অঙ্গ ভঙ্গ তরঙ্গ
সত্যব্রতর সঙ্গে আমার যখন প্রথম পরিচয়, তখন সে ইলেকট্রনিক্স নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিল। এক বিপদের সময় সে আমাকে সাহায্য না করলে আজ হয়তো…। যাক, সেই ঘটনা এই কাহিনিতে অপ্রাসঙ্গিক। তবে সেই ঘটনাই আমাদের মধ্যে এক স্থায়ী পরিচয়ের ভিত গড়ে তুলেছিল। তারপর তো দুই বাড়ির মধ্যে সম্পর্ক হয়ে দাঁড়ায় আত্মীয়ের মতো। তখন সত্যর বাবা-মা বেঁচে ছিলেন। ছোট ভাই প্রিয়ব্রত স্কুলে পড়ত।
তারপর কত বছর কেটে গেছে। সত্যর বাবা-মা এখন আর নেই। তাঁদের জায়গা পূরণ করেছে তার স্ত্রী নীতা আর ফুলের মতন একটি ছোট্ট মেয়ে টিকলি। আর সঙ্গে ডাক্তার-ভাই প্রিয় তো আছেই। তার অবশ্য এখনও বিয়ে হয়নি। ভুবনেশ্বরে এক হাসপাতালে কর্মরত। ওদের বাড়িতে এখনও মাঝেমধ্যেই যাই। বিশেষ করে টিকলিসোনার টানে।
সত্য ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেই অধ্যাপনা করে। সঙ্গে গবেষণাও। একদিন তার বাড়িতে যাওয়ামাত্র সে বলল, আসুন সন্দীপদা, এক নতুন যন্ত্র আপনাকে দেখাই। এখনও অবশ্য পরীক্ষার স্তরে আছে, তবে সম্পূর্ণ হলে অনেক কাজে লাগবে এটা।
আমি ঠাট্টা করে বললাম, কী আবার বানালে তুমি? মানুষ অদৃশ্য করার যন্তর নাকি?
সত্য হেসে উঠে বলল, বলা যায় না। আমরা সবাই তো ভবপারাবারে তরঙ্গমাত্র। তাকে মিলিয়ে দিলেই তো আমাদের কাছে ফক্কা।
যন্ত্রটা দেখলাম। বললাম, এ তো দেখছি, টেপরেকর্ডারের মতন মনে হচ্ছে। তা এটা কী কম্ম করে, সেটা বলো।
সত্য এবার অধ্যাপক মেজাজে ফিরে এল। বলল, এটাকে বলা যায় তরঙ্গ পরিবর্তক। আমাদের এই বিশ্বজগতে অহরহ সংখ্যাহীন তরঙ্গের প্রবাহ চলছে। রবি ঠাকুরের গানটাকে এভাবে বলা যায়–তরঙ্গধারা বহিছে ভুবনে। তার অতি ক্ষুদ্রাংশ আমাদের দেখায়, শোনায়, অনুভব করায় বা অন্য কিছু কাজ করে দেয়। আমরা দেখতে পাই–শুধুমাত্র গঙ্গাস্তোত্রের সেই তরল-তরঙ্গ। আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এইসব অঙ্গের পরিমাণ তো নৌকো থেকে হাত ডুবিয়ে মহাসমুদ্রের ঢেউ গোনার মতো। বেশির ভাগই থাকে আমাদের নাগালের বাইরে। এই যন্ত্রের সাহায্যে এক তরঙ্গকে ছোটবড় করে ভেঙে রূপ বদলে অন্য তরঙ্গে রূপায়িত করা যাবে। যেমন… আগে আপনাকে বাজনা শোনাই।–এই বলে যন্ত্রটাতে একটা রেকর্ড প্লেয়ার যোগ করে দিয়ে চালিয়ে দিল। বেজে উঠল রবিশংকরের সেতারে দেশ রাগের মূৰ্ছনা।
এবার শুনুন।–বলে সে যন্ত্রটার একটা নব ঘুরিয়ে কাচের ভেতরের একটা কাঁটা সরাতে লাগল। অদ্ভুত একটা আওয়াজ হতে হতে একসময় শুনলাম, সরোদ বাজছে। সেই দেশ রাগ।
সত্য হেসে বলল, এটা কিন্তু আলি আকবর বা আমজাদ আলি না। রবিশংকরের সেতারই শুনছেন। আসলে সেতারের তরঙ্গের এক রূপ আছে। সেটাকে সরোদের তরঙ্গের রূপে বদলে দিয়েছি। আমার, আপনার–পৃথিবীর সমস্ত মানুষের কণ্ঠস্বরের রূপ আলাদা। যেমন, আঙুলের ছাপ কি মুখমণ্ডলের চেহারা। ভাবুন তো, কী মহাবিস্ময়! শব্দতরঙ্গ থেকে এবার দেখুন আলোকতরঙ্গ। এবার তরঙ্গের রূপ নয়, তার মাপ বদলেই তার দৃশ্যরূপ বদলাব।
সে রেকর্ডারটা খুলে একটা লাল আলোর টর্চ যন্ত্রটার পেছনে লাগিয়ে দিল। যন্ত্রের সামনে ছোট স্বচ্ছ পর্দা দিয়ে সেই আলো বেরিয়ে এল। সত্য আবার যন্ত্রটাকে টিউন করতে লাগল। আলোর লাল রং ক্রমে বদলে কমলা, হলদে, সবুজ, নীল হতে হতে বেগুনি হয়ে গেল। তারপর আলোটা নিবে গেল।
সত্য বলল, আলো কিন্তু আছে। আলট্রাভায়োলেট বা বেগুনি-পারের আলো। আমরা দেখতে পাচ্ছি না। একটা লাল আলোর তরঙ্গের আকার বা মাপ হচ্ছে এক সেন্টিমিটারের এক লক্ষ ভাগের সাত ভাগ। সেটাকে আরেকটু ছোট করে যদি তরঙ্গের দৈর্ঘ্য সাতের জায়গায় এক লক্ষ ভাগের চার ভাগ করা যায়, তাহলেই সেটা বেগুনি আলোর তরঙ্গ হয়ে যাবে। এই অণুপরিমাণ তফাতের মধ্যেই সাত রঙের রাজত্ব। আরও ছোট করলে দেখা যাবে না। তবে না জেনে এ কাজ করতে বসবেন না। তাতে আপনার অজ্ঞাতে বিপদ ডেকে আনতে পারেন। এক্স-রে হয়ে আপনার শরীরে ঢুকতে পারে, যা বেশি যাওয়া খারাপ। তা ছাড়া আরও ছোট হয়ে দেহে ঢুকে রক্তকণিকা ভেঙে দিতে পারে।
আমি ভয় পেয়ে বললাম, আরে, ঘুরিয়ো না, ঘুরিয়ো না আর!
সত্য হেসে বলল, ভয় নেই, সীমার মধ্যেই আছে। এইভাবে শব্দতরঙ্গকেও ছোট করে আলট্রাসনিক থেকে আলোকতরঙ্গে পরিণত করা যায়। রূপ আর মাপ একসঙ্গে বদলে আরও মজার ব্যাপার হয়, সন্দীপদা। একদিন আসবেন, আপনাকে বড়ে গোলামের রেকর্ড বাজুবন্দ খুল খুল লতা মঙ্গেশকরের গলায় শোনাব।
আমি অবাক হয়ে বললাম, আর ওপাশের নবটা?
সত্য হেসে বলল, এটা সামান্য জিনিস। শব্দ বা আলোর জোর কমানো-বাড়ানো। নেহাত গার্হস্থ্য কাজে লাগবে। রাত্তিরে বেশি পাওয়ারের আলো ইচ্ছেমতো কমানো যাবে।
সত্য আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় হইহই করে টিকলিকে নিয়ে নীতা এসে পড়ায় তাতে বাধা পড়ল।
নীতা বলল, সন্দীপদা আসামাত্র বোধহয় তোমার ম্যাজিক বাক্স নিয়ে লেগে পড়েছে। তা-ও যদি ওই বাক্স থেকে বোতাম টিপে এক কাপ চা বানানো যেত তাহলে বুঝতাম। তখন তো এই শর্মা। বলেই ভেতরে চলে গেল।
টিকলি আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, রোবটজেঠু, গঙ্গারাম এখন কী করছে?
সেই কবে টিকলিকে ঠাট্টা করে বলেছিলাম, আমার একটা রোবট আছে। নাম গঙ্গারাম। সেই থেকে আমার নামই হয়ে গেল রোবটজেঠু। এখন টিকলিই আমার এই ভূতের মতন চেহারার নির্বোধ অতি ঘোর রোবটটা নিয়ে ঠাট্টা করে।
আমি মুখটা কাঁদো কাঁদো করে বললাম, আর বোলো না, গঙ্গারাম মরে গেছে।
অ্যাঁ!–টিকলির মুখে হাসি, চোখে কপট বিস্ময়।
আমি বললাম, দুঃখের কথা কী বলব! বাজারের ব্যাগটা থেকে কয়েকটা পটোল মেঝেতে পড়ে যেতে গঙ্গারামকে বললাম, পটোল তোল! ওটা এমনই বুদ্ধ যে, সঙ্গে সঙ্গে ধপাস করে চোখ উলটে পড়ে গেল। রোবটের ডাক্তার এসে বললেন, যন্ত্রপাতি সব পুড়ে গেছে। আর ভালো হবে না।
টিকলি হাততালি দিয়ে বলে উঠল, কেমন জব্দ, রোবটজেঠু!
নীতা চায়ের সঙ্গে বড়া ভেজেও নিয়ে এল। আমি খেতে খেতে বললাম, সত্যর ম্যাজিক বাক্সকে চা বানাতে শেখালেও এমন বড়া ভাজাতে পারবে না।
ভরতি মুখ নিয়ে সত্য বলল, তা সত্যি। এটা অন্য তরঙ্গ। যন্ত্রের অঙ্গকে এত নিখুঁত করা আমার সাধ্য নেই।
কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে সে দিন চলে এলাম। কিছু দিন পরে চলে গেলাম কর্মস্থল দিল্লিতে। সেখান থেকে সত্যর চিঠিতে তার গবেষণার অগ্রগতির কথা মাঝে মাঝে পেতে লাগলাম। বোতাম টিপে তাতে তরঙ্গের বিভিন্ন রেঞ্জ বা এলাকার ব্যবস্থা করেছে। লং ওয়েভ থেকে শর্ট, মাইক্রো, আলট্রা-মাইক্রো ইত্যাদি।
টিকলিও আঁকাবাঁকা অক্ষরে লিখল, এবার একটা চালাক রোবট বানাও, রোবটজেঠু। নাম দিয়ো, বাঞ্ছারাম।
শেষের দিকে সত্যর চিঠি বেশ কিছুকাল না পেয়ে ভাবলাম, সে হয়তো খুবই ডুবে আছে তার কাজে। তারপরেই বাড়ি থেকে পেলাম সেই মর্মান্তিক দুঃসংবাদ-লেখা চিঠি। চিঠি পড়ে সে দিন অফিস যেতে পারলাম না। রাত্রে ঘুম এল না। খাওয়াদাওয়াও দায়সারা, অন্যমনস্কভাবে চলল। ভাবতে লাগলাম, কী কাজ সাধন করতে টিকলির মতো একটি পবিত্র ফুলের জীবন সৃষ্টি হয়। স্নেহ-মমতায় ফুটে ওঠা সেই ফুল কেনই বা আট বছর বয়সে বাবা-মা-র বুক দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে ঝরে পড়ে যায়! এই চিরন্তন প্রশ্ন আমার মনকে ছেয়ে রাখল। প্রাত্যহিক কাজকর্মের মধ্যেও। রোগটা ধরা পড়ার আগেই ডাক্তারদের ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছিল। সত্য আর নীতার অবস্থা ভাবতে পারছিলাম না। আমার চোখের সামনে ভাসছে সেই হাসিভরা মুখটি, কানে বাজছে সেই ডাক– রোবটজেঠু।
ছুটি নিয়ে কলকাতায় চলে এলাম। সত্যর ওখানে গিয়ে দেখলাম, প্রিয় খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চলে এসেছে দাদা-বউদিকে সামলাতে। কিন্তু তাকে দেখলাম, নিজেই টিকলির খেলনার বাক্স খুলে নাড়াচাড়া করছে আর বারবার গুছিয়ে রাখছে।
নীতা এক পাষাণমূর্তি। সত্য যেন লোকদেখানো স্বাভাবিকতার ব্যর্থ অভিনয়ে চাপা এক ভগ্নাবশেষ। হঠাৎ যেন একটা কথা মনে পড়েছে, এমনভাবে সত্য বলে উঠল, তবে জানেন সন্দীপদা, টিকলি চলে গেলেও আমরা তাকে রোজ দেখতে পাই। তার সঙ্গে কথা বলি। সেই যন্ত্রটাকেই আমি আন্তর্জাগতিক সঞ্চারক যন্ত্রে রূপ দিতে পেরেছি। প্রয়াত আত্মাকে তাতে ধরা যায়। তবে টিকলির জন্যেই সেটাকে বিন্যস্ত করা আছে। আজ সন্ধেবেলাতেই আসুন। আপনিও দেখবেন, ওর সঙ্গে কথা বলবেন। তবে আমরা কথা দিয়েছি, এই রবিবারেই তাকে শেষবারের মতো ডাকব। তারপর সে আর আসবে না। কারণ সে আমাদের বলেছে যে, ভালো বাবা-মা খুঁজে পেয়েছে। দেরি হয়ে গেলে হয়তো খুবই দুঃখের জীবন হবে পরের জন্মে। তা ছাড়া, ডাকলে তার একটা কষ্টও হয়। আমাদের মন খারাপ করতে মানা করেছে।
এতক্ষণে নীতা স্বাভাবিকভাবে কথা বলল। সে বলল, হ্যাঁ, সন্দীপদা। টিকলিকে শুধু শুধু নিজেদের স্বার্থ দেখতে কষ্ট দিচ্ছি। টিকলি পরের জন্মে ভালোভাবে আনন্দে থাকুক, এটাই তো আমরা চাইব। নাকি, নিজেদের সুখের জন্যে ওকে কষ্ট দিয়ে যাব? আপনি কী বলেন, সন্দীপদা?
আমি বোকার মতন ফ্যালফ্যাল করে দু-জনের দিকে তাকিয়ে বললাম, বটেই তো।
ওদের কাছ থেকে চলে আসার সময় সত্য বেরিয়ে এসে চুপিচুপি বলল, এটার কথা গোপন থাক, সন্দীপদা, আমাদের চারজনের মধ্যেই। বলে হাতে একটু চাপ দিল।
হতভম্ব অবস্থাতেই বাড়িতে পৌঁছোলাম। স্ত্রী অবশ্য আগেই বেশ কয়েকবার ও বাড়ি ঘুরে এসেছে। তবে এই ব্যাপারটা জানে না। প্রতিশ্রুতিমতো আমিও কিছু বললাম না। সত্যি কথা বলতে, নিজেরই মাথায় কিছু ঢুকছিল না।
সন্ধেবেলা টিকলিকে সত্যিই দেখলাম। সত্য তার সেই তরঙ্গভঙ্গের যন্ত্রটা টেলিভিশনে যোগ করে দিল। প্রিয় টিকলিকে এভাবে দেখাটা সহ্য করতে পারে না। ডাক্তার হলেও তার মন খুবই নরম। সে বাইরে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা আবছা ধোঁয়াটে আবরণের আড়ালে টিকলির হাসিভরা মুখ দেখা গেল।
ওর মা কেঁদে উঠে বলল, আর দু-দিন, সোনামণি। তারপরে তোর ছুটি। শুধু শুধু তোকে কষ্ট দিচ্ছি আমাদের আনন্দের জন্যে।
টিকলি হাসতে হাসতেই উত্তর দিল, তুমি এমন করলে কিন্তু আমি আরও কষ্ট পাব, মা। হাসো, একবার হাসো আগে, দেখি। দাঁত দেখালেই যদি হাসি হয়, নীতা তা-ই করল। টিকলি বলল, কই, শব্দ করে জোরে হাসো। নইলে ধোঁয়ার মধ্যে আমি দেখতেই পাচ্ছি না।
নীতা এবার জোর করে হাসার চেষ্টা করল। তার হাসিটা আমার কাছে ফুঁপিয়ে কান্নার মতো মনে হল। নীতাই কথা বলে যেতে লাগল। হঠাৎ সত্যর দিকে নজর পড়তে সে বলল, তুমি টিকলির সঙ্গে কথা বলছ না কেন? কীরকম বাবা তুমি? মুখ গোমড়া করে বসে আছ!
সত্যর যেন চমক ভাঙল। সে বলল, হ্যাঁ রে, টিকলি। এই রবিবারেই তুই শেষবারের মতো আমাদের কাছে আসবি। তারপর তুই আবার ফিরে পাবি নতুন বাবা-মা। তাঁরা যে ভালো হবেন, সে তো তুই জানতেই পেরেছিস। আমাদের তাতেই আনন্দ। আমরা আর মন খারাপ করব না। তোর মা-ও আর করবে না। তোকে তো কথাই দিয়েছে। না হলে পরের জন্মে তোর অমঙ্গল হবে। আমাদের স্মৃতিতেই তুই থাকবি।.. ওহো, এই দেখ, কে এসেছে এখানে।
টিকলি হাসতে হাসতে বলল, কেমন আছেন, জেঠু? আমার এই আসার কথা কাউকে বলবেন না। জেঠিমাকেও না। প্রমিস!
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো উচ্চারণ করলাম, প্রমিস। কিন্তু অবাক হলাম। টিকলি তো আমাকে রোবটজেঠু ছাড়া ডাকে না। আপনিও বলে না। তবে কি তার স্মৃতি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে! নীতাও যেন একটু অবাক হল। সত্য তা-ই দেখে তাড়াতাড়ি বলল, নাঃ, তুই এরই মধ্যে সব ভুলতে শুরু করেছিস, টিকলি। সন্দীপদাকে রোবটজেঠু বলে ডাকলি না। আবার আপনি বলছিস!
টিকলি যেন থতমত খেয়ে গেল।
বলল, সত্যিই একটু ভুলে যাচ্ছি, বাবা। কিছু মনে কোরো না রোবটজেঠু, কেমন?
সে দিন আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পরে টিকলি বিদায় নিল। আমিও প্রায় স্তম্ভিত অবস্থায় বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আসার সময় আবার সত্য বেরিয়ে এসে আমার হাত ধরে অনুরোধ করল, টিকলির আবির্ভাবের ঘটনাটা যেন আমি দ্বিতীয় প্রাণীকে না বলি। আমি নির্বাক অবস্থাতেই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। সে প্রমিস তো টিকলির কাছেই করেছি। মাথায় সব কিছু ঘুলিয়ে যাচ্ছিল। এত দিনের ধারণা কি সব ভুল? আত্মা, তার পোশাক পরিহিত বিলীন হওয়া অঙ্গ ধারণ করে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে দৃষ্টিগোচর হওয়া, জন্মান্তর–সবই কি সত্যি! আত্মার কি কোনও তরঙ্গ আছে? সত্যব্রত নিজেই তো আত্মার পরিস্ফুটন যন্ত্র আবিষ্কার করেছে। নাকি, সবাই মিলে ভুল দেখেছি! মানুষ তো দল বেঁধে মরীচিকাও দেখে। কিন্তু বিজ্ঞান সেই রহস্যের সমাধান করে দিয়েছে। এখানে তো রহস্য সৃষ্টি করেছে বিজ্ঞান নিজেই। সত্যব্রতর মতন নাস্তিক বিজ্ঞানীও যখন
ভুল বললাম। সত্যব্রত তো নাস্তিক নয়। সে বলে, সে অজ্ঞেয়বাদী। এক্স-এর ভ্যালু শূন্য বললে, সে নাস্তিক। এক্স-এর ভ্যালু কোনও সংখ্যা বললে সে হয় আস্তিক। সত্যব্রত বলে, এক্স-এর ভ্যালু আমাদের অজ্ঞাত। অজ্ঞেয়ও। তাই সেটা নিয়ে ভেবে, চেঁচিয়ে সময় নষ্ট না করে নিজের কাজ করে যাও। তার ধারণা, একটা ব্যাখ্যাতীত বিরাট অজ্ঞাত বুদ্ধির মহাশক্তিতে জৈব-অজৈব সব কিছু নিয়ে বিশ্বজগতের শৃঙ্খলিত নিয়মের প্রবাহ চলছে। সে শক্তি করুণাময়ও নয়, নিষ্ঠুরও নয়–নির্লিপ্ত।
এর মধ্যে আর সত্যর ওখানে গেলাম না। দিল্লিতে ফিরে এলাম। ক-দিনের মধ্যেই পেলাম তার চিঠি। লিখেছে–টিকলি চলে গিয়েছে, সন্দীপদা। নীতার জন্যে তাকে আমার যন্ত্রে আনতে হয়েছিল। নইলে নীতা বাঁচত না। বাঁচলেও হয়তো পাগল হয়ে যেত। মনের তরঙ্গ ধরা আমার কাজ নয়। তবে বুঝতে পারি, নীতার মনের তরঙ্গ আমার চাইতে ভঙ্গুর। এখন সে অনেক স্বাভাবিক। সে জানে, টিকলি এখন একটা সুখী মেয়ে হয়ে এই পৃথিবীতেই জন্মাবে। তার নতুন জীবনের মঙ্গলের জন্যে সে পুজো দিয়েছে। কিন্তু আমার নিজের জন্যে যে কোনও সান্ত্বনা নেই! বুকের মধ্যে জমাট হয়ে থাকবে একমাত্র অনুভূতি আর বেদনা–যার ভাগীদার নীতাকে জীবনে করা যাবে না। তাই নীতার সঙ্গে টিকলির সাক্ষাতের ঘটনা নিয়ে আলোচনা করি। সেটা একটা অভিনয়, যা আমাকে করে যেতে হবে। কারণ, সত্যিই তো টিকলি আমাদের দেখা দেয়নি।
সন্দীপদা, সমসাময়িক সব কিছু নিয়ে একটা মানুষের জীবনও তো মহাকালের সমুদ্রে এক তরঙ্গমাত্র। সেটা মিলিয়ে যায় অন্য শক্তিতে পরিণত হয়ে। আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে শরীরটাও শতাধিক মৌলে বিশ্লিষ্ট হয়ে এক বিতরণের খেলায় মেতে ওঠে একটি নিয়মে অঙ্গ-ভঙ্গ-তরঙ্গ। তাকে কি আবার একীভূত করে ফিরিয়ে আনা যায়? তাহলে তো মানুষটাই ফিরে আসবে। টিকলিকে ধরে রাখার ইচ্ছে তো কবির সেই ভাষায়–প্রবাহ আঁকড়ি রাখিবারে চাই। তবে টিকলির গলার রেকর্ডিং আমার কাছে ছিল। তার কণ্ঠস্বরের মাপ আর রূপ তার থেকেই পেয়েছি। যন্ত্রে সেটা চিহ্নিত করে রেখেছিলাম। অন্য যে-কেউ মাউথপিসে কথা বললেই সেটা টিকলির কণ্ঠস্বর হয়ে যন্ত্রের স্পিকারে ধ্বনিত হবে। আর টিকলির হাসিমাখা মুখের ভিডিয়ো রেকর্ডিং তো আমার ছিলই। টেলিভিশনের পর্দায় সেটাকেই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রয়োজনমতো সময় ধরে ব্যবহার করেছি। তাৎক্ষণিক কথার সঙ্গে ঠোঁটের অমিল ধোঁয়ার আবরণে যত কম নজরে পড়ে, তার ব্যবস্থাও করেছিলাম। আপনিও ধরতে পারেননি। অবশ্য এসব লক্ষ করার মতো মানসিকতা তখন নীতার ছিল না।
আমাদের প্রশ্নগুলো একটা মাইক্রোফোনের মারফত দূরে একটা কর্ডলেস টেলিফোনের রিসিভারে ধরা পড়বে, আর সেই টেলিফোনধারীই টিকলির হয়ে উত্তর দেবে, যা টিকলির কণ্ঠস্বরে শোনা যাবে আমার যন্ত্রে। আপনি নিশ্চয়ই অনুমান করতে পেরেছেন, কে এই উত্তরদাতা। সে টিকলিকে অশরীরী অবস্থায় দেখাটা সহ্য করতে না পেরে ঘর থেকে বেরিয়ে যেত। কারণ, তাকেই যে টিকলি হতে হবে। অনেকদিন কলকাতায় না থাকাতে টিকলি আপনাকে কীভাবে সম্বোধন করত, সেটা হয়তো সে ভুলে গিয়েছিল। তাই একটু ভুল করে ফেলেছিল। আমার যন্ত্রটা আসলে কিছু দিনের জন্যে হয়ে গিয়েছিল দুই ভাইয়ের একটা ষড়যন্ত্র। নীতাকে বাঁচাতে। আমরা দু-জন ছাড়া কেউ জানত না। এখন আপনি জানলেন। কারণ, আমি জানি, চতুর্থজন কেউ জানবে না আমাদের কাছ থেকে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মগ্ন মৈনাক পড়েছেন তো? রহস্যের মৈনাক মগ্নই থাকুক। আপনাকে না-জানানো একটা অপরাধ হত। তাহলে আপনি সারাজীবন শুধু আমার মানসিকতা নয়, আপনার নিজের বুদ্ধি-বিশ্বাস সম্পর্কেও একটা ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে থাকতেন। নীতা এখন ভালো আছে। প্রিয় চলে গেছে তার কাজে। আমিও যন্ত্রটা নিয়ে লেগে আছি। ইতি, সত্যব্রত।
চিঠিটা হাতে ধরে অনড় হয়ে বসে থাকলাম অনেকক্ষণ। কানের কাছে কেউ যেন অশ্রুত হাততালি দিয়ে বলে উঠল, কেমন জব্দ, রোবটজেঠু!
[শুকতারা, শারদীয়া ১৪০৬]