নরোত্তম-সংবাদ

নরোত্তম-সংবাদ

ডক্টর সাত্যকি সোমের বাড়ি থেকে যে দিন ওরকমভাবে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এসেছিলাম, সে দিন লজ্জা আর অপমানে কান লাল হয়ে উঠেছিল ঠিকই, তবু তার চেয়েও বেশি আমাকে ধাক্কা দিয়েছিল একটা বিস্ময়। সাত্যকিবাবুর মতন একজন পণ্ডিত, নিখুঁত ভদ্রলোক, তিনিও যে আর-পাঁচজন সাধারণ লোকের মতন মনে মুখে দুই রূপ নিয়ে থাকেন, সেটা আমাকে আঘাত করেছিল। অবশ্য তিনি যে কৌশলে আমার ওপর ওভাবে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন, সেটা বিশ্বাস করতে এখনও মন চায় না। হয়তো সত্যিই সে দিন যান্ত্রিক গোলযোগের ফলে নরোত্তম ওরকম বাঁদরামি (নাকি, রোবটামি?) করেছিল।

শনিচক্রের সদস্য উদ্দালক রুদ্র একদিন বললেন, ডক্টর সোম নাকি কী এক কারণে, নরোত্তমের ওপর রেগে গিয়ে তার ফাঁসি দিয়েছেন। ডা. মল্লিক বললেন, ভেতরের লোকটা বোধহয় মাইনে বাড়াতে বলছিল। তা-ই শুনে সবাই হো-হো করে হেসে উঠলেন। আমি অবশ্য সেই ফাঁকে উঠে পড়েছিলাম। সদস্যরা আমার ব্যাপারটা জানেন না।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবলাম, সত্যিই নরোত্তমরা এ জগতে থাকতে পারে না। সাত্যকি সোম মিষ্টি কথার মোড়কে আমাকে ঠকাচ্ছিলেন। না জানতে পারলে কী এমন ক্ষতি হত আমার? নরোত্তম ধরিয়ে দিয়েই ফ্যাসাদ বাধাল।

তবে নরোত্তম আমার মধ্যে একটা পরিবর্তন এনেছে, সেটা বুঝতে পারি। আজও আমি শনিচক্রের বৈঠকে যাই। নির্দোষ আচ্ছা, আলোচনায় শরীর আর মন দুটোই ভালো থাকে। জ্ঞান বাড়ে। সমাজে থাকতে গেলে কচ্ছপের মতন খোলার মধ্যে থাকা যায় না। কিন্তু পারস্পরিক সম্পর্কের প্রসঙ্গটা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমিও উঠে পড়ি। ওটা আমার আর ভালো লাগে না। বুঝি যে, এর ফলে বেশির ভাগ দিনই আলোচনার বিষয়বস্তু হই আমি নিজেই। তাহলেও আমার মনে এসব আর দাগ কাটে না। আজ সাত্যকিবাবুর সঙ্গে দেখা হলে হয়তো বলতেও পারব, ডক্টর সোম, ওই ম-এ-মু-আ ক্যাপসুল তো আপনি যে কোনও লোকের রক্তেই করতে পারেন। এমনকী, আপনার নিজেরও…

ব্যাপারটা গুছিয়ে বলতে গেলে, শনিচক্র ক্লাবের কথা থেকেই শুরু করতে হয়। আমাদের পাড়ার পার্কটার কোণে প্রতি শনিবার সন্ধেবেলায় যে ফুটবলের মতন দেখতে ঘরটাকে দেখা যায়, ওটাই আমাদের শনিচক্রের আড্ডাখানা। সদস্যদের মধ্যে অধ্যাপক, আইনজীবী, অফিসকর্মী থেকে আরম্ভ করে আমার মতন স্বগৃহে ভোজন সেরে বনমহিষ বিতাড়নের কাজে দক্ষ লোক, সকলেই আছে। প্রতি শনিবার বিকেলে ক্লাবের এই ঘরটাকে জুড়ে তৈরি করা হয়। আবার বৈঠক হয়ে গেলে পার্কের এক রোবট দারোয়ান এসে কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘরটার টুকরোগুলো খুলে ফেলে খোলা অংশগুলো পার্কের একপাশে গুদামঘরে রেখে দেয়। তার জন্য কিছু ভাড়া অবশ্য ক্লাবটা দিয়ে থাকে। এভাবে তো আজকাল, এই একবিংশ শতাব্দীর শেষে, অনেক বাড়িঘরই তৈরি হচ্ছে।

শনিচক্রের এই ঘরটাকে তৈরি করেছিলেন আমাদেরই এক ইঞ্জিনিয়ার-বন্ধু অভিমন্যু রায়। ক্লাবঘরটা দেখতে অনেকটা শনি গ্রহেরই মতন। গোলাকার ঘরটা লাট্র আলের মতন একটা শিকের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তার চারপাশে কোনাকুনিভাবে যে বলয়টাকে দেখা যায়, সেটা আসলে নীচের থেকে ক্লাবঘরে ওঠবার চলন্ত সিঁড়ি বা এসকালেটর। এটা একপাশে ঘরটার দরজাটাকে এমনভাবে ছুঁয়ে গিয়েছে যে, এর সাহায্যে ওপরে উঠে ঘরে ঢুকতে কোনও অসুবিধেই নেই। এখনকার সব কিছুর মতন এটাও জমিয়ে রাখা সৌরশক্তিতেই কাজ করে।

যা-ই হোক, আমাদের বৈঠকে সব প্রসঙ্গই আলোচিত হয়। সাহিত্য, খেলাধুলো, অর্থনৈতিক সমস্যা–যেমন, সম্প্রতি মঙ্গল গ্রহে যাত্রায় অস্বাভাবিক ভাড়াবৃদ্ধি, বিচিত্র সংবাদ–যেমন, চাঁদে নতুন আবিষ্কৃত হিরের খনির কথা, ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে সব কিছুর পরে পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ক প্রসঙ্গটা থাকবেই। কারণ, এটা সবার প্রিয় বিষয়। যেমন, খাওয়ার শেষে চাটনি, দই আর মিষ্টি। এটা হল, যিনি সে দিন বৈঠকে আসতে পারেননি, তাঁর কোনও অসুখবিসুখ হয়েছে কি না, বা আর কোনও অসুবিধে দেখা দিয়েছে কি না, এ ব্যাপারে বন্ধুর মতন খোঁজখবর নেওয়া আর কী। এই যেমন, গত মাসে একদিন চন্দ্রকীর্তিবাবু এলেন না। কেন এলেন না, এ ব্যাপারে প্রশ্ন উঠতেই শাতকর্ণিবাবু বললেন, চন্দ্রকীর্তিবাবু আসবেন কী করে? তাঁর রোবটটা নাকি আগের দিন তাঁকে এক চড় কষিয়ে দিয়েছে। (ব্যাপারটা আসলে, রোবটের হাতটা হঠাৎ নীচে নেমে পড়াতে চন্দ্রকীর্তিবাবুর কাঁধে লেগেছিল।)

সবাই আগ্রহে হাঁ-হাঁ করে উঠলেন। শীলভদ্রবাবু বললেন, রোবট তো বিনে কারণে এরকম করে না। নিশ্চয় চাঁদুবাবুর কিছু অস্বাভাবিকতা দেখেছিল সে।

একদিন চন্দ্রকীর্তিবাবুকে বাজারে জিনিসপত্রের দামের ব্যাপারে গজগজ করতে দেখেছিলাম আমি। সে কথা বলতেই সবাই প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলেন, বলেন কী! চাঁদুবাবুর মাথার গোলমাল আরম্ভ হয়েছে নাকি?

বাণভট্টবাবু বললেন, চাঁদুবাবুকে ছেলেবেলায় একবার উঁদুরে কামড়েছিল। চাঁদুবাবু নিজে এ কথা বলেছিলেন।

সবাই তা-ই শুনে বিস্ফারিত চোখে পরস্পরের দিকে তাকালেন। বৈঠক শেষ হওয়ার সময় আমরা মোটামুটি জেনে গেলাম, চন্দ্রকীর্তিবাবু বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন।

এরকম বিষয় থাকলে ক্লাবের বৈঠক ভাঙতে বেশ রাত হয়ে যায়। আমাদেরই ক্লাবে এক সদস্যের কুশলসংবাদ বলে কথা!

সাত্যকিবাবুর মতন একজন বিজ্ঞানীকে সংবর্ধনা জানানোর মতো ব্যাপারটা অবশ্য শনিচক্রে প্রথম। ডক্টর সাত্যকি নোম আমাদের ক্লাবের সদস্য নন। তবুও আমরা সর্বসম্মতিক্রমে এই প্রস্তাব নিলাম। আমাদের আমন্ত্রণে আর অনুরোধে এক শনিবার তিনি আমাদের ক্লাবে এলেন।

সে দিন অনুষ্ঠানে সভাপতি হলেন আমাদের প্রবীণতম সদস্য সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডক্টর দ্বৈপায়ন বসু। তিনি প্রথমেই সাত্যকিবাবুকে তাঁর অমূল্য সময় নষ্ট করে আমাদের মধ্যে উপস্থিত হওয়ার জন্যে এক গোগুলপ্লেক্স ধন্যবাদ দিলেন। একের পরে একশোটা শূন্য দিলে যে বিরাট সংখ্যাটি হয়, তা হল এক গোগুল। আর গোগুলপ্লেক্স হচ্ছে এক অকল্পনীয় মহাসংখ্যা। কয়েক কোটি কিলোমিটার লম্বা কাগজ দিলেও সেই সংখ্যাটা লেখা যাবে না। তাই সাত্যকিবাবু শুধু একটু মৃদু হাসলেন। সব কিছুতেই তিনি এরকম মৃদু হাসেন। তাতে দ্বৈপায়নবাবু যেন একটু থতমত খেলেন, মনে হল। তিনি আর বেশি কিছু না বলে শনিচক্রের তরফ থেকে একটি উপহার সাত্যকি সোমের হাতে তুলে দিলেন।

এবার আমরা তাঁকে নানারকম প্রশ্ন করতে লাগলাম। সবই তাঁর গবেষণা সম্পর্কে। আমাদের মধ্যে তাঁর গবেষণা বোঝার মতো বিজ্ঞানী কেউ নেই। তাই একটার উত্তর পাওয়ার আগেই আরও অনেক প্রশ্ন ছুটে এল। এবার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা না করে সাত্যকিবাবু ফের একটু মৃদু হাসলেন। তাতেই কাজ হল। একটি বর্ণপরিচয়-পড়া শিশুকে বীজগণিতের বই খুলতে দেখলে আমরা যেরকম কৌতুক বোধ করে হাসি, সাত্যকিবাবুর হাসিটাও আমাদের কাছে সেইরকম লাগল।

সাত্যকিবাবু লোক হিসেবে অত্যন্ত ভদ্র। আমাদের মনোভাব বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি বললেন, আপনারা আমার যে কাজে আগ্রহ বোধ করবেন, সেরকম একটা সৃষ্টির কথা আমি আপনাদের বলছি। আমি একটা রোবট তৈরি করেছি।

আমরা সবাই অবাক হয়ে পরস্পরের মুখের দিকে চাইলাম। রোবট তৈরি আবার একটা কাজ নাকি! এই শহরে রাস্তাঘাটেই তো কত রোবট ঘুরছে। ওই তো জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, পার্কে, একটি ছোট্ট মেয়ের হাত ধরে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে এক রোবট। অনেক বাড়িতেই রোবট আছে। কেউ রান্না করে, কেউ ছোট ছেলেমেয়েদের পড়ায়, কেউ খেলাধুলোর সঙ্গী হয়।

আমাদের মনের কথা যেন এবারেও বুঝতে পারলেন সাত্যকিবাবু। বললেন, আমার রোবট সাধারণ কর্মী-রোবট নয়। ওটা হুবহু একটা মানুষের মতন। একজন মানুষের যা দোষগুণ–সেই সাহস, ভয়, লজ্জা, ক্রোধ, ভদ্রতা–সব কিছুই তার আছে। বলতে গেলে, সে আপনার-আমার মতন সাধারণ একজন মানুষ।

আমরা সবাই মিলে সমস্বরে বলে উঠলাম, কী আশ্চর্য! অদ্ভুত! আপনি সত্যিই একজন মহৎ প্রতিভা, ডক্টর সোম!

সাত্যকিবাবু একটু মুচকি হেসে বললেন, এই যে প্রত্যেকটি দোষগুণ বা মানসিক অবস্থা, যা-ই বলুন-না কেন, তার জন্যে রোবটের মাথায় লাগানো আছে ফিউজের মতন আলাদা আলাদা ক্যাপসুল। প্রত্যেকটার জন্যে আলাদা সুইচও আছে, আবার একটা মেন সুইচও আছে। সব একসঙ্গে কাজ করলে রোবটটা একটা সাধারণ মানুষের মতোই ব্যবহার করে।

একটু থেমে সাত্যকিবাবু আবার বললেন, এইসব মানসিক প্রবৃত্তির ক্যাপসুল কীসের থেকে তৈরি করেছি জানেন? নানারকম জীবজন্তুর রক্ত নিয়ে। যেমন, শেয়ালের দেহ থেকে কয়েক ফোঁটা রক্ত নিয়ে ভয় আর চুরির প্রবৃত্তির ক্যাপসুলটা তৈরি করেছি। যাতে অন্য ক্যাপসুলের সঙ্গে গুলিয়ে না যায়, তার জন্যে ওই ক্যাপসুল আর সুইচের ওপর ছোট্ট করে ভ-চু অক্ষর দুটো লেখা আছে। ঠিক তেমনি বনশুয়োরের রক্ত থেকে গোঁ, কুকুরের রক্ত থেকে বিশ্বাস আর দাসত্ব বা বি-দা–এইসব ক্যাপসুল করেছি। ইচ্ছে করলে একেকটা সুইচ বন্ধ রেখে আমি নরোত্তমকে একেকরকম মেজাজে আনি। ও, বলতে ভুলে গেছি, আমার রোবটের নাম নরোত্তম। কাজের অবসরে কিছু গল্পগুজব করে মাথাটাকে হালকা করে নেওয়ার জন্যেই একজন সাধারণ আর স্বাভাবিক মানুষের মতন নরোত্তমকে সৃষ্টি করেছি। আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন, সে তো আমি যে-কোনও বন্ধুবান্ধব বা পরিচিতজনের সঙ্গে গল্প করেও আনন্দ পেতে পারি। না। দেখেছি, তাঁরা আমার সুবিধামতো সময়ে আসেন না। বরং আমি যখন ব্যস্ত, তখন এসে তাঁরা অসুবিধারই সৃষ্টি করেন। তা ছাড়া… সাত্যকি সোম ছোট্ট একটু হেসে বললেন, নরোত্তম আমার দরকারমতো থামতে বা বিদায় নিতেও পারে। তা আপনারা একদিন দেখে আসবেন ওকে।

আমরা একসঙ্গে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলাম, অবশ্যই, অবশ্যই!

দ্বৈপায়নবাবু দুলে দুলে বলেই চললেন। জানি না, এক গোগুল অবশ্যই বলে থামবেন কি না। তার আগেই সাত্যকি সোম উঠে পড়ে সবাইকে নমস্কার জানিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন।

এবার আড্ডায় পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনা হবে। প্রথমেই আমি উচ্চকণ্ঠে হোঃ-হো করে হেসে উঠে বললাম, বুড়োর এবার মাথা খারাপ হয়েছে। নইলে, খেয়েদেয়ে কাজ নেই, একটা মানুষের মতন নিষ্কর্মা রোবট তৈরি করেছে! কী, না তাকে হাসাই, কাঁদাই, রাগাই, ভয় দেখাই। গবেষণাটবেষনা সব চুলোয় গিয়েছে বোধহয়।

উপগুপ্ত মল্লিক হেসে বললেন, দ্যাখো, আসলে রোবটই কি না। সাতু-বুড়ো হয়তো যন্তরের ভেতরে কোনও মানুষকেই ভরে রেখেছে।

আমি এবার টেবিলে ঘুসি মেরে বললাম, যদি সত্যিই খামখেয়ালি করে এরকম একটা অকর্মণ্য রোবট তৈরি করে থাকে বুড়ো, তবে সেটা হচ্ছে বৈজ্ঞানিক শক্তির অপচয়। এসব লোককে ধরে…।

কথা শেষ হল না। দেখি, দরজার মুখে সাত্যকি সোম। আমার মুখের রক্ত যে সরে যাচ্ছে, সেটা আমি বেশ বুঝতে পারলাম। সাত্যকি সোমের মুখে কিন্তু সেই একই রকম মৃদু হাসি। তিনি কি আমার কথা শুনতে পেয়েছেন? তাঁর আচরণে কিন্তু কিছু বোঝা গেল না। সবাইকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, দয়া করে যাওয়ার আগে একবার টেলিফোন করবেন। নরোত্তমই বলে দেবে, কোন সময়ে গেলে আমার সুবিধে। নমস্কার।

কিছুক্ষণ সবাই চুপ। জানলা দিয়ে উঁকি মেরে ধৃতরাষ্ট্র মণ্ডল দেখলেন, সাত্যকি সোম পার্কের বাইরে চলে যাচ্ছেন। দেখার পর নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি বললেন, তাহলে যাচ্ছেন কবে আপনারা নরোত্তম মহাশয়কে দর্শন করতে?

প্রায় একসঙ্গেই সবাই বলে উঠলেন, খেপেছেন! যেরকম শুয়োর আর শেয়ালের কথা শুনলাম, গুতিয়ে বা কামড়ে দিলেই গেছি।

আমি কোনও কথা বললাম না। যে লজ্জা আর অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যে পড়েছিলাম, সেটা আমার তখনও কাটেনি।

পরদিন ভাবলাম, দেখেই আসি-না একবার সাত্যকি সোমের রোবটকে। ডক্টর সোম যেরকম আত্মভোলা লোক, তাতে হয়তো আমার কথাগুলো শুনে থাকলেও মনে রাখেননি। তা ছাড়া শনিচক্রের সদস্যদের মধ্যে একমাত্র আমিই তাঁর রোবটকে দেখতে যাচ্ছি, এতে হয়তো আমার ওপর খুশিও হতে পারেন।

টেলিফোন করতেই নরোত্তম ধরল। বোতাম টিপে ফোনোভিশনের পর্দায় তার মুখটাও দেখতে পেলাম। ধাতুর তৈরি হলেও সুশ্রী। অন্য সব রোবটের মতন কাঠখোট্টা নয়। মুখমণ্ডলটা বোধহয় সাত্যকিবাবু তাঁর বাল্যবন্ধু ভাস্কর অগ্নিদেব চৌধুরীকে দিয়েই তৈরি করিয়েছেন। নরোত্তম কথাবার্তাতেও চৌকশ। আমার মাথার চকচকে টাক আর মাথার পেছনের পাকা চুল বোধহয় সে-ও তার কোনোভিশনে দেখে নিয়েছিল। বলল, চলে আসুন-না দাদু এখনই। স্যার এখন ব্রেকফাস্ট খাচ্ছেন। তারপরে আমাকে নিয়ে পড়বেন কিছুক্ষণ। কাজেই আপনিও চলে আসুন। এক ঢিলে… এক ঢিলে.. এক ঢিলে..

আমি বললাম, এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে, এই বলছ তো?

নরোত্তম হেসে বলল, ঠিক তা-ই। আমার মাথায় প্রবাদ ডিভাইস ইউনিটের কানেকশনটা মাঝে মাঝে আলগা হয়ে যায়, বুঝেছেন? স্যারকে বলব ভাবি, কিন্তু ভুলে যাই। ভুলের ক্যাপসুলটা বড় জোরদার করেছে আমার। কীসের রক্ত দিয়ে কে জানে! হয়তো রামছাগলের।

নরোত্তম চুপ করল। আমি দু-একটা কথা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সাড়া পেলাম না। কিছুক্ষণ পরে নরোত্তম শুধু বলল, এখন আর কোনও কথা নয়। আবার আপনি এলে।

বেরোচ্ছি-বেরোচ্ছি করেও সাত্যকিবাবুর বাড়ি যেতে একটু দেরি হয়ে গেল। ঠিক সময়ে কোথাও যাওয়া আমার ধাতে নেই। গিয়ে দেখলাম, সাত্যকিবাবু বৈঠকখানার ঘরে আমার জন্যই অপেক্ষা করছেন। এক কোণে নারোত্তম একেবারে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে। মেন সুইচ অফ করা ছিল।

সাত্যকিবাবু আমাকে রোবটের কাছে নিয়ে গিয়ে তার মাথার দিকে তাকাতে বললেন। সারা মাথায় মোটা মোটা শজারু-কাঁটার মতন চুল বলে দূর থেকে যেগুলোকে ভেবেছিলাম, সেগুলোই যে নানারকম স্বভাবের ক্যাপসুল, সেটা এবার কাছ থেকে বুঝতে পারলাম। প্রত্যেকটার গায়ে ছোট ছোট অক্ষরে কী সব লেখা। যেমন, একটার ওপর দেখলাম, অধ্য শব্দটা লেখা আছে। সাত্যকিবাবু বুঝিয়ে দিলেন, এটার অর্থ অধ্যবসায়। মৌমাছির রক্ত বা রস নিয়ে এটার ক্যাপসুল তৈরি।

মানুষের রক্ত দিয়ে কোনও ক্যাপসুল করা হয়েছে কি না জিজ্ঞেস করতে সাত্যকিবাবু বললেন, না, একই শ্রেণির জন্তু, পাখি বা কীট একই রকম ব্যবহার করে। মানুষের বেলায় তো এটা হয় না। যে লোকটা চুরি করে, সে হয়তো কোথাও দানও করে থাকে। তাই কোনও মানুষ সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ না হয়ে তার রক্ত কাজে লাগাই কী করে?

এরপর তিনি মেন সুইচটা অন করে দিলেন। পাছে নরোত্তম অতিথিকে কোনও কিছু অসম্মানজনক কথা বলে, সে জন্যে রাগের সুইচটা বুদ্ধি করে আগেভাগেই অফ করে রাখলেন সাত্যকি সোম।

মুহূর্তে রোবটটা জ্যান্ত হয়ে উঠল। সে আমার দিকে তাকাল। কিন্তু ফোনোভিশনে তার যে হাসিখুশি মুখ দেখেছিলাম, এটা যেন সেরকম নয়। বরং এর দৃষ্টিতে বুঝি মিশে ছিল একটু বিরক্তি আর অপ্রসন্নতা।

সাত্যকি সোমকে বললাম, আমি এসে হয়তো আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম। আপনার মতন একজন…

সাত্যকি সোম স্বভাবসুলভদ্রতায় বোধহয় প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই নরোত্তম মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠল, সেটা যখন জানেনই, তখন ন্যাকামি করে আরও সময় নষ্ট করছেন কেন? কেটে পড়ন-না। স্যার এখন কাজে বসবেন। যখন আসতে বলেছিলাম, তখনই এলেন না কেন? মহাকাজ ছিল?

আর কিছু বলার আগেই সাত্যকি সোমের কণ্ঠস্বর গর্জে উঠল, নরোত্তম! চুপ কর! তোর সুইচ এখনই অফ করে দিচ্ছি।

বলার সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিকের মতন ফল হল। তার মাথার ভ-চু ক্যাপসুলের মধ্যে ছোট্ট একটা আলো জ্বলে উঠে কাঁপতে কাঁপতে আবার নিবে গেল। নরোত্তমের কণ্ঠও কেঁপে উঠল। সে বলল, ক্ষমা করুন স্যার। আমার মাথার ম-এ-মু-আ ক্যাপসুলটা বোধহয় খুলে গিয়েছে।

সে কী! বলে সাত্যকি সোম লাফ দিয়ে উঠলেন। তাড়াতাড়ি মেন সুইচটা অফ করে দিলেন নরোত্তমের আপত্তি সত্ত্বেও। তারপর রোবটের কাছে গিয়ে দেখলেন, সত্যিই একটা ক্যাপসুল ভেঙে মেঝের ওপর পড়ে আছে। ওপরে লেবেল আঁটা ম-এ-মু-আ।

ভাঙা ক্যাপসুলটা হাতে নিয়ে সাত্যকিবাবু আমার পাশে তাঁর চেয়ারে এসে আবার বসলেন। বললেন, এটা হল ভদ্রতার ক্যাপসুল। এটা তৈরি করেছিলাম বেড়ালের এক ফোঁটা রক্ত নিয়ে। আমার বেড়ালের নাম কাবলি। আমার খাওয়ার সময় সে পাশে এমনভাবে চোখ বুজে বসে থাকে, যেন হরিনাম জপ করছে। আসলে যে তার মাথায় খেলছে চুরির মতলব, সেটা বোঝা যায় আমি একটু অন্যদিকে তাকালেই। ম্যাজিকের মতন দেখি আমার পাতের মাছ কাবলির মুখে। তাই ভাবলাম, এত ভদ্র বেড়াল যখন, ওর রক্ত দিয়ে এই ম-এ-মু-আ ক্যাপসুলটা করা যাক। বলে এবার একটু শব্দ করেই হাসলেন সাত্যকি সোম।

আমার কান লাল হয়ে উঠেছিল নরোত্তমের কথায়। সে দিন শনিচক্রে আমার নিজের কথাগুলো মনে পড়ে গেল। নরোত্তম সামনাসামনি বলল, আর আমি আড়ালে বলতে গিয়ে ধরা পড়েছিলাম। তাই সাত্যকি সোম যখন বোঝালেন যে, ভদ্রতার ক্যাপসুলটা ভেঙে যাওয়াতে আমার যে অসম্মান হল, তাতে তিনি কতখানি লজ্জিত আর মর্মাহত, তখন আমাকে কেঠো হাসি হেসে বলতে হল, না, না। এতে মনে করার কী আছে? নরোত্তম একটা যন্ত্র বই তো কিছু না ইত্যাদি ইত্যাদি।

ড্রয়ার থেকে একটা তরল পদার্থভরা ক্যাপসুল বের করে সাত্যকিবাবু বলেন, বিদুরবাবু, আপনি যদি একটু সাহায্য করেন, তবে আমার উপকার হয়। আপনার আঙুলে সুচ ফুটিয়ে এক ফোঁটা রক্ত নেব আমি। সেটা এই ক্যাপসুলের তরল পদার্থে মিশিয়ে নরোত্তমের মাথার মুডো-ইনভার্টর খোপে এঁটে দেব। দেখবেন, ও আবার কেমন ভদ্র হয়ে যায়। যে-কোনও লোকের রক্ত তো নিতে পারি না। আপনার ভদ্রতার পরিচয় পেয়েছি, তাই নিশ্চিন্তে নিতে পারি। সাত্যকিবাবুর কথায় এতটা খুশি হলাম যে, মনে হল, তিনি যদি এক বোতল রক্ত চান, তা-ও বোধহয় দিতে পারি। কিন্তু তিনি এক ফোঁটা রক্তই নিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যাপসুল প্রস্তুত হয়ে গেল। এবার ছিপের ফাতনার মতন ক্যাপসুলটাকে মাথায় খুঁজে দেওয়ার অপেক্ষা।

সাত্যকি সোম কিন্তু তার আগেই ভুল করে রোবটের মেন সুইচটা অন করে দিলেন। নরোত্তম আবার জ্যান্ত হয়ে উঠল। সাত্যকি সোম ক্যাপসুলটা নিয়ে এগোতে এগোতে বললেন, দাঁড়া নরোত্তম। ভদ্রতার ক্যাপসুলটা রেডি করেছি। বিদুরবাবুর মতন তোকেও একজন ভদ্র সভ্য ব্যক্তি হতে হবে।

নরোত্তমও হেসে উঠল, ওঁর রক্ত নিয়েছেন বুঝি, স্যার? তবে ম-এ-মু-আ ক্যাপসুলটাকে মিছিমিছি ভদ্রতার ক্যাপসুল কেন বলছেন? নামটা বলেই দিন-না–মনে এক, মুখে আর। বিদুরবাবুরও বুঝি তা-ই?

আরও কিছু বলার আগেই অপদস্থ সাত্যকি সোম ছুটে গিয়ে ক্যাপসুলটা রোবটের মাথায় লাগিয়ে দিলেন।

ততক্ষণে আমার কান শুধু নয়, সমস্ত মুখ লাল হয়ে উঠেছে অপমানে। মনে হল, রোবটকে দিয়ে সাত্যকি সোম ইচ্ছে করেই আমাকে অপমান করালেন। আমারই রক্ত দিয়ে ক্যাপসুল তৈরি করে সে দিনকার শনিচক্রের ঘটনার প্রতিশোধ নিলেন তিনি।

আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে বাইরের দিকে পা বাড়ালাম। সাত্যকিবাবু কোনও বাধা না দিয়ে অন্যদিকে ফিরে রইলেন মাথা নিচু করে। কতই যেন লজ্জা পেয়েছেন, এমন ভান করলেন। রাগে গা জ্বলে গেল।

অবশ্য নরোত্তমের মাথায় ক্যাপসুলটা তখন লাগানো হয়ে গিয়েছিল। ঘরের বাইরে পা ফেলতেই শুনলাম নরোত্তমের কণ্ঠস্বর, চললেন নাকি দাদু? একটু চা খাবেন না? অবিশ্যি এত বেলায় চা না খেয়েই কি বেরিয়েছেন? বড়ই আনন্দ পেলাম। আরেকদিন আসবেন।

কয়েক পা সিঁড়ি নামতেই নরোত্তমের উচ্চকণ্ঠের হাসি শুনলাম। তারপর সে বলে উঠল (বোঝাই গেল, সাত্যকি সোমকে বলছে), রাগছেন কেন স্যার? ঠিকই করেছি। যেমন বুনো ওল, তেমনি বাঘা…বাঘা…বাঘা…

প্রবাদ ডিভাইস ইউনিটের কানেকশনটা আবার বোধহয় ফেল করতে শুরু করল।

[আনন্দমেলা, ৫ বৈশাখ ১৩৯১]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

নরোত্তম-সংবাদ
গল্প - রেবন্ত গোস্বামী
ছড়া - রেবন্ত গোস্বামী
সাক্ষাৎকার

নরোত্তম-সংবাদ

নরোত্তম-সংবাদ

ডক্টর সাত্যকি সোমের বাড়ি থেকে যে দিন ওরকমভাবে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এসেছিলাম, সে দিন লজ্জা আর অপমানে কান লাল হয়ে উঠেছিল ঠিকই, তবু তার চেয়েও বেশি আমাকে ধাক্কা দিয়েছিল একটা বিস্ময়। সাত্যকিবাবুর মতন একজন পণ্ডিত, নিখুঁত ভদ্রলোক, তিনিও যে আর-পাঁচজন সাধারণ লোকের মতন মনে মুখে দুই রূপ নিয়ে থাকেন, সেটা আমাকে আঘাত করেছিল। অবশ্য তিনি যে কৌশলে আমার ওপর ওভাবে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন, সেটা বিশ্বাস করতে এখনও মন চায় না। হয়তো সত্যিই সে দিন যান্ত্রিক গোলযোগের ফলে নরোত্তম ওরকম বাঁদরামি (নাকি, রোবটামি?) করেছিল।

শনিচক্রের সদস্য উদ্দালক রুদ্র একদিন বললেন, ডক্টর সোম নাকি কী এক কারণে, নরোত্তমের ওপর রেগে গিয়ে তার ফাঁসি দিয়েছেন। ডা. মল্লিক বললেন, ভেতরের লোকটা বোধহয় মাইনে বাড়াতে বলছিল। তা-ই শুনে সবাই হো-হো করে হেসে উঠলেন। আমি অবশ্য সেই ফাঁকে উঠে পড়েছিলাম। সদস্যরা আমার ব্যাপারটা জানেন না।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবলাম, সত্যিই নরোত্তমরা এ জগতে থাকতে পারে না। সাত্যকি সোম মিষ্টি কথার মোড়কে আমাকে ঠকাচ্ছিলেন। না জানতে পারলে কী এমন ক্ষতি হত আমার? নরোত্তম ধরিয়ে দিয়েই ফ্যাসাদ বাধাল।

তবে নরোত্তম আমার মধ্যে একটা পরিবর্তন এনেছে, সেটা বুঝতে পারি। আজও আমি শনিচক্রের বৈঠকে যাই। নির্দোষ আচ্ছা, আলোচনায় শরীর আর মন দুটোই ভালো থাকে। জ্ঞান বাড়ে। সমাজে থাকতে গেলে কচ্ছপের মতন খোলার মধ্যে থাকা যায় না। কিন্তু পারস্পরিক সম্পর্কের প্রসঙ্গটা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমিও উঠে পড়ি। ওটা আমার আর ভালো লাগে না। বুঝি যে, এর ফলে বেশির ভাগ দিনই আলোচনার বিষয়বস্তু হই আমি নিজেই। তাহলেও আমার মনে এসব আর দাগ কাটে না। আজ সাত্যকিবাবুর সঙ্গে দেখা হলে হয়তো বলতেও পারব, ডক্টর সোম, ওই ম-এ-মু-আ ক্যাপসুল তো আপনি যে কোনও লোকের রক্তেই করতে পারেন। এমনকী, আপনার নিজেরও…

ব্যাপারটা গুছিয়ে বলতে গেলে, শনিচক্র ক্লাবের কথা থেকেই শুরু করতে হয়। আমাদের পাড়ার পার্কটার কোণে প্রতি শনিবার সন্ধেবেলায় যে ফুটবলের মতন দেখতে ঘরটাকে দেখা যায়, ওটাই আমাদের শনিচক্রের আড্ডাখানা। সদস্যদের মধ্যে অধ্যাপক, আইনজীবী, অফিসকর্মী থেকে আরম্ভ করে আমার মতন স্বগৃহে ভোজন সেরে বনমহিষ বিতাড়নের কাজে দক্ষ লোক, সকলেই আছে। প্রতি শনিবার বিকেলে ক্লাবের এই ঘরটাকে জুড়ে তৈরি করা হয়। আবার বৈঠক হয়ে গেলে পার্কের এক রোবট দারোয়ান এসে কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘরটার টুকরোগুলো খুলে ফেলে খোলা অংশগুলো পার্কের একপাশে গুদামঘরে রেখে দেয়। তার জন্য কিছু ভাড়া অবশ্য ক্লাবটা দিয়ে থাকে। এভাবে তো আজকাল, এই একবিংশ শতাব্দীর শেষে, অনেক বাড়িঘরই তৈরি হচ্ছে।

শনিচক্রের এই ঘরটাকে তৈরি করেছিলেন আমাদেরই এক ইঞ্জিনিয়ার-বন্ধু অভিমন্যু রায়। ক্লাবঘরটা দেখতে অনেকটা শনি গ্রহেরই মতন। গোলাকার ঘরটা লাট্র আলের মতন একটা শিকের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তার চারপাশে কোনাকুনিভাবে যে বলয়টাকে দেখা যায়, সেটা আসলে নীচের থেকে ক্লাবঘরে ওঠবার চলন্ত সিঁড়ি বা এসকালেটর। এটা একপাশে ঘরটার দরজাটাকে এমনভাবে ছুঁয়ে গিয়েছে যে, এর সাহায্যে ওপরে উঠে ঘরে ঢুকতে কোনও অসুবিধেই নেই। এখনকার সব কিছুর মতন এটাও জমিয়ে রাখা সৌরশক্তিতেই কাজ করে।

যা-ই হোক, আমাদের বৈঠকে সব প্রসঙ্গই আলোচিত হয়। সাহিত্য, খেলাধুলো, অর্থনৈতিক সমস্যা–যেমন, সম্প্রতি মঙ্গল গ্রহে যাত্রায় অস্বাভাবিক ভাড়াবৃদ্ধি, বিচিত্র সংবাদ–যেমন, চাঁদে নতুন আবিষ্কৃত হিরের খনির কথা, ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে সব কিছুর পরে পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ক প্রসঙ্গটা থাকবেই। কারণ, এটা সবার প্রিয় বিষয়। যেমন, খাওয়ার শেষে চাটনি, দই আর মিষ্টি। এটা হল, যিনি সে দিন বৈঠকে আসতে পারেননি, তাঁর কোনও অসুখবিসুখ হয়েছে কি না, বা আর কোনও অসুবিধে দেখা দিয়েছে কি না, এ ব্যাপারে বন্ধুর মতন খোঁজখবর নেওয়া আর কী। এই যেমন, গত মাসে একদিন চন্দ্রকীর্তিবাবু এলেন না। কেন এলেন না, এ ব্যাপারে প্রশ্ন উঠতেই শাতকর্ণিবাবু বললেন, চন্দ্রকীর্তিবাবু আসবেন কী করে? তাঁর রোবটটা নাকি আগের দিন তাঁকে এক চড় কষিয়ে দিয়েছে। (ব্যাপারটা আসলে, রোবটের হাতটা হঠাৎ নীচে নেমে পড়াতে চন্দ্রকীর্তিবাবুর কাঁধে লেগেছিল।)

সবাই আগ্রহে হাঁ-হাঁ করে উঠলেন। শীলভদ্রবাবু বললেন, রোবট তো বিনে কারণে এরকম করে না। নিশ্চয় চাঁদুবাবুর কিছু অস্বাভাবিকতা দেখেছিল সে।

একদিন চন্দ্রকীর্তিবাবুকে বাজারে জিনিসপত্রের দামের ব্যাপারে গজগজ করতে দেখেছিলাম আমি। সে কথা বলতেই সবাই প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলেন, বলেন কী! চাঁদুবাবুর মাথার গোলমাল আরম্ভ হয়েছে নাকি?

বাণভট্টবাবু বললেন, চাঁদুবাবুকে ছেলেবেলায় একবার উঁদুরে কামড়েছিল। চাঁদুবাবু নিজে এ কথা বলেছিলেন।

সবাই তা-ই শুনে বিস্ফারিত চোখে পরস্পরের দিকে তাকালেন। বৈঠক শেষ হওয়ার সময় আমরা মোটামুটি জেনে গেলাম, চন্দ্রকীর্তিবাবু বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন।

এরকম বিষয় থাকলে ক্লাবের বৈঠক ভাঙতে বেশ রাত হয়ে যায়। আমাদেরই ক্লাবে এক সদস্যের কুশলসংবাদ বলে কথা!

সাত্যকিবাবুর মতন একজন বিজ্ঞানীকে সংবর্ধনা জানানোর মতো ব্যাপারটা অবশ্য শনিচক্রে প্রথম। ডক্টর সাত্যকি নোম আমাদের ক্লাবের সদস্য নন। তবুও আমরা সর্বসম্মতিক্রমে এই প্রস্তাব নিলাম। আমাদের আমন্ত্রণে আর অনুরোধে এক শনিবার তিনি আমাদের ক্লাবে এলেন।

সে দিন অনুষ্ঠানে সভাপতি হলেন আমাদের প্রবীণতম সদস্য সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডক্টর দ্বৈপায়ন বসু। তিনি প্রথমেই সাত্যকিবাবুকে তাঁর অমূল্য সময় নষ্ট করে আমাদের মধ্যে উপস্থিত হওয়ার জন্যে এক গোগুলপ্লেক্স ধন্যবাদ দিলেন। একের পরে একশোটা শূন্য দিলে যে বিরাট সংখ্যাটি হয়, তা হল এক গোগুল। আর গোগুলপ্লেক্স হচ্ছে এক অকল্পনীয় মহাসংখ্যা। কয়েক কোটি কিলোমিটার লম্বা কাগজ দিলেও সেই সংখ্যাটা লেখা যাবে না। তাই সাত্যকিবাবু শুধু একটু মৃদু হাসলেন। সব কিছুতেই তিনি এরকম মৃদু হাসেন। তাতে দ্বৈপায়নবাবু যেন একটু থতমত খেলেন, মনে হল। তিনি আর বেশি কিছু না বলে শনিচক্রের তরফ থেকে একটি উপহার সাত্যকি সোমের হাতে তুলে দিলেন।

এবার আমরা তাঁকে নানারকম প্রশ্ন করতে লাগলাম। সবই তাঁর গবেষণা সম্পর্কে। আমাদের মধ্যে তাঁর গবেষণা বোঝার মতো বিজ্ঞানী কেউ নেই। তাই একটার উত্তর পাওয়ার আগেই আরও অনেক প্রশ্ন ছুটে এল। এবার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা না করে সাত্যকিবাবু ফের একটু মৃদু হাসলেন। তাতেই কাজ হল। একটি বর্ণপরিচয়-পড়া শিশুকে বীজগণিতের বই খুলতে দেখলে আমরা যেরকম কৌতুক বোধ করে হাসি, সাত্যকিবাবুর হাসিটাও আমাদের কাছে সেইরকম লাগল।

সাত্যকিবাবু লোক হিসেবে অত্যন্ত ভদ্র। আমাদের মনোভাব বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি বললেন, আপনারা আমার যে কাজে আগ্রহ বোধ করবেন, সেরকম একটা সৃষ্টির কথা আমি আপনাদের বলছি। আমি একটা রোবট তৈরি করেছি।

আমরা সবাই অবাক হয়ে পরস্পরের মুখের দিকে চাইলাম। রোবট তৈরি আবার একটা কাজ নাকি! এই শহরে রাস্তাঘাটেই তো কত রোবট ঘুরছে। ওই তো জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, পার্কে, একটি ছোট্ট মেয়ের হাত ধরে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে এক রোবট। অনেক বাড়িতেই রোবট আছে। কেউ রান্না করে, কেউ ছোট ছেলেমেয়েদের পড়ায়, কেউ খেলাধুলোর সঙ্গী হয়।

আমাদের মনের কথা যেন এবারেও বুঝতে পারলেন সাত্যকিবাবু। বললেন, আমার রোবট সাধারণ কর্মী-রোবট নয়। ওটা হুবহু একটা মানুষের মতন। একজন মানুষের যা দোষগুণ–সেই সাহস, ভয়, লজ্জা, ক্রোধ, ভদ্রতা–সব কিছুই তার আছে। বলতে গেলে, সে আপনার-আমার মতন সাধারণ একজন মানুষ।

আমরা সবাই মিলে সমস্বরে বলে উঠলাম, কী আশ্চর্য! অদ্ভুত! আপনি সত্যিই একজন মহৎ প্রতিভা, ডক্টর সোম!

সাত্যকিবাবু একটু মুচকি হেসে বললেন, এই যে প্রত্যেকটি দোষগুণ বা মানসিক অবস্থা, যা-ই বলুন-না কেন, তার জন্যে রোবটের মাথায় লাগানো আছে ফিউজের মতন আলাদা আলাদা ক্যাপসুল। প্রত্যেকটার জন্যে আলাদা সুইচও আছে, আবার একটা মেন সুইচও আছে। সব একসঙ্গে কাজ করলে রোবটটা একটা সাধারণ মানুষের মতোই ব্যবহার করে।

একটু থেমে সাত্যকিবাবু আবার বললেন, এইসব মানসিক প্রবৃত্তির ক্যাপসুল কীসের থেকে তৈরি করেছি জানেন? নানারকম জীবজন্তুর রক্ত নিয়ে। যেমন, শেয়ালের দেহ থেকে কয়েক ফোঁটা রক্ত নিয়ে ভয় আর চুরির প্রবৃত্তির ক্যাপসুলটা তৈরি করেছি। যাতে অন্য ক্যাপসুলের সঙ্গে গুলিয়ে না যায়, তার জন্যে ওই ক্যাপসুল আর সুইচের ওপর ছোট্ট করে ভ-চু অক্ষর দুটো লেখা আছে। ঠিক তেমনি বনশুয়োরের রক্ত থেকে গোঁ, কুকুরের রক্ত থেকে বিশ্বাস আর দাসত্ব বা বি-দা–এইসব ক্যাপসুল করেছি। ইচ্ছে করলে একেকটা সুইচ বন্ধ রেখে আমি নরোত্তমকে একেকরকম মেজাজে আনি। ও, বলতে ভুলে গেছি, আমার রোবটের নাম নরোত্তম। কাজের অবসরে কিছু গল্পগুজব করে মাথাটাকে হালকা করে নেওয়ার জন্যেই একজন সাধারণ আর স্বাভাবিক মানুষের মতন নরোত্তমকে সৃষ্টি করেছি। আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন, সে তো আমি যে-কোনও বন্ধুবান্ধব বা পরিচিতজনের সঙ্গে গল্প করেও আনন্দ পেতে পারি। না। দেখেছি, তাঁরা আমার সুবিধামতো সময়ে আসেন না। বরং আমি যখন ব্যস্ত, তখন এসে তাঁরা অসুবিধারই সৃষ্টি করেন। তা ছাড়া… সাত্যকি সোম ছোট্ট একটু হেসে বললেন, নরোত্তম আমার দরকারমতো থামতে বা বিদায় নিতেও পারে। তা আপনারা একদিন দেখে আসবেন ওকে।

আমরা একসঙ্গে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলাম, অবশ্যই, অবশ্যই!

দ্বৈপায়নবাবু দুলে দুলে বলেই চললেন। জানি না, এক গোগুল অবশ্যই বলে থামবেন কি না। তার আগেই সাত্যকি সোম উঠে পড়ে সবাইকে নমস্কার জানিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন।

এবার আড্ডায় পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনা হবে। প্রথমেই আমি উচ্চকণ্ঠে হোঃ-হো করে হেসে উঠে বললাম, বুড়োর এবার মাথা খারাপ হয়েছে। নইলে, খেয়েদেয়ে কাজ নেই, একটা মানুষের মতন নিষ্কর্মা রোবট তৈরি করেছে! কী, না তাকে হাসাই, কাঁদাই, রাগাই, ভয় দেখাই। গবেষণাটবেষনা সব চুলোয় গিয়েছে বোধহয়।

উপগুপ্ত মল্লিক হেসে বললেন, দ্যাখো, আসলে রোবটই কি না। সাতু-বুড়ো হয়তো যন্তরের ভেতরে কোনও মানুষকেই ভরে রেখেছে।

আমি এবার টেবিলে ঘুসি মেরে বললাম, যদি সত্যিই খামখেয়ালি করে এরকম একটা অকর্মণ্য রোবট তৈরি করে থাকে বুড়ো, তবে সেটা হচ্ছে বৈজ্ঞানিক শক্তির অপচয়। এসব লোককে ধরে…।

কথা শেষ হল না। দেখি, দরজার মুখে সাত্যকি সোম। আমার মুখের রক্ত যে সরে যাচ্ছে, সেটা আমি বেশ বুঝতে পারলাম। সাত্যকি সোমের মুখে কিন্তু সেই একই রকম মৃদু হাসি। তিনি কি আমার কথা শুনতে পেয়েছেন? তাঁর আচরণে কিন্তু কিছু বোঝা গেল না। সবাইকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, দয়া করে যাওয়ার আগে একবার টেলিফোন করবেন। নরোত্তমই বলে দেবে, কোন সময়ে গেলে আমার সুবিধে। নমস্কার।

কিছুক্ষণ সবাই চুপ। জানলা দিয়ে উঁকি মেরে ধৃতরাষ্ট্র মণ্ডল দেখলেন, সাত্যকি সোম পার্কের বাইরে চলে যাচ্ছেন। দেখার পর নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি বললেন, তাহলে যাচ্ছেন কবে আপনারা নরোত্তম মহাশয়কে দর্শন করতে?

প্রায় একসঙ্গেই সবাই বলে উঠলেন, খেপেছেন! যেরকম শুয়োর আর শেয়ালের কথা শুনলাম, গুতিয়ে বা কামড়ে দিলেই গেছি।

আমি কোনও কথা বললাম না। যে লজ্জা আর অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যে পড়েছিলাম, সেটা আমার তখনও কাটেনি।

পরদিন ভাবলাম, দেখেই আসি-না একবার সাত্যকি সোমের রোবটকে। ডক্টর সোম যেরকম আত্মভোলা লোক, তাতে হয়তো আমার কথাগুলো শুনে থাকলেও মনে রাখেননি। তা ছাড়া শনিচক্রের সদস্যদের মধ্যে একমাত্র আমিই তাঁর রোবটকে দেখতে যাচ্ছি, এতে হয়তো আমার ওপর খুশিও হতে পারেন।

টেলিফোন করতেই নরোত্তম ধরল। বোতাম টিপে ফোনোভিশনের পর্দায় তার মুখটাও দেখতে পেলাম। ধাতুর তৈরি হলেও সুশ্রী। অন্য সব রোবটের মতন কাঠখোট্টা নয়। মুখমণ্ডলটা বোধহয় সাত্যকিবাবু তাঁর বাল্যবন্ধু ভাস্কর অগ্নিদেব চৌধুরীকে দিয়েই তৈরি করিয়েছেন। নরোত্তম কথাবার্তাতেও চৌকশ। আমার মাথার চকচকে টাক আর মাথার পেছনের পাকা চুল বোধহয় সে-ও তার কোনোভিশনে দেখে নিয়েছিল। বলল, চলে আসুন-না দাদু এখনই। স্যার এখন ব্রেকফাস্ট খাচ্ছেন। তারপরে আমাকে নিয়ে পড়বেন কিছুক্ষণ। কাজেই আপনিও চলে আসুন। এক ঢিলে… এক ঢিলে.. এক ঢিলে..

আমি বললাম, এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে, এই বলছ তো?

নরোত্তম হেসে বলল, ঠিক তা-ই। আমার মাথায় প্রবাদ ডিভাইস ইউনিটের কানেকশনটা মাঝে মাঝে আলগা হয়ে যায়, বুঝেছেন? স্যারকে বলব ভাবি, কিন্তু ভুলে যাই। ভুলের ক্যাপসুলটা বড় জোরদার করেছে আমার। কীসের রক্ত দিয়ে কে জানে! হয়তো রামছাগলের।

নরোত্তম চুপ করল। আমি দু-একটা কথা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সাড়া পেলাম না। কিছুক্ষণ পরে নরোত্তম শুধু বলল, এখন আর কোনও কথা নয়। আবার আপনি এলে।

বেরোচ্ছি-বেরোচ্ছি করেও সাত্যকিবাবুর বাড়ি যেতে একটু দেরি হয়ে গেল। ঠিক সময়ে কোথাও যাওয়া আমার ধাতে নেই। গিয়ে দেখলাম, সাত্যকিবাবু বৈঠকখানার ঘরে আমার জন্যই অপেক্ষা করছেন। এক কোণে নারোত্তম একেবারে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে। মেন সুইচ অফ করা ছিল।

সাত্যকিবাবু আমাকে রোবটের কাছে নিয়ে গিয়ে তার মাথার দিকে তাকাতে বললেন। সারা মাথায় মোটা মোটা শজারু-কাঁটার মতন চুল বলে দূর থেকে যেগুলোকে ভেবেছিলাম, সেগুলোই যে নানারকম স্বভাবের ক্যাপসুল, সেটা এবার কাছ থেকে বুঝতে পারলাম। প্রত্যেকটার গায়ে ছোট ছোট অক্ষরে কী সব লেখা। যেমন, একটার ওপর দেখলাম, অধ্য শব্দটা লেখা আছে। সাত্যকিবাবু বুঝিয়ে দিলেন, এটার অর্থ অধ্যবসায়। মৌমাছির রক্ত বা রস নিয়ে এটার ক্যাপসুল তৈরি।

মানুষের রক্ত দিয়ে কোনও ক্যাপসুল করা হয়েছে কি না জিজ্ঞেস করতে সাত্যকিবাবু বললেন, না, একই শ্রেণির জন্তু, পাখি বা কীট একই রকম ব্যবহার করে। মানুষের বেলায় তো এটা হয় না। যে লোকটা চুরি করে, সে হয়তো কোথাও দানও করে থাকে। তাই কোনও মানুষ সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ না হয়ে তার রক্ত কাজে লাগাই কী করে?

এরপর তিনি মেন সুইচটা অন করে দিলেন। পাছে নরোত্তম অতিথিকে কোনও কিছু অসম্মানজনক কথা বলে, সে জন্যে রাগের সুইচটা বুদ্ধি করে আগেভাগেই অফ করে রাখলেন সাত্যকি সোম।

মুহূর্তে রোবটটা জ্যান্ত হয়ে উঠল। সে আমার দিকে তাকাল। কিন্তু ফোনোভিশনে তার যে হাসিখুশি মুখ দেখেছিলাম, এটা যেন সেরকম নয়। বরং এর দৃষ্টিতে বুঝি মিশে ছিল একটু বিরক্তি আর অপ্রসন্নতা।

সাত্যকি সোমকে বললাম, আমি এসে হয়তো আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম। আপনার মতন একজন…

সাত্যকি সোম স্বভাবসুলভদ্রতায় বোধহয় প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই নরোত্তম মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠল, সেটা যখন জানেনই, তখন ন্যাকামি করে আরও সময় নষ্ট করছেন কেন? কেটে পড়ন-না। স্যার এখন কাজে বসবেন। যখন আসতে বলেছিলাম, তখনই এলেন না কেন? মহাকাজ ছিল?

আর কিছু বলার আগেই সাত্যকি সোমের কণ্ঠস্বর গর্জে উঠল, নরোত্তম! চুপ কর! তোর সুইচ এখনই অফ করে দিচ্ছি।

বলার সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিকের মতন ফল হল। তার মাথার ভ-চু ক্যাপসুলের মধ্যে ছোট্ট একটা আলো জ্বলে উঠে কাঁপতে কাঁপতে আবার নিবে গেল। নরোত্তমের কণ্ঠও কেঁপে উঠল। সে বলল, ক্ষমা করুন স্যার। আমার মাথার ম-এ-মু-আ ক্যাপসুলটা বোধহয় খুলে গিয়েছে।

সে কী! বলে সাত্যকি সোম লাফ দিয়ে উঠলেন। তাড়াতাড়ি মেন সুইচটা অফ করে দিলেন নরোত্তমের আপত্তি সত্ত্বেও। তারপর রোবটের কাছে গিয়ে দেখলেন, সত্যিই একটা ক্যাপসুল ভেঙে মেঝের ওপর পড়ে আছে। ওপরে লেবেল আঁটা ম-এ-মু-আ।

ভাঙা ক্যাপসুলটা হাতে নিয়ে সাত্যকিবাবু আমার পাশে তাঁর চেয়ারে এসে আবার বসলেন। বললেন, এটা হল ভদ্রতার ক্যাপসুল। এটা তৈরি করেছিলাম বেড়ালের এক ফোঁটা রক্ত নিয়ে। আমার বেড়ালের নাম কাবলি। আমার খাওয়ার সময় সে পাশে এমনভাবে চোখ বুজে বসে থাকে, যেন হরিনাম জপ করছে। আসলে যে তার মাথায় খেলছে চুরির মতলব, সেটা বোঝা যায় আমি একটু অন্যদিকে তাকালেই। ম্যাজিকের মতন দেখি আমার পাতের মাছ কাবলির মুখে। তাই ভাবলাম, এত ভদ্র বেড়াল যখন, ওর রক্ত দিয়ে এই ম-এ-মু-আ ক্যাপসুলটা করা যাক। বলে এবার একটু শব্দ করেই হাসলেন সাত্যকি সোম।

আমার কান লাল হয়ে উঠেছিল নরোত্তমের কথায়। সে দিন শনিচক্রে আমার নিজের কথাগুলো মনে পড়ে গেল। নরোত্তম সামনাসামনি বলল, আর আমি আড়ালে বলতে গিয়ে ধরা পড়েছিলাম। তাই সাত্যকি সোম যখন বোঝালেন যে, ভদ্রতার ক্যাপসুলটা ভেঙে যাওয়াতে আমার যে অসম্মান হল, তাতে তিনি কতখানি লজ্জিত আর মর্মাহত, তখন আমাকে কেঠো হাসি হেসে বলতে হল, না, না। এতে মনে করার কী আছে? নরোত্তম একটা যন্ত্র বই তো কিছু না ইত্যাদি ইত্যাদি।

ড্রয়ার থেকে একটা তরল পদার্থভরা ক্যাপসুল বের করে সাত্যকিবাবু বলেন, বিদুরবাবু, আপনি যদি একটু সাহায্য করেন, তবে আমার উপকার হয়। আপনার আঙুলে সুচ ফুটিয়ে এক ফোঁটা রক্ত নেব আমি। সেটা এই ক্যাপসুলের তরল পদার্থে মিশিয়ে নরোত্তমের মাথার মুডো-ইনভার্টর খোপে এঁটে দেব। দেখবেন, ও আবার কেমন ভদ্র হয়ে যায়। যে-কোনও লোকের রক্ত তো নিতে পারি না। আপনার ভদ্রতার পরিচয় পেয়েছি, তাই নিশ্চিন্তে নিতে পারি। সাত্যকিবাবুর কথায় এতটা খুশি হলাম যে, মনে হল, তিনি যদি এক বোতল রক্ত চান, তা-ও বোধহয় দিতে পারি। কিন্তু তিনি এক ফোঁটা রক্তই নিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যাপসুল প্রস্তুত হয়ে গেল। এবার ছিপের ফাতনার মতন ক্যাপসুলটাকে মাথায় খুঁজে দেওয়ার অপেক্ষা।

সাত্যকি সোম কিন্তু তার আগেই ভুল করে রোবটের মেন সুইচটা অন করে দিলেন। নরোত্তম আবার জ্যান্ত হয়ে উঠল। সাত্যকি সোম ক্যাপসুলটা নিয়ে এগোতে এগোতে বললেন, দাঁড়া নরোত্তম। ভদ্রতার ক্যাপসুলটা রেডি করেছি। বিদুরবাবুর মতন তোকেও একজন ভদ্র সভ্য ব্যক্তি হতে হবে।

নরোত্তমও হেসে উঠল, ওঁর রক্ত নিয়েছেন বুঝি, স্যার? তবে ম-এ-মু-আ ক্যাপসুলটাকে মিছিমিছি ভদ্রতার ক্যাপসুল কেন বলছেন? নামটা বলেই দিন-না–মনে এক, মুখে আর। বিদুরবাবুরও বুঝি তা-ই?

আরও কিছু বলার আগেই অপদস্থ সাত্যকি সোম ছুটে গিয়ে ক্যাপসুলটা রোবটের মাথায় লাগিয়ে দিলেন।

ততক্ষণে আমার কান শুধু নয়, সমস্ত মুখ লাল হয়ে উঠেছে অপমানে। মনে হল, রোবটকে দিয়ে সাত্যকি সোম ইচ্ছে করেই আমাকে অপমান করালেন। আমারই রক্ত দিয়ে ক্যাপসুল তৈরি করে সে দিনকার শনিচক্রের ঘটনার প্রতিশোধ নিলেন তিনি।

আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে বাইরের দিকে পা বাড়ালাম। সাত্যকিবাবু কোনও বাধা না দিয়ে অন্যদিকে ফিরে রইলেন মাথা নিচু করে। কতই যেন লজ্জা পেয়েছেন, এমন ভান করলেন। রাগে গা জ্বলে গেল।

অবশ্য নরোত্তমের মাথায় ক্যাপসুলটা তখন লাগানো হয়ে গিয়েছিল। ঘরের বাইরে পা ফেলতেই শুনলাম নরোত্তমের কণ্ঠস্বর, চললেন নাকি দাদু? একটু চা খাবেন না? অবিশ্যি এত বেলায় চা না খেয়েই কি বেরিয়েছেন? বড়ই আনন্দ পেলাম। আরেকদিন আসবেন।

কয়েক পা সিঁড়ি নামতেই নরোত্তমের উচ্চকণ্ঠের হাসি শুনলাম। তারপর সে বলে উঠল (বোঝাই গেল, সাত্যকি সোমকে বলছে), রাগছেন কেন স্যার? ঠিকই করেছি। যেমন বুনো ওল, তেমনি বাঘা…বাঘা…বাঘা…

প্রবাদ ডিভাইস ইউনিটের কানেকশনটা আবার বোধহয় ফেল করতে শুরু করল। [আনন্দমেলা, ৫ বৈশাখ ১৩৯১]