2 of 3

জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রকে নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা

জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রকে নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা

আমার মনে হয় আমার ওপর যা ঘটছে তা বর্ণনা করলেই অনুমান করা যায় বাক স্বাধীনতার হাল এখন কী। যেদিন বাক স্বাধীনতার পক্ষে সুপ্রীম কোর্টের রায় ঘোষিত হল, বলা হলো বাক স্বাধীনতা বিরোধী আইন ৬৬এ আইটি অ্যাক্ট এখন থেকে বাতিল, সেদিনই ঘোষণা করা হলো নির্বাসিত ছবিটিকে দেওয়া হচ্ছে সেরা বাংলা ছবির সম্মান। নির্বাসিত ছবিটি বাক স্বাধীনতা নিয়ে। বাক স্বাধীনতার জয় হলো সেদিন। ধীরে ধীরে ঘনিয়ে এলো পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের দিন। একখানা আমন্ত্রণপত্র চূর্ণী আমার জন্য ব্যবস্থা করেছিল বলেই যেতে পেরেছিলাম। সে এক অভিজ্ঞতা বটে। বিজ্ঞান ভবনের বিশাল অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠান হলো। রাষ্ট্রপতির হাত থেকেই পুরস্কার নিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক এবং কলা কুশলী। এই ছবিটি কখনও যে সত্যি সত্যি আলোর মুখ দেখবে, ভাবিনি। কয়েক বছর আগে বাংলার স্বনামধন্য চিত্রপরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলীই আমাকে বলেছিল আমার বেড়ালকে নিয়ে ও একটা কমেডি বানাতে চায়। মাঝখানে চুক্তিপত্রে সই করার পরও দেখেছি সব থেমে আছে। আমি অবাক হইনি। কারণ আমার গল্প নিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি বানাতে চেয়েছে অনেকেই। চলচ্চিত্র-স্বত্ব কিনে নিয়ে যাওয়ার পরও কলকাতায় গিয়ে জানি না কোন অন্ধকারে তলিয়ে যায় সবাই। আসলে সরকার কাউকে আমার জীবন নিয়ে বা আমার লেখা কোনও গল্প নিয়ে ছবি করতে দিতে চায় না। আমার নামটা খুব ভয়ংকর। লেখকের নামের জায়গায় আমার নামটার বদলে অন্য নাম থাকলেই কোনও সমস্যা হতো না।

দুবছর আগে আকাশ টেলিভিশন সারা শহরে বিশাল করে বিজ্ঞাপন সেঁটে আমার নতুন মেগাসিরিয়াল দুঃসহবাসের প্রচার করলো, মেগাসিরিয়ালের গল্প কেউ তখনও জানে না, কারণ প্রচার তো হয়নি ওটা। কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী টিভি চ্যানেলে পুলিশ পাঠালেন মেগাসিরিয়াল বন্ধ করতে। কী কারণে বন্ধ করতে হবে? হবে কারণ মুসলমানদের মনে আঘাত লাগবে এই মেগাসিরিয়াল দেখলে। তারা কী করে জানে যে আঘাত লাগবে? গল্পটাই তো কেউ জানে না এখনো! গল্পটা যে কী হবে তা অনুমান করতে পারছে ওরা। তিনটে হিন্দু বোনের গল্প শুনলে ওদের মনে আঘাত লাগবে কেন? লাগবে লাগবে। যে লেখক গল্প লিখেছে, তার নাম দেখলেই আঘাত লাগবে। সেটা বলুন। আকাশ৮ আপোসের চূড়ান্ত করেছে। মেগাসিরিয়াল পঞ্চাশ এপিসোড অবধি বানানো হয়ে গিয়েছিলো, সবগুলো এপিসোডের সিঁড়ি দিয়ে এলো এক দল মৌলবাদীকে। পাঁড় অশিক্ষিত কিছু লোক এলিয়ে কেলিয়ে সিরিয়াল দেখলো, যেন ভারতের সেন্সরবোর্ডের হোমড়াচোমড়া কোনও কর্মকর্তা ওরা। ওদের মধ্যেও এত অসততা ছিল না। ওরা দেখে বলে দিলো, না এমন কিছু নেই এতে, চ্যানেল চাইলে চালাতে পারে। মৌলবাদীরা অনুমোদন দিয়েছে, সুতরাং দেখানো চলবে। পরদিন প্রস্তুতি নেওয়া হয়ে গেছে মেগাসিরিয়ালের প্রচারের জন্য। এমন সময় পুলিশ এসে তছনছ করলো চ্যানেল অফিস, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর লিখিত নোটিশ নিয়ে এসেছে তারা। মুখ্যমন্ত্রী এই সিরিয়াল কিছুতেই প্রচার করতে দেবেন না। প্রচার করলে ওঁর লোকরা শাসিয়ে গেছে উনি দেখে নেবেন।

আমার নাম নিয়ে আপত্তি। ঝামেলা চুকে যেত যদি নামটা ওরা বদলে দিতো। আমি আকাশ কে বলেছিলাম নাম বদলে দিতে। ওরা রাজি হয়নি। যা বলছিলাম, যেদিন নির্বাসিত সেরা ছবির সম্মান পেলো, সেদিনই তৃণমূলের এক মুসলিম লোকসভা সদস্য বলে দিলো এই ছবি তারা পশ্চিমবঙ্গে দেখাতে দেবে না। লোকটা রাস্তার দাঙ্গাবাজ। মুসলিম সন্ত্রাসী। এরাই আজ সিদ্ধান্ত নেয় কে রাজ্যে থাকবে কে থাকবে না, রাজ্যের লোকরা কার বই পড়বে, কার বই পড়বে না, কার ছবি দেখবে, কার ছবি দেখবে না। রাজ্যের সরকার গুটিকয় মুসলিম সন্ত্রাসীর হাতে বন্দি। সরকার কিন্তু যেচে বন্দি হয়েছে। এরকম নয় যে তারা কোনও পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে। নির্বাসিত ছবিটা করা হয়েছে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। আমাকে নিয়ে এ ছবি, অথচ ছবিতে আমার নাম নেই। আমার যে সব গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম, সে সব এই ছবিতে দেখানো হয়নি। বলা হয়নি আমি ধর্ম নিয়ে কী বলেছি, দেখানো হয়নি আমি নারীর অধিকার নিয়ে কী লিখেছি। অত সতর্ক থেকে কার কী লাভ হয়েছে। সেই তো ছবি নিষিদ্ধ করার দাবি উঠছেই। দাবি উঠছে ছবিতে কী আছে না আছের জন্য নয়। ছবিটির সঙ্গে আমার নাম জড়ানো বলে। আমার নামটি কারও সহ্য হয় না।

পশ্চিমবঙ্গ আমাকে ব্রাত্য করেছে। শুধু সরকার নয়, সব রাজনৈতিক দল, সব সংগঠন, সব মিডিয়া। যে আনন্দবাজার আমাকে দুবার আনন্দ পুরস্কার দিয়েছে, সেই আনন্দবাজারের কাছে আমি আজ ব্রাত্য। পৃথিবীর কোথাও কোনও মানুষ দেশের সব সরকার এবং সব রাজনীতিক দ্বারা ব্রাত্য নয়, একঘরে নয়। আমি যা বলি তা কি এতই ভয়ংকর? নারীর সমানাধিকার ভয়ংকর? মানবাধিকার ভয়ংকর? মানববাদ ভয়ংকর? নাকি একটা ইসলাম-বিরোধী তকমা লাগিয়ে আজ যে আমাকে ভোটের জন্য ব্যবহার করছে রাজনীতিক দলগুলো, মুসলিম মৌলবাদীগুলো সেটা ভয়ংকর? যে আমাকে যত বেশি লাথি দিতে পারবে, যত জোরে চড় কষাতে পারবে, সে মুসলিম ভোট তত পাবে। এই অংক সবাই কষছে। প্রতিষ্ঠানগুলোও সরকারি সাহায্যে চলে। সংগঠনগুলোও। সুতরাং আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে যেই আসবে, তার মরণ হবে। এর চেয়ে ভয়ংকর আর কী ঘটনা থাকতে পারে!

আমার নামটা বদলে ফেললে চমৎকার হবে। বড় প্রকাশক আমার বই ছাপাবেন, পত্র পত্রিকাগুলোয় লেখা ছাপানো হবে। আমার গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ হবে, মেগাসিরিয়াল তৈরি হবে। আমার জীবন নিয়েও ছবি হবে, সে সব ছবিকে মুক্তি পেতে দেওয়া হবে না বলে কেউ হুমকি দেবে না। কিন্তু নাম বদলে ফেললে তো আমাকে মুখোশ পরতে হবে। আর মুখোশ পরতে তো আমি কিছুতেই পারবো না।

বাংলাদেশেও আমার নামটি নিষিদ্ধ একটি নাম। আমি কে, আমি কী, আমার লেখা বইপত্র কোনওদিন না পড়েও আমার নামটিকে ঘৃণা করতে শিখেছে মানুষ। এই ঘৃণা মস্তিষ্কের গভীরে ঢুকে গেছে। ধর্ম বিশ্বাস করতে হলে এদের যেমন কোনও যুক্তি বা প্রমাণের প্রয়োজন হয় না, আমাকে ঘৃণা করতে হলেও সেসবের কিছুর প্রয়োজন হয় না।

কলকাতা থেকে চেনা কয়েকজন বললো, নির্বাসিত চলচ্চিত্র পুরস্কার হয়তো পেয়েছে, কিন্তু কলকাতায় ওটা দেখাতে দেবে না। কে দেবে না জিজ্ঞেস করায়। বললো, মুখ্যমন্ত্রী দেবে না। নাকি মুসলিমরা দেবে না? মুসলিমদের কোনও ক্ষমতা নেই না দেওয়ার। মুখ্যমন্ত্রী নিষিদ্ধ করে মুসলিমদের বলবে তোমাদের অনুভূতিতে যেন এই ছবিটা আঘাত না দেয় সে কারণে নিষিদ্ধ করেছি। ভোটটা যেন নিশ্চিন্তে দেয় অনুভূতিকাতর লোকগুলো। একজন লেখকের কতটুকু করুণ অবস্থা দাঁড়ায় যখন তাকে নিষিদ্ধ করার রাজনীতিই প্রতিটি রাজনৈতিক দলের, প্রতিটি অরাজনৈতিক দলের, প্রতিটি সংস্থার, সংগঠনের, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের এজেণ্ডা! লেখক যাবে কোথায়? আমি যাবো কোথায়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *