হ্যাঁকো

হ্যাঁকো

একটা টানা ঝিমঝিম শব্দের মধ্যে অনেক যুগের মহানিদ্রা থেকে জেগে উঠলেন ইলাগ্‌গো গ্রহের মহাকাশযাত্রী বিজ্ঞানী ইঠামি। জেগে উঠলেন না বলে বলা উচিত, জাগিয়ে তোলা হল। তাঁকে জাগিয়ে তুলল তাঁর সহযাত্রী রোবট, যার নাম নিরি। তাঁকো নামে মহাকাশযানটিতে এমন ব্যবস্থা ছিল যে, উপযুক্ত আবহাওয়া আর পরিবেশ আছে এমন কোনও গ্রহ বা উপগ্রহ যদি মহাকাশযানটির হাজার ইবারুর (ইলাগৃগো গ্রহে ব্যবহৃত মহাকাশে দূরত্বের মাপ) মধ্যেও পড়ে, তবে হ্যাঁকো গতি পরিবর্তন করে সেই গ্রহে নামবে। আর রোবটটাতেও সেইভাবে প্রোগ্রাম করা ছিল যে, মহাকাশযানটি উপযুক্ত গ্রহে নামলে তখনই সে সংগীতময় তরঙ্গ বাজিয়ে ইঠামি মহাশয়কে জাগিয়ে তুলবে।

বিজ্ঞানী ইঠামি উঠে বসলেন। তাঁর চেহারা দেখলে আজকের এই পৃথিবীর মানুষের নিঃসন্দেহে মনে হবে পৌরাণিক দেবতা বা রূপকথার কোনও অতিমানবের কথা। ইঠামির হাত চারটে। প্রতি হাতে আঙুলের সংখ্যা পৃথিবীর মানুষের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। সেগুলি আকারে ছোট হলেও অক্টোপাসের শুড়ের মতন গাঁটবিহীন আর তরঙ্গায়িত। তাঁর চোখগুলো পাখির চোখের মতন গোল। আর দু-চোখের মাঝখানে কপালে একটি তৃতীয় চক্ষুও বর্তমান। ইঠামির সঙ্গী ও অনুচর রোবট নিরির অবয়বও তাঁর প্রভুর মতোই। কারণ ইলাগো গ্রহের সবচাইতে বুদ্ধিমান প্রাণী ইন্দ্ৰেচাঁদের চেহারা যে এরকমই।

ইঠামি উঠে বসে প্রথমেই ওপরের ডান হাত তুলে কম্পিউটারের একটি চাবি টিপলেন। পর্দায় কতকগুলো চিহ্ন ফুটে উঠল, যা দিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, কী বিরাট পরার্ধ ইবারুর মহাদূরত্বের পথ পার হয়ে এসেছে তাঁর মহাকাশযান হ্যাঁকো। তিনি ভাবলেন, ইলাগো গ্রহে ইতিমধ্যে কত যুগ পার হয়ে গিয়েছে। তাঁর নিজের বাড়ির কথা মনে পড়ল। স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মা, ভাইবোন, বন্ধুবান্ধব–সবার কথা। এখন তারা তো দূরের কথা, ইন্দ্ৰেচা নামে সেই বুদ্ধিমান প্রাণীই কি এখনও টিকে আছে ইলাগো গ্রহে? তাঁর মনে পড়ল নিজের ছোট ছেলেমেয়ে দুটি–লিটুলটু আর লিম্পাটুকে। তাদের মুখের কচি কচি কথা যেন তাঁর কানে লেগে আছে এখনও। একটা ঠেলে-ওঠা ব্যথায় তাঁর কপালের চোখটা নীল হয়ে গেল। দুঃখ-বেদনায় ইন্দ্ৰেচাঁদের মধ্যনে নীল হয়ে যায়। তখনই ইঠামির মনে পড়ল মহাকাশযাত্রার আগের মুহূর্তে তাঁর বিজ্ঞানী গুরু অধ্যাপক মিসৌয়ের সান্ত্বনাবাক্য। তিনি বলেছিলেন, দ্যাখো ইঠামি, তুমি যেখানে গিয়ে পৌঁছোবে, তার দূরত্ব তোমার কম্পিউটারের পর্দায় দেখে চমকে যেয়ো না বা মন খারাপ কোরো না। আমাদের এই ইলাগো গ্রহটাকে দশবার পাক খেয়ে মনে করো এখানেই ফিরে এলে। তখনও তো অনেকখানি পথ পার হয়ে আসছ। এখানেও সেটা হতে পারে। আজকের এই দিনটি কি তারও আগের দিনগুলো তুমি মহাবিশ্বের অন্য কোথাও গিয়ে ফিরে পেয়ে যেতে পারো। সেখানেই হয়তো দেখবে, তোমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সবাই এসে হাজির হয়েছে তোমার সামনে।

মহাকাশযাত্রার আগে তাঁর মনে জোর আনতে অধ্যাপক মিসৌ যে একটা দার্শনিকসুলভ কথার কথা বলে উৎসাহ দিচ্ছিলেন, সেটা বিজ্ঞানী ইঠামি অবশ্য বুঝতে পেরেছিলেন। তবুও এখন তিনি একটু সময় নিয়ে তাঁর সংস্কারমুক্ত জাগতিক ভাবাবেগহীন বিজ্ঞানী মনটাকে আবার ফিরিয়ে আনলেন নিজের মধ্যে। তাঁর মধ্যনেত্র আবার স্বাভাবিক গোলাপি রং ধারণ করল।

তিনি নিরিকে সঙ্গে নিয়ে গোলাকৃতি মহাকাশযান হ্যাঁকো থেকে বেরিয়ে এলেন। বাইরে এই নতুন জগতের নানারকম শব্দ শুনতে পেলেন। সেইসব শব্দ ছাপিয়ে যেন তাঁর কানে বাজতে লাগল লিটুলটু আর লিম্পাটুর কলকাকলি। তাদের মুখের সেই ছড়া–

কটা মদুমাদু
কনা মদুমাদু
টাঠপি নকে কিবা।
টাঠপি তেপে
নাসচা তেখে।
ঠপি মদুমাদু কিটা।

মহানিদ্রার জন্যে তাঁর মনে হচ্ছে, গতকালই যেন তাদের ছেড়ে এসেছেন।

অনুভূতিহীন রোবট নিরি অবশ্য নির্বিকারভাবে ইঠামিকে বলে যেতে লাগল এই নতুন গ্রহের তাপমাত্রা, বায়ুর উপাদান, মূল নক্ষত্র থেকে এটার দূরত্ব, আবর্তনের রীতি–সব কিছু। বলার সঙ্গে সঙ্গে ডেটাপ্রিন্টের কাগজও সে তার মনিবের হাতে দিয়ে যাচ্ছে। তারপর মনিবের সঙ্গে হাস্য-পরিহাসের ঢঙে বলল, অধ্যাপক মিসৌ এই গ্রহ দেখলে অবাক হয়ে তাঁর সৃষ্টিকর্তা-তত্ত্বে অনেক তথ্য যোগ করতেন। ইলাগ্‌গোতে যেটা হয় না, এখানে সেটাও হয়। কক্ষপথে এই গ্রহটাকে মিসৌয়ের মাথার মতন একটু কাত করে দিয়েছেন সেই সৃষ্টিকর্তা। তাই নক্ষত্র পরিক্রমার সঙ্গে সঙ্গে এই গ্রহে আবহাওয়ার পরিবর্তনও হয়। কিছুকাল বেশ গরম। তারপর বৃষ্টি। আবার কিছু সময় ঠান্ডা। গরম থেকে শীত, আর শীত থেকে গরমের মাঝে দু-বার না-গরম না-ঠান্ডা। এই গ্রহের একটামাত্র উপগ্রহ আছে। রাত্তিরে তাতে প্রতিফলিত মূল নক্ষত্রের আলো এই গ্রহে এসে পড়লে বড়ই স্নিগ্ধ লাগে। আর আশ্চর্যের কথা হল, এই গ্রহ থেকে মূল নক্ষত্র আর এই উপগ্রহের আকার আর দুরত্ব এমনই লাগসই করেছেন মিসৌয়ের সৃষ্টিকর্তা যে মাঝে মাঝে দুটোরই পূর্ণগ্রাস গ্রহণ হয়। তাই বলছিলাম, আপনার গুরু এসব দেখলে…।

নিরিকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন ইঠামি। ইঠামি নিজে নাস্তিক হলেও তাঁর গুরু মিসৌ অতটা নন। তিনি বলেন, সাধারণ ক্ষুদ্রচিন্তাপরায়ণ ইন্দ্ৰেচাঁদের মতো আস্তিক হওয়া, আর মূল পর্যন্ত না গিয়ে নাস্তিক হওয়া–দুটোই বিজ্ঞানবিরুদ্ধ।

যা-ই হোক, নিরিকে নিয়ে ইঠামি মহাশয় নতুন গ্রহে ভ্রমণ করতে করতে যখন নানা তথ্য আহরণ করছেন, তখন আমরা সেখান থেকে একটু দূরে এক পার্বত্য গুহায় চলে যাই। দেখি, সেখানে কী হচ্ছে।

.

পাহাড়ে গুহাটির একপাশে একটি অদ্ভুত জীব বসে পাথরের বেদিতে কাঠের টুকরোর মতন দেখতে একটা পাথর ঘষে যাচ্ছিল। দূর থেকে তাকে বানর বলে মনে হলেও সে একটি প্রাগৈতিহাসিক মানবশিশু। তার নাম আমরা জানি–পুন্নি। বাবোসরা অর্থাৎ বড়রা শিকার করতে বেরিয়ে গিয়েছে। খুব ছোটরা, যারা উংগা উংগা করে কাঁদতেই জানে– সেইসব কুন্টি মায়ের কোলে ঘুমোচ্ছে। আর পুন্নির মতন ছেলেমেয়েদের বসিয়ে দিয়েছে পাথর ঘষতে। এগুলো দিয়ে শিকার করার অস্ত্র তৈরি হবে।

পুন্নির এই কাজ ভালো লাগে না। সে সকালে একটু লুকোচুরি খেলতে চায়। দূরে দেখল, নেংরেও পাথর ঘষতে ঘষতে তার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। তার মনের ভাব পুন্নি বুঝতে পারে। তাদের চোখে চোখে কী কথা হল, সেটা তারাই জানে। তারা গুহার ভেতরে একবার দৃষ্টি ফেলেই ছুট লাগাল হাতের পাথরগুলো রেখে দিয়ে। ছুটতে ছুটতে তারা দু-জনে পাহাড়ের ওপরদিকে চলে গেল।

এর মধ্যে লুকোচুরি ছাড়াও তারা একটা নতুন খেলা আবিষ্কার করেছে। তারা দেখেছে, গোল পাথরগুলো অন্য পাথরের চেয়ে বেশি ছুটতে পারে। এগুলোকে ওপর থেকে ঠেলে দিলে ঘুরতে ঘুরতে গড়িয়ে যায় অনেক দূর। অন্য পাথরগুলো কিছুটা গিয়েই থেমে যায়। তারা বনের মধ্যে গাছ থেকে গোল গোল শক্ত ফল জোগাড় করেছে। এগুলো পাথরের মতন ভারী না, তাই গায়ে লাগলেও ভয় নেই। পুন্নিদের কাছে গোল জিনিসমাত্রই তাঁকো। তারা গাছের হ্যাঁকো নিয়ে নানারকম খেলায় মেতে উঠল। একটা হ্যাঁকো দিয়ে দূর থেকে আরেকটা হ্যাঁকোকে মারতে পুন্নির মতন কেউ পারে না।

এই পাহাড়ে কত পাথরের হ্যাঁকো আছে। কোনওটা কুন্টি অর্থাৎ ছোট। কোনওটা বাবোস অর্থাৎ বড়। কোনওটা কাঁপা বা সাদা, কোনওটা চিপা বা কালো। তবে ওগুলো গায়ে পড়লে খুব ব্যথা লাগে, সেটা পুন্নি আর নেংরে দু-জনেই জানে। তাই গাছের হ্যাঁকো দিয়েই তাদের যত খেলা।

আজকের পৃথিবীর ছেলেমেয়েরা যদি তাদের এই অবস্থায় দেখত, তারা ভাবত, দুটো বাঁদর কতবেল নিয়ে বল খেলছে। ব্যাপারটাও তা-ই। পুন্নিদের হ্যাঁকো মানে বল।

.

বল খেলতে খেলতে তারা পাহাড়ের নীচে ফাঁকা জায়গাটায় চলে আসতেই একটা অদ্ভুত জিনিস তাদের নজরে পড়ল। পুন্নিই প্রথমে দেখল। একটা প্রকাণ্ড হ্যাঁকো খোলা প্রান্তরে পড়ে আছে। তাদের গুহাটার চেয়েও বড়। সূর্যের আলো লেগে সেটা ঝলমল করছে। নদীর জল যেমন ঝলমল করে, তার চেয়েও কত সুন্দর।

পুন্নি চেঁচিয়ে উঠল, বাবোস হ্যাঁকো হুক! বাবোস হ্যাঁকো হুক!

নেংরের হাতে টিপ না থাকলে কী হবে, নাচে সে পুন্নির চেয়ে ওস্তাদ। সে-ও নাচতে নাচতে চিৎকার জুড়ল, বাবোস হ্যাঁকো হু!

যেভাবে লেখা হল, তাদের উচ্চারণ অবশ্য অত স্পষ্ট ছিল না। গলার স্বরও যেন গোরু আর ঘোড়ার ডাকের সম্মিলিত আওয়াজ। তবুও তাঁকো শব্দটা হয়তো পরিষ্কার শোনা গেল নিরির যান্ত্রিক কানে। তারা কাছে আসতেই নিরির অটোমোড ক্ষেপণাস্ত্রের আলো জ্বলে উঠল। অন্য গ্রহের জীব কি তাদের মহাকাশযান হ্যাঁকোকে আক্রমণ করার মতলব করছে?

যন্ত্র-রোবট যেটা না বুঝতে পারল, বুদ্ধিমান ইন্দ্ৰেচা বিজ্ঞানী ইঠামি সেটা স্বাভাবিক অনুভূতিতেই বুঝতে পারলেন। তিনি নিরিকে অস্ত্র সংবরণ করতে বললেন। তাঁর দৃষ্টিতে ধরা পড়ল আনন্দে মত্ত ক্রীড়ারত দুটি শিশু। হোক-না সে অন্য গ্রহের বুদ্ধিহীন জীব– ইন্দ্ৰেচা শিশুর মতন যাদের মস্তিষ্ক অত উন্নত নয়। তবু শিশু শিশুই।

পুন্নি আর নেংরেও এর মধ্যে দেখে ফেলেছে ইঠামি আর নিরিকে। এরকম অদ্ভুতাকৃতি জীব তারা এর আগে দেখেনি। একজনের রং কাঁপা। অন্যজন চিপা। আর কী ঘেন্না! তাদের গায়ে একটুও লোম নেই!

তারা ভয়ে পালাতেই যাচ্ছিল। কিন্তু ইঠামির নির্দেশে নিরি এমন সুন্দর বাজনা বাজাতে লাগল যে, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তারা দাঁড়িয়ে পড়ল। তারা এর আগে কোনও সংগীত শোনেনি।

ইঠামি আস্তে আস্তে তাদের কাছে এলেন। কোমল চারটি হাত দিয়ে দুজনকে কাছে টেনে নিলেন। এই দুই অজানা জীবশিশুর অদ্ভুত সাদা-কালো চোখের সরল দৃষ্টির মধ্যে লক্ষ লক্ষ ইবারু দূরের আরেক গ্রহের দুটি শিশুর গোলাপি চোখের চাহনির মিল খুঁজে পেলেন। প্রস্তর যুগের মানবশিশুদ্বয় তাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি দিয়ে বুঝতে পারল, এই দুটি চতুর্ভুজ জীব তাদের কোনও ক্ষতি করবে না। পুন্নি হাত তুলে মহাকাশযানটিকে দেখাল। ইঠামি তাদের দুজনকে হ্যাঁকোর কাছে নিয়ে এলেন। রোবট নিরি এই ফাঁকে পুন্নি আর নেংরের মাথা স্পর্শ করে নির্বিকারভাবে বলে চলেছে, এরাই হল আপাতত এই গ্রহের সবচাইতে বুদ্ধিমান প্রাণী। এখন এরা আগুনের ব্যবহার পর্যন্ত জানে না। ধাতুরও না। তবে মস্তিষ্কের অন্তর-রশ্মি বিশ্লেষণ করে দেখে মনে হচ্ছে কয়েক হাজার টোটির (ইলাগ্‌গো গ্রহের বছর) মধ্যে এরাও ইন্দ্রেচার মতন…

নিরির কথা ইঠামির কানে গেল না। তিনি তখন চার হাতে তালি বাজিয়ে লিম্পাটু লিটুলটুদের সেই ছড়াটা পুন্নি আর নেংরেকে শোনাতে লাগলেন, কটা মদুমাদু… কনা মদুমাদু…

পুন্নি আর নেংরেও নাচতে নাচতে অস্ফুট কর্কশ গলায় বলতে লাগল, খৰু মাঁউ মাঁউ..ঘং মাঁউ মাঁউ..

হঠাৎ দূরে একটা হল্লা শোনা গেল। পুন্নিরা বুঝতে পারল, বাবোসরা শিকার বা মারামারি করে ফিরছে। এখন যদি তাদের গুহাতে না দেখে, তবে আস্ত রাখবে না। তারা ছুটে চলল তাদের গুহার দিকে। তারা গিয়ে বন্ধুদের জানাবে বাবোস হ্যাঁকোর কথা, কাঁপা আর চিপা জীব দুটোর কথা। ছুটতে ছুটতে তারা আওয়াজ করতে লাগল, খক্ক মাঁউ মাঁউ, ঘং মাঁউ মাঁউ…

তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ইঠামির তৃতীয় নয়ন আবার নীল হয়ে উঠল।

নিরির মাঝের চোখের গোলাপি রঙের অবশ্য কোনও পরিবর্তন হয় না। সে প্রাগৈতিহাসিক মানুষ সম্বন্ধে ডেটাপ্রিন্টটা ইঠামির হাতে গুঁজে দিল। তারপর পরবর্তী আদেশের প্রতীক্ষা করতে লাগল।

ইঠামি বললেন, এই গ্রহের যেদিকে এখন নক্ষত্রালোক পড়ছে না, অর্থাৎ রাত্রি, সেখানে নিয়ে চলো। তবে হ্যাঁকোকে কিছুক্ষণ ওই পাহাড়ের ওপরে স্থির করে রাখে। আমি কিছুক্ষণ ওই জীবগুলোকে একটু টেলিস্কোপিক পেরিভিশনে দেখতে চাই।

পুন্নি আর নেংরে তাদের অভিজ্ঞতার কথা বন্ধুদের বলার আগেই ভোলগা নদীর ধারের প্রাগৈতিহাসিক মানুষের দল অবাক বিস্ময়ে দেখল, তাদের পাহাড়ের মাথার ওপরে দিনের বেলাতেই পূর্ণচাঁদ জ্বলজ্বল করছে। কিছুক্ষণ পরে সেটা দ্রুত সরে গেল পশ্চিমে পাহাড়ের ওপারে। মানুষের প্রথম-দেখা সেই উড়ন্ত পিরিচের কথা ভুলে তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই মেতে উঠল সদ্য আহরিত মৃত ভালুক ভোজন উৎসবে। শুধু পুন্নি আর নেংরে কোনও দিন ভুলতে পারল না সেই বাবোস হ্যাঁকোর কথা, লোমহীন চতুর্ভুজ জীব দুটির কথা আর সেই অদ্ভুত শব্দের কথা–যা শুনলে আর সেখান থেকে যেতে ইচ্ছে করে না। তারা পাথরে পাথরে ঠুকে গলা দিয়ে নানারকম আওয়াজ করার চেষ্টা করত। বাবোসরা বিরক্ত হলেও কুন্টিরা তা-ই শুনে হাসত। বড় হয়ে তারাও ওরকম করত। গুহার প্রাগৈতিহাসিক মানুষদের মধ্যে সংগীতের বীজ বপন করে গেল এক অজানা আগন্তুক সেটা অবশ্য পুন্নি আর নেংরের মৃত্যুর পরে কারও জানা থাকল না।

[শুকতারা, শারদীয়া ১৩৯৭]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

হ্যাঁকো
গল্প - রেবন্ত গোস্বামী
ছড়া - রেবন্ত গোস্বামী
সাক্ষাৎকার

হ্যাঁকো

হ্যাঁকো

একটা টানা ঝিমঝিম শব্দের মধ্যে অনেক যুগের মহানিদ্রা থেকে জেগে উঠলেন ইলাগ্‌গো গ্রহের মহাকাশযাত্রী বিজ্ঞানী ইঠামি। জেগে উঠলেন না বলে বলা উচিত, জাগিয়ে তোলা হল। তাঁকে জাগিয়ে তুলল তাঁর সহযাত্রী রোবট, যার নাম নিরি। তাঁকো নামে মহাকাশযানটিতে এমন ব্যবস্থা ছিল যে, উপযুক্ত আবহাওয়া আর পরিবেশ আছে এমন কোনও গ্রহ বা উপগ্রহ যদি মহাকাশযানটির হাজার ইবারুর (ইলাগৃগো গ্রহে ব্যবহৃত মহাকাশে দূরত্বের মাপ) মধ্যেও পড়ে, তবে হ্যাঁকো গতি পরিবর্তন করে সেই গ্রহে নামবে। আর রোবটটাতেও সেইভাবে প্রোগ্রাম করা ছিল যে, মহাকাশযানটি উপযুক্ত গ্রহে নামলে তখনই সে সংগীতময় তরঙ্গ বাজিয়ে ইঠামি মহাশয়কে জাগিয়ে তুলবে।

বিজ্ঞানী ইঠামি উঠে বসলেন। তাঁর চেহারা দেখলে আজকের এই পৃথিবীর মানুষের নিঃসন্দেহে মনে হবে পৌরাণিক দেবতা বা রূপকথার কোনও অতিমানবের কথা। ইঠামির হাত চারটে। প্রতি হাতে আঙুলের সংখ্যা পৃথিবীর মানুষের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। সেগুলি আকারে ছোট হলেও অক্টোপাসের শুড়ের মতন গাঁটবিহীন আর তরঙ্গায়িত। তাঁর চোখগুলো পাখির চোখের মতন গোল। আর দু-চোখের মাঝখানে কপালে একটি তৃতীয় চক্ষুও বর্তমান। ইঠামির সঙ্গী ও অনুচর রোবট নিরির অবয়বও তাঁর প্রভুর মতোই। কারণ ইলাগো গ্রহের সবচাইতে বুদ্ধিমান প্রাণী ইন্দ্ৰেচাঁদের চেহারা যে এরকমই।

ইঠামি উঠে বসে প্রথমেই ওপরের ডান হাত তুলে কম্পিউটারের একটি চাবি টিপলেন। পর্দায় কতকগুলো চিহ্ন ফুটে উঠল, যা দিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, কী বিরাট পরার্ধ ইবারুর মহাদূরত্বের পথ পার হয়ে এসেছে তাঁর মহাকাশযান হ্যাঁকো। তিনি ভাবলেন, ইলাগো গ্রহে ইতিমধ্যে কত যুগ পার হয়ে গিয়েছে। তাঁর নিজের বাড়ির কথা মনে পড়ল। স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মা, ভাইবোন, বন্ধুবান্ধব–সবার কথা। এখন তারা তো দূরের কথা, ইন্দ্ৰেচা নামে সেই বুদ্ধিমান প্রাণীই কি এখনও টিকে আছে ইলাগো গ্রহে? তাঁর মনে পড়ল নিজের ছোট ছেলেমেয়ে দুটি–লিটুলটু আর লিম্পাটুকে। তাদের মুখের কচি কচি কথা যেন তাঁর কানে লেগে আছে এখনও। একটা ঠেলে-ওঠা ব্যথায় তাঁর কপালের চোখটা নীল হয়ে গেল। দুঃখ-বেদনায় ইন্দ্ৰেচাঁদের মধ্যনে নীল হয়ে যায়। তখনই ইঠামির মনে পড়ল মহাকাশযাত্রার আগের মুহূর্তে তাঁর বিজ্ঞানী গুরু অধ্যাপক মিসৌয়ের সান্ত্বনাবাক্য। তিনি বলেছিলেন, দ্যাখো ইঠামি, তুমি যেখানে গিয়ে পৌঁছোবে, তার দূরত্ব তোমার কম্পিউটারের পর্দায় দেখে চমকে যেয়ো না বা মন খারাপ কোরো না। আমাদের এই ইলাগো গ্রহটাকে দশবার পাক খেয়ে মনে করো এখানেই ফিরে এলে। তখনও তো অনেকখানি পথ পার হয়ে আসছ। এখানেও সেটা হতে পারে। আজকের এই দিনটি কি তারও আগের দিনগুলো তুমি মহাবিশ্বের অন্য কোথাও গিয়ে ফিরে পেয়ে যেতে পারো। সেখানেই হয়তো দেখবে, তোমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সবাই এসে হাজির হয়েছে তোমার সামনে।

মহাকাশযাত্রার আগে তাঁর মনে জোর আনতে অধ্যাপক মিসৌ যে একটা দার্শনিকসুলভ কথার কথা বলে উৎসাহ দিচ্ছিলেন, সেটা বিজ্ঞানী ইঠামি অবশ্য বুঝতে পেরেছিলেন। তবুও এখন তিনি একটু সময় নিয়ে তাঁর সংস্কারমুক্ত জাগতিক ভাবাবেগহীন বিজ্ঞানী মনটাকে আবার ফিরিয়ে আনলেন নিজের মধ্যে। তাঁর মধ্যনেত্র আবার স্বাভাবিক গোলাপি রং ধারণ করল।

তিনি নিরিকে সঙ্গে নিয়ে গোলাকৃতি মহাকাশযান হ্যাঁকো থেকে বেরিয়ে এলেন। বাইরে এই নতুন জগতের নানারকম শব্দ শুনতে পেলেন। সেইসব শব্দ ছাপিয়ে যেন তাঁর কানে বাজতে লাগল লিটুলটু আর লিম্পাটুর কলকাকলি। তাদের মুখের সেই ছড়া–

কটা মদুমাদু
কনা মদুমাদু
টাঠপি নকে কিবা।
টাঠপি তেপে
নাসচা তেখে।
ঠপি মদুমাদু কিটা।

মহানিদ্রার জন্যে তাঁর মনে হচ্ছে, গতকালই যেন তাদের ছেড়ে এসেছেন।

অনুভূতিহীন রোবট নিরি অবশ্য নির্বিকারভাবে ইঠামিকে বলে যেতে লাগল এই নতুন গ্রহের তাপমাত্রা, বায়ুর উপাদান, মূল নক্ষত্র থেকে এটার দূরত্ব, আবর্তনের রীতি–সব কিছু। বলার সঙ্গে সঙ্গে ডেটাপ্রিন্টের কাগজও সে তার মনিবের হাতে দিয়ে যাচ্ছে। তারপর মনিবের সঙ্গে হাস্য-পরিহাসের ঢঙে বলল, অধ্যাপক মিসৌ এই গ্রহ দেখলে অবাক হয়ে তাঁর সৃষ্টিকর্তা-তত্ত্বে অনেক তথ্য যোগ করতেন। ইলাগ্‌গোতে যেটা হয় না, এখানে সেটাও হয়। কক্ষপথে এই গ্রহটাকে মিসৌয়ের মাথার মতন একটু কাত করে দিয়েছেন সেই সৃষ্টিকর্তা। তাই নক্ষত্র পরিক্রমার সঙ্গে সঙ্গে এই গ্রহে আবহাওয়ার পরিবর্তনও হয়। কিছুকাল বেশ গরম। তারপর বৃষ্টি। আবার কিছু সময় ঠান্ডা। গরম থেকে শীত, আর শীত থেকে গরমের মাঝে দু-বার না-গরম না-ঠান্ডা। এই গ্রহের একটামাত্র উপগ্রহ আছে। রাত্তিরে তাতে প্রতিফলিত মূল নক্ষত্রের আলো এই গ্রহে এসে পড়লে বড়ই স্নিগ্ধ লাগে। আর আশ্চর্যের কথা হল, এই গ্রহ থেকে মূল নক্ষত্র আর এই উপগ্রহের আকার আর দুরত্ব এমনই লাগসই করেছেন মিসৌয়ের সৃষ্টিকর্তা যে মাঝে মাঝে দুটোরই পূর্ণগ্রাস গ্রহণ হয়। তাই বলছিলাম, আপনার গুরু এসব দেখলে…।

নিরিকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন ইঠামি। ইঠামি নিজে নাস্তিক হলেও তাঁর গুরু মিসৌ অতটা নন। তিনি বলেন, সাধারণ ক্ষুদ্রচিন্তাপরায়ণ ইন্দ্ৰেচাঁদের মতো আস্তিক হওয়া, আর মূল পর্যন্ত না গিয়ে নাস্তিক হওয়া–দুটোই বিজ্ঞানবিরুদ্ধ।

যা-ই হোক, নিরিকে নিয়ে ইঠামি মহাশয় নতুন গ্রহে ভ্রমণ করতে করতে যখন নানা তথ্য আহরণ করছেন, তখন আমরা সেখান থেকে একটু দূরে এক পার্বত্য গুহায় চলে যাই। দেখি, সেখানে কী হচ্ছে।

.

পাহাড়ে গুহাটির একপাশে একটি অদ্ভুত জীব বসে পাথরের বেদিতে কাঠের টুকরোর মতন দেখতে একটা পাথর ঘষে যাচ্ছিল। দূর থেকে তাকে বানর বলে মনে হলেও সে একটি প্রাগৈতিহাসিক মানবশিশু। তার নাম আমরা জানি–পুন্নি। বাবোসরা অর্থাৎ বড়রা শিকার করতে বেরিয়ে গিয়েছে। খুব ছোটরা, যারা উংগা উংগা করে কাঁদতেই জানে– সেইসব কুন্টি মায়ের কোলে ঘুমোচ্ছে। আর পুন্নির মতন ছেলেমেয়েদের বসিয়ে দিয়েছে পাথর ঘষতে। এগুলো দিয়ে শিকার করার অস্ত্র তৈরি হবে।

পুন্নির এই কাজ ভালো লাগে না। সে সকালে একটু লুকোচুরি খেলতে চায়। দূরে দেখল, নেংরেও পাথর ঘষতে ঘষতে তার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। তার মনের ভাব পুন্নি বুঝতে পারে। তাদের চোখে চোখে কী কথা হল, সেটা তারাই জানে। তারা গুহার ভেতরে একবার দৃষ্টি ফেলেই ছুট লাগাল হাতের পাথরগুলো রেখে দিয়ে। ছুটতে ছুটতে তারা দু-জনে পাহাড়ের ওপরদিকে চলে গেল।

এর মধ্যে লুকোচুরি ছাড়াও তারা একটা নতুন খেলা আবিষ্কার করেছে। তারা দেখেছে, গোল পাথরগুলো অন্য পাথরের চেয়ে বেশি ছুটতে পারে। এগুলোকে ওপর থেকে ঠেলে দিলে ঘুরতে ঘুরতে গড়িয়ে যায় অনেক দূর। অন্য পাথরগুলো কিছুটা গিয়েই থেমে যায়। তারা বনের মধ্যে গাছ থেকে গোল গোল শক্ত ফল জোগাড় করেছে। এগুলো পাথরের মতন ভারী না, তাই গায়ে লাগলেও ভয় নেই। পুন্নিদের কাছে গোল জিনিসমাত্রই তাঁকো। তারা গাছের হ্যাঁকো নিয়ে নানারকম খেলায় মেতে উঠল। একটা হ্যাঁকো দিয়ে দূর থেকে আরেকটা হ্যাঁকোকে মারতে পুন্নির মতন কেউ পারে না।

এই পাহাড়ে কত পাথরের হ্যাঁকো আছে। কোনওটা কুন্টি অর্থাৎ ছোট। কোনওটা বাবোস অর্থাৎ বড়। কোনওটা কাঁপা বা সাদা, কোনওটা চিপা বা কালো। তবে ওগুলো গায়ে পড়লে খুব ব্যথা লাগে, সেটা পুন্নি আর নেংরে দু-জনেই জানে। তাই গাছের হ্যাঁকো দিয়েই তাদের যত খেলা।

আজকের পৃথিবীর ছেলেমেয়েরা যদি তাদের এই অবস্থায় দেখত, তারা ভাবত, দুটো বাঁদর কতবেল নিয়ে বল খেলছে। ব্যাপারটাও তা-ই। পুন্নিদের হ্যাঁকো মানে বল।

.

বল খেলতে খেলতে তারা পাহাড়ের নীচে ফাঁকা জায়গাটায় চলে আসতেই একটা অদ্ভুত জিনিস তাদের নজরে পড়ল। পুন্নিই প্রথমে দেখল। একটা প্রকাণ্ড হ্যাঁকো খোলা প্রান্তরে পড়ে আছে। তাদের গুহাটার চেয়েও বড়। সূর্যের আলো লেগে সেটা ঝলমল করছে। নদীর জল যেমন ঝলমল করে, তার চেয়েও কত সুন্দর।

পুন্নি চেঁচিয়ে উঠল, বাবোস হ্যাঁকো হুক! বাবোস হ্যাঁকো হুক!

নেংরের হাতে টিপ না থাকলে কী হবে, নাচে সে পুন্নির চেয়ে ওস্তাদ। সে-ও নাচতে নাচতে চিৎকার জুড়ল, বাবোস হ্যাঁকো হু!

যেভাবে লেখা হল, তাদের উচ্চারণ অবশ্য অত স্পষ্ট ছিল না। গলার স্বরও যেন গোরু আর ঘোড়ার ডাকের সম্মিলিত আওয়াজ। তবুও তাঁকো শব্দটা হয়তো পরিষ্কার শোনা গেল নিরির যান্ত্রিক কানে। তারা কাছে আসতেই নিরির অটোমোড ক্ষেপণাস্ত্রের আলো জ্বলে উঠল। অন্য গ্রহের জীব কি তাদের মহাকাশযান হ্যাঁকোকে আক্রমণ করার মতলব করছে?

যন্ত্র-রোবট যেটা না বুঝতে পারল, বুদ্ধিমান ইন্দ্ৰেচা বিজ্ঞানী ইঠামি সেটা স্বাভাবিক অনুভূতিতেই বুঝতে পারলেন। তিনি নিরিকে অস্ত্র সংবরণ করতে বললেন। তাঁর দৃষ্টিতে ধরা পড়ল আনন্দে মত্ত ক্রীড়ারত দুটি শিশু। হোক-না সে অন্য গ্রহের বুদ্ধিহীন জীব– ইন্দ্ৰেচা শিশুর মতন যাদের মস্তিষ্ক অত উন্নত নয়। তবু শিশু শিশুই।

পুন্নি আর নেংরেও এর মধ্যে দেখে ফেলেছে ইঠামি আর নিরিকে। এরকম অদ্ভুতাকৃতি জীব তারা এর আগে দেখেনি। একজনের রং কাঁপা। অন্যজন চিপা। আর কী ঘেন্না! তাদের গায়ে একটুও লোম নেই!

তারা ভয়ে পালাতেই যাচ্ছিল। কিন্তু ইঠামির নির্দেশে নিরি এমন সুন্দর বাজনা বাজাতে লাগল যে, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তারা দাঁড়িয়ে পড়ল। তারা এর আগে কোনও সংগীত শোনেনি।

ইঠামি আস্তে আস্তে তাদের কাছে এলেন। কোমল চারটি হাত দিয়ে দুজনকে কাছে টেনে নিলেন। এই দুই অজানা জীবশিশুর অদ্ভুত সাদা-কালো চোখের সরল দৃষ্টির মধ্যে লক্ষ লক্ষ ইবারু দূরের আরেক গ্রহের দুটি শিশুর গোলাপি চোখের চাহনির মিল খুঁজে পেলেন। প্রস্তর যুগের মানবশিশুদ্বয় তাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি দিয়ে বুঝতে পারল, এই দুটি চতুর্ভুজ জীব তাদের কোনও ক্ষতি করবে না। পুন্নি হাত তুলে মহাকাশযানটিকে দেখাল। ইঠামি তাদের দুজনকে হ্যাঁকোর কাছে নিয়ে এলেন। রোবট নিরি এই ফাঁকে পুন্নি আর নেংরের মাথা স্পর্শ করে নির্বিকারভাবে বলে চলেছে, এরাই হল আপাতত এই গ্রহের সবচাইতে বুদ্ধিমান প্রাণী। এখন এরা আগুনের ব্যবহার পর্যন্ত জানে না। ধাতুরও না। তবে মস্তিষ্কের অন্তর-রশ্মি বিশ্লেষণ করে দেখে মনে হচ্ছে কয়েক হাজার টোটির (ইলাগ্‌গো গ্রহের বছর) মধ্যে এরাও ইন্দ্রেচার মতন…

নিরির কথা ইঠামির কানে গেল না। তিনি তখন চার হাতে তালি বাজিয়ে লিম্পাটু লিটুলটুদের সেই ছড়াটা পুন্নি আর নেংরেকে শোনাতে লাগলেন, কটা মদুমাদু… কনা মদুমাদু…

পুন্নি আর নেংরেও নাচতে নাচতে অস্ফুট কর্কশ গলায় বলতে লাগল, খৰু মাঁউ মাঁউ..ঘং মাঁউ মাঁউ..

হঠাৎ দূরে একটা হল্লা শোনা গেল। পুন্নিরা বুঝতে পারল, বাবোসরা শিকার বা মারামারি করে ফিরছে। এখন যদি তাদের গুহাতে না দেখে, তবে আস্ত রাখবে না। তারা ছুটে চলল তাদের গুহার দিকে। তারা গিয়ে বন্ধুদের জানাবে বাবোস হ্যাঁকোর কথা, কাঁপা আর চিপা জীব দুটোর কথা। ছুটতে ছুটতে তারা আওয়াজ করতে লাগল, খক্ক মাঁউ মাঁউ, ঘং মাঁউ মাঁউ…

তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ইঠামির তৃতীয় নয়ন আবার নীল হয়ে উঠল।

নিরির মাঝের চোখের গোলাপি রঙের অবশ্য কোনও পরিবর্তন হয় না। সে প্রাগৈতিহাসিক মানুষ সম্বন্ধে ডেটাপ্রিন্টটা ইঠামির হাতে গুঁজে দিল। তারপর পরবর্তী আদেশের প্রতীক্ষা করতে লাগল।

ইঠামি বললেন, এই গ্রহের যেদিকে এখন নক্ষত্রালোক পড়ছে না, অর্থাৎ রাত্রি, সেখানে নিয়ে চলো। তবে হ্যাঁকোকে কিছুক্ষণ ওই পাহাড়ের ওপরে স্থির করে রাখে। আমি কিছুক্ষণ ওই জীবগুলোকে একটু টেলিস্কোপিক পেরিভিশনে দেখতে চাই।

পুন্নি আর নেংরে তাদের অভিজ্ঞতার কথা বন্ধুদের বলার আগেই ভোলগা নদীর ধারের প্রাগৈতিহাসিক মানুষের দল অবাক বিস্ময়ে দেখল, তাদের পাহাড়ের মাথার ওপরে দিনের বেলাতেই পূর্ণচাঁদ জ্বলজ্বল করছে। কিছুক্ষণ পরে সেটা দ্রুত সরে গেল পশ্চিমে পাহাড়ের ওপারে। মানুষের প্রথম-দেখা সেই উড়ন্ত পিরিচের কথা ভুলে তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই মেতে উঠল সদ্য আহরিত মৃত ভালুক ভোজন উৎসবে। শুধু পুন্নি আর নেংরে কোনও দিন ভুলতে পারল না সেই বাবোস হ্যাঁকোর কথা, লোমহীন চতুর্ভুজ জীব দুটির কথা আর সেই অদ্ভুত শব্দের কথা–যা শুনলে আর সেখান থেকে যেতে ইচ্ছে করে না। তারা পাথরে পাথরে ঠুকে গলা দিয়ে নানারকম আওয়াজ করার চেষ্টা করত। বাবোসরা বিরক্ত হলেও কুন্টিরা তা-ই শুনে হাসত। বড় হয়ে তারাও ওরকম করত। গুহার প্রাগৈতিহাসিক মানুষদের মধ্যে সংগীতের বীজ বপন করে গেল এক অজানা আগন্তুক সেটা অবশ্য পুন্নি আর নেংরের মৃত্যুর পরে কারও জানা থাকল না।

[শুকতারা, শারদীয়া ১৩৯৭]