2 of 3

ইহা বোমা নহে

ইহা বোমা নহে

আহমদ মোহাম্মদ রাতারাতি সেলেব্রিটি হয়ে উঠেছে। সারা বিশ্ব থেকে ১৪ বছর বয়সী আহমদের জন্য পাঠানো হচ্ছে সহানুভূতি, সমর্থন, অভিনন্দন, আর অগাধ ভালোবাসা। এর কারণ নিশ্চয়ই মানুষের অপরাধবোধ। আহমদ যা নয়, তাকে তাই ভাবা হয়েছিল, সন্ত্রাসী নয়, কিন্তু সন্ত্রাসী ভাবা হয়েছিল, সে কারণেই অপরাধবোধ। ঘড়ি বানিয়েছিল, যেটিকে বোমা ভেবেছে তার শিক্ষক, পুলিশ ডেকেছে, পুলিশ এসে হাতকড়া পরিয়ে ছেলেটিকে থানায় নিয়ে গেছে, একটি নিরপরাধ কিশোরের বিরুদ্ধে অন্যায় আচরণ করা হয়েছে,– অপরাধবোধ সে কারণে। থানা থেকে জিজ্ঞাসাবাদের পর আহমদকে ছেড়েও দেওয়া হয়েছে, তারপরও মানুষের অপরাধবোধ কমেনি। উদারপন্থীরা ভাবছেন, যদিও মুসলমানদের বেশির ভাগ লোকই ভালো লোক, তারপরও গোটা মুসলমান সম্প্রদায়কে মানুষ ভয় পায়, সন্দেহের চোখে দেখে, সন্ত্রাসী বলে মনে করে। এ কারণেই একটা অস্বস্তির কাঁটা বিঁধে রয়েছে উদারপন্থীদের মনে। এ কথা তো সত্য, মুসলমানদের মধ্যে কেউ কেউ সন্ত্রাসী, সকলেই নয়। ঠিক যেমন ক্রিশ্চানদের মধ্যে, ইহুদিদের মধ্যে, হিন্দুদের মধ্যে কেউ কেউ সন্ত্রাসী, সকলেই নয়। এই সত্যটা সবারই জানা নেই, তাই উদারপন্থীদের লজ্জা, তাই অপরাধবোধ।

কত কত নিরপরাধ মানুষকে অন্যায়ভাবে হাতকড়া পরানো হচ্ছে প্রতিদিন,জেলবন্দি করা হচ্ছে,যাবজ্জীবন দেওয়া হচ্ছে। আমরা কজনকে সেলেব্রিটি বানাই! কিন্তু থানায় নিয়ে কিছুক্ষণ রাখার কারণেই নিরপরাধ আহমদ মোহাম্মদকে আমরা সেলেব্রিটি বানিয়েছি। থানায় নিয়ে কত কালো বাদামী লোককেই তো রাখা হয়, কিন্তু তারা তো সেলেব্রিটি হয় না, আহমদ মোহাম্মদ কেন সেলেব্রিটি হয়? তার কারণ আহমদ মুসলিম ছেলে। আহমদ যদি ক্রিশ্চান হতো, অথবা ইহুদি হতো অথবা হিন্দু হতো তাহলে কি সারা পৃথিবীর ভালো মানুষগুলো আমেরিকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এত প্রতিবাদ করতো, বা আহমদকে এত সমর্থন করতো? আমার কিন্তু মনে হয় না। আহমদ মুসলিম বলেই করেছে।

ইসলাম কিন্তু কোনও বর্ণ নয় বা রেস নয়। মুসলিমরা সাদা হলুদ বাদামি কালো যে কোনও বর্ণের হতে পারে। যে কোনও জাতিই তারা হতে পারে। ইসলাম কেবলই এক ধর্ম। খ্রিস্টান ধর্ম যেমন এর উৎপত্তিস্থল থেকে ভ্রমণ করেছে নানা অঞ্চলে, ইসলামও তেমন। আহমদকে যারা অপছন্দ করে বা ভয় পায়, তাদের বর্ণবাদী বলার চেয়ে মুসলিম-ভীতু বলাটাই হয়তো ঠিক। (মুসলিম বিদ্বেষী বলার চেয়ে মুসলিমদের যারা ভয় পায় তাদের মুসলিম ভীতু বললাম, ইংরেজিতে মুসলিমফোবিয়াও বলতে পারি। ইংরেজিতে একটি শব্দ খুব প্রচলিত, ইসলামোফোবিয়া। এই শব্দটিতে ভয়ের চেয়ে ঘৃণার ইঙ্গিতই বেশি দেওয়া হয়। ইস্কুল শিক্ষক এবং পুলিশ যারা আহমদকে হেনস্থা করেছে তারা মুসলিমদের নিয়ে তাদের ভয় থেকে করেছে, বর্ণবাদ থেকে নয়।

সাদা বর্ণবাদীরা সম্ভবত অনেকেই মুসলিম বিদ্বেষী।কিন্তু কেন তারা হিন্দু বিদ্বেষী, বৌদ্ধ বিদ্বেষী, জৈন বিদ্বেষী, শিখ বিদ্বেষী না হয়ে মুসলিম বিদ্বেষী? এর কি কোনও কারণ আছে নাকি একেবারেই নেই? আমরা কি বলতে পারবো, যে তারা এমনি এমনি মুসলিম বিদ্বেষী হয়ে গেছে? কিছু কি কারণ নেই এর পেছনে? খুব বেশি দিন তো হয়নি টুইন টাওয়ার উড়ে গেলো চোখের সামনে, খুব বেশিদিনও হয়নি দুটো কচি ছেলে ব্যাগে প্রেসারকুকার-বোমা নিয়ে বস্টন ম্যারাথনের ভিড়ের মধ্যে ফোঁটালো, কিছু মানুষ মারা গেল, কিছু হাত-পা হারালো। ইদানীং খবরে প্রায় প্রতিদিনই শুনছি আইসিস বা ইসলামিক স্টেট মানুষকে জবাই করছে, শত শত মানুষকে নীল ডাউন করিয়ে মাথায় গুলি করছে। শিশু আর কিশোরীদের অপহরণ করছে, ধর্ষণ করছে। দেখছি ইসলামের নামে বোকো হারাম কী করে মানুষ মারছে, আর মেয়েদের ধর্ষণ করছে, বাজারে বিক্রি করছে। আল-শাবাব কী করে গুলি চালাচ্ছে, অবলীলায় শত শত মানুষ মারছে। বর্বরতা, নৃশংসতা, ভয়াবহতা এরা ইসলামের নামেই করছে। ইজরাইলের রাস্তাঘাটে, বাসে ট্রেনে গায়ে বোমা বাঁধা মুসলমানরা কিছু ইহুদি মারবে বলে নিজেকে উড়িয়ে দিতেও দ্বিধা করেনি। ডেনিস কার্টুনের কারণে দেশে দেশে আগুন জ্বালিয়েছে মুসলমান জঙ্গীরা। ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছে এই অভিযোগ করে ক্রিস্টানদের ফাঁসাচ্ছে পাকিস্তানী মুসলিমরা। ইসলামের সমালোচনা করেছে এই অজুহাতে বাংলাদেশের ব্লগারদের কুপিয়ে মারছে মুসলমান মৌলবাদীরা। এইসব খবর কারও অজানা নয়। সে কারণে তারা সম্ভবত মুসলমানদের ভয় পায়, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে। এ কী স্বাভাবিক নয়? এ কারণেই হয়ত এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি একটু ভালোভাবেই চেক করে মুসলমান নামের মানুষদের। এ কারণেই হয়তো মুসলমান নামের মানুষদের হাতে ঘড়ি অথচ ঘড়ির মতো দেখতে নয় কিছু একটা দেখলে পুলিশ ডাকে। আমেরিকার বাচ্চারা বন্দুক হাতে নিয়ে ইস্কুলে ঢুকে মানুষ মারে। বহুবার এরকম ঘটনা ঘটেছে। আমি নিশ্চিত, টেক্সাসের ওই ইস্কুলেও যদি আমেরিকার কোনও সাদা ছাত্র খেলনা রাইফেল বা খেলনা পিস্তল নিয়ে ঢুকতো, সবাই তটস্থ হয়ে পিস্তলটি সত্যিকারের পিস্তল কি না তা যাচাই করতে পুলিশ ডাকতো। কারণ এ রকম ঘটনা ঘটেছে আগে।

 মুসলিমদের সন্দেহ করা যাবে না, এ কেমন কথা? মুসলিমদের সন্দেহ করলেই বা ইসলামের সমালোচনাকরলেই, নতুন একটা গালি বানানো হয়েছে, ইসলামোফোবিয়া, সেটি তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়। এই গালির ভয়ে মানুষ মুখ বুজে থাকে। আমি মনে করি, ইসলামোফোবিয়া শব্দটি বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অত্যন্ত অশ্লীল একটি শব্দ। এই শব্দটি যত দ্রুত বিলুপ্ত হবে, তত ভালো। এই শব্দটিকে অক্ষত রেখে বাক স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন চালানো সম্ভব নয়। ইহুদিদের বাইহুদিদের ধর্মের বিরুদ্ধে কোনও সমালোচনা করলেই এন্টি-সেমেটিক বলে গালি দেওয়া হয়, এই গালিও বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে একটি গালি। এটিরও বিলুপ্তি প্রয়োজন। নিরাপত্তার কারণে সব ধর্মের, সব জাতের, সব ভাষার, সব রঙের মানুষদের ব্যাপারেই সতর্ক থাকতে হবে। তবে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে একটু বেশি সতর্ক থাকা উচিত। ব্যক্তিগতভাবে একজন মুসলমান সর্বগুণে গুণান্বিত হতে পারে, কিন্তু সে কথা তো বাইরের সবার জানার কথা নয়, সমষ্টিগতভাবে মগজধোলাই হচ্ছে কিনা তার খবর সবার তো জানা নেই। যেমন জানা ছিল না ফুটফুটে দুই জারনায়েভ ভাই ভেতরে ভেতরে মগজধোলাই হয়েছে। ব্যাকপ্যাকে যদি প্রেসারকুকার বোমা থাকতে পারে, পেন্সিল বাক্সে ঘড়ি-বোমা থাকতে পারে, এ যে কেউ ভাবতে পারে। আমি ওদের ভাবনাটার মধ্যে কোনও দোষ দেখি না। সবাইকে আমরা সমানভাবে বিশ্বাস করি না, করা উচিত নয় বলেই করি না। আমাদের চিন্তাশক্তি, বুদ্ধি বিবেচনা যুক্তি খাঁটিয়ে আমরা মানুষকে বিচার করি, কারও ওপর আস্থা রাখি, কারও ওপর রাখি না।

আহমদ মোহাম্মদকে ওবামা ডেকেছেন, সমর্থন জানিয়েছেন বাঘা বাঘা সব লোক। আহমদ কতটা বুদ্ধিমান জানি না। ও বড় হয়ে কত বড় বিজ্ঞানী হবে তা জানি না, তবে শুনেছি ও ঘড়ির বিভিন্ন পার্টস কিনে এনে জোড়া দিয়েছে মাত্র। তবে যা কিছুই করুক, যেভাবেই যা বানাক, তাকে আমি ধন্যবাদ দিই সে যে বোমা না বানিয়ে। ঘড়ি বানানোর চেষ্টা করেছে। আমেরিকার অনেক মুসলিম কিশোরই আইসিসে যোগ দিয়েছে, ইরাকে আর সিরিয়ায় গিয়ে জঙ্গীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে মানুষ মারছে। অনেক শিশু-কিশোরকে জঙ্গীরা খুন করতে শেখাচ্ছে। অনেকে জঙ্গীদের আকারে ইঙ্গিতে অথবা প্রকাশ্যে সমর্থনও করছে। আইসিসের পোশাক না পরে আহমদ নাসার টিশার্ট পরেছে, সে কারণে কৃতজ্ঞতা জানাই তাকে। আমরা আহমদকে উৎসাহ দেবো যেন সে বিজ্ঞানমনস্ক হয়, শিক্ষিত হয়, সচেতন হয়। কিন্তু অনুগ্রহ করে কেন আহমদকে সন্দেহ করা হলো, সে মুসলমান বলেই সন্দেহ করা হলো, সাদারা সবাই রেসিস্ট, আমেরিকানরা মুসলিম-বিদ্বেষী বলে ন্যাকামো না করাই ভালো। মুসলমানকে কেন সন্ত্রাসী বলে সন্দেহ করা হয়, তা না জানলে জেনে নিন মুসলমানদের সন্ত্রাসের ইতিহাস। গর্ত খুঁড়ে পুরোনো কাহিনী বের করতে হবে না। যা ঘটছে চারদিকে এখন, তা জানলেই যথেষ্ট।

সন্ত্রাসী যে কোনও ধর্মের, যে কোনও বর্ণের মানুষই হতে পারে। তবে ধর্মের নামে হলেই গোটা ধর্মীয় গোষ্ঠীর ওপরও সন্দেহের চোখ পড়ে। এ আমাদের বুঝতে হবে এবং এই সন্দেহ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে মুসলিমদের উচিত ধর্মের নামে যারা জিহাদ করছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, নিজেদের ধর্মান্ধতা থেকে মুক্ত করা, বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত করা। মুসলিম জঙ্গিরা মুসলিমদের যতটা ক্ষতি করেছে, ততটা ক্ষতি অন্য কোনও শ এ যাবৎ করেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *