2 of 3

খাওয়াদাওয়া

খাওয়াদাওয়া

খাবার দাবারের বেলায়, লক্ষ করেছি, বাংলাদেশের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গের লোকের গ্রাম্যতা বেশি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে একবার দুবন্ধু এলো আমার বাড়িতে, সাতদিন থাকবে। আমি ভাত ডাল শাক সবজি মাছ মাংস রাঁধলাম দুপুরে। খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বেড়াতে বেরোলো। রাতে ফিরে এলে ডিনার খেতে বসেছি একসঙ্গে। ভেটকি মাছ দেখে একজন বললো, কী ব্যাপার, দুপুরে ভেটকি বেঁধেছো, রাতেও ভেটকি বেঁধেছো?

–রাতে রাঁধিনি।

–রাতে রাঁধোনি? কিন্তু এইতো ভেটকি। এটা ভেটকি না?

–হ্যাঁ এটা ভেটকি। কিন্তু এটা দুপুরে যে রেঁধেছিলাম, সেটাই।

–বলছো কী? দুপুরের ভেটকি?

–হ্যাঁ। ভেটকি তো শেষ হয়নি। অনেকটাই ছিল। নতুন করে রাঁধবো কেন? এগুলোই খাবো এখন।

–কিন্তু এগুলো তো দুপুরে খেয়েছি।

–হ্যাঁ, যা বাকি ছিল, সেগুলো ফ্রিজে রেখেছিলাম, মাইক্রোওয়েভে এখন গরম করে দিয়েছি।

-মানে?

–মানে হলো আমি যখন রাঁধি তখন বেশি করেই রাঁধি, যেন পরে আবার খাওয়া যায়।

–কিন্তু আমরা তো বাসি খাবার খাই না।

–বাসি হতে যাবে কেন? ফ্রিজে ছিল।

 –ফ্রিজের খাবার তো আমরা খাই না।

–তোমাদের বাড়িতে তো ফ্রিজ আছে। ফ্রিজে খাবার রাখো না? ফ্রিজটা তবে কী কাজে লাগাও?

— জল টল রাখি।

–ব্যস?

–ব্যস।

–আর আমি তো একদিন রান্না করে সব ফ্রিজে তুলে রাখি। একটু একটু করে সাতদিন খাই।

–হোয়াট?

–বলছি, একদিন রান্না করে সাতদিন খাই। কারণ রান্না ছাড়াও তো আরও কাজ আছে। সে সব করতে হবে না? বেলায় বেলায় রাঁধতে হবে কে বললো?

–তাই তো জানি।

–আমি আবার তা জানি না। রেফ্রিজারেটারে আমি খুব ভালো ভাবে খাবার রাখি। নষ্ট হয়না। এখানে গরমকালে তিনদিন খেতে পারি। আর শীতকালে পাঁচদিন। বিদেশে ঠাণ্ডার দেশে তো একদিন রান্না করে আরও বেশিদিন খাই।

চোখ কপালে তোলে বন্ধুরা।

ওদের শেষ অবধি রাজি করাতে পেরেছি, একবার রাঁধলে একবেলা নয়, দুবেলা খাবে। কিন্তু আজ বেঁধে কাল খাওয়াটা বা পরশু খাওয়াটা মানেনি। আমাকে প্রতিদিন রাঁধতে হয়েছে। কোনওদিন যদি রাঁধতে না পারি, ওদের রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেছি। আগের দিনের খাবার দিইনি। আগের দিনের খাবারগুলো শুধু আমি খেয়েছি।

রেফ্রিজারেটরের ব্যবহার জানে না বেশির ভাগ লোক। ফ্রিজারেও কাঁচা মাছ মাংস রাখে না খুব। কিন্তু ফ্যাশনের আরামবাগ ফ্রোজেন চিকেন বাজারে এলে সেটা কেনার ধুম পড়ে যায়। তখন ফ্রেশ চিকেন ভালো লাগে না। জ্যান্ত মুরগি বাজারে রেখে দোকানের ফ্রিজার থেকে চিকেন কিনে এনে রান্না করে খায় আর আহা কী স্বাদ আহা কী স্বাদ বলে। বড়লোকরা পছন্দ করে বলে মধ্যবিত্তরাও ওই চিকেনে স্বাদটা দ্রুত পেয়ে যায়।

একবার কলকাতার যদুবাজার থেকে আমি পাঙ্গাস মাছ এনেছিলাম। বন্ধুদের নেমন্তন্ন করেছি। বন্ধুরা অন্য যা যা খাবার ছিল, খেলো, পাঙ্গাস মাছের নাম শুনে ছিটকে সরে গেলো। ও মাছ খাবে না, কারণ ও মাছ আগে খায়নি অথবা ও মাছের নাম শোনেনি। অচেনা কোনও খাদ্য চেখে দেখতে কেউ রাজি নয়। সবই হতে হবে চেনা। জন্ম থেকে খেয়ে এসেছে, এমন চেনা।

একবার চিতল মাছের মুইঠ্যা বানিয়েছিলাম। মুইঠ্যা ওই আমি প্রথম বানিয়েছি। এবং আশ্চর্য ভালো হয়েছিল সেই মুইঠ্যা। মুইঠ্যা খেতে বন্ধুরা এলো। সবাই কাড়াকাড়ি করে খেয়ে হাত চাটতে লাগলো। সক্কলে বললো, এমন সুস্বাদু মুইঠ্যা তারা তাদের জীবনে খায়নি কোনওদিন। এটা তাদের লাইফের বেস্ট মুইঠ্যা। মুইঠ্যার প্রশংসা চললো আরও কয়েক ঘণ্টা। তারপর, সবাই যখন যাবে, তখনই কথা প্রসঙ্গে বললাম, যদুবাজার থেকে কিনেছিলাম চিতল মাছটা। বিশাল ছিল মাছটা। পেটিগুলো বেঁধেছি। আর মুইঠ্যার জন্য কাঁটামুক্ত মাছ সরিয়ে রেখেছিলাম। কতদিন ভেবেছি মুইঠ্যা বানাবো। আর হয়ে ওঠেনি। প্রতি মাসেই ভাবি এ মাসেই নামাবো মাছটা ফ্রিজার থেকে। ফ্রিজারের এত তলায় পড়ে গিয়েছিল যে ওই প্যাকেটটা খুব চোখে পড়তো না। ছমাস পরে বের করেছি।

বন্ধুদের চোখ কপালে। অস্ফুট স্বরে বললো, কী বললে?

আমি বললাম, ছমাস।যে মাছটা দিয়ে মুইঠ্যা বানিয়েছি সে মাছটা ছমাস ফ্রিজারে ছিল।

–ছমাস এই মুইঠ্যার মাছ ফ্রিজারে ছিল? ভাঙা গলায় একজন জিজ্ঞেস করলো।

–হ্যাঁ। বললাম।

একেকজন বমি করে দেয় অবস্থা। দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে ওয়াক ওয়াক করতে লাগলো। কেউ বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। আর এসব শুনতে পারছে না। কারও মাথা ধরলো। মুখ চোখ বিবর্ণ।

(ওহ আর একটা কথা তো বলাই হয়নি। পুরুষগুলো তো চামচে করে খাবার নিতে পারে না নিজের থালায়। পড়ে যায়। কারণ নিয়ে তারা অভ্যস্ত হয়। যখন তারা খেতে বসে, তাদের মা বা তাদের বউ, পাশে দাঁড়িয়ে বেড়ে দেয়। কলকাতার শিক্ষিত ঘরেও এই দৃশ্য দেখতে হয়েছে আমাকে। আমার বাড়িতে এলে, প্রথমেই সোজা বলে দিই, এখানে কেউ খাবার বেড়ে দেবে না আপনাদের, নিজেদের তুলে খেতে হবে। আর আমার বাড়িতে পুরুষের আগে খাওয়া আর মেয়েদের পরে খাওয়ার কুৎসিত নিয়মটা নেই।)

নর্থ বিচ এলাকার আনাচ-কানাচে কবিতা পড়ার অন্য এক আনন্দ আছে। যেন জ্যাক কেরুয়াক, অ্যালেন গিন্সবার্গ, লোরেন্স ফারলিংগেটির আমরাই উত্তরসূরি। জ্যাক কেরুয়াক অ্যালিতে ছিল একদিন আমার কবিতা পড়া। কবিতা উৎসবের আয়োজক জ্যাক হিরশম্যান সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আমি কবিতা পড়বো আমার মাতৃভাষায়, আমেরিকার কোনও কবি আমার কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পড়ে শোনাবেন। আমাদের বড় অনুষ্ঠানটা হয় সানফ্রান্সিসকোর প্যালেস অব ফাইন আর্টসে। ওই প্যালেসে অডিটোরিয়ামের বাইরে কবিদের কবিতার বইও বিক্রি হয়েছে। আমার বইও ছিল, তবে কবিতার বই নয়, গদ্যের বই। ফাঁক পেয়ে একদিন বিটনিকদের মিউজিয়াম ঘুরে এসেছি। যেন স্বপ্নপুরী। অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে প্যারিসে। জানি না কেন, গিন্সবার্গের চেয়ে বেশি জ্যাক কেরুয়াক আমাকে টানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *