ভোগবতী

ভোগবতী

এপারে বাংলা, ওপারে মানভূম। পাথর-মেশানো রাঢ়ের অনুর্বর কঠিন বিস্তারের ওপর দিয়ে রাঙা সুরকির পথ। মাঝে মাঝে শালের ঘনবিন্যাস। হিমালয়ের বুকে শালবীথির যে সমুন্নত উদ্ধত মহিমা, এরা যেন তাদের সংক্ষিপ্ত হাস্যকর সংস্করণ। আকন্দের ঝোপের মতো রাশি রাশি পলাশও মাঝে মাঝে বিকীর্ণ হয়ে আছে। ওই পলাশবন যে বসন্তে রাঙা ফুলের চেলি পরে নিজের বিন্দুতম শ্যামলিমাকেও নিশ্চিহ্ন করে মুছে ফেলে—এটা যেন কেমন অদ্ভুত অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়।

কিন্তু এ দেশটার রীতিই এই। যেন জগৎটাকে সৃষ্টি করবার আগে বিশ্বকর্মা এখানে তাদের ছোটোখাটো কতকগুলো মডেল তৈরি করে নিয়েছিলেন। অথবা যেন পৃথিবীর বড়োসড়ো আকারের একটা রিলিফ ম্যাপ। নদী আছে, কিন্তু মোটা মোটা বালিদানা আর ছোটো-বড়ো পাথরের টুকরোর ভেতর দিয়ে তাদের জলের ধারাটা এক ফালি অভ্রের পাত বলে ভুল হতে পারে। আর আছে পাহাড়। শুধু রাত্রির অন্ধকারে যেখানে বার্নপুরের চিমনির আভায় কালো দিগন্তটা লাল হয়ে থাকে, সেদিকটা ছাড়া আর তিন দিকেই চলেছে পাহাড়ের অনন্ত শ্রেণি।

একদিকের দূরান্ত রেখায় পঞ্চকোট, অন্যদিকের চক্ৰবালে শুশুনিয়া পাহাড়ের অলক্ষপ্রায় ছায়ামূর্তি। মাঝখানে বিহারীনাথ পাহাড়। তা ছাড়া ছোটো-বড়ো অখ্যাত ও অজ্ঞাতনামা পাহাড়ের কোনো সীমাসংখ্যাই নেই। কোনোটায় পলাশের জঙ্গল, কোনোটা একেবারে ন্যাড়া। কোনোটা নিতান্তই জংলা—শতমূলী সহস্ৰমূলী থেকে শুরু করে দু-হাত উঁচু আবলুস গাছ আর নলবনের মতো সরু সরু পাহাড়ি বাঁশ অথবা বাঁশের ক্যারিকেচার। তাতে কখনো কখনো বাঘের সন্ধান পাওয়া যায় আর মাঝে মাঝে দেখা হয় শঙ্খচূড় সাপের সঙ্গে। স্বল্পবিস্তীর্ণ একটা ব্যাসার্ধের ভেতরে সমস্ত পৃথিবীর ভূগোল-পরিচয়।

বহু দূরে দূরে ভদ্রলোকের গ্রাম। আর সাঁওতাল—সব সাঁওতাল। চাষি সাঁওতাল, খেড়ে সাঁওতাল। চাষি সাঁওতালরা ভদ্র পাড়ার কাছাকাছি এসে বাসা বেঁধেছে। চাষ করে, সবজি লাগায়। জামাকাপড় পরে তারা, কখনো কখনো কাঁচা চামড়ার ফাটা ফাটা মোটা জুতোও। আর খেড়ে সাঁওতালের কোমরে এখনও লেংটি, কানে ফুল গোঁজা, মাথায় বাবরি, হাতে কাঁড় বাঁশ। ভাতের মহিমা উপলব্ধি করে তারা এখনও পুরোপুরি ভেতো হয়ে উঠতে পারেনি, বনেজঙ্গলে প্রচুর প্রাণপ্রাচুর্য নিয়ে তাদের প্রাকৃতিক খাদ্য ছড়িয়ে পড়ে আছে।

এদের মাঝামাঝি যারা, তারা কাঠুরে। ভদ্রলোক জমিদার বাবুদের পাহাড়ে তারা বিনা অনুমতিতে কাঠ কাটে। এসব পাহাড়ে তাদের জন্মগত অধিকার। দশ মাইল দূরের জমিদার কোন সূক্ষাতিসূক্ষ আইনের বলে পুত্রপৌত্রাদিক্রমে এ সমস্ত পাহাড়ের ভোগদখলের অধিকারী, তাদের স্থূল মস্তিষ্কে সেটা সহজে প্রবেশ করে না।

দূরের থেকে যে-পাহাড়টাকে কালবৈশাখী মেঘের মতো নিবিড় নীলবর্ণ বলে মনে হয়, ওর নাম ভৈরব পাহাড়। ওর সর্বাঙ্গে জঙ্গল, নিবিড় জঙ্গল। মাটি আর পাথরের ফাঁকে ফাঁকে জন্মেছে যেন প্রাগৈতিহাসিক অরণ্য। কিন্তু ছোটো পাহাড়টির মতো গাছগুলিও ছোটো ছোটো, জ্বালানি ছাড়া কোনো কাজেই তারা লাগে না।

এই পাহাড়ে কাঠ কাটতে এল শুকলাল আর সোনা।

ভোর হয়ে আসছে। বার্নপুরের আকাশে রক্তাভ ফিকে হয়ে আসছে, আর রাঙা রং ধরছে শুশুনিয়ার ছায়ামূর্তির আশেপাশে। হালকা-শিশিরে-ভেজা পাহাড়ি গাছগাছড়া আর রাঢ়ের রাঙামাটির বুক থেকে উঠছে প্রতিদিনের পরিচিত লঘু একটি মিষ্টি গন্ধ।

ঝাঁকড়া তিন-চারটে মহুয়া গাছের তলা থেকে এখনও রাত্রির অন্ধকার সরে যায়নি। সেটাকে পাশ কাটিয়েই এগিয়ে যাচ্ছিল শুকলাল, পেছন থেকে সোনা তার হাত চেপে ধরলে।

এই মোড়লের পো, বাবাঠাকুরকে প্রণাম করলিনে?

থেমে দাঁড়িয়ে শুকলাল হাসল, ঠাকুরের ঘুম এখনও ভাঙেনি, জাগালে রাগ করবে। দেরি করিসনি সোনা, চল।

সোনা ভ্রুকুটি করলে, মশকরা করিসনে খালভরা। ঠাকুরকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করছিস, পাহাড়ে তোকে বাঘে ধরবে দেখিস। আয়, প্রণাম করে যা ঠাকুরকে।

নিজের পেশল শরীরটার দিকে এক বার তাকাল শুকলাল। পলিমাটির দুলাল নয়, পাথুরে দেশের পাথরে তৈরি দামাল ছেলে। বললে, বাঘের বরাত মন্দ না হলে বাঘ আমাকে ধরতে আসবে না।

থাক, থাক, খুব মরদ হয়েছিস। গলার স্বরে অবজ্ঞা ফোঁটাবার চেষ্টা করলেও সেটা ফুটল। কালো সাঁওতাল মেয়ের কালো চোখে আনন্দিত গর্বের আলোই ঝিলিক দিয়ে গেল। সত্যিই অহংকার করবার অধিকার আছে শুকলালের। তার কুড়লের ঘায়ে শুধু গাছগাছালিই নয়, শক্ত পাথর পর্যন্ত গুঁড়ো হয়ে যায়। শুকলালের চওড়া বুকের ওপর খেলা করে গেল সোনার সানুরাগ সস্নেহ দৃষ্টি।

আর তেমনি সপ্রেম গভীর চোখে সোনার ওপরে দৃষ্টি বুলিয়ে নিলে শুকলাল। শুশুনিয়া পাহাড়ের আকাশে রঙের সমুদ্রে ডুব দিয়ে রক্তপদ্মের মতো সবে ফুটে উঠেছে প্রথম সূর্য। সোনার যৌবনোজ্জ্বল দেহেও তার আভাস এসে পড়েছে—যেন তারও ভেতরে কোথায় পাঁপড়ি মেলেছে ভোরের পদ্ম। হাওয়ায় কাঁপা পদ্মপাতার শ্যামলতা তার ভেতরেও যেন হিল্লোলিত হয়ে উঠেছে।

চকিতে চোখ নামিয়ে নিলে সোনা। বললে, আয়, প্রণাম করবি।

মহুয়াকুঞ্জের তলায় ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার, অবসিত রাত্রি আর ছায়ার মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটছে এতক্ষণে। পাথরের ঠাকুরও বোধ হয় ঘুমভরা চোখ মেলে জেগে উঠেছেন, মহুয়া পাতার ফাঁকে ফাঁকে কালো গ্রানিটের ওপরে পড়েছে টুকরো টুকরো রঙের ফালি।

পাহাড়ের নীচে প্রতিহারী হয়ে আছেন বাবাঠাকুর। চওড়া একখানা শিলাপট্টমাটির ভেতরে আধাআধি পরিমাণে সমাহিত। তার মাথার ওপর ছেনি দিয়ে কাটা একটা সিংহের আকৃতি। নীচে অশ্বারোহী একটি বীরপুরুষের মূর্তি, তার প্রসারিত হাতে খোলা একখানা সুদীর্ঘ তরবারি; বোঝা যায় কোনো দিগবিজয়ী রাজা নিজের শৌর্যবীর্যকে অক্ষয় করে রাখবার প্রয়াস পেয়েছিলেন। শিলাপট্টের গায়ে কিছু কিছু লেখাও আছে, তার আভাস মাত্র পাওয়া যায়। বাকিটা তলিয়ে আছে মাটির নীচে, হয়তো ভবিষ্যৎ কালের কোনো প্রত্নতত্ত্ববিদের হাতে মুক্তির প্রতীক্ষায়।

কিন্তু এসব বোঝবার শিক্ষাদীক্ষা নেই সরল সাঁওতালের। গাছতলায় একটা বড়ো পাথর দেখলেই তারা সিঁদুর মাখিয়ে পুজো করে, একটা ভাঙা মূর্তি দেখলেই থান বসিয়ে দেয় মুরগি বলি। তাই এখানকার বিস্মৃতনামা রাজা রূপান্তরিত হয়েছেন পাহাড়ের অধিষ্ঠাতা ভৈরবঠাকুরে।

ঠাকুরপ্রণাম করে পাহাড়ে উঠল শুকলাল আর সোনা। কাঠুরেদের যাতায়াতে জঙ্গল ভেঙে দু-একটা সরু পথ আপনা থেকে তৈরি হয়েছে এদিকে-ওদিকে, সরীসৃপ গতিতে পাহাড়ের চারদিকে পাক খেয়ে গেছে। তা ছাড়া দুর্ভেদ্য জঙ্গল, পাথরের চাঙাড়ের ফাঁকে ফাঁকে মাটির ভেতর থেকে রাশি রাশি বুনো গাছ আর লতার জটিলতা। কাঁটাগাছের মাথায় হাওয়ায় দুলছে বনধুধুল। মাঝে মাঝে ফুটে উঠেছে ভূঁইচাঁপা আর কাঠগোলাপ। কোথাও কোথাও বেগুনে রঙের ফুলের বাহার নিয়ে পাহাড়ের আড়ালে আড়ালে উঁকি দিচ্ছে লজ্জাবতী। ছোটো ছোটো পাখি নেচে বেড়াচ্ছে এদিক-ওদিকে।

শুকনো আধ-শুকনো গাছ খুঁজে কুড়ল চালাতে লাগল শুকলাল, আর মোটা একটা গুলঞ্চের লতা দিয়ে খড়ির আঁটি বাঁধতে লাগল সোনা। ওরই এক ফাঁকে কখন দুটো বঁধুল সংগ্রহ করেছে সোনা, গোটা কয়েক কাঠগোলাপও সাজিয়ে নিয়েছে খোঁপায়। সংসারের কথা ভোলেনি, সেইসঙ্গে একটুখানি অঙ্গরাগও করে নিয়েছে। মাঝে মাঝে একটা গানের কলিও গুনগুন করে উঠেছে। কিন্তু আপাতত তার দিকে নজর নেই শুকলালের। বিশ্রামহীনভাবে তার কুড়ল চলছে, মড়মড় খটখট শব্দে ভেঙে পড়ছে গাছ আর গাছের ডাল। আর থেকে থেকে বাঁ-হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলছে কপালে-জমে-ওঠা বড়ো বড়ো ঘামের বিন্দুগুলো।

এর মধ্যেই কখন উঠে গেছে অনেকখানি বেলা। শুশুনিয়া পাহাড়ের মাথা ডিঙিয়ে সূর্য উঠে এসেছে আকাশের মাঝখানে। পাথর গরম হয়ে উঠেছে, চারদিক থেকে বিস্তীর্ণ হয়ে পড়ছে একটা বাষ্পীয় উত্তাপ। এতক্ষণ পরে হাতের কুড়ল নামিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াল শুকলাল—হাঁপাতে লাগল।

ওদিকে পিঠের বোঝাটাও বেশ ভারী হয়ে উঠেছে সোনার। রোদে টকটক করছে মুখ। দুজনে দুজনের দিকে তাকাল।

শুকলাল বললে, ভারি গরম।

শ্রান্ত গলায় সোনা জবাব দিলে, এখন থাক। ঝোরার কাছে চল।

ঝোরা! মনে পড়তেই যেন শান্তি আর তৃপ্তির একটা স্নিগ্ধ অনুভূতি এসে সর্বাঙ্গ জুড়িয়ে দিলে ওদের। ঝোরা। এই বিস্তীর্ণ নির্মম পাষাণের বুকের ভেতর থেকে উচ্ছলিত ফন্তুর প্রবাহ। পাহাড়ের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় একটা ভাঁজ পড়ে যেখানে ছোটো একটা মালভূমির মতো সৃষ্টি হয়েছে, ওইখানে ছোটো অশ্বথ আর ছোটো পলাশের ছায়াকুঞ্জের ভেতর প্রকান্ড একখানা পাথরের তলা দিয়ে একটা ঝরনা নেমেছে এসে। এত বড়ো পাহাড়ে ওটা ছাড়া আর কোথাও একবিন্দু জল নেই। ওই জলটা কোথা থেকে নিঃশব্দ প্রবাহে যে বয়ে আসছে। কেউ বলতে পারে না। কিন্তু মাটির তলা থেকে উৎসারিত ভোগবতীধারার মতোই ওর ঠাণ্ডা আর মিষ্টি জল কঠিন পাহাড়টার মর্মবাহী স্নেহের মতো উছলে পড়ছে।

হাতের কুড়ল আর পিঠের বোঝা নামিয়ে রেখে পাথর বেয়ে বেয়ে ঝরনার পাশে এসে বসল দুজনে। চারপাশে নিবিড় ছায়া দুপুরের রোদে যেন ঝিমুচ্ছে। পাহাড়ে যে দু-চারটে বড়ো গাছ আছে—এখানেই যেন তারা সার বেঁধে রয়েছে। ইচ্ছে করেই ওদের গায়ে হাত দেয়নি কাঠুরেরা। রাঢ়ের আগুনঝরা দুপুরে পাথরের অসহ্য উত্তাপের ভেতর এখানে ওদের মরূদ্যান।

পাথরের তলা থেকে বেরিয়ে নীচে যেখানে ছোটো একটা গর্তের ভেতরে একটুখানি জল জমেছে, দুটো নীলকণ্ঠ পাখি পরমোল্লাসে সেখানে স্নান করছিল পাখা নেড়ে। মানুষের সাড়া পেয়েও তারা ভয় পেল না, ধীরেসুস্থে তারা ঠোঁট দিয়ে নিজেদের সদ্যস্নাত নরম পালকগুলোকে পরিষ্কার করে নিলে। তারপর মিষ্টিগলায় কী-একটা ডেকে লাফাতে লাফাতে বনের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল।

ততক্ষণে সোনা আর শুকলাল এসে বসেছে ছায়ার নীচে। মিঠে বাতাসে দুজনের ক্লান্তি যেন এক মুহূর্তে দূর হয়ে গেছে। সোনার কাছে আরও ঘন হয়ে এসে শুকলাল বলল, দেখলি?

কী দেখব?

ওই পাখি দুটো।

ওদের দেখবার কী আছে?

এতক্ষণ ওরা এখানে এ ওকে সোহাগ করছিল, চান করছিল। তুই আমি এলাম দেখে জায়গা ছেড়ে দিয়ে সরে গেল।

মুখের ভঙ্গি করে সোনা বললে, যাঃ।

হ্যাঁ, সত্যি!

ওরা কি এসব বোঝে?

বোঝে বই কী। সব বোঝে।

এবারে সোনা আরও কাছে ঘেঁষে এল শুকালের। তার খোঁপা থেকে একটা ফুল তুলে নিয়ে শুকলাল খেলা করতে লাগল।

বড়ো পিয়াস লেগেছে, জল খাই।

পলাশের পাতা ভেঙে নিয়ে দুটো ঠোঙা তৈরি করলে সোনা। ঠোঙা ভরে ভরে জল খেল দুজনে—ঠাণ্ডা জল, সুস্বাদু স্ফটিকের মতো জল। এই ঝোরা তাদের প্রাণ। যদি না-থাকত তাহলে কোনো কাঠুরের সাধ্য ছিল না এই পাহাড়ে এসে কাঠ কাটে। কাছাকাছি কোথাও জল নেই, শুধু এক মাইল দূরে একটা মরা নদী ছাড়া। দু-হাত বালি খুঁড়লে তা থেকে এক আঁজলা জল মিলতে পারে। নীরস অনুর্বরতার মাঝখানে এই ঝরনাটা একটা অপরিসীম বিস্ময়—যেন দৈবী করুণা। পাতালবাহিনী ভোগবতীর একটুখানি উদবেলিত স্নেহনির্যাস।

তৃপ্ত গলায় সোনা বললে, আঃ! ঠাকুরের দয়া দেখেছিস! পাথর-ফুড়ে কেমন জল দিয়েছে?

এবারে আর ঠাকুরকে নিয়ে ঠাট্টা করলে না শুকলাল। জলে ভিজে ভিজে সোনার একখানা ঠাণ্ডা হাত নিজের কড়া-পড়া মস্ত শক্ত মুঠোর মধ্যে জড়িয়ে নিলে। গভীর স্বরে বললে, সত্যি।

এবার উঠবি না মোড়ল? ওদিকে কাঠ আর কুড়ল পড়ে রইল যে।

থাক পড়ে, কেউ নেবে না। বস, আর একটু জিরুই। যা রোদ! একটু হেলে যাক।

দুজনে চুপ করে বসে রইল। অশ্বথের পাতা কাঁপছে, পলাশের পাতা কাঁপছে। বেলোয়ারি চুড়ির বাজনার মতো শব্দ করে পড়ছে ঝরনার জল, পাতার দোলানিতে মাঝে মাঝে চিকমিকে রোদ তার ওপরে খেলা করে যাচ্ছে। একখানা পাথর থেকে আর একখানার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বার সময় চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে হিরের গুঁড়ো। খানিক দূর গিয়ে তাকে আর দেখা যাচ্ছে না, আবার কোন পাথরের তলা দিয়ে পাতালের ফন্তু পাতালেই ফিরে গিয়েছে হয়তো।

রোদে ঝিমঝিম করছে পাহাড়, ঝিরঝির করছে হাওয়া। পাখির ডাক আসছে, সেই নীলকণ্ঠ পাখি দুটোই হয়তো। বেলোয়ারি চুড়ির মতো শব্দ করে তেমনি বাজছে ঝরনার একতারা। সোনা একটা গান ধরেছে, হয়তো ঝরনার সঙ্গে সুর মিলিয়েই। এমন সময় একটা বিজাতীয় শব্দে পাহাড়ের দিবাস্বপ্ন ভেঙে গেল।

তলিয়ে গেল নীলকণ্ঠ পাখির ডাক, ঝরনা আর সোনার মিলিত ঐকতান। শিকরে বাজের মতো বিশাল কালো একটা জানোয়ার আকাশে দেখা দিয়েছে। তার গর্জনে পাহাড়ের গুহা গহ্বরগুলো একসঙ্গে গুম গুম করে উঠল—যেন সাড়া দিয়ে উঠল আকাশচারী বিশাল জন্তুটার ডাকে, গম্ভীর ক্রুদ্ধ স্বরে কী-একটা প্রত্যুত্তর পাঠিয়ে দিলে একটা কুটিল জিজ্ঞাসার।

সোনা সোৎসাহে বললে, হাওয়াই জাহাজ।

শুকলাল বললে, তাই লাগছে পারা।

আয় দেখি।

ও আর কী দেখব। রোজই তো আসছে আজকাল, লড়াই বেঁধেছে কিনা।

আয়, আয়-না।

ঝরনার পাশ থেকে বেরিয়ে একটা বড়ো পাথরের ওপর দাঁড়াল ওরা। হাওয়াই জাহাজটা কোন খেয়ালে কে জানে, ওই পাহাড়টার চারিদিকেই ঘুরে ঘুরে চক্র দিচ্ছে। আরও আশ্চর্য! এত নীচে নেমে এসেছে যে ওর ভিতরের দু-তিনটে মানুষের মাথা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

ভয় পেয়ে সোনা শুকলালের পেছনে সরে এল, ওটা নামবে নাকি?

কে জানে। ওদের মর্জি!

সোনা বিস্ফারিত চোখে এরোপ্লেনটার দিকে তাকিয়ে রইল বিস্ময়ে নয়, ভয়ে। এই হাওয়াই জাহাজগুলো নাকি মানুষেরই কীর্তি। কিন্তু সোনার তা বিশ্বাস হয় না, তার আশঙ্কা হয় ওর ভেতরে অস্বাভাবিক একটা-কিছু লুকিয়ে আছে, একটা-কিছু অলৌকিক এবং ভয়ংকর। ঝড়ের রাত্রে যেসব ভূত-প্রেত-পিশাচ পাহাড়ে পাহাড়ে প্রচন্ড উল্লাসে নেচে বেড়ায়, ওই অস্বাভাবিক কান্ডটা যেন তাদেরই খেয়াল ছাড়া আর কিছু নয়। ওটা মাটিতে নেমে এলে যে কত বড়ো একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে, ভাবতেও ওর রক্ত জল হয়ে যায়।

বিমানটা কিন্তু নামল না। বার কয়েক পাহাড়ের মাথায় ঘুরপাক খেয়ে সাঁ করে একটা তিরের মতো বানপুরের দিকে দেখতে দেখতে উধাও হয়ে গেল। শুধু নির্মেঘ আকাশে অনেকক্ষণ ধরে একটা ধূমপুচ্ছ দীর্ঘ রেখায় বিস্তীর্ণ হয়ে রইল—যেন ধূমকেতুর সংকেত।

দু-দিন পরে পাহাড় থেকে কাঠের বোঝা নিয়ে নামবার পরে দেখা হরিকৃষ্ণ রায়ের সঙ্গে।

হরিকৃষ্ণ রায় এই পাহাড়ের মালিক পালবাবুর গোমস্তা। একটা হাড়-বের-করা টাট্টুঘোড়াকে শায়েস্তা করতে করতে আসছিল। পাঁজরের ওপরে জুতোর ঠোক্কর খেতে খেতে ঘোড়াটা যেভাবে এগোচ্ছিল, তাতে মনে হচ্ছিল যেকোনো সময় সে মুখ থুবড়ে ধরাশয্যা গ্রহণ করবে।

ওদের দেখে হরিকৃষ্ণ রায় ঘোড়ার রাশ টানল। কিন্তু রাশ না টানলেও সেটা এমনিই থামত।

খড়ির বোঝাটার দিকে একটা তির্যক কুটিল কটাক্ষ করলে হরিকৃষ্ণ।

বেশ মনের আনন্দে গাছ কাটছিস, অ্যাঁ?

দুটো খড়ি নিলাম খালি।

দুটো খড়ি! দুটো দুটো করে নিয়েই তো পাহাড়ের গাছপালাগুলো সব সাবাড় করে দিলি। বাবু ভালোমানুষ বলে করে খাচ্ছিস, কেমন?

জবাব না দিয়ে আপ্যায়নের হাসি হাসলে শুকলাল। তিরস্কারের মধ্যেও প্রচ্ছন্ন স্নেহের সুর আছে হরিকৃষ্ণের। তার মুখটাই খারাপ, মনটা নয়।

দাঁড়া, মিলিটারি আসছে। দু-দিনেই তোদের ঠাণ্ডা করে দেব।

কে আসছে বাবু?

মিলিটারি–মিলিটারি, মানে পল্টন। মাথার ওপর দিয়ে হাওয়াই জাহাজ গেল, দেখলি? এখানে কাঠের মধ্যে আস্তানা গাড়বে—দেখিস তখন।

কথার শেষে হরিকৃষ্ণ ঘোড়ার পিঠে একটা চাবুক বসাল। চিড়চিড় করে লাফিয়ে উঠে ঘোড়াটা তিন-পা দৌড়ে গেল, তারপর আবার গজেন্দ্রগতি।

সোনা পাংশুমুখে জিজ্ঞাসা করলে, আকাশ থেকে ওরা নেমে আসবে এখানে?

গম্ভীর চিন্তিত দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকাল শুকলাল। কয়েক মুহূর্ত পরে জবাব দিলে, হুঁ।

তারও পরে মাত্র একটা মাস। সব কিছু অদলবদল হয়ে গেল। পৃথিবীর রূপ পালটে গেল, পালটে গেল সোনা আর শুকলাল। সেই বুড়ো টাট্টু ঘোড়ায় চড়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াল হরিকৃষ্ণ রায়। ছড়ালে মিষ্টি কথা, ছড়ালে টাকা। চাষি সাঁওতালের লাঙল খসে পড়ল, খেড়ে সাঁওতালের ধনুক আর রইল না, মরচে ধরল কাঠুরেদের কুড়লে। তার জায়গায় চকচকে হয়ে উঠল শাবল, ঝকঝকে হল কোদাল।

যুদ্ধের অবস্থা আশাপ্রদ নয়। সীমান্ত থেকে দুঃসংবাদ আসছে। পশ্চাদপসারণ যদি করতে হয় তাহলে আগে থেকে তার ব্যবস্থা করা দরকার। সুতরাং এই অঞ্চলটাকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য ডিফেন্স লাইন গড়ে তোলা হতে লাগল।

রাঙা কাঁকরের টানা পথ ঘুমিয়েছিল শাল-পলাশের ছায়াকুঞ্জের ভেতরে। তাকে ক্ষতবিক্ষত বিধ্বস্ত করে এল জিপ, এল লরি। কাঠ এল, তাঁবু এল, বিচিত্র যন্ত্রপাতি এল আর তার সঙ্গে সঙ্গে এল বিচিত্ৰতর মানুষ। রাঢ়ের অনুর্বর মাঠের ভেতর জাঁকিয়ে বসল কলোনি, একটা ছোটো এরোড্রোম। দেশটা যেন হাজার বছরের একটানা ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠল যন্ত্রযুদ্ধের বাস্তবতম নির্মম পরিবেশের ভেতর।

সহজ হয়ে গেছে শুকলাল আর সোনার। অভ্যস্ত হয়ে গেছে বুনো সাঁওতাল, গৃহস্থ সাঁওতালদের। আজ আর ওদের ভেতরে জাতি-গোত্রের ভেদ নেই। একটি মন্ত্রবলে ওরা সবাই এক হয়ে গেছে—ওরা কুলি। নিজেদেরই ওরা এখন আর চিনতে পারে না। টাকা পায়, খেতে পায়—পায় বিস্কুট, টিনের দুধ আর চকোলেট। মেজাজ প্রসন্ন থাকলে মাঝে মাঝে কারও কিটব্যাগ থেকে এক-আধটা লাল রঙের বেঁটে চেহারার বিয়ারের বোতলও ওদের দিকে এগিয়ে আসে। মহুয়া আর ভাত-পচানো হাঁড়িয়ার চাইতে তার স্বাদ ঢের ভালো।

আর ওরা কাজ করে। আসানসোলের দিক থেকে বড়ো বড়ো মোটর গাড়ি যাতে নির্বিঘ্ন পাড়ি জমাতে পারে, তারই জন্যে পথ তৈরি করে ওরা। কঠিন লালমাটিতে শাবল-গাঁইতির ঘা পড়ে ঝনঝনিয়ে। মাটি সহজে আমল দিতে চায় না, তার তলায় তলায় ছোটো-বড়ো পাথর শাবলের ফলা দুমড়ে দেয়, কোদাল ছিটকে বেরিয়ে আসে। তবু মাটি কাটতেই হবে— পথকে বাড়াতে হবে, বড়ো করতে হবে। শুকলালেরা ঘর্মাক্ত দেহে আসুরিক শক্তিতে মাটিকে কেটে নামায় আর সোনারা ঝুড়ি ভরে ভরে সেই মাটি নিয়ে ফেলে পথের পাশে।

মাথার ওপরে দুপুরের সূর্য জ্বলে। নিষ্ঠুর, করুণাহীন। পাহাড়ের পাথর আর পাথুরে মাটিতে তার উত্তাপের কোনো তারতম্য ঘটে না। সাঁওতালের কালো শরীর থেকে রক্ত-জল করা সাদা ঘাম মাটিতে ঝরে পড়ে, তৃষ্ণার্ত পৃথিবী যেন এক চুমুকে তা চোঁ করে শুষে নেয়। ওদের অনাবৃত পেশল সিক্ত পিঠগুলো রোদের আলোয় জ্বলতে থাকে, ঘাড়ে কপালে লবণের গুঁড়ো চিকমিক করে। অস্ত্ৰাহত পাথরের টুকরোগুলো ছিটকে ছিটকে এসে চোখে-মুখে আঘাত দিয়ে যায়—অসহায় পৃথিবীর যেন ক্ষীণ সহিংস প্রতিবাদ। একটু দূরে খোলা তাঁবুর ছায়ায় টেবিল-ফ্যান খুলে বসে নগ্ন-গাত্র সাদা সাহেব কাজের তদারক করে ওদের। নীল চশমাপরা চোখের ভেতর থেকে উগ্র দৃষ্টিক্ষেপণ করে, গাল দেয় আর একটার পর একটা বোতল শূন্য হয়ে টেবিলের নীচে গড়াগড়ি খেতে থাকে।

কাজ করে সোনা, কাজ করে শুকলাল। রোদে চাঁদি পুড়ে যায়। পিপাসায় টাকরার ভেতর যেন পিন ফুটতে থাকে। সামনে একটা মরা দিঘির দুর্গন্ধ কাদাজল, সেই জল খেয়ে ওরা পিপাসা দূর করার চেষ্টা করে।

আর তখনি চোখে পরে দূরে ভৈরব পাহাড়।

মাটির বুক থেকে ঢেউয়ের মতো হঠাৎ সোজা উঠে নীলিম রেখায় দিগন্তের দিকে তরঙ্গিত। হয়ে গেছে। ওখানে রুক্ষ মাটি, কঠিন পাথর। কিন্তু সে-মাটি, সে-পাথর এ জাতের নয়। তাদের ঘিরে ঘিরে উঠেছে প্রকৃতির অকৃপণ শ্যামলতা—শতমূলী অনন্তমূলী থেকে শুরু করে ছোটো আবলুস আর পাহাড়ি বাঁশের ঝাড়। সেখানে পাথরের আড়ালে আড়ালে বেগুনি ফুলে আকীর্ণ লজ্জাবতী সংকুচিত হয়ে আছে। সেখানে বেঁটে পলাশের ছায়ায় ফুটেছে ভুইচাঁপা, বাতাসে ভাসছে বনগোগালাপের গন্ধ। আর আর পাথর চুইয়ে নামছে একটি ছোটো ঝরনা, বনের ভেতর যেন একটি সাঁওতাল মেয়ের হাতে ঠিন ঠিন করে বেলোয়ারি চুড়ির সুর বাজছে। তার জলের রং জ্যোৎস্নার মতো উজ্জ্বল, তার স্বাদ দুধের মতো মিষ্টি আর তা বরফের মতো ঠাণ্ডা। মরা দিঘির কাদাজলের মতো তা বুকটাকে পুড়িয়ে দেয় না, তার দিকে তাকালেই আর ক্লান্তি থাকে না কোথাও।

কিন্তু ভৈরব পাহাড় অনেক দূরে। এখানে মাটি কাটা হচ্ছে, পাথর-জড়ানো রাঙামাটি। পথ তৈরি হলে বড়ো বড়ো গাড়ি আসতে পারবে আসানসোল থেকে। তাই দু-হাত ভরে মিলিটারি ওদের মজুরি দিচ্ছে। এখন আর মহুয়া গাছের নীচে শিলাপটে খোদাই করা বাবাঠাকুর ওদের ইষ্টদেবতা নয়, তার জায়গা দখল করেছে অতিচেতন এবং অতিসজাগ ওই সাদা চামড়ার লোকটা। নীল চশমার ভেতর দিয়ে শানিত চোখে ওদের কাজ দেখছে আর বোতল টানছে!

এই কুলি, ঠারো মত, ঠারো মত! ফুরতিসে কাম চালাও-জলদি!

বহুত ধুপ হুজুর।

ওঃ, ধুপ! ধুপ! মরদ লোগকা ধুপসে কেয়া ডর হ্যায়? ডেভিল টেক ইউ লেজি ব্রুটস…

গাল দেয় সাহেব, হাত ভরে পয়সা দেয়, মদ দেয়। কিন্তু কী দিতে পারে ভৈরব পাহাড়? কিছু খড়ি, কিছু ছায়া আর আর পাতাল-ফুড়ে-ওঠা ভোগবতীর ঠাণ্ডা মিষ্টি জল। ঝরনার পাশে আজ আর কেউ বসে না; শুকলাল নয়, সোনা নয়, অন্য সাঁওতালেরাও নয়। সেখানে এখন নিশ্চিন্তে নীলকণ্ঠ পাখিরা স্নান করে, পাখা ঝাড়ে আর মিষ্টি গদগদ গলায় এ ওর সঙ্গে প্রেমালাপ করে হয়তো।

কিন্তু সাহেবের দেওয়া মদ ভুলিয়ে দেয় ভোগবতীকে। তার স্বাদ মিষ্টি নয়, তেতো বিষের মতো তেতো। রক্ত জুড়িয়ে যায় না, জ্বলে ওঠে। মুহূর্তে ভৈরব পাহাড় সরে যায় দৃষ্টির সামনে থেকে। পাগলের মতো কোদাল তুলে নেয় শুকলাল, ঝুড়ি মাথায় করে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সোনা। দুপুরের রোদ আর মদের নেশা শরীরের ভেতরে একটা আসুরিক মত্ততা সৃষ্টি করে। অদম্য অন্ধবেগে যেন ওরা ভেঙে পড়তে চায়, টুকরো টুকরো হয়ে বিদীর্ণ হয়ে যেতে চায়। প্রবল বেগে অনিচ্ছুক মাটির বুকের ভেতরে কোদালের আঘাত নেমে আসে। পাথরে গায়ে ঘা লাগে, যেন শোনা যায় মাটির তলা থেকে মা বসুমতীর চাপা যন্ত্রণার গোঙানি।

তারপরে দিনান্তে শুকলাল আর সোনা ফিরে রওনা হয় ঘরের দিকে।

মদের নেশা তখন কেটে গেছে, শরীরে ঘনিয়েছে দ্বিগুণ শ্রান্তি আর অবসাদ। পা জড়িয়ে জড়িয়ে দুজনে মূৰ্ছিতের মতো এগিয়ে চলে। আকাশের প্রান্তরেখায় প্রথম প্রেমের মতো অপূর্ব কোমল মাদকতা নিয়ে সন্ধ্যাতারা দেখা দিয়েছে। দিগন্তে কালো আর করুণ হয়ে আছে ভৈরব পাহাড়, যেন একটা অতিকায় ভালুক শিকারির গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ে আছে।

দুজনে তাকায় সেদিকে। দুজনেরই একসঙ্গে একই কথা মনে হয়।

শুকলাল বলে, সোনা চল, কাল থেকে আবার আমরা কাঠ কাটব।

সোনা মাথা নাড়ে, জবাব দেয় না। অকারণে তার ইচ্ছে করতে থাকে মজুরির টাকাগুলো পথের ওপর ছুড়ে ছড়িয়ে ফেলে দেয়।

শুকলাল বলে, মাটি কাটতে ভালো লাগে না। কাঠুরে ছিলাম বেশ ছিলাম রে।

সোনা তেমনি নিরুত্তরে মাথা নাড়ে। অন্ধকার পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে মনে হয় যেন ওটা অভিমানে ম্লান হয়ে আছে। লজ্জা হয় সোনার, অপরাধবোধ জাগে মনের মধ্যে। একটু পরে জবাব দেয়, ঠিক।

কিন্তু রাত্রি কাটে, দিন আসে, সন্ধ্যার সংকল্প মনে থাকে না কারও—শুকলালেরও নয়, সোনারও নয়। আবার শাবল-গাঁইতির ঝকঝকে ফলা মাটির বুক কুরে কুরে বার করতে থাকে। মদের নেশা আর দুপুরের রৌদ্র বিষ হয়ে আবর্তন করে রক্তের ভেতরে। শুকলালের কোদাল পড়তে থাকে ঝনঝন ঝনাৎ–

ওরা ভৈরব পাহাড়কে ভুলেছে, ভৈরব পাহাড় ওদের ভোলেনি।

তাই হয়তো মহুয়া গাছের নীচে একদিন জেগে উঠলেন শিলাপটে আঁকা বাবাঠাকুর। তাঁর মাথার ওপরে গর্জন করে উঠল সিংহ, তাঁর হাতে ঝিকিয়ে উঠল তরোয়াল। নিজের শক্তির পরিচয় দিলেন।

রাস্তা অনেকখানি তৈরি হয়ে গেছে, ভারী ভারী গাড়ির যাতায়াতের সংখ্যাও বেড়েছে অনেক। সেই গাড়িগুলোর একটা সেদিন বেসামাল হয়ে বসল। ড্রাইভারের মদের মাত্রা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল বোধ হয়। হঠাৎ কোথা থেকে কী হল—হাত থেকে পিছলে গেল স্টিয়ারিং। পথের পাশে বড়ো একখানা বেলেপাথরের গায়ে আচমকা ধাক্কা খেল গাড়িটা, তারপর সোজা একটা ডিগবাজি খেয়ে পথের উলটো দিকে গিয়ে চিত হয়ে পড়ল। কুলি মেয়েরা ঝুড়ি ভরে মাটি ফেলছিল সেখানে।

এক মিনিটের মধ্যে যা হওয়ার তা হয়ে গেল।

উলটানো গাড়িটার সামনের চাকা দুটো আকাশের দিকে উদ্যত হয়ে বিষ্ণুচক্রের মতো ঘুরলে খানিকক্ষণ। একটা প্রলয়ংকর ঝড়ের মতো ঝুরোমাটি চারদিকে ছিটকে যেতে লাগল। তাঁবু থেকে সাহেবরা ছুটে এল, চেঁচামেচি জুড়ে দিলে কুলিরা।

কিন্তু শুকলালের মুখে কথা নেই—যেন পাথর।

গাড়ির ভেতর থেকে বেরুল সাহেবের দেহ। মাথাটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, ঘিলু আর রক্ত পড়ছে গড়িয়ে। হাত-পাগুলো বেঁকে দুমড়ে কচ্ছপাকার ধারণ করেছে সাহেব। আর গাড়ির তলা থেকে বেরুল সোনা। সোনা? না, ঠিক সোনা নয়। নাক-মুখ-শরীর সমস্ত চেপটে একটা অমানুষিক বীভৎসতা। রাঢ়ের তৃষ্ণার্ত রাঙামাটিও অত রক্ত শুষে খেয়ে ফেলতে পারেনি, থকথকে খানিকটা কাদার সৃষ্টি হয়েছে। কালো সাঁওতালের রক্ত যে অত লাল কে জানত? আশ্চর্য, ভারী আশ্চর্য! সাহেবের রক্তের রঙের সঙ্গে তার কোনো তফাত নেই!

যুদ্ধের ক্যাজুয়ালটি। অমন কত হয়, অমন কত হয়েছে; কে তার খবর রাখে, কে তা নিয়ে নিজেকে বিব্রতবোধ করে? ডিফেন্স লাইন তৈরি করতেই হবে—বৃহত্তর প্রয়োজনের জন্যে, অসুরদের নিপাত করে ধর্মরাজ্য সংস্থাপনের জন্যে। একটা সাঁওতাল মেয়ের মৃত্যু, তার জন্যে মাটিকাটা বন্ধ থাকবে না—মাটি ফেলাও না।

ফিরে এল শুকলাল। এক ফোঁটা চোখের জল ফেললে না, বুক চাপড়ে হাহাকার করে উঠল না এক বারও। ভৈরব পাহাড়ের দেবতা শোধ নিয়েছেন, পরিচয় দিয়েছেন তাঁর ক্ষমতার, তাঁর দোর্দন্ড দুরন্ত প্রতাপের।

টাট্টুঘোড়ায় চড়ে আসছিলেন হরিকৃষ্ণ রায়। দূরের গ্রামে আরও কুলি সংগ্রহের চেষ্টায় গিয়েছিলেন তিনি। এ এক মন্দ ব্যাবসা নয়, বেশ দু-চার পয়সা কমিশন আসছে হাতে। আনন্দে উৎসাহে বুড়ো ঘোড়াটাকে তাড়না করতেও ভুলে যাচ্ছিলেন তিনি, ঘোড়াটা ইচ্ছেমতো থেমে থেমে চলছিল।

শুকলালকে দেখে কষ্ট হল হরিকৃষ্ণ রায়ের। আ…হা বেচারা! বউটাকে সত্যিই বড়ো ভালোবাসত। ঘোড়া থেকে নামলেন তিনি। পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, কষ্ট করে আর কী করবি শুকলাল? কপালে যা ছিল তাই হয়েছে।

কথা বললে না শুকলাল, থেমেও দাঁড়াল না। যেন হরিকৃষ্ণ রায়কে সে দেখতেই পায়নি। অলস শ্রান্ত গতিতে যেমন যাচ্ছিল, তেমনই চলে গেল। শুধু তার অর্থহীন শূন্য দৃষ্টিটা দূরে আকাশের কোলে গিয়ে পড়তে লাগল, যেখানে লতাকুঞ্জে আচ্ছন্ন হয়ে ভৈরব পাহাড় স্তব্ধ একটা ধ্যানস্থ মূর্তি।

বহুদিন পরে মরচে-পড়া কুলটায় শান দিয়েছে শুকলাল, তারপর পাহাড়ে উঠে পাগলের মতো গাছ কাটতে শুরু করে দিয়েছে।

পাহাড় তার ওপরে প্রতিশোধ নিয়েছে, সেও পাহাড়কে ক্ষমা করবে না। দু-হাতে সে ডাইনে–বাঁয়ে যা পাচ্ছে কেটে চলেছে। পাহাড়টাকে আজ সে ন্যাড়ামুড়ো আর নির্মূল করে দেবে। এক বার যাচাই করে দেখবে তার শক্তি বেশি না দেবতার প্রতাপটাই বড়ো।

মাথার ওপরে তেমনি আগুন-ঝরানো সূর্য। পাহাড় তেমনি উত্তাপের বাষ্পনিশ্বাস ছাড়ছে। তৃষ্ণায় বুকের ভেতরটা তেমনি খাঁ-খাঁ করছে। চোখে ধোঁয়া দেখতে লাগল শুকলাল, কানের মধ্যে ঝাঁঝাঁ করতে লাগল।

তখনই মনে পড়ল ভোগবতীকে। রুক্ষ পাহাড়ের বুক থেকে উচ্ছলিত স্নেহধারা। পলাশ আর পিয়াশাল গাছের নীচে ঝিরঝির করে বয়ে চলেছে। ছোটো গর্তের ভেতর যেখানে একটুখানি জল জমেছে, সেখানে পাখা ঝেড়ে ঝেড়ে স্নান করছে নীলকণ্ঠ পাখি।

তার ঠাণ্ডা মিষ্টি জল। বহুদিনের অনাস্বাদিত সুধার পাত্র। টলতে টলতে ঝরনার দিকে ছুটে এল শুকলাল, কিন্তু কোথায় ভোগবতী?

তার চিহ্নমাত্র নেই। নেই বেলোয়ারি চুড়ির হালকা ঝংকার সেই নীলকণ্ঠ পাখি। যেখানে ঝরনা ছিল সেখানে কালো অজগরের মতো মোটা একটা লোহার নল। পাহাড়ের মাথার ওপর দিয়ে সে-নলটা ঘুরে চলে গেছে, কোথায় গেছে বুঝতে কষ্ট হল না শুকলালের।

এক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়াল শুকলাল। ওই কালো লোহার সাপটা মাটির তলায় তার হিংস্র মাথাটা ডুবিয়ে দিয়ে তাদের ভোগবতীকে চুষে খেয়ে নিয়েছে। ভোগবতীর জল—ঠাণ্ডা মিষ্টি দুধের মতো জল তার সরীসৃপ দেহের বিষসঞ্চয়কে পুষ্ট করছে আজ। তার সেই বিষে সোনা মরে গেছে, শুকলাল মরবে, আরও অনেকে মরবে। কেউ বাঁচবে না, কেউ নয়।

কেউ বাঁচবে না। কেউ বাঁচবে না। শুকলালের মাথার ভেতর সব কিছু যেন আতসবাজির ফুলঝুরি হয়ে ঝরে পড়তে লাগল। কুড়লটা তুলে নিলে হাতে, প্রচন্ড শক্তিতে ঘা বসাল অজগরটার গায়ে।

ঝনঝন করে একটা বিরাট শব্দে পাহাড় কেঁপে উঠল। আর এক ঘা, আর এক ঘা। কুড়ালের ফলা কুঁকড়ে এল কিন্তু লোহার সাপটা টোল খেল না।

হু ইজ দেয়ার?

পাহাড়ের মাথা থেকে প্রশ্ন। রাইফেল হাতে সেন্ট্রি দেখা গিয়েছে।

হু ইজ দেয়ার?

শুনতে পেল না শুকলাল, জবাব দিলে না। আরও এক ঘা, এইবার একটু দাগ পড়েছে মনে হচ্ছে। আর এক ঘা।

স্যাবোটেজ।

পাহাড়ের মাথা থেকে অব্যর্থ লক্ষ্যে ছুটে এল রাইফেলের গুলি।

মুখ থুবড়ে পড়ে গেল শুকলাল। চেতনার শেষ বিন্দুটুকু মুছে যাওয়ার আগে টের পেল তার পিপাসাকাতর মুখে কে যেন জল দিচ্ছে। ভোগবতীর ধারা কি মুক্ত হয়ে গেল? কিন্তু সে-জল তো এমন গরম নয়, এমন নোনতা নয়। নিজের রক্ত লেহন করতে করতে লোহার পাইপটার ওপরে মাথা রেখে স্থির হয়ে গেল শুকলাল। মিলিটারি কলোনিতে ট্যাপের মুখে ভোগবতীর স্নিগ্ধ জল ঝরে পড়ছে শত ধারায়। সে-জল তেমনই নির্মল, তেমনই স্বচ্ছ; শুকলালের রক্তের এতটুকুও লালের আভাস তাতে লাগেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *