মালুবাবু
চায়ের জল বসিয়ে দিয়ে পটদীপের মা বললেন, পটুরা তো এখনও মাঠ থেকে ফিরল না! মালুবাবুকে ঠিকমতো সময় বলা ছিল তো?
সংবিৎবাবু তোয়ালেটা হাতে নিয়ে বললেন, ওর সামনেই কবে মালুবাবু বলে ডেকে ওঠো, আমার সেই ভয়। হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক পাঁচটা কুড়ি মিনিটে খেলা বন্ধ করতে বলা আছে। আসতে বড়জোর দশ-বারো মিনিট।
একটু পরেই পটদীপ বাড়ি ফিরে ধপাস করে চিত হয়ে শুয়ে পড়ে একটা ক্লান্তিসূচক শব্দ করল। মা ঘরে ধূপকাঠি জ্বালছিলেন। বললেন, কী রে পটু, তুই একা ফিরলি? পেলে কোথায়?
পটদীপ বলল, ও আমার বল, বুটজুতো নিয়ে গুটিগুটি আসছে। ওর যত ছোটাছুটি মাঠে। রাস্তা দিয়ে তো গোরুর মতন হাঁটে। গুরু, না গোরু!
পটদীপের মা অর্যমাদেবী বললেন, ও কী অভদ্রের মতো ভাষা শেখা হচ্ছে? তোমার বাবাকে বলতে হবে, খেলাধুলো, লেখাপড়ার কোচ না রেখে তোমার জন্যে ভব্যতা শেখানোর কোচ রাখতে। বাথরুম থেকে বেরোলেই বলব।
পটদীপ তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসে বলল, বাবা ফিরেছে নাকি? প্লিজ মা, বাবাকে বোলো না। আমি এবার থেকে পেলেদাকে খুব সম্মান করব।
মা হেসে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। এবার হাত-পা-মুখ ধুয়ে নে। পড়ার বই নিয়ে বসতে হবে।
পটদীপ এই ফাঁকে তার প্রিয় পত্রিকার ধাঁধার পাতাটা বের করল। সিধুদাদুকে জিজ্ঞেস করলে মুহূর্তে উত্তর বলে দিতে পারে, কিন্তু আগে একগাদা জ্ঞান দেবে। নিজে চেষ্টা না করলে মাথা খুলবে কী করে? অঙ্কের মতো এগুলোরও নিজে থেকে উত্তর বের করলে দেখবে, কত আনন্দ হবে–হেনতেন। তাই পটদীপ নিজেই চেষ্টা করে দ্যাখে। না পারলেও পরের মাসে তো উত্তর বেরোবেই। তা ছাড়া, সিধুদাদুকে বাবা দু-সপ্তাহে একবারই আনেন। জিকে, অর্থাৎ সাধারণ জ্ঞানের কুইজ করাতে।
বাবা বাথরুম থেকে বেরোনোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জুতো-বলের ব্যাগটা কাঁধে চাপিয়ে মূর্তিমানও হাজির। তারপর, পটদীপ যা ভেবেছিল, ঠিক তা-ই। পটদীপের যত দোষ আর খুঁতের ফিরিস্তি শোনাতে বসল বাবাকে। পেলের পিঠটা নেহাত গন্ডারের চামড়ার মতো। না হলে ঠিক একসময় কিল বসিয়ে দিত পটদীপ।
পেলে সংবিৎবাবুকে বলতে লাগল, পটু কিন্তু ফুটবলে পটু হবে না, কাকাবাবু। পা দুটো, দৃষ্টিশক্তি কিছুই আয়ত্তে আনতে পারল না এখনও। বলটা তুলে মারলে কত ডিগ্রি কোণ করে কত জোরে ঠিক কোন দিকে মারতে হবে হাওয়ার গতি বুঝে–এসব তো বলতে গেলে এক ন্যানোসেকেন্ডে মাথায় এনে কিক করা যায়। গড়িয়ে পাস দিলে জমির ফ্রিকশনটাও মাথায় আনতে হবে। অন্য টিমের কে কোথায় আছে আর কোথায় যেতে পারে, সেটাও মুহূর্তে বুঝে নিতে হবে। তার জন্যে পেছনে আর দু-দিকে আরও তিনজোড়া অদৃশ্য চোখ থাকতে হবে। কে বোঝায় সে কথা! আর গোলে খেললে তো আরও শোচনীয় অবস্থা। যেদিকে বল আসছে, তার উলটোদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আরে, তুই স্ট্রাইকারের চোখের দৃষ্টি, পায়ের ভঙ্গি, বলের গতি–এগুলো কি এক পলকে ব্রেনে নিতে পারিস না? নাকি বলকে ভয় পাস? বেশি কিছু বললে আমাকেই কিনা–
পটদীপের মা তাড়াতাড়ি তাকে থামিয়ে চায়ের কাপটা সংবিৎবাবুর হাতে দিয়ে বললেন, সবই জানি, পেলে। ডনও বলেছে, ওর দ্বারা ক্রিকেটও হবে না। মনের একাগ্রতাই নেই। তাই তো ওর বাবাকে বলি, কী দরকার বাপু ওকে বিরাট খেলোয়াড় বানানোর চেষ্টা করে?
পেলে ফোড়ন কাটল, এই ক্রিকেটটা যে কী জিনিস–খাদ্য, না পোশাক, কিছু দিন আগে পর্যন্ত তা-ই জানতাম না। ওটা নিয়ে সময় নষ্ট না করে
তার কথার মাঝখানেই পটদীপের বাবা বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুমি থামো। তারপর পটদীপের মা-র দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি তো বলছি না যে, পটুকে বড় ফুটবলার কি ক্রিকেটার বা অন্য কিছু হতে হবে। সব বিষয়ে একটা প্র্যাকটিক্যাল ধারণা থাকাটা পরিণত বয়সে কাজে লাগে। তা ছাড়া খেলাধুলোর মাধ্যমে ব্যায়ামটাও হয়। আর প্রত্যেক ছেলেমেয়ের মধ্যে কোনও-না-কোনওদিকে কমবেশি একটা সম্ভাবনার বীজ লুকিয়ে থাকে। সেটাই না-জানা থাকলে, বা জোর করে চেপে দিলে সেটা শুকিয়ে গিয়ে আর অঙ্কুরিত হয় না সারাজীবনেই। কত হচ্ছে এরকম! সেই জন্যেই মালুবাবু, ইয়ে, পেলের মতো ছেলেদের দরকার। এই যে অত্রিবাবুর মেয়ে হংসকিঙ্কিণী আজ ডাক্তার হিসেবে এত নাম করেছে, সেটাও তো মা.. ইয়ে, কাদম্বিনী দিদিমণির দৌলতেই। নইলে অত্রিবাবু তো ওকে ইঞ্জিনিয়ার আর গায়িকা দুটোর একটা বানানোর পেছনেই আদা-জল খেয়ে লেগেছিলেন। ওর ডাক্তারিতে ব্রেন, সেটা টেনে বের করেছিল তো ওই কাদম্বিনীই।
পটদীপের মা বললেন, সত্যি, হাঁসু থাকাতে আমরা কত নিশ্চিন্ত। ওদের মালু, মানে সেই কাদম্বিনী না কী, তাকে দিয়ে তো আর ডাক্তারি চলে না।
সংবিৎবাবু হেসে বললেন, না, তা চলে না। মালু তো কেবল শিক্ষকের কাজ করে। যেমন, আমাদের পেলে। বলেই সরি বলে উঠলেন। পেলে ওসব কথা কানেই নিল না।
ওর নিজের নাম শোনামাত্রই বলতে শুরু করল, আর পটুর বিনে কারণে ফাউল করার স্বভাব। জেনে-শুনে আগে গিয়ে অফসাইডে দাঁড়ায়। আমার কথা ও
সংবিৎবাবু হাত তুলে তাকে থামিয়ে বললেন, তুমি তো সব রেকর্ড করেই রাখছ। পরে এক ফাঁকে পটুকে দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে ওর দোষত্রুটিগুলো। এখন কানের কাছে বকবক না করে তোমার ঘরে যাও। পটু এখন পড়তে বসবে। তার ব্যবস্থা করতে হবে।
পেলে গজগজ করতে করতে চলে গেল। সংবিৎবাবু স্ত্রী-র দিকে ফিরে বললেন, পটু অঙ্কে বেশ কাঁচা। আমি বলছি না, ওকে রামানুজন হতে হবে। তবে ভালোভাবে পাস করা তো দরকার। আজ অঙ্ক করুক গজেনবাবুর কাছে।
পটদীপের মা বললেন, ঠিক আছে। গজেনবাবুই আসবেন।
স্কটিশ চার্চ কলেজে সংবিৎবাবুদের সময়ে অঙ্কের এক অধ্যাপকের নাম ছিল গজেন গাঙ্গুলি–সংক্ষেপে ছাত্রছাত্রীদের কাছে জি-টু। তাঁর পড়ানো নাকি একমাত্র গর্দভ ছাড়া কারও বুঝতে অসুবিধে হত না। ছাত্রজীবনেও তিনি অঙ্কে এত পাকা ছিলেন যে, একবার নাকি তাঁকে পরীক্ষায় ভুল করে একশোর মধ্যে একশো কুড়ি দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে ভুল শুধরে দেওয়া হয়। আসলে তিনি কয়েকটি অলটারনেটিভ অঙ্কও কষে দিয়েছিলেন। মার্কস দেওয়ার সময় পরীক্ষকের খেয়াল ছিল না। তাই কয়েকটি অঙ্কে ডাবল নম্বর পেয়েছিলেন। এসব গল্প পটদীপের মা অনেকবার শুনেছেন। তাই মজা করে পটদীপের অঙ্কের মাস্টারের নাম তিনিই রেখেছেন–গজেনবাবু।
সংবিৎবাবু বললেন, পটু তাহলে অঙ্ক করুক। আমি একটু ঘুরে আসছি বাইরে থেকে।
পটুর মা পেলের ঘরে গিয়ে দেখলেন, পেলে কম্পিউটারে পুরোনো বিশ্বকাপের রেকর্ড চালিয়ে দেখছে আর বিরক্তি প্রকাশ করছে প্রায় সবারই খেলা দেখে। পটদীপের মা-কে দেখেই বলে উঠল, দেখছেন কাকিমা, কোথায় পাস দিল? বিশ্বকাপেই যদি এই মানের খেলা হয়, তাহলে পটুর মতো একটা অপটু ছেলের আর দোষ কী? কেবলমাত্র স্কিল, স্ট্রেংথ আর স্ট্যামিনা থাকলেই হবে না, থাকা চাই সিক্সথ সেন্স। মুহূর্তেই মাথার মধ্যে অঙ্ক কষা হয়ে যাবে, কীভাবে বলটা খেলতে হবে। এই ছ-টা এস্..
পেলে তার কথা বলে যেতে লাগল। পটদীপের মার মনটা কেমন খচখচ করে ওঠে। একেবারে ছেলেমানুষ ফুটবল-পাগল এই পেলে। আর গজেনবাবু একেবারেই গুরুগম্ভীর। পটুর বাবাকে অনেকবার বলেছেন তিনি, কেন বাপু, পড়ার মাস্টারমশাইদের কি হাসিখুশি হতে নেই?
সংবিৎবাবু বলেছেন, মাঝে মাঝে গাম্ভীর্যও দরকার। সবরকম মেজাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতাও ছোট থাকতেই জন্মানো দরকার। আর হাসিখুশি গল্প করার জন্যে তো আছেই গল্পদাদু, আমাদের দক্ষিণাবাবু।
পটদীপের মা পেলের মাথার পেছনে হাত রাখলেন। যেন ওখানে কোনও ফোঁড়া আছে, পেলে যন্ত্রণা পেয়ে বলে উঠল, আহা পটদীপের মা-র চোখের কোণটা অকারণে চিকচিক করে ওঠে। তিনি একটু পরেই বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। কিছুক্ষণ পরেই কোঁচা ঠিক করতে করতে পেলের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন এক বয়স্ক লোক। নাকের ওপর চশমা কিছুটা নেমে গিয়েছে। চশমার কাচের ওপর দিয়ে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলেন চারদিকে। হাতে একটা উলটো ইংরেজি জে হরফের মতো মান্ধাতার আমলের লাঠি। কাঁধে ভাঁজ-করা চাদর।
পড়ার ঘরে ঢুকেই হাঁক দিলেন, পটুবাবু কোথায় গেলে? পট করে এসে পাটি পেতে বসে পড়ো।
পাটি, মানে মাদুর পেতে! গজেনবাবুর ডাকের মধ্যেও সেই গাম্ভীর্য নেই। বরং একটা হালকা মেজাজ তাঁর আজকে। পটদীপের মা আড়াল থেকে শুনে বেশ অবাক হলেন। থাক গে, গজেনবাবুর এই পরিবর্তনে তিনি খুশিই হলেন। নিশ্চিন্ত মনে তিনি টেলিভিশনে তাঁর প্রিয় চটপটে গৃহিণী দেখতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ পরে পটদীপের বাবা বাড়িতে ফিরেই শুনলেন, পড়ার ঘরে কে একজন বকবক করে যাচ্ছে। উঁকি মেরে দেখলেন, গজেনবাবু হাত নেড়ে নেড়ে কী বলে যাচ্ছেন আর পটদীপ হাসিমুখে গালে হাত দিয়ে তা-ই শুনছে। অন্য দিনের মতো হাই তোলা, উশখুশ করা–সব উধাও। গজেনবাবুকেও অন্যরকম দেখতে লাগছে। কী ব্যাপার!
একটু এগিয়ে এসে তিনি শুনলেন, গজেনবাবু বলছেন, তিরিশ বছর আগে ইস্কুল ছেড়েছেন মোহিত সরকার। তাঁর ক্লাসে তখন এই ধরো, জনা চল্লিশেক ছেলে ছিল। সবার নাম তো এত দিন পরে আর মনে পড়ে না। তুমিও দেখবে, আজ যাদের সঙ্গে রোজ দেখা হচ্ছে, যাদের সঙ্গে পাশাপাশি বসে বছরের পর বছর পড়াশোনা, খেলা, মারামারি করছ, তিরিশ বছর পরে তাদের অনেকের নাম ভুলে যাবে। কেমন দেখতে ছিল তা আবছা আবছা মনে পড়বে। তখন হঠাৎ দেখা হলে অবাক হয়ে যাবে, আরে, এই ভদ্রলোক আমাদের সেই ভুতো! যা-ই হোক, যা বলছিলাম, মোহিতবাবুও ভাবলে বড়জোর কুড়িজনের মতো সহপাঠীর নাম আর চেহারা মনে করতে পারেন। তবে জয় বা জয়দেবের কথা আলাদা। সে তো ক্লাসের সেরা শুধু নয়, চৌকশ ছেলে ছিল। পড়াশোনায় শুধু না, হাই জাম্পে ইনটার স্কুলে রেকর্ড করেছিল। ইংরেজি-বাংলা আবৃত্তিতেও তুখোড়। একবার তো হি স্টুড অন দ্য বার্নিং ডেক সেই ক্যাসাবিয়াঙ্কা আবৃত্তি করে রাজ্যপালের কাছ থেকে মেডেলও পেয়েছিল।
পাওয়াচ্ছি মেডেল! গর্জে উঠলেন সংবিৎবাবু। তারপর হাঁক ছাড়লেন স্ত্রী-র উদ্দেশে –অর্যমা!
গজেনবাবু পটদীপের বাবার এই ব্যবহারে অপ্রস্তুতের একশেষ। তিনি অবাক হয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলেন। পটদীপের মুখের হাসিও উধাও।
পটদীপের মা ঘর থেকে ছুটে এসে গজেনবাবুর দিকে তাকিয়ে দেখলেন, আরে! এ যে দক্ষিণাবাবু! গজেনবাবু তো কাঁধে চাদর দেন না। এরকম গোঁফও নেই। তবে কি তিনি ভুল প্রোগ্রামিং করেছিলেন!
সংবিবুর কাছে গিয়ে লজ্জায় জিব কেটে বললেন, পেলের পিঠটার দিকে আলো ছিল না। বোধহয় ভুল করে…। ইনি দক্ষিণাবাবু। ওঁর কোনও দোষ নেই। ছি ছি, কী মনে করলেন!
সংবিৎবাবুও নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। তাড়াতাড়ি দক্ষিণাবাবুর কাছে এসে বললেন, ও, আপনি এসেছেন। ছি, ছি, কী ভুল করলাম! প্লিজ কিছু মনে করবেন না। আসলে এই সময় পাশের বাড়ির সুজিত এসে পটুকে পড়ায় খুব ডিস্টার্ব করে। আমি পেছন থেকে ভালো দেখতে পাইনি। সুজিত ভেবেছিলাম। আপনি ক্ষমা করে দেবেন।
দক্ষিণাবাবু হেসে বললেন, না, না, কিছু মনে করিনি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কোথাও কোনও গোলমাল হচ্ছে। নইলে এত দিন তো দেখছি আপনাদের। কী সুন্দর ব্যবহার!
সংবিৎবাবু বললেন, পটুকে গল্পটা শুনিয়ে আজ ছুটি দিয়ে দেবেন। মাঠে আজ পেলে ওকে খুব ছুটিয়েছে। আর যদি কিছু মনে না করেন, তারপর আমার কাছে এসে একটা মজার গল্প বলবেন। ত্রৈলোক্যনাথের গল্প। ছোটবেলায় পড়েছিলাম। একদম ভুলে গিয়েছি।
দক্ষিণাবাবু হেসে বললেন, না, না, মনে করার কী আছে? আমারও তো ভালো লাগে গল্প করতে। এসো পটু, এই গল্পটা শুনেই কিন্তু তোমার আজ ছুটি।
সংবিৎবাবু স্ত্রীর কাছে এসে আস্তে আস্তে বললেন, একটু ধীরেসুস্থে দেখে-শুনে কাজ করবে তো? যাক গে, শনিবার দক্ষিণাবাবুর আসার কথা। সে দিন তার বদলে গজেনবাবু আসবেন। দেখো, এবার থেকে সাবধান। দরকার হলে একটা টর্চ নিয়ে যেয়ো।
অর্যমাদেবী হাসলেন, ছেলেকে ছুটি দিয়ে এখন নিজে গল্প শুনতে বসবেন। তিনি অবশ্য দুপুরে সময় পান। তখন বাবা-ছেলে কেউ থাকে না। ছুটির দিনে থাকলেও মালুকে তিনি আনতে পারেন। বেলাদিই হোক, কিংবা বিবিদিই হোক। তাঁরা সবাই রান্না-সেলাই শেখান। গল্প বলার তো কেউ নেই। দক্ষিণাবাবু শুধু পটুকে ছোটদের সাহিত্যের গল্প করেন। তাঁকে ডাকতেও পারেন না। ছি! পটুর গল্প শোনাও নাকি শিক্ষার অঙ্গ। পেলে, ডন, ধ্যান থেকে গজেনবাবু, আশুবাবু সবই পটুর জন্যে। সংবিৎবাবুও মাঝে মাঝে ডাকেন কিছুতে ঠেকে গেলে। আজ যেমন গল্প শোনার জন্যে ডাকলেন। বেলাদিকে ডেকে মাঝে মাঝে রান্নার নানারকম পদ দেখেন। কিন্তু তখন এত ঘুম পায়। তা ছাড়া বেলাদির এটা চাই, ওটা চাই, এসব না জোগাড় থাকলে রান্না শিখবে কী করে–এসব শুনতে ভালোও লাগে না।
ওদিকে দক্ষিণাবাবু পটদীপকে আবার গল্প বলতে শুরু করেছেন। কী যেন বলছিলাম, পটুবাবু? হ্যাঁ, সেই মোহিতবাবুর ক্লাসফ্রেন্ড জয়ের কথা–
অর্যমাদেবী সেদিকে চেয়ে দেখেন। সংবিত্বাবুও। দু-জনেই ভাবেন, এই একই দেহ নিয়ে কখনও পেলে, কখনও গজেনবাবু, কখনও দক্ষিণাবাবু, এমনকী মাঝে মাঝে বেলাদিরও রূপ ধরে চব্বিশ ঘণ্টা তাঁদের বাড়িরই একজন বা বহুজন হয়ে রয়ে গিয়েছে এই রোবটটি–মালটি-কোবরা বা মালটিপারপাস কোচ রোবো। তাঁরা দু-জনে আড়ালে ঠাট্টা করে অবশ্য এর নাম দিয়েছেন–মালুবাবু।
[শুকতারা, শারদীয়া ১৪১৪
এই গল্পটি শারদীয়া সন্দেশ, ১৪০২-তে প্রকাশিত বশিরো গল্পের পরিমার্জিত রূপ।]