কিম্ভূত রহস্য
০১.
সভ্যতা যত অগ্রসর হইবে, মানুষের জীবন হইতে কবিতাও তত দূরে সরিয়া যাইবে। ইংরেজিতে এইরকম একটা প্রবাদ আছে। কিন্তু আমার মতে, কেবলমাত্র কবিতা নহে– সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে একদিন শিকার-কাহিনি, অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি সব কিছুই রূপকথার গল্পের রূপ এক যে ছিল শ্রেণিভুক্ত হইয়া বালক-বালিকাদের পাঠ্য হইয়াই থাকিবে। জিম করবেটের মতো শিকারির আর প্রয়োজন থাকিবে না।
এটুকু পড়েই ম্যাগাজিনটা সশব্দে বন্ধ করে টেবিলে ফেলে অর্ণব মাথার পেছনে দু হাত রেখে সোফাতে হেলান দিয়ে চোখ বুজল। একটু দূরে খাটের ওপর সুদীপ্ত তাস নিয়ে ধৈর্য রাখার খেলা খেলছিল। সাতবারের বারও যখন তাসের সিঁড়ি তিন-চার ধাপের নীচে নামল না, তখন সে-ও সশব্দে তাসের প্যাকেট টেবিলে ছুঁড়ে রেখে বলল, এখন বুঝতে পারছি, ধৈর্যশীল আর রোগী দুটোকেই ইংরেজিতে একই শ্রেণিতে ফেলে কেন।
অর্ণব চোখ খুলে হাসল বন্ধুর কথা শুনে। বলল, একই সঙ্গে কর্মক্ষমতা, প্রাণচঞ্চলতা আর ধৈর্য কিন্তু অনেক মনীষীর মধ্যেই দেখা যায়। বিশেষ করে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের মধ্যে। আমাদের জীবকও ওরকম ছিল। একদিকে যেমন কিছু করার জন্যে ছটফট করত, অন্যদিকে সেটা সমাধা না-হওয়া পর্যন্ত একেবারে কামড়ে লেগে থাকত।
সুদীপ্ত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে অর্ণব বলল, জীবকের আসল নাম জীবন ইসলাম। জীবনের বাবার নাম সিরাজুল ইসলাম হলেও ছেলেমেয়ের নাম তিনি মাতৃভাষাতেই রেখেছিলেন। তবে জীবন থেকে জীবক–এই নামবিকৃতির জন্যে দায়ী আমার মতোই তাঁর কিছু সহপাঠী। তাঁর রোগা লম্বা চেহারা আর বকের মতো হাঁটা–এটাই কারণ। জীবন পড়াশোনায় খুব ব্রিলিয়ান্ট ছিল। আমরা একসঙ্গেই জুয়োলজিতে অনার্স নিয়ে পড়েছিলাম। বিএসসি, এমএসসি দুটোতেই জীবন প্রথম স্থান পেয়েছিল। পরে উচ্চশিক্ষার জন্যে বিদেশে চলে যায়। শুনেছিলাম, নাইরোবি না দারেসালাম–কোথায় যেন গবেষণা করছিল।
একটু থেমে অর্ণব হেসে আবার বলল, তবে বাংলায় জীবকের লেখার স্টাইল মোটেই ভালো লাগত না আমার। এইমাত্র পুরোনো কলেজ ম্যাগাজিন খুলে ওর একটা লেখা দেখছিলাম, রসকষের বলাই নেই। তবে জীবকের বক্তব্যটা ভাবার বিষয়।
.
০২.
কয়েকদিন পর রবিবার সকালে অর্ণবের বৈঠকখানায় বসে দু-জনে আড্ডা মারছিল। রবিবরের আড্ডা মানেই তর্ক।
অর্ণব খবরের কাগজ পড়তে পড়তে হঠাৎ সেটা সুদীপ্তর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, সকালে উঠে খবরের কাগজ পড়াটা স্বাস্থ্য আর মনের পক্ষে ক্ষতিকর। সিগারেটের বিজ্ঞাপনের মতন কাগজেও এটা ছাপিয়ে দেওয়ার আইন করা উচিত। প্রথম পাতায় হেডলাইনগুলো পড়লেই তো মন জুড়িয়ে যায়! নাগপুরের কাছে ট্রেন দুর্ঘটনায় হতাহত… খড়দহে দুঃসাহসিক ডাকাতি… শিয়ালদহের কাছে ফুটপাথে লরি উঠে পড়ায় ঘুমন্ত পাঁচজনের মৃত্যু… আরও কত কী!
সুদীপ্ত সাংবাদিক। আক্রমণটার মূল লক্ষ্য সে নিজে জেনে হেসে বলল, খবর মানেই তো তা-ই। কথায় বলে, নো নিউজ ইজ গুড নিউজ।
অর্ণব বলল, আচ্ছা, তা-ও না-হয় হল। কিন্তু এগুলো কী? এ পাতা জুড়ে রাশি, লগ্ন, গণ, রত্ন, অমুক বাবাজি, তমুক মহারাজ।
সুদীপ্ত নিজেও কুসংস্কারে ঘোর অবিশ্বাসী। তাই তর্কটা আর জমল না। সে অন্য একটা খবরের দিকে অর্ণবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, এই খবরটা পড়েছিস? উত্তরবঙ্গে নরখাদকের আবির্ভাব। কোচবিহারের কাছে কয়েকদিন পরপর দুটো মানুষ মেরেছে। এর আগে কিছু গোরু-ছাগলও নাকি খেয়েছে বাঘটা।
অর্ণব বলল, সুন্দরবন অঞ্চলে ওরকম নরখাদক কিছু আছে। কাঠুরে, জেলে আর মধু সংগ্রহকারীরাই এদের শিকার হয়। শুনেছি, সুন্দরবনের কাছে এমন একটা গ্রাম ছিল, যার পুরুষমানুষ সব বাঘের পেটে গিয়েছে। তাই গ্রামটাকে লোকে বলত বিধবা গ্রাম। হাস্যরসের আড়ালে করুণরসের এক অসাধারণ উদাহরণ এই গ্রামটার নাম। আসল ব্যাপারটা হল, মানুষের মতন নখ নেই, শিং নেই, করে নাকো ফোঁসফাঁস, মারে নাকো টুসটাঁস–এরকম জন্তু পেলে কোন বোকা বাঘ আর অনর্থক হরিণ-শুয়োরের পেছনে খামোখা ছোটাছুটি করে?
.
০৩.
কোচবিহারের মানুষখেকোর খবরটা কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পঞ্চম পৃষ্ঠার ছোট হরফ থেকে প্রথম পাতায় মোটা হেডিং-এ স্থান পেল প্রতিটি কাগজেই। তবে মানুষখেকোটি বাঘ, না অন্য কোনও জন্তু, সে বিষয়ে সঠিক ধারণা দিতে পারলেন না বিশেষজ্ঞরা। হত ব্যক্তির মৃতদেহ দেখে বাঘের কাজ বলে মনে হলেও এখনও পর্যন্ত বাঘের পায়ের কোনও ছাপ পাওয়া যায়নি, যেটা খুবই অস্বাভাবিক। আরেকটা ব্যাপারও লক্ষ করার মতন। জন্তুটা শিকার ধরত নির্জন মাঠে বা গ্রামের প্রান্তে। পাহাড়, বন, জঙ্গল–যেখানে সাধারণত বাঘ ভালুক-হাতি থাকে, সেখানে জন্তুটার কোনও কীর্তি চোখে পড়েনি। আবার নিহত ব্যক্তি ছাড়া আজ পর্যন্ত জন্তুটাকে কেউ চাক্ষুষ দেখেনি।
কোচবিহার থেকে রিপোর্ট সংগ্রহ করে কাগজের জন্য একটা জব্বর বিশেষ নিবন্ধ লিখছিল সুদীপ্ত। নামটা দিল–ইউএফএ। অজানা হিংস্র জন্তুর ইংরেজি আদ্যক্ষর নিয়ে ইউএফও-র অনুকরণে। এমন সময় অর্ণব ঘরে ঢুকল।
সুদীপ্তর লেখার ওপর একবার চোখ বুলিয়েই সে বুঝে নিল ব্যাপারটা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওপর দিকে তাকিয়ে বলল, কারও সর্বনাশ, কারও পৌষ মাস। সাধারণের বিপদ যখন কারও আয় বৃদ্ধি করে, তখন তাদের এই বৃত্তিকে কি মহান বৃত্তি বলব?
সুদীপ্ত লেখাটা খামে ভরতে ভরতে হেসে বলল, তাহলে ডাক্তারের বৃত্তিটাও নরাধমের বৃত্তি–কী বলিস?
অর্ণব সোফাতে বসে পকেট থেকে একটা খাম বের করল। বলল, লেখাটা বেঙ্গল টাইমসের কর্তার হাতে দিয়েই চল আবার কোচবিহারে কয়েকদিন ছুটি নিয়ে।
সুদীপ্ত বুঝতে না পেরে অর্ণবের দিকে তাকাল। অর্ণব বলল, সমুদা যেতে লিখেছে আমাকে। আর সঙ্গে যে তুই যাবি, এটা লেখা বাহুল্যমাত্র।
সমুদা অর্ণবের জ্যাঠতুতো দাদা। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ বিভাগে বেশ উচ্চপদস্থ অফিসার। বর্তমানে উত্তরবঙ্গের মানুষখেকো নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। কোচবিহারে গিয়েছেন। তিনিই অর্ণবকে যেতে লিখেছেন।
সুদীপ্ত বলল, অর্ণব, তোর কি মনে হয়, ব্যাপারটা সত্যিই ভৌতিক?
অর্ণব হেসে বলে, ভূতের মুখেও নাকি রামনাম শোনা যায়। কিন্তু তোর মুখে ভূতের নাম!
.
০৪.
কোচবিহারে এসে সমুদার নিষেধ সত্ত্বেও দুই বন্ধু একটা মোটরবাইকে করে বেরিয়ে পড়ল। সঙ্গে নিল একটি দূরবিন আর বিশেষ লাইসেন্স করা এক রিভলভার।
যে অঞ্চলে সব চাইতে বেশি মানুষ আর গোরু-ছাগল মরেছে, সেইদিকেই তারা এগলো। গ্রামগুলোতে লোকজনের দেখা পেল বটে, তবে সবসময় একাধিক লোককে একসঙ্গে পথ চলতে দেখল। তা-ও হাতে তাদের নানা ধরনের অস্ত্র।
অনেক দূর আসার পরে একটা নির্জন মাঠের কাছে এল তারা। মাঠে কয়েকটা গোরু চরছে, কিন্তু ধারেকাছে কোনও রাখাল নেই। বোঝা গেল, অবলা নিশ্চিন্ত প্রাণীগুলোকে ভবিতব্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে চরতে পাঠিয়েছে। পরে হয়তো দল বেঁধে মাঠে আসবে।
হঠাৎ গোরুদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য লক্ষ করল তারা। দূর থেকে একটা গোরুকে প্রাণভয়ে তাদের দিকে ছুটে আসতে দেখে বাকি গোরুগুলোও মাঠ থেকে রাস্তায় উঠে ছুটতে লাগল। অর্ণব সুদীপ্তর দিকে তাকাল। গোরুগুলো নিঃসন্দেহে বিশেষ অনুভূতিতে বুঝতে পেরেছে যে, আক্রমণকারী আসছে। অর্ণব সুদীপ্তকে সেইদিকে মোটর সাইকেলটা চালাতে বলল।
কিন্তু একটু পরেই গোরুগুলো আবার এলোমেলোভাবে মাঠে নেমে পড়ল। একটা গোরু শুধু রাস্তায় দাঁড়িয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে বারবার পেছন ফিরে তাকাতে লাগল। অর্ণবের নির্দেশে সুদীপ্ত বাইক থামাল। তবে কি ওরা মোটর সাইকেলের শব্দে ভয় পেয়েছে? অর্ণব দূরবিন চোখে চারপাশে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।
রাস্তার গোরুটা রাস্তা থেকে পাশের ঝিলটায় নেমে জল খেতে লাগল। অর্ণব হঠাৎ বিস্ময়মিশ্রিত স্বরে বলে উঠল, আশ্চর্য! অদ্ভুত!
সুদীপ্ত হেসে বলল, কিম্ভূত না তো?
অর্ণব একই রকম গলায় বলল, কী জানি। চল তো আবার সামনে।
ভটভট শব্দে বাইকটা আবার ছুটতে লাগল। অর্ণব দেখল, বাইকের শব্দে সেই গোরুটা আবার ভয় পেয়ে সামনের দিকে ছুটতে লাগল। কিছু দূরেই গাছপালা-ঘেরা একটা বাংলো ধরনের বাড়ি চোখে পড়ল। গোরুটা সোজা সেই বাড়িটাতে ঢুকে পড়ল। মনে হল, ওটা ওদেরই পোষা গোরু।
বাংলোটার সামনে এসে তারা থামল। বাগান পরিবেষ্টিত সুন্দর কটেজ ঢঙের বাড়িটা নজর কাড়ে। তাদের ভটভট শব্দে ঘর থেকে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ালেন।
অর্ণব কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল সেদিকে। তারপর বাইক থেকে এক লাফ দিয়ে নেমে আনন্দে চিৎকার করে উঠল, জীবক-থুড়ি, জীবন! তুই এখানে?
ডক্টর জীবন ইসলাম দু-হাত বাড়িয়ে হেসে বললেন, আরিব্বাস? অর্ণব না? ওঃ, কত্ত বছর পরে দেখা! আয়, ভেতরে আয়।
সুদীপ্তর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল অর্ণব। সুদীপ্ত অন্য কলেজে পড়ত। তাই জীবনের সঙ্গে পরিচয় হয়নি।
অর্ণব সংক্ষেপে জীবনকে তাদের কোচবিহারে আসার উদ্দেশ্য জানাল। কিছু দিন আগেই পুরোনো কলেজ পত্রিকায় তার লেখা পড়ে সুদীপ্তর সঙ্গে তার কথা আলোচনা করছিল–সে কথাও বলল।
আবোল-তাবোল পুরোনো কথার উজ্জ্বস শেষ হলে অর্ণব বলল, যা-ই হোক জীবক, তোর এখন আর আপশোশ নেই। কুমায়ুন বা রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকোর চেয়ে অনেক মারাত্মক আর রহস্যময় মানুষখেকো দেখা দিয়েছে এখানে।
ডক্টর ইসলাম অন্যমনস্কভাবে কী ভাবলেন। তারপর বললেন, ঠাট্টা করিস আর যা-ই করিস, এর ভালো দিকটা দেখেছিস অর্ণব? কিছু লোক মরছে ঠিকই, কিন্তু মানুষে মানুষে হানাহানি এখন কিছু দিন এদিককার লোকজন একেবারে ভুলে গিয়েছে। এখন লাঠি সড়কি হাতে রাস্তায় কাউকে কাছে আসতে দেখলে লোকে শঙ্কিত হয় না, বরং ভরসা পায়। ওই রাক্ষসটা লোকজনের মধ্যে সংহতি এনেছে, তাদের অসাম্প্রদায়িক করেছে। একে তোরা মারতে এসেছিস?
অর্ণব হেসে বলল, তোর বিচিত্র দর্শন ঠিক মানতে পারলাম না। বনে দাবানল লাগলে বাঘ-হরিণ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কাঁপে। বন্যায় সাপে-মানুষে একই কাঠ ধরে আশ্রয় নেয়। তা-ই বলে কি তুই দাবানল বন্যাকে সমর্থন করবি? আসলে লোকে সত্যিকারের শিক্ষা পেলেই মনের সংকীর্ণতা দূর হয়। জুজুর ভয় দেখিয়ে তা করা যায় না।
মানুষখেকো প্রসঙ্গ থেকে তাদের বর্তমান জীবন আর পেশার কথা এসে পড়ল। জীবন বিদেশ থেকে চলে এসে এখন উত্তরবঙ্গের এই গ্রাম্য পরিবেশে তাঁর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাড়ির পেছনে ঘুরিয়ে একটা ছোটখাটো চিড়িয়াখানাও দেখালেন অর্ণবদের। এই শ্রাবণ মাসে কোকিলের ডাক শুনে সুদীপ্ত চমকে অর্ণবের দিকে তাকাল। তারা দুজনেই অবাক হয়ে দেখল, সামনে একটা ময়ুর কুহুধ্বনি করছে। জীবন ইসলাম হেসে বললেন, ভোকাল কর্ডে একটা কারসাজি করেছি। অবশ্য একটা কোকিলকে এর জন্যে মৃত্যুবরণ করতে হল।
কিছুক্ষণ পরে অর্ণব আর সুদীপ্ত ডক্টর জীবন ইসলামের কাছে বিদায় নিল। আসার সময় অর্ণব কিছু জার্নালের কপি ধার নিয়ে এল। জীবনের গবেষণামূলক কিছু প্রবন্ধ এতে আছে।
সমুদার কোয়ার্টারে ফিরতে বোঝা গেল, সমুদা কীরকম উদবিগ্ন হয়ে ছিলেন এতক্ষণ। তারা ফিরতেই নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, তাহলে অভিযাত্রীদ্বয়, আজকের চষে বেড়ানোটা গেল কি বিফলে?
অর্ণব চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, সাধুজনে বলেছেন, সবুরে মেওয়া ফলে।
.
০৫.
কিছু দিন পরে অর্ণব আর সুদীপ্ত কলকাতায় ফিরছিল। সমুদা তাদের প্লেনেই পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা ট্রেনে আসতে চাইলে তাদের দুজনের জন্যে আলাদা কুপের ব্যবস্থা করে দিলেন। উত্তরবঙ্গের মানুষখেকো মরেছে। জল লোবো নামে এক গোয়ান শিকারি একটা নির্দোষ বাঘকে সন্দেহের বশে গুলি করেছিলেন। এরকম সম্ভাবনা হতে পারে, সেটা প্রথমে বোঝা যায়নি। পরে অবশ্য সাবধানতা নেওয়া হয়েছিল, যাতে মানুষখেকোর সন্ধানে অন্য বাঘ বা জন্তুজানোয়ার মরা না পড়ে। জন লোবোর আহত বাঘটা মানুষের ওপর দু-একবার আক্রমণ করতে চেষ্টা করলে নিরুপায় হয়ে তাকে মেরে ফেলা হয়। সমুদা প্রচার করে দেন উত্তরবঙ্গের মানুষখেকো খতম। আসল খবরটা প্রকাশ করলেন না অর্ণবেরই কাতর অনুরোধে। সুদীপ্তকেও কাগজে লিখতে নিষেধ করল অর্ণব। বলল, দু-এক বছর পরে লিখিস। লোকে অবশ্য তখন আর বিশ্বাস করবে না।
সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করল, কিন্তু তুই জানলি কী করে যে, ডক্টর জীবন ইসলামের গোরুটাই সেই রাক্ষস?
অর্ণব বলল, গোরুটা যখন রাস্তার ধারে নালাটায় জল খাচ্ছিল, তখন দূরবিন দিয়ে দেখে তো আমি তাজ্জব। গোরুতে যেমন মুখ ডুবিয়ে চোঁ চোঁ করে জল খায়, সেভাবে না খেয়ে বাঘের মতন জিব বার করে চকচক করে খেতে লাগল। আর তার মুখের মধ্যে স্পষ্ট দেখলাম মুলোর মতন স্বদন্ত। পরে জীবনের প্রবন্ধ পড়ে এক যোগসূত্র পেলাম। অঙ্গ আর ইন্দ্রিয় সংস্থাপন নিয়ে সে লিখেছে। ও লিখেছে, কী করে এক প্রাণীর অঙ্গ অসমশ্রেণির অন্য প্রাণীর শরীরে সংস্থাপন করেছে অনেক দিনের চেষ্টায়। কোকিলের স্বরযন্ত্র ময়ূরের গলায় বসানো তো সে তুলনায় জল-ভাত। সে লিখেছে, এইভাবে আমিষাশী প্রাণীকে তৃণভোজী করা যায়, তৃণভোজীকে আমিষাশী। এক প্রাণীর প্রচণ্ড ঘ্রাণশক্তি, প্রখর দৃষ্টিশক্তি, এমনকী বুদ্ধিও অন্য প্রাণীর মধ্যে সংস্থাপন করা যায়, যদি বাচ্চা অবস্থা থেকে সেটা আরম্ভ করা যায়।
একটু থেমে অর্ণব বলল, জীবক গোরুটাকে শুধু বাঘে পরিণত করেনি, তার মস্তিষ্কে শিম্পাঞ্জির মস্তিষ্কের কোশও বসিয়েছিল। তাই বুদ্ধি দিয়ে জন্তুটা বুঝতে পারত যে, একাধিক লোককে একসঙ্গে আক্রমণ করলে তার ধরা পড়ার অর্থাৎ স্বরূপ প্রকাশ পাওয়ার সম্ভাবনা। এই বুদ্ধির জোরেই সে এত দিন রহস্যাবৃত থেকেছে।
গোরুটাকে মারার পরে আমি একা জীবকের কাছে ক্ষমা চাইতে গিয়েছিলাম। জীবক ম্লান হেসে বলেছিল, তুই হিন্দু হয়ে গোহত্যা করলি?
সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করল, তুই কী উত্তর দিলি?
অর্ণব বলল, আমি বললাম, গোরু যদি গোরুর মতো ব্যবহার না করে, তবে আমি তাকে গোরু বলে মানি না। শুনে জীবক হেসে বলল, মানুষের বেলায়ও এটা খাটে। সে তার অনেক দুঃখের কথা আমাকে বলল। সে নিজে বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী হয়ে যখন দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন তার দাদা-বউদি-ভাইপোদের ঘরের মধ্যে বদ্ধ অবস্থায় জ্যান্ত পুড়ে মরতে হল, সে আগুন মানুষেরই লাগানো। জীবন ইসলাম শিক্ষিত। তার প্রতিশোধও অন্যরকম।
সুদীপ্ত বলল, সুবর্ণদ্বীপ রহস্যের মতন এবার আর তেমন বিপদটিপদ এল না। কেমন যেন জোলো জোলো। এটাকে কী রহস্য নাম দিবি?
অর্ণব বলল, আমি তো বলেইছিলাম–কিস্তৃত রহস্য।
সুদীপ্ত কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলে, কী অদ্ভুত, না? আবোল-তাবোলের কিতে তো অনেক প্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিল। এখানে তো শুধু বাঘ আর গোরু। এই বকচ্ছপ জন্তুটা তবে আসলে কী-বাঘ না গোরু?
অর্ণব হেসে পড়ল, মরেই যখন গিয়েছে, তখন চন্দ্রবিন্দুও বলতে পারিস।
[কিশোর ভারতী, শারদীয়া ১৩৯৭]