ভিন্নমতের নিরাপত্তা নেই, বাংলাদেশ কি আদৌ কোনও ডেমোক্রেসিং?
১.
আহমেদ রাজিব হায়দার (থাবা বাবা)
অভিজিৎ রায়
অনন্ত বিজয় দাশ
ওয়াশিকুর রহমান বাবু
জগৎজ্যোতি তালুকদার
আশরাফুল আলম
নিয়াজ মোর্শেদ বাবু
আরিফ রায়হান দ্বীপ
নীলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় (নিলয় নীল)
এরপর কে? আমরা জানি না এরপর কে। অনেক ব্লগার দেশ ছেড়েছে। যারা আছে দেশে, তাদের কুপিয়ে মেরে ফেলা হবে। ধর্মে অবিশ্বাস, এমন কারও অস্তিত্ব বাংলাদেশে রাখা হবে না।
বাংলাদেশ কোনও নাস্তিককে নিরাপত্তা দেবে না। হাসিনা ভয় পাচ্ছেন, নাস্তিকদের নিরাপত্তা দিলে তাঁকে না আবার নাস্তিক বলে ভাবা হয়। নাস্তিক বলে ভাবলে তাঁর তো আবার মুসলমানের ভোট জুটবে না। শেখ হাসিনা কি নাস্তিক নন? নাস্তিক তো আসলে প্রায় সবাই। তুমি যদি হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস না করো, তুমি একজন অবিশ্বাসী। তুমি খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাস না করো, তুমি একজন অবিশ্বাসী। যদি ইহুদি ধর্মে বিশ্বাস না করো, মরমন ধর্মে, জিহোবাজ উইটনেসে, প্যাগান ধর্মে বিশ্বাস না করো, তুমি একজন অবিশ্বাসী। পৃথিবীতে প্রচুর ধর্ম ছিল, আছে। সব ধর্মের কাছে। তুমি অবিশ্বাসী। তুমি শুধু একটি ধর্ম বিশ্বাস করো, বাকি হাজারো ধর্ম অবিশ্বাস করো। তুমি যত না বিশ্বাসী, তার চেয়ে বেশি অবিশ্বাসী। যত না আস্তিক, তার চেয়ে ঢের বেশি নাস্তিক।
নাস্তিক ব্লগারদের যারা খুন করেছে, তাদের বিরুদ্ধে মনে হচ্ছে হাসিনা কোনও পদক্ষেপ নেবেন না, কারণ ওই একটিই, পদক্ষেপ নিলে যদি আবার তাঁকে নাস্তিকদের বন্ধু বা ইসলাম-সমোলোচকদের বন্ধু বলে ভাবা হয়! একবার ওরকম ভেবে বসলে মুসলমানের ভোট তো তাঁর জুটবে না।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকারই দেশটাকে পুরো নষ্ট করে দিয়েছে। যে ফ্রাংকেনস্টাইন তাঁরা তৈরি করেছেন, সেই ফ্রাংকেনস্টাইন তাঁদের এখন কোপানোর কথা। কিন্তু তাঁরা এতই নিরাপত্তার মধ্যে নিজেদের রাখেন যে তাঁদের কোপাতে না পেরে ফ্রাংকেনস্টাইন এখন নিরীহ জনগণকে কোপাচ্ছে।
২. নিলয় নীল ভয় পাচ্ছিল। নীল লিখেছিল তাকে ফলো করা হচ্ছে। তাকে ফলো করা হচ্ছে মেরে ফেলার জন্য। নীল দুমাস আগেই লিখেছিল যে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করতে গিয়েছে সে, বলেছে, তাকে ফলো করছে কিছু লোক, লোকগুলোকে তার সন্দেহ হচ্ছে। নীল লিখেছিল পুলিশ তাকে বলেছে দেশ থেকে পালাতে। নীল দেশ থেকে পালাতে পারছিল না। দেশের ভেতর বাঁচার জন্য ছুটোছুটি করছিলো। নীলকে বাংলাদেশ সরকার তারপরও নিরাপত্তা দেয়নি। একজন প্রতিভাবান মুক্তচিন্তককে বাঁচাবার কোনও চেষ্টা সরকার করেনি।
৩.আনসারুল্লাহ বাংলা ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে তারা নিলয় নীলকে খুন করেছে। এর আগেও খুন করে এসে একইরকমভাবে সদর্পে ঘোষণা করেছিল তারাই খুনি। তারপরও পুলিশ নাকি খুনিদের খুঁজে পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে নিজেদের এবার পুলিশের কাছে গিয়ে বলতে হবে আমরা খুন করেছি, আমাদের গ্রেফতার করো। তাতেও ওদের গ্রেফতার করা হবে বলে মনে হচ্ছে না। তখনও তদন্ত চলবে, যে তদন্ত বছরের পর বছর চলে যায়, শেষ হয় না। আমার তো ভয় হয়, কবে স্বয়ং রক্ষাকর্তা বিধাতা হাসিনাকে ওরা কোপাতে শুরু করে। নীলের মাথা থেকে যত রক্ত গড়িয়েছে, হাসিনার মাথা থেকে তো তুত রক্তই গড়াবে, কিছু কম তো নয়। রক্ত দেখতে দেখতে আমাদের এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। আমরা হয়তো বিস্মিত হবো না।
৪.নিলয় নীলের পুরো নাম নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়। বয়স ২৭। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিলোসফিতে মাস্টার্স করেছে। ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে পাস করা মেধাবী ছাত্র। প্রচুর পড়াশোনা করতো। ভালো লিখতো।শিক্ষিত। সচেতন। আজ তার ঘরে পড়ে আছে তার বই আর তার রক্ত। তুমি যদি খুব পড়ো, খুব বোঝে, তুমি যদি মুক্তচিন্তায় বিশ্বাস করো, তুমি যদি ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কারের দিকে আঙুল তোলো, প্রশ্ন করো, তোমার রক্তে এভাবেই ভেসে যাবে ঘর। সুতরাং বাংলাদেশে বাঁচতে হলে তোমাকে বোকা হতে হবে, বুদ্ধিমান হলে চলবে না। তোমাকে ধর্মভীরু হতে হবে, তোমাকে ধর্মমুক্ত হলে চলবে না। তোমাকে অমানুষ হয়ে থাকতে হবে, মানুষ হলে চলবে না।
৫. তসলিমা পক্ষ নামে একটি মানবাধিকার সংগঠন দাঁড় করিয়েছিল কিছু ছেলেমেয়ে, নীল সেই সংগঠনের একজন ছিল একসময়।
ফেসবুকে ওর অনেক লেখাই পড়েছি আমি। হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম, ইসলাম ধর্ম –সব ধর্ম নিয়েই ও লিখতো। হিন্দুরা ওকে মারলো না, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ওকে মারলো না, শুধু ইসলাম ধর্মের লোকেরাই মারলো। যারা বলে সব ধর্মই মূলত এক, কোনও ধর্মান্ধদের মধ্যে মূলত কোনও পার্থক্য নেই তারা নিশ্চয়ই ভুল বলে।
৬. বাংলাদেশের পুলিশপ্রধান বলেছেন, ব্লগাররা যেন সীমা লজ্বন না করে, মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে এমন কিছু যেন না লেখে, লিখলে ১৪ বছরের জেল। সরকারি ওলামারা বলেছে, ব্লগারদের ফাঁসি দিতে হবে, ব্লগ বন্ধ করে দিতে হবে, অথবা দেশ থেকে সবকটা ব্লগারকে বের করে দিতে হবে।
ভাইয়েরা আমার, একটু আস্তে বলুন এসব কথা। পাকিস্তান শুনলে হাসবে।
৭. বাংলাদেশ সরকার সোজাসুজি বলে দিয়েছে ধর্মের বিরুদ্ধে লিখলে গ্রেফতার করা হবে। আমার খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে কোন ধর্মের বিরুদ্ধে লিখলে গ্রেফতার করা হবে! হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে লিখলে কি গ্রেফতার করা হবে? বৌদ্ধ ধর্মের বিরুদ্ধে লিখলে? খ্রিস্টান ধর্মের বিরুদ্ধে লিখলে? সরকার না বললেও উত্তর আমরা সবাই জানি যে অন্য কোনও ধর্মের বিরুদ্ধে লিখলে কিচ্ছু হবে না, শুধু ইসলামের বিরুদ্ধে লিখলেই গ্রেফতার করা হবে। সরকারের তো বুকের পাটা কম নয়। তাহলে সত্যি কথাটা বলে ফেললেই হয় যে যারা ইসলামের বিরুদ্ধে লিখবে, তাদের হেনস্থা করা হবে, গ্রেফতার করা হবে, জেলে ভরা হবে, ফাঁসি দেওয়া হবে।
মাঝে মাঝে ইসলামী সন্ত্রাসী আর বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে আমি কোনও পার্থক্য দেখি না আজকাল। দেখে শুনে মনে হচ্ছে দেশ আসলে চালাচ্ছে ইসলামী সন্ত্রাসীরা, সরকার তাদের সেবাদাস মাত্র।
৮. যুক্তিবাদী মুক্তচিন্তকদের পরিকল্পিতভাবে খুন করা হচ্ছে বাংলাদেশে। খুন করার পর খুনিরা জানিয়ে দিচ্ছে তারা কারা, তাদের নাম কী, তারা কোন গোষ্ঠীর। জানি না ঠিকানা ফোন নম্বরও হয়তো জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পুলিশ তাদের টিকিটি স্পর্শ করছে না। করবে না বলেই করছে না।
প্রথম দিকে রাস্তায় করা হতো, রাতের অন্ধকারে করা হতো খুন, এখন দিন দুপুরে খুন করা হচ্ছে, বাড়িতে ঢুকে করা হচ্ছে। খুনিরা এখন খুন করে পালিয়ে যাচ্ছে। এমন দিন আসছে যখন খুনিরা আর পালাবে না। লুকিয়ে নয়, সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়েই রামদা বা চাপাতি হাতে নিয়ে ব্লগারদের বাড়িতে ঢুকবে, দেখিয়ে দেখিয়েই কোপাবে, সবার সামনে দিয়েই হাসতে হাসতে হেঁটে যাবে, মোড়ের দোকানে বসে চা খাবে। কেউ তাদের কিছু বলবে না।
এমন ভয়াবহ দিন আসছে সামনে। শুধু ব্লগার নয়, কোনও মেয়ের শরীরে বোরখা নেই তো রাস্তায় সে মেয়েকে দুটুকরো করে ফেলে রাখবে খুনিরা, দুটো ছেলে মেয়ে কোথাও বসে প্রেম করছে দেখলে দুটোকেই কোপাবে। কেউ ধর্মীয় শাসন মানতে আপত্তি করবে তো প্রকাশ্য দিবালোকে তাকে জবাই করবে। এমন দিন আসছে সামনে। এমন যুগ। সেই যুগের নাম ইসলামী শরিয়ার যুগ।
৯. ১ জন ব্লগার গ্রেট খায়, ১০ জন ব্লগার ব্লগ গুটিয়ে ফেলে। ১ জন ব্লগার কোপ খায়, ১০০ জন ব্লগার ব্লগ লেখা বন্ধ করে দেয়। এরকমই মনে হচ্ছে। এভাবেই বাঙালির অতি স্বল্প আয়ুর যুক্তিবাদের যুগ বা এজ অব রিজনের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। ব্লগারদের পাশে দেশের শিল্পী সাহিত্যিক, দেশের বিজ্ঞানী বুদ্ধিজীবী কেউ নেই। এসব দেখে মনে পড়ছে ২২ বছর আগে আমার পাশেও খুব বেশি কেউ ছিল না। অলমোস্ট একা আমি ভারসেস গোটা দেশ ইনক্লডিং অপদার্থ সরকার। লক্ষ মৌলবাদী শহর জুড়ে লম্ফঝম্ফ করছে, আমার মুণ্ডুর জন্য উন্মাদ হয়ে উঠছে। কোথায় আমার পাশে দাঁড়াবে সরকার, তা নয় আমার বিরুদ্ধেই কেস দিয়ে বসলো। তখন আইটি অ্যাক্ট ছিল না, তখন পিনাল কোডের ২৯৫ এ ই সাহসী লেখককে মেরে ফেলার জন্য যখেষ্ট। হাতে গোণা কিছু বুদ্ধিজীবী গোপনে গোপনে অবশ্য ছিল পাশে। ওরকম থাকায় লাভ কিছু হয় না। যদি দেশজুড়ে বিক্ষোভ হতো ইসলামী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে, আমার বাক স্বাধীনতার পক্ষে যদি অন্তত পাঁচশ লোকও দাঁড়াতো, তাহলে কারও সাধ্য ছিল না আমাকে দেশ থেকে তখন বের করে। সেই দুযুগ আগের ঘটনাকেই যেন পূনরায় ঘটতে দেখছি এখন। এখনও প্রগতিশীল ব্লগারদের খুন হয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বিক্ষোভ নেই। ইঁদুরের মতো সবাই গর্তে লুকিয়ে পড়েছে। যাদের সচেতন শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী বলে মনে করা হয়, তারাও লুকিয়েছে। স্টুপিড সরকার দেশের জনগণকেও ছলে বলে কৌশলে স্টুপিড বানিয়েছে। ডেমোক্রেসি নেই বাংলাদেশে, যা আছে তার নাম ইডিওক্রেসি।