2 of 3

ওরা আটজন

ওরা আটজন

পশ্চিমবঙ্গের এবং বাংলাদেশের যে কজন মানুষ আমাকে তাঁদের অফুরন্ত শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, স্নেহ এবং সমর্থন দিয়েছেন, আমার সুসময়ে শুধু নয়, আমার দুঃসময়েও পাশে ছিলেন, আছেন, তাঁরা অন্নদাশংকর রায়, শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্ত, নিখিল সরকার, শামসুর রাহমান, শামীম সিকদার, চূর্ণী গাঙ্গুলী। ওঁরাই আমার আত্মীয়, আমার স্বজন, আমার বন্ধু, আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। আজ ওঁদের অনেকেই বেঁচে নেই। ওঁদের মতো মানুষ আরও জন্মাক। পৃথিবীটা সুন্দর হোক আরও।

অন্নদাশংকর রায়

আমাকে খুব ভালোবাসতেন অন্নদাশংকর রায়। আমি যখন বাংলাদেশে আক্রমণের শিকার হচ্ছি, তখন থেকেই তিনি আমাকে নিয়ে অনেক বলেছেন, অনেক লিখেছেন। একবার তো ঘোষণা করলেন, আমি যেন সঙ্গে পিস্তল রাখি নিজের নিরাপত্তার জন্য।

ইউরোপের নির্বাসন জীবন থেকে যখনই কলকাতায় যেতাম, চাইতেন সবার আগে তাঁর বাড়িতে যাই। দুপুরের খাবার নিয়ে বসে থাকতেন, একসঙ্গে খাবেন। কত কথা যে বলতেন, কত কথা যে শুনতে চাইতেন। শুনতে চাইতেন বেশি।

একবার তিনি আমার সাক্ষাৎকার নিলেন। সেই সাক্ষাৎকারটা পুরো রেকর্ড করে নিয়ে এক ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছাপিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারটা নিয়ে ভীষণ উত্তেজিত ছিলেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি তখন বাড়ির বাইরে কোথাও যান না। তাঁকে কোলে করে এনে চেয়ারে বসাতে হয়, কোলে করে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিতে হয়। অথচ আশ্চর্য, ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের অডিটোরিয়ামে আমার মেয়েবেলার প্রকাশনা উৎসবে সভাপতিত্ব করতে দিব্যি চলে এলেন। আমাকে ভালোবাসেন বলেই তিনি অনুষ্ঠানে আসতে রাজি হয়েছিলেন।

ওখানেই তিনি তাঁর সেই বিখ্যাত ভাষণটি দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ তসলিমার মা, পশ্চিমবঙ্গ তসলিমার মাসি। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি হয়না, কিন্তু তসলিমার বেলায় মনে হচ্ছে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি..। আমি তাঁর এই স্নেহ ভালোবাসার মর্যাদা ঠিক ঠিক দিতে পারিনি। বিদেশ থেকে কলকাতার কত কারও জন্য কত উপহার নিয়ে আসতাম। প্রতিবার ভুলে যেতাম অন্নদাশংকর রায়ের কথা। আমি কলকাতায় এসেছি শুনেই তিনি খবর পাঠাতেন, একবার যেন দেখা করতে যাই। অপেক্ষা করতেন আমার জন্য। আমি ব্যস্ত হয়ে পড়তাম তরুণ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায়। একবার খুব অল্প সময়ের জন্য তাঁর বাড়ি গেলাম, কথা দিয়ে এলাম দুদিন পর যাবো। দুদিন পর এলো। যথারীতি ভুলে গেলাম যেতে। তার পরদিন গিয়ে দেখি তিনি অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছেন বিছানায়। আমি যে এসেছি দেখতে পেলেন না।

নার্স বললেন আমি আসবো বলে আগের দিন সারাদিন ভালো কাপড় চোপড় পরে ড্রইং রুমের চেয়ারে বসে ছিলেন। নার্স অনেকবার বিছানায় নিয়ে আসতে চেয়েছেন, রাজি হননি। বলেছেন, আজ তসলিমা আসবে। নার্স বলেছিলেন, রাত হয়ে গেছে, আর হয়তো আসবে না। তারপরও তিনি নড়েননি চেয়ার থেকে। বলেছেন, না না ও আসবেই। কথা যখন দিয়েছে আসবেই।

পরদিনের ওই অচেতন অবস্থা থেকে আর ফেরেননি অন্নদাশংকর রায়। খবর পাই, মারা গিয়েছেন। নিজেকে সেই থেকে আর ক্ষমা করতে পারিনি।

.

শিবনারায়ণ রায়

শিবনারায়ণ রায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় বিরানব্বই সালে। সেই বিরানব্বইএর পর থেকে আমার জীবনে কত ফতোয়া, কত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস,কত নির্বাসন, কত নির্যাতন এলো, তিনি কখনও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেননি। লেখক সাহিত্যিক, সহযাত্রী, সহমর্মী, এমনকী আত্মীয় বন্ধুও সুদূর নির্বাসনে পড়ে থাকা একাকী আমাকে নিজেদের নানা ব্যস্ততায় ভুলে থেকেছেন। বছরের পর বছর কারও কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি। কিন্তু শিবনারায়ণ রায় তাঁর অপরিসীম স্নেহ থেকে আমাকে কোনওদিনের জন্য বঞ্চিত করেননি। যেখানেই ছিলাম, দেশে বা বিদেশে, তাঁর চিঠি পেতাম। প্রতিটি চিঠি কী অসম্ভব প্রেরণার চিঠি! সবসময় বলতেন, যেন লিখি, যেন হেরে না যাই, যেন ভেঙে না পড়ি। বলতেন, নির্বাসনে পৃথিবীর অনেক লেখককে কাটাতে হয়েছে, কারাগারে বসে সংগ্রামী লেখকরা উদ্যম হারাননি, লেখার জন্য খাতা কলম থাকতো

, মনে মনে লিখতেন। শিবনারায়ণ রায় মনে করতেন, সমাজে আমার একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা আছে, আমি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছি, যে কাজ করার সাহস এবং সততা সবার থাকে না।

তিরানব্বই সালে আমার ঢাকার বাড়িতে তিনি ছিলেন কদিন। প্যারিসেও আমাকে তিনি দেখতে গিয়েছিলেন দুহাজার সালে। তাঁর দুটি ফুসফুসের একটি নষ্ট ছিল বহুদিন। কিন্তু নিজের শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে অভিযোগ করতে কখনও শুনিনি।

শিবনারায়ণ রায় নাস্তিক ছিলেন জীবনভর। তিনি তাই মরণোত্তর দেহদান করে গেছেন। অনেক কপট নাস্তিকদের দেখেছি গোপনে গোপনে ধর্মের আচার অনুষ্ঠান সারতে। শিবনারায়ণ রায়ের মধ্যে কোনও কপটতা ছিল না।

আমার কলকাতার বাড়িতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করেছেন একটিও অর্থহীন কথা না বলে। তিনি সাহিত্য, সংস্কৃতি,দর্শন, বিজ্ঞান, মানববাদ, মানবতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে পছন্দ করতেন। মানুষ চিন্তা করুক, চাইতেন। নিজে বিশ্বাস করতেন মুক্তচিন্তায়। চিন্তার চর্চা যে বাংলাদেশে হচ্ছে না, তা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করতেন। লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশ বলতে তিনি দুই বাংলাকে বোঝাতেন।

তাঁর প্রজ্ঞা, তাঁর প্রতিভা, তাঁর প্রত্যয়, তাঁর পান্ডিত আমাকে চিরকালই মুগ্ধ করেছে। কলকাতা থেকে আমাকে বিতাড়নের পর শিবনারায়ণ রায়কে দেখেছি বড় বিপন্ন বোধ করতে। আমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি কীভাবে কী করতে পারেন তা নিয়ে খুব ভাবতেন। পত্রিকায় প্রতিবাদ লিখেছেন, সভায় ভাষণ দিয়েছেন। কিন্তু এতে তিনি জানেন কোনও কাজ হয় না। বড় করুণ কণ্ঠে, বড় অসহায়। স্বরে বারবার বলেছেন, ওদের আমি চিঠি লিখতে পারি, কিন্তু আমার কথা তো ওরা শুনবে না!

বাঙালি সমাজে মনীষী আর কজনই রইলো! আমরা দীন ও দরিদ্র হয়ে পড়ছি দিনদিন। মনীষীদের আর্তি কারও কানে পৌঁছোয় না। মনীষীরা বড় নিঃসঙ্গ বেঁচে থাকেন। র‍্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট শিবনারায়ণ রায়ের যুক্তিবাদ এবং মানবতন্ত্রের সঙ্গে আমার মতের একফোঁটা কখনও বিরোধ ছিল না। একটা সময়ে মত বিরোধ দেখা দিল যখন তিনি পতিতাপ্রথার পক্ষে দুবারের আন্দোলনে শরিক হলেন, এবং আমি যেহেতু বরাবরই পুরুষতান্ত্রিকতার সবচেয়ে বীভৎস প্রথাটি নির্মুল হোক চাই, পতিতাপ্রথার পক্ষে তাঁর কোনও যুক্তিই আমি মেনে নিইনি। এই মত-বিরোধ সত্ত্বেও আমাদের সম্পর্ক একটি দিনের জন্যও এতটুকু নষ্ট হয়নি। পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক আগের মতোই অটুট ছিল। আমার আশংকা, শিবনারায়ণ রায় না হয়ে অন্য কেউ হলে সম্পর্কে হয়তো সামান্য হলেও চিড় ধরতো। তিনি ক্ষুদ্রতা সংকীর্ণতা, হিংসে দ্বেষএর সীমানা ছাড়িয়ে অনেক ওপরে ওঠা মানুষ ছিলেন। তিনি যে কোনও মতকে, সে মত তাঁর মত থেকে ভিন্ন হলেও, যদি যথেষ্ট যুক্তি থাকে সে মতের পক্ষে, গুরুত্ব দিতেন।

ক্ষমতার পেছনে, বড় বড় প্রতিষ্ঠানের পেছনে, নামের জন্য, অর্থের জন্য, সম্মানের জন্য কোনওদিন নিজের সত্তা বিকিয়ে দেননি তিনি। যতদিন বেঁচেছিলেন, নিজের নীতি আর আদর্শ নিয়ে মাথা উঁচু করেই ছিলেন।

শিবনারায়ণ রায়ের মতো অকুতোভয় মানুষ আমি কমই দেখেছি। জোর গলায় প্রতিবাদ করতেন, যা হয় হোক। কাউকে ছেড়ে কথা কইতেন না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা রা-শব্দ খুব করে না, যারা গা বাঁচিয়ে চলে, তারা আজ প্রখ্যাত। আর শিবনারায়ণ রায় ছিলেন পেছনে অন্ধকারে। কলকাতার বাড়িটাও তাঁকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। শান্তিনিকেতন থেকে ট্রেনে চড়ে কলকাতায় এসে ছোটখাটো আলোচনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। যেদিন শেষ কথা হলো, মৃত্যুর তিন দিন আগে, বললেন হাওড়া স্টেশনের ভিড়ে তাঁর কিছুটা অসুবিধে হয় হাঁটতে। বললাম, কেউ যেন সঙ্গে থাকে এমন ব্যবস্থা কি করা যায় না?, শিবনারায়ণ রায় কারও সাহায্য নিয়ে বা কারও কাঁধে ভর দিয়ে চলতে রাজি নন। অনেকদিন আগে কেউ একজন তাঁকে একটা লাঠি উপহার দিয়েছিল হাঁটার জন্য, ওটিও কোনওদিন তিনি ব্যবহার করেননি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি নিজের পায়েই হেঁটেছেন।

.

অম্লান দত্ত

আমি তখন ঢাকায় থাকি। আমার কোনও একটি বই পড়ার পর আমার ঢাকার ঠিকানায় একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন অম্লান দত্ত। চিঠিতেই আমাদের অনেকদিন যোগাযোগ ছিল। তারপর একদিন ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে প্রথম তাঁর বক্তৃতা শুনে ভীষণ মুগ্ধ হই। অনুষ্ঠানের কোনও বক্তাই অম্লান দত্তের মতো এত অল্প কথায়, এত স্পষ্ট ভাষায়, আসল কথাটা এবং খাঁটি কথাটা এত চমৎকার বলতে পারেননি। আমি সেদিন ছুটে গিয়েছি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। জীবন ও জগতের অনেক কিছু নিয়ে সেদিন আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। মৃদুভাষী ছিলেন, সবার তর্ক বিতর্ক, মত ভিন্নমত শুনতেন, তারপর শেষ মন্তব্যটি করতেন, যেটির পর কারও কোনও কথা বলার দরকার হয় না। যখন নির্বাসন জীবন যাপন করছি, তিনি আমার বার্লিনের বাড়িতে কিছুদিনের জন্য আমার আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। তাঁকে তখন আরও কাছ থেকে জানার সৌভাগ্য হয়। তাঁর নীতি এবং আদর্শের সামনে, তাঁর নির্লোভ নির্মোহ জীবনের সামনে, তাঁর সততা এবং সারল্যের সামনে শ্রদ্ধায় বারবার আমি মাথা নত করেছি।

অম্লান দত্তের যে অসাধারণ গুণ আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে, তা হল নিজে ঈশ্বরবিশ্বাসী হয়েও আমার মতো নাস্তিকের কথা বলার স্বাধীনতার পক্ষে তিনি শুধু মত দেননি, আমাকে সমর্থন করে তিনি লিখেছেন, বলেছেন, সরব হয়েছেন সবখানে। সহিষ্ণুতার পক্ষে তিনি তাঁর মত প্রকাশ করে গেছেন সারা জীবন। পশ্চিমের নির্বাসন জীবন থেকে যখনই আমি কলকাতা আসার সুযোগ পেয়েছি, প্রতিবারই অম্লান দত্ত আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। প্রতিবারই আমাদের গল্প হয়েছে দীর্ঘক্ষণ, জীবন আর জগতের গল্প। বিজ্ঞান, ধর্ম, সাহিত্য, শিল্প, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি– যে কোনও বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে মন খুলে কথা বলা যেত, যে কোনও জটিল প্রশ্নের সহজ এবং সত্য উত্তর তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যেত। নির্বাসন জীবনে দেশ হারানোর বেদনায় যেন নুয়ে না থাকি; শুধু হা হুতাশ করে, চোখের জল ফেলে সময় নষ্ট না করে যেন আরও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি, আরও জ্ঞান যেন আহরণ করি, বলতেন। আমার সাফল্য তাঁকে আনন্দ দিত, আমার বেদনায় মুষড়ে পড়তেন।

কলকাতায় বাস করার সময় তাঁর বাড়িতে গিয়েছি অনেক। বয়স হয়েছে, একা থাকেন, এ কারণে তাঁকে সাংসারিক কিছু সাহায্য করতে চেয়েছি, তিনি কারও কোনও সাহায্য নেননি। কারও দেওয়া কোনও উপহার তিনি নেননি। জীবনের যেসব জিনিসকে এ যুগে আমরা অতীব প্রয়োজনীয় বলে মনে করি, এবং যেসব ছাড়া বাঁচা অসম্ভব বলে। ভাবি, সেসব ছাড়াই অম্লান দত্ত বেঁচে থাকতেন। তাঁর কোনও অভাববোধ ছিলো না। একবার মানববাদের ওপর একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দুজন দিল্লিতে গিয়েছিলাম,গান্ধী আশ্রমের অতিথিশালায় ছিলাম, হাড় কাঁপানো শীতে আমি কাবু হয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি আমার দেখভাল করছিলেন। মাঝে মাঝে শিশুর মতো রাগ করতেন। রাগ পড়ে গেলে আবার শিশুর মতোই অমলিন হাসতেন। কলকাতায় আমার সাত নম্বর রাউডন স্ট্রিটের বাড়িতে তিনি প্রায়ই আসতেন। যেদিনই তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, এসেছেন, একদিন। শুধু নিজেই ছুটে এসেছিলেন আমার আমন্ত্রণ ছাড়াই। হায়দারাবাদে আমার ওপর আক্রমণ হওয়ার পর দিন। উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ তাঁর মুখে স্থির হয়ে বসে ছিল। তাঁর বোধহয়। এই ভেবে কষ্ট হত যে, মানুষ তার যুক্তি বুদ্ধি বিবেক বিসর্জন দিয়ে যেভাবে বেঁচে আছে, সেটার নাম সত্যিকার বেঁচে থাকা নয়।

কলকাতা থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর যখনই আমার ওপর কোনও প্রতিবাদ সভার অনুষ্ঠান হয়েছে, অম্লান দত্ত গিয়েছেন। বাক স্বাধীনতার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। তাঁকে কখনও ক্লান্ত মনে হয়নি এসবে। বরং যত অসুস্থতাই থাকুক, আদর্শের জন্য তিনি সব ভুলে উঠে দাঁড়িয়েছেন, যখন এই কলকাতা শহরেই, অনেক লেখক, কবি, শিল্পী, আমার বিপদ দেখে আলগোছে কেটে পড়েছেন।

.

নিখিল সরকার

একসময় নিখিল সরকার হয়ে উঠেছিলেন একই সঙ্গে আমার মা বাবা ভাইবোন, আত্মীয় স্বজন আর বন্ধু বান্ধব। হোঁচট খেলে তুলে ধরছেন। হাঁটতে সাহায্য করছেন। নির্বাসন অসহ্য লাগলে বলছেন, আমি একা নই, আরও অনেক লেখক নির্বাসন জীবন যাপন করেছেন। আমি যেন হতাশ না হয়ে দুচোখ খুলে জগৎটা দেখি, যেন লেখাপড়ায় মন দিই। উপদেশ দিয়েই যাচ্ছেন, ক্লান্তিহীন। চিঠি লিখছেন যেখানেই ডেরা বাঁধি সেখানেই। আমিও নানান দেশ থেকে ফোন করছি নিখিল সরকারকে। খুঁটিনাটি সবকিছু জানাচ্ছি। কোনও কারণে একটা দিনের জন্যও নিখিলদার সঙ্গে সম্পর্ক আমার নষ্ট হয়নি। নিখিল সরকার আমাকে বই পাঠাতে বলতেন। ভারতে পাওয়া যায় না এমন সব দুষ্প্রাপ্য বই। বইগুলো বিদেশের বিভিন্ন বইয়ের দোকান থেকে কিনে পাঠাতাম নিখিলদাকে। ভাবতাম, এসব বই কজন লোক পড়ে আজকাল। এত জ্ঞানের বই! সত্যি বলতে কী, জগতের এত বিষয়ে এত জ্ঞান খুব বেশি মানুষের আমি দেখিনি। এমন পণ্ডিত লোক কজন আছে উপমহাদেশে! যে কোনও বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলেই আমি লক্ষ্য করেছি, তিনি বিশাল এক জ্ঞানের সমুদ্র। কত কিছু যে শিখেছি নিখিল সরকারের কাছে! নিখিল সরকার আমার শুধু বন্ধুই ছিলেন না, শিক্ষকও ছিলেন।

নিখিল সরকার যে বছর চলে গেলেন, সে বছরই আমি কলকাতায় বাস করতে শুরু করেছি। শহরটায় অনেকগুলো বছর কাটিয়েছি, শুন্য শহরটায়, খা খা করা শহরটায়। এই শহর থেকেও আমাকে তিনবছর পর তাড়িয়ে দেওয়া হল, ঠিক বাংলাদেশ থেকে যেমন তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। নিখিল সরকার বেঁচে থাকলে প্রতিবাদ করতেন এই অন্যায়ের। একজন লেখক তার লেখালেখির কারণে আর কত যুগ রাজনৈতিক, সামাজিক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক আঘাত পেতেই থাকবে!

নিখিল সরকার চলে যাওয়ার পর শিবনারায়ণ রায় চলে গেলেন। অম্লান দত্তও গেলেন। আমার জগৎ এখন বড় ফাঁকা। কলকাতা নিশ্চয়ই খুব ফাঁকা এখন। মানুষ আছে, মনীষী নেই। কলকাতায় হয়তো আমাকে এ জীবনে কখনও ঢুকতে দেওয়া হবে না। তবে যেখানেই থাকি পৃথিবীর, নিখিল সরকার মনে রয়ে যাবেন, যতদিন বাঁচি ততদিন। আমি তো ঋণী তাঁর কাছে। আমার মার কাছে আমি ঋণী, বাবার কাছেও ঋণী। নিখিল সরকারের কাছেও। কিছু কিছু ঋণ কখনও শোধ হয় না।

.

শামসুর রাহমান

দেশে থাকাকালীন শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার খুব সখ্য ছিল। এই একটি মানুষই ছিলেন বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে যাঁকে আমার মনে হতো সরল সহজ ভালোমানুষ। হৃদয় দিয়ে লিখতেন। প্রচণ্ড আবেগ ছিল। রেগে গেলে চিৎকার করতেন। দুঃখ পেলে কাঁদতেন। চোখে জল দেখেছি তাঁর। যখন প্যারিসে দেখা হয়েছিল ২০০০ সালে, বিদেয় নেওয়ার সময় জড়িয়ে ধরেছিলেন আমাকে। চলে আসতে আসতে পেছন ফিরে দেখেছিলাম চোখ মুছছেন। দেশে ফিরে গিয়ে আমাকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন। ধিক্কার দিয়েছিলেন দেশের সরকার আর ধর্মীয় মৌলবাদীদের। তিনি হয়তো জানতে ও দেখাই আমার সঙ্গে তাঁর শেষ দেখা।

শামসুর রাহমান নেই। আর কেউ তাঁর মতো অত বড় বৃক্ষ হতে পারেনি। চারদিকে শুধু তৃণ।

.

প্রশান্ত রায়

প্রশান্ত রায় ইস্কুল কলেজের ক্রিম ছাত্র। সব ছেড়েছুঁড়ে নকশাল করতে একসময় মাঠে নেমেছিলেন। গ্রামের এক জোতদারকে প্রাণে মেরে ফেলার আদেশ পান, বড় বড় নকশাল নেতার সে আদেশ তিনি মানতে পারেননি। খুনের রাজনীতি তিনি করবেন। না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। কত নকশাল নেতা পচে গেছেন। প্রশান্ত রায় কিন্তু আগের মতোই আছেন। সমাজতন্ত্রে আজও গভীর বিশ্বাস তাঁর। আজও তিনি নিজের আদর্শ থেকে এক চুল নড়েননি। মেরুদণ্ড তেমনই দঢ়। বাড়িতে আজও কোনও রঙিন। টেলিভিশন নেই, কোনও রেফ্রিজারেটর নেই, কোনও এসি নেই, কোনও মাইক্রোওয়েভ নেই, ওয়াশিং মেশিন নেই। গাড়ি তো নেইই। তিনি বলেন, ভারতবর্যের অধিকাংশ লোকের যা নেই, তা আমার থাকবে না। প্রশান্ত রায় আমার লেখা খুব পছন্দ করেন। কারণ, আমার লেখায় মানুষের মধ্যে সমতা আর সমানাধিকারের কথা থাকে। আমার জীবন সংগ্রাম দেখে তিনি অভিভূত। তাই তাঁর পিপলস বুক সোসাইটি থেকে আমার সাত খণ্ড আত্মজীবনী প্রকাশ করেছেন। আমরা পরস্পরকে মাঝে মাঝে কমরেড বলেও সম্বোধন করি।

.

শামীম সিকদার

শামীম সিকদারের দাদা সিরাজ সিকদার,সর্বহারা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। সর্বহারা পার্টি অনেকটা নকশাল পার্টির মতো, নিষিদ্ধ ছিল। শেখ মুজিবের আমলে সিরাজ সিকদারকে মেরে ফেলা হয়েছিল। শামীম সিকদার অসাধারণ মানুষ। ছোটবেলায়। সাইকেল চালাতেন। কোনও এক ছেলে তারা ওড়না টান মেরে নিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে আর ওড়না পরেননি, সালোয়ার কামিজও পরেননি। সেই থেকে প্যান্ট সার্ট। কে কী বললো না বললো, তার কোনওদিন ধার ধারেননি। যা ইচ্ছে হয়েছে, করেছেন। ঢাকার আর্ট কলেজে পড়াশোনা করেছেন। ভাস্কর্য ডিপার্টমেন্টের মাস্টার হয়েছেন। কিছু পুরুষ-মাস্টার তাঁকে আর্ট কলেজ থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য আন্দোলন করেছিলেন একসময়। শামীম সিকদার মোটেও দমে যাননি। মাথা উঁচু করে ফাইট করেছেন। ফাইটার ছিলেন। প্রয়োজনে পকেটে পিস্তল নিয়ে চলতেন। নাম কিন্তু ওই পুরুষ-মাস্টারদের হয়নি। হয়েছে শামীম সিকদারের। ঢাকা শহরে তাঁর বিশাল বিশাল ভাস্কর্য শোভা পাচ্ছে স্বাপার্জিত স্বাধীনতা, স্বাধীনতা সংগ্রাম ইত্যাদি। সিগারেট খেতেন। তবে কখনও আড়ালে নয়। সবার সামনে খেতেন। আমি যদি ডাকাবুকো মেয়ে হই, আমার চেয়ে শত গুণ বেশি ডাকাবুকো শামীম সিকদার, এবং আমার আগের জেনারেশনের মেয়ে, যখন সমাজ আরও রক্ষণশীল ছিলো। কৈশোরে শামীম সিকদারের জীবন পড়ে চমকিত হতাম। সেই শামীম সিকদার আমার বিরুদ্ধে মৌলবাদীদের ফতোয়া ঘোষণা হওয়ার পর ঢাকার রাস্তায় আমার পক্ষে ব্যানার নিয়ে হেঁটেছেন। এবং তাঁরও চেয়ে বড় কথা, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। আমাকে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে, যখন আমার বিরুদ্ধে ১৯৯৪ সালে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। সরকার আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল আর লক্ষ লক্ষ মৌলবাদী আমাকে হত্যা করার জন্য সারা দেশে মিছিল মিটিং করেছিলো। সেই দুঃসময়ে যখন বন্ধুরাই সরে গিয়েছিল, এগিয়ে এসেছিলেন তিনি। শুধু শুধু বসে বসে দুঃশ্চিন্তা করার বদলে আমাকে কাগজ কলম দিয়েছেন লেখার জন্য, ইজেল, ক্যানভাস আর রং তুলি দিয়েছিলেন ছবি আঁকার জন্য। অনেক রাত পর্যন্ত আমার সঙ্গে কথা বলতেন। দুমাস অনেকের বাড়িতে আমাকে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিলো, সবাই একটা সময় বেঁধে দিয়েছিলেন কদিন থাকতে পারবো তার। কিন্তু শামীম সিকদারই বাঁধেননি সময়, যতদিন প্রয়োজন ততদিন থাকার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। শামীম সিকদারই কাউকে ভয় পাননি। পকেটে অস্ত্র নিয়ে তিনি কোর্টেও চলে যেতে চেয়েছিলেন যেদিন জামিনের জন্য আমার যাওয়ার কথা ছিল। এই একটা মানুষ আমার জীবনে আমি দেখেছি, যে মানুষ কাউকে ভয় পাননা, পাছে লোকে কিছু বলের ভয় তো তার কোনওদিন ছিলই না, যে মানুষ মাথা উঁচু করে চিরকাল চলেছেন এবং আমাকেও চলতে শিখিয়েছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *