2 of 3

কল্পনার রাজ্য

কল্পনার রাজ্য

প্রচুর লোকের ধারণা, ইসলামের সমালোচনা করলে পশ্চিমের দেশ থেকে বেশ ইনাম, মেলে। মুখগুলো তাদের কল্পনার রাজ্যে বাস করে। সত্য কথা হলো, ইসলামের সমালোচনা করলে তোমার কোথাও ঠাঁই নেই। মুসলিম সন্ত্রাসীরা তোমাকে জবাই করবে, মৌলবাদীরা তোমার মাথার মূল্য ঘোষণা করবে, মুসলিম সরকার তোমাকে জেলে পুরবে, ইওরোপ আমেরিকা তোমাকে অবজ্ঞা করবে। তুমি একা হয়ে যাবে। সম্পূর্ণ একা। একঘরে। হাতে গোণা কিছু অসহায় নাস্তিক কালে ভদ্রে তোমার খোঁজ নেবে। নাও নিতে পারে।

পশ্চিমের দেশে কদর পায় আদর পায় ফুল পায় ফুল পায় তারা, যারা বলে, ইসলামী মৌলবাদ খারাপ কিন্তু ইসলাম ভালো; যারা বলে, মৌলবাদীরা বা সন্ত্রাসীরা যে ইসলাম চর্চা করছে, সেটা সহি ইসলাম নয়; যারা বলে, মৌলবাদীরা বা সন্ত্রাসীরা কোরানের যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে, তা ভুল ব্যাখ্যা। সে কারণে পশ্চিমে মালালা হিরো, কারণ মালালা বলে বেড়ায়, ইসলামী মৌলবাদ খারাপ কিন্তু ইসলাম ভালো। সে কারণে পশ্চিমে তসলিমা জিরো, কারণ তসলিমা বলে বেড়ায়, ইসলামে আর ইসলামী মৌলবাদে কোনও তফাৎ নেই, ফারাক নেই।

পশ্চিমের দেশগুলো মডারেট মুসলমানদের পছন্দ করে, ইসলাম-নিন্দুক নাস্তিকদের মোটেও পছন্দ করে না। বরং যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে। ওরা মনে করে ইসলামে পরিবর্তন আসতে হবে ভেতর থেকে, অন্য সব ধর্মে যেভাবে এসেছে। বিশ্বাস করে, ইসলামের বাইরে দাঁড়িয়ে নাস্তিকরা চেঁচালে কোনও লাভ তো হবেই না, বরং ক্ষতি হতে পারে। তাই আমরা, মুসলমান পরিবারের নাস্তিক সন্তানেরা, বাতিলের খাতায়। আমাদের নিয়ে পশ্চিমের রাজনীতিক, দার্শনিক, ভাবুক, বুদ্ধিজীবী, সমাজবিদ, নৃতত্ত্ববিদ, পূর্ব বিশারদ, ধর্ম বিশারদদের কোনও উৎসাহ নেই।

কল্পনার রাজ্যে বাস করা মুখরা কিন্তু যতদিন বাঁচবে, বলেই যাবে যে ইসলামের বিরুদ্ধে লিখলে পশ্চিমের ইনাম পাওয়া যায়। পশ্চিমের তো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, ইসলাম বিরোধী কাউকে ইনাম দিয়ে নিজের সর্বনাশ করবে! আসলে, সত্যিটা হলো, ইসলামের স্তুতি গাইলে শুধু পুবে নয়, পশ্চিমেও ইনাম মেলে।

বেশির ভাগ মুসলমানের ধারণা, আমেরিকা মুসলমান-বিরোধী, কারণ মুসলমানের দেশ আফগানিস্তানে আর ইরাকে বোমা ফেলেছে আমেরিকা, আর সেই বোমায় নিহত হয়েছে লক্ষ লক্ষ মুসলমান। ইজরাইলকে অস্ত্র শস্ত্র দিচ্ছে আমেরিকা, যে ইজরাইল ফিলিস্তিনি মুসলমানদের মেরে সাফ করে দিচ্ছে। সুতরাং ইসলামের নীতি রীতি নিয়ে প্রশ্ন করলে বা ইসলামে অবিশ্বাস করলে আমেরিকার ইহুদি নাসারারা ওত পেতে থাকে আলিঙ্গন করার জন্য, হীরে মুক্তোয় ডলারে পাউণ্ডে ইউরোয় ডুবিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু এটা যে সম্পূর্ণ মিথ্যে, তা তাদের কে বোঝাবে। আমেরিকার কোনও সরকার কি ইসলামের নিন্দা করেছেন? কোনও সরকার কি কোনও চিহ্নিত ইসলাম বিরোধীর সঙ্গে দেখা করেছেন? এরকম আমি শুনিনি, দেখিওনি। বরং আমেরিকার সরকার সেইসব মডারেট মুসলিমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যাঁরা বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম। আমেরিকার সব প্রেসিডেন্টই ঘোর নিশ্চিন্তে বলেছেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম, কিছু বিপথগামী লোক শুধু অশান্তি সৃষ্টি করছে। আমেরিকার কোনও সরকারই কোনও ইসলাম বিরোধীর সঙ্গে না প্রকাশ্যে না গোপনে কোনও সম্পর্ক রেখেছেন। তাঁরা অনেকেই নিজেরা ধর্মে বিশ্বাস করেন। এবং অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসীর সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগটা সে কারণেই ভালো।

রাজনৈতিক শরণার্থীদের উন্নতমানের জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে, এমন একটি দেশে আমি রাজনৈতিক শরণার্থী ছিলাম। কিন্তু সরকারের কাছে থেকে কোনও টাকা পয়সা আমি পাইনি। চাইওনি। বই বিক্রির রয়্যালটি কিছু পেতাম, ওতেই কষ্টেসৃষ্টে বাঁচার চেষ্টা করেছিলাম। আজ পর্যন্ত এই যে এত দেশে বাস করেছি, কোনও সরকারের কাছ থেকে কানা কড়ি সাহায্য আমি পাইনি কিন্তু। সরকারি বা বেসরকারি কোনও সংস্থা আগ বাড়িয়ে আমাকে সাহায্য করতে চায়নি। আমি ইসলামের সমালোচনা করি জানার পরও কোনও বাড়তি আগ্রহ কেউ দেখায়নি। অথবা ইসলামের সমালোচনা করি জানার পরই বাড়তি আগ্রহ তো দেখায়ইনি, স্বাভাবিক আগ্রহও দেখায়নি। যদি পশ্চিমের দেশগুলো ইসলাম বিরোধী হতো, তাহলে আমাকে লুফে নিতো। লুফে হয়তো আমাকে নিতো, যদি আমি ইসলামের প্রশংসা করতাম, এবং মুসলিম মৌলবাদী এবং সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লিখতাম। সালমান রুশদি জনপ্রিয়, কিন্তু ইসলাম বিরোধী লেখা লিখে উনি জনপ্রিয় নন। বাক স্বাধীনতার পক্ষের যে লোকেরা তাঁকে সমর্থন জানিয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই কিন্তু রুশদির বইগুলোর মধ্যে সেটানিক ভার্সেসকে খুব উন্নতমানের উপন্যাস বলে মনে করেন না। পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে চরম ডানপন্থীর সংখ্যা কম, ইসলাম এবং মুসলিমদের প্রতি তাঁদের প্রবল সহানুভূতি এবং সহমর্মিতা।

ইওরোপ আর আমেরিকা যদি ইসলাম বিরোধী হতো, তাহলে এত বিপুল পরিমাণ মুসলিম অভিবাসী ওসব দেশে বাস করতে পারতো না। মুসলিমরা যে মানবাধিকার ভোগ করে ইওরোপ আর আমেরিকায়, তা পৃথিবীর অন্য কোথাও ভোগ করতে পারে না, মুসলিম দেশগুলোতে তো প্রশ্নই ওঠে না। আজ মুসলিমদের মানবাধিকার রক্ষায় সবচেয়ে বেশি যাঁরা এগিয়ে আসেন, তাঁরা পশ্চিমের বুদ্ধিজীবী, পশ্চিমীদের তৈরি হিউমেন রাইটস ওয়াচ, এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, এরকম শত শত সংগঠন। অবৈধ অভিবাসীরা যখন আইনের তাড়া খায়, আশ্রয় নেয় গির্জায় না, এসব গির্জা মুসলিমদের ক্রিশ্চান হওয়ার কোনও শর্ত না দিয়েই আশ্রয় দেয়। এই অভিবাসীদের অনেকেই পায়ের নিচে মাটির ছোঁয়া পেতে না পেতেই পশ্চিমেরই বিরোধিতায় নিজেকে উৎসর্গ করে। পশ্চিমের পুলিশই গাড়ি ঘোড়া সরিয়ে পশ্চিমের বিরোধিতায় ওদের সামিল হতে দেয়, ওদের নিরাপত্তাও একশ ভাগ নিশ্চিত করে। মুসলিমদের জন্য স্বর্গরাজ্য পাশ্চাত্য। বিশ্বাস হয় না? ওদের জিজ্ঞেস করুন। উত্তর আমেরিকার কোনও অঞ্চল থেকে, বা সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যাণ্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যাণ্ড থেকে ওরা সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, সিরিয়া, জর্দান, মিশর, কুয়েত, কাতার, পাকিস্তান, আফগানিস্তানে বাস করতে চায় কি না। যত বড় ধর্মপ্রাণই হোক না কেন, যতই বিধর্মীদের গালাগালি করুক না কেন, যতই শরিয়া আইনকে শ্রেষ্ঠ আইন বলে বলে রাস্তায় নামুক না কেন, বিধর্মীদের মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে, কিছুতেই শরিয়া আইনের দেশে, ইসলামের দেশে, মুসলিম প্রধান কোনও দেশে বাস করতে চাইবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *