কীরকম যেন ভয় ভয় লাগে
সভ্য পৃথিবীতে নাস্তিক, ব্লগার, মুক্তমনা হওয়া খুব গৌরবের বিষয়। মানুষ তাঁদের শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। যাদের পরিচিতি আছে, তাদের দেখার জন্য ভিড় হয়, তাদের অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। পৃথিবীর অসভ্য জায়গাগুলোয় নাস্তিক, ব্লগার, মুক্তমনাদের নিয়ে গৌরব করা হয় না। কারণ অসভ্য লোকরা জানেনা, নাস্তিক, ব্লগার, মুক্তমনা মানে কী। অসভ্য লোকদের কাছে যে মানুষই প্রগতিশীল, যে মানুষই ব্লগ লেখে, যে মানুষই মুক্তচিন্তায় বিশ্বাস করে–সে মানুষই নাস্তিক। এবং অসভ্য লোকরা এও বিশ্বাস করে, নাস্তিকদের মেরে ফেলার মতো ভালো কাজ আর হয় না। এই অসভ্য লোকদের সভ্য করার উপায় কী! এদের সভ্য করার জন্য আজ প্রায় তিরিশ বছর আগে লেখালেখি শুরু করেছিলাম, তিরিশ বছর পর দেখলাম, অসভ্যরা আরও অসভ্য হয়েছে। আমার একার লেখালেখি দিয়ে তো আর গোটা দেশের অসভ্যকে সভ্য করা সম্ভব নয়। আরও লেখক যদি লিখতেন, রাজনীতিকরা যদি বলতেন, সরকার যদি পদক্ষেপ নিতেন অসভ্যকে সভ্য করার, মুক্তবুদ্ধির মানুষরা মিলেজুলে পারতেন কিন্তু দেশটাকে বদলে দেবার। সেই কবে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কী ভেবে স্বাধীন হলো, আর কোথায় এসে দাঁড়ালো দেশ!
দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর পুত্র সজীব জয়, যিনি তাঁর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা, ঘোষণা করে দিয়েছেন, নাস্তিকদের পাশে তাঁরা প্রকাশ্যে দাঁড়াবেন না। প্রশ্ন ওঠে, নাস্তিকরা তো দেশের নাগরিক, তাদের পাশে দাঁড়াবেন না তো কাদের পাশে দাঁড়াবেন? উত্তর খুব সহজ। দাঁড়াবেন আস্তিকের পাশে। ভাবছিলাম, নাস্তিক শব্দটি এত ঘৃণিত শব্দ হলো কবে থেকে? সবাই নাস্তিক থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে চায়। এমনকী যে সরকারের দায়িত্ব, ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ ভাষা অঞ্চল বিশ্বাস নির্বিশেষে সব মানুষকে সমান ভাবা, সেই সরকারও পক্ষপাতিত্ব করছে।
নির্যাতিত সংখ্যালঘু যুক্তিবাদীদের পাশে দাঁড়াবেন না সরকার। বিনা দোষে তাদের হত্যা করা হলেও তিনি বলবেন না যে হত্যা করাটা অন্যায়। তিনি হত্যাকারীদের শাস্তির ব্যাপারে আগ্রহ দেখাবেন না। অন্য যে সব হত্যাকাণ্ড ঘটছে দেশে, যেমন, পেট্রোল বোমা মেরে যে মানুষগুলোকে মারা হল, সে নিয়ে হাসিনা তো দিব্যি বিবৃতি দিয়েছেন। এক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করবেন, আরেক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করবেন না। কী ভয়ংকর এই দেশ! নাস্তিকদের সঙ্গে কোনও ওঠা বসা আছে, সেটা প্রচার হোক, চান না হাসিনা। কারণ তাঁর ভয়, ধর্মান্ধদের ভোট যদি আবার এই ফাঁকে ফসকে যায়।
বাংলাদেশ সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কোনও ধর্ম থাকে না। বাংলাদেশের একটি ধর্ম আছে। যতদিন না রাষ্ট্রধর্মটি বিদেয় নিচ্ছে, যতদিন না নাস্তিক শব্দটি আস্তিক শব্দটির মতো একই রকম গ্রহণযোগ্য হচ্ছে, ততদিন বাংলাদেশকে সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা যায় না। বাংলাদেশে নাস্তিক শব্দটি গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মুক্তমনা শব্দটিও আজ গালি। দেশ কত দুর্ভাগা হলে বিজ্ঞানমনস্ক নাস্তিকদের আজ ঘৃণা করে দেশের জনগণ। বিজ্ঞান আর ধর্মের সংঘাত চিরকালের। তবে, বিজ্ঞানের জয় অবশ্যম্ভাবি। এর একটিই কারণ, বিজ্ঞান সত্য। সত্যকে মিথ্যের ছাই দিয়ে বেশিদিন গোপন করে রাখা যায় না। আজ যে প্রতিভাবান তরুণ মানববাদীদের খুন করা হচ্ছে বাংলাদেশে, দেশটাকে সুষ্ঠুভাবে গড়তে হলে, দেশটাকে ধর্মান্ধতা আর বর্বরতা মুক্ত করতে হলে এদের মতো মানুষেরই দরকার হবে এই দেশের। দরকার হবে আরও অনেক অভিজিতের, অনন্তর, রাজিবের, ওয়াশিকুরের। এ ছাড়া উপায় নেই।
শুনেছি লেখক-অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রধানমন্ত্রীর পুত্র যে নাস্তিকদের হত্যাকাণ্ডের প্রকাশ্যে নিন্দা করতে চাননি, সে বিষয়ে বলেছেন যে এসব মন্তব্য মৌলবাদীদের জন্য গ্রিন সিগন্যাল। জাফর ইকবাল কোনও ভুল কথা বলেননি। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাঁর বিরুদ্ধে সিলেট শহরে মিছিল শুরু করে দিয়েছে, মৌলবাদী দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে মিছিল করছে আওয়ামী লীগ। শুনেছি আওয়ামী নেতারা নাকি চট্টগ্রামেও মধ্যযুগীয় ১৩ দফা দেয়া হেফাজতের আমীর শফির কাছ থেকে নিয়মিত দোয়া নিতে যান। নতুন মেয়রও দোয়া নিয়ে এসেছেন। বিশ্বাস হয় না এসব কথা। এখনও আওয়ামী লীগকে মানুষ সেকুলার দল বলে ভাবে, এখনও বিশ্বাস করে মৌলবাদীর প্রতিপক্ষ হিসেবে একটি দলই আছে বাংলাদেশে। কিন্তু যা ঘটছে বাস্তবে, তা দেখলে মনে হয়, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাতে ইসলামি– এসব দলে মূলত কোনও পার্থক্য নেই।
আজকাল মাঝে মাঝেই আমার মনে হয়, দেশ নিয়ে আশা করার আর কিছু নেই। রাজনৈতিক দলগুলো দেশটাকে একটা ইসলামী মৌলবাদী আর সন্ত্রাসীর দেশ বানাবে। জনগণ চুপচাপ বসে বসে দেশের এই সর্বনাশ দেখবে। অবশ্য সবাই একে সর্বনাশ বলে ভাবছে না। যে হারে সমাজে ধর্মান্ধতা বাড়ছে, তাতে মনে হয়, বেশির ভাগ জনতাই দেশটাকে দারুল ইসলাম বানাতে চায়। যে বুদ্ধিজীবীরা বিজ্ঞানমনস্ক, ধর্মমুক্ত, মানববাদী, যাঁরা অন্যায় আর অরাজকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস দেখিয়েছেন, তাঁদের অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এক এক করে হত্যা করা হচ্ছে। এই বর্বর হত্যাকারীরা কখনও শাস্তি পাবে না। কারণ হত্যাকারীরা ধর্মব্যাবসায়ী রাজনীতিকদের ঘরের লোক। এই রাজনীতিকরা অন্ধে, ধর্মান্ধে, কূপমণ্ডুকে, কবন্ধে, অশিক্ষিতে, অসভ্যে, খুনীতে, ধর্যকে দেশটা ভরে রাখার স্বপ্ন দেখছে।
বাংলাদেশকে একসময় বিশ্বের মানুষ জানতো বছর বছর বন্যা হওয়ার দেশ হিসেবে। এখন জানছে মাসে মাসে নাস্তিক হতার দেশ হিসেবে। প্রথমটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়। দ্বিতীয়টি মানুষের তৈরি। বাংলাদেশের নতুন পরিচয়টি প্রথম পরিচয়ের থেকে ভয়ংকর। মানুষের ধর্মানুভূতিকে ব্যবহার করে ভোটে জেতার কৌশল বন্ধ না করলে এক এক করে আরও প্রতিভাবান মানুষের রক্তে ভাসবে রাজপথ। একসময় শেখ মুজিবুর রহমান ডাক দিয়েছিলেন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যারা বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করছিলো তাদের হাত থেকে দেশ বাঁচাতে, আজ সেই শেখ মুজিবুরের কন্যা শেখ হাসিনার ছায়াতলে বাস করছে সেই জঙ্গীসেনারা যারা দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যা করছে। শেখ মুজিব রুখে উঠেছিলেন। শেষ হাসিনা রুখে ওঠা দূরের কথা, তাদের বরং সাহারা দিচ্ছেন। সজীব জয়ও দিচ্ছে খুনীদের সাহারা। লজ্জা হয় না আর, বরং ভয় হয়।