কালাবদর

কালাবদর

উত্তরে বলে মেঘনা। তারও উত্তরে ব্রহ্মপুত্র, আরও উত্তরে যেখানে হিমালয়ের বুকের ভেতর থেকে ফেনায় ফেনায় গর্জে বেরিয়ে আসছে সেখানকার ইতিহাস কেউ বলতে পারে না।

মেঘের মতো জলের রং বলে নদীর নাম দিয়েছিল মেঘনা। এখানে এসে নাম হল কালাবদর। শুধু মেঘবরণ জল নয়, অদূর সমুদ্রের ঘন নীলিমাও যেন এর ভেতরে এসে সঞ্চারিত হয়ে গেছে। দিনে রাতে দু-বার মাতলা হাতির ঝাঁকের মতো ছুটে আসে জোয়ারের জল, এদেশে বলে শর এল। সে তো আসা নয়, বলতে হয় আবির্ভাব। পাহাড়প্রমাণ উঁচু হয়ে ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসে খ্যাপা জলোল্লাস, রাশি রাশি মল্লিকা ফুলের মালার মতো ফেনার ঝালর দুলতে থাকে তার সর্বাঙ্গে, জলকণার একটা ছোটো কুয়াশা ঘুরতে থাকে তার মাথার ওপর; আর দু-দিকের তটের গায়ে প্রবল শব্দে আছড়ে পড়ে তার পাশব-মত্ততা। একখানা ছোটো নৌকোও যদি তখন কূলে বাঁধা থাকে, মুহূর্তে হাজারখানা হয়ে কুটোর মতো মিলিয়ে যায়, কখনো আর তার সন্ধান মেলে না।

কালাবদর। পাঁচ পির বদর বদর করে পাড়ি ধরে মাঝিরা। উৎসুক আকুল চোখে। আকাশটাকে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখে কোথাও লুকিয়ে আছে কি না একফালি সোনামুখী মেঘ। বিশ্বাস নেই এই সর্বনাশা নদীকে। মেঘ দেখলেই কালো ময়ূরের মতো আনন্দে পেখম মেলে দেয়, নাচতে শুরু করে ভৈরবী উল্লাসে। তখন ছোটো নৌকো তো দূরের কথা, জাহাজে পর্যন্ত সামাল সামাল ওঠে।

বিশাল ভয়ংকর নদী কালাবদর। কালকেউটের মতো তার জ্বলের রং। তার গর্জনে কোটি কোটি বিষাক্ত কেউটের ফোঁসফোঁসানি। ঝড় ওঠে, নৌকো ডোবে, মানুষ মরে। শরের ঘা লেগে উঁচু ডাঙাসুদ্ধ নারকেল-সুপারির গাছ ভেঙে পড়ে করাল স্রোতে। কালীদহ ছেড়ে কালীয়নাগ কালাবদরে এসে বাসা বেঁধেছে।

আলাইপুরের খালটা যেখানে মানুষের প্রসারিত একটা মুঠির মতো হঠাৎ চওড়া হয়ে কালাবদরে এসে পড়েছে, ওইখানেই কেরায়া নৌকোগুলোর আড্ডা। পাগলা শরের ভয়ে মাঝিরা পারতপক্ষে নৌকো নদীর ওপরে রাখে না, খালের এই মুখটুকুর ভেতরে ঢুকেই লগি পোঁতে। বিশ্বাস নেই কালাবদরকে। হয়তো একটুখানি বাজার করতে গেছে কিংবা সংগ্রহ করতে গেছে দুটো-একটা মাছ, এমন সময় এল নদীর মাতলামি। ফিরে এসে মাঝি দেখলে নৌকো তো দূরের কথা, তার কাছিটির চিহ্ন অবধি নেই। খাল এদিক থেকে নিরাপদ। জলের ঝাপটা ভেতরে যতটুকু আসে তা নৌকোকে একটুখানি নাগরদোলায় দুলিয়ে যায় মাত্র, তার বেশি আর কিছুই করে না।

খালে আজ বেশি নৌকো ছিল না। কফিলদ্দি মাঝি সবে পেঁয়াজকলি দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোলটা চাপিয়ে দিয়েছে, এমন সময় এল সওয়ারি!

ও মাঝি ভাই, কেরায়া যাবা?

যাইবেন কই?

জাউলা!

জাউলা? জাউলার হাট?

হ।

কন কী? হারা (সারা রাত্তির পাড়ি দেওনের কাম।

করুম কী কও? বিয়া আছে, যাইতেই অইবে।

হঃ, বুঝছি।

এতক্ষণ অন্যমনস্কভাবে অভ্যস্ত রীতিতে কথা বলছিল কফিলদ্দি, হুঁকোয় অল্প অল্প টান দিচ্ছিল নিরাসক্তভাবে। এইবার ধীরেসুস্থে মুখ থেকে হুঁকোটা নামালে, কলকের আগুনটা ঝেড়ে দিলে খালের ঘোলাজলে। জলস্রোতের মধ্যে ছ্যাঁক ছ্যাঁক করে পোড়া টিকের টুকরোগুলো পড়তে লাগল, কালো ছাইয়ের একটা সরল রেখা লগিটার চারদিকে পাক খেয়ে তীব্র বেগে নদীর দিকে চলে গেল।

ক্যারায়া দিবেন কত?

বুইজঝা-সুইজঝা লও ভাই, তোমাগো আর কমু কী?

তমো কয়েন? (তবু বলুন?)

পাউচগা টাহা দিমু (পাঁচটা টাকা দেব), এয়ার বেশি না।

হেইলে হাতর দিয়ে যায়েন (তা হলে সাঁতার দিয়া যান), নায়ে নায়ে চড়নের কাম নাই।

এটাও অভ্যস্ত জবাব কিন্তু এ অভ্যাস বেশিদিনের নয়, যুদ্ধ বাঁধবার পর থেকে। আগে মাঝিরাই সওয়ারির তোয়াজ করত, চার আনা ভাড়া বেশি দেওয়ার জন্যে আল্লার দোহাই পাড়ত। দু-হাত জোড় করে বলত, আইচ্ছা আইচ্ছা, বেশি না দ্যান, কুদঘাটের (সরকারি কর সংগ্রহের ঘাট) পয়সা আর এক বেলার জলপান দিবেন।

কোথায় গেল সেসব। আশ্চর্যভাবে ঘুরল পৃথিবীর চাকা, সময়ের চাকা। যুদ্ধ গেল, মন্বন্তর গেল, মরল হাজারে হাজারে মানুষ। কালাবদরের কালো জলে যারা ডুবে মরে, তারপর ভেসে ওঠে প্রকান্ড একটা জয়টাকের মতো, তাদের মতো করে নয়। বরং শুকিয়ে মরল, এত বেশি শুকিয়ে মরল যে ফুলবার মতো শরীরে আর কিছু রইল না, শুকনো হাড়ের থেকে চিমসে চামড়া গলে গলে মিলিয়ে গেল মাটিতে। হাড়ের ওপরে ঠোকা মেরে ঠোঁট ঘুরিয়ে অবজ্ঞায় উড়ে চলে গেল শকুনের পাল। পৃথিবী বদলাল। যারা বাঁচল তাদের এক টাকা কেরায়া উঠল পাঁচ টাকায়, তাদের মেজাজ হল হাজার বিঘে ধানজমির মালিক তালুকদারের মতো। সুতরাং হুকো নামিয়ে নিবিষ্টভাবে আবার ঝোলের কড়াইয়ের দিকে মনোযোগ নিবন্ধ করলে কফিলদ্দি।

লও, আর আষ্ট আনা দিমু, হোনজু (শুনছ)? কথা কও না দেহি?

কমু আর কী? পাঁচ-ছয় টাহার কাম না কত্তা, দউশগার কোমে কথা নাই।

ওরেঃ, ডাহাইত (ডাকাত)! মাথায় বাড়ি দিতে চাওনি?

অবজ্ঞাভরে খালের জলে থুথু ফেললে কফিলদ্দি, চাউলের মন হইছে কুড়ি টাহা, হেয়া দ্যাহেন না?

লও ভাই, আর অ্যাট্টা (একটা) টাহা ধরো। আর বগড় বগড় দিয়া কাম নাই।

এতক্ষণে যেন চমক ভাঙল কফিলদ্দির। এতক্ষণে সে এদের দিকে তাকাল। মধ্যবয়সি একটি পুরুষ, গায়ে ময়লা একটা ছিটের শার্ট, পায়ে এক জোড়া মলিন জুতো। রোগা চেহারা, গলার হাড়টা থুতনির নীচ দিয়ে অনেকখানি এগিয়ে এসেছে। হাতে একটা ছোটো পুঁটলি। তার পেছনে ঘোমটা-দেওয়া একটি বউ, একখানি ডুরে শাড়ির নীচে তার রোগা রোগা দুখানি পা দেখা যাচ্ছে। মুখোনি ঘোমটায় ঢাকা কিন্তু পায়ের দিকে তাকিয়েই কফিলদ্দি বুঝতে পেরেছে ওই মেয়েটির মুখে পুরুষটির মতোই ক্লান্তির কালো ছাপ আঁকা রয়েছে। মধ্যবিত্তের পরিচিত ক্লান্তি আর অবসন্নতা।

শেষপর্যন্ত রফা হল সাত টাকায়।

আলাইপুরা থেকে জাউলার হাট কোনাকুনি পাড়ি, প্রায় বারো মাইল পথ। মাঝখানে হাসানদির আধজাগা লম্বা চড়াটা ছাড়া আর ডাঙা নেই কোনোখানে। রাত্রির ছায়ায় কালাবদরের কালো জল হয়ে গেল নিকষ কালো, তারপর কখন একফালি মেঘ এসে চিকচিকে তারাগুলোর ওপর দিয়ে ঘন একটা পর্দা টেনে দিয়ে গেল।

তখন ঝিরঝির করে বাতাস বইছিল নদীতে। আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল বাতাসের বেগ। কালাবদরের কালো ঢেউয়ের মাতন শুরু হয়ে গেল। অন্ধকার জলের ওপরে উজলে উজলে উঠতে লাগল ফেনার রাশি। একটা ঢেউয়ের মাথা থেকে নৌকোটা প্রবল বেগে আর একটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

বিরক্ত কুটি ফুটে উঠল কফিলদ্দির কপালে। কালাবদরের এমন মাতামাতি কিছু অস্বাভাবিক নয়। তার এক-কাঠের শালতি ঢেউয়ের ওপর দিয়ে ঘোড়ার মতো জোরকদমে ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে চলে যাবে তাও সে জানে। হাজার ঝাপটা লাগলেও তার নৌকোর তলার জোড় খুলবে না। কিন্তু ছুটন্ত তেজিয়ান ঘোড়াকে যেমন রাশ টেনে সামলে সামলে রাখতে হয়, তেমনি তাকেও আজ সারারাত নৌকো সামলাতে হবে। পালের মুখে ছেড়ে দিয়ে গলুইয়ের ওপরে একটুখানি কাত হয়ে নেবার আশা আজ বিড়ম্বনা। নদী আজ সারারাত ভোগাবে বলে বোধ হচ্ছে।

চারদিকে জলের গর্জন উঠছে। আকাশে জোরালো মেঘ নেই, মাঝে মাঝে পাতলা পর্দাটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে গিয়ে উঁকি দিচ্ছে তারা। কিন্তু বাতাসের বিরাম নেই, ঢেউ উঠছে সমানভাবে। হাতের পেশিগুলোকে দৃঢ় করে কফিলদ্দি নৌকোটাকে আর একটা বড় ঢেউয়ের ওপর দিয়ে বার করে নিয়ে গেল।

ভেতরে স্বামী-স্ত্রী বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ চমকে উঠল তারা।

ও মাঝি ভাই, মাঝি ভাই? পুরুষটির গলা।

জলের দিকে স্থির চোখ রেখে কফিলদ্দি বললে, কী কন? কন কী?

গাং দেহি কেমন কেমন ঠ্যাকে। কাইতান (কার্তিকী তুফান) ওঠল নাকি?

চিন্তিত স্বরে কফিলদ্দি বললে, মনে তো লয়।

খাইছে! পুরুষটির স্বরে ভয়ার্ত কাতরতা ফুটে বেরুল, নাও কোনহানে (কোন খানে)?

মদ্য গাঙে (মাঝ নদীতে)।

হাসানদির চর?

ঠাহর পাইতে আছি না।

 অ্যাহন কর কী? কফিলদ্দি মেয়েটির একটা অস্ফুট আর্তনাদও যেন শুনতে পেল।

ডরাইবেন না, চুপ মারিয়া শুইয়া থাহেন। আমার নাও ডোববে না।

কইবে কেডা? যে রাইকোসা (রাক্ষুসে) গাং, মানুষ খাউনের লইগ্যা জেব্বা (জিহ্বা) বাড়াইয়া রইছে।

নাও ফালাইতে (ডোবাতে) এয়ার আর দোসর নাই।

মেয়েটির আর্তনাদ এবার স্পষ্টই শুনতে পেল কফিলদ্দি। আর সঙ্গে সঙ্গেই কেমন একটা বিশ্রী বিরক্তিতে তার মনটা আচ্ছন্ন হয়ে উঠল। রূঢ় গলায় বললে, ফ্যাগড়া প্যাচাল পাড়েন ক্যান কত্তা? (বাজে বকছেন কেন?) চুপ মারিয়া শুইয়া থাহেন কইলাম। আমার নাও গেলনের আগে নদীরে পিরের শিন্নি খাইয়া আইথে লাগবে। (আমার নৌকো গিলবার আগে নদীকে পিরের শিন্নি খেয়ে আসতে হবে।)

বাচাইলে তুমি বাচাইবা, মরলে তোমার হাতেই মরুম। পুরুষটি মূঢ় অসহায় গলায় জবাব দিলে।

মরণের অ্যাহন হইছে কী? খামাকখা (খামোকা) হাবিজাবি কইয়া মাঠারইনরে ডরাইতে আছেন, চোপাহান (মুখোনা) একটু খ্যামা দিয়া থোয়ন।

চুপ করে গেল পুরুষটি। কফিলদ্দির কণ্ঠস্বরের রূঢ়তাটা তাকে নিরুৎসাহ করে দিয়েছে। বিপদে পড়লে খানিকটা প্রগলভ হয়ে ওঠে মানুষ, কথার ভেতর দিয়ে মনের থেকে নামিয়ে দিতে চায় পুঞ্জিত ভয়ের বোঝাটা। কিন্তু সে-অবস্থা নয় কফিলদ্দির। হাতের পেশিকে লোহার মতো শক্ত করে যখন খ্যাপা ঘোড়ার মতো উচ্ছঙ্খল ঢেউকে একটার পর একটা টপকে যেতে হচ্ছে, যখন চোখের দৃষ্টিকে রাত্রিচর পাখির মতো তীক্ষ্ণ তীব্র করে রাখতে হচ্ছে নিকষ কালো অন্ধকারে ঢাকা চক্রবালের দিকে, এবং যখন জানা আছে কালাবদরের এই মাঝগাঙে দুশো হাত লগিরও থই মিলবে না, তখন উৎসাহের অভাবটা কফিলদ্দির তরফ থেকে একান্ত স্বাভাবিক এবং সঙ্গত।

আকাশে হালকা হালকা মেঘ বটে, কিন্তু এককোণে পেটা লোহার এক টুকরো পাতের মতো খানিকটা ঘন কৃষ্ণতা লেপটে আছে আকাশের গায়ে। ঝড়াং ঝড়াং করে লাল বিদ্যুতের এক-একটা শিখা সেখানে কতগুলো আগ্নেয় বাহু এদিক-ওদিক বাড়িয়ে দিয়েই ফিরে যাচ্ছে আবার। কালাবদরের কালো জলটা অদ্ভুতভাবে কুটিল হয়ে উঠছে সে-আলোয়, যেন জলের তলা থেকে একটা অতিকায় অক্টোপাস তার রক্তাক্ত বহুভুজগুলি নিয়ে মুহূর্তের জন্যে ভেসে উঠেই আবার হারিয়ে যাচ্ছে ভয়ংকর গভীর অতলতায়। আর ওদিকে মাঝে মাঝে শঙ্কিতভাবে তাকাচ্ছে কফিলদ্দি। ওই ইস্পাতের পাতটা যদি ক্রমশ নিজেকে ছড়াতে আরম্ভ করে, যদি একসময় একটা দমকা হাওয়ায় আচ্ছন্ন করে ফেলে সমস্ত আকাশটাকে, তাহলে? তাহলে?

পায়ের থেকে মাথা পর্যন্ত শিউরে উঠল কফিলদ্দির। পাকা মাঝি, কালাবদরের কালো জলের সঙ্গে তার পরিচয় সুদীর্ঘ এবং ঘনিষ্ঠ। আর এই কারণেই নদীকে তার বিশ্বাস নেই। উন্মাদ কালাবদরের কাছে বড়ো বড়ো জাহাজও যা, একমাল্লাই শালতিরও সেই একই অবস্থা।

ঢেউয়ের বেগটা প্রবল হচ্ছে ক্রমশ, বাতাস এখন চোখে-মুখে যেন ঝাপটার মতো ঘা দিতে শুরু করেছে। লাল বিদ্যুতের আকস্মিক উদ্ভাসে সামনে যতদূর চোখ যাচ্ছে শুধু ঢেউয়ের ফেনা উপচে উপচে পড়ছে। ভূতগ্রস্ত মানুষ যেমন বিশৃঙ্খলভাবে মাতামাতি করতে থাকে, গ্যাঁজলা ভাঙে তার মুখ দিয়ে, তেমনি অসংবৃত উচ্ছঙ্খল হয়ে গেছে নদী, তেমনি করে ফেনা গড়াচ্ছে তার লক্ষ লক্ষ মুখে। কালাবদরকে ভূতে পেয়েছে।

হৃৎপিন্ড থেকে একঝলক রক্ত যেন উছলে উঠে কফিলদ্দির মাথার মধ্যে গিয়ে পড়ল। বইঠাতে প্রবলভাবে টান দিলে সে, নৌকোটা আকস্মিকভাবে যেন মস্ত একটা লাফ দিয়ে হাত তিনেক এগিয়ে গেল। নৌকোর ভেতরে ভয়ার্ত যাত্রী দুজন প্রায় হাহাকার করে উঠল।

কী হইল, ও মাঝিভাই, হইল কী?

চুপ করেন কইলাম-না? কফিলদ্দি গর্জে উঠল, অ্যাক্কালে চুপ!

যাত্রীরা চুপ করল। কোনো উপায় নেই, কিছু বলবার নেই। অসহায়, বিব্রত, মাঝির করুণার কাছে একান্তভাবেই আত্মসমর্পিত। কফিলদ্দি ইচ্ছা করলে ওদের খুন করতে পারে, রাত্রির অন্ধকারে পুঁতে দিতে পারে কালাবদরের যেকোনো একটা বালুচরের হোগলাবনের মধ্যে, কেউ টের পাবে না; একটা রক্তের বিন্দু দূরে থাক, এক টুকরো হাড়ও খুঁজে পাবে না কোনোদিন। নইলে একটা পাক দিয়ে চোখের পলকে ডুবিয়ে দিতে পারে নৌকো, মুহূর্তে তলিয়ে দিতে পারে ক্ষিপ্ত কালোজলের ভেতরে। কালাবদরের মাঝি—ওর আর কী, কিছুতেই ডুববে না, একটা খড়ের আঁটির মতো অবলীলাক্রমে ভাসতে ভাসতে ডাঙায় গিয়ে পোঁছোবেই শেষপর্যন্ত।

কিন্তু কফিলদ্দির আত্মবিশ্বাস নেই অতটা। কালাবদরকে সে চেনে, কালাবদরকে সে বিশ্বাস করে না। ঠিক কথা; এ সাধারণ নদী নয়, এ ভূতুড়ে। এর জলের ভেতরে শয়তান লুকিয়ে আছে। এর ঢেউয়ে ঢেউয়ে হাজার হাজার প্রেতাত্মা নেচে বেড়ায়। কত মানুষ যে এই নদীতে ডুবে মরেছে তার কি হিসেব আছে কিছু! এর অদৃশ্য অতলতায় বালির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আছে শ্যাওলা-ধরা অসংখ্য কঙ্কাল, অসংখ্য নরমুন্ডের শূন্য খোলের ভেতরে ডিম পাড়ছে গভীরচারী পাঙাস মাছের দল। ডোবা নৌকোর পচা-ভাঙা কাঠের ভেতরে কিলবিল করে বেড়ায় রাক্ষুসে কামটের ছানা। আর… আর আছে প্রেতাত্মা। দুর্যোগের রাত্রে, ঝড়ের রাত্রে তারা উঠে আসে, উদ্দাম জলের দোলায় দোলায় তান্ডব নাচে, অসহায় মানুষ পেলেই হিমশীতল কঙ্কাল বাহু বাড়িয়ে টেনে নেয় তাদের। সদ্য নোনা-কাটা চরের হোগলা আর শণঘাসের বনে ডাকাতের হাতে অপঘাতে যারা প্রাণ দিয়েছে, জলের গর্জনে গর্জনে তাদেরও বিকট অট্টহাসি বেজে ওঠে, তারাও…।

গজরাচ্ছে কালাবদর, মেতে উঠেছে ফেনায় ফেনায়। লোহার চ্যাপটা পাতটার ভেতরে বজ্র ঝলকাচ্ছে, জলের মধ্যে লিকলিক করে উঠছে রক্তাক্ত অক্টোপাস। কফিলদ্দির সারা গা দিয়ে ঘাম ছুটতে লাগল। নৌকো এগোচ্ছে না, প্রতিকূল জল ক্রমাগত বাধা দিচ্ছে। ক্রমাগত প্রেতাত্মাদের কঙ্কাল হাতগুলো যেন তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে। হু-হু করে বাতাস বয়ে যাচ্ছে, কোথাও যেন যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে কেউ। মাঝে মাঝে ঢেউয়ের মাথায় কী চিকচিক করছে, যেন সেই তাদের চোখ, সেই যারা…

পাঁচ পির বদর বদর…

হঠাৎ আর্তনাদের মতো শব্দ করে বিকটভাবে চেঁচিয়ে উঠল কফিলদ্দি। তার ভয় করছে, ভয় ধরেছে তার। জলের ভয় নয়, এইসব প্রেতাত্মাদের ভয়। মাঝে মাঝে এইরকম এক একটা আকস্মিক ভয়ে কালাবদরের মাঝিদেরও মন আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। কিন্তু কফিলদ্দি জানে এ খারাপ লক্ষণ; ভারি খারাপ, ভারি খারাপ লক্ষণ। দুর্যোগের রাত্রে যখন মরণ ঘনিয়ে আসে, তখনই এই ধরনের ভয় পায় মাঝিরা। কেউ ডুবে মরে, কেউ পাগল হয়ে যায়, কারো কারো জবাফুলের মতো রাঙা চোখ দুটোর ভেতর দিয়ে যেন রক্ত ফেটে পড়বার উপক্রম করে মুখ দিয়ে এমনি করেই ফেনা গড়াতে থাকে।

লা ইল্লাহা, রসুলাল্লা।

না না, এ ভয় চলবে না কফিলদ্দির। এ ইচ্ছে করে নিজের মৃত্যু ডেকে আনা ছাড়া আর কিছু নয়। মানুষে ভয় পেলেই তার দুর্বল স্নায়ুর ওপরে ইবলিশ তার প্রভাব বিস্তার করে, মানুষের অসতর্কতার সুযোগ নেবার জন্যেই তৈরি হয়ে থাকে জিন-পরি-প্রেতাত্মার দল! চোখ বুজে আবার প্রবল বেগে দাঁড়ে টান দিলে কফিলদ্দি। এ অন্ধকারে চোখ বুজে আর চোখ চেয়ে থাকা একই কথা।

নৌকোর পুরুষ যাত্রীটি আবার স্তব্ধতা ভঙ্গ করলে।

ও মাঝি ভাই, হোনছ নি?

কী কইথে আছেন?

নায়ের পাল উড়াইয়া দ্যাও-না? বায়ে (বাতাসে) লইয়া যাউক।

হ, এতক্ষুণে অ্যাট্টা পন্ডিতের মতো কথা কইছেন। অত্যন্ত তিক্ত শোনাল কফিলদ্দির স্বর।

অপরাধীর গলায় পুরুষটি আবার বললে, ক্যান, অন্যে কইছি নাকি? জোর কাইতান মারতে আছে, নাও ডুবাইয়া দে (ডুবিয়ে দেয়) কি না বোঝতে আছি না। হেয়ার থিয়া (তার চেয়ে) বায়ে যেদিক লইয়া যায়…

যা বোঝেন না, হেয়ার উপার কথা কইয়েন না কত্তা। দ্যাখতে আছেন না গাঙের চেহারাডা? বায়ে যদি সুমুদুরে টানিয়া লইয়া যায়, হ্যাশে (শেষে) কী হরবেন (করবেন)? লোনা সুমুদুরে ডুবিয়া মরণের সাধ হইছে নি?

তা বটে। এ যুক্তি নির্ভুল। কালাবদরের বুকে খ্যাপা বাতাস ক্রমশ ঝড়ের রূপ নিচ্ছে। এই ঝড়ের মুখে পাল তুলে দিলে দেখতে দেখতে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে কে জানে? সমুদ্রে না হোক অন্তত তার মোহনার মুখে নিয়ে গিয়েও যদি ফেলে দেয়, তা হলে আর আশা নেই। কালাবদর যদি-বা ক্ষমা করতে রাজি থাকে, কিন্তু ভয়ংকর বিপুল সমুদ্রের ক্ষমা নেই। কালাবদরের চাইতেও ঢের বেশি নিবিড় তার কালো রং, তার জলের মাতামাতি আরও উদ্দাম। কালাবদরে তবু কূল মিলতে পারে, কিন্তু সমুদ্র অকূল, আদি অন্তহীন।

হেইলে উপায়?

খোদা ভরসা।

খোদা ভরসা। তাই বটে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুরুষটি চুপ করে গেল। আর জলের ক্ষিপ্ত কলধ্বনির মধ্যেও কফিলদ্দি শুনতে পেল মেয়েটির চাপা কান্নার শব্দ। ওরা ভয় পেয়েছে, অত্যন্ত ভয় পেয়েছে।

জলের সঙ্গে লড়াই করতে করতে হাতের পেশিগুলো যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে কফিলদ্দির। দাঁতের ওপর দাঁত চেপে বসেছে, শরীরের সর্বাঙ্গে বয়ে যাচ্ছে ঘামের স্রোত। এতদিনের পরিচিত অভ্যস্ত নৌকোটাও যেন আজ বাগ মানছে না। কী কুক্ষণেই আজ সে কেরায়া ধরেছিল।

হু-হু হু-হু বাতাসের অশ্রান্ত আর্তনাদ। অন্ধকার জলের ওপরে থেকে থেকে রক্তাক্ত চমকানি। উঃ, বাতাসটা কি আজ আর কিছুতেই থামবে না? চারদিকে প্রেতাত্মাদের গোঙানি চলেছে সমানে। ঢেউয়ের মাথায় মাথায় তেমনি চিকচিক করে ঝিকিয়ে উঠছে কাদের বিষাক্ত কুটিল চোখ, ফেনাগুলো উছলে উছলে পড়ছে চারিদিকে—যেন কাদের পৈশাচিক কঙ্কাল মুষ্টিগুলো ওদের নিষ্পিষ্ট করবার জন্যে বারে বারে খুলছে আর বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অপরিসীম ভয়ে আবার চোখ মুদে ফেলল কফিলদ্দি, শক্ত করে চেপে ধরলে চোখের পাতা দুটো, জলের দিকে আর সে তাকাতে পারছে না।

কফিলদ্দি ভয় পেয়েছে, ওদের চাইতেও বেশি ভয় পেয়েছে। নদীর ভয়? না, তার চাইতেও ভয়ানক, ভয়ানক পিশাচের ভয়, অপদেবতার ভয়। এর চাইতেও অনেক কঠিন দুর্যোগের ভেতরে তার শালতি নির্ভয়ে পথ কেটে এগিয়ে গিয়েছে, মৃত্যুর রাক্ষসরূপ কালাবদর তাকে দেখিয়েছে অনেক বার। কিন্তু পাকা মাঝির বুক তাতে এমন করে আতঙ্কে ভরে যায়নি, এমন করে তার স্নায়ুকে শিথিল নিস্তেজ করে দিতে পারেনি। বরং দুলে উঠেছে রক্ত, কলিজার ভেতর বয়ে গেছে উত্তেজনার উত্তপ্ত জোয়ার। দাঙ্গার সময় বিরুদ্ধ দলের মধ্যে লাঠি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেলে শিরায় শিরায় রক্ত যেমন টগবগ করে ফুটতে থাকে, তেমনি একটা কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সংকল্পে সতেজ আর সজাগ হয়ে উঠেছে চেতনা। কিন্তু আজ এমন হল কেন? যেন মন হচ্ছে আজ তার নদীর সঙ্গে সংগ্রাম নয়, এ যুদ্ধ কতকগুলো ভয়ংকর অশরীরীর সঙ্গে, কতকগুলো অপঘাতে মরা হিংস্র প্রেতাত্মার সঙ্গে। কেন হল! এমন কেন হল

বইঠা ছেড়ে দাঁড় ধরেছে কফিলদ্দি। তেমনি চোখ বুজে দাঁড় টেনে চলেছে, শরীরের সমস্ত শক্তিকে সঞ্চারিত করে নিয়েছে দুটো বাহুর মধ্যে। টানের সঙ্গে সঙ্গে শরীরটা গলুয়ের ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ছে নীচের দিকে। বুকের ভেতরে কী যেন চড়চড় করে উঠছে, হৃৎপিন্ডটা হঠাৎ করে ছিঁড়ে যাবে নাকি?

কেন এমন হল? কেন? সেও কি আজ পাগল হয়ে যাবে? তার চোখ দিয়ে অমনি করে ফেটে পড়বে রক্ত? আধ হাত জিভ বার করে দিয়ে সেও হাঁপাবে একটা ক্লান্ত কুকুরের মতো, আর থেকে থেকে আকাশ-ফাটানো এক-একটা অর্থহীন ভয়ংকর আর্তনাদ করে উঠবে?

লা ইল্লাহা, রসুলাল্লা

জিন জেগে উঠেছে, প্রেতমূৰ্তিরা মাথা তুলেছে চারদিকে। এ বাতাসের শব্দ নয়, তাদের আর্তনাদ; এ জলের গর্জন নয়, ফেনায় ফেনায় তাদেরই কঙ্কাল মুঠিগুলো মানুষের গলা টিপবার একটা লোলুপ উল্লাসে প্রসারিত হয়ে উঠেছে।

কালাবদরকে ভূতে পেয়েছে, পালাতে হবে এর কাছ থেকে! এ প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ নয়, অলৌকিক সত্তার সঙ্গে। রহমান-রহিমতুল্লা! দাঁড়ের ঝাঁকিতে ঝাঁকিতে হোঁচট-খাওয়া মাতালের মতো অসংলগ্ন গতিতে চলেছে নৌকা। কফিলদ্দির হৃৎপিন্ডটা কখন বুঝি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।

হু-হু হু-হু বাতাসের বিরাম নেই। উন্মত্ত কালোজলে মুহুর্মুহু ভেসে উঠছে রক্তাক্ত অক্টোপাসটা। নৌকোর যাত্রী দুজন পরস্পরকে জড়িয়ে পড়ে আছে মূৰ্ছিতের মতো, আর অশরীরীদের সঙ্গে লড়াই করে অমানুষিক শক্তিতে দাঁড়ে ঝাঁকি মারছে কফিলদ্দি। আল্লা, আল্লা, নবি।

আকাশের মেঘের পর্দাটা আরও যেন ঘন হয়ে চেপে বসছে। অন্ধকার—দুর্ভেদ্য, আদি অন্তহীন।

সওয়ারি নামিয়ে দিয়ে কফিলদি ময়লা গামছা পেতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। বেশ বেলা হয়েছে, মিষ্টি নরম রোদে ধুয়ে যাচ্ছে পৃথিবী, সোনা মেখে ঝলমলিয়ে উঠেছে কালাবদরের জল! দুর্যোগের চিহ্নমাত্র নেই কোনোখানে।

এমন কিছু অসম্ভব দুর্যোগ নয়, তবু কাল রাত্রে কেন এত ভয় পেল কফিলদ্দি?

আর আশ্চর্য! তখন একটা কথা বিদ্যুৎচমকের মতো মনের মধ্যে সাড়া দিয়ে উঠল। সোজা হয়ে কফিলদ্দি উঠে বসল, সরিয়ে ফেললে পাটাতনের তক্তা একখানা। চোখে পড়ল শানানো মস্ত রামদাখানা সেখানে ঝকমক করছে।

আরও মনে পড়ল মহাজনের দেনায় জ্বালাতন হয়ে কাল সে খেপে গিয়েছিল। কাল সে চেয়েছিল প্রথম ডাকাতি করতে, প্রথম মানুষ খুন করে রক্তের আস্বাদ নিতে। কিন্তু কথাটা সে ভুলে গেল কেন? কাল রাত্রে কালাবদরের জলে যারা তাকে ভয় দেখিয়েছিল তারা কি প্রেতাত্মা? নাকি আল্লার ক্রোধ সহস্র সহস্র তর্জনী তুলে শাসন করেছিল তার পাপকে, তার মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ইবলিশকে? বিমূঢ়ের মতো রামদাখানার দিকে তাকিয়ে রইল কফিলদ্দি! কী আশ্চর্য, কথাটাকে এমন করে ভুলে গেল কেমন করে?

নরম রোদে অপূর্ব প্রশান্ত হয়ে গেছে কালাবদর। কফিলদ্দির নৌকার গায়ে কুলকুল করে সস্নেহ আঘাত দিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ লক্ষ কালনাগিনি যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছে, শুনতে পেয়েছে কোনো সাপ-খেলানো বাঁশির সুর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *