দুচাকায় দুনিয়া – ৯

রাইকাভিক পৌঁছেই শুনলাম মার্গারেট ক্লার্ক বন্দরে রয়েছে। আমার পুরনো সঙ্গীদের কাছে ফিরে গেলাম আর সেইদিনই স্কটল্যান্ডের দিকে রওনা হলাম। জাহাজ ভর্তি মাছ ছিল। পথে ট্রলিং করে আরও মাছ উঠল। মনে হয় সমুদ্রের নিচে এত মাছ, বিশেষ করে এই অঞ্চলে যা কড মাছ আছে মানুষ তা তুলে শেষ করতে পারবে না। কত দেশের ট্রলার তখনও ঘোরাফেরা করছে।

চারদিন পর এবারডিন পৌঁছলাম। যখন আমরা জাহাজ থেকে মাছ নামাতে আরম্ভ করলাম বহুলোক দেখতে এসেছিল। আমার বন্ধু, নিশীথরঞ্জন দাস ও শর্মা সেখানে উপস্থিত ছিল। আমি তাদের মাছ দেখালাম ও ক্যাপ্টেনের সঙ্গে আলাপ করলাম। এবারডিনের খবরের কাগজের ফটোগ্রাফাররা উৎসাহে আমাদের একসঙ্গে ছবি তুলল এবং আমার অভিজ্ঞতা ইত্যাদি লিখে সেই ছবিগুলি প্রকাশিত হল।

এবারডিন শহর থেকে ডারহাম ও নিউ ক্যালস-অন-টাইনের ওপর দিয়ে হাল বন্দরে পৌঁছে, নরওয়ের বারগেন শহরে যাবার বন্দোবস্ত করলাম।

নরওয়েজিয়ান জাহাজ। তিনদিন পর বারগেন পৌঁছলাম। বারগেন সুন্দর শহর ও বন্দর। চারদিকে পাহাড়, তার মধ্যে উপত্যকাতেও সমুদ্রের জল গভীরভাবে ঢুকে পড়েছে। এর নাম ফিয়র্ড। জাহাজ যাতায়াত করে। ফিয়র্ডের ভেতর সমুদ্রের মাছ রোজই লক্ষ লক্ষ ঢুকছে এবং নরওয়েজিয়ানরা জাল ফেলে তাদের ধরছে। বারগেন শহরে অনেক মাছের কারখানা দেখা যায়। সারডিন, হেরিং, স্প্র্যাট ইত্যাদি টিনে পুরে পৃথিবীর নানা জায়গায় পাঠানো হয়। নরওয়েজিয়ানদের কাছে মাছের ব্যবসা খুবই লাভজনক। দেশটা পাহাড়ে ভর্তি। চাষবাসের সুবিধা নেই, এইজন্যই নরওয়েজিয়ানরা পশ্চিমমুখী হয়ে সমুদ্রের দিকে মুখ ফিরিয়েছে।

এখন আর সে অবস্থা নেই। আজ খনিজ পদার্থ নরওয়েকে উন্নতির পথে নিয়ে চলেছে। এরা শিক্ষিত, ভদ্র এবং সংস্কৃতিবান। ভাইকিংরা এদের পূর্বপুরুষ। সে অনেকদিন আগের কথা। মধ্যযুগে ডেনিশ ও নরওয়েজিয়ানরা ইংল্যান্ড আক্রমণ করে ক্যানুটের রাজস্ব শুরু করে। আজও বহু শহর ও গ্রামের নাম ডেনিশ বা নরওয়েজিয়ান। যেমন হনবি, গ্রিমসবি ইত্যাদি।

শহরের ওপরে পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে বহুদূর দেখা যায়। চোখে পড়ে সমুদ্র ও পাহাড়ের অপূর্ব সমাবেশ। দুটো হ্রদের মিষ্টি জল কাচের মতো স্বচ্ছ। সমুদ্রের জল ঘন নীল।

গরম দিন আসছে। জুন মাস তবু সমুদ্রের জল এত ঠান্ডা যে স্নান করতে পারা যায় না। পাহাড়ের রাস্তায় উঠে নেমে অনেক কষ্ট করে অসলোতে পৌঁছলাম। পথে প্রায়ই ছাগলের দুধের চিজ দিয়ে রুটি খেতাম।

ক্রিস্টিয়ানিয়া ফিওর্ডের ওপর অসলো রাজধানী অবস্থিত। মনে হল অসলো ছোট শহর। ভালো ইউনিভার্সিটি আছে। রাজার প্রাসাদ দেখতে গেলাম। এককালে যখন নরওয়ে স্বাধীন রাজ্য বলে নিজেকে ঘোষণা করল, তখন এরা ডেনমার্কের রাজার ভাইকে রাজা বলে আমন্ত্রণ করে তার হাতে রাজ্যভার তুলে দিল।

ডেনমার্ক ও নরওয়ের ভাষা একই। ডেনিশ ভাষাই নরওয়ের লোকেদের ভাষা। বিখ্যাত ইবসেন নরওয়ের লোক কিন্তু তাঁর ভাষা ছিল ডেনিশ। নরওয়ের লোকেরা ইবসেনকে নিয়ে যতখানি গর্ববোধ করে, ঠিক ততখানিই ডেনমার্কের লোকেরাও।

আজকাল দুদেশের ভাষাই একটু-আধটু করে বদলে যাচ্ছে। যেমন সুইডেনের লোকেরা তাদের ভাষার রূপ বদলে ফেলছে। আগে ডেনিশ ভাষার কাছাকাছি ছিল। নরওয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জীবন খুব স্বাধীন। কলেজের ছেলেমেয়েদের মাথায় টুপি নানা রঙের। ইউরোপের অন্যান্য দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের মতো এরাও একটা বিশেষ রেস্তোরাঁ পছন্দ করে নেয়। তার একাংশে সবাই বিয়ার খায় ও স্ফূর্তি করে।

জার্মানিতে হিটলারের যুগে এইরকম বিয়ার হলগুলো তরুণ-তরুণীদের রাজনৈতিক মতবাদ প্রচারের কেন্দ্রস্থল হয়েছিল।

নরওয়েকে বিখ্যাত করেছে অভিযাত্রীর দল। তারা উত্তরমেরু ও দক্ষিণমেরু জয় করেছে। বরফের ওপর কষ্ট সহ্য করবার ক্ষমতা এদের অসাধারণ। ন্যানসেন, পিয়ারী, আমুন্ডসেন এদের অগ্রণী। অসলো শহর থেকে ১৫ মাইল দূরে ফ্রগনারশেটেয়ার্ন নামে একটা জায়গায় অভিযাত্রীদের মিউজিয়াম সযত্নে রক্ষিত আছে। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে প্রত্যেক দিন কত লোক আসে মিউজিয়ামটিতে, বীর যুবকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। তাদের যাতে কোনও অসুবিধা না হয় সেজন্য মধ্যবিত্ত অবস্থার লোকেদের উপযুক্ত রেস্তোরাঁ আছে।

নরওয়ের বেতার কেন্দ্র আমাকে একদিন সন্ধ্যাবেলায় ডাকল প্রশ্নোত্তর আসরের বৈঠকে। ইউনিভার্সিটিতেও আমার ভ্রমণকাহিনী বলবার নিমন্ত্রণ এল, ছেলেমেয়েদের খুব উৎসাহ দেখলাম। একজন যুবক জিজ্ঞাসা করল ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ মানুষ কাকে মনে করি। আমি বিনা দ্বিধায় বললাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একজন তরুণী তখনই বলল এক শ্রেষ্ঠ মহিলার নাম বলতে। আমি বললাম, সরোজিনী নাইডু। এদেশের লোকেরা এত কম আমাদের খবর রাখে যে সরোজিনী নাইডুর কথা কেউ শোনেনি। ভাগ্যে রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন, তাই নরওয়ের লোকেরা তাঁর নাম শুনেছে বা বই পড়েছে।

যাহোক আমার দুই দিক থেকে টাকা লাভ হল, ইউনিভার্সিটি এবং বেতার কেন্দ্রের কাছ থেকে।

নরওয়ে ছেড়ে সুইডেনের উত্তরদিকে গোটেবর্গ বন্দরের দিকে এগোতে লাগলাম। লোকেদের মনে হয় খুব সচ্ছল অবস্থা। অপর্যাপ্ত কাঠ, ইলেক্ট্রিসিটি ও লোহার খনিতে সুইডেন বড়লোক। ভালো rust free steel, সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় সুইডেনে। বছরে দু-তিনবার ইংল্যান্ড ও জার্মানির এবং ফ্রান্স ও ইতালির লোকেরা সুইডেনে যায় লোহা কিনতে। মস্ত বড় শহর। বড় বড় হোটেল, দোকানভরা পণ্যসামগ্রী সাক্ষ্য দেয় সুইডেনের আর্থিক অবস্থার কথা।

আরও উত্তরে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোলম শহরে পৌঁছলাম। খুব সুন্দর ও পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন শহর। লোকেদের বেশভূষা উন্নতমানের। রাস্তায় পুলিশদেরও যেন রাজপুত্রের মতো সাজ। দামি সিল্ক সার্জের নীল রঙের সার্ট, জামাকাপড়

শহরটায় অনেক জলপথ আছে। রাস্তা দিয়ে যেমন বাস চলেছে তেমনই জলপথে ছোট স্টিমার তাড়াতাড়ি শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে দেয়। একেক জায়গায় মনে হয় যেন ভেনিস পৌঁছে গেছি, এত খাল চারদিকে।

সুইডিশ ভাষার সঙ্গে ডেনিশ ভাষার সাদৃশ্য আছে, বাংলার সঙ্গে যেমন অসমিয়া ভাষা। একজন আরেক জনের কথা কিছুটা বুঝতে পারে।

ইউরোপে যে কটা দেশ দেখেছি অবাধ মেলামেশা সবচেয়ে বেশি সুইডেনের স্ত্রী- পুরুষের।

আমি একটা স্টুডেন্টস হস্টেলে উঠেছি। ৩০ জন ছাত্র থাকে। খরচ সামান্য।

এদেশের ট্যাক্স নাকি খুব বেশি। গভর্নমেন্ট ট্যাক্স নিয়ে পরিবর্তে দেয় শিক্ষার সুবিধা, সুচিকিৎসার সুবিধা এবং বৃদ্ধ বয়সে দেখাশোনার সুবন্দোবস্ত, সবই বিনামূল্যে। সোশাল সিকিউরিটি ব্যবস্থা এত ভালো যে বুড়ো হলে কে আমাকে দেখবে বা কোথায় আমি থাকব, সে ভাবনা কাউকেই ভাবতে হয় না।

কাছেই রুশ দেশ, তাই কমিউনিজম সম্বন্ধে এরা খুবই সচেতন।

আইসল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক ও ফিনল্যান্ডের মধ্যে স্কানডিনেভিয়ান মুভমেন্ট বা সগোত্র ভাই ভাই ভাব খুব দেখা যায়। নরওয়ে সুইডেন ও ডেনমার্কে রাজা রানি এখনও বর্তমান। তাঁদের মধ্যে আত্মীয়তা আছে। হিংসার ভাব দেখা যায় না।

এই পাঁচটা দেশই এক ধরনের সমাজতন্ত্র দ্বারা রাজ্য শাসিত হয়। রাজা রানিকে লোকেরা শ্রদ্ধা করে ও ভালোবাসে। তারা হিজ ম্যাজেস্টি বলতে অজ্ঞান হয় না। সামনা-সামনি দেখা হলে গুড মর্নিং মিস্টার কিং বলাই প্রথা।

আরও উত্তরে ভেস্তেরস নামে একটা জায়গায় গেলাম। সেখান থেকে সুইডেনের ইউনিভার্সিটি উপশালায় গেলাম। আমার কাজ ছিল দুটি বিষয়ে বক্তৃতা দেবার। প্রথম, আমার ভ্রমণকাহিনী, দ্বিতীয় ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থা

লন্ডনে থাকাকালীন আমি লন্ডন হ্যারিয়াস নামে একটা দৌড়োবার দলে যোগ দিয়েছিলাম। সেখানে ফিনল্যান্ডের তিনজন শ্রেষ্ঠ দৌড় চ্যাম্পিয়ন, হোক্কার্ট, সালমিনেন ও ককাসের সঙ্গে আলাপ হয়। হোক্কার্টের সঙ্গে বেশ ভাব জমে উঠেছিল। তারা প্রায়ই হ্যাম্পস্টেড হিথে দৌড় শেষ করে আমার ফ্ল্যাটে আসত এবং প্রাতরাশ খেত। হোক্কার্টের ডাক নাম গুন্নার, আমাকে অনেক সেধেছিল তার দেশে বেড়াতে যাবার জন্য। ফিনল্যান্ডে যাবার ইচ্ছা আমারও ছিল, বিশেষ করে নুরমির সঙ্গে আলাপ করবার জন্য। আমার তিন বন্ধু দেশে নুরমির সঙ্গে দৌড়ঝাঁপ ও কসরৎ করে আগামী অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় নামবার তোড়জোড় করেছিল।

অনেকে আজ হয়তো নুরমির নাম জানে না। বলে রাখা ভালো যে নুরমি অলিম্পিকে জিতেছে। তাকে কেউ হারাতে পারত না। আমেরিকা তাকে লুফে নিয়ে গিয়ে নিজের দেশে যুবকদের ট্রেনিং দেবার ভার দিল। অনেক সম্মান ও অর্থোপার্জন করে সে ফিনল্যান্ডে ফিরে আসে এবং নিজের দেশের তরুণদের প্রশিক্ষণের ভার গ্রহণ করেছে।

স্টকহোলমে ঠিক করলাম ফিনল্যান্ডে যাব। হেলসিঙ্কি পৌঁছেই গুন্নারের খোঁজ করলাম। সে খুব সহজেই সমস্ত স্পোর্টসম্যানদের একত্র করে স্টেডিয়ামে জোটাল। মেয়র ও আরও একজন ভদ্রলোক, স্পোর্টসমন্ত্রী আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। নুরমি আমার কথা আগেই শুনেছিল। সে আমাকে ফ্রেন্ড অব ফিনল্যান্ড বলে পরিচয় দিয়েছিল।

একটা সুসজ্জিত ছোট ফ্ল্যাটে থাকবার ব্যবস্থা হল। এই ফ্ল্যাটটা গুন্নারের বাড়ির কাছে। প্রথমদিনই গুন্নারের বাড়িতে ডিনার খাবার নিমন্ত্রণ হল। গুন্নারের বাবা ব্যবসায়ী লোক, স্বল্পভাষী। মা আশ্চর্য রকম বুদ্ধিমতী। পাঁচটি কন্যা ও দুটি পুত্রের মা হয়েও তিনি সময় পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের বই পড়বার যা ফিনিশ ভাষায় ও ইংরিজিতে তর্জমা হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের দেওয়া চয়নিকা আমার কাছে আছে জেনে ভদ্রমহিলা আমাকে ভালোবেসে ফেললেন। তাঁকে যে কত কবিতা বাংলা ছন্দে পড়ে শুনিয়েছি এবং ইংরিজিতে মানে বলেছি তার ঠিক নেই। তবু উৎসাহ কমেনি। অত্যন্ত স্নেহের সঙ্গে আমাকে বলতেন যে তিনি তাঁর অষ্টম সন্তানকে পেয়েছেন।

রোজ সকালে নুরমি ও গুন্নারের দলের সঙ্গে স্টেডিয়ামে যেতাম দূরপাল্লা দৌড় অভ্যাস করতে। জগদ্বিখ্যাত দৌড়বিদদের সঙ্গে আমি শেষপর্যন্ত টিকে থাকতে পারতাম। এটা বোধহয় পাইনভরা দেশের জল-হাওয়া ও সাউনা বাথের গুণে।

পরে ১৯৩২ সালের অলিম্পিকে ১,৫০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় গুন্নার স্বর্ণপদক পেল এবং রেকর্ড করল। সালমিনেন একাই তিনটে স্বর্ণপদক পেল। ৩,০০০, ৫,০০০ ও ১০,০০০ মিটার দৌড়ের প্রতিযোগিতায়, ক‍কাস স্বর্ণপদক পেল লং জাম্পে, ফিনল্যান্ডের সে একটা স্বর্ণযুগ এসেছিল নুরমির আবির্ভাবের ঠিক পরেই। এই দেশে যেরকম চর্চা দেখেছিলাম তাতে মনে হত ভবিষ্যতের অনেক নুরমি, হোক্কার্ট, সালমিনেন অলিম্পিক থেকে স্বর্ণপদক আনতে পারবে। ফিনিশ অ্যাথেলিটদের শিক্ষাপ্রণালী অন্য ধরনের। তারা যত দূরপাল্লার রেস দিক না কেন একেবারে শেষে অমানুষিক জোরে দৌড়বার ক্ষমতা সবাই রাখে।

অনেকদিন আগে, সুইডেনের অধীনে ফিনল্যান্ড করদ রাজ্য ছিল। অনেক সুইডিশ এখানে ঘরবাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেখাপড়া করেছে এবং এখনও করছে। ফিনরা তখন পিছিয়ে ছিল। ভালো ভালো চাকরি ব্যবসা সব সুইডিশদের হাতে ছিল। আমাদের দেশে অনুন্নত ক্লাসের লোকেরা যেমন উন্নত ক্লাসের লোকেদের হিংসা করে এখানেও তেমনই। তবে দেখা যাচ্ছে, ফিন ও সুইডিশদের মধ্যে পার্থক্য কমে আসছে।

ফিনল্যান্ডের ছেলেমেয়েদের চুল একেবারে কাঁচা সোনা রঙের, কখনও কখনও মনে হয় শনের দড়ির মতো সাদা।

ইউরোপের মধ্যে দুটি দেশের লোকেদের ঠিক ইউরোপীয় না বলে এশিয়াটিক বলা হয়, যেমন হাঙ্গেরি ও ফিনল্যান্ড। তুর্কির মতো এদের পীত জাতিও বলা হয়। এদের ভাষাও অন্য ধরনের, না ল্যাটিন, না অ্যাংলো স্যাকসন, না গ্রিকবংশোদ্ভূত। এ দুই ভাষার মধ্যে অবশ্য মিল নেই। হরফ দুই দেশেরই রোমান।

গুন্নারের মা বাবা পুরনো সুইডিশ বাসিন্দা কিন্তু তাঁরা মনেপ্রাণে ফিনল্যান্ডকে আপনার দেশ বলে স্বীকার করে নিয়েছেন।

সুইডেনের মতো ফিনল্যান্ড দেশও পাইন গাছে ভর্তি। বার্চও অনেক। গাছের সম্পদ হয়েছে আজ বহু মূল্যবান। গাছ থেকে কাগজ হয়, ফার্নিচার হয় এবং ছোট ছোট নৌকো তৈরি হয়। ফিনল্যান্ড অনেক দেশে কাঠের পালপ বা মণ্ড রপ্তানি করে প্রভূত অর্থোপার্জন করে। এই দেশটা বেশি চওড়া নয় কিন্তু প্রায় হাজার মাইল লম্বা, দক্ষিণ থেকে উত্তর সীমানা পর্যন্ত। কথায় বলে, ফিনল্যান্ডে লক্ষ হ্রদ ও সরোবর আছে। জলপথে সেই উত্তর থেকে সুদূর দক্ষিণে হেলসিল্কি পর্যন্ত পাইন গাছ কেটে পাঠানো হয়। জলের স্রোতে ভাসতে ভাসতে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে গাছ চলে গন্তব্য স্থানে। অনেক সময় দেখেছি যে অনেক কাঠের গুঁড়ির ওপর একটা ছাউনি করে মানুষও চলেছে, যাতে ঠিক জায়গায় মাল পৌঁছয়। এক জায়গায় কখনও না আটকে পড়ে।

চারদিকে জলাশয় এত যে, প্রচুর মিঠা জলের সুস্বাদু মাছ পাওয়া যায়। রাস্তার ধারে মাছ রেঁধে বিক্রি করে। খুব পরিষ্কার বলে খেয়েছি এবং আনন্দ পেয়েছি। আরেকটা জিনিস এ দেশে অপর্যাপ্ত পাওয়া যায়, দুধ। রেস্তোরাঁতে খাওয়া শেষ হলে এক গ্লাস দুধ দিয়ে যায় বিনামূল্যে। ভারতবর্ষের লোকেরা ভাবতে পারে না খাঁটি দুধ, তাও আবার বিনামূল্যে, জাতির স্বাস্থ্য ভালো হবে বলে

হেলসিঙ্কি ছেড়ে উত্তরে একটা জলপ্রপাত দেখতে গেলাম। জায়গাটা খুবই সুন্দর, তাম্পেরে। কাঠের তৈরি আমার শোবার ঘর জলপ্রপাতের কাছেই। সেজন্য জলোচ্ছ্বাসের শব্দ ও লগস পড়ার শব্দ আমাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল।

আরও উত্তরে সাভনলিন্না, লেপ্পাভিটা প্রভৃতি সুন্দর সুন্দর গ্রামের পথ ধরে এগোতে লাগলাম। তারপর যেখানে গেলাম, তার নাম পুষ্কাহারিউ, সৌন্দর্যে এর তুলনা হয় না। দুধারে দুটো লম্বা হ্রদের মাঝখানে একটি সঙ্কীর্ণ জংলী পথ। শুকনো বার্চের পাতার শব্দ নিজের পায়ের তলায়। পা ফেলা বন্ধ করলে সব স্তব্ধ, নিঝুম চুপচাপ। আমি পায়ে হেঁটে সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে চলেছি, এমন সময় শুনলাম পিছনে কে যেন আমার উদ্দেশে কী বলছে। থেমে পিছন ফিরে দেখি হাত ধরাধরি করে একটি পুরুষ ও নারী আসছে।

একটু অপেক্ষা করার পর দুজনেই কাছে এল। মনে হল শিক্ষিত ভদ্র সন্তান। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। আমি কে এবং সেই জনবিরল পৃথিবীর একপ্রান্তে কী করছি শুনে লোকটি বলল, ভালোই হয়েছে, আমরা একসঙ্গে যাব; তাতে আমার স্ত্রী অনেক শান্তিতে এদিকটা বেড়াতে পারবেন। হয়তো আমার অসুবিধা হবে এই আশঙ্কা করাতে আমি বললাম বেশ তো সে ভালো কথা, আমরা একসঙ্গেই পুঙ্কাহারিউ আবিষ্কার করব।

ভদ্রলোক পরিচয় দিয়ে বললেন যে তিনি অল্পদিন হল হেলসিঙ্কিতে এসেছেন কন্সাল জেনারেল অব ফ্রান্স হয়ে। সুশ্রী দেখতে ভদ্রমহিলাটি তাঁর স্ত্রী। এই কথা বলে নিজের আইডেন্টিফিকেশন কার্ড বের করে দেখালেন। আমি ভদ্রতার খাতিরে পাসপোর্ট দেখালাম। ভদ্রলোকের নাম মঁসিয়ে ভ্যাঁ সাঁ বা ভিনসেন্ট, পাসপোর্টের এপাতা ওপাতা উল্টে বললেন যে আমি তো ওঁদের দেশে আবার যাব, তখন যেন রোন উপত্যকা নিশ্চয়ই দেখতে যাই।

মঁসিয়ে ভ্যাঁ সাঁ, তাঁর স্ত্রী ইভন ও আমার মধ্যে খুব ভাব হয়ে যায়। তিনদিন আমরা পুষ্কাহারিউর অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখতে গেলাম। ফরেস্ট রেস্টহাউস সর্বত্র আছে। দু-তিনখানা ঘর কাঠের বাড়িতে। তক্তপোশ, কাঠের চেয়ার ও টেবিল সর্বত্র আছে। তখন ছিল সামার টাইম, দিন ফুরোতে চায় না। রাত বারোটা পর্যন্ত সূর্যের আলো জঙ্গলের পথ আলোকিত করে রাখে।

সঙ্গে মাছভাজা, চিজ, পাঁউরুটি, মাখন ছিল। ভ্যাঁ সাঁদের খেতে দিলাম। তারাও নানারকম খাবারের টিন বের করে আমাকে উপহার দিল।

ডিনার খাবার পর ইভন আবদার ধরল হ্রদের কাকচক্ষু পরিষ্কার জলে সাঁতার কাটতে যাবে। আমি ট্রাঙ্ক পরে জলের ধারে গিয়ে দেখি দুখানা তোয়ালে পড়ে রয়েছে। আদম ও ইভ জল থেকে আমাকে ডাকছে। কাছে গিয়ে দেখি দুজনেই বার্থ ডে অবস্থায়। এরকম দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। এক ঘণ্টার ওপর সাঁতার কেটে রেস্টহাউসে ফিরলাম। আরামে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে শুয়ে ঘুম দিলাম। খানিকক্ষণ অবাক হয়ে ভাবছিলাম যে মাঝরাত্রে ঘন জঙ্গলের মধ্যে জলে লাফ দিয়ে সাঁতার কাটা ভারতবর্ষের কোথাও সম্ভব হত না। সাপ, পোকামাকড়, জন্তু- জানোয়ারের হাত এড়ানো যায় না সেখানে, কিছু না থাক তো জোঁক, বিছে ও মাকড়সার ভয়, লাল পিঁপড়ের ও মাছির ভয় তো আছেই। এই ভয়ঙ্কর শীতের দেশে বরফে সব মরে যায়।

নিরীহ জন্তু যেমন হরিণ, খরগোশ ও খেঁকশিয়াল দেখা যায়। তারা মানুষের ভয়ে অস্থির। এই কারণে নিতান্ত নিশ্চিন্তে মানুষ যেখানে খুশি জামাকাপড় খুলে শুতে পারে বা জলে নামতে পারে। যেখানে প্রাণ চায় শুয়ে-বসে রাত কাটানো যায়। ভয়ের কোনও কারণ নেই। ভীষণ বরফের ঝড়ে কখনও কখনও নেকড়ে বাঘ দেখা যায়। চার্লস ভ্যাঁ সাঁ খুব আমুদে, সারাক্ষণ রসিকতা করত। হাতে থাকত একটা স্কেচের খাতা, মজার মজার ছবি আঁকত সারাক্ষণ। আমি যেন একটা মডেল তার কাছে। যা করছি সে সবের স্কেচ করত। অন্য মডেল হচ্ছে তার স্ত্রী। ছবি আঁকার হাত থেকে নিস্তার নেই।

স্কেচ বইটা হাতে নিয়ে পাতা উল্টে ছবি দেখলাম এবং প্রশংসা করে ফেরত দিলাম। ভ্যাঁ সাঁ না নিয়ে নিজেই স্কেচ বইয়ের আরও পাতা উল্টে আমাকে দেখাতে লাগল। আমি খুব তারিফ করলাম। আরও দেখাল তার স্ত্রীকে আঁকা অনেক অপূর্ব সুন্দর ছবি। সেগুলো আমার কেমন লাগল জিজ্ঞেস করাতে আমি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা জানালাম। ভ্যাঁ সাঁ হেসে উঠে বলল, আমার স্ত্রী বলে বলছি না ও সত্যি সুন্দরী, হাসতে হাসতে ছবি দেখিয়ে বলল, ইমপ্রুভমেন্ট অন দি অরিজিনাল।

হাস্যরসিকতা ও কৌতুকের মধ্যে তিনদিন কাটল। তারপর ছাড়াছাড়ি, কে কোথায় গেলাম তার ঠিক ঠিকানা নেই, ভ্যাঁ সাঁর স্কেচ বইয়ে আমার কত ছবি রয়ে গেল তারও হিসাব নেই।

উত্তর ফিনল্যান্ডে দুজন শিকারির সঙ্গে দেখা হল। তারা বরফের দেশে কাছাকাছি থেকে বলগা হরিণ মারে এবং সুদূর হেলসিঙ্কি শহরে অনেক দামে মাংস বেচে

যে জায়গাটায় পৌঁছেছি তার নাম পেতসামো, একেবারে উত্তরে। একটা ছোট সুন্দর বন্দর। সেখানে মাছ ধরার ছোট নৌকো রয়েছে কয়েকটি। রাশিয়ার জাহাজ এই জলপথে সারা বছর যাতায়াত করে। যদি বরফে জল জমে যায় তো আইসকাটার জাহাজ দিয়ে পথ পরিষ্কার করা হয়। রাশিয়া ইউরোপের একেবারে মাথার ওপরে বন্দরে বন্দরে তার পণ্যসামগ্রী নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। যুদ্ধ বিগ্রহের দিনে যখন বলটিক বন্ধ হয়ে যায়, উত্তরমেরু অঞ্চলের এই জলপথে রাশিয়ার জাহাজ পশ্চিমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।

একবার মাত্র রুশ দেশ এই পথে আক্রান্ত হয়েছিল। চার্চহিল, ব্রিটিশ নৌবাহিনী মারমান্সকে পাঠিয়েছিল কমিউনিজম ধ্বংস করবার আশায়। সেটা ব্যর্থ হয়।

পেতসামোর পর জলপথ পার হয়ে চিরতুষারের দেশ, একেবারে সোজা উত্তরমেরু পৌঁছনো যায়। একজন কল্পনা করেছিল জলপথে সাবমেরিনের সাহায্যে বরফের নিচ দিয়ে উত্তরমেরু পৌঁছনোর। এই দিয়ে সে প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে উত্তরমেরুর চারপাশে হাজার হাজার বর্গমাইল জুড়ে শুধু বরফের চাপড়া, ডাঙা জমি নেই। নিচে জল, ওপরে বরফ ভাসছে।

ফিনল্যান্ডের দক্ষিণদিকে ফিরতি পথে অনেক সুন্দর সুন্দর নাম না-জানা হ্রদ আর বার্চ গাছ দিয়ে ঘেরা জায়গা দেখলাম। এদেশে লোকের ভিড় কম

হেলসিঙ্কি পৌঁছে হোক্কার্ট পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। গুন্নারের মা একজন সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। তাঁর সঙ্গে জগদ্বিখ্যাত সুরকার, ইয়ান সিবেলিউসের ভাব ছিল। কথায় কথায় একদিন আমার কথা তাঁকে বলেছিলেন। তখন সিবেলিউস ইচ্ছা প্রকাশ করেন আমার সঙ্গে আলাপ করবার। একদিন টেলিফোনে সিবেলিউসকে বললেন হেলসিঙ্কিতে আমার ফেরার কথা। সঙ্গে সঙ্গে কফি খাবার নেমন্তন্ন এল। গুন্নার আমাকে নিয়ে সিবেলিউসের বাড়িতে পৌঁছে দিল।

ইয়ান সিবেলিউস সম্বন্ধে একটি কথা জানা ভালো। সিবেলিউস যেন ফিনল্যান্ড দেশের একচ্ছত্র রাজা। তিনি মিউজিক রচনা করেন। এমন কোনও ফিন নেই যে সিবেলিউসের কথা শোনেনি বা তাঁকে শ্রদ্ধা করে না। পাশ্চাত্য দেশে ওয়াগনার, বিথোভেন, মোজার্টের সঙ্গীতরসজ্ঞ লোকেরাও সিবেলিউসকে সমকক্ষ কম্পোজার বলে মনে করে। বিথোভেনের মতো সিবেলিউসও নটা সিম্ফনি লেখেন। জগতের কাছে সিবেলিউসকে তুলে ধরে ফিলাডেলফিয়া ফিলহার্মনিক অর্কেস্ট্রার নেতা,

মিঃ কুসেভিৎস্কি। অনেক রেকর্ড করানো হয়। দুজনেই বিখ্যাত লোক অথচ একজন অন্যজনকে দেখেননি, যদিও কুসেভিৎস্কি বহুদিন ধরে সিবেলিউস মিউজিকের বিশেষত্ব পৃথিবীসুদ্ধ লোককে শোনাচ্ছেন।

সিবিলিউস ও তাঁর স্ত্রী নিজেরাই এগিয়ে এসে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। গুন্নার ট্র্যাক প্র্যাক্টিস আছে বলে পলায়ন করল। বলে গেল রাত্রে ডিনারের পর আমাকে নিয়ে যাবে।

আমি দেখলাম সিবেলিউস ভারতবর্ষকে জানবার জন্য আগ্রহী। যেখানে যা পেয়েছেন আমার দেশের ওপর লেখা তাই মন দিয়ে পড়েছেন। জার্মান ভাষায় তর্জমা করা রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়েছেন। ভালো লেগেছে। বললেন, বাংলা ভাষা শিখতে তাঁর ইচ্ছা করে কারণ, তা ভাবে ও সৌন্দর্যে ভরপুর।

এই দিনই দুপুরবেলায় লাঞ্চ খাবার পর মিসেস সিবেলিউস আমাকে গেস্টরুম দেখাতে নিয়ে গেলেন। এমন সময় একটা টেলিগ্রাম এল। কুসেভিৎস্কি লিখেছেন দুদিন পরে তিনি হেলসিঙ্কিতে এসে সিবেলিউস মিউজিক পরিবেশন করবেন। সিবেলিউসরা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, আনন্দে আকুল। একটা লক্ষ করবার বিষয় এই যে সিবেলিউসের মাথাটা মস্ত বড় এবং কেশহীন আর মিসেস সিবেলিউসের এক মাথা সাদা চুল।

বিকালে চা খাবার সময় আরও অনেক গল্প হল। সিরেলিউস বললেন, ভারতবর্ষের মতো ফিনল্যান্ডেরও মিথলজি আছে যা বিখ্যাত। পৌরাণিক কাহিনীর নাম কালেভালা, আমাকে অনেক রঙিন ছবি দেখালেন কালেভালা অনুধাবনে আঁকা। আমাকে একখানা ছবি উপহার দিলেন।

কুসেভিৎস্কির টেলিগ্রাম পাবার পর থেকে সিবেলিউস খুশিতে ভরপুর। ডিনারের পর বিদায় নেবার সময় বললেন যে কুসেভিৎস্কির সঙ্গে তাঁর প্রথম যখন দেখা হবে সেই সময়টি আমাকে ছবি তুলতে হবে স্টেজের ওপর।

যথাসময়ে সিবেলিউস টেলিফোনে মিসেস হোক্কার্টকেও নেমন্তন্ন করলেন কুসেভিৎস্কির কনসার্টে হাজির থাকবার জন্য। দুখানা নেমন্তন্নর চিঠি এল।

কনসার্ট হল লোকে লোকারণ্য। এত বড় ঐতিহাসিক ঘটনা সবাই প্রত্যক্ষ করতে চায়। তাছাড়া কুসেভিৎস্কির পরিবেশনে সিবেলিউসের মিউজিক অন্যরকম সৌন্দর্যময় রূপ গ্রহণ করত। আমি ক্যামেরা হাতে মিসেস হোক্কার্টের সঙ্গে কনসার্ট হলে পৌঁছলাম। কার্ড দেখানো মাত্র আমাদের নিয়ে গেল ম্যানেজারের ঘরে। তিনি বললেন যে স্বয়ং সিবেলিউস তাঁকে হুকুম করেছেন আমাকে যেন সর্বত্র যেতে দেওয়া হয়। অর্থাৎ স্টেজের ওপরেও আমার অবাধ গতি।

যথাসময়ে কম্পোজার ও কন্ডাক্টরের প্রথম মিলন হল কনসার্ট হলে, স্টেজের ওপর। সর্বসমক্ষে দুটো ছবি তুললাম। ছবি দেখলে মনে হয় দুজনেই অভিভূত। সবাই দাঁড়িয়ে উঠে হর্ষধ্বনি করল।

একটু পরেই কনসার্ট আরম্ভ হবে। ফিনল্যান্ডিয়া বাজাবার কথা। সিবেলিউস তাড়াতাড়ি স্টেজ ছেড়ে চলে গেলেন গ্যালারির ওপর বসে শোনবার জন্য। গ্যালারি অনেক উঁচুতে, সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। বৃদ্ধ বয়সে, বিরাট দেহ টানতে টানতে সিঁড়ি বেয়ে চললেন ওপরে, আরও ওপরে। সঙ্গীতজ্ঞ মনে করেন যে গ্যালারিতে বসে যদি প্রত্যেকটি নোট স্পষ্ট শুনতে পান তবেই কনসার্ট সর্বাঙ্গসুন্দর, তবেই তাঁর মিউজিকের সার্থকতা সম্পূর্ণ। সবাই জানত সিবেলিউসের এই খামখেয়ালি অভ্যাস। হাঁপাতে হাঁপাতে গ্যালারিতে পৌঁছনোমাত্র সমস্ত লোক দাঁড়িয়ে উঠল এবং তাঁর পরিচিত জায়গাটি ছেড়ে দিল। ফিনল্যান্ডের লোকেরা কী প্রগাঢ় স্নেহ ও শ্রদ্ধার চোখে দেখে এই শিল্পীকে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। একমাত্র তুলনা করতে পারি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। তিনি তাঁর রচিত গীতিনাট্য শোনাবার জন্য যদি থিয়েটারের উঁচু গ্যালারিতে উপস্থিত হতেন তবে বোধহয় লোকেদের এই রকম অবস্থা হত।

আমি নিচে চলে গেলাম। সেখান থেকে অর্থাৎ অডিটোরিয়াম থেকে ক্যামেরা ওপর দিকে তুলে ইয়ান সিবেলিউসের একটা ছবি তুললাম। এক সার লোকের মধ্যে তিনি বসে আছেন। প্রকাণ্ড মাথাওয়ালা লোকটিকে সহজেই চেনা যায়। আমার মনে হয় এই রকম ছবি অতি বিরল। মাঝে মাঝে ছবিটা দেখি আর সেদিনের উত্তেজনাপূর্ণ সন্ধ্যার কথা স্পষ্ট মনে পড়ে। বিরতির সময় সিবেলিউস নিচে নেমে এলেন এবং পায়চারি করতে লাগলেন আমার কাঁধের ওপর হাত রেখে। আমাদের জন্য সবাই সসম্মানে পথ ছেড়ে দিচ্ছিল। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছিলাম, সবার চোখে প্রশ্নের চিহ্ন, এই কালো আদমিটি কে?

ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট কে বা প্রধানমন্ত্রীর নাম হয়তো অনেকে জানে না, তারা জানে কিংবা শুনেছে ইয়ান সিবেলিউসের কথা। মিউজিক জগতে তাঁর স্থান ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠদের সমান পংক্তিতে, বিথোভেন, মোজার্টের মতো সম্মান লাভ করেছেন বিশ্ববাসীর কাছ থেকে। ফিনল্যান্ডবাসীরা গর্বের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে বলে, আমাদের দেশের একমাত্র রাজা ইয়ান সিবেলিউস। ফিনল্যান্ডের পরিচয় আর ইয়ানের পরিচয় একই কথা।

দুঃখের বিষয় কি দেশি কি পাশ্চাত্য মিউজিকে আমি অনভিজ্ঞ, সিবেলিউসের বহু প্রশ্নের তাই উত্তর দিতে পারিনি। আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন হিন্দু মিউজিক কী প্রকার? যতটুকু জানি আমি রাগরাগিণীর কথা বললাম। এও বললাম যে গায়ক কিংবা বাদকের সেখানে যথেষ্ট স্বাধীনতা থাকে মূলসূত্রটি বজায় রেখে অল্প বিস্তর হেরফের করার, যেমনটি পাশ্চাত্য সঙ্গীতে সম্ভব নয়। গ্রিক পণ্ডিত পাশ্চাত্য মিউজিক সৃষ্টি করবার সময় একটি বাঁধা-ধরা নিয়মে চলেছেন। যে মূল রচনার যত কাছাকাছি গাইতে বা বাজাতে পারবে সে তত বড় আর্টিস্ট। হিন্দু মিউজিক তেমন নয়।

আমি বললাম, ক্ল্যাসিক্যাল ভারতীয় মিউজিক বিজ্ঞানসম্মত ও শাস্ত্রানুমোদিত। তবে তা বোঝাবার ক্ষমতা আমার নেই। তখন সঙ্গীতজ্ঞ বললেন, আচ্ছা, রিমস্কি- কমার্কভ যেমন লিখেছেন সেটি কি আসল রূপ? আমি বহুবার শুনেছি রুশ কম্পোজার, রিমস্কি কসার্কভের একটি মিউজিক হিন্দু লাভ সং। অনেক হোটেলে আমি পৌঁছনোমাত্র খাতির দেখাবার জন্য এই পিসটি বাজাত।

আসলে এটা যে কোনও ভারতীয় সঙ্গীতের ধারা বয়ে আসছে না সেটা সিবেলিউসকে বললাম। একটা কল্পনার মিউজিক বলা চলে, যেমন আরেকটি লেখা ইন এ পার্শিয়ান মার্কেট।

আমি রবীন্দ্রনাথের গান লেখার ও হাজার হাজার গানে সুর দেওয়ার অমানুষিক ক্ষমতার কথা বললাম। গানগুলি ভাব ও ভাষার চরম অভিব্যক্তি, পৃথিবীর কোথাও এমনটি দেখা যায় না। একাধারে শ্রেষ্ঠ কবিতা, গান ও সুরবিন্যাস।

ইয়ান সিবেলিউস আমাকে এত আপনার করে কাছে টেনে নিয়েছেন দেখে মিসেস হোক্কার্ট ভীষণ খুশি। তাঁর বাড়িতে আমার ঘন ঘন ভোজের নেমন্তন্ন আসতে আরম্ভ করল। একজনের মুখে হাসি ধরে না, আর হাসলে যাকে খুব সুন্দর দেখায়, সে হচ্ছে গুন্নারের বোন জিম। মেয়ের কেন এমন পুরুষালী নাম হল জিজ্ঞেস করা হলে জিম বলল, সে একটা ইংরিজি ফার্মে কাজ করে। তার মালিক ইংরিজি ভালো জানার জন্য একদিন প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘ইউ স্পিক লাইক জিম’। আমি তোমাকে জিম বলে ডাকব। জিমটি কে জানতে চাইলে তিনি বললেন যে সে তাঁর একমাত্র পুত্র। সে অবধি গুন্নারের তৃতীয় বোন জিম নামেই অভিহিত।

এক শনিবার চাঁদনি রাত্রে জিম আর তার আরও দুটি ছোট বোন, বয়স ২১ ও ১৭ আমাকে নিয়ে গেল তাদের নিজস্ব একটা কটেজ আছে পাহাড়ের গায়ে, বিশ মাইল দূরে। পৌঁছেই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল জ্বালানি কাঠ কুড়তে। নিচে একজন হ্রদ থেকে জল আনতে গেল। কটেজ ছোট, মোটামুটি চারজনের মতো শোবার বাঙ্ক ছিল। ঘর বলতে একটা। রাত্রের খাবার সঙ্গেই ছিল। উইক-এন্ডের বাকি খাবার কটেজের চুলাতেই হবে। মেয়েদের উৎসাহ খুব। আমাকে কোনও কাজ করতে দেবে না। আমি নাকি অতিথি।

খাবারের তোড়জোড় শেষ করে যখন কটেজটা সাফসুফ করা হল, তখন সবাই চলল লেকের জলে, সাঁতার কাটতে। কটেজের দরজা সব খোলা রইল। আমরা নিচে গিয়ে জলে নামলাম। এত আরাম লাগছিল, কারও জল ছাড়বার ইচ্ছে হচ্ছিল না। রাত তখন দশটা হবে। তখনও সূর্যের আলোও ভালো রকমই ছিল।

কটেজের সিঁড়ির ওপর বসে খানিকক্ষণ গান হল। জিম ভালো গান গায়, খুব মিষ্টি গলা। সবচেয়ে ছোট বোন মরিয়ান্না পকেট থেকে মাউথ অরগ্যান বের করে বাজাতে লাগল। এমনিভাবে কেটে গেল প্রায় এক ঘণ্টা।

প্রত্যেক বাঙ্কে খড় ছিল কিছু কিছু, তার ওপর বিছানা খুব আরামের। শহর থেকে যারা এসেছে তাদের কাছে এর নতুনত্ব আছে। এটা আমার জীবনের এখন অঙ্গ হয়ে গেছে। শহরের চেয়ে বনে জঙ্গলে আমার বেশি ভালো লাগে। আপনার লোকের মতো কাছে ঘেঁসে তিন বোন আমাকে গান গাইতে বলল।

প্রচণ্ড শীতের দেশ বলে এই রকম একটা শোবার, বসবার ও খাবার ঘরই যথেষ্ট। একপাশে ছোট্ট রান্নাঘর ও অন্যদিকে বাথরুম। বছরের আট মাস বরফে ঢাকা থাকে। স্কিইং করবার পক্ষে পাহাড়ের গায়ে জায়গাটা চমৎকার। হ্রদের ওপরের জল যখন জমে শক্ত হয়ে যায়, তখন সবাই আইস স্কেটিং করে। গরমের দিনে সাঁতার ও বেড়ানো খুবই আরামদায়ক। ছেলেমেয়েদের অটুট স্বাস্থ্য, কর্মক্ষমতাও তেমনই। আধমন ওজনের একটা রুকস্যাক পিঠে নিয়ে তাতে প্রয়োজনীয় সব জিনিস ভরে, পাহাড়ের পথে ওঠা-নামা সব মেয়েরাই করে

শীতের দেশে সবচেয়ে সুবিধা হচ্ছে এই যে খাবার জিনিস অল্প সময়ের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায় না। চিজ, কয়েকটা ডিমসেদ্ধ, সসেজ এবং রুটি ও খাঁটি সুগন্ধী মাখন, জ্যাম হলেই যথেষ্ট হল। তাছাড়া টিনের সবরকম খাবার, দুধ ও স্যুপ তো আছেই।

আমাদের দেশে যেমন সারা বছর নানারকম ফল পাওয়া যায়, শীতের দেশে তেমন নয়। টক আপেল সর্বত্র পাওয়া যায়। কমলালেবু ও কলা এরা সুদূর দেশ থেকে আমদানি করে। কলা সবার প্রিয়। আপেল খেলে শরীর ভালো থাকে। এই বিশ্বাসে খুব ছোট থেকে ফল খেতে শেখে, তা যতই টক হোক। শীতের দেশে ফল মিষ্টি হয় না, ফুলও সুগন্ধী হয় না রোদের অভাবে। দক্ষিণ ইউরোপ থেকে মিষ্টি পিচ, প্লাম, পেয়ার্স ইত্যাদি আসে। সেইসব ফলের দাম অনেক। সেসব সাধারণের ভোগে আসে না। অপেক্ষাকৃত মিষ্টি ফল চেরি মাঝে মাঝে খেয়েছি। আঙুর মিষ্টি হয় যদি দক্ষিণ স্পেনে মালাগা অঞ্চলের অথবা গ্রিসের রোদমাখা দেশ থেকে আসে।

ফিনল্যান্ডে সাউনা বাথ বা স্বাস্থ্যস্নান সম্বন্ধে কিছু না বললে কাহিনী সম্পূর্ণ হবে না। শহরের বাইরেই হয় আসল সাউনা। কিন্তু শহরেও আছে কিছুটা ভিন্ন ধরনের। হেলসিঙ্কিতে আমাকে নিয়ে গুন্নার একটা বড় সাউনাতে গেল। ঢুকতে এক টাকা লাগল। একজন যুবতী এগিয়ে এসে হাসিমুখে একটা টাওয়েল দিল এবং একটা ঘর দেখিয়ে বলল এই ঘরটা তোমার, কাপড় ছেড়ে এস। আমি কাপড়চোপড় লোহার আলমারিতে রেখে তোয়ালে জড়িয়ে বেরিয়ে এলাম। আমার গায়ের রং রোদে পোড়া ব্রাউন। এরকম বোধহয় কখনও মেয়েটি দেখেনি। আমার দিকে বড় বড় চোখে চেয়ে রইল। কাছে এসে বললাম তারপর? মেয়েটি বলল, এখন তুমি টার্কিশ বাথ নিয়ে এস ওই ঘরের ভেতর। ভাজা ভাজা হয়ে গেলে আবার এখানে এস। টার্কিশ বাথের ঘরটা গরম হাওয়ায় ভর্তি। অল্পক্ষণের মধ্যে ঘর্মাক্ত হয়ে গেলাম। তখন আরও বেশি গরম হাওয়া নেওয়ার জন্য দুধাপ এগিয়ে গেলাম। যখন গরম অসহ্য হল, বেরিয়ে এলাম। সাদা ইউনিফর্ম পরা মেয়েটি আমাকে দেখে এগিয়ে এল এবং কোনও এক অতর্কিত মুহূর্তে আমার কোমরে জড়ানো তোয়ালে খানা ফস করে টেনে নিল এবং তখনই বলল, চারদিকে চেয়ে দেখ, একজনও তোয়ালে বা অন্য কিছু পরে নেই। কথাটা ঠিকই, সবাই কিছু না পরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাঁতার কাটছে, ম্যাসাজ হচ্ছে।

মেয়েটি আমার হতভম্ব অবস্থা ভালো না বুঝলেও বলল, দারুণ গরম থেকে বেরিয়েছ, এবার এই কনকনে ঠান্ডা জলে সাঁতার কেটে এস। জলে নেমে মনে হল হার্ট চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। ওপরে উঠলাম, আবার জলে পড়লাম। একটু পরে ঠান্ডা জলে খুব আরাম লাগছিল। সুইমিং পুলে অনেক নাগা সন্ন্যাসী জলে ডুবছিল, উঠছিল আবার পড়ছিল। আমার তখন মনে হল ভারতবর্ষের বাইরে কোথাও কাপড়-জামা পরে স্নান করার রেওয়াজ নেই, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে।

জল থেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমার পরিচিত মেয়েটি এসে একটা শ্বেত পাথরের ওপর শুতে বলল। তখন রীতিমতো বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে আমার দলাইমলাই অর্থাৎ ম্যাসাজ আরম্ভ হল। খুব স্মার্ট ও পরিপাটিভাবে ম্যাসাজ করল। সমস্ত শরীর জুড়িয়ে গেল। তারপর আবার স্নানে গেলাম শাওয়ারের নিচে। সেই মহিলাটি তোয়ালে হাতে অপেক্ষা করছিল। আমাকে ভালো করে মুছিয়ে বলল, ঘরের মধ্যে বিছানায় শুয়ে পড়, এক গ্লাস দুধ রাখলাম, খেও।

কম্বল মুড়ি দিয়ে শুলাম এবং শীঘ্রই ঘুমিয়ে পড়লাম।

যদি কেউ না বলে সে কী পানীয় চায় যেমন বিয়ার, হরলিক্স, বভরিল ইত্যাদি, তাহলে তাকে বিনামূল্যে এক গ্লাস দুধ দেওয়া নিয়ম।

সাউনা বাথের এত কসরৎ করার ফল জিজ্ঞাসা করলে আমি বলব অনেক। খুব সহজ উপায়ে মেদ কমানো যায়। তাছাড়া শরীরটাকে দারুণ গরম ঠান্ডার ভেতর দিয়ে ইস্পাতের মতো সহনশীল শক্ত ও নরম কাজের উপযুক্ত করা যায়। মাংসপেশীর জড়তা কেটে যায়। আমারই ঘুম দিয়ে উঠে ইচ্ছা করছিল দশ-বিশ মাইল ছুটে আসি। মনে হল যেন শরীরের ও সেইসঙ্গে মনের সমস্ত অবসাদ কেটে গেল। আনন্দের অনুভূতি যে কীরকম তা লিখে বা বলে বোঝানো যাবে না।

শহরের বাইরে সর্বত্র সব বাড়িতে একটা সাউনার ঘর আছে। তার মাঝখানে তিন-চার মন ওজনের একটা গ্র্যানাইট পাথর ইটের ওপর সাজানো। পাথরের নিচে সারাদিন কাঠ দিয়ে গরম করে রাখে। ঘরটার তিন পাশে কাঠের বাঙ্ক আছে। পাথরটা গরম হওয়ার সঙ্গে ঘরও বেশ গরম হয়ে যায়। ওপরের বাঙ্কে সবচেয়ে গরম, তার ঠিক নিচে অপেক্ষাকৃত কম।

যারা সাউনা স্নান করতে চায় তারা পাথরের চারপাশে এসে বসে। হাতে একটি ছোট বালতি তাতে বার্চ গাছের হাল্কা ডাল। পরস্পর পরস্পরকে বার্চের ডাল দিয়ে শরীরে মৃদু আঘাত করে এবং পাথরের ওপর জলের ছিটা দেয়। ফলে খুব স্টিম হয় এবং ঘরটা অসহ্য রকম গরম হয়।

বার্চ পাতাসুদ্ধ হাল্কা ডাল দেহের ওপর মারে, একে অন্যের শরীরে রক্ত চলাচলে সাহায্য করতে। তারপর রীতিমতো ঠান্ডা জলে স্নান করে কিংবা হ্রদের জলে লাফ দেয়। ঠান্ডার দিনে বরফের ওপর শুতে হয়। অন্যরা শরীরের ওপর বরফ ঘসে দেয়। ম্যাসাজ করার সমান কাজই হয়। বলা বাহুল্য সাউনা শহরেই হোক আর গ্রামাঞ্চলে হোক জামাকাপড় ছাড়াই হয়।

দুদিন পরে সিবেলিউয়ের সঙ্গে দেখা করে আমার তোলা ছবিগুলো দিয়ে এলাম। বৃদ্ধ খুব খুশি।

হোক্কার্ট পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কতবার এমন হল তার ঠিক নেই। কত লোক এত আপনার করে নেয় অল্প সময়ে, যেন চিরকালের চেনা, তারপর ছাড়াছাড়ি। কিছুদিন মনটা ভার হয়ে থাকে।

হেলসিঙ্কি ছাড়ার পর ভিবর্গ শহরে থামলাম। ফিনল্যান্ড যদি কখনও শত্রুপক্ষে যোগ দেয় তো ভিবর্গে বসে বসে লেনিনগ্রাদের অশেষ ক্ষতি করতে পারে। অনেকদিন পরে, নাৎসিদের কুপরামর্শে ফিনল্যান্ড লড়তে গিয়েছিল রাশিয়ার বিরুদ্ধে। খারাপভাবে হেরে গিয়ে ফিনল্যান্ডের এক টুকরো জমি (যেখানে এখন কারেলিয়া) এবং ভিবর্গ শহর ও উত্তরে পেতসামো শহর রাশিয়াকে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ দিতে হল। সেইসঙ্গে গুন্নার, হোক্কার্ট ও জিমের ফিয়াসে (একজন এয়ার পাইলট) প্রাণ হারাল অন্য অনেক যুবকদের সঙ্গে। পরে ফিনল্যান্ড বুঝেছে যে বড় দেশের গায়ে গা লাগিয়ে শত্রুতা করা চলে না। রুশ জনসাধারণ অতিকষ্টে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে, কোনওমতেই তা হারাবার জন্য তারা প্রস্তুত নয়। এখন দুই দেশে খুব ভাব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *