ড. সাকসেনার ডায়েরি

ড. সাকসেনার ডায়েরি

ইন্সপেক্টর বেদপ্রকাশ শর্মা হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের ইনচার্জ মি. মালহোত্রর কামরায় ঢুকে স্যালুট করে দাঁড়তেই মি. মালহোত্র ফাইল থেকে একবার চোখ তুলে দেখলেন। তারপর আবার ফাইলে দৃষ্টি নামিয়ে ঠোঁটের ফাঁকে পাইপটা চেপে ধরেই জিজ্ঞেস করলেন, ইয়েস মি. শর্মা, এনি প্রগ্রেস ইন ইয়োর ইনভেস্টিগেশন?

উত্তরে মি. শর্মা বললেন, ইয়েস স্যার। মনে হয়, রহস্যের কিনারা করতে পেরেছি। যদিও কোনও প্রমাণ এখন আর নেই। কারণ–।

মি. মালহোত্র এবার যেন একটু সচকিত হলেন। ফাইল থেকে চোখ তুলে সোজাসুজি শর্মার দিকে তাকালেন। তারপর পাইপটা মুখ থেকে নামিয়ে বললেন, প্লিজ, সিট ডাউন।

মি. শর্মার ওপর যে তদন্তের ভার পড়েছিল, সে সম্বন্ধে এই ফাঁকে কিছু বলা দরকার। দিল্লির প্রখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক হরদয়াল সাকসেনার বাড়িতে পরপর যে কয়েকটা মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গেল, সেটা ভারতের প্রায় সব কাগজেই প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথমে গবেষণাগারে মারা গেলেন ড. সাকসেনার সহকারী ড. চ্যাটার্জি। ঘটনাটা সরকারি বেসরকারি সব মহলেই বেশ চাঞ্চল্য তুলেছিল। কানাঘুষো শোনা গিয়েছিল যে, ড. সাকসেনা পেট্রোলিয়াম নিয়ে এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন। এমন সময় ড. চ্যাটার্জির রহস্যময় বিষক্রিয়ায় মৃত্যু। আর সেটা একেবারে ড. সাকসেনার বাড়িতে তাঁর গবেষণাগারের মধ্যে।

নানারকম সন্দেহের ছায়া পড়েছিল সব মহলে। তবে কি ড, চ্যাটার্জির গবেষণার ফলই ড, সাকসেনা আত্মসাৎ করতে তাকে এভাবে সরিয়ে দিলেন? নাকি, ড. চ্যাটার্জিই এই গবেষণার বিষয় নিজের নামে করে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বলে ড. সাকসেনা প্রতিশোধ নিলেন? যা-ই হোক, দু-দিক থেকেই ড, সাকসেনার ওপর সন্দেহ হল পুলিশের। কারণ ব্যাপারটা আত্মহত্যা নয়, সে বিষয়ে তারা নিঃসন্দেহ। গবেষণাগারে চ্যাটার্জির সঙ্গে ড. সাকসেনা ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। ড. সাকসেনার ভৃত্য প্রসাদ তাঁদের দুজনকে শুধু দু-কাপ কফি দিয়ে গিয়েছিল। সেই কফির কাপ পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। কোনও বিষ পাওয়া যায়নি। অথচ মৃতের শরীরে সায়ানাইড বিষের ক্রিয়া ধরা পড়েছিল, যা একমাত্র ল্যাবরেটরিতেই ছিল।

ঘটনাটির প্রাথমিক তদন্ত চলাকালীন আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল সাকসেনা পরিবারে। আরেকটি মৃত্যু। এবারে ড. সাকসেনার ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে পুষ্প। নামেও পুষ্প, দেখতে ছিল ফুলেরই মতন। বারান্দার কোণে পুতুলের বিয়ের রান্না-রান্না খেলছিল। সেখানেই সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। মৃত্যুর কারণও সেই এক–সায়ানাইড বিষ। ব্যাপারটাতে চাঞ্চল্য পড়ে গেল সর্বত্র। দিল্লি পুলিশ থ।

ড. চ্যাটার্জির মৃত্যুতেই ড. সাকসেনা প্রায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন। আদরের মেয়েটির মৃত্যু তাঁকে পাষাণ করে দিল। তিনি উশকোখুশকো চেহারা নিয়ে বারবার ঘর বার করতে লাগলেন। একবার বারান্দায় মেয়ের ফেলে-যাওয়া সংসার দেখেন। আবার ল্যাবরেটরিতে গিয়ে সেই চেয়ারটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন, যেখানে চ্যাটার্জি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। তারপর ঘটল শেষ বিয়োগান্ত ব্যাপার। বাড়ির লোকজনের কাছ থেকে পাওয়া তার বিশদ বিবৃতি পুলিশের রেকর্ডে লিপিবদ্ধ আছে। ড. সাকসেনা পাগল হয়ে গেলেন। গবেষণার জন্য রাখা পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দিলেন বারান্দার টবে সাজানো সুন্দর গাছগুলো। বাড়ির লোকজন তাঁকে যখন ধরল, তখন তিনিও নিজে লুটিয়ে পড়লেন চিরদিনের মতো। পোস্টমর্টেমে তাঁর দেহেও পাওয়া গেল সেই একই বিষ–সায়ানাইড।

ঘটনাগুলো ঘটে যাওয়ার পর দু-সপ্তাহ অতিক্রান্ত। দিল্লি পুলিশ আজও রহস্যের কিনারা করতে না পারায় মালহোত্রর মেজাজ সবসময়ই খিটখিটে। কাগজ আর লোকের সমালোচনায় বাইরে মুখ দেখানো ভার হয়ে উঠল। কাজেই আজ একটু আশান্বিত হয়ে পাইপটা একেবারে অ্যাশ-ট্রে-র ওপরেই নামিয়ে রাখলেন। তারপর বললেন, ইয়েস শর্মা, প্লিজ গো অন।

মি. শর্মা তাঁর হাতে ধরা একটা ডায়েরি মালহোত্রর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ড. সাকসেনার ডায়েরি। এখান থেকে পড়ে দেখুন স্যার।

মালহোত্র একবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শর্মার দিকে তাকালেন। তারপর পাইপটা তুলে দাঁতে চেপে ধরে ডায়েরির দিকে মন দিলেন। প্রথমে মনে হল, ভ্রমণকাহিনি পড়ছেন। কিন্তু কিছুটা পড়ে যেতেই পাইপটা তিনি বাঁ হাতে চেপে ধরলেন, খুব মনঃসংযোগ করলেই যেটা তিনি করেন।

.

১০ জানুয়ারি।

আজ একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে গেল, যা আমাকে একেবারে হতচকিত করে দিয়েছে। ঘটনাটার কথা লিখতে গেলে আমাকে আগের কথা কিছু লিখতে হয়। সেই দু-মাস আগে বিজ্ঞান সম্মেলনে টোকিয়োতে যাওয়ার কথা, আর ছোট্ট জাহাজটায় করে আরেকটি দ্বীপে যাওয়ার সময় সমুদ্রের মাঝখানে মৃত আগ্নেয়গিরি দেখার কথা। সমুদ্রের মাঝখানে এরকম উলটো কাপের মতন পাহাড়টা দেখে খুবই ইচ্ছে হল ওখানে যাওয়ার। শুনলাম ওটা একটা মৃত আগ্নেয়গিরি। অগ্ন্যুৎপাতের সম্ভাবনা ওতে না থাকলেও এখনও ওটার মুখ থেকে অল্প অল্প ধোঁয়া বেরোয়। আমার আগ্রহ দেখে ওঁরাই ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি আর আমার জাপানি বন্ধু মোরিতে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে সেই আগ্নেয় পর্বত বা দ্বীপে উঠলাম। একেবারে মাথায় উঠে একটা গন্ধ নাকে এল। এই গন্ধ আমার পরিচিত। ভারতের অনেক উষ্ণপ্রস্রবণের কাছে যেতেই এই গন্ধ আমি পেয়েছি। এই গন্ধ আমার ল্যাবরেটরিতে তৈরি হচ্ছে প্রায়ই। সেই পচা ডিম আর বিটনুনের কটু গন্ধ। পাহাড়ের ওপরে গাছপালা-তৃণ বলতে কিছুই নেই। কিন্তু একেবারে মাথায় আগ্নেয়গিরির মুখটার চারপাশে ঘিরে আছে এক অদ্ভুত ধরনের সুন্দর ক্যাকটাস। ব্যাপারটা আমাকে একসঙ্গে মুগ্ধ আর অবাক করল। গাছগুলোর পাতা এমনভাবে সাজানো, যাতে সমস্ত গাছটা একটা গোলকাকার ধারণ করছে। যেন কোনও অদৃশ্য মালি গাছগুলোকে হেঁটে দিয়েছে এইভাবে। দেখে মনে হয় এক-একটা সবুজ ফুলের তোড়া।

মোরিতোকে গাছগুলো সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে তিনি কিছু বলতে পারলেন না। সঙ্গের লোকজনও পারল না। জাপানের লোক হয়েও মোরিতো ফুল বা গাছের ব্যাপারে রসকষহীন। সঙ্গের লোকজনও কেউ গাছটিতে আগ্রহী দেখলাম না। হয়তো ওরা নিজেরাই কেটেছেঁটে এর চাইতে গাছের আরও ভালো আকার দিতে পারে। হাতির আকার, ময়ুরের আকার। তাই হয়তো প্রকৃতিদেবীর কেরামতিতে অবাক হল না অত। কয়েকটি গাছে দোপাটির মতন শুকনো বীজ ঝুলছিল। আমি কিছু সংগ্রহ করে নিলাম।

দিল্লিতে ফিরে ছাদের টবে কিছু বীজ লাগালাম। কিন্তু বীজগুলো অঙ্কুরিত হয়ে শুকিয়ে যেতে লাগল। অবাক হলাম। আগ্নেয়গিরির মাথায় রসকষহীন পাথরের গন্ধকের ধোঁয়ায় যে গাছ বেড়ে উঠছে, সে গাছ ভারতের মাটিতে জন্মাবে না। জন্মালে নিশ্চয় দেখা যেত কোথাও-না-কোথাও।

হঠাৎ মাথায় কী খেয়াল হল। একটা টব শুধু পাথর দিয়ে ভরতি করলাম। তাতে মিশিয়ে দিলাম গন্ধকের গুঁড়ো। এবার বীজগুলো অঙ্কুরিত হল সেই টবে আর চারাগুলো মরল না। বেশ বেড়েই উঠল। বুঝলাম, পাথর আর আগুন খেয়ে যারা বাড়ে, মাটির রসে কি তারা বাঁচতে পারে!

এইভাবে আরও কয়েকটি টব তৈরি করে বীজ লাগালাম। সব গাছই বেশ বেড়ে উঠল।

আজ সন্ধেবেলায় কাজের অবসরে ছাদের গাছগুলোর পাশে বসেছিলাম আর ভাবছিলাম, বটানিক্যাল গার্ডেনসকে দু-একটা গাছ উপহার দেব। জানি না এই গাছ ভারতে আছে কি না। সিগারেটটা ধরিয়ে দেশলাইয়ের কাঠিটা নিবিয়েছি, এমন সময় দেখি, সামনের গাছটায় পাতার ওপর একটা বড়সড় পোকা মরে পড়ে আছে। দেশলাইয়ের কাঠিটা দিয়ে ওটাকে ফেলে দিতে যাব, তখনই ঘটল সে আশ্চর্য ঘটনা। কাঠিটা একেবারে নেবেনি, একটু অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বোধহয় কাঠিতে তখনও ধকধক করছিল। পাতার কাছে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দপ করে জ্বলে উঠল কাঠিটা।

ফোটোসিন্থেনিসের দ্বারা গাছ অক্সিজেন ত্যাগ করে, সে কথা জানি। কিন্তু সে তো দিনের বেলায় সূর্যের আলোতে। ক্লোরেলা নামক এক ছত্রাকের কথাও জানি, যার অক্সিজেন ত্যাগ করার ক্ষমতা বিস্ময়কর। কিন্তু এই গাছের ধারেকাছে নয়।…

.

১৫ জানুয়ারি।

পরদিনই একটা গাছকে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে এসেছি। গাছটাকে নানাভাবে পরীক্ষা করে এক অদ্ভুত ফল সংগ্রহ করেছি। বলতে গেলে, আমি আর আমার সহকারী ব্যাপারটাতে আনন্দে ভাসছি। আমাদের পেট্রোলসম্পর্কীয় গবেষণাটা মুলতুবিই রেখে দিলাম আপাতত।

বড় আকারের বেলজারের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের গ্যাস ভরে তার মধ্যে একটা গাছ রেখে এইরকম ফল পেয়েছি

কার্বন-ডাই-অক্সাইড (Co,)–অক্সিজেন নির্গত করে।
অ্যামোনিয়া (NH)-অপরিবর্তিত। কোনও বিক্রিয়া নেই।
সালফার-ডাই-অক্সাইড (So,)–অক্সিজেন নির্গত করে।
নাইট্রাস অক্সাইড (N0,)–ওই।
মিথেন (CH)–অপরিবর্তিত। কোনও বিক্রিয়া নেই।
 হাইড্রোজেন সালফাইড (HS)–ওই।

এইভাবে অনেকভাবে অনেকরকম গ্যাসের সঙ্গে পরীক্ষা করে গাছটার ধর্ম সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হয়েছি যে, ওটা শুধু অক্সিজেনের যৌগ গ্যাসকে বিশ্লিষ্ট করে তার থেকে অক্সিজেনকে আলাদা করে বের করে দেয়। যৌগটির অন্য অংশ–সেটা কার্বন, নাইট্রোজেন, গন্ধক, যা-ই হোক–সে নিজের দেহে গ্রহণ করে।

গাছটাকে মানুষের কী বিরাট উপকারে লাগানো যেতে পারে ভেবে সত্যই আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করল আমার আর চ্যাটার্জির দু-জনেরই। একটা ছোট্ট গাছ প্রায় একটা বিরাট বট গাছের সমান অক্সিজেন নির্গত করে। তবুও বট গাছ কেবল দিনের বেলাতেই এ কাজ করে। এই গাছ করে দিনরাত্রি সবসময়েই।

বর্তমান সভ্যতার অভিশাপ বায়ুদূষণ বা এয়ার পলিউশন সমস্যাটা হয়তো মুছে যাবে, যদি এই গাছ হাজারে হাজারে লাগানো যায় শহরের রাস্তার ধারে, কলকারখানার আশপাশে, বাড়ির বাগানে, ছাদে, বারান্দায়। এখন বুঝতে পারছি, আগ্নেয়গিরির বিষাক্ত গ্যাসের মধ্যে গাছটা কীভাবে বেঁচে ছিল। ভাবলাম, গাছটার নাম রাখব অমৃতবৃক্ষ।

আমি আর চ্যাটার্জি দুজনে মিলে ঠিক করলাম, আগামী মাসে দিল্লির সায়েন্স কংগ্রেসে এই অসাধারণ উদ্ভিদটির কথা নাটকীয়ভাবে ঘোষণা করব।

.

৩১ জানুয়ারি।

আজ ডায়েরির পাতায় এই লেখাই হবে আমার জীবনের শেষ লেখা। ঠিক তিন সপ্তাহ আগে এই দিনটাতে কী উৎসাহ নিয়েই না সে দিনকার ডায়েরি লিখেছিলাম। ভেবেছিলাম, বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে এই ডায়েরির পাতা ক-টি। ভবিষ্যৎ মানবসমাজ কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হয়তো এই ডায়েরি কোনও দুষ্প্রাপ্য জিনিসের সংগ্রহশালায় রেখে দেবে। কিন্তু সকলই গরল ভেল! হ্যাঁ, সত্যিই সব বিষ হয়ে গেল। এখন শুধু পুলিশের কাজে লাগবে এই ডায়েরি। তাই গবেষণাগারের ড্রয়ারে সযত্নে রেখে গেলাম এই অসম্পূর্ণ ডায়েরি।

চ্যাটার্জির মৃত্যু আমাকে হতভম্ব করে দিয়েছিল। আমি একপাশে টেবিলে ডেটাগুলো লিখছিলাম। চ্যাটার্জি কিছুক্ষণ আগে ল্যাবরেটরিতে এসেছে। এসেই বলল, জলীয় বাষ্পের ওপর গাছটার ক্রিয়াটা সে পরীক্ষা করে দেখতে চায়। জলীয় বাষ্পও তো অক্সিজেনেরই যৌগ। এটাকেও কি গাছটা বিশ্লিষ্ট করে অক্সিজেন বের করবে? হাইড্রোজেনও কি গাছটা গ্রহণ করে? নাকি কেবলমাত্র অক্সিজেন আর হাইড্রোজেন আলাদাই করে দেবে ইলেকট্রোলিসিসের মতো? আমি সানন্দে রাজি হতেই চ্যাটার্জি পরীক্ষা শুরু করল। প্রসাদ এর মধ্যে দু-কাপ কফি দিয়ে গেল। কফিটা শেষ করে চ্যাটার্জির পরীক্ষা কেমন চলছে দেখতে–পেছন ফিরতেই দেখলাম সেই মর্মন্তুদ দৃশ্য। টেবিলের ওপর মাথা ঠেকিয়ে চ্যাটার্জি পড়ে আছে। তার চোখ দুটি ভালো থাকলেও দৃষ্টি শূন্য। এক লহমার মধ্যে বুঝতে পারলাম, চ্যাটার্জি মৃত।

পুলিশটুলিশের ব্যাপার চলল ক-দিন ধরেই। ফরেনসিক থেকে মৃত্যুর কারণ জানা গেল সায়ানাইড বিষ। এই বিষ সব ল্যাবরেটরিতেই থাকে।

আমারও ছিল। কিন্তু তার কোনও ব্যবহার আমাদের বর্তমান গবেষণায় ছিল না। আর চ্যাটার্জি আত্মহত্যা করবে! এটা আমাকে স্বয়ং ঈশ্বর বললেও বিশ্বাস করব না। তার মধ্যে ছিল এক অসাধারণ পৌরুষ আর আত্মমর্যাদাবোধ।

তবে কী তার মৃত্যুরহস্য? দু-দিন পর সকালে ল্যাবরেটরিতে এসে চ্যাটার্জির চেয়ারটার নীচে তাকাতেই চমক খেলাম। তবে কি…!

সপ্তাহ না ঘুরতেই পুষ্প আমাকে নিঃসন্দেহ করে গেল। পুষ্প যেন আমাকে বলে গেল, বাবা, তুমি বড় ঢিলে স্বভাবের। তাই আমাকে মরতে হল। না হলে আঙ্কল চ্যাটার্জির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই যদি তুমি সাবধান হতে, তবে তো আমাকে চলে যেতে হত না।

সত্যিই তা-ই–চ্যাটার্জির চেয়ারের তলায় যা ছিল, পুষ্পর খেলনার বাটিতেও তা-ই। ক্যাকটাস গাছটির পাতা। চ্যাটার্জি হয়তো কৌতূহলবশে গাছটির পাতায় কামড় দিয়েছিল। পুষ্প দিয়েছিল খেলার ছলে। তারা কেউ জানত না, গাছটা যখন অক্সিজেন সৃষ্টি করছে, সেই সঙ্গে তখন বাতাসের কার্বন আর নাইট্রোজেন নিয়ে নিজের দেহে তৈরি করছে এক মারণবিষ–যার নাম, সায়ানাইড। আমিও কি জানতাম! পরে পরীক্ষা করে নিঃসন্দেহ হলাম।

হা ঈশ্বর! আমি যাকে অমৃতবৃক্ষ ভেবেছিলাম, সে যে বিষবৃক্ষ। ভুলেই গিয়েছিলাম, সমুদ্রমন্থনে অমৃতের পরেই তো বিষ উঠেছিল–কালকূট। অমৃত আর বিষ যে জীবন আর মরণের মতোই, একের সঙ্গে অন্যের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক। বিষবৃক্ষই বা বলি কেন? এ তো অমৃত ছড়িয়ে দিয়ে বিষটা নিজের দেহে ধারণ করে নীলকণ্ঠর মতো। কিন্তু মানুষ যে চিরদিনই শিশুর মতন কৌতূহলী। সে খেলা করতে ভালোবাসে। তাই সে সেই বিষ নিজেই কণ্ঠে তুলে নেয় চ্যাটার্জির মতন, আমার পুষ্পর মতন। আমাদের মধ্যে অনেক চ্যাটার্জি আর পুষ্প আছে। শুনেছি, মহান বিজ্ঞানী নিউটনের মৃত্যুর কারণও ছিল এই কৌতূহল। পরীক্ষাগারে নানারকম রাসায়নিক বস্তু তিনি আস্বাদন করতেন মাঝে মাঝে। এতে ধীরে ধীরে বিষক্রিয়া হয় তাঁর শরীরে, মস্তিষ্কে।

তাই এই গাছ থাকতে পারে না মানুষের সমাজে। বায়ুদূষণ সমস্যার সমাধান করতে ভবিষ্যতে হয়তো অনেক বৈজ্ঞানিক উপায় উদ্ভাবন হবে। এখন এই মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে এই মারণবৃক্ষ। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেব সব গাছ, সব কটি পাতা।

ভুল বললাম। একটা পাতা রেখে দেব আমার নিজের জন্যে। পুষ্প আর চ্যাটার্জির সঙ্গে যদি দেখা হয়, তবে তাদের বলতে হবে তো যে, আর কেউ মরবে না এই বিষবৃক্ষের আস্বাদ নিতে গিয়ে।

.

এখানেই ডায়েরি লেখা শেষ করেছেন ড. সাকসেনা। ডায়েরিটা বন্ধ করে মি. মালহোত্র শর্মার দিকে তাকালেন।

মি, শর্মা উৎসাহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, প্রেসের লোককে থামানোর জন্যে আজই কি এটা দেব স্যার?

মি. মালহোত্র শর্মার দিকে কিছুক্ষণ অন্যমনস্কভাবে চেয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, ড, সাকসেনার পেট্রোলের গবেষণাটা কী, জানেন মি. শর্মা?

মি. শর্মা উত্তর দিলেন, না স্যার! আমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম না, তাই এ বিষয়ে তেমন খোঁজ নিইনি। তা ছাড়া এই কেসের সঙ্গে

শর্মাকে থামিয়ে মি. মালহোত্র বললেন, তা-ও বটে। ঠিক আছে–ডায়েরির কথা কাগজে দিন।

[সন্দেশ, পৌষ ১৩৮৯]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *