চূর্ণী গাঙ্গুলী
চূর্ণী গাঙ্গুলীর নির্বাসিত আমার জীবনের কোনও এক সময়ের কোনও এক ঘটনা অবলম্বনে তৈরি। চূর্ণীর প্রথম ছবি এটি। চূর্ণী মূলত অভিনেত্রী। অসাধারণ অভিনয় করেন। কৌশিক গাঙ্গুলীর ছবিতে প্রচুর করেছেন অভিনয়। এমন প্রতিভাময়ী ব্যক্তিত্ব ঠিক ঠিকই আমার ওপর একটা ছবি বানিয়ে ফেললেন, যখন অন্য অনেকে বানাচ্ছি বানাচ্ছি করেও আজ অবধি কিছুই বানাতে পারেননি। এ অবধি কম লোকতো পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অনুমতিপত্রে সই নিয়ে যান নি! কিন্তু কেউ এখনও শুরুই করতে পারেননি কোনও ছবি। না আমাকে নিয়ে, না আমার গল্প নিয়ে।
ব্যাগ ফিল্মস নামের একটা কোম্পানি আমার ফরাসি প্রেমিক উপন্যাসটির চলচ্চিত্র স্বত্ব কিনেছে প্রায় দশ বছর আগে। দশ বছর ব্যাগ ফিল্মস আর যোগাযোগ করেনি। ভারতের বিখ্যাত মুভি কোম্পানি ইউটিভিও আমার আত্মজীবনীভিত্তিক ছবি করতে চেয়েছে। কেউ একজন চিত্রনাট্য লেখার কাজও শুরু করেছিল। পরে ওদেরও আর কোনও খবর নেই।
বোম্বের নামী পরিচালক মহেশ ভাট দুহাজার সালে ঘোষণা দিয়েছিলেন আমার জীবন নিয়ে ছবি বানাবেন। তিনিও তাঁর ওই ইচ্ছে থেকে কবেই একদিন আলগোছে। নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। এখনও আমার কাছে পড়ে আছে নিমন্ত্রণ আর ফেরার চলচ্চিত্র স্বত্ব বিক্রির টাকা। সৌরভ দে, প্রেমাংশু রায়রা চিত্রনাট্য লিখে কাস্টিংও ঠিক করে ফেলেছিলেন। সৌরভ তো বোম্বে থেকে নিয়ে এসেছিলেন নায়ক, নায়িকাকে নিয়ে মহড়াও শুরু করেছিলেন। কাপে প্লেটে নিমন্ত্রণ লিখে বিলিয়েছিলেন। প্রেমাংশু তো রুনা লায়লাকে দিয়ে গানও পর্যন্ত রেকর্ড করিয়ে নিয়েছিলেন। লোকেশন দেখতে গিয়েও টাকা খরচ হয়েছে। এত টাকা খরচ করেও প্রযোজক ছবি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর কারণ তসলিমা।
আমার নামটাকে নিয়ে ভীষণ ভয় সবার। শুনেছি কিছু বদলোক আমার নাম গন্ধ আছে এমন কিছু নিয়ে ছবি করা, সাফ সাফ বলে দিয়েছে, আর যেখানেই সম্ভব হোক, বাংলায় হবে না। সব রাজনৈতিক দলের অবস্থানই, দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমার বিরুদ্ধে। যুদ্ধটা, সবাই ধরেই নিয়েছে যে, আমার আর মুসলিম মৌলবাদীদের মধ্যে। সবাই খুব হিসেবে করেই মুসলিম মৌলবাদীর পক্ষ নিচ্ছে।
পক্ষ নেওয়ার আরেকটা পদ্ধতি হলো তসলিমার ক্ষতি করা, ক্ষতি করা সম্ভব না হলে নিদেনপক্ষে বিরোধিতা করা। পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা নিশ্চয়ই জানে বছর দুয়েক আগে তাদের মুখ্যমন্ত্রী কী করে টেলিভিশনের আকাশ আট চ্যানেলে হতে যাওয়া আমার মেগা সিরিয়াল দুঃসহবাসের প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে। কলকাতার রাস্তায়। বিশাল বিশাল বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং টাঙানো হয়েছিল, টিভিতে আমার মেগা সিরিয়াল, সত্যি বলতে কী, খুব ঘটা করেই আসছিল। চ্যানেলে ঘন ঘন বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে দুঃসহবাসের। স্কাইপের মাধ্যমে সাংবাদিক সম্মেলনও একদিন করতে হলো। কিন্তু যেদিন শুরু হবে আমার মেগা সিরিয়াল, তার দুদিন আগে, বলা নেই কওয়া নেই, পুলিশ এসে টিভি চ্যানেলকে হুমকি দিলেন, দুঃসহবাস দেখানো চলবে না। পঞ্চাশ এপিসোড় সুটিং হয়ে গেছে, আর কিনা সিরিয়াল দেখানো চলবে না। আমার বেলায় কেন চলবে নার উত্তর সব সরকারের জিভের ডগায়, চলবে না কারণ মুসলিম মৌলবাদিরা রায়ট লাগাবে, দাঙ্গা বাধাবে। আমার বই নিষিদ্ধ করার বেলায় মমতা ব্যানার্জীর আগে যিনি মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন পশ্চিমবঙ্গে, একই যুক্তি দিয়েছিলেন।
মুসলিম মৌলবাদিদের আবার ভারতের হিন্দুরাবিশেষ করে বাঙালি হিন্দুরা যমের মতো ভয় পায়। কলকাতার মানুষ জানে, কলকাতা বইমেলার এসি অডিটোরিয়ামে আমার নির্বাসন নামের বইটির উদ্বোধন অনুষ্ঠানটি বাতিল করে দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জী। তাছাড়া মানুষ তো দেখেছেই কী করে কলকাতা থেকে আমাকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। কী করে আমাকে হেনস্থা করা হয়েছে বছরের পর বছর। কী করে দৈনিক স্টেটসম্যান আমার নিয়মিত কলাম ছাপানো বন্ধ করে দিল। কী করে ঋতুপর্ণ ঘোষও বাধ্য হয়েছিলেন রোববার ম্যাগাজিনে আমার লেখা নিয়মিত ছাপা হবে ঘোষণা দেওয়ার পরও লেখা ছাপা বন্ধ করে দিতে।
এইসব দেখার পর কার সাহস হয় আমার ছিটেফোঁটা নিয়ে বা আমার গল্পের বিন্দুমাত্র কিছু নিয়ে ছবি করার! কারোর হয়নি। কেউ কেউ ভুল করে এ পথে পা বাড়িয়েও ভুল বুঝতে পেরে সরে গেছে। মানুষ দেখেছে কী করে পুরো পশ্চিমবঙ্গে আমাকে ব্ল্যাকআউট করে দেওয়া হয়েছে। এই অর্জন কি চাট্টিখানি অর্জন? সমাজের সকল স্তরের সকল শ্রেণীর সকল দলের ভয় এবং ঘৃণা, অবজ্ঞা আর অসম্মান অর্জন করা কি আদৌ সহজ? নিশ্চয়ই আমি কোনও কঠিন সত্য কথা বলেছি।
এমন যখন অবস্থা, তখন বাংলার প্রতিভাবান চলচ্চিত্র পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলী চাইলেন কলকাতা থেকে আমাকে বের করে দেওয়ার ঘটনা নিয়ে একটা কমেড়ি বানাতে। মুখ্য চরিত্রে থাকবে আমার বেড়াল। কৌশিক একদিন তাঁর লেখা স্ক্রিপ্টও আমাকে পাঠিয়ে দিলেন। কৌশিককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কৌতুকের আশ্রয় না নিয়ে সরাসরি বললে ভালো হতো না? কৌশিকের বক্তব্য, কৌতুকের মাধ্যমে বললে বেঁধে ভালো। চার্লি চ্যাপলিনের ছবিগুলো মনে ভাসলো। প্রযোজক জুটে গেছে, সুতরাং কৌশিক একদিন কলকাতা থেকে দিল্লি চলে এলেন আমার কাছ থেকে ছবি করার লিখিত অনুমতি নিতে। ছিলেন দুদিন। বেশ আড্ডা হলো।
কৌশিক খুব ভালো ছবি করেন, প্রতিটি ছবির জন্য কোনও না কোনও পুরস্কার পাচ্ছেন, এরকমই জানে লোকে। যেটা জানে না সেটা হলো কৌশিক মানুষটা অসাধারণ, তাঁর রসবোধের কোনও তুলনা হয় না। কলকাতার পত্র পত্রিকায় কৌশিকের নির্বাসিত নিয়ে বড় বড় খবর ছাপা হলো। আমার পোষা বেড়াল মিনুর ছবিখানাও বেশ চমৎকার ছাপা হতে লাগলো ওইসব খবরের সঙ্গে। কৌশিক জানালো বেড়ালের অডিশন চলছে। বেড়ালের মায়েরা ভিড় করছে বেড়াল নিয়ে। ছবির শুটিং সামনের মাসেই শুরু হবে। কিন্তু সামনের মাসে স্তব্ধতার ঝড় বইতে শুরু করলো।
একদিন পত্রিকায় দেখলাম কৌশিক তাঁর নতুন ছবি শব্দর শুটিং করছেন। কৌশিক বলেছিলেন তাঁর প্রযোজক শব্দ আর নির্বাসিতর গল্প শুনে নির্বাসিতকেই বেছে নিয়েছেন। বুঝি যে সেই বেছে নেওয়াটা শেষ বেছে নেওয়া নয়। শেষ পর্যন্ত নির্বাসিতকে ছুঁড়ে ফেলে শব্দকেই নির্বাচন করেছেন প্রযোজক। গণ্ডগোলটা তাহলে আমাকে নিয়েই।
কৌশিকের কাছে আমি আর জানতে চাইনি কী ঘটেছে। মনে মনে তো জানিই কী ঘটতে পারে। মাসের পর মাস চলে গেলো। কৌশিক এক ছবি করে আরেক ছবিতে হাত দিচ্ছেন, নির্বাসিত ওদিকে কবরে, অন্ধকারে, একা। অনুমান করি, অন্য পরিচালকেরা যেমন কোনও ছবি, শেষ করা তো দূরের কথা, শুরুই করতে পারেননি। কৌশিকও পারবেন না। কৌশিকের সঙ্গে মাঝে মাঝে তাঁর অন্য ছবি টবি নিয়ে কথা হয়। নির্বাসিতর কথা তুলি না। তুলে ওকে অপ্রস্তুত করি না।
এমন সময় হঠাৎ একদিন অভিনেত্রী চূর্ণী গাঙ্গুলী, কৌশিকেরই স্ত্রী, আমাকে জানালেন নির্বাসিতটা কৌশিক নয়, উনি করবেন। চূর্ণী নতুন করে স্ক্রিপ্ট লিখছেন। প্রযোজক পেয়ে গেছেন। চূর্ণী আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন দিল্লিতে। কয়েকদিন কাটালেন আমার আর আমার বেড়ালের সঙ্গে। কলকাতায় ফিরে গিয়ে শুটিং শুরু করলেন। সবকিছুই অপ্রত্যাশিত। তবে ছবিটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি নিশ্চিত নই ছবিটা শেষ হতে আদৌ পারবে কিনা। শত সহস্র উপদ্রব ওত পেতে আছে। সে কী এতদিনেও বুঝিনি!
ছবিতে আমার জীবন সংগ্রাম, আমার ওপর রাজনৈতিক অত্যাচার, আমার লেখালেখি, আমার আদর্শ বিশ্বাস, খুব স্পষ্ট করে দেখানো হয়নি, যা হয়েছে দেখানো তা হলো আমার সঙ্গে আমার বেড়ালের বিচ্ছেদ। মায়ের সঙ্গে কন্যার বিচ্ছেদ। বেড়াল আমাকে চাইছে, আমি বেড়ালকে চাইছি। চূর্ণী এভাবেই প্রতিবাদ করেছেন আমাকে দেশ থেকে, রাজ্য থেকে বিতাড়িত করে যে অন্যায় করা হয়েছে তার। এভাবেই উনি প্রকাশ করেছেন মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে ওর মত। অন্যভাবে হলে, উচ্চকণ্ঠ হলে হয়তো ছবিটা ছাড়পত্রই পেতো না। তাই খুব বেশি ঝুঁকি না নিয়ে তৈরি করেছেন ছবি।
ছবিটি শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ হয়েছে বলে, সেন্সরবোর্ডের অনুমতি পেয়েছে বলে আমি খুশি। চূর্ণী হয়তো আশংকা করছিলেন সেন্সর বোর্ড ছবিটাকে আটকে দেবে। মমতার পুলিশ বাহিনী কলকাতার টিভি চ্যানেলে গিয়ে সিরিয়াল প্রচার বন্ধ করতে পারে, সেন্সর বোর্ডকে হুমকি দিয়ে ছবি বন্ধ করার কৌশল এখনও বোধহয় রপ্ত করেনি। আমি খুশি ছবিটি বোম্বে, গোয়া আর দিল্লির ফিল্ম ফেস্টিভেলে দেখানো হয়েছে বলে, আমি খুশি দিল্লির ফিল্ম ফেস্টিভেল থেকে ছবিটি বেস্ট ফিল্ম এর পুরস্কার পেয়েছে বলে। আমি খুশি ছবিটি কলকাতায় নির্বিঘ্নে মুক্তি পেয়েছে বলে। আমি খুশি দিল্লি বোম্বে ব্যাঙালোর পুনে এসব বড় বড় শহরে নির্বাসিত দেখানো হয়েছে বলে। বাক স্বাধীনতা লংঘনের বিরুদ্ধে সামান্য হলেও, খুব শান্তকণ্ঠে হলেও, নির্বাসিত নামের একটি প্রতিবাদ হয়েছে বলে, আমি খুশি নিষিদ্ধ একটি মানুষের কথা ছবিটিতে বলা হয়েছে বলে। বাক স্বাধীনতার পক্ষে তিন যুগ লড়ছি। নির্বাসিতর গল্প আমার গল্প না হয়ে অন্য কারো গল্প হলেও আমি একইরকম পাশে দাঁড়াতাম। একইরকম বাহবা দিতাম। নির্বাসিত সম্ভবত এ বছরের মে মাসের দিকে ভারতবর্ষে মুক্তি পাবে। এ ছবি কেউ দেখুক না দেখুক, এ ছবি ফ্লপ হোক, এ ছবি এই সময়ের মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী এক লেখকের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নির্যাতনের প্রতিবাদ। মুখ বুজে থাকা আপোসকামী মানুষের ভিড়ে চূর্ণী অনেকটা দেবীর মতো। আহ দেবীতে তো আমার বিশ্বাস নেই। তবে কি সুপারহিরোর মতো? সুপারহিরোতেও তো বিশ্বাস নেই। তাহলে কী? সত্যিকার মানুষের মতো! মনে হয় মহিয়ষীর মতো।