সাত্যকি সোম ও মহাকালাধার
পাহাড়ের কোলে সুন্দর বাংলোটিতে গভীর ঘুমের মধ্যে রাত কাটিয়ে বেশ ভোরেই বিখ্যাত বিজ্ঞানী সাত্যকি সোমের ঘুম ভেঙে গেল। বিছানা ছেড়ে উঠে প্রথমেই তিনি সোজা বারান্দায় চলে এলেন। মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকালেন দূরের সবুজ বনানী আর প্রভাতের রঙিন আলোয় মাখামাখি তুষার-ঢাকা পর্বতশৃঙ্গের দিকে। তারপরে প্রাণভরে বাতাস নিলেন বুকে। ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠলেন, গত শতাব্দীর শেষদিকে কীভাবে এইসব গাছপালা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল স্বার্থান্বেষী অবিবেচক আত্মঘাতী মানুষের হাতে। বায়ুদূষণে ভরে যাচ্ছিল এইসব স্বাস্থ্যকর পার্বত্য অঞ্চলগুলোও। কলকাতারই বা কী অবস্থা হয়েছিল? শহরের শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই ভুগত ফুসফুসের রোগে, রক্তচাপে, আরও কত অসুখে। আজ ঘরে ঘরে বাসে-গাড়িতে সোমের পলিউশন অ্যাবজর্ভার বা এস-পি-এ যন্ত্রের দৌলতে কলকাতার শীতের সন্ধ্যার বাতাসও ভোরের এই পাহাড়ের হাওয়ার মতোই নির্মল।
সাত্যকি সোমের মনে হয়তো একটু আত্মপ্রসাদের ভাব এসেছিল, এমন সময় তাঁর প্রিয় ছাত্র ও সহকারী বিক্রমকে একটা ফাইল হাতে বাংলোতে ঢুকতে দেখলেন।
ফাইলে কী আছে, সাত্যকি সোম জানেন। এখানে যে গবেষণার কাজে দু-জনে এসেছেন, তারই ডেটা ওতে লিপিবদ্ধ। বিক্রম বারান্দায় উঠতেই তিনি মৃদু হেসে বললেন, আজ সকালে ও কাজটা থাক-না বিক্রম। এখানে দাঁড়িয়ে একটু সামনে তাকিয়ে দ্যাখো। ওই সবুজ বন, চূড়ার বরফ আর সূর্যের আলোর খেলা দেখে তোমার কি মনে হবে, ওর পেছনে ক্লোরোফিল, তাপমাত্রা আর আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ভূমিকা? বলতে কি ইচ্ছে করে না?
হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি,
জগৎ আসি হেথা করিছে কোলাকুলি?
বিক্রম অবাক বিস্ময়ে ডক্টর সোমের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকল। তা-ই দেখে সাত্যকি সোম বললেন, অবাক হয়ে যাচ্ছ? বিজ্ঞানী সাত্যকি সোমের কী অধঃপতন–তা-ই না? তবে বিক্রম, মায়া বা ইলিউশন সবসময়ে মন্দ নয়। এই মায়াতে বদ্ধ আছি বলেই তো আমরা স্বাভাবিক মানুষ, পাগল হয়ে যাইনি। আমি যখন বলি, সূর্য উঠবে বা সিনেমায় ছবি নড়ছে–কই, তখন তো বলো না, সাত্যকি সোম ভুল বকছে?
বিক্রম লজ্জিতভাবে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর একটু ইতস্তত করে বলল, স্যার, তাহলে আজকের সকালটা একটু কাছাকাছি বেড়িয়ে এলে হয় না? কাছেই আছে মহাকালের বিগ্রহ। একবার দেখে এলে কেমন হয়?
সাত্যকি সোম হো-হো করে হেসে উঠে বললেন, তা-ই বলে বিজ্ঞানী সাত্যকি সোম শালপাতায় প্যাঁড়া আর ফুল হাতে মন্দিরের দরজায় দাঁড়াবে, অতটা তুমি ভাবলে কী করে বিক্রম?
বিক্ৰম কুণ্ঠিত হয়ে বলল, না স্যার। বিগ্রহটা সম্বন্ধে একটা জনশ্রুতি আছে, তাই একটু কৌতূহল হচ্ছে। শোনা যায়, মোগল সেনাপতি মানসিংহ পূর্ব ভারতে যাত্রার সময়ে রাত্রে এখানে ছাউনি ফেলেছিলেন। সেই রাত্রে ওই পাহাড়ের কোলে একটা উজ্জ্বল আলোর রেখাকে নেমে আসতে দেখা যায়। পরদিন সকালে তিনি আবিষ্কার করেন পাহাড়ের গায়ে এই পাঁচ ফুট উঁচু শিবলিঙ্গটিকে–যেটা আগের দিনও ওখানে ছিল না। মানসিংহ শিবের পুজো করে যাত্রা করেন আর সেটা তাঁর পক্ষে সফল যাত্রা হয়েছিল। তাই ফেরার পথে আবার এখানে পুজো দেন। মুসলমান মোগল সেনারাও এই পবিত্র প্রস্তরখণ্ডের কাছে। নমাজ পড়েছিল। এখনও হিন্দু-মুসলমান সকলের কাছে এটা পবিত্র। পাছে তাদের মধ্যে এই শিবলিঙ্গ বা পবিত্র পাথর নিয়ে কোনও মনোমালিন্য দেখা দেয়, তাই রাজা মানসিংহ হুকুম দেন, এটি উন্মুক্ত স্থানেই থাকবে। একে ঘিরে কোনও মন্দির বা মসজিদ গড়ে উঠতে পারবে না। হিন্দু-মুসলমান সবাই এটি স্পর্শ করতে পারবে। আর রাত্রে কেউ এখানে আসতে পারবে না।
সাত্যকি সোম হেসে উঠে বললেন, বাবাঃ, তুমি ইতিহাসের ছাত্র হলে নাম করতে। তবে তোমার কাছে যা শুনলাম, তাতে একটা ব্যাপারে নিঃসন্দেহ যে, ওটা একটা উল্কাপিণ্ড ছাড়া কিছু নয়। প্রায় পাঁচশো বছর আগে ওটা ওখানে পড়ে মাটিতে গেঁথে যায়। যা-ই হোক, তোমার যখন অত ইচ্ছে, চলো দেখে আসি। বুড়ো বয়সে কিছু পুণ্যিও তো করা দরকার। বলে হেসে উঠলেন ডক্টর সোম।
মহাকালের মূর্তির কাছাকাছি এসে তাঁরা দেখলেন, স্থানীয় অধিবাসীরা কাজে যাওয়ার আগে শিবলিঙ্গ স্পর্শ করে যাচ্ছে। মানসিংহর ব্যবস্থামতো এখানে কোনও পূজারি নেই। কেউ কেউ ফুল-বেলপাতা ছড়িয়ে দিয়েছে পাশে। এমন মুক্তাঙ্গন সর্বজনীন দেববিগ্রহ সাত্যকি নোম সত্যিই কোথাও দেখেননি।
মহাকাল লিঙ্গের কাছে আসতেই ডক্টর সোমের চোখে ফুটে উঠল বিস্ময়ের চিহ্ন। বিক্রমের দিকে চেয়ে বললেন, তুমি বলেছিলে, এটা মোগল যুগের শিবলিঙ্গ। তুমি কি ভালোভাবে খবর নিয়েছ এ ব্যাপারে? একটা জিনিস লক্ষ করেছ? এটা কেমন মসৃণ আর তেল চকচকে। এতকাল ধরে খোলা জায়গায় রোদ-বৃষ্টি-তুষারপাত আর ঝড়ের মধ্যে থেকে তো এটা সম্ভব নয়। দাঁড়াও, বাংলোতে আমার এজ-কাউন্টার আছে। কোটি কোটি বছরের পুরোনো ফসিল থেকে পঞ্চাশ বছর আগেকার দলিল–সব কিছুর বয়সই তাতে ধরা পড়বে। সেটা সঙ্গে করে রাত্তিরে আবার আসব। তখন তো কেউ এখানে আসে না। ব্যাপারটায় কোনও কারচুপি থাকলে তখনই ধরা পড়বে।
একটা বিগ্রহ নিয়ে ডক্টর সোমের এই আগ্রহ বিক্রমকে একটু অবাক করল। তবে সে নিজেও যে এ ব্যাপারে কৌতূহলী হয়নি, সেটা সে বলতে পারবে না।
.
সারাদিন গবেষণার ব্যাপারে কাজ, আলসেমি আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করে কাটল। রাত হলে টর্চ, এ-সি যন্ত্র আর বিক্রমকে সঙ্গে নিয়ে ডক্টর সোম মহাকাল লিঙ্গের বেদির কাছে গেলেন। পাথরের গায়ে যন্ত্র লাগাতে যে অঙ্ক ফুটে উঠল, তাতে তিনি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। একক দশক শতক সহস্র অযুত লক্ষ নিযুত কোটি ছাড়িয়ে এ যে পরার্ধের দিকে! যন্ত্র তুলে রিসেট করলেন। আবার ছোঁয়ালেন। সেই একই অঙ্ক। তিনি বিক্রমকে ইঙ্গিতে অঙ্কটা দেখতে বললেন। বিক্রমের চোখে-মুখেও ফুটে উঠল অগাধ বিস্ময়। অস্ফুট স্বরে সে শুধু বলল, এ কী করে সম্ভব, স্যার?
সাত্যকি সোম ধীরে ধীরে বললেন, সত্যিই বিস্ময়কর। যে সংখ্যাটা ফুটে উঠেছে, তত বছর আগে পৃথিবীটা ছিল একটা জ্বলন্ত গ্যাসের পিণ্ড। তার কাছে মানসিংহর সময় তো কয়েক সেকেন্ড আগের ব্যাপার মাত্র। আর পাথরটার গায়ে হাত দিয়ে দ্যাখো। কী বস্তু এটা? মৌলিক পদার্থ হলে পিরিয়ডিক টেলে এর স্থান আছে কি? আর যদি যৌগিক হয়
বিক্রম প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল, তবে কি বলছেন স্যার, পৃথিবী সৃষ্টির আগে বাইরে থেকে এসেছিল এই তথাকথিত পাথরটা?
সাত্যকি সোম হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন। তারপরে অস্ফুট বিস্ময়ে সোজা হয়ে উঠলেন। বিক্ৰম কারণটা বুঝল। টর্চের আলোয় সে দেখল, ক্যালকুলেটারের অঙ্কের মতো ফুটে উঠেছে আলোর অঙ্ক পাথরটার গায়ে শূন্য থেকে নয়। তার বেশ কিছুটা নীচে আরেকটা সংখ্যা–৬৫৪৭৮৩২৯০১। সংখ্যাটার পাশে ব্র্যাকেটের মধ্যে ইংরেজিতে লেখা –ওপরের সংখ্যাগুলোর ওপর এই নিয়মে পরপর কাষ্ঠশলাকা দিয়ে চাপ দাও।
বিক্রম হেসে উঠে বলল, দেখেছেন স্যার, খুব সাম্প্রতিককালেই কেউ এটা করেছে। সেই যে পড়েছিলাম, বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণর দোলনায় টাটা কোম্পানির ছাপ মারা ছিল, সেরকম আর কী। অন্ধকারে টর্চের আলোয় ফ্লুরোসেন্ট লেখাগুলো ফুটে উঠেছে। দিনের বেলায় কারও নজরে পড়েনি।
সাত্যকি সোমকে হাসতে দেখা গেল না। সেরকমই গম্ভীর মুখে তিনি বললেন, কিন্তু আমার এজ-কাউন্টার মিথ্যে বলে না। তা ছাড়া এইভাবে গুপ্তধনের সংকেতের মতো লেখার মানেই বা কী? দেখাই যাক-না।
পাশে একটা শুকনো সরু বেলের ডাল পড়ে ছিল। সেটা তুলে নিয়ে ওপরের অঙ্কগুলোর ওপর নির্দেশমতো চাপ দিতে লাগলেন ডক্টর নোম।
শেষ সংখ্যা এক-এর ওপর চাপ দিতেই যা ঘটল, তাতে দু-জনেই সভয়ে পিছিয়ে এলেন। বাঁশির মতন একটা শব্দের সৃষ্টি হল আর সেই সঙ্গে শিবলিঙ্গের মাথা থেকে একটা ঢাকনা খুলে গেল। ভেতরের ব্যাপারস্যাপার দেখে দু-জনে আরও অবাক। পরপর ইংরেজিতে লেখা আছে কতকগুলো ভাষার নামইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, ইটালিয়ান, চিনা, জাপানি ইত্যাদি। হিন্দি, এমনকী বাংলার নামও খুঁজে পেলেন ডক্টর সোম! প্রতিটি লেখার তলায় একটি করে বোতাম। নীচে লেখা–প্রেস এনিওয়ান। যেখানে বেঙ্গলি লেখা, তার নীচের বোতামটা ডক্টর সোম টিপে দিলেন। আরেক বিস্ময়ের ধাক্কায় এবার তাঁরা বসে পড়লেন। পরিষ্কার বাংলায় কেউ বলে যাচ্ছে–
পৃথিবী নামক এক গ্রহ থেকে এই কালাধার বা টাইম ক্যাপসুল আমরা পঠিয়ে দিয়েছি। একটা নক্ষত্রকে ঘিরে আমাদের পৃথিবী ঘুরছে। সেটাকে আমরা সূর্য বলি। একবার ঘোরার সময়কালকে বলি বৎসর। এই কালাধার আমরা মহাকাশে এমনভাবে ছুঁড়ে দিয়েছি, যাতে এই পৃথিবীর মতন উপযুক্ত গ্রহ পেলে তবেই সেখানে নামবে। হয়তো তার মধ্যে কোটি কোটি বছর কেটে যাবে। আমাদের পৃথিবীর কিছু প্রধান ভাষাতেও এটা প্রোগ্রাম করা আছে। তা ছাড়া আছে ইনটারস্পেস ফিগার ল্যাঙ্গুয়েজ বা মহাজাগতিক অঙ্কের ভাষা। যদি কোনও বুদ্ধিমান প্রাণী এই কালাধার খোলন এবং আমাদের ভাষা বুঝতে পারেন, তবে তিনি আমাদের গ্রহ, তার ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারবেন। এই গ্রহের প্রতিটি দেশের প্রতিটি অঞ্চলের ইতিহাস এতে স্টোর করা আছে। যে ভাষাতে আমি কথা বলছি, সেই ভাষাতে প্রশ্ন করলেই জানতে পারবেন। পেছনে এফ-বি বা ফ্ল্যাশব্যাক বোতাম আছে। সেটা টিপলে এই কালাধারের ভেতরে ভি ডি-ইউ পর্দায় দেখতে পাবেন ঘটনাপ্রবাহ, যেটা আপনারা দেখতে চান। তবে একটা অনুরোধ, কাজ হয়ে গেলে একসময় এটাকে আবার আমাদের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেবেন। পেছনের দিকে আরবি বোতাম টিপলেই সেটা হবে। টেপার দু-মিনিটের মধ্যে এটা ছুটে ফিরে আসবে আমাদের পৃথিবীতে। হয়তো তখন এই পৃথিবী একটা মৃত গ্রহ। তবুও এটাই আমাদের ইচ্ছা।
কালাধার চুপ করল।
সাতকি সোম ফিশফিশ করে বিক্রমকে বললেন, দেখেছ বিক্রম, কীরকম মিল? মহাকাল আর কালাধার। প্রশ্ন করো, কী জানতে চাও।
বিক্রম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তার চোখে ভেসে উঠল তার মা-র মুখ। ক্যানসারে মারা গিয়েছেন তিনি। তাঁর আত্মা থাকলে সেটা কোথায়? এই পৃথিবীতে? না, ওই কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে আরেক পৃথিবীতে, যেটা এর মধ্যেই হয়তো একটা মৃত গ্রহ।
সে প্রশ্ন করল, ক্যানসারের ভালো ওষুধ কি আপনারা আবিষ্কার করেছেন?
কালাধার হেসে উঠল। বলল, এত কঠিন কঠিন রোগ থাকতে একটা সামান্য ব্যাধির ওষুধের কথা জানতে চাচ্ছেন কেন? একটা মামুলি ওষুধেই তো এটা সেরে যায়। ব্লস্টা লাভিয়া টাইকোটিস শতকরা চল্লিশ, ফেরামিন গ্লুকোসাইডিস শতকরা ষাট।
ডক্টর সোম বিক্রমকে ঠেলা দিয়ে বললেন, যা শুনছ, লিখে নাও। পরে ও ব্যাপারে। খোঁজখবর নিয়ো। ভাগ্যিস পকেটে নোটবই ছিল। বিক্রম লিখে নিল নামগুলো।
এবার সাত্যকি সোম প্রশ্ন করলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এই কালাধার যখন আপনারা উৎক্ষেপণ করেন, তখন আপনাদের নিয়মে কোন সময়? মানে এই গ্রহে যাকে সাল বলি।
কালাধার উত্তর দিল, আমাদের পৃথিবীতে জিশুখ্রিস্ট নামে এক মহাপুরুষ জন্মেছিলেন। তাঁর সময় থেকে একটা সাল চালু আছে, আমরা যাকে বলি খ্রিস্টাব্দ। সেই হিসেবে এখন দু-হাজার ন-শো উনিশ খ্রিস্টাব্দ।
ডক্টর সোম জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের পৃথিবীর কি কোনও উপগ্রহ আছে?
কালাধার উত্তর দিল, স্বাভাবিক উপগ্রহ একটিই আছে। আমরা নাম দিয়েছি–চাঁদ। সত্যি বলতে কী, এই কালাধার আমরা চাঁদের পিঠ থেকেই উৎক্ষেপণ করেছি।
সাত্যকি সোম বিক্রমের দিকে তাকালেন। দেখলেন, বিস্মিত হওয়ার অনুভূতিও বোধহয় সে হারিয়ে ফেলেছে।
তিনি কালাধারের দিকে মুখ করে বললেন, আপনাদের গ্রহে যেখানে এই বাংলা ভাষায় কথা বলা হয়, সেখানকার প্রধান কোনও শহরের আজকের, মানে যখন এই কালাধার পাঠানো হয়েছে–ওখানকার কিছু দৃশ্য কালাধারের পর্দায় দেখতে চাই।
কালাধার বলল, এফ-বি বোতাম টিপুন।
কৌতূহলের ধাক্কায় বিক্রম এবার প্রায় হুমড়ি খেয়ে পেছনের বোতাম টিপে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেও কোনও ছবি এল না। সাত্যকি সোম কালাধারকে প্রশ্ন করতে উত্তর পেলেন, এফ-বি বোতামের বদলে আর-বি বোতাম টেপা হয়েছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যে এটা ছুটে যাবে মহাকাশে আমাদের পৃথিবীর দিকে।
ডক্টর সোম লাফিয়ে উঠে বললেন, সর্বনাশ, করেছ কী বিক্রম? তারপরে কালাধারের দিকে ফিরে বললেন, কমান্ডটাকে কি কিছুতে ইরেজ–মানে নষ্ট করে দেওয়া যায় না? ভুল করে ওটা হয়ে গিয়েছে। আমাদের আরও অনেক কিছু জানার আছে।
কালাধার হেসে বলল, বুদ্ধিমান জীব বলে নিজেকে দাবি করলে আরও নিখুঁত, আরও ধীরস্থির হওয়া দরকার। এই কমান্ড আর ফেরানো যাবে না। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কালাধার এই গ্রহ থেকে ছুটে যাবে। প্রায় হাজার বছর আগে আমাদের এই গ্রহেও অন্য এক জগৎ থেকে পাঠানো একটা কম্পিউটারাইজড কালাধার আবিষ্কৃত হয়েছিল। কিন্তু একজন অর্বাচীন বিজ্ঞানীর হঠকারিতায় আমরা সেটাকে হারিয়েছিলাম। এক বিরাট জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম সে দিন।
সাত্যকি সোম প্রায় চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন, কী নাম সেই বিজ্ঞানীর?
বিক্রম রায়!
নামটা উচ্চারণ করেই রকেটের মতন মাটি খুঁড়ে উঠে আকাশের দিকে ছুটে গেল সেই কালাধার। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে অনন্ত নীলিমায় সেটা মিলিয়ে গেল।
বিক্রমের দিকে চেয়ে ডক্টর সোম দেখলেন, সে ক্ষোভে-লজ্জায় নুয়ে পড়েছে। মহাকালের বেদির ওপর। সস্নেহে তার পিঠে হাত রেখে তিনি বললেন, ওই মহাদূরের পৃথিবীতে এককালে যা হয়েছিল, কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে এই পৃথিবীতে তারই পুনর্ঘটন হচ্ছে। তার ব্যতিক্রম তো হতে পারে না। কাজেই তোমার–তোমার-আমার সকলেরই দুঃখের কিছু নেই, বিক্রম। যা আমরা জানতে পারলাম না, তা জানতে আরও এক হাজার বছর অপেক্ষা করতে হবে। সে দিন আমাদের উত্তরপুরুষ বিজ্ঞানীরা ঠিক ওরকম একটা মহাকালাধার পাঠাবে মহাকাশে। ওঠো। চলো, বাংলোয় ফিরে যাই। ভবিষ্যৎ তার নিজের নিয়মেই আসবে। তাকে হয়তো আগে জানা যায় না। তোমার নোটবইয়ের ফর্মুলাও সময় এলেই মানুষ আবিষ্কার করবে, তার আগে নয়।
[শুকতারা, শারদীয়া ১৩৯৩]