নাস্তিক নাগরিকদের নিরাপত্তা দিন
আমার বিরুদ্ধে যখন বাংলাদেশ উত্তাল, যখন মৌলবাদী সন্ত্রাসী আর দেশের সরকার মিলে মিশে আমার বিরুদ্ধে হেন বদমাইশি নেই করছে না, তখন কিন্তু এখনকার অনেক নাস্তিক ব্লগারের জন্মও হয়নি। সেই আশির দশক থেকে বাংলাদেশের আগপাশতলা ইসলামের পানি দিয়ে ধোয়া হচ্ছে, ইসলামের সোনা দিয়ে মোড়ানো হচ্ছে। তার ফুল এখন হাতে নাতে পাচ্ছে সবাই। আমাকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে বলে আজও প্রাণে বেঁচে আছি। এখন দেশের তরুণ নাস্তিক ব্লগারদের এক এক করে কুপিয়ে মারা হচ্ছে। প্রাণ বাঁচানোর জন্য এরা এখন দেশের বাইরে বেরোতে চাইছে। কিছুদিন আগে যুগান্তর পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো পুলিশের এক বিশেষ রিপোর্ট। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নাকি ভারতে তিনটে স্লিপার সেল পাঠিয়েছে আমাকে মেরে ফেলার জন্য। আমি ইউরোপের নাগরিক, আমেরিকার গ্রীনকার্ড ধারী। আমি বিপদের আঁচ পেলে উড়াল দিতে পারবো। কিন্তু বাংলাদেশের ব্লগাররা উড়াল দেবে কী করে? তাদের পাসপোর্ট চাই, বিদেশ থেকে আমন্ত্রণ চাই, ভিসা পেতে গেলে ব্যাংক ব্যালেন্স সহ হাবিজাবি কাগজপত্র চাই। সবাই ভাবছে, এর পরের ভিকটিম বোধহয় সে নিজেই। আমি লিখেছি অনেক, হাসিনা যেন নাস্তিক ব্লগারদের,যাদের জীবনের হুমকি আছে, নিরাপত্তা দেন। আমার কথা হাসিনা শুনবেন কেন? হু এম আই? তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী। বিশাল জিনিস। হাতের কাছে পেলে তিনিই আমাকে কোপাবেন। আসল কথা হলো, হাসিনা পরের নির্বাচনে জেতার জন্য মৌলবাদী পটাচ্ছেন, তিনি ব্লগারদের নিরাপত্তা তো দেবেনই না, খুনীদের বিরুদ্ধেও কোনও ব্যবস্থা নেবেন না। এই দুঃসহ অবস্থায় দেশ ত্যাগ করা ছাড়া নাস্তিক ব্লগারদের আর কোনও উপায় নেই। আপাতত বাঁচুক। দেশের অবস্থা ভালো হলে না হয় ফিরবে দেশে। কিন্তু শাহরিয়ার কবির চান না ব্লগাররা দেশ ছাড়ক। তিনি বলছেন, এতে লাভ হবে না, জামাতে ইসলামিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। জামাতে ইসলামি নিষিদ্ধ হলে সন্ত্রাসীরা নাস্তিকদের খুন করবে না? কোনও কি গ্যারেন্টি আছে? এতকাল যাবৎ জামাতে ইসলামির বাইরেও লক্ষ লক্ষ মৌলবাদী-সন্ত্রাসীর জন্ম হয়েছে, তারা জামাতের চেয়েও লক্ষ গুণে ভয়ংকর। তারা আইসিস আলকায়দার নির্দেশে চলে। শাহরিয়ার কবির বললেন তাঁর হাতে পিস্তল আছে, এবং তিনি একা বাইরে বেরোন না। শাহরিয়ার কবির না হয় পিস্তল এবং পিস্তলের লাইসেন্স যোগাড় করতে পারেন। কিন্তু অল্প বয়সী নাস্তিক ব্লগাররা পিস্তল কোত্থেকে যোগাড় করবে, লাইসেন্সই বা তাদের কে দেবে? যে সরকার তাদের কোনও দেহরক্ষী দেয় না, সে সরকার দেবে লাইসেন্স?
অনন্ত বিজয় দাসকে কুপিয়ে মারা হয়েছে, একমাস হয়ে গেলো। এবার আরেকজন নাস্তিকের খুন হওয়ার সময় হয়েছে। ভয়ে একএকজন সেঁধিয়ে গেছে গর্তে। গর্ত থেকে তো বের হতে হবে। লিখতে হবে যেমন লিখছিলো। নিজের লেখা বন্ধ করে দেওয়া বা সেন্সর করার চেয়ে খারাপ কোনও সেন্সরশিপ নেই। দেশের ভেতর লেখালেখি মাচায় তুলে ভয়ে গুটিয়ে থাকবে। আর বিদেশে চলে গেলে ওখানে ব্যস্ত হয়ে পড়বে বাঁচার লড়াই চালাতে, হয়তো লেখাই তখন বাধ্য হয়ে বন্ধ করতে হবে। দেশের মৌলবাদী পরিবেশ থেকে খুব দূরে চলে গেলে অনেকের লেখা বন্ধ হয়ে যায়। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের তাগিদটা চলে যায়। দেশকে বাঁচানোর চেয়ে নিজের বাঁচার প্রয়োজনটা বড় হয়ে দাঁড়ায়। তবে কি আমাদের মেনে নিতেই হবে যে দেশের প্রতিভাবান মানববাদী অস্তিত্ববাদী লেখকরা আর লিখবে না। এভাবেই সরকারের উদাসিনতা এই প্রতিভাবান প্রজন্মকে ধ্বংস করে দেবে?
অনন্ত বিজয় দাসের বন্ধু মনির হোসেন অত্যন্ত প্রতিভাবান ব্লগার। যুক্তি পত্রিকাটি অনন্ত আর মনির বের করতো। মনির হোসেনের নাম ওই ৮৪ জনের লিস্টে আছে, যাদের মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছে ইসলামি সন্ত্রাসীরা। অনন্তকে খুন করার পর থেকেই মনির হোসেনকে খুনীরা মৃত্যুর জন্য তৈরি হতে বলছে। কুপিয়ে মারার জন্য খুনীরা মনিরের পিছু নিয়েছে। মনির এক শহর থেকে আরেক শহরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। দেশ ছাড়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু গরিব দেশের গরিব যুবকদের ভিসা দিতে আগ্রহী নয় বিদেশের রাষ্ট্রদূতগণ। তাঁরা ব্লগারের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করবেন, কিন্তু ওদের বাঁচাতে এগিয়ে আসবেন না। ইউরোপ আমেরিকা ভরে গেছে। মৌলবাদী সন্ত্রাসীতে। বড় বড় কূটনীতিকও জানেন না কাকে ভিসা দিতে হয়, এবং কাকে দিতে হয় না। বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী প্রতিভাবানকে ভিসা দিলে তাঁদের দেশের লাভ, আর ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীদের ভিসা দিলে তাঁদের দেশের ক্ষতি। হয়তো জানেন। শুধু চিনতে পারেন না কারা মন্দ লোক, কারা ভালো লোক। অনন্ত বিজয় দাসের মতো হীরের টুকরো ছেলেকে সুইডিশ দূতাবাস ভিসা দেয়নি। অথচ সুইডেন ভরে রয়েছে অনন্তকে যারা খুন করেছে, সেই ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীতে।
যাদের লেখা কোনও পত্রিকায় প্রকাশ হবে না, যাদের মত কোনও টিভিতে প্রচারিত হবে না,কারণ তাদের মত সমাজের অধিকাংশ মানুষের মতের চেয়ে ভিন্ন, তাদের জায়গা ছিল ফেসবুকে। ফেসবুকে তারা তাদের ভিন্নমত প্রকাশ করতে পারতো। সেই ফেসবুকও এখন মৌলবাদীদের খপ্পরে। ফেসবুক একটা নিয়ম চালু করেছিল, কেউ আপত্তিকর কথা লিখলে, নোংরা ফটো পোস্ট করলে ফেসবুকাররা রিপোর্ট করতে পারে। এটিই কাজে লাগাচ্ছে ইসলামিং রিপোর্টিং গোষ্ঠী। এরা লক্ষ লক্ষ। দলবদ্ধ। এদের সর্দার বলে দেয় আজ একে মারো, কাল ওকে ধরো। চলে তাদের গণরিপোর্টিং। এদের রিপোর্টের কারণে প্রগতিশীল, নারীবাদী, নাস্তিক, মৌলবাদ বিরোধীরা তাদের আইডি হারাচ্ছে। মৌলবাদবিরোধী নাস্তিকগোষ্ঠী সংগঠিত নয়, তারা সংখ্যায় লক্ষ লক্ষ নয়। তারা রিপোর্ট করে মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের ফেসবুক থেকে হঠাতে পারবে না। রিপোটিংএর ভয়ে, খুনীদের ভয়ে নাস্তিক ব্লগাররা বেশিরভাগই ব্লগ লেখা বন্ধ করে দিয়েছে। ইত্তিলা ইতু, চার্বাক শুভ্রর মতো প্রগতিশীল ফেসবুকারদের আইডি এখন কাজ করছে না। আবদুল মামুন অসাধারণ ফেসবুকার। তার লেখা মানুষকে সচেতন করে। মানুষকে ভাবতে শেখায়। আবদুল মামুন প্রগতিশীল পাঠকদের মধ্যে জনপ্রিয়। একটি নাম। আবদুল মামুনের আইডি ৩০ দিনের জন্য নিষিদ্ধ করেছে ফেসবুক। সেও মৌলবাদীদের রিপোর্টিংএর শিকার। আইসিস, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আর আল কায়দার খুনী সন্ত্রাসীদের আইডি কিন্তু যেমন ছিল তেমন আছে। ফেসবুকের কর্তারা এত কিছু বোঝে, শুধু এটা বোঝে না কাদের রাখতে হয়, কাদের বিয়ে করতে হয়? ফেসবুক এখন সন্ত্রাসীদের প্রিয় জায়গা। এটিকে তারা সন্ত্রাস ছড়ানোর কাজে ব্যবহার করে। কী ভালোই না হতো ফেসবুক কর্মকর্তা যদি ফেসবুককে ধর্মান্ধতা, মৌলবাদিতা, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, খুন বন্ধ করার কাজেও ব্যবহৃত হতে দিতো। কিন্তু কী করে হবে, যদি রিপোর্টিং এর ব্যবস্থা থাকে এবং ফেসবুক ভর্তি থাকে জঙ্গী সন্ত্রাসীতে। আমি বুঝি না কেন ফেসবুকের কেউ যাচাই করে দেখে না কারা রিপোর্ট করে, এবং যাদের আইডি রিপোর্ট করে, তারাই বা কারা, তারা কী লেখে! যাচাই না করলে, এভাবেই চলতে দিলে যেভাবে চলছে, আজ হোক কাল হোক সব মুক্তচিন্তককে ফেসবুক থেকে বিদেয় নিতে হবে। নাস্তিক ব্লগাররা বাংলাদেশের নাগরিক। এই নাগরিকরা প্রতিদিন মৃত্যুর হুমকি নিয়ে জীবন যাপন করছে। তারা জানেনা কে কখন পেছন থেকে তাদের মাথায় কোপ বসাবে। বাংলাদেশ যদি কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে থাকে, তবে নাস্তিক ব্লগারদের নিরাপত্তা দেবে। আর যদি এটি সম্পূর্ণ ইসলামী রাষ্ট্র, তবে নিরাপত্তা দেবে না। বাংলাদেশ ঘোষণা করে দিক যে, এটি এখন সম্পূর্ণই ইসলামী রাষ্ট্র। ঘোষণা করুক, কোনও সভ্য আইন বলে কিছু নেই এ দেশে, এ দেশ শরিয়ার দেশ। মদিনা সনদ অনুযায়ী দেশ চলছে, এবং চলবে, এটা ফাইনাল। বলে দিক।