চন্দ্রাহত সাত্যকি সোম

চন্দ্রাহত সাত্যকি সোম

আজ সেই প্রতীক্ষিত বৈশাখী অমাবস্যা তিথি। আজই রাত্রে কলকাতার বুকে ছড়িয়ে পড়বে সেই আলো–বিজ্ঞানীরা যার নাম দিয়েছেন কৃত্রিম জ্যোৎস্না।

সন্ধ্যার একটু আগেই বিষণ্ণ মন নিয়ে বৈঠকখানা ঘরের সোফায় এসে বসলেন বিজ্ঞানী সাত্যকি সোম। কয়েক বছর আগে আরেকবার এরকম ভারাক্রান্ত মনে এইভাবেই দু হাতের তালুতে মুখ ঢেকে এখানে বসেছিলেন। যেবার শয়তান বিজ্ঞানী রিউবেন বুশ টাইটেনিয়াস গ্রহ থেকে পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেন। কিন্তু সে দিন তাঁর বিষাদের অংশীদার ছিলেন পৃথিবীর সমস্ত বিজ্ঞানী। তাঁর পরিকল্পনায় সম্পূর্ণ আস্থা রেখে নির্ভর করেছিলেন তাঁরা। অবশেষে সাফল্যের বরমাল্য হিসাবে তাঁকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দিয়েও সমগ্র বিশ্বের সে দিন মনে হয়েছিল, আগামী এক শতাব্দীর সব কটি নোবেল পুরস্কার সাত্যকি সোমকে উৎসর্গ করলে তবেই হয়তো তাঁর অবদানের কিছুটা স্বীকৃতি দেওয়া হত।

সমস্ত পৃথিবী যাঁকে সে দিন জীবনদাতা দেবতা বলে মনে করেছিল, আজ সেই ডক্টর সোমই নিজের ঘরে নিঃসঙ্গ, বিষণ্ণ। কয়েকটি বছরেই সব উচ্ছ্বস, কৃতজ্ঞতাভরা কথার মালা শুকিয়ে ঝরে গেল রে, নরোত্তম!–ডক্টর নোম তাঁর একমাত্র সঙ্গী রোবট নরোত্তমকে উদ্দেশ্য করে বললেন। এই মুহূর্তে তাঁর বাসস্থান থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে ভাস্কর ভবনে জড়ো হয়েছেন দেশ-বিদেশের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানী–টেলি-কনট্রোলের মারফত কৃত্রিম জ্যোৎস্নার উদবোধন অনুষ্ঠানে।

বিশদভাবে না বললে পাঠকদের কাছে প্রসঙ্গটা হয়তো বোধগম্য হচ্ছে না। তাই বিষয়টা প্রথম থেকেই বলি।

আজ থেকে দু-বছর আগে দিল্লিতে এক সম্মেলনে ভারতীয় বিজ্ঞানী ডক্টর রমেশ বেরি এক প্রস্তাব ও পরিকল্পনা দেন। সেটা হল সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে রাত্রে ভারতের চার মহানগরীর রাস্তাঘাট আলোকিত করা। তিনি বললেন, চার মহানগরীর ঠিক ওপরে চারটি কৃত্রিম উপগ্রহ থাকবে। বার্তা সঞ্চারের উপগ্রহের মতো ওগুলোও পৃথিবীর সঙ্গে একই কৌণিক গতিতে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে পৃথিবীকে আবর্তন করবে–যাতে করে আপাতদৃষ্টিতে তাদের সবসময়ই আকাশের একই জায়গায় থাকতে দেখা যাবে। এই উপগ্রহগুলিতে শক্তিশালী আলো-প্রতিফলক থাকবে। যেটাকে টেলি-কনট্রোল দিয়ে পৃথিবী থেকেই চালু অথবা বন্ধ করা যায়। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ থাকুক কি না থাকুক–সন্ধ্যার পরেই ভাস্কর ভবনের মতো কেন্দ্র থেকে বোতাম টিপে প্রতিফলিত সূর্যালোকের কৃত্রিম জ্যোৎস্না শহরে ছড়িয়ে দিলে রাস্তায় আর বৈদ্যুতিক আলো জ্বালানোর দরকার হবে না। ময়দানে, গঙ্গার বুকে সেই উজ্জ্বল জ্যোৎস্নার প্লাবন বয়ে যাবে।

দেশের যত বিজ্ঞানী ডক্টর বেরির এই প্রস্তাবে সাধুবাদ দিলেন। একবাক্যে সমর্থন করলেন। একমাত্র সাত্যকি সোমই সে দিন আপত্তি তুলেছিলেন। সকলে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও তিনি বেঁকে বসেছিলেন। তাঁর আপত্তির কারণ শুনে সবাই অবাক হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, তিনি কি বার্ধক্যভারে দুর্বল আর আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন? নইলে–তাঁর আপত্তির ভাষা ঠিক বিজ্ঞানীসুলভ তো নয়। কবিরা অবশ্য এরকম ভাব-মাখা ভাষায় বলে থাকে–দাও ফিরে সে অরণ্য ইত্যাদি ইত্যাদি।

ডক্টর সোম যা বলেছিলেন, তার সারমর্ম হল–পূর্ণিমার যেমন প্রয়োজন আছে, অমাবস্যারও সেরকম প্রয়োজন আছে মানুষের জীবনে। আলোর রূপের মতন আঁধারের রূপ আছে। আলো যদি হয় গতি, আঁধার বিরতি। যে অজ্ঞেয় প্রকৃতিদেবী পৃথিবীটাকে হেলিয়ে দিয়ে ঋতু পরিবর্তন করাচ্ছেন, তিনিই তাকে পাক খাইয়ে দিন আর রাত্রি ঘটাচ্ছেন। এই বৈচিত্র্যকে কৃত্রিমভাবে নষ্ট করে মিডাসের রাজার মতন সব কিছুকে সোনা করতে চাইলে একঘেয়েমির অভিশাপ মানুষের মনকে বিপর্যস্ত করে তুলবে। তাই শহরজীবনের আলো-আঁধারের এটুকু বৈচিত্র্য অন্তত আপনারা ধ্বংস করবেন না। রাত্রে রাস্তার আলো থাকুক, আপত্তি নেই কিন্তু তার বাইরেও থাকুক বিদিশার নিশার সেই তিমির, যেখানে দু-দণ্ড শান্তির বিশ্রাম নিতে পারে ক্লান্ত মানুষ। অন্তত কিছুক্ষণের জন্যও বলতে পারে–আমার আঁধার ভালো।

সাত্যকি সোমের ভাষণ শুনে অন্য সব বিজ্ঞানী অবাক হয়েছিলেন। কেউ কেউ আড়ালে হয়তো হেসেওছিলেন। বলেছেন, ডক্টর সোম কি বিজ্ঞান ছেড়ে দিয়ে কবিতা লিখছেন? রমেশ বেরি তো বাঙালি বিজ্ঞানী ডক্টর দোলা চক্রবর্তীকে বলেই বসলেন, আপনাদের বাঙ্গালীদের ওই এক গলত আছে ডক্টর চক্রবর্তী। বিজ্ঞানী হোবেন, খিলাড়ি হোবেন, বিজিনেসম্যান হোবেন–লেকিন কবি ভি হোবেন।

ডক্টর সোমের আপত্তিকে নিছক সাময়িক আবেগপ্রবণতা ধরে নিয়ে তাঁকে কোনও মূল্য না দিয়ে যখন সত্যিই কৃত্রিম জ্যোৎস্না প্রকল্প অনুমোদন পেল, সে দিন সাত্যকি সোম বিরাট আঘাত পেলেন মনে। তাঁর আপত্তি কেন গ্রাহ্য হল না, তার কারণটা পর্যন্ত তাঁকে জানানোর সৌজন্য দেখালেন না এএমপিসি বা কৃত্রিম জ্যোৎস্না প্রকল্প পরিষদের কর্তাব্যক্তিরা। তিনি কি তবে তাঁদের কাছে এতই মূল্যহীন হয়ে গেলেন যে, তাঁর বক্তব্যকে অকিঞ্চিৎকর প্রলাপ বলে মনে করা হল?

তাই যখন ডক্টর বেরি তাঁকে টেলিফোনে ডেকে প্রস্তাব করলেন যে, বিজ্ঞানীকুলতিলক সাত্যকি সোমের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ প্রথম কৃত্রিম জ্যোৎস্না কলকাতার আকাশেই ছাড়া হবে, আর তার উদ্বোধন ডক্টর সোমই করবেন–তখন ডক্টর সোম নিজেকে ঠিক রাখতে পারেননি। তাঁকে এর রাগে ফেটে পড়তে কেউ কখনও দেখেনি। তিনি কাঁপতে কাঁপতে বলেছিলেন, আমি তো যাবই না, বরং সে দিন প্রতিবাদস্বরূপ আমার বাড়ি অন্ধকার করে রাখব।

টেলিফোন রেখে দেওয়ার আগেই তিনি শুনতে পেয়েছিলেন ক্ষীণস্বরে একটু মৃদু হাসির আওয়াজ আর তারপরেই একটা শব্দ–পাগল! ডক্টর বেরি নিজের মনেই বললেন, অথবা হয়তো পাশে অন্য কেউ ছিল।

রিসিভার রেখে দিয়ে সশব্দে হেসে উঠলেন ডক্টর সোম। দণ্ডায়মান রোবট নরোত্তমকে চালু করাই ছিল। তিনি বললেন, জানিস নরোত্তম, সে দিনের দেবতা সাত্যকি সোম আজ পাগল। কারণ ওদের মতে মত মেলাইনি।

নরোত্তম রোবট ডক্টর সোমের অবসরের সঙ্গী। সমবয়সির মতো তাঁর সঙ্গে ঠাট্টা ইয়ারকিও করে।

সে কিছু না জেনেই সাত্যকি সোমকে খুশি করার জন্য বলে উঠল, তাতে কী হয়েছে? গ্যালিলিও, কোপার্নিকাস সবারই তো হেনস্থা হয়েছে। তবুও একসময় পৃথিবী জানবে–ওই একজনেরই মাথা ঠিক ছিল, অন্য সকলেই পাগল বা মূর্খ।

নরোত্তমের সঙ্গে এই কথোপকথনের মাঝখানে ঘরে প্রবেশ করল গৌতম ব্ৰহ্ম। এই সংস্কারাচ্ছন্ন প্রাচীনপন্থী তর্কবাগীশ তরুণটিকে ডক্টর নোম স্নেহ করেন–যদিও তার পৌরাণিক ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়ার সময় তিনি কপালে হাত দেওয়ার ভান করে বুড়ো আঙুল দুটো দিয়ে নিজের দু-কান বন্ধ করে রাখেন।

গৌতম ঘরে ঢুকেই বলে উঠল, কী ব্যাপার! দরজায় রোবট দারোয়ান দ্বারিকনাথ দেখি দিনের বেলাতেই জেগে আছে। আমাকে দেখে বলল, তার স্পেশ্যাল ডিউটি পড়েছে দিনে, কারণ আপনি দিনের বেলাতেই নিশিপালন করছেন। আলো না জ্বালান, কিন্তু জানলাটা খুলে দিন। দেখবেন, একটু পরেই কেমন আলোতে ভরে যাবে চারদিক। একটু পরেই কৃজ্যোতের উদবোধন হবে। টেলিভিশনে দেখাবে।

ডক্টর নোম অবাক হয়ে বললেন, ক্রিয়োজোট!

গৌতম হেসে বলল, ক্রিয়োজোট নয়, কৃজ্যোৎ। কৃত্রিম জ্যোৎস্নার সংক্ষিপ্ত রূপ। বলেই ঘরের কোণে রাখা টেলিভিশন চালিয়ে দিল।

কেন আর তুমি কাটা ঘায়ে নরোত্তম তার মন্তব্য শুরু করতেই তাড়াতাড়ি সুইচ অফ করে ডক্টর সোম তাকে মৃত করে দিলেন। ঠোঁটকাটা রোবট নরোত্তম রেখেঢেকে কথা বলে না। ওর জন্যে ডক্টর সোমকে অন্যের কাছে অনেকবার অপদস্থ হতে হয়েছে। সে কথা যারা নরোত্তমের কীর্তিকলাপের সঙ্গে পরিচিত, তারা সবাই জানে। তবু গৌতম আজ একটু অবাক হল।

টেলিভিশনে ভেসে উঠল ভাস্কর ভবনের ভেতরের দৃশ্য। পাশাপাশি বসে আছেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীগণ, তাবড় তাবড় ব্যক্তি আর মন্ত্রী। মাঝে মাঝে ক্লোজ-আপে দেখা যাচ্ছে রমেশ বেরির বিরাট মুখ–তাঁর গোঁফের আড়ালে হাসি। টিভি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে তিনি যেন সাত্যকি সোমের উদ্দেশে একটা ব্যঙ্গের হাসি পাঠিয়ে দিলেন–ডক্টর সোমের হঠাৎ এ কথা মনে হল। একটা নাচের অনুষ্ঠান হচ্ছে। নেপথ্যে রবীন্দ্রসংগীত—’আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে…’

একটু পরেই নাচ-গান শেষ হল। রমেশ বেরি উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে স্বাগত জানালেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, আজ এই অনুষ্ঠানে যাঁর অনুপস্থিতি আমরা অন্তরে অনুভব করছি, তিনি সর্বজনশ্রদ্ধেয় মহাবিজ্ঞানী ডক্টর সাত্যকি সোম। আমাকে টেলিফোনে তিনি জানিয়েছেন যে, প্রবল ইচ্ছা সত্ত্বেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি আজ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারলেন না।..।

হঠাৎ একটা প্রচণ্ড হুংকারে চমকে উঠল গৌতম। দেখল, সাত্যকি সোম রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়েছেন। মুখ-চোখ লাল হয়ে উঠেছে তাঁর। টেবিলে ঘুসি মেরে বললেন, মিথ্যেবাদী শয়তান! আমাকে অপমান! এর প্রতিশোধ আমি নেব।

শান্ত ধীর জ্ঞানবৃদ্ধের এই দুর্বাসারূপ গৌতম আগে কখনও দেখেনি। সে টিভি বন্ধ করে বাক্যহারা হয়ে ডক্টর সোমের দিকে তাকিয়ে থাকল। তার সেই বিস্মিত চাহনির দিকে দৃষ্টি পড়তে নিজেকে সামলে নিলেন সাত্যকি সোম। তারপরে দু-হাতে মাথা ধরে মুখ নিচু করে সোফায় বসে পড়লেন।

এইভাবে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর পকেট থেকে একটা ছোট কৌটো বার করে তার থেকে সাদা বড়ি নিয়ে জল দিয়ে খেয়ে নিলেন। নির্বাক হয়ে বসে-থাকা গৌতমকে দেখে বোধহয় একটু লজ্জিতই হলেন। একটু চুপ করে থেকে তারপর বললেন, তোমাকে একটা গল্প বলব, গৌতম। গল্পের পরে একটা প্রশ্ন করব। যদি সঠিক উত্তর দিতে পারো, তবে যে বইটা আমি লিখছি, সেটা আমি উৎসর্গ করব কুসংস্কারী অবিজ্ঞানী গৌতম ব্ৰহ্মকে। আর যদি ভুল উত্তর দাও, তবে আমার বাড়ির দরজা তোমার কাছে চিরকালের জন্য বন্ধ থাকবে।

গৌতম হেসে বলল, নিজেকে বিক্রমাদিত্যর চাইতেও নার্ভাস লাগছে। তবুও বলুন।

সাত্যকি সোম বললেন, শোনো তবে। এক যে ছিলেন রাজা। তোমার ওই বিক্রমাদিত্যর মতনই বুদ্ধিমান, জ্ঞানবান, দয়ালু, ন্যায়নিষ্ঠ আর সুশাসক। তাঁর সুশাসনে রাজ্যের সমস্ত প্রজার গৃহ সুখের নীড়। সুখ, স্বাস্থ্য, শান্তি আর সমৃদ্ধিতে দিন দিনই ভরে উঠতে লাগল রাজ্য। প্রজারা রাজার গুণগানে পঞ্চমুখ।

রাজা-প্রজার এই সুখসমৃদ্ধি সহ্য হল না বুঝি অদৃষ্টদেবীর। সেই রাজ্যের মধ্যে একটি কুয়ো ছিল। প্রজারা তার জল পান করত। হঠাৎ কীভাবে সেই জল পরিণত হল বিষাক্ত কারণবারিতে। যে খাবে, সে মরবে না বটে, তবে সে পরিণত হবে বিকৃতমস্তিষ্ক উন্মাদে। কিন্তু সে জল হল আরও সুস্বাদু, মিঠে আর শীতল। দলে দলে প্রজারা মহানন্দে সে জল পান করতে লাগল। সবাইকে ডেকে বলল, জলের স্বাদগুণের কথা–যা খেলে সব রোগ সেরে যাবে। এইভাবে অল্পকালের মধ্যেই রাজ্যের সমস্ত লোক পাগল হয়ে গেল। প্রকৃতিস্থ থাকলেন একা রাজা নিজে। রাজ্যের লোকের পাগল হওয়ার কারণ তিনি বুঝতে পারলেন। সেই কুয়োর জলপান নিষেধ করে আদেশ জারি করলেন। কিন্তু খুব দেরি হয়ে গিয়েছে তখন। কেউ রাজি হল না অদ্ভুত এই আদেশ রাজ্যে ঢাঁড়া পেটাতে। রাজা নিজে গিয়ে পাথরের চাঁই দিয়ে ঢেকে দিলেন কুয়োর মুখ। সবাই ক্ষিপ্ত হয়ে রাজাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে সরিয়ে দিল পাথরের ঢাকা। বলতে লাগল, আমাদের রাজা পাগল হয়ে গিয়েছে রে! আয়, ওটাকে মেরে ফেলে আমরা সবাই মিলে এই কুয়োটাকে রাজা করি।

রাজা সেখান থেকে পালিয়ে এসে প্রাণে বাঁচলেন। তারপর ঘরে এসে জানলা-দরজা বন্ধ করে দু-হাতে মাথা চেপে ধরে ভাবেন–এ কী হল! আমার সোনার রাজ্য কার কারসাজিতে এভাবে রসাতলে গেল! কী করবেন তিনি এখন? রাজ্য ছেড়ে পালাবেন? দুঃখে-হতাশায় ক্ষণেকের জন্যে ভাবেন, নিজের বুকেই বসিয়ে দেবেন তাঁর তরবারি। পরক্ষণেই চিন্তা করেন, এ তো আত্মহত্যা! পলায়ন আর আত্মহত্যা দুটোই তাঁর কাছে সমান পাপ।

সারারাত জেগে তিনি ভাবলেন আর ভাবলেন। ভোরের আলো ফুটতেই মনস্থির করে ফেললেন তিনি। সকলের ঘুম ভাঙার আগেই তিনি চুপিচুপি প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন সেই কুয়োর উদ্দেশে। কুয়োর কাছেই দড়ি-বালতি ছিল। দড়ি নামিয়ে তিনি এক বালতি জল তুললেন। তারপর সেই বালতিতে মুখ লাগিয়েই ঢকঢক করে পান করে যেতে লাগলেন সেই জল–যতক্ষণ না উদরপূর্তি হয়ে গেল বিষাক্ত মাদকবারিতে।

সকালে প্রজারা উঠে দেখল, রাজার পাগলামি একদম সেরে গিয়েছে। তারা দু-হাত তুলে নাচতে নাচতে বলল–আমাদের রাজাটা ভালো হয়ে গিয়েছে রে! দেখল, রাজাও তাদের মতো উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করছেন আর অবিরাম বকে চলেছেন মূল্যবান আবোল তাবোল বক্তৃতা।

ডক্টর সোম তাঁর গল্প শেষ করে বললেন, এবার বলো তো, রাজা কুয়োর জল খেয়ে প্রজাদের সঙ্গে এক হয়ে গিয়ে ঠিক কাজ করেছিলেন? নাকি করেননি?

গৌতম সজোরে বলল, মোটেই করেননি। রাজা বিক্রমাদিত্য হলে ওই কুয়োর জলের বদলে সত্যিকার বিষপান করাও শ্রেয় বলে মনে করতেন।

সাত্যকি সোম থেকে লাফিয়ে উঠে গৌতমকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, আমার মনের জোর তুমি অনেক বাড়িয়ে দিলে, গৌতম। আমি বিজ্ঞানী আর তুমি অবিজ্ঞানী সংস্কারাচ্ছন্ন। তাই মাঝে মাঝে কর্মক্লান্ত হয়ে তোমার ওইসব আজগুবি ধারণার কথা শোনার মধ্যেও আমি বিনোদন পাই। কিন্তু আজ তোমার কাছে শুনতে পেলাম সত্যের ধ্বনি। ওইসব বিজ্ঞানী মিলে চাঁদকে তার সৌন্দর্যের সাম্রাজ্য থেকে নির্বাসিত করছে। যে চাঁদ মায়ের কোলে বাঙালি শিশুদের কপালে টিপ দিয়ে যেত। যে চাঁদের চলার ছন্দে হিন্দু মুসলমান-বৌদ্ধদের উৎসব-অনুষ্ঠান আজও নিয়ন্ত্রিত হয়, সেই চাঁদের আলোকে বিদায় দিচ্ছে আজকের কৃত্রিম জ্যোৎস্না। তাই আমার কাছে এটা শোক দিবস। গৌতম, কাকজ্যোৎস্না কাকে বলে জানো? নির্মেঘ আকাশে গভীর রাতে যখন পৃর্ণিমার চাঁদ ওঠে, সেই জ্যোৎস্নার প্লাবনে মাঠঘাট ভরে যায়। গাছে গাছে কাকেরা জেগে উঠে ডাকতে শুরু করে। ভাবে, ভোর হয়েছে বুঝি। এই কৃত্রিম জ্যোৎস্নায় কাকরা আর আনন্দে চঞ্চল হয়ে উঠবে না। তাদের রাত্রের » বিশ্রাম আর জাগরণের আনন্দের মধ্যে আক্রমণ হানবে এই কৃত্রিম জ্যোৎস্না।

একটু থেমে সাত্যকি সোম আবার বললেন, রমেশ বেরির মতন অনেক বিজ্ঞানীই হয়তো ভাবছেন, সাত্যকি সোমের মাথার গোলমাল দেখা দিয়েছে। যাকে বলে চন্দ্রাহত অবস্থা, তা-ই। যে কথাই জানুন তাঁরা, এবার আমি কিছু দিন বিশ্রাম চাই। শুধু তোমাকেই বলছি গৌতম, আমি বেশ কিছু দিনের জন্যে আত্মগোপন করতে চাই এমন জায়গায় গিয়ে, যেখানে কেউ আমার পরিচয় জানবে না। সেখানে বেশি লোকজন থাকবে না। থাকবে প্রকৃতির শ্যামল সজল রূপ। এই বর্ষাকালেই যাব। তার আগে দুটো জিনিস তোমাকে এনে দিতে হবে গৌতম।

গৌতম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চাইতে ডক্টর সোম বললেন, দাশু রায় কে, গৌতম? পাঁচালি নামে কোনও বই লিখেছিলেন এই দাশু রায়। সাহিত্য পরিষদ থেকে আমার নাম করে সেই পাঁচালি বইয়ের একটা ফোটোকপি আনিয়ে দাও। আর কিছু তামাকও কিনে আনো কোনও দোকান থেকে।

গৌতম অবাক হয়ে বলল,  কিন্তু আপনি তো ধূমপান করেন না। চিরদিনই এর বিরুদ্ধে।

ডক্টর সোম মৃদু হেসে বললেন, তা হোক। একবারই খাব। তবে সেটা দা-কাটা তামাক হওয়া চাই। অবাক হচ্ছ? আমার ভাইপোর আলমারি থেকে একটা পুরোনো বাংলা বই বের করে পড়ছিলাম আজ। মন ভালো না থাকলে আমি বিজ্ঞান ছাড়া অন্য বই মাঝে মাঝে পড়ি। এই বইটা পড়তে পড়তে আমি যেন কোথায় ভেসে গেলাম। যেখানে শক্তি, ভর, গতি–সব যেন বুকের অণু-পরমাণুতে ধাক্কা দিতে লাগল। পড়ছিলাম–রাত্রে নদীতে যাওয়া, ছোট্ট হাঁড়িতে মাছের ঝোল-ভাত রাঁধিয়া খাওয়া, হয়তো মাঝে মাঝে তাদের সেই মহাভারতখানা কি বাবার সেই দাশু রায়ের পাঁচালিখানা মাটির প্রদীপের সামনে খুলিয়া বসিয়া বসিয়া পড়া! বাহিরে অন্ধকারে বর্ষারাতে টিপটিপ বৃষ্টি পড়িতেছে, কেহ কোথাও নাই, পিছনের ডোবায় ব্যাং ডাকিতেছে–কী সুন্দর।

সাত্যকি সোম আনন্দে হেসে উঠে বললেন, আমিও যেতে চাই সেখানে, যেখানে ওরকম ব্যাং-ডাকা বর্ষা আছে। সঙ্গে থাকবে ওই পাঁচালি আর তামাক। অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে না থেকে খুলে দাও জানলাটা। ভয় নেই, আমাকে হাসতে দেখে মনে কোরো না যে, সেই পাগল রাজার দলে যোগ দিয়েছি। সাত্যকি সোম বিক্রমাদিত্যই আছে–থাকবে।

গৌতম উঠে জানলা খুলে দিতেই ঘরের মধ্যে আছড়ে পড়ল ঝলমলে কৃত্রিম জ্যোৎস্নার আলো। সেই আলোর আঘাতে যেন আহত হয়ে বৃদ্ধ বিজ্ঞানী অস্ফুট আর্তনাদ করে গৌতমের বাহুমূল চেপে ধরলেন।

[শুকতারা, শারদীয়া ১৩৯৮]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চন্দ্রাহত সাত্যকি সোম
গল্প - রেবন্ত গোস্বামী
ছড়া - রেবন্ত গোস্বামী
সাক্ষাৎকার

চন্দ্রাহত সাত্যকি সোম

চন্দ্রাহত সাত্যকি সোম

আজ সেই প্রতীক্ষিত বৈশাখী অমাবস্যা তিথি। আজই রাত্রে কলকাতার বুকে ছড়িয়ে পড়বে সেই আলো–বিজ্ঞানীরা যার নাম দিয়েছেন কৃত্রিম জ্যোৎস্না।

সন্ধ্যার একটু আগেই বিষণ্ণ মন নিয়ে বৈঠকখানা ঘরের সোফায় এসে বসলেন বিজ্ঞানী সাত্যকি সোম। কয়েক বছর আগে আরেকবার এরকম ভারাক্রান্ত মনে এইভাবেই দু হাতের তালুতে মুখ ঢেকে এখানে বসেছিলেন। যেবার শয়তান বিজ্ঞানী রিউবেন বুশ টাইটেনিয়াস গ্রহ থেকে পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেন। কিন্তু সে দিন তাঁর বিষাদের অংশীদার ছিলেন পৃথিবীর সমস্ত বিজ্ঞানী। তাঁর পরিকল্পনায় সম্পূর্ণ আস্থা রেখে নির্ভর করেছিলেন তাঁরা। অবশেষে সাফল্যের বরমাল্য হিসাবে তাঁকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দিয়েও সমগ্র বিশ্বের সে দিন মনে হয়েছিল, আগামী এক শতাব্দীর সব কটি নোবেল পুরস্কার সাত্যকি সোমকে উৎসর্গ করলে তবেই হয়তো তাঁর অবদানের কিছুটা স্বীকৃতি দেওয়া হত।

সমস্ত পৃথিবী যাঁকে সে দিন জীবনদাতা দেবতা বলে মনে করেছিল, আজ সেই ডক্টর সোমই নিজের ঘরে নিঃসঙ্গ, বিষণ্ণ। কয়েকটি বছরেই সব উচ্ছ্বস, কৃতজ্ঞতাভরা কথার মালা শুকিয়ে ঝরে গেল রে, নরোত্তম!–ডক্টর নোম তাঁর একমাত্র সঙ্গী রোবট নরোত্তমকে উদ্দেশ্য করে বললেন। এই মুহূর্তে তাঁর বাসস্থান থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে ভাস্কর ভবনে জড়ো হয়েছেন দেশ-বিদেশের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানী–টেলি-কনট্রোলের মারফত কৃত্রিম জ্যোৎস্নার উদবোধন অনুষ্ঠানে।

বিশদভাবে না বললে পাঠকদের কাছে প্রসঙ্গটা হয়তো বোধগম্য হচ্ছে না। তাই বিষয়টা প্রথম থেকেই বলি।

আজ থেকে দু-বছর আগে দিল্লিতে এক সম্মেলনে ভারতীয় বিজ্ঞানী ডক্টর রমেশ বেরি এক প্রস্তাব ও পরিকল্পনা দেন। সেটা হল সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে রাত্রে ভারতের চার মহানগরীর রাস্তাঘাট আলোকিত করা। তিনি বললেন, চার মহানগরীর ঠিক ওপরে চারটি কৃত্রিম উপগ্রহ থাকবে। বার্তা সঞ্চারের উপগ্রহের মতো ওগুলোও পৃথিবীর সঙ্গে একই কৌণিক গতিতে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে পৃথিবীকে আবর্তন করবে–যাতে করে আপাতদৃষ্টিতে তাদের সবসময়ই আকাশের একই জায়গায় থাকতে দেখা যাবে। এই উপগ্রহগুলিতে শক্তিশালী আলো-প্রতিফলক থাকবে। যেটাকে টেলি-কনট্রোল দিয়ে পৃথিবী থেকেই চালু অথবা বন্ধ করা যায়। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ থাকুক কি না থাকুক–সন্ধ্যার পরেই ভাস্কর ভবনের মতো কেন্দ্র থেকে বোতাম টিপে প্রতিফলিত সূর্যালোকের কৃত্রিম জ্যোৎস্না শহরে ছড়িয়ে দিলে রাস্তায় আর বৈদ্যুতিক আলো জ্বালানোর দরকার হবে না। ময়দানে, গঙ্গার বুকে সেই উজ্জ্বল জ্যোৎস্নার প্লাবন বয়ে যাবে।

দেশের যত বিজ্ঞানী ডক্টর বেরির এই প্রস্তাবে সাধুবাদ দিলেন। একবাক্যে সমর্থন করলেন। একমাত্র সাত্যকি সোমই সে দিন আপত্তি তুলেছিলেন। সকলে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও তিনি বেঁকে বসেছিলেন। তাঁর আপত্তির কারণ শুনে সবাই অবাক হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, তিনি কি বার্ধক্যভারে দুর্বল আর আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন? নইলে–তাঁর আপত্তির ভাষা ঠিক বিজ্ঞানীসুলভ তো নয়। কবিরা অবশ্য এরকম ভাব-মাখা ভাষায় বলে থাকে–দাও ফিরে সে অরণ্য ইত্যাদি ইত্যাদি।

ডক্টর সোম যা বলেছিলেন, তার সারমর্ম হল–পূর্ণিমার যেমন প্রয়োজন আছে, অমাবস্যারও সেরকম প্রয়োজন আছে মানুষের জীবনে। আলোর রূপের মতন আঁধারের রূপ আছে। আলো যদি হয় গতি, আঁধার বিরতি। যে অজ্ঞেয় প্রকৃতিদেবী পৃথিবীটাকে হেলিয়ে দিয়ে ঋতু পরিবর্তন করাচ্ছেন, তিনিই তাকে পাক খাইয়ে দিন আর রাত্রি ঘটাচ্ছেন। এই বৈচিত্র্যকে কৃত্রিমভাবে নষ্ট করে মিডাসের রাজার মতন সব কিছুকে সোনা করতে চাইলে একঘেয়েমির অভিশাপ মানুষের মনকে বিপর্যস্ত করে তুলবে। তাই শহরজীবনের আলো-আঁধারের এটুকু বৈচিত্র্য অন্তত আপনারা ধ্বংস করবেন না। রাত্রে রাস্তার আলো থাকুক, আপত্তি নেই কিন্তু তার বাইরেও থাকুক বিদিশার নিশার সেই তিমির, যেখানে দু-দণ্ড শান্তির বিশ্রাম নিতে পারে ক্লান্ত মানুষ। অন্তত কিছুক্ষণের জন্যও বলতে পারে–আমার আঁধার ভালো।

সাত্যকি সোমের ভাষণ শুনে অন্য সব বিজ্ঞানী অবাক হয়েছিলেন। কেউ কেউ আড়ালে হয়তো হেসেওছিলেন। বলেছেন, ডক্টর সোম কি বিজ্ঞান ছেড়ে দিয়ে কবিতা লিখছেন? রমেশ বেরি তো বাঙালি বিজ্ঞানী ডক্টর দোলা চক্রবর্তীকে বলেই বসলেন, আপনাদের বাঙ্গালীদের ওই এক গলত আছে ডক্টর চক্রবর্তী। বিজ্ঞানী হোবেন, খিলাড়ি হোবেন, বিজিনেসম্যান হোবেন–লেকিন কবি ভি হোবেন।

ডক্টর সোমের আপত্তিকে নিছক সাময়িক আবেগপ্রবণতা ধরে নিয়ে তাঁকে কোনও মূল্য না দিয়ে যখন সত্যিই কৃত্রিম জ্যোৎস্না প্রকল্প অনুমোদন পেল, সে দিন সাত্যকি সোম বিরাট আঘাত পেলেন মনে। তাঁর আপত্তি কেন গ্রাহ্য হল না, তার কারণটা পর্যন্ত তাঁকে জানানোর সৌজন্য দেখালেন না এএমপিসি বা কৃত্রিম জ্যোৎস্না প্রকল্প পরিষদের কর্তাব্যক্তিরা। তিনি কি তবে তাঁদের কাছে এতই মূল্যহীন হয়ে গেলেন যে, তাঁর বক্তব্যকে অকিঞ্চিৎকর প্রলাপ বলে মনে করা হল?

তাই যখন ডক্টর বেরি তাঁকে টেলিফোনে ডেকে প্রস্তাব করলেন যে, বিজ্ঞানীকুলতিলক সাত্যকি সোমের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ প্রথম কৃত্রিম জ্যোৎস্না কলকাতার আকাশেই ছাড়া হবে, আর তার উদ্বোধন ডক্টর সোমই করবেন–তখন ডক্টর সোম নিজেকে ঠিক রাখতে পারেননি। তাঁকে এর রাগে ফেটে পড়তে কেউ কখনও দেখেনি। তিনি কাঁপতে কাঁপতে বলেছিলেন, আমি তো যাবই না, বরং সে দিন প্রতিবাদস্বরূপ আমার বাড়ি অন্ধকার করে রাখব।

টেলিফোন রেখে দেওয়ার আগেই তিনি শুনতে পেয়েছিলেন ক্ষীণস্বরে একটু মৃদু হাসির আওয়াজ আর তারপরেই একটা শব্দ–পাগল! ডক্টর বেরি নিজের মনেই বললেন, অথবা হয়তো পাশে অন্য কেউ ছিল।

রিসিভার রেখে দিয়ে সশব্দে হেসে উঠলেন ডক্টর সোম। দণ্ডায়মান রোবট নরোত্তমকে চালু করাই ছিল। তিনি বললেন, জানিস নরোত্তম, সে দিনের দেবতা সাত্যকি সোম আজ পাগল। কারণ ওদের মতে মত মেলাইনি।

নরোত্তম রোবট ডক্টর সোমের অবসরের সঙ্গী। সমবয়সির মতো তাঁর সঙ্গে ঠাট্টা ইয়ারকিও করে।

সে কিছু না জেনেই সাত্যকি সোমকে খুশি করার জন্য বলে উঠল, তাতে কী হয়েছে? গ্যালিলিও, কোপার্নিকাস সবারই তো হেনস্থা হয়েছে। তবুও একসময় পৃথিবী জানবে–ওই একজনেরই মাথা ঠিক ছিল, অন্য সকলেই পাগল বা মূর্খ।

নরোত্তমের সঙ্গে এই কথোপকথনের মাঝখানে ঘরে প্রবেশ করল গৌতম ব্ৰহ্ম। এই সংস্কারাচ্ছন্ন প্রাচীনপন্থী তর্কবাগীশ তরুণটিকে ডক্টর নোম স্নেহ করেন–যদিও তার পৌরাণিক ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়ার সময় তিনি কপালে হাত দেওয়ার ভান করে বুড়ো আঙুল দুটো দিয়ে নিজের দু-কান বন্ধ করে রাখেন।

গৌতম ঘরে ঢুকেই বলে উঠল, কী ব্যাপার! দরজায় রোবট দারোয়ান দ্বারিকনাথ দেখি দিনের বেলাতেই জেগে আছে। আমাকে দেখে বলল, তার স্পেশ্যাল ডিউটি পড়েছে দিনে, কারণ আপনি দিনের বেলাতেই নিশিপালন করছেন। আলো না জ্বালান, কিন্তু জানলাটা খুলে দিন। দেখবেন, একটু পরেই কেমন আলোতে ভরে যাবে চারদিক। একটু পরেই কৃজ্যোতের উদবোধন হবে। টেলিভিশনে দেখাবে।

ডক্টর নোম অবাক হয়ে বললেন, ক্রিয়োজোট!

গৌতম হেসে বলল, ক্রিয়োজোট নয়, কৃজ্যোৎ। কৃত্রিম জ্যোৎস্নার সংক্ষিপ্ত রূপ। বলেই ঘরের কোণে রাখা টেলিভিশন চালিয়ে দিল।

কেন আর তুমি কাটা ঘায়ে নরোত্তম তার মন্তব্য শুরু করতেই তাড়াতাড়ি সুইচ অফ করে ডক্টর সোম তাকে মৃত করে দিলেন। ঠোঁটকাটা রোবট নরোত্তম রেখেঢেকে কথা বলে না। ওর জন্যে ডক্টর সোমকে অন্যের কাছে অনেকবার অপদস্থ হতে হয়েছে। সে কথা যারা নরোত্তমের কীর্তিকলাপের সঙ্গে পরিচিত, তারা সবাই জানে। তবু গৌতম আজ একটু অবাক হল।

টেলিভিশনে ভেসে উঠল ভাস্কর ভবনের ভেতরের দৃশ্য। পাশাপাশি বসে আছেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীগণ, তাবড় তাবড় ব্যক্তি আর মন্ত্রী। মাঝে মাঝে ক্লোজ-আপে দেখা যাচ্ছে রমেশ বেরির বিরাট মুখ–তাঁর গোঁফের আড়ালে হাসি। টিভি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে তিনি যেন সাত্যকি সোমের উদ্দেশে একটা ব্যঙ্গের হাসি পাঠিয়ে দিলেন–ডক্টর সোমের হঠাৎ এ কথা মনে হল। একটা নাচের অনুষ্ঠান হচ্ছে। নেপথ্যে রবীন্দ্রসংগীত—’আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে…’

একটু পরেই নাচ-গান শেষ হল। রমেশ বেরি উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে স্বাগত জানালেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, আজ এই অনুষ্ঠানে যাঁর অনুপস্থিতি আমরা অন্তরে অনুভব করছি, তিনি সর্বজনশ্রদ্ধেয় মহাবিজ্ঞানী ডক্টর সাত্যকি সোম। আমাকে টেলিফোনে তিনি জানিয়েছেন যে, প্রবল ইচ্ছা সত্ত্বেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি আজ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারলেন না।..।

হঠাৎ একটা প্রচণ্ড হুংকারে চমকে উঠল গৌতম। দেখল, সাত্যকি সোম রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়েছেন। মুখ-চোখ লাল হয়ে উঠেছে তাঁর। টেবিলে ঘুসি মেরে বললেন, মিথ্যেবাদী শয়তান! আমাকে অপমান! এর প্রতিশোধ আমি নেব।

শান্ত ধীর জ্ঞানবৃদ্ধের এই দুর্বাসারূপ গৌতম আগে কখনও দেখেনি। সে টিভি বন্ধ করে বাক্যহারা হয়ে ডক্টর সোমের দিকে তাকিয়ে থাকল। তার সেই বিস্মিত চাহনির দিকে দৃষ্টি পড়তে নিজেকে সামলে নিলেন সাত্যকি সোম। তারপরে দু-হাতে মাথা ধরে মুখ নিচু করে সোফায় বসে পড়লেন।

এইভাবে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর পকেট থেকে একটা ছোট কৌটো বার করে তার থেকে সাদা বড়ি নিয়ে জল দিয়ে খেয়ে নিলেন। নির্বাক হয়ে বসে-থাকা গৌতমকে দেখে বোধহয় একটু লজ্জিতই হলেন। একটু চুপ করে থেকে তারপর বললেন, তোমাকে একটা গল্প বলব, গৌতম। গল্পের পরে একটা প্রশ্ন করব। যদি সঠিক উত্তর দিতে পারো, তবে যে বইটা আমি লিখছি, সেটা আমি উৎসর্গ করব কুসংস্কারী অবিজ্ঞানী গৌতম ব্ৰহ্মকে। আর যদি ভুল উত্তর দাও, তবে আমার বাড়ির দরজা তোমার কাছে চিরকালের জন্য বন্ধ থাকবে।

গৌতম হেসে বলল, নিজেকে বিক্রমাদিত্যর চাইতেও নার্ভাস লাগছে। তবুও বলুন।

সাত্যকি সোম বললেন, শোনো তবে। এক যে ছিলেন রাজা। তোমার ওই বিক্রমাদিত্যর মতনই বুদ্ধিমান, জ্ঞানবান, দয়ালু, ন্যায়নিষ্ঠ আর সুশাসক। তাঁর সুশাসনে রাজ্যের সমস্ত প্রজার গৃহ সুখের নীড়। সুখ, স্বাস্থ্য, শান্তি আর সমৃদ্ধিতে দিন দিনই ভরে উঠতে লাগল রাজ্য। প্রজারা রাজার গুণগানে পঞ্চমুখ।

রাজা-প্রজার এই সুখসমৃদ্ধি সহ্য হল না বুঝি অদৃষ্টদেবীর। সেই রাজ্যের মধ্যে একটি কুয়ো ছিল। প্রজারা তার জল পান করত। হঠাৎ কীভাবে সেই জল পরিণত হল বিষাক্ত কারণবারিতে। যে খাবে, সে মরবে না বটে, তবে সে পরিণত হবে বিকৃতমস্তিষ্ক উন্মাদে। কিন্তু সে জল হল আরও সুস্বাদু, মিঠে আর শীতল। দলে দলে প্রজারা মহানন্দে সে জল পান করতে লাগল। সবাইকে ডেকে বলল, জলের স্বাদগুণের কথা–যা খেলে সব রোগ সেরে যাবে। এইভাবে অল্পকালের মধ্যেই রাজ্যের সমস্ত লোক পাগল হয়ে গেল। প্রকৃতিস্থ থাকলেন একা রাজা নিজে। রাজ্যের লোকের পাগল হওয়ার কারণ তিনি বুঝতে পারলেন। সেই কুয়োর জলপান নিষেধ করে আদেশ জারি করলেন। কিন্তু খুব দেরি হয়ে গিয়েছে তখন। কেউ রাজি হল না অদ্ভুত এই আদেশ রাজ্যে ঢাঁড়া পেটাতে। রাজা নিজে গিয়ে পাথরের চাঁই দিয়ে ঢেকে দিলেন কুয়োর মুখ। সবাই ক্ষিপ্ত হয়ে রাজাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে সরিয়ে দিল পাথরের ঢাকা। বলতে লাগল, আমাদের রাজা পাগল হয়ে গিয়েছে রে! আয়, ওটাকে মেরে ফেলে আমরা সবাই মিলে এই কুয়োটাকে রাজা করি।

রাজা সেখান থেকে পালিয়ে এসে প্রাণে বাঁচলেন। তারপর ঘরে এসে জানলা-দরজা বন্ধ করে দু-হাতে মাথা চেপে ধরে ভাবেন–এ কী হল! আমার সোনার রাজ্য কার কারসাজিতে এভাবে রসাতলে গেল! কী করবেন তিনি এখন? রাজ্য ছেড়ে পালাবেন? দুঃখে-হতাশায় ক্ষণেকের জন্যে ভাবেন, নিজের বুকেই বসিয়ে দেবেন তাঁর তরবারি। পরক্ষণেই চিন্তা করেন, এ তো আত্মহত্যা! পলায়ন আর আত্মহত্যা দুটোই তাঁর কাছে সমান পাপ।

সারারাত জেগে তিনি ভাবলেন আর ভাবলেন। ভোরের আলো ফুটতেই মনস্থির করে ফেললেন তিনি। সকলের ঘুম ভাঙার আগেই তিনি চুপিচুপি প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন সেই কুয়োর উদ্দেশে। কুয়োর কাছেই দড়ি-বালতি ছিল। দড়ি নামিয়ে তিনি এক বালতি জল তুললেন। তারপর সেই বালতিতে মুখ লাগিয়েই ঢকঢক করে পান করে যেতে লাগলেন সেই জল–যতক্ষণ না উদরপূর্তি হয়ে গেল বিষাক্ত মাদকবারিতে।

সকালে প্রজারা উঠে দেখল, রাজার পাগলামি একদম সেরে গিয়েছে। তারা দু-হাত তুলে নাচতে নাচতে বলল–আমাদের রাজাটা ভালো হয়ে গিয়েছে রে! দেখল, রাজাও তাদের মতো উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করছেন আর অবিরাম বকে চলেছেন মূল্যবান আবোল তাবোল বক্তৃতা।

ডক্টর সোম তাঁর গল্প শেষ করে বললেন, এবার বলো তো, রাজা কুয়োর জল খেয়ে প্রজাদের সঙ্গে এক হয়ে গিয়ে ঠিক কাজ করেছিলেন? নাকি করেননি?

গৌতম সজোরে বলল, মোটেই করেননি। রাজা বিক্রমাদিত্য হলে ওই কুয়োর জলের বদলে সত্যিকার বিষপান করাও শ্রেয় বলে মনে করতেন।

সাত্যকি সোম থেকে লাফিয়ে উঠে গৌতমকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, আমার মনের জোর তুমি অনেক বাড়িয়ে দিলে, গৌতম। আমি বিজ্ঞানী আর তুমি অবিজ্ঞানী সংস্কারাচ্ছন্ন। তাই মাঝে মাঝে কর্মক্লান্ত হয়ে তোমার ওইসব আজগুবি ধারণার কথা শোনার মধ্যেও আমি বিনোদন পাই। কিন্তু আজ তোমার কাছে শুনতে পেলাম সত্যের ধ্বনি। ওইসব বিজ্ঞানী মিলে চাঁদকে তার সৌন্দর্যের সাম্রাজ্য থেকে নির্বাসিত করছে। যে চাঁদ মায়ের কোলে বাঙালি শিশুদের কপালে টিপ দিয়ে যেত। যে চাঁদের চলার ছন্দে হিন্দু মুসলমান-বৌদ্ধদের উৎসব-অনুষ্ঠান আজও নিয়ন্ত্রিত হয়, সেই চাঁদের আলোকে বিদায় দিচ্ছে আজকের কৃত্রিম জ্যোৎস্না। তাই আমার কাছে এটা শোক দিবস। গৌতম, কাকজ্যোৎস্না কাকে বলে জানো? নির্মেঘ আকাশে গভীর রাতে যখন পৃর্ণিমার চাঁদ ওঠে, সেই জ্যোৎস্নার প্লাবনে মাঠঘাট ভরে যায়। গাছে গাছে কাকেরা জেগে উঠে ডাকতে শুরু করে। ভাবে, ভোর হয়েছে বুঝি। এই কৃত্রিম জ্যোৎস্নায় কাকরা আর আনন্দে চঞ্চল হয়ে উঠবে না। তাদের রাত্রের » বিশ্রাম আর জাগরণের আনন্দের মধ্যে আক্রমণ হানবে এই কৃত্রিম জ্যোৎস্না।

একটু থেমে সাত্যকি সোম আবার বললেন, রমেশ বেরির মতন অনেক বিজ্ঞানীই হয়তো ভাবছেন, সাত্যকি সোমের মাথার গোলমাল দেখা দিয়েছে। যাকে বলে চন্দ্রাহত অবস্থা, তা-ই। যে কথাই জানুন তাঁরা, এবার আমি কিছু দিন বিশ্রাম চাই। শুধু তোমাকেই বলছি গৌতম, আমি বেশ কিছু দিনের জন্যে আত্মগোপন করতে চাই এমন জায়গায় গিয়ে, যেখানে কেউ আমার পরিচয় জানবে না। সেখানে বেশি লোকজন থাকবে না। থাকবে প্রকৃতির শ্যামল সজল রূপ। এই বর্ষাকালেই যাব। তার আগে দুটো জিনিস তোমাকে এনে দিতে হবে গৌতম।

গৌতম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চাইতে ডক্টর সোম বললেন, দাশু রায় কে, গৌতম? পাঁচালি নামে কোনও বই লিখেছিলেন এই দাশু রায়। সাহিত্য পরিষদ থেকে আমার নাম করে সেই পাঁচালি বইয়ের একটা ফোটোকপি আনিয়ে দাও। আর কিছু তামাকও কিনে আনো কোনও দোকান থেকে।

গৌতম অবাক হয়ে বলল,  কিন্তু আপনি তো ধূমপান করেন না। চিরদিনই এর বিরুদ্ধে।

ডক্টর সোম মৃদু হেসে বললেন, তা হোক। একবারই খাব। তবে সেটা দা-কাটা তামাক হওয়া চাই। অবাক হচ্ছ? আমার ভাইপোর আলমারি থেকে একটা পুরোনো বাংলা বই বের করে পড়ছিলাম আজ। মন ভালো না থাকলে আমি বিজ্ঞান ছাড়া অন্য বই মাঝে মাঝে পড়ি। এই বইটা পড়তে পড়তে আমি যেন কোথায় ভেসে গেলাম। যেখানে শক্তি, ভর, গতি–সব যেন বুকের অণু-পরমাণুতে ধাক্কা দিতে লাগল। পড়ছিলাম–রাত্রে নদীতে যাওয়া, ছোট্ট হাঁড়িতে মাছের ঝোল-ভাত রাঁধিয়া খাওয়া, হয়তো মাঝে মাঝে তাদের সেই মহাভারতখানা কি বাবার সেই দাশু রায়ের পাঁচালিখানা মাটির প্রদীপের সামনে খুলিয়া বসিয়া বসিয়া পড়া! বাহিরে অন্ধকারে বর্ষারাতে টিপটিপ বৃষ্টি পড়িতেছে, কেহ কোথাও নাই, পিছনের ডোবায় ব্যাং ডাকিতেছে–কী সুন্দর।

সাত্যকি সোম আনন্দে হেসে উঠে বললেন, আমিও যেতে চাই সেখানে, যেখানে ওরকম ব্যাং-ডাকা বর্ষা আছে। সঙ্গে থাকবে ওই পাঁচালি আর তামাক। অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে না থেকে খুলে দাও জানলাটা। ভয় নেই, আমাকে হাসতে দেখে মনে কোরো না যে, সেই পাগল রাজার দলে যোগ দিয়েছি। সাত্যকি সোম বিক্রমাদিত্যই আছে–থাকবে।

গৌতম উঠে জানলা খুলে দিতেই ঘরের মধ্যে আছড়ে পড়ল ঝলমলে কৃত্রিম জ্যোৎস্নার আলো। সেই আলোর আঘাতে যেন আহত হয়ে বৃদ্ধ বিজ্ঞানী অস্ফুট আর্তনাদ করে গৌতমের বাহুমূল চেপে ধরলেন।

[শুকতারা, শারদীয়া ১৩৯৮]