দেশ ১
কলকাতার দেশ পত্রিকা একসময় ছিল সাহিত্যের পত্রিকা। এখন হয়ে গেছে গুজব, স্ক্যান্ডাল, কাকাতু, নাক সিঁটকানো, খোঁচা মারা, দলবাজি, পুরুষবাজি, মাস্তানি, শয়তানি, মিথ্যে আর অপবাদের পত্রিকা। আর এগুলোর জন্য বেছে নেওয়া হয় স্বয়ং আমাকে। কারণ আমার সম্পর্কে কুৎসা রটালে মার খাবার ভয় নেই, মামলায় ফেঁসে যাওয়ার ডর নেই। সাগরময় ঘোষ মারা যাওয়ার পর একসময় অমিতাভ চৌধুরী নামের এক চরিত্রহীন লোককে দেশ এর সম্পাদক করা হয়েছিল। ওই সম্পাদক আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য একবার ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে উন্মাদ হয়ে উঠলেন। কী, না, দেশ পত্রিকা আমার সাক্ষাৎকার ছাপাতে চান, সাক্ষাৎকারটা নেবেন সাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে আমার হোটেলে তিনি এক সকালে চলে এলেন। তাজ বেঙ্গলের লাউজে বসে ব্রেকফাস্ট করতে করতে কথা বলছিলাম। সাক্ষাৎকার চলাকালীন অমিতাভ চৌধুরী শ্যামলকে কনুইয়ের গুতো দিয়ে দিয়ে সেক্স নিয়ে প্রশ্ন করার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। সেক্স নিয়ে যে প্রশ্নই তাঁরা করছিলেন, আমি খুব নিস্পৃহ নির্লিপ্ত কণ্ঠে সেসবের উত্তর দিচ্ছিলাম। জীবনে কজনের সঙ্গে সেক্স করেছি– ওঁদের ওসব বিদঘুঁটে প্রশ্ন আমাকে লজ্জা দিচ্ছিল না, আমাকে বরং লজ্জা দিচ্ছিল আমার সামনে বসে থাকা ওই দুই বুড়োর জিভ বেরিয়ে আসা, চোখ বেরিয়ে আসা চেহারা। আমার সঙ্গে আমার ফরাসি প্রেমিক ছিল। ও বুঝতে পারছিল না আমরা কী নিয়ে কথা বলছি।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের নেওয়া অশ্লীল সাক্ষাৎকারটি অমিতাভ চৌধরী দেশ-এ ছাপিয়েছিলেন। যৌনতার বিষয় ছিল বলে ওটিকে অশ্লীল বলছি না। বরং যৌনতাকে অশ্লীল বলে বিচার করা হচ্ছিল বলে ওটিকে অশ্লীল বলছি। একজন নারী, যিনি নারীর স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, এমন কী যৌন স্বাধীনতায়ও, যে যৌন স্বাধীনতার অর্থ যত্র তত্র শুয়ে বেড়ানো নয়, বরং এক অর্থে যত্র তত্র শুয়ে না বেড়ানো, এবং যৌনসম্পর্কে হ্যাঁ বলার মতো না বলারও স্বাধীনতা–জেনেও তাকে লোকসমক্ষে একটা বিকট যৌন রাক্ষুসী রূপে দেখানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন দেশএর সম্পাদক। সাগরময় ঘোষের সঙ্গে রুচিতে যাঁর এক পাহাড় সমান ফারাক।
এরপর লোকটি ফের পরের বছর আমি কলকাতায় পৌঁছলেই উন্মাদ হয়ে উঠলেন। আমার সঙ্গে নাকি ভীষণ জরুরি কথা আছে। তাজ বেঙ্গলের এক বারে এক সন্ধ্যাবেলায় দেখা করতে চাইলেন। আমি কলকাতায় ওই হোটেলেই উঠেছিলাম। বারে গিয়ে দেখি তিনি হুইস্কি অর্ডার দিচ্ছেন দুজনের জন্য। না, আমি তো হুইস্কি খাবো না। তিনি পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। আমি বললাম, খেলে বড় জোর একটা কোক খাবো। শুনে তিনি চুপসে গেলেন। এরপর ইনিয়ে বিনিয়ে শুরু করলেন সেক্স প্রসঙ্গ। আমি প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য কথা বলি। দেশ টেশ নিয়ে। তিনি সেক্স ছাড়া আর কিছুতে উৎসাহী নয় বুঝে, গ্লাসের কোকটুকু খেয়ে আমার বাবা এসেছেন দেশ থেকে, তিনি রুমে একা আছেন বলে উঠে যাই। তিনি চুপসে বসে থাকেন। তিনি ভেবেছিলেন আমি যৌন স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, সুতরাং তিনি আমার সঙ্গে যৌনতা নিয়ে কথা বললে আমি মহা উৎসাহে শুনে যাবো। এই না শুনতে চাওয়াটা যে যৌন স্বাধীনতার মতোই আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সেটুকু বুঝতে ম্যাগসেসাই পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিকমশাই পারেননি।
এরপরই দেশ পত্রিকায় অমিতাভ চৌধুরী ছাপিয়েছিলেন আমার বিরুদ্ধে লেখা সমরেশ মজুমদারের কুৎসারচনা, যে কুৎসারচনায় আমার সম্পর্কে লেখা তাঁর প্রতিটি বর্ণ মিথ্যে। এই মজুমদারকে আজ থেকে চব্বিশ বছর আগে, যখন তাঁকে বেশি লোকে চেনে না, আমার প্রকাশকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। ওঁর বই ছাপানোর জন্য অনুরোধ করেছিলাম। বাংলাদেশে আমি তখন জনপ্রিয় লেখক, আমার অনুরোধ রেখেছিলেন প্রকাশকরা। উপকারীর উপকার স্বীকার না করে মজুমদার আমার কুৎসা রটিয়েছিলেন, যে মিথ্যে বা কুৎসা অমিতাভ চৌধুরী অত্যন্ত যত্ন নিয়ে ছাপিয়েছিলেন, ২০০০ সালের ১০ জুন তারিখে। ওই সময়টায় কলকাতাও আমাকে ভীষণ ভালোবাসছে। অনেক বছর পর ভারতের ভিসা পেয়ে ইউরোপ থেকে কলকাতায় ছুটে গিয়েছি। কলকাতা বইমেলায় আমাকে দেখার জন্য, আমার অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য ভিড় উপচে পড়ছে। পুলিশকে লাঠিচার্য করতে হচ্ছে ভিড় সামাল দিতে। এসব দৃশ্য কলকাতার অনেক লেখকদের বড় পীড়া দিয়েছিল। মজুমদার সেই লেখকদের মধ্যে একজন। তাছাড়াও বাংলাদেশে তিনি দ্রুত জনপ্রিয় হতে চেয়েছিলেন, যত বই বিক্রি হচ্ছে, চাইছিলেন তার চেয়েও বেশি বিক্রি হোক। তিনি টের পেয়েছিলেন, বাংলাদেশের নারীবিরোধী মুসলিম সমাজ তসলিমবিদ্বেষী আর দেশ পত্রিকা বাংলাদেশের লোকরাও পড়ে সুতরাং এই পত্রিকাটিতে তিনি যদি আমার কুৎসা রটান, তবে পশ্চিমবঙ্গে আমার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়বে, বাংলাদেশে আমার নিন্দুক হিসেবে তাঁর সমাদরও বেশ হবে।
এরপর জানি না আর কোন কোন নিবন্ধ প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল আমার চরিত্র হনন করে। তবে কিছু না ছাপা হলেও ঈর্ষান্বিত তসলিমবিদ্বেষী লেখককুল দেশ পত্রিকায় তসলিমার লেখা বন্ধ করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে তসলিমার বই বেরোলে ইভেন নট এ সিঙ্গল ওয়ার্ড সে বই নিয়ে, এই কর্তব্যটি দেশ পত্রিকা সুষ্ঠুভাবে অনেকগুলো বছর পালন করে গেছে। আমাকে পাঠকের মন থেকে ভুলিয়ে দিতে চাইছে, ভালো কথা, তবে আমাকে কেন নিজেরাই তোমরা ভুলতে পারছে না হে? এই সেদিন, ১৭ ফেব্রুয়ারিতে, আমার বিরুদ্ধে বাদল বসুর করা এক গাদা কুৎসা ছাপিয়েছে। তারপর ১৭ মার্চে আবারও ছাপিয়েছো মিথ্যে-নির্ভর কুৎসা। দেশ এর এমনই মন্দা চলছে যে ছোটলোকদের দিয়ে গুজব লিখিয়ে তা বিক্রি করতে হয়? কলকাতার পাঁড় মাতালরা অন্য একজনকে মাতাল বলে গালি দিচ্ছে, বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পত্রিকায় তা অত্যন্ত গুরুত্বসহ ছাপা হচ্ছে। আমি কবে মদ খেয়েছি, কবে মদ খেয়ে মাতাল হয়েছি, রাত কটার সময় ঘরে ফিরেছি, ভেতর থেকে কে আমাকে গালি দিয়েছে — এসব লিখে নারীবিদ্বেষী ছোটলোকেরা এক নারীবাদী লেখককে চাইছেন যেন পাঠকসমাজে সে তার সম্মান হারায়।
মজুমদার আর বসু নিচুমনের নিচুমানের লোক। কিন্তু দেশ কেন এত নিচে নামলো?