছে, যাতে জন্মের পর তার এতটুকু কান্নার শব্দও এত মানুষের পৃথিবীতে একবিন্দু সাড়া জাগাতে না পারে।

টর্চের আলোয় সে-বিভীষিকাটা যেন পাতালপুরীর দুঃস্বপ্ন!

শা-লা, খুনি!

হাতের ব্যাটনটা দিয়ে প্রচন্ড বেগে বুলাকির মাথায় ঘা বসাল সার্জেন্ট। মাথা ঘুরে বুলাকি পড়ে গেল মাটিতে, ডালহাউসি ফেরত ট্রামের ভদ্রবাবুদের প্রহারে যেমন করে জর্জরিত হয়ে সে পড়ে গিয়েছিল। চোখের সামনে অন্ধকার গলি, টর্চের আলো একসঙ্গে আবর্তিত হয়ে গেল, গঙ্গার ধারে কুড়িয়ে-পাওয়া সোনার মুহূর্তটি চুরমার হয়ে তলিয়ে গেল সীমাহীন একটা তমসার ভেতরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *