টুকরো টুকরো জীবন
১. মাঝে মাঝে ভারতের লোকদের জিজ্ঞেস করছি, কেমন খেলছে বাংলাদেশ। তারা উচ্ছ্বসিত। তারা বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সবার নাম জানে, কে ব্যাটসম্যান, কে বোলার, কে কেমন খেলে, সব তাদের নখদর্পণে। কবে বাংলাদেশ কার সঙ্গে খেলেছে, কবে জিতেছে, কবে হেরেছে–সব মুখস্ত। আমি তো হাঁ হয়ে যাই। আমিই জানিনা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলটি সম্পর্কে কোনও কিছু। ভারতের ক্রিকেট-ভক্তরা জানে। বাংলাদেশ ভালো খেললে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা তো বেজায় খুশি। এতদিন তো ক্রিকেট-জগতে একজন বাঙালিকে দেখেছে, এখন এগারো জন বাঙালিকে দেখে আহ্লাদে আটখানা। ভারতের লোকেরা জানে, আমি ভারত-পাকিস্তান, ভারত শ্রীলংকা, ভারত-অস্ট্রেলিয়া ভারত-হোয়াটএভার খেলা হোক, আমি ভারতের পক্ষ নিই। প্রশ্ন করলো, এবার কী করবে, যখন ভারত আর বাংলাদেশ খেলবে? ভারতের পক্ষ নেওয়া ছাড়াও আমার আরও একটি নীতি আছে। গরিব দেশ, নতুন দেশ, দুর্বল দেশের পক্ষ নিই আমি। ভারত-বাংলাদেশের খেলায় আমি আমার নীতি অনুযায়ীই বাংলাদেশের পক্ষ নেবো, কারণ বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় ক্রিকেট জগতে নতুন, ভারতের তুলনায় গরিব এবং দুর্বল।
একবার মনে আছে ভারতের সঙ্গে কোনো এক দলের খেলা হচ্ছিল, আমি ভারতকে নয়, অন্য দলকে সমর্থন করছিলাম, যেহেতু অন্য দলটি ভালো খেলছিল। টুইটারে আমার মত প্রকাশ করতেই উড়ে এলো জাতীয়তাবাদী ভারতীয়রা, পারলে আমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে, নয়তো কান ধরে টেনে নিয়ে বর্ডার পার করে দিয়ে আসে। যদি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের খেলায় বাংলাদেশকে সমর্থন করি, আশা করছি, ভারত আমাকে ততোটা তিরস্কার করবে না। আর তিরস্কার করলেই বা কী! আমি কি পাছে লোকে কিছু বলের ভয়ে কোনওকালেই নিজের মতকে পাল্টেছি নাকি নিজের মতকে কোথাও অপ্রকাশ করেছি!
২. সেদিন, নারী দিবসের দিন, দিল্লির বেঙ্গল এসোসিয়েশন আমাকে সম্বর্ধনা দিল। যেহেতু আমি কোনও অনুষ্ঠানে আজকাল যাই টাই না, ঘরোয়া আড্ডা হবে এই বলে যখন ডাকা হলো, গিয়েছিলাম। কিন্তু দেখলাম তিনশ লোক বসে আছে, সামনে স্টেজ, মাইক। অনেকে কবিতা পড়লেন, গান গাইলেন, বক্তব্য রাখলেন। আমি অল্প কিছু কথা বললাম, দুটো কবিতা পড়লাম। কিন্তু দর্শক শ্রোতা ওটুকুতে সন্তুষ্ট ছিল না, তারা আমার আরও কথা, আরও কবিতা শুনতে চাইছিল। অনুষ্ঠান শেষে হুড়মুড় করে সবাই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার ওপর, আমার অটোগ্রাফ নেবে, ছবি তুলবে, আমার হাতখানা একটুখানি ছোঁবে। বেশ চমকিত হলাম। সাত বছর পার হয়ে গেছে আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাড়ানো হয়েছে। কোথাও আমার কোনও লেখা ছাপা হয় না বললেই চলে। পশ্চিমবঙ্গের সরকার আমাকে রাজ্যছাড়া করার সঙ্গে সঙ্গে পত্র পত্রিকাগুলো বন্ধ করে দিয়েছে আমার লেখা ছাপানো, আমার বইএর খবর বা রিভিউ ছাপানো। আমার বই যে বের হয়, বই কেমন হয়, সে খবর কোনও পাঠকই জানতে পারে না। বাংলা মিডিয়ার ব্যবহারে মনে হয়, আমি একজিস্ট করি না। জনপ্রিয় একজন লেখককে রাতারাতি একটা নিষিদ্ধ নামে পরিণত করেছে ওরা। ছোট একটি প্রকাশক, নষ্ট না হওয়া-চরম-বামপন্থী, বই ছাপিয়ে যাচ্ছেন এখনও। যে মানুষটা কোনওদিন কোনও রাজনীতি করলো না, তাকে নিয়ে রাজনীতি কে আগে করবে, কে বেশি করবে, তার প্রতিযোগিতা চলে ভারতবর্ষে। সবারই বিশ্বাস, আমাকে যে বেশি লাথি মারতে পারবে, আমার প্রতি ঘৃণা যে বেশি প্রকাশ করতে পারবে, সে-ই সংখ্যালঘুর ভোট পাবে বেশি। দেখে হাসি পায়, দুঃখও লাগে। তবে আটই মার্চের ওই অনুষ্ঠানটায় গিয়ে আমার মনে হয়েছে, বাঙালির মন থেকে এখনও আমাকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে পারেনি বাংলার সরকার এবং মিডিয়া জগৎ। এখনও মানুষ মনে রেখেছে আমাকে, এখনও তারা আমার বই পড়ে।
৩. আমি নারীবাদী লেখিকা। লোকে এ কারণেই ভেবে নেয় আমি রান্না করতে জানি না। নারীবাদের সঙ্গে রান্না না করার সম্পর্ক ঠিক কী, আমি জানি না। আমি নিজে বাজার করি, নিজে রান্না করি, বাগান করি, ঘর সাজাই। এগুলো করতে আমি খুব পছন্দ করি। আমি খুব নরম স্বরে কথা বলি, সদা হাস্যোজ্জ্বল, কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করি না, অতি উদার, অতি অতিথি পরায়ণ। এগুলো নাকি নারীবাদের সঙ্গে যায় না। আমাকে নাকি চিৎকার করতে হবে, গালাগালি করতে হবে, বর্বর পুরুষ দেখলে কিছু কিল ঘুসি লাগাতে হবে। সেদিন নারী দিবসের অনুষ্ঠানেও দেখলাম অনেকে বলছিল, ভেবেছিলাম কিছু কড়া কথা বলবেন। কিন্তু আমি যে গলা নামিয়ে, শান্ত কণ্ঠে, কড়া কথা বলতে পারি, তা অনেকে বুঝতে পারে না। কড়া কথা, উচিত কথা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা–এসবের জন্য গলার স্বর সপ্তমে চড়ানোর আসলে দরকার পড়ে না।
তা যা বলছিলাম, রান্না। বন্ধুদের জন্য রান্না করতে, বন্ধুদের খাওয়াতে আমি খুব ভালোবাসি। প্রচুর মাছ টাছ রান্না করি। কিছুকাল হলো লক্ষ করছি, বন্ধুরা সবাই খুব কম খায়। সেদিন বাংলাদেশ থেকে আমার সঙ্গে দেখা করতে ছোটভাইমতো একজন এসেছিলো। অনেক কিছু রান্না করেছিলাম, চিংড়ি, পাবদা, ভেটকি, ইলিশ, পার্সে। খেলোনা প্রায় কিছুই। ভাত তো আজকাল কেউ এক চামচের বেশি নিতেই চায় না। কালও কলকাতা থেকে পুরোনো এক বন্ধু এসেছিলো। খাদ্যরসিক হিসেবেই তাকে জানতাম। কলকাতায় যখন ছিলাম, আমার বাড়িতে প্রায় দুপুরবেলায় ও চলে আসতো, তৃপ্তি করে খেতো। কাল দেখলাম ও শুধু মাছের কোনা ভেঙে ভেঙে নিচ্ছে, পুরো মাছটা খাবে না।ভাত তো নেবেই না। জিজ্ঞেস করলাম, ডায়বেটিস হয়েছে কি না। বললো, না। তবে কেন? বললো, পেটটায় যেন মেদ না হয়। পেটের মেদ নিয়ে শুধু মেয়েদের নয়, ছেলেদেরও আজকাল অস্বস্তি। বন্ধুটা বললো, অনেকদিন বাঁচতে চাই, তাই খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। অনেকদিন বাঁচতে হলে বুঝি খাওয়া কমিয়ে দিতে হয়। লক্ষ করছি, খাবারের মধ্যে ভালো খারাপ না বেছে, খাবারের পরিমাণটা অনেকে কমিয়ে দেয়। পাতে ঘি নিচ্ছে, মাখন খাচ্ছে, পনির খাচ্ছে, মিস্টি খাচ্ছে, চায়ে চিনি খাচ্ছে কিন্তু ভাতটা খাচ্ছে না, ভাতে নাকি ক্যালোরি বেশি। নিরীহ শাক সবজি আর মাছ খেতেও অনেকের ভয়। আজকাল স্বাস্থ্য সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বাড়ছে। পার্কে, জিমে লোকের ভিড়। সবাই বেশিদিন বাঁচতে চায়। এদিকে আমি সেদিন আমার ট্রেডমিলটা দিয়ে দিলাম আমার এক বন্ধুকে। সে লুফে নিলো। আমার ব্যায়াম ট্যায়াম করতে ভালো লাগে না। আমি কি বেশিদিন বাঁচতে চাই না! চাই তবে নিজেকে কষ্ট দিয়ে নয়। মাঝে মাঝে সাইকেল চালাতে ইচ্ছে করলে চালাই বা সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করলে কাটি। আর বায়ু যদি দুষিত না থাকে, চমৎকার যদি আবহাওয়া, মনটাও ফুরফুরে, তাহলে হাঁটতে ভালো লাগে, হাঁটি। যা খেতে ইচ্ছে করে খাই। শুধু দেশি খাবার নয়। পৃথিবীর নানা দেশে, নানা শহরে আর গ্রামে, লোকাল খাবার খাওয়া আমার শখের মধ্যে পড়ে। কোনওদিন যদি ভ্রমণ কাহিনী লিখি, লিখবো সেসব। স্বাস্থ্যকর খাবারের মধ্যেও হাজারো সুস্বাদু খাবার আছে। আমি মাছ ভেজে নিয়ে রান্না করি না। অতি স্বাস্থ্য-সচেতন বাঙালিরা আবার মাছ না ভেজে রান্না করলে মাছই মুখে দেয় না। খুব তেল মশলার খাবার না হলে তাদের মুখে রোচে না। আমার অল্প তেলের অল্প মশলার রান্নাকে বাঙালিরা বলে, তেলমশলা ছাড়া রান্না। ভারতের অবাঙালিরা বলে, সাদা খানা। অনেকে আমাকে বলেছে, রান্নার একটা বই লিখতে। অনেক বড় বড় লেখক রান্নার বই লিখেছেন। কিন্তু আমি জানি, আমার পক্ষে রান্নার বই লেখা সম্ভব হবে না। কারণ আমি রান্নার কোনও রেসিপি মানি না। কী করে রান্না করতে হয়। তা কোনওদিন শিখিনি। আমার রান্নাগুলো একধরনের এক্সপেরিমেন্ট। একদিন আমার রান্নার গল্প শোনাবো।
৪. স্বার্থপর মানুষের সংখ্যা খুব বেড়ে যাচ্ছে. নিষ্ঠুর, নির্দয়, হিংসুক, ঠগ, মিথ্যুক, লোভী লোকের সংখ্যা বাড়ছে সমাজে. আমি বলতে চাইছি না, আগে সব ভালো ছিল, এখন সব খারাপ. ভালো খারাপ সব সময়েই থাকে। তবে এটা কি ঠিক নয়। যে কিছুকাল আগেও মানুষ মানুষের সাহায্যে, এখন যত আসে, তার চেয়েও বেশি এগিয়ে আসত। এখন মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, হাত গুটিয়ে নেওয়ার মানুষই চারদিকে মনে হচ্ছে বেশি। ধনী দেশগুলোয় একে অপরকে সহযোগিতা করার, আমি দেখেছি, প্রবণতাটা এখনো আছে, গরিব দেশে মনে হয় ঘৃণাটা, নৃশংসতাটা বেশি। এক দেশে সবাই ধনী হলে সম্ভবত উদার হওয়ার সম্ভাবনাটা বাড়ে। আর কেউ কেউ ধনী, কেউ কেউ গরিব হলে মুশকিলটা শুরু হয়। টাকা পয়সাটা জীবনে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে। ধনী তার ধন কামড়ে রাখে, ধনী হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে গরিবেরা। গরিব দেশে এখন বোধ হয় মানুষ মানুষকে আর সাহায্য করে না, সাহায্য করার জন্য এনজিও ভাড়া করা হয়। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তাঁর মুভেবল ফিস্টএ লিখেছেন, তখন আমরা খুব গরিব ছিলাম এবং খুব সুখে ছিলাম। কজন আজকাল এমন কথা লেখে। আমি কিন্তু দারিদ্রকে গ্লোরিফাই করছি না। শুধু বলতে চাইছি ওপরে ওঠার সিঁড়ি বলতে কি শুধু ধনী হওয়ার সিঁড়িই বুঝব! আমাদের বাবা মারা বলতেন, টাকা পয়সা বড় নয়, লেখাপড়াটা বড়, জ্ঞানটা বড়, সততাটা বড়। আজকালকার বাবা মারা কি এমন কথা বলেন? আমাদের বাবা মারা, অনেকে হয়ত বলবে, বোকা ছিলেন। আমার কিন্তু মনে হয় না।