রিউবেন বুশের মৃত্যুবাণ
ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সাত্যকি সোম সকাল আটটা নাগাদ তাঁর বৈঠকখানায় এসে বসলেন। এখানে বসে প্রাতরাশ খেতে খেতে তিনি কিছুক্ষণ তাঁর রোবট নরোত্তমের সঙ্গে হালকা কথাবার্তা বলেন। এটাই তাঁর সারাদিনের মধ্যে একমাত্র বিনোদন। কিছু দিন থেকে সেটাও তাঁর নিয়মিত হচ্ছে না। দিন দশেক আগে সেই শনিবার রাত থেকেই তাঁর এই দুশ্চিন্তাময় দিনযাপনের শুরু। সেই রাতে ইকুয়েডরের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ফেলিক্স ক্লিনটন টেলিফোনে যখন তাঁকে কুইটোর অস্বাভাবিক সাইক্লোনের কথা বললেন, তখন বাইরে অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। কোথা থেকে গান ভেসে আসছিল–প্রলয়ের শাঁখ বেজে ওঠে হোথা দূর অম্বরে। কুইটোর মানমন্দিরে সেই ঘূর্ণিবাত্যার কোনও পূর্বাভাস পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আধ কিলোমিটার জায়গা প্রায় মরুভূমিতে পরিণত হল।
পরদিন সকালে খবরের কাগজ খুলেই প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় হরফে ছাপা তিনি দেখলেন কুইটোর এই অভূতপূর্ব ঘূর্ণিবতার সংবাদ। সারা পৃথিবী জুড়ে সাড়া পড়ে গিয়েছে এর মধ্যেই এই ঝড়ের ব্যাপারে–যাতে চিরবসন্তের শহরটির কিছু অংশ প্রায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। কয়েক হাজার লোক নিখোঁজ। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে বৈজ্ঞানিকদের ঘন ঘন টেলিফোন পেয়েছেন সাত্যকি সোম। টেলিফ্যাক্স মেশিনে এত বার্তা এসেছে যে, কাগজের কুণ্ডলী নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। তার কয়েকদিন পরেই পেয়েছিলেন টাইটেনিয়াস গ্রহ থেকে মহাপ্রতিভাধর কিন্তু মহা অমানুষ বিজ্ঞানী রিউবেন বুশের টেলিফোন। বুশের সেই ব্যঙ্গাত্মক ঘৃণ্য হাসি এখনও যেন ডক্টর সোমের কানে লেগে আছে। বুশের বৈজ্ঞানিক প্রতিভার যেমন তুলনা নেই, তেমনি তুলনা নেই তাঁর বীভৎস হৃদয়বৃত্তির। মহাধুরন্ধর বুশ রাশিয়া, আমেরিকা, ভারত ও আরও অনেক দেশের সাহায্য নিয়েছিল তার পরিকল্পনাকে রূপ দিতে। তার এই আপাতনির্দোষ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাতে কেউ সন্দেহ করেনি। সৌরমণ্ডলে ছড়ানো গ্রহাণুপুঞ্জকে একত্রীভূত করে সে একটা গ্রহ সৃষ্টি করেছে। নাম দিয়েছে টাইটেনিয়াস। নিজের নামে নাম দিতে পারত। কিন্তু তা দেয়নি। তার এই কাজে চমৎকৃত হয়ে বিজ্ঞানে তৃতীয়বারের জন্যে তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাব উঠেছে নানা মহল থেকে। সাত্যকি সোম বুশের প্রতিভাকে শ্রদ্ধা জানালেও তাকে যে পছন্দ করতেন না, এটাকে বিজ্ঞানীদের অনেকেই ঈর্ষাপ্রসূত মনে করেছেন। ডক্টর সোম সেটা শুনেছেন। শুনে মনে ব্যথা পেলেও কিছু প্রকাশ করেননি।
বুশ টেলিফোনে যা বলেছিল, তার মর্মার্থ হল–টাইটেনিয়াস গ্রহ তার সাম্রাজ্য। পৃথিবী থেকে প্রাণরস–যথা জল, বায়ু, গাছের বীজ ইত্যাদি সংগ্রহ করে একে জীবিত করবে। তারপরে পৃথিবী থেকে আনবে কিছু বোকা অবৈজ্ঞানিক মানুষকে। সবশেষে ধ্বংস করে দেবে টাইটেনিয়াসের প্রতিদ্বন্দ্বী পৃথিবীকে।
ওই গ্রহের একমাত্র আরাধ্য দেবতা বা ভগবানের নাম হবে রিউবেন বুশ। পৃথিবী তাকে দু-বার নোবেল পুরস্কার দিলেও ডক্টর সোমের মতন শ্রদ্ধা দেয়নি। এডিসন, নিউটন, আইনস্টাইন থেকে সাত্যকি সোম–এঁদের নামের সঙ্গে বুশের নাম উচ্চারণ করবে না কেউ। কারণ রিউবেন ওসব বিজ্ঞানের জনহিতকর ব্যবহারে আগ্রহী নয়। তার মনে মানবিকতাবোধ, শান্তি, কল্যাণ ইত্যাদি উটকো ভাব বা দার্শনিকতা জাগে না। সাত্যকি সোমের মতো পৃথিবীর যত পোকাওয়ালা মাথাকে ধ্বংস করাই তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। কারণ তাঁদের কাছেই বুশের ঈশ্বরত্বলাভের পথে বাধা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে তার আগে টাইটেনিয়াসকে বাসযোগ্য করতে হবে, ইত্যাদি… ইত্যাদি…।
বুশের কথা সাত্যকি সোমের কাছ থেকে শুনেছেন পৃথিবীর তাবৎ বৈজ্ঞানিক। রুদ্ধদ্বার কক্ষে গোপন বৈঠক চলেছে রাশিয়া, আমেরিকা, চিন, ভারত, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে। কিন্তু সংবাদপত্রে বা দূরদর্শনে এ খবর সযত্নে গোপন রাখা হল। নইলে ভয়ানক ভীতির সঞ্চার হবে পৃথিবী জুড়ে। তাতে ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না।
তার পরের শনিবার আবার সেই একই জায়গায়–সেই আধ কিলোমিটার ব্যাসের এক বৃত্তাকার অঞ্চলকে আলোড়িত করে মাত্র কয়েক সেকেন্ডব্যাপী আবার যখন সাইক্লোন হল, তখন পৃথিবী জুড়ে চাঞ্চল্য দেখা দিল। শুধু দিনটাই এক নয়, সময়ও এক। কুইটোর স্থানীয় সময় দুপুর বারোটা। এবারে নিহতের সংখ্যা আগের বারের মতো বেশি না হলেও প্রায় শ-খানেক। তারা ধ্বংসস্তূপের সংস্কার করছিল। তাদের কোনও খোঁজ মিলল না। আর নিশ্চিহ্ন হয়ে অদৃশ্য হল একটি হেলিকপ্টার। ওই সময় ওখান দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল।
ব্যাপারটা অনেকে বিগত শতাব্দীর বারমুডা ত্রিভুজের ঘটনার সঙ্গে তুলনা করল। অতলান্তিক মহাসাগরের একটি অংশে এরকম জাহাজ প্লেন ইত্যাদি অদৃশ্য হয়ে যেত। পরে অবশ্য জানা গেল–
যাক গে, সেসব পুরোনো কথা। তবে এই একবিংশ শতাব্দীতেও কেউ কেউ মতামত প্রকাশ করল, এটা নিছক ভৌতিক ঘটনা। অবশ্য এরা সবাই বিজ্ঞানের বাইরের স্তরের লোক। যদিও তাদের কেউ হয়তো সাংবাদিক, শিক্ষক, আবার কেউ কাপড়ের দোকানদার। সাত্যকি সোম ভাবলেন, এরপরে গ্রহশান্তি যজ্ঞে কয়েক কুইন্টাল ঘি পুড়লেও আশ্চর্য হওয়ার মতো নেই। কয়েকশো বছর আগে যেরকম কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোক ছিল, এই শতকেও তারা আছে। তবে নতুন খোলসে। এরা কম্পিউটারে ভাগ্যগণনা করে, রোবট দিয়ে অষ্টপ্রহর নামসংকীর্তন করায়, এই যা তফাত।
ডক্টর সোম ক্লান্ত-অসহায়ভাবে বৈঠকখানায় এসে বসলেন। আজ মঙ্গলবার। আগামী শনিবারেও কি কুইটোয় একই ঘটনা ঘটবে? তিনি শুনেছেন, ঘটনাস্থলে আর কোনও লোক কাজ করছে না। আশপাশের অঞ্চল থেকেও লোকজন সরে যাচ্ছে ইকুয়েডরের অন্য স্থানে। যেখানে এই ঘটনা পরপর দু-বার ঘটল, সেটা একটা বৃত্তাকার অঞ্চল। পরিষ্কারভাবে তার সীমারেখা চিহ্নিত। তার বাইরে একটি ঘাসও নষ্ট হয়নি, ঝরে পড়েনি একটিও গাছের পাতা। এর মধ্যেই রসিক সাংবাদিকরা বারমুডা ত্রিভুজের মতন অভিশপ্ত জায়গাটির নামকরণ করেছে, ইকুয়েডরের বৃত্ত ইকুয়েডোরান সার্কল।
সাত্যকি সোমের মনে হল, অলৌকিকতায় বিশ্বাসী কোটি কোটি লোক আড়াল থেকে তাঁর প্রতি যেন বিদ্রুপের হাসি হাসছে। কী ব্যাখ্যা দেবেন তিনি?
তরুণ প্রতিবেশী গৌতম ব্রহ্মের কথা তাঁর মনে হল। বয়সে অর্ধেকেরও কম হলেও সাত্যকি সোমের মনে হয় গৌতম তাঁর চেয়ে একশো বছরের বড়। গত শতকের অধিকাংশ মানুষের মতোই গৌতম বিশ্বাস করে জ্যোতিষে, শাস্ত্রের বিধানে আর নানা আজগুবি ব্যাপারে। অবসর সময়ে সাত্যকিজ্যাঠার কাছে এসে হাস্যকর যুক্তিতে বোঝাতে চেষ্টা করে, বৃহস্পতি গ্রহ সূর্যকে ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় এলে তার জন্যে কেউ কেউ বড়লোক হয়ে যেতে পারে। আবার মঙ্গল গ্রহ যদি সেখানে এসে হাজির হয়, তবে হয়তো সেইসব লোকের বাসের তলায় চাপা পড়ার সম্ভাবনা। প্রথম প্রথম ডক্টর সোম এইসব কথার অসারতা গৌতমকে বোঝানোর চেষ্টা করতেন, হেসে উঠতেন। তাতে ফল উলটো হতে। গৌতম উত্তেজিত হয়ে আরও তর্ক জুড়ে দিত। তাই এখন ওসব কথা উঠলেই তিনি চোখ বুজে থাকেন মনের কান বন্ধ করে।
সাত্যকি সোমের এই মানসিক অবস্থা দেখলে গৌতম তাঁর হাত দেখে নিশ্চয় বলত, তা তো হবেই–ওই শনিবার থেকেই তো শনি গ্রহ সাত্যকি সোমের (নাকি, গোটা পৃথিবীর?) মাথায় চড়ে বসেছে।
নিজের মনে একটু হেসে ডক্টর সোম তাঁর টেলিফ্যাক্সের ডালা খুললেন। প্রথমে কাঁচা হাতে লেখা সুন্দর রঙিন বার্তাটি তার নজরে পড়ল। তাঁর নাতনি টুকলি লন্ডন থেকে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লিখে পাঠিয়েছে–
দাদু, তোমার জন্মদিনে জানাই ভালোবাসা,
ভালো থাকো, সুখে থাকো
এই আমাদের আশা।
তার নীচে নিজেই এঁকেছে দাদুর ছবি। চশমা আর কপালের তিল আঁকা সত্ত্বেও যদি দাদু চিনতে না পারেন, তাই নীচে লিখে দিয়েছে–দাদু।
পরের ফ্যাক্সটা ভাইপো আর বউমার চিঠি। নিজের সংসার না থাকলেও ছোট্ট টুকলি নিঃসন্তান বিপত্নীক ডক্টর সোমের হৃদয়ের কোমল অংশ জুড়ে রয়েছে। সবচেয়ে ভালো লাগে, লন্ডনে থেকেও তাঁর বাংলা জন্মতারিখটি ওরা ঠিক মনে রাখে। আর টুকলিও বাংলা শিখে অন্যদের মতন বিদেশি ভাষায় হ্যাপি বার্থডে না লিখে মধুর মাতৃভাষায় জানায় তার শুভেচ্ছা।
তবে আজ তাঁর জন্মতারিখ? এটা জন্মমাস শ্রাবণ? ডক্টর নোম নিজে কিছুই খোঁজ রাখেন না। খোঁজ রাখতেন তাঁর মা তাঁর ছোটবেলায়। পরে দিনটিকে মনে রাখতেন স্বৰ্গগতা মৈত্রেয়ী সোম। একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর কিছু পরেই তিনিও যখন তাঁর কাছ থেকে চলে গেলেন, তখন জন্মদিন-মৃত্যুদিন সব মিশে একাকার হয়ে গেল। আর আজ আবার সে হিসেব রাখছে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূর থেকে আরেকটি নতুন মা। সাত্যকি সোম জানেন, তাঁর ভাইপোও লন্ডনে থেকে বাংলা সন-তারিখের খবর রাখে না। টুকলির মা-ই টুকলিকে আর তার বাবাকে মনে করিয়ে দিয়েছে ডক্টর সোমের জন্মদিনটির কথা।
তাঁর মনে কিছুক্ষণের জন্যে তলিয়ে গেল কুইটো, বুশ আর বৈজ্ঞানিক-অবৈজ্ঞানিক নানা ব্যক্তির মন্তব্যের প্রসঙ্গ। কিন্তু পরের ফ্যাক্সেই আবার প্রকটভাবে ভেসে উঠল সেসব। একেবারে পরিষ্কারভাবে। কুইটোর রহস্যের ব্যাখ্যা নিয়ে, পৃথিবীর বিপদের বার্তা নিয়ে।
পরের ফ্যাক্সটা পাঠিয়েছে রিউবেন বুশ তার টাইটেনিয়াস গ্রহ থেকে। বার্তাটা এরকম–
মহাসম্মানিত ডক্টর সোম মহাশয়, জানি না আপনার আর আপনার মহাপণ্ডিত বন্ধুদের গোচরে এসেছে কি না যে, আমি পৃথিবী থেকে অক্সিজেন আর নাইট্রোজেন কিছু কিছু করে আমদানি শুরু করেছি। আপনি জানেন, টাইটেনিয়াম ইস্পাত শিল্পে অক্সিজেন আর নাইট্রোজেন লাগে নিষ্কাশনের কাজে। আমার টাইটেনিয়াস গ্রহও পৃথিবী থেকে ওগুলো নিষ্কাশন করে নিজের কাছে নিয়ে আসছে। বিষুবরেখার কাছাকাছি কোনও উঁচু জায়গা এই বায়ু টেনে নেওয়ার জন্যে সব চাইতে উপযুক্ত। তাই আমি কুইটো শহর বেছে নিয়েছি। অবশ্য প্রথম কিস্তিতে বায়ুর সঙ্গে প্রচুর ইট-পাথর-কংক্রিট আর মানুষের দেহে ছিল এরকম হাইড্রোকার্বন সেই টানে চলে এসেছে। দ্বিতীয়বারেও এসেছে–তবে অনেক কম। ভালোই হয়েছে, ওগুলো কাজে লাগবে।
পৃথিবীর হিসাবে আবার ঠিক এক সপ্তাহ পরে একই সময়ে ওখান থেকে আরও বাতাস টেনে নেব। ওই সময়টা বেছে নিয়েছি কেন? কারণ দেখেছি, ওই সময়ে মাঝপথে কৃত্রিম গ্রহ বা অন্য কিছুর বাধা থাকে না।
আসুন-না সে দিন আপনার পণ্ডিত বন্ধুদের নিয়ে কুইটোর ওই জায়গাটিতে পিকনিক করতে! আপনাদের নশ্বর দেহের চিহ্ন বুকে ধারণ করে টাইটেনিয়াস ধন্য হবে। পৃথিবীর হিসেবে আপনার জায়গায় সোমবার রাত্তিরে ফ্যাক্স পাঠিয়ে আবার আপনাকে শুভেচ্ছা জানাব। প্রতি সোমবারেই, কারণ ওটাই তো আপনার দিন–আপনি একবার হাসতে হাসতে বলেছিলেন, মনে পড়ে মিস্টার মনডে?–ইতি আপনার চির অপ্রিয় বন্ধু রিউবেন বুশ।
এরপর পুনশ্চ দিয়ে লিখেছে–রাশিয়া, আমেরিকা, চিন, ভারত প্রভৃতি সব দেশের মাতব্বরদের আমার হয়ে এই কথা জানানোর ভার আপনিই নিন যে, রকেটে করে অস্ত্র পাঠিয়ে আমাকে আর আমার গ্রহকে জব্দ করা যাবে না। আমি নিজে টেনে না নিলে কোনও বাইরের বস্তু এই গ্রহে আসতে পারবে না। আপনাদের অস্ত্র ঘুরিয়ে দেওয়া হবে আপনাদেরই দিকে। আর তার পরিণাম? হাঃ হাঃ হাঃ!
.
ফ্যাক্সটা হাতে নিয়ে ক্রোধে-দুশ্চিন্তায় কাঁপতে লাগলেন সাত্যকি সোম। কী ভয়ংকর লোক এই বুশ! গৌতম ব্ৰহ্মর কথা তাঁর মনে হল। গৌতম বলে, রামায়ণের রাবণ এক মহাপ্রতিভাধর বৈজ্ঞানিক ছিলেন। তাঁর মালিকানায় ছিল পুষ্পক এয়ারক্রাফ্ট। দরকার হলে দেহে আরও ন-টা কম্পিউটার ব্রেন লাগিয়ে নিতেন। তিনি মহাকাশ অভিযান করার তোড়জোড় করেছিলেন। যাকে বাল্মীকি বলেছেন স্বর্গের সিঁড়ি। মহাকাশযানে কুম্ভকর্ণকে মহাসুপ্ত বা হাইবারনেশন অবস্থায় পাঠানোর জন্যে তাকে পরীক্ষাগারে নিদ্রাযযাগের শিক্ষাও দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু সব কিছু রসাতলে গেল তাঁর দুষ্কর্মের জন্যে। নিজের কাছে রাখা মৃত্যুবাণেই রাবণ রাজার মৃত্যু এসেছিল। ন্যায়ের জয় যে হবেই!
ডক্টর সোম ভাবেন, দুষ্ট বিজ্ঞানী রিউবেন বুশও কি রাবণ রাজার মতন ধ্বংস হবে? মাথাটাকে দু-হাতের মধ্যে ধরে রেখে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন তিনি।
হঠাৎ একটা আশার আলো দেখতে পেলেন তিনি। আর মাত্র চার দিন আছে শনিবার আসতে। এর মধ্যে না পারলে আরও এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। তিনি টেলিফোন তুলে আইএসডি-তে যোগাযোগ করতে লাগলেন বিশ্বের তাবৎ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। ফ্যাক্স মেশিনে তাঁদের কাছে পাঠাতে লাগলেন বুশের বার্তার প্রতিলিপি। তারপর বললেন, পরমাণু বোমা দিয়ে আক্রমণ হানতে চান টাইটেনিয়াস গ্রহে। তাতে রিউবেন বুশের মতো একজন প্রতিভা ধ্বংস হয়ে যাবে–যেটাকে তিনি নিজেও বিজ্ঞানজগতের একটা অপূরণীয় ক্ষতি বলে মনে করেন। কিন্তু উপায় নেই।
বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে উত্তরও পেতে লাগলেন। রাশিয়া বলল, পরমাণু বোমা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারা তৈরি করে দিতে পারে। কিন্তু কী লাভ তাতে? বুশ তো পরিষ্কারভাবে বলেইছে..
আমেরিকা বলল, এই প্রস্তাব গ্রহণীয় নয়। বুশ পৃথিবীর বাতাসের যে অংশ টেনে নিচ্ছে, তাকে অন্যভাবে পূরণ করা যাবে। তাদের মনে হয়, বুশের পৃথিবী ধ্বংসের কথা বলা, বা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের বধ করার ধমকানি সাত্যকি সোমের ওপর গায়ের ঝাল ঝাড়া ঠাট্টা বই আর কিছু নয়। তাই রকেটে পরমাণু অস্ত্র পাঠিয়ে টাইটেনিয়াস ধ্বংস করার চেষ্টা পৃথিবীর নিজের মরণকে ডেকে আনা।
চিনও বলল, বুশের চিঠির পুনশ্চ অংশ নেহাত ফাঁকা আওয়াজ বলে তাদের মনে হয় না। পরমাণু বোমাকে উৎসস্থানে ফেরত পাঠানোর রিফ্লেক্টর তিনি নিঃসন্দেহে তৈরি করেছেন। তিনি নিজে টাইটেনিয়াসের বাইরে থেকে কিছু আমদানি না করলে একটা উল্কাপিণ্ডও ওই গ্রহে পড়তে পারবে না, সে কথা তো তিনি অনেক আগেই বলেছিলেন।
ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইজরায়েল, এমনকী ভারতের বিজ্ঞানীসমাজও হতাশায় মাথা নাড়লেন।
সাত্যকি সোম এবার বলে পাঠালেন, আমার পরিকল্পনাটা শুনুন। বুশ যে ধমকানি দিয়েছে, পৃথিবী ধ্বংস করে টাইটেনিয়াসকে সমৃদ্ধ করবে, এটাও ফাঁকা আওয়াজ নয়। বুশকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। আমার প্রতিবেশী গৌতম ব্ৰহ্ম এক গল্প বলেছেন যে, এইসব প্রতিভাধর রাক্ষসের মৃত্যুবাণ তাদের কাছেই থাকে। সেই পদ্ধতিতেই যদি বুশের মরণ আনা যায়, সেটাই আমি দেখতে চাই। আসুন-না আপনাদের মারণ অস্ত্র নিয়ে। এমনভাবে তৈরি করবেন, যাতে সংঘর্ষেই সেগুলো বিস্ফোরিত হয়। তাহলে আসছেন তো কুইটোতে শুক্রবার রাত্রেই? সপ্তাহান্তিক ছুটিটা ওখানেই কাটানো যাবে। পরিকল্পনাটাও ওখানেই বলব।
সাত্যকি সোমের কথা বলার ভঙ্গিতে যেন মনে ভরসা পেলেন দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানী আর কর্ণধারগণ। সাত্যকি সোমও রওনা দিলেন ইকুয়েডরের উদ্দেশে।
শুক্রবারই সেখানে অস্ত্রসম্ভার নিয়ে এলেন দশটি দেশের প্রতিনিধি। ভারতের প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন ডক্টর সোম নিজে পাঁচজন সতীর্থ নিয়ে। তাঁর পরিকল্পনামতো পরদিন শনিবারেই হল অপারেশন টাইটেনিয়াস।
রবিবার সকালেই ফিরে এলেন দেশে। দু-দিন ধরে দূরবিনে টাইটেনিয়াসের স্পেকট্রামের বিশ্লেষণ চালালেন। বর্ণালিতে পরিবর্তন বোঝা গেল। এখন সেখানে একটা ধোঁয়াশার আবরণ।
মঙ্গলবারও কেটে গেল। রিউবেনের কোনও বার্তা এল না। পরের শনিবারও পার হয়ে গেল। কুইটোর কুখ্যাত বৃত্তাঞ্চলে দেখা দিল না কোনও বায়ুস্তম্ভ। দেশ-বিদেশ থেকে শয়ে শয়ে ফ্যাক্সবার্তা আর টেলিফোন ডক্টর সোমকে যেন পাগল করে দিল। তৃতীয়বারের নোবেল পুরস্কার বুশের বদলে তিনিই পাচ্ছেন। তবে বিজ্ঞানে নয়–শান্তির জন্য।
খবরটি শুনে সাত্যকি সোম ভাবলেন, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মনে স্বস্তি এনে তিনি যে আনন্দ পেলেন, তার কাছে কি কোনও পুরস্কার পাওয়ার আনন্দ লাগে? তবে সবচেয়ে আগে তিনি তাঁর কুসংস্কারাচ্ছন্ন তরুণ বন্ধু গৌতম ব্ৰহ্মকে নিজের তরফ থেকে পুরস্কৃত করবেন। সে-ই তো বলেছিল, রাবণ রাজার নিজের মৃত্যুবাণ তার নিজের কাছেই ছিল। সে-ই বলেছিল, ন্যায়ের জয় যে হবেই।
এক্ষেত্রেও তো তা-ই হল। নিজের মৃত্যুবাণ–একটা নয়, প্রায় দু-ডজন ব্রহ্মাস্ত্রকে পৃথিবীর বাতাসের সঙ্গে নিজের কাছে নিজেই টেনে নিলেন মহাপ্রতিভার অধিকারী বিজ্ঞানী রিউবেন বুশ। তাদের পৃথিবীর দিকে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা বা পরিকল্পনা কোনওটাই ছিল না রিউবেনের-রাবণের সঙ্গে যার নামেরও ছিল মিল।
[শুকতারা, শারদীয়া ১৩৯৫]