দুচাকায় দুনিয়া – ১১

১১

গ্রিসে পৌঁছলাম। এই সেই ইউরোপীয় সভ্যতার জন্মস্থান। কলা, কৃষ্টি ও যুদ্ধবিদ্যায় গ্রিকরা একদা শীর্ষস্থানে পৌঁছেছিল। দেশটা খুব ছোট্ট। চারদিকে পাহাড় ও সমুদ্র। মূল দেশের সঙ্গে অফুরন্ত দ্বীপপুঞ্জ সংযোগ রাখে জলপথে। এইজন্য এককালে গ্রিক নৌবহর খুব শক্তিশালী ছিল।

আমার আশ্চর্য লাগে যে এই ছোট দেশটা বহুধা-বিভক্ত বিভিন্ন শাসন প্রণালীতে শাসিত হয়েও পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় স্বাক্ষর রেখেছে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, ভাস্কর্যে, মনীষীর সমাবেশে ও দার্শনিক অবদানে। আমরা ভ্রমণ করতে করতে একদিন হঠাৎ লক্ষ করলাম যে মরুভূমির মাঝখানে ৭০-৮০ ফুট উঁচু একটা বাড়ির খিলান ও দুটি দেওয়াল আজও দাঁড়িয়ে আছে। এত বড় প্রাসাদ যখন তৈরি হয়েছিল তখন মনে হয় দেশটা এমন বালুময় ছিল না বরং সেখানে জনপদ ছিল ও নিশ্চয় চাষবাসও হত। কালের অমোঘ নিয়মে আরব দেশ থেকে মরুভূমি বাড়তে বাড়তে শস্যশ্যামলা সুফলা মেসোপটেমিয়াকে (অধুনা ইরাক) গ্রাস করে ফেলেছে। গ্রিস দেশটা ভারি সুন্দর। পাহাড়, নীল আকাশ, সুনীল জল, চারদিকে অলিভ গাছ। তেমন শীত নেই বরং গরমই বলা চলে। অনেক দিন পর মুখরোচক খাবার খেলাম। বেগুন ও টমাটোর ভেতর মাংসের পুর দিয়ে সব রেস্তোরাঁতে বেচছে। অনেকটা ভারতীয় পদ্ধতিতে রাঁধা, মশলা দিয়ে, তবে ঝাল বাদ।

পিরায়ুস জাহাজটার মালিকের সঙ্গে আলাপ হল। অনেকদিন আমেরিকায় ছিল বলে ইংরিজি সহজেই বলতে পারত। আমাকে তার বাড়িতে থাকবার নেমন্তন্ন করল।

এথেন্স শহরে দেখবার জিনিস অফুরন্ত। খ্রিস্ট জন্মাবার ৫০০-৭০০ বছর আগে থেকে গ্রিক সভ্যতার প্রসার লাভ করেছে। সেই পুরনো যুগের মন্দিরগুলি এবং মুক্তাঙ্গন থিয়েটার ও বাথ ইত্যাদি আজও তার মহিমা প্রচার করছে।

গ্রিকরা দেবদেবীর পূজা করত। তাদের জন্য বিরাট মন্দির করেছিল সর্বত্র। মোটামুটি তিন ধরনের স্থাপত্য দেখা যায়: ডোরিক, আইয়োনিয়ান এবং কোরিন্থিয়ান।

খ্রিস্টধর্মের অভ্যুদয় হয় অন্তত ৮০০ বছর পরে, গ্রিকদের খ্রিস্টান হতে অনেক বছর কেটেছে। কোনও কোনও জায়গায় দেখেছি মন্দিরকে গির্জায় পরিণত করা হয়েছে একটু আধটু বদল করে। তারা অটুট দাঁড়িয়ে রয়েছে এখনও

জাহাজের ক্যাপ্টেন, আমার হোস্টের নাম ক্যানারিশ। বয়স পঞ্চাশের মতো হবে। স্ত্রী ও একমাত্র কন্যা নিয়ে ঘরসংসার। বাড়িটা একটা ছোট টিলার ওপর। ঘর থেকে বাইরের দৃশ্য অপূর্ব। সমুদ্রের নীল জল পাথর ভর্তি দ্বীপগুলির গায়ে আছড়ে পড়ছে, বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই

ক্যানারিশের স্ত্রী কিছুদিন আমেরিকাতে ছিলেন। বয়স ৪৫ হবে। তাঁর মেয়ের বিয়ে হয়েছে কিছুদিন আগে। আপাতত বাবা মার কাছে বেড়াতে এসেছে। সকলের সঙ্গে ভাব হয়ে গেল। আমাকে একটা খুব সুন্দর ঘরে থাকতে দিয়েছে।

ক্যানারিশ ব্যবসার জগতে আছেন। লোকেদের অসাধু ব্যবহারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলল যে তুমি ইতিহাসে যে গ্রিকদের কথা পড়েছ, সে গ্রিক আজকাল আর নেই। আমাদের দেশের লোকেরা এখন ক্ষুদ্র স্বার্থ নিয়ে মিথ্যা কথা বলে এবং মিথ্যা আচরণ করে। কে বলবে যে এরা হোমার, সফোক্লেশ, পিথাগরাস ও প্লেটোর বংশধর। চারদিকে অবনতি!

ক্যানারিশ খেদ করে যা বলল তা বোধহয় বেশিরভাগ দেশের পক্ষেই প্রযোজ্য।

গ্রিসে অলিভের চাষ ছাড়া মদও তৈরি হয় প্রচুর। দুপুরবেলায় লাঞ্চ খেলাম, দুটোরই যথেষ্ট সদ্ব্যবহার করে। অলিভের তেলে রান্না হয়। তাই লোকেদের স্বাস্থ্য ভালো। অলিভ অয়েল খুব সস্তা, দশ আনা থেকে বারো আনায় সের পাওয়া যায়। গ্রিক পুরুষদের চেয়ে মেয়েরা অনেক বেশি সুন্দর দেখতে। রূপচর্চার জন্য অলিভ তেল গায়ে মাখে। সেজন্য ত্বক মসৃণ হয়, সব চর্মরোগেরও ঔষধ হিসাবে এই তেল ব্যবহার হয়। হয় খাবে নয় মালিশ করবে। ক্ষতের ওপর প্রলেপ দেয়। পেটের রোগ সারে।

ক্যানারিশের সঙ্গে দ্রষ্টব্য জায়গাগুলি যেমন পার্থেনন, এক্রোপলিস ইত্যাদি দেখে এলাম। ধ্বংসাবস্থায় তাদের সৌন্দর্য ও বিরাটত্ব দেখে মুগ্ধ হতে হয়। পাথরের তৈরি বলে আজও দাঁড়িয়ে আছে। মাথাটা সব খালি। কাঠ দিয়ে ঢাকা ছিল একদিন। কালের প্রবাহে সেসব ধ্বংস হয়ে গেছে।

বিকালে ক্যানারিশ তার ইয়টে বেড়াতে যাবার আমন্ত্রণ জানাল। আমরা চারজন যাত্রী। ইয়ট হল পাল তোলা জাহাজ, যার মধ্যে ইঞ্জিনও আছে। বাতাস বন্ধ হলে কলে চলে। সেদিন শনিবার ছিল। সাদা পাল তুলে মরাল গতিতে জাহাজ সুনীল সাগরে চলেছে। ক্যানারিশের মেয়ের নামে জাহাজের নাম রাখা হয়েছে হেলেন।

এথেন্স থেকে অনেক দূরে এসে পড়েছি। জাহাজে খাবার ও শোবার ঢালাও ব্যবস্থা আছে। সুন্দর সূর্যাস্ত দেখলাম। গোধূলিতে আকাশ জল সব লাল হয়ে গেল। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে এল। ওদিকে পূর্ণিমার চাঁদ উঠল পুবাকাশে। সে আরেক রকম সৌন্দর্য দূরে, বহুদূরে এথেন্স শহরে আলো জ্বলে উঠেছে। পাহাড়ের ওপর শহর বলে দূরে জল থেকে মনে হয় যেন একটা মণিমাণিক্য খচিত রাজার মুকুট ঝিকঝিক করছে।

মেয়ে আবদার ধরল যে অনেকদিন ইয়টে রাত্রিবাস করেনি, তাই বলল ইয়ট নিয়ে রবিবার সন্ধ্যায় ফেরবার কথা। ক্যানারিশ ভালো মুডি ছিল। মেয়ের কথায় সানন্দে যোগ দেবার আগে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল, কোনও অসুবিধা বা আপত্তি আছে কিনা। স্ত্রী খুশি মনে রাজি হলেন। আমার হাতে অপর্যাপ্ত সময় ছিলই।

সন্ধ্যার পরেই ক্যানারিশ সুরা পানের জন্য ডেকের ওপর ব্যবস্থা করল। একটা মিষ্টি মিষ্টি গ্রিক মদ, সদ্য আঙুর নিংড়ানো এবং অ্যালকোহলের মাত্রা কম, খুবই ভালো লাগল। বছরের এই সময়, শরৎকালে এরকম নিরামিষ গোছের মদ পাওয়া যায়। বেশি দিন রাখলে নষ্ট হয়ে যায় যথেষ্ট স্পিরিটের অভাবে।

মন মাতানো বাতাস বইছিল। ইয়ট যারা চালায় তাদের মধ্যে একটি যুবককে ডেকে ক্যানারিশ গান গাইতে বলল। গানের জন্য সে নাকি বিখ্যাত। খুব মোটা দরাজ গলায় গান ধরল। যুবকটির উচিত ছিল ইয়টে যোগ না দিয়ে অপেরাতে যোগ দেওয়া। চাঁদনি রাতে স্বপ্নের দেশে চলেছি মনে হচ্ছিল। মিসেস ক্যানারিশের হাতে একটা গিটার ছিল, তিনি আস্তে আস্তে বাজাতে লাগলেন।

ডেকের ওপর আমাদের খাবার ব্যবস্থা হল। জাহাজ ধীর মন্থর গতিতে চলেছে উত্তরে। খেয়ে উঠলাম তখন রাত প্রায় দশটা। ইয়ট নোঙর ফেলল। আমি শুতে গেলাম। ভালো হোটেলের মতো সুন্দর ব্যবস্থা।

ক্যানারিশ তার দেশকে ভালো চেনে। জল থেকে ডাঙার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ওইসব জায়গার ঐতিহাসিক বিবরণ দিয়ে গেল। ওই পাহাড়ের ধারে উপত্যকায় হয়েছিল ব্যাটল অব থার্মপলি। এই জলপথে প্যারিস সাঁতার দিয়ে আরেক হেলেনের কাছে পৌঁছেছিল ইত্যাদি।

ভোরে ডেকে এসে বসলাম। জাহাজের নাবিকরা সবাই কাজে ব্যস্ত। জাহাজের নোঙর তুলে নিয়ে রওনা করা হয়েছে, ইয়টের কাজ ছাড়া রান্না-বাড়ার কাজে সকলে খুব ব্যস্ত।

ক্যানারিশ পরিবারের ঘুম ভাঙল যখন সূর্য অনেক ওপরে উঠে গিয়েছে। ছায়াতে বসলে ভালো লাগে, না হলে বেশ তাপ।

আমাদের কোনও কাজ নেই। দফায় দফায় খাওয়া এবং চারদিকের অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করা। গ্রিসকে জল থেকে দেখাই সবচেয়ে ভালো।

গৃহিণী প্রাতরাশ খেতে ডাকলেন। তিনিও স্বামীর মতো জাহাজে সময় কাটাতে ভালোবাসেন। ওদিকে পাকা গৃহিণী, সবার সুখ সুবিধার ওপর নজর আছে।

জলে সারাদিন কাটিয়ে সন্ধ্যার সময় এথেন্স পৌঁছলাম।

আরও সাতদিন থাকতে হল ক্যানারিশদের বাড়িতে বিশেষ অনুরোধে। সেখান থেকে প্রায় রোজই একেকদিকে ঘুরে বেড়ালাম।

ক্যানারিশকে বলে পোর্ট সৈয়দগামী একটা জাহাজে ডেক প্যাসেঞ্জার হয়ে আফ্রিকায় নামব ঠিক করেছিলাম। এক সপ্তাহ পরে খবর এল একটা ছোট জাহাজ পোর্ট সৈয়দ যাবে। গণতন্ত্রের আদি পীঠস্থান গ্রিস ছেড়ে চললাম অনিশ্চিত এবং বিপদসঙ্কুল আফ্রিকায়। ইচ্ছা আছে কায়রো থেকে কেপ টাউন পর্যন্ত যাবার। কিন্তু রাস্তা নেই, নদীর ওপর বেশিরভাগ জায়গায় ব্রিজ নেই, তাছাড়া হিংস্র বন্যজন্তুর হাতে মৃত্যুর সম্ভাবনা যথেষ্ট। মানুষও নাকি হিংস্র প্রকৃতির। শেষের কথাটা আমি বিশ্বাস করতাম না। ভাষা না জানার ফলে এবং ভুল বোঝাবুঝির জন্য অনেক সময় উপজাতিদের সঙ্গে বহির্জগতের লোকের সংঘর্ষ ঘটে। এটা এড়ানো যায় যদি মনে ঘুণার বদলে ভালোবাসা নিয়ে এদের কাছে এগনো যায়।

ক্যানারিশরা খুব আপনার লোকেদের মতো ব্যবহার করছিল আমার প্রতি। তাদের বিদায় দিয়ে জাহাজে উঠলাম। পোর্ট সৈয়দ মাত্র ১৬ ঘণ্টার পথ।

সন্ধ্যার সময় লেসেন্সের প্রস্তর মূর্তির সামনে দিয়ে জাহাজটা বন্দরে ঢুকল। পোর্ট সৈয়দ আলোয় আলোকময়। প্রথমেই নজর পড়ল ভারতবর্ষের চা বিক্রেতা ব্রুকবন্ডের মস্ত বড় বিজ্ঞাপন। তাইতেই মনে হল যেন আমার ও ভারতবর্ষের মাঝখানে যোগসূত্রের মতো সেটা দাঁড়িয়ে।

পোর্ট সৈয়দে জাহাজ থামে। প্যাসেঞ্জাররা নামে ওঠে। ডাঙার ওপর চলাফেরা করে জড়তা কাটায়, আমোদ-প্রমোদ করে। এখানে ইংরেজের প্রভুত্ব সর্বত্র। এখানকার লোকেরা নৌকো ভর্তি মিশরীয় নানা জিনিসের পসরা নিয়ে বড় জাহাজের কাছে যায় এবং কেনাবেচা করে। উটের চামড়ার বাক্স, বসবার মোড়া, ব্যাগ ইত্যাদি খুব সস্তা দরে পাওয়া যায়। এখানে বিশেষ দ্রষ্টব্য হল ফরাসি ইঞ্জিনিয়ার ফার্দিনান্দ লেসেপসের অক্ষয় কীর্তি সুয়েজ ক্যানাল— ইউরোপ ও এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে যাতায়াতের একমাত্র পথ। আগে জাহাজ যেত কেপ অব গুড হোপ হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে। তাতে অনেক সময় নষ্ট হত এবং খরচও পড়ত অনেক বেশি।

জাহাজ চলাচলের ফলে কোম্পানির বেশ মোটা টাকা লাভ হয়। সুয়েজ খাল কোম্পানির অংশীদাররা বেশিরভাগ ইংরেজ ও কিছু ফরাসি। ইংরেজের শোষণ নীতি অবাধে চলছে।

স্টুডেন্টস হস্টেলে তাঁবু ফেললাম। ছেলেদের একত্র করে একদিন আমার ভ্রমণকাহিনী বললাম। তাতে কিছু আয় হল। শিক্ষকরা বললেন যে তাঁরা কখনও শিক্ষিত ও অ্যাডভেঞ্চারাস ভারতীয় দেখেননি— গান্ধীজির নাম শুনেছেন।

পোর্ট সৈয়দ থেকে কায়রোর পথ খুব সুন্দর পিচে ঢাকা। তিনদিনের মধ্যে মিশরের রাজধানীতে পৌঁছলাম। উঠলাম ওয়াই এম সি এ-তে। ম্যানেজার খুব ভদ্র খ্রিস্টান। তিনি মিশরীয়। মনে হল কায়রো শহরটা বেশ বড়। তবে যেমন মাছি, তেমনই গরম। দুপা বাড়ালেই বহু প্রকাণ্ড মসজিদের ডোম ও মিনারেট দেখা যায় কায়রোতে।

ওয়াই এম সি এ-র এক সভ্যর সঙ্গে আলাপ হল। নাম মিঃ ইয়ুনুশ, দূর সম্পর্কে সে মুক্তিযোদ্ধা জগলুল পাশার আত্মীয়। খেলাধুলায় ইয়ুনুশের খুব ঝোঁক। টেবিল টেনিস, ফুটবল তার প্রিয় খেলা। কলেজের হয়ে দুটো খেলাতেই সে পারদর্শিতা দেখিয়েছে।

কায়রোর রাস্তা সব কলকাতার মতো। সরু, ট্যারা-বাঁকা তার মধ্যে ইলেক্ট্রিকের গোছা গোছা তার, মনে হয় শহরে জাল ফেলেছে। একেকটা পাড়ায় বড়বাজারের মতো বড় বাড়ি ও সঙ্কীর্ণ পথ। মেয়েরা ভূতের মতো বোরখা পরে দোকান বাজার করছে। বোরখা আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না। মনে হয় পুরুষের নারীর প্রতি কী অমানুষিক দুর্ব্যবহার। তারা চায় বলেই তো মেয়েরা পর্দার আড়ালে থাকে।

তুর্কিতে দেখেছি কামাল পাশার সময় বোরখা তুলে দেওয়া হল। পুরুষদের চারটে বিয়ে উঠে গেল। সভ্য জগতের সঙ্গে একতালে এক বিবাহ প্রতিষ্ঠিত হল। অন্য মুসলিম দেশ তার অনুকরণ করল না। ধর্মের দোহাই দিয়ে মেয়েদের ওপর কঠিন অবিচার চালু রেখেছে সব মুসলিম দেশ। সে রকম ক্ষমতাপন্ন মুসলমান স্ত্রী নেত্রীও কেউ জন্মায়নি যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে দেশের মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করতে পারে। বোরখার মধ্যে থেকে স্ত্রী জাতির পক্ষে মাথা তোলা খুব কঠিন। মিশরীয় স্ত্রী লোকেরা বিদেশি মেয়েদের স্বাধীনতা দেখে নিশ্চয় বোরখাকে ঘৃণা করে, কিন্তু ছাড়বার সাহস নেই।

মেয়েদের কলেজে গেলাম। সেখানে বড় মেয়েরা বোরখা ফেলে খেলাধুলা করছে। কলেজের বাইরে বেরোলেই নিজেকে ঢেকে ফেলবে। গরম দেশে কী ভীষণ কষ্ট হয়, সে কথা কেউ চিন্তা করে না। অন্যায় চলেছে— চলছে।

এদেশে নেতা হবার জন্য সবাই ধর্মের দোহাই দেয়। আর তার জন্য সমাজে যা ঘৃণ্য, যা অন্যায়, কোরানের নামে তা পাকাপাকি বন্দোবস্ত হয়ে দাঁড়ায়। ধর্ম বাদ দিয়ে এখানে রাজনীতি হয় না অথচ ধর্মের মূল আদর্শ গ্রহণ করবার আগ্রহ কম লোকেরই আছে।

এখানে মস্ত আরবি শিক্ষাকেন্দ্র, বহু লোক পড়াশুনা করতে আসে। আমাদের দেশের নেতা, আবুল কালাম আজাদ কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষায় গবেষণা করতেন।

মসজিদের স্থাপত্য মোটামুটি এক ধরনের। ডোম, মিনারেট এবং নমাজের জন্য মস্ত হল কিংবা খোলা চত্বর। আমাদের দেশে জুমা মসজিদ দেখার পর আর কোনও মসজিদ চোখে লাগে না। কাচ দিয়ে মোজেকের কাজ প্রায় দেখা যায়। মসজিদের ভেতরে কিছু দেখবার থাকে না। যা কিছু দ্রষ্টব্য সব বাইরে। রাস্তায় সর্বত্র লোকারণ্য। জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে তীব্রগতিতে। তারা সব শহরেই থাকে। শহরের বাইরে মরুভূমি, গ্রাম নেই বললেই চলে।

বালির দেশে একমাত্র সান্ত্বনা হল নাইল নদী। নদী দীর্ঘ, চওড়া। নদীতে পান্নার মতো সবুজ রংয়ের পরিষ্কার জল; দক্ষিণে ভিক্টোরিয়া হ্রদ থেকে উত্তরে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বয়ে চলেছে। এই নদীর দুধারে শত শত মাইল জুড়ে চাষবাস হয়। এদেশের কাপাস তুলো বিখ্যাত, সারা পৃথিবীতে তার রপ্তানি চলে। মাল নিয়ে দূর জায়গায় অল্প খরচায় যাওয়া সোজা জলপথে। পাল তোলা নৌকো যাতায়াত করছে।

ইজিপ্টের পুরনো নাম মিশর। মিশরের সভ্যতা খুব প্রাচীন। যীশু জন্মাবার প্রায় তিন হাজার বছর আগে মিশরের যে সভ্যতা ও সংস্কৃতি ছিল তার অনেক অনেক স্বাক্ষর আজও পাওয়া যায়। পাথরের গায়ে খোদাই করে মিশরের রাজারা অনেক জ্ঞান ও বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। তাঁরা পশু, পাখি ইত্যাদি পূজা করতেন। অসংখ্য পশুকে পাথরের ভাস্কর্য দ্বারা চিরন্তন করেছেন। ভাস্কর্য এত উঁচু স্তরের যে না দেখলে বিশ্বাস হয় না।

হাজার হাজার বছর আগে এই দেশে পিরামিড তৈরি হয়েছিল। পিরামিড পৃথিবীর মধ্যে এক আশ্চর্য স্থাপত্য-নৈপুণ্যের পরিচয় দেয়। যখন ক্রেন ছিল না, তখন যে কেমন করে তারা বিরাট, বিরাট গ্র্যানাইট চতুষ্কোণ পাথরকে উঁচুতে নিয়ে গিয়ে যথাস্থানে বসিয়েছে নিখুঁতভাবে! তিনটে বিরাট পিরামিড ছাড়া ছোট পিরামিডও আছে অনেক। দেখা যায় তার নিচে তৎকালীন রাজা রানিদের মরদেহ যত্নে রাখা হত মমি করবার পরে। মৃত্যুর পর দেহের বিনাশ বন্ধ করবার জন্য মিশরীয় লোকেরা মমি করত। পৃথিবীর আর কোথাও এ বিদ্যা জানা নেই।

১৯২০ সাল নাগাদ একদল ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদ মিশরে ভ্যালি অব দি কিংস-এ একটা পিরামিডের নিচে খুঁজতে খুঁজতে রাজা তুতেনখামেন ও তাঁর স্ত্রী নেফারতিতির দেহ বার করে। মাটির নিচে একটা দরজা। সেটা খুললে একটা প্রশস্ত হল ঘর। তার মাঝখানে খুব সাজসজ্জা। রাজবেশে ভূষিত মমি, তার চারপাশে রাজা কিংবা রানির দৈনিক ব্যবহারের জিনিস, এমনকী সোনার গয়না, ধনরত্ন ও প্রসাধনের সব জিনিস দেহের চারদিকে সাজিয়ে রাখা থাকত।

শোনা যায়, দরজার ওপর নাকি লেখা ছিল ‘তুমি দরজা খুলবে না এবং যাঁরা চিরশান্তি উপভোগ করছেন তাঁদের তুমি বিরক্ত করবে না বা কোনও উপদ্রব করবে না। যদি কর তো মৃত্যু অনিবার্য।’

ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদদের নেতা মিঃ হাওয়ার্ড কার্টার সেই লেখা অগ্রাহ্য করে দরজা খোলেন। তখন দেখা গেল একটা মস্ত ভোমরার মতো কালো কীট উড়ে এসে হাওয়ার্ডের ঘাড়ে কামড়ে চলে গেল। সেই বিষাক্ত কীটের কামড়েই নাকি হাওয়ার্ড প্রাণ হারান।

রাজা দ্বিতীয় রামেসিসের মরদেহ মাটির গভীর থেকে তুলে প্রত্নতত্ত্ববিদরা মিশরের রহস্য উদঘাটন করার চেষ্টা করেছেন। এ সব মমি যীশুখ্রিস্টের জন্মের ২,৫০০-৩,০০০ বছর আগেকার।

বলা যায় না কতকাল ধরে দুষ্কৃতকারীরা মাটির নিচে সমাধি সব খুঁড়ে যুগ যুগ ধরে লুট করেছে।

ইজিপসিয়ান মিউজিয়াম দেখতে গেলাম। বার্লিন মিউজিয়ামের চেয়ে এটা সমৃদ্ধ। বর্তমান ইজিপসিয়ানরা আগেকার মিশরের গৌরবময় ইতিহাস সম্বন্ধে হুঁশিয়ার ছিল না। যার ফলে জার্মান ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদরা ইজিপ্ট লুট করেছে বহু বছর ধরে। পশ্চিমের বহু ধনীর বাড়িগুলি মিশর ও চিনের অমূল্য জিনিসপত্রে সাজানো।

কায়রোর আল আজহার ইউনিভার্সিটিতে আমার ভ্রমণকাহিনী বলবার নিমন্ত্রণ পেলাম।

এদেশে এখন রাজতন্ত্র। রাজারা আরাম ও আমোদ আহ্লাদ নিয়েই ব্যস্ত— বিদেশি শাসকরা যা খুশি করছে। দুপকেট ভর্তি টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছে দেশে।

প্রথম মহাযুদ্ধে তুর্কি জার্মানির দলে যোগ দিয়েছিল। ইজিপ্ট ছিল তুর্কি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। তুর্কি যখন যুদ্ধে হারল, ইংরেজ ইজিপ্ট অধিকার করল। এমনভাবে ইংরেজের মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। তুর্কির অধীন দেশগুলি কিছু ফরাসি ও

বেশিরভাগ ইংরেজ ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিল।

একজন ইজিপসিয়ান, জগলুল পাশা ইংরেজের বিরুদ্ধে সমস্ত দেশকে উদ্বুদ্ধ করছেন। তিনি দেশবাসীকে বলছেন মিশরকে স্বাধীন করতে হবে, শোষণনীতি বন্ধ করতে হবে। পাশার কপালে অনেক দুঃখ ও কারাবরণ ছিল। তবু বহু লোক তাঁর উদ্দীপনাপূর্ণ বক্তৃতা শুনে দেশপ্রেমের মূল্য বুঝেছে। ছাত্ররা সব একজোট হয়ে জগলুলকে সমর্থন করে। একটি লোকের ক্ষীণ স্বরের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে হাজার কণ্ঠে, আমাদের দেশে যেমন গান্ধীজি, চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে জনতা হাত মিলিয়েছে আর তাইতে ব্রিটিশ সিংহাসন টলমল করছে। এদেশেও সে অবস্থা হতে বেশি দেরি নেই।

মিঃ ইয়ুনুশের বাড়ি গতকাল নেমন্তন্ন ছিল। খ্রিস্টান বলে ইয়ুনুশ অনেকাংশে আধুনিক, ভূরিভোজ খাওয়াল। দুঃখের বিষয় কফিতে পর্যন্ত উটের গায়ের বোঁটকা গন্ধ। উটের দুধ দিয়ে কফি তৈরি হয় বলে এই গন্ধ এড়ানো যায় না। বহুদিন নাক টিপে খেয়েছি কিন্তু তবু উটের গন্ধ বরদাস্ত করতে পারি না। দুধ ছাড়া ঘন কফি আমার বেশি ভালো লাগে।

ওয়াই এম সি এ ও ইউনিভার্সিটিতে ভারতবর্ষের কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হল। আমার ভ্রমণকাহিনীও বললাম।

কায়রো ছেড়ে রওনা হলাম দক্ষিণে। রাস্তা ভালো। এত অসহ্য গরম যে কষ্ট হচ্ছিল। সাইকেল চালাবার সময় একটা গরম হাওয়া পাওয়া যায় কিন্তু থামলে অতিষ্ঠ লাগে।

দুদিন চলবার পর একেবারে ডানদিকে নুবিয়ার বিস্তীর্ণ দেশ জুড়ে বালির পাহাড় দেখলাম। এটা সাহারা মরুভূমির পূর্ব অংশ, দেশটার নাম সুদান। উটের ওপর চড়ে ছাড়া এ দেশের যাতায়াত করা যায় না। ১২০-১৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রা। মানুষ একটু ছায়া পাওয়ার জন্য ব্যাকুল। সুদানের লোকের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হচ্ছে। দুর্ধর্ষ জাতি।

ইসলামের অভ্যুদয়ের পর থেকে ইজিপ্ট, সুদান এবং পুরো উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকা মুসলমান হয়ে যায়। মোটামুটি আফ্রিকার মানুষকে দুভাগে ভাগ করা যায়। আফ্রিকার নানা উপজাতি ও মুসলমান সম্প্রদায়।

দেখতে দেখতে ৭০০ মাইল দক্ষিণে এসেছি। দিনে ৫০ মাইলের বেশি সাইকেল চালাতে পারছি না গরমের কষ্টে।

একদিন বিকালে নুবিয়ার মরুভূমিতে অস্পষ্ট দেখলাম দুটো সিংহ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। আচ্ছাদন ছাড়া বাইরে কোথাও রাত কাটানো যাবে না। এক্ষেত্রে কাপড়ের তাঁবু ফেলে শোওয়া বিপজ্জনক। সিংহের কোনও অভিজ্ঞতা আমার নেই। দেখামাত্র আক্রমণ করবে কিনা জানি না। বন্দুকটা হাতে নিয়ে চলতে আরম্ভ করলাম।

প্রায় আট মাইল চলবার পর আশ্রয় পেলাম এক মিশরীয় চাষীর কুঁড়ে ঘরে। সে বলল যে সিংহ সাধারণত আক্রমণ করে না মানুষকে, যদি মানুষ তার দিকে তেড়ে না যায়। অফুরন্ত জীবজন্তু আছে, তাদের জলাশয়ের ধারে জল খেতে গেলে ধরে খায়। মরুভূমি-প্রধান জায়গায় জন্তুরা জল না খেয়ে কেমন করে বেঁচে থাকে জানি না। দূরে দূরে জলাশয় আছে নিশ্চয়। সিংহের গায়ের বা লোমের রং এবং বালির রং একই খুব সহজে গা ঢাকা দিয়ে জলাশয়ের কাছে বসে থাকে।

মাঝে মাঝে দেখতাম ছোট ছোট গাছের ঝোপ, প্রাণপণে মরুভূমির প্রকোপ থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রেখেছে।

এগারো দিন পর আসওয়ান শহরে পৌঁছলাম। ইজিপ্টের সব শহর নাইল নদীর গা ঘেসে। আসওয়ান একেবারে দক্ষিণে। এক প্রকাণ্ড মন্দির নাইলের জলের ধারে। এটির বয়স অন্তত চার হাজার বছর, অনেক ভাস্কর্যে ভরা দেবদেবীর পাথরের মূর্তি। খুব নিখুঁত কাজ। যখন লোহা বা ইস্পাত আবিষ্কার হয়নি তখন কেমন করে বা কী দিয়ে এমন সূক্ষ্ম খোদাই করতে পেরেছিল পাথরের ওপর, আজ ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়। এটি পুরনো মিশরীয় শিল্পের একটি সেরা নিদর্শন।

আসওয়ানে তিনদিন বিশ্রাম নিলাম। বড় শহর। তুলোর প্রধান কেন্দ্ৰ। ঠিক পাশেই নাইল নদী বয়ে চলেছে। উত্তর ইজিপ্টের চেয়ে এ অঞ্চলের লোকেরা শান্ত প্রকৃতির।

আসওয়ান থেকে একশো মাইল দক্ষিণে চলেছি। সামনেই সুদানের দ্বিতীয় বড় শহর ওয়াদি-হাইফা। সুদান মস্ত বড় দেশ। ইজিপ্টের দ্বিগুণের চেয়ে বেশি জমি। কিন্তু মরুভূমির চাপ অর্থাৎ সাহারার প্রকোপ দেশটাকে বালুময় করে তুলেছে। ওয়াদি- হাইফায় উট আর উট। মাটির তৈরি দোতলা ঘরবাড়ি। মরুভূমির উপযুক্ত নানা রকম জিনিসের কারবারের জন্য বহু লোকের এই শহরে আনাগোনা।

নদীর ধারে তুলোর চাষ পুরোদমে চলে। মিশরের মতো সুদানের তুলোরও খুব সুনাম আছে। বিদেশে রপ্তানি করে জাতীয় আয় বৃদ্ধি করা হয়। নানা দেশে উটও সরবরাহ করা হয় চাষের জন্য ও মাংসের জন্য।

সামনে কঠিন পরীক্ষা আসছে। রাস্তা খারাপ হতে আরম্ভ করেছে, কাঁচা মেঠো পথ যদিও চওড়া। এদিকে কোনও যানবাহন চলে না। বন্য আফ্রিকা বলতে যা বোঝায় তা এখান থেকে শুরু। পথে জনমানব দেখলাম না। পঞ্চাশ মাইল অতি কষ্টে যাবার পর একটা ছোট গ্রাম পেলাম। এখানে অনেক লোক জড়ো হয়েছে জরিপের কাজ করবার জন্য। আরও কিছুদূরে রেল পাতার কাজ শুরু হয়েছে দেখলাম।

ইংরেজের মতলব কায়রো থেকে কেপটাউন পর্যন্ত রেলপথ সংযোগ করবে। অনেকটা কাজ এগিয়েছে কিন্তু প্রকাণ্ড বাধা পাচ্ছে, বুনো হিংস্র জন্তুর কাছে।

রেলওয়ে লাইন পাতা কেবলই বাধা পাচ্ছে হাতি ও সিংহের অত্যাচারে। একজন রেলকর্মী বলল যে সে কাজে ইস্তফা দিয়েছে। সিংহ তাকে তাড়া করেছিল, ধরতে না পেরে আরেকজন কর্মীকে মুখে তুলে নিয়ে চলে গেল। কাজ করবে না ঠিক করেছে। কর্তৃপক্ষ অগত্যা বন্দুকধারী গার্ড রাখবার ব্যবস্থা করল। তা সত্ত্বেও লোক মারা পড়ত মাঝে মাঝে।

.

রেললাইন পাতার কাজ বন্ধ রইল বেশ কিছুদিন। অবশেষে ঠিক হল যে চারদিকে আগুনের পরিখা করে তার মধ্যে লোকজন কাজ করবে। একে গরমের দেশ তার ওপর চারদিকে আগুনের মধ্যে রেললাইন পাততে লোকেদের খুবই কষ্ট

ইতিমধ্যে একদল হাতি এল, কালান্তক যমের মতো প্রকাণ্ড। খাবার গুদাম ভেঙে চাল ডাল খেয়ে রাত্রে চলে গেল। আবার রসদ জোগাড় করতে লোক ছুটল। রেল কর্তৃপক্ষ বিপর্যস্ত। তারা সহজে কাজ ছেড়ে দেবার লোক নয়। অনেক বন্দুক আমদানি করা হল এবং ছোটখাটো আর্মি তৈরি হল। সিংহকে ঠেকিয়ে রাখা গেছে শেষ পর্যন্ত। আবার রেললাইন পাতার কাজে লোকজন যোগ দিয়েছে।

তাতে আমার দুঃখ ঘুচল না। পথে যদি একাধিক হাতি কিংবা সিংহ দাঁড়িয়ে থাকে তো আমার পথ বন্ধ। কবে রাস্তা ছাড়বে ও আমি এগোতে পারব, তার স্থিরতা নেই।

রাত্রে একটা মাশাইদের গোল মাটির ঘরে শোবার স্থান পেলাম। পরদিন রওনা হয়ে গেলাম। পথে জেব্রা, জিরাফ, গ্লু ইত্যাদি দেখতে দেখতে চলেছি। মনে মনে জানতাম যে সিংহ কাছেই কোথাও আছে। এই জীবগুলোকে খেয়েই তারা বেঁচে আছে।

রাস্তা মোটেই ভালো নয়। দিনের পর দিন চলেছি, খুব একা মনে হয়। লোকজন দেখাই যায় না। দেশটা বিরাট। ভারতবর্ষের চেয়ে বহুগুণ বড়, গরম খুব। সঙ্গে যা খাবার এনেছিলাম সব ফুরিয়ে গেল। একটা গ্রামে উপস্থিত হলাম। গ্রামে বেশ কয়েক ঘর লোকের বাস। একটা দোকান আছে— সব নাকি পাওয়া যায়। গিয়ে দেখি আমার নিজের দেশের একজন লোক সেই দোকানের মালিক। বলা বাহুল্য যে আমি ভারতীয় একজনকে দেখে যেমন আশ্চর্য হয়েছিলাম, সেও তেমনই অবাক হয়ে আমাকে দেখছিল। দোকানির নাম মোহনলাল দেশাই। বয়স ৪৫, বোম্বাই থেকে জাহাজে মোম্বাসা পৌঁছেছিল ভাগ্য অন্বেষণে। তারপর পনেরো বছর ধরে নানা রকম কাজ করেছে। টাকা জমিয়ে দোকান করেছে এই সুদূরে।

মোহনলাল তার বাড়িতে আমাকে আতিথ্য গ্রহণ করতে বলল। সে পরিষ্কার দুটো ভাষাই বলে। সহেলি ও মাশাই। একজন কর্মচারীকে বাড়িতে পাঠাল দুকাপ চা আনার জন্য। গুজরাটি চা হলেও চা, বহুদিন পরে তৃপ্তি করে খেলাম।

মোহনলাল জিনিস কেনাবেচা করছিল। সন্ধ্যার পর কেউ দোকানে আসে না, এজন্য সকাল সকাল দোকানপাট বন্ধ করে আমাকে নিয়ে দেশাই বাড়ি গেল। বাড়িটা বেশি দূরে নয়। আমাদের দেশের আটচালা ধরনের, আফ্রিকানদের মতো গোল মাটির বাড়ি নয়।

আমি গুজরাতি ভাষা বুঝতে পারি। দেশাই-গৃহিণী ইংরিজি জানেন না। তাই হিন্দিতে শুরু করলাম ‘নমস্তে’ বলে। দেশাই আমার পরিচয় দিয়ে বলল আমাকে তাদের সঙ্গে দুয়েকদিন থাকবার নেমন্তন্ন জানিয়েছে।

সূর্যাস্তের পর অন্ধকার ও ঠান্ডা নেমে আসে। দিনেরবেলায় যত কষ্ট হোক, রাত্তিরটা আরামের

দেশাই বলল, তার একটি ছেলে আছে, বিলাতে ‘সেভেন ওকসে’ পড়াশোনা করে। বয়েস তেরো। খুব ইচ্ছা যে ছেলে ডাক্তার হয়ে আফ্রিকায় প্র্যাক্টিস করে।

মোহনলালের বাড়ির সংলগ্ন প্রকাণ্ড এক গুদাম ঘর। বহু টাকার হাতির দাঁত, নানা রকম চামড়া ও পাথর সংগ্রহ করা আছে সেখানে। অন্যদিকে মনিহারী জিনিসপত্র, চাল, ডাল, মশলা ইত্যাদি। দেখলেই বোঝা যায় বেশ পয়সাওয়ালা লোক। একটা ছোট লরি আছে, নানাদিকে মালবোঝাই করে পাঠানো হয়। এক মাসের মতো টিনে ভর্তি পেট্রোল মজুত আছে। আশপাশে দশটা গ্রামে উপজাতিরা কম কাপড় পরে, তবু যেটুকু দরকার সব মোহনলালের দোকানেই পাওয়া যায়।

দেশাই আমাকে বলল যে পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকার সব জায়গায় দোকানদার এবং ব্যবসায়ী হচ্ছে ভারতীয়, বরং বলা উচিত গুজরাটি। তারা সবাই পয়সা করেছে খনিজ পদার্থ রপ্তানি করে। আফ্রিকার লোকেরা মনে হয় বেনে জাতিকে ঈর্ষা করে কিন্তু তাদের সাহায্য ছাড়াও তাদের জীবিকা নির্বাহ অসম্ভব।

সন্ধ্যার সময় দেশাইয়ের বাড়ির সামনে একদল উপজাতি গ্রাম থেকে এল আমাকে দেখতে। তাদের মধ্যে কর্তাব্যক্তি যে সে আসলে ওঝা। এদেশে খুব বিষাক্ত সাপ আছে। তারা কামড়ালে ওঝাকে ডাকে কিন্তু ওঝা বাঁচাতে পারে না। যখন বিষাক্ত নয়, এমন সাপ কামড়ায় তখন ওঝা খুব বাহাদুরি করে।

যা হোক ওঝা কেন জানি না আমাকে দেখে মন্তব্য করল যে আমি ভালো লোক। দেশাই অনুরোধ করল নাচ দেখাবার জন্য। নাচ সহজে হবার নয়। একপাত্র সোমরস আর তার সঙ্গে বড় ড্রাম চাই। দেশাই দুটোই বের করে দিল। এরা মাশাই উপজাতি। মহা উল্লাসে সবাই কোমর বাঁধতে শুরু করল।

মাশাইদের দীর্ঘ ঋজু দেহ। ড্রামের তালে তারা নাচতে আরম্ভ করল। খুব কসরৎ করে নাচবার সময়। দেখতে দেখতে মাশাই রমণীরা উপস্থিত হল। বেশ আনন্দের রোল বয়ে গেল।

যত সোমরসের মাত্রা বাড়ছে ততই নাচের লয়ও বাড়তে আরম্ভ করল। এরা এরকম সারারাত নাচে কিন্তু আমি সাইকেল চালিয়ে এবং বোঝা বয়ে ক্লান্ত। বললাম, রাত এগারোটার পর শুতে যাব। সবাইকে তাই বলা হল।

দুজন মাশাই যুবক দেশাইয়ের কাছে গিয়ে বলল যে তারা আমার সঙ্গে পৃথিবী ভ্রমণে যাবে। তাদের ইচ্ছা আমাকে বন্যজন্তুর হাতে থেকে রক্ষা করা, আমি বন্দুক দেখিয়ে বললাম আমার রক্ষী এই। তবু ধন্যবাদ জানালাম অনেক।

মাশাইদের প্রথম পরিচয়ে ভালো লাগল। ভাষা জানি না বলে অসুবিধা হচ্ছিল। দোভাষীর কাজ করছিল দেশাই।

দেশাইদের ছেড়ে দক্ষিণের রাস্তা ধরলাম। রাস্তা নামে মাত্র। মাঠের ওপর দিয়ে, ঝোপের পাশ দিয়ে যেখানে সেখানে চলেছে। তবে দিক ঠিক আছে, গাড়ি ঘোড়া বা মোটর চলে না। সেজন্য রাস্তার সমতল জায়গাটার ওপর বন্যজন্তু শুয়ে বসে বিশ্রাম করে।

সারাদিন সাইকেল চালিয়ে কত যে বুনো পশু ও পাখি দেখলাম তার ঠিক নেই। একজোড়া চিতা বাঘ আমাকে দেখে রাস্তা থেকে উঠে মাঠের দিকে হেলতে দুলতে চলে গেল। এদেশে এত বুনো গাই, ‘গু’ আছে যে পঙ্গপালের মতো দেখায়। মনে হয় পৃথিবীর সব জন্তুজানোয়ার এই দেশে জমা হয়েছে।

গণ্ডার দেখবার সুযোগ হল অনেক দূর থেকে। বাইনোকুলার দিয়ে দেখলাম চামড়ার রং কালচে। দুটো খড়্গা। আকৃতিতে আমাদের দেশের গণ্ডারের মতোই। শুনেছি এই গণ্ডার নাকি রাগীবাবুর মতো সব সময় ক্ষেপে থাকেন। ভীষণ জোরে ছুটতে পারে। এদের ঘাঁটাতে সিংহও সাহস পায় না, হাতি দূরে দূরে থাকে। আমি বন্দুক হাতে নিয়ে চলেছি। হাতির দল প্রায়ই দেখা যায়। হাতির এত বিরাট দেহ আগে কখনও দেখিনি। আমাদের দেশে সব চেয়ে বড় হাতি এখানের হাতির চেয়ে অনেক ছোট। মাথা ও কান দেখলে মনে হয় যেন একটা প্রকাণ্ড পাথর নড়ছে চড়ছে। দাঁতও তেমনই বড় বড়। একেকটা ছয় ফুট থেকে সাত ফুট লম্বা হবে। শুনেছি তার চেয়েও নাকি বড় হয়, তবে আমার নজরে পড়েনি।

আফ্রিকার হাতিকে পোষ মানানো যায় না, আমাদের দেশের হাতি মানুষের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে। হাতিকে লোকেরা কত কাজে লাগায়। পৃথিবীতে যত সাকার্স আছে সর্বত্র ভারতীয় হাতির দল খেলা দেখায়।

হাতির দাঁত অমূল্য। দাঁত দিয়ে নানা রকম গয়না ও সাজাবার জিনিস তৈরি হয়। পাশ্চাত্য দেশের শিকারিরা নির্মমভাবে হাতিকে গুলি করে মারে দাঁত পাবার জন্য। শুনলাম একজন জার্মান শিকারি বই লিখে গর্ব করেছে যে সে এক সপ্তাহে ২৫টা হাতি মেরেছে। এটা যে কত বড় অন্যায় তা বলা যায় না। এই হারে হাতি মারলে আফ্রিকার মতো মহাদেশ হাতিশূন্য হয়ে যাবে, ১০০ বছরের মধ্যে। শিকারিদের বাধা দেবার কেউ নেই। যার যত ইচ্ছা বন্যজন্তু সামান্য লাভের জন্য মেরে ফেলছে।

মাশাইরা ঢাল ও বর্শা দিয়ে সিংহ শিকার করে। ঢালটা গণ্ডারের চামড়ায় তৈরি। মাশাইদের মধ্যে নিয়ম আছে যে মাশাই যুবক যদি সিংহ মারতে পারে তবেই তাকে বিয়ে করবার উপযুক্ত বিবেচনা করা যাবে, না হলে নয়। বর্শা ও ঢাল নিয়ে সিংহ মারতে যাওয়ার মধ্যে সত্যিই সাহসের পরিচয় পাওয়া যায়। কোনও তরুণ, সিংহ মেরে তার ল্যাজটি ভাবী স্ত্রীকে উপহার দিলে বিয়ের প্রস্তাব পাকা হয়। পৃথিবীর অন্যত্র যদি এই শর্তে বিয়ে করতে হত তা হলে বেশিরভাগ যুবকের বিয়েই হত না।

সাধারণ মাশাই ও সিংহ পাশাপাশি বাস করে, কোনও বিরোধিতা নেই। যদি কোনও সিংহ দুষ্টবুদ্ধির বশে গরু ছাগল ইত্যাদি খেতে আরম্ভ করে তখনই মাশাইরা দল বেঁধে সেই উৎপাতকারী সিংহকে সরাবার জন্য ঢাল ও বর্শা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। দলটা গায়ে গায়ে লেগে প্রায় কুড়িজন থাকে এক লাইনে।

সিংহকে ঘিরে ফেলে আক্রমণ করে। লাইন তখন ধনুকের মতো বেঁকে যায়। সিংহ চকিতের মধ্যে পাল্টা আক্রমণ করে কিন্তু এইরকম সারবন্দী লোক দেখলে ঘাবড়ে যায়, কাকে কামড়ে ছিনিয়ে নেবে ঠিক করতে পারে না। দলের শেষের দুই পাশে বার বার ঝাঁপিয়ে লোক ধরবার চেষ্টা করে কিন্তু দল তৈরি থাকে। যাকে আক্রমণ করে তাকে ঘিরে অন্যরা চারদিক থেকে বর্শা হাতে এগিয়ে আসে এবং সিংহকে বারবার আঘাত করে। দলবদ্ধভাবে আক্রমণের ফলে মাশাইরা শেষ অবধি জয়ী হয়, সিংহের জীবনান্ত হয়।

বিশেষ ঘটা করে যখন মাশাই পুরুষেরা সাজগোজ করে, তখন কারও কারও কাঁধের ওপর সিংহের চামড়া থাকে। সিংহ মারবার পরের দৃশ্য হচ্ছে অসীম উল্লাস ও নৃত্য। মেয়েরাও যোগ দেয়।

সাধারণত চলাফেরার সময় মাশাইয়ের হাতে বর্শা কিংবা লম্বা লাঠি থাকে। জঙ্গলের নানা রকম জন্তু যেমন বুনো শুয়োর, সজারু, খরগোশ ইত্যাদি মেরে তারা খায়।

আমাদের দেশের আরেকটি জীব এখানে দেখলাম— শকুন। একেকটা গাছে বসে কিংবা মাথার ওপর আকাশে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। জন্তু প্রায়ই নানা কারণে মারা পড়ে, তখন শকুন সব চেটেপুটে সাফ করে খেয়ে ফেলে, পড়ে থাকে হাড় কখানা। হায়নাও প্রায়ই দেখতাম। তারাও কাজ করে শকুনের মতো।

আজ পর্যন্ত উটপাখি দেখলাম না। জিরাফ মাঝে মাঝে দেখেছি। মানুষ দেখলে ওই প্রকাণ্ডকায় জীব ছুটে পালায়। সামনের পা বড়ো ও পিছনের পা অনেক ছোট বলে ছোটবার সময় জিরাফকে খুব মজার দেখায়। আত্মরক্ষার জন্য সে বিপুল বিক্রমে লাথি ছুড়তে থাকে। লাথির এত জোর যে বেশিরভাগ জানোয়ার ঘায়েল হয়ে যাবে যদি লাগে।

মাশাইদের সঙ্গে একসঙ্গে থাকি। অল্প দু-চার কথা শিখেছি, বাকি আভাসে ইঙ্গিতে সারতাম। এরা গাছের শেকড় বেটে তা থেকে বার্লির মতো পানীয় তৈরি করে খায়। পুষ্টিকর নিশ্চয়ই। না হলে মাশাইদের এত সুন্দর, সুঠাম দেহ হত না।

ভোরবেলায় রওনা হলাম। দিনের উত্তাপ ভয়ানক বেশি। এদেশে গাছপালা কম। বড় গাছ আছে শিরীষের মতো দেখতে, কিন্তু পাতা বিরল। ভোরে চলাফেরার বিপদ হচ্ছে ছোট-বড় নানা রকম জন্তুর সামনে পড়তে হয়। রোদ ওঠার সঙ্গে তারা আশ্রয় নেয় যতক্ষণ না সূর্যদেব অস্তাচলে যান।

তখন ৬টা হবে। সাতটা অতিকায় হাতি কালো একটা ছোট পাহাড়ের মতো রাস্তার ধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আমি থমকে দাঁড়ালাম। আমার সাইকেলের ওপর জানোয়ারদের যত আক্রোশ। তারা এটা ভেঙে চুরমার করে দিতে চায়। হাতির ছোট ছোট চোখে মনে হয় সাইকেলের প্রতি আপত্তি জানাচ্ছে। আমি নাচার। আমার অতি পুরনো বিশ্বস্ত বাহনের ওপর অনাবশ্যক কটাক্ষ আমার মোটেই পছন্দ নয়।

হাতি যদি তেড়ে আসে সেই ভয়ে বন্দুক হাতে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম দুঘণ্টা, তারপর হাতি বাবাজিদের কী মনে হল জানি না, ধীর মন্থর গতিতে মাঠের দিকে চলে গেল আমাকে পথ ছেড়ে দিয়ে। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সাইকেলে উঠলাম।

আজ সারাদিন ধরে দামামা বাজছে। গুরুগম্ভীর শব্দ বহুদূর থেকে শোনা যায়। শুনেছি ড্রাম বাজিয়ে এক জায়গার লোক অন্য জায়গার লোকেদের সঙ্গে সাঙ্কেতিকভাবে কথা বলে। একটা বড় গ্রামে পৌঁছলাম। এটা পরবের দিন। সবাই অপেক্ষা করে আছে বিকালের জন্য। সোমরস পান করবে এবং সারারাত ধরে নাচবে ছেলেমেয়েরা।

লক্ষ করবার বিষয় হল যে উপজাতির মধ্যে স্ত্রী স্বাধীনতা যথেষ্ট রয়েছে। ছেলেরা সাধারণত কুঁড়ে, মেয়েরা যাবতীয় কাজ করে। ছোট ছেলেমেয়ে থাকলে তাকে খাসিয়ানীদের মতো পিঠে বেঁধে সারাক্ষণ কাজ করে যায়।

গ্রামে একটি মাত্র দোকান, সেটা এক গুজরাটির। এখানে আর আতিথ্য গ্রহণ না করে এক আফ্রিকান সর্দারের বাড়িতে উঠলাম। এদের ভাষা সহেলি, মাশাইদের থেকে এরা ভিন্ন রকমের দেখতে। জীবনপ্রণালী মোটামুটি এক রকমের।

স্ত্রীলোকেরা গায়ে কাপড় দেয় না যেমন আমাদের দেশে বহু উপজাতির মেয়েরা দেয় না। ছেলেমেয়ে বড় হলেও স্তন্যপান করে।

গ্রামের ধারে একটি সিংহ এসেছে এবং গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছে দূরের দিকে মুখ ফিরিয়ে, এইরকম ভাব যে গ্রামের জীবজন্তুতে তার কোনও স্পৃহা নেই। অনেকক্ষণ ধরে দূরবীন দিয়ে ভালো করে সিংহকে দেখতে লাগলাম। গ্রামের লোকেরা সিংহকে তাড়াচ্ছে না দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। সর্দার বলল যে যতক্ষণ সিংহ বাড়ির গরু, ছাগল, মুরগি গ্রাস না করে ততদিন সিংহের সঙ্গে কোনও বিরোধ নেই।

আকাশ মেঘলা, মনে হয় বৃষ্টি হবে। দূরের কালো মেঘ ছড়িয়ে পড়ছে। সর্দার বলল, সিংহের দিকে দেখতে, যেন তার দেহ থেকে তেল বা মোম বেরিয়ে ঘাড়ের ও গায়ের লোম ভিজিয়ে দিল। এই থেকে বোঝা যায় যে বৃষ্টি সুনিশ্চিত, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে বৃষ্টির আগে সিংহের গায়ে মোম দেখা যায়। সিংহের গলায় তো স্তূপাকার লোম। সেই লোম জলে ভিজলে ঠান্ডা লাগার সম্ভাবনা, এমনকী নিউমোনিয়াও হতে পারে সিংহের।

সিংহ থাকে তরুলতাহীন খোলা মাঠে। মাথার ওপর বৃষ্টির সময় আচ্ছাদন পাবার সম্ভাবনা নেই। সেইজন্য এই মোমের উদ্ভব, প্রকৃতিরই নাকি এই ব্যবস্থা। বৃষ্টির সময় গাছের নিচে যদি দাঁড়ায় তো টুপটাপ করে তার গায়ে জল পড়ে। এটা সিংহের খুবই অপছন্দ। তার চেয়ে খোলামেলায় দাঁড়ানো ভালো।

এদিকে লোকেরা মুসলমান নয়। এরাই আফ্রিকার আদিবাসী। এরা চিরকাল বন্যজন্তুর পাশাপাশি বিনা দ্বিধায় বাস করে এসেছে। কেউ কাউকে ভয় পায় না। জঙ্গলের জীবনের এই রীতি।

মাম্বা নামে একরকম বড় সাপ আছে, তাদের থেকে সবাই দূরে থাকে। সাংঘাতিক রকম বিষাক্ত সাপ। এত তাড়াতাড়ি চলে যে মনে হয় চরকিবাজি হচ্ছে।

আজ সারাদিন আমোদ আহ্লাদ, পান ভোজন ও নৃত্য বহু রাত পর্যন্ত চলবে। কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। সর্দার বলল যে নতুন ফসল উঠেছে এবং ফসল ভালো হয়েছে, সেজন্য সবাই একদিন আনন্দ প্রকাশ করে আমাদের দেশের নবান্নর মতো।

এই গ্রামের লোকেদের কোনও স্কুল নেই। কেউ লেখাপড়া ও বইয়ের ধার ধারে না। সব বিষয় লোকেরা সর্দারের শরণাপন্ন হয় এবং তার বিবেচনায় যা ঠিক হয় তা সবাই পালন করে।

কোনও গ্রামে হাসপাতাল নেই, ডাক্তারের ভীষণ অভাব। গ্রামের ওঝা আছে। অসুখ বিসুখে তার কথা মেনে চলতে হয়। আসলে এখানে যার পরমায়ুর জোর আছে সেই বেঁচে থাকবে। কোনও বাহাদুরি নেই মেডিসিন ম্যানের

আরও তিনদিন চলার পর মনে হল যতই এগোচ্ছি ততই বেশি সংখ্যক বন্যজন্তুর দেখা পাচ্ছি। আজ একটা নদী পার হলাম নৌকোয়। জলে অনেকগুলি হিপোপটেমাস ডুব দিচ্ছে, উঠছে। আমাদের নৌকোটা দেখে প্রকাণ্ড হাঁ করে জানিয়ে দিল যে নৌকো থেকে জলে পড়লে তাদের মধ্যাহ্নভোজন হবে। কুমিরের অভাব নেই। জল দেখে ইচ্ছা করছিল নদীতে ডুব দিয়ে আসি কিন্তু জলে নামে কার সাধ্য। আমি ভাবছিলাম কুমিরগুলো কেন হিপোদের খেয়ে শেষ করে দেয় না। নিশ্চয় হিপোর ভালো রকম আত্মরক্ষার ক্ষমতা আছে।

নদীর ওপারে নামতে গিয়ে দেখি একপাল গ্লু (গরুর মতো দেখতে, কিন্তু খবু বিশ্রী) জল খেতে নেমেছে। নৌকোয় চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া অন্য পথ নেই যতক্ষণ না সবাই জল খেয়ে চলে গেল। সৌভাগ্যক্রমে তারা মাঠের ওপর দিয়ে গেল আমার পথ ছেড়ে।

আরেকটি হিংস্র জীবের কাছ থেকে আমাকে দূরে এবং সাবধানে চলতে হল, তারা হল বেবুন। দলবেঁধে গাছে ও মাঠে ঘুরে বেড়ায়। মানুষকে আক্রমণ করতে দ্বিধা করে না। বেশিরভাগ বন্যজন্তু এদের ভয় পায়, এমনকী চিতাবাঘ পর্যন্ত। বেবুনের কামড় ভীষণ। ফলমূল, ফসল খায়, মাংস পেলে আরও খুশি। দলবেঁধে থাকে বলে সিংহ যতই ক্ষুধার্ত হোক, বেবুনদের ঘাঁটায় না। হয়তো চেষ্টা করলে একটা বেবুন ঘায়েল করতে পারবে কিন্তু তার বদলে প্রাণ যাবার সম্ভাবনা বেশি।

যত দক্ষিণে এগোচ্ছি ততই মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বন্যজন্তুদের মুক্তাঙ্গনের সম্মুখীন হচ্ছি। একটা উট পাখিকে ধরে ঘেরা জায়গায় রেখে দিয়েছে

একটা গ্রামে। পাখিটা এত বড় যে স্বচ্ছন্দে পিঠে মানুষকে বসিয়ে দূর-দূরান্তে নিয়ে যেতে পারে। বালির ওপর চলতে উটপাখির কোনও অসুবিধা নেই। এরা উড়তে পারে না, কিন্তু ডানার সাহায্যে ছোটবার সময় ঝড়ের বেগে এগিয়ে যেতে পারে।

এখন এসেছি জুবা নামে ছোট গ্রামে, সেখান থেকে ভিক্টোরিয়া হ্রদ মাত্র ১৮০ মাইল। সামনে উগান্ডা, বাঁয়ে কেনিয়া, ভিক্টোরিয়া হ্রদ পার হলেই ট্যাঙ্গানিকা, এখন ট্যানজানিয়া। দুমাইল দূরে লোকজন কাজ করছে রেললাইন বসাতে। আগুনের লাইনের ভেতর লাফ দিয়ে সিংহ মানুষকে তুলে নিয়ে গেছে তাই কদিন রেলের কাজ বন্ধ।

হঠাৎ রাস্তার সামনে দেখি একপাল সিংহ, সংখ্যায় এগারোটা, পথের ধারে গাছের ওপর এবং পথের ওপরে শুয়ে বসে রয়েছে। চমকে উঠলাম। বন্দুক খুলে হাতে নিলাম যদিও জানি সেটা আমাকে বাঁচাতে পারবে না যদি একাধিক সিংহ আক্রমণ করে। খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর স্থির করলাম যে পিছু হটে এক আদিবাসীর বাড়িতে আশ্রয় নেব। চারদিকে একটিও মানুষ দেখতে পেলাম না। বাড়িটা আসলে গরু ছাগল থাকার খোঁয়াড়। আমি গেটের ভেতরে ঢুকে বন্ধ করে দিলাম। সাইকেলের ঘন্টা শুনে দুজন লোক বেরিয়ে এল। তাদের বুঝিয়ে বললাম যে রাস্তার ওপর সিংহ রয়েছে। ওরা না উঠলে যাব কেমন করে। ওদের খেপিয়ে এগনো যাবে না।

লোক দুটি বোঝাল যে সিংহগুলি দুষ্ট প্রকৃতির। রেললাইন পাতার কাজে ব্যাপৃত লোকেদের ধরে এনে প্রায়ই ওই জায়গায় বসে খায়। আপাতত খোঁয়াড়ের ওপর ভীষণ আক্রোশ। তারা গরু ছাগল নিয়ে যাবার জন্য উপদ্রব করছে। সেদিন গরু ও ছাগলদের খোঁয়াড়ের বাইরে চরাতে নিয়ে যেতে পারেনি। আমারই অবস্থা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম যে কবে সিংহের দল সরে যাবে। লোক দুটি বলল, তার কোনও স্থিরতা নেই। দেখা যাচ্ছে দুটো সিংহী রোজ জন্তু ধরে নিয়ে আসছে এবং সিংহমশাইদের ভূরিভোজন করাচ্ছে। আজ একটা জেব্রা মেরেছে।

আমি আদিবাসীদের কাছে আশ্রয় চাইলাম। তারা বরং খুশি হল আমার কাছে বন্দুক আছে দেখে। আজ আমার অগ্রগতি মাত্র ২৩ মাইল। খোঁয়াড়ের গেটের পাশে বসে দেখতে লাগলাম সিংহের দল ওঠবার নাম করে কিনা।

সঙ্গে এক টিন মাছ ছিল, সেটা খুলে দুটি লোককে ভাগ দিলাম। তারা আমাকে গাব ফল খেতে দিল। সারাদিন বসে থাকলাম। অবস্থার কোনও পরিবর্তন হল না। সন্ধ্যার অন্ধকার হবার আগে খোঁয়াড়ের গেট বন্ধ করে যেখানে অন্য দুটি লোক বসেছিল তাদের কাছে গিয়ে বসলাম। গরুদের চরানো হয়নি। আজ তারা খিদেয় অস্থির হয়ে কেবলই ডাকছে সমস্বরে।

সারারাত ভালো ঘুম হল না। বন্দুক খুলে হাতে নিয়ে শুলাম। টের পাইনি কখন একটা সিংহ গেট পার হয়ে খোঁয়াড় থেকে একটা গরু ধরে নিয়ে চলে গেছে। সকালবেলায় সবই স্পষ্ট হল। দুটি লোক হায় হায় করতে লাগল। আমাকে গুলি করে সিংহ মারবার জন্য তাগিদ দিতে লাগল। আমি অতি কষ্টে বোঝালাম যে সিংহের দলকে একটা বন্দুক ঠেকাতে পারবে না, হয়তো আমাদের সবার তার ফলে প্রাণ যাবে।

পরদিন চুপচাপ বসে দেখতে লাগলাম সিংহের মিটিং ভাঙল কিনা। কিন্তু নড়বার কোনও লক্ষণ দেখলাম না। মহা চিন্তায় পড়েছি। খোঁয়াড়ে বসে বসে সিংহের লাগাতার ধর্মঘট দেখব, না অন্য কিছু করবার আছে। ইতিমধ্যে একটা সিংহী মরে গেছে বলে মনে হল। দূরবীন দিয়ে দেখে বোঝা গেল সত্যিই আমাকে যারা পীড়া দিচ্ছে তাদের মধ্যে একজনের জীবনান্ত ঘটেছে। মৃত সিংহীকে মাঝখানে রেখে অন্যরা শোকসভা আরম্ভ করল।

দুজন আদিবাসী বলল যে তারা উত্তরদিক দিয়ে ঘুরে গ্রামে যাবে এবং গরু মারার খবর দেবে। তারপর কর্তারা যা হোক ব্যবস্থা করবে। খোঁয়াড়ের বাইরে গরু বেরতে পারছে না বলে তারা অভুক্ত রয়েছে, অস্থির হয়ে চেঁচাচ্ছে। বড়জোর আরেকদিন তাদের ধরে রাখা যাবে, তারপর খোঁয়াড় খুলতেই হবে।

আমি আমার নিজের সমস্যা কিছুতেই সমাধান করতে পারছি না। এগোলে নিশ্চিত মৃত্যু। পিছনে ফিরলে আমার কার্যসিদ্ধি হবে না। ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত দেখতে যাবার খুবই ইচ্ছা, বিশেষ করে এত কাছে এসে গেছি যখন। হাজার হাজার বড় বড় পাখি দক্ষিণে যাচ্ছে। মনে হয় তারা ভিক্টোরিয়া হ্রদে থাকে।

খোঁয়াড়ে আমি একা বসে থাকলাম। পিছন দিকে দুজন আদিবাসী চলে গেল বশা হাতে গ্রামের দিকে। দুঘণ্টার পরে তিনজন লোক নিয়ে ফিরল, সবার হাতে বর্শা ও ঢাল। আগন্তুকরা সব দেখে বলল, এ পরিস্থিতিতে কিছু করা যাবে না। দলবদ্ধ সিংহকে তাড়াতে যাওয়ার ফল খারাপ হবে, এ বিষয় সবাই নিঃসন্দেহ। একটা সিংহী মরেছে, তাও স্পষ্ট বোঝা গেল।

ঠিক হল গ্রাম থেকে দূরের পথ দিয়ে গরুর খাবার এনে দেবে। খোঁয়াড় খোলা চলবে না কোনওমতেই। আমার জন্য ভাতসেদ্ধ এবং নুন দেবে বলে গেল। খোঁয়াড় দেখার জন্য আমাকে ধন্যবাদ দিল। আমি আশ্রয় পেয়েছি বলে আমারই ধন্যবাদ দেবার কথা।

আরও একটা দিন কাটল। সিংহরা মরা সিংহী থেকে খানিকটা দূরে গিয়ে বসল। হায়না ও শকুন নিজ নিজ কাজ করছে। আমি ভেবেছিলাম যে মৃতকে অন্য সিংহরা হয়তো খাবে কিন্তু তা হল না।

দুপুরবেলায় অনেক লোক খড় ও গরুর খাবার নিয়ে ফিরল। বর্শা ছিল সবার কাছে। গরুর একটা উপায় হল। আমার পথের কণ্টক কিন্তু সরল না। সিংহের দলের দিকে চেয়ে বসে থাকা ছাড়া আমার আর কাজ নেই।

তিনদিন এমনিভাবে কাটাবার পর আমাকে মনস্থির করতে হল। দক্ষিণে যাবার একটি মাত্র পথ, তাও আটকা। গ্রামের লোকেরা যখন উত্তরদিক দিয়ে বাড়ি গেল, আমিও তাদের সঙ্গ নিলাম যতক্ষণ পর্যন্ত সিংহের দৃষ্টির মধ্যে ছিলাম। তারপর তাদের বিদায় দিয়ে সাইকেলে উঠলাম ফিরতি পথে। ভিক্টোরিয়া হ্রদ দেখার শখ মিটল না। সুদানের পরিচিত পথ ধরলাম।

বারোদিন পরে আসওয়ানে পৌঁছে একটা স্টিমারে উঠলাম। সাতদিন পর আলেকজান্দ্রিয়া পৌঁছলাম জলপথে।

আলেকজান্দ্রিয়া ইজিপ্টের একটা বন্দর। একদিকে নাইল নদ, অন্যদিকে ভূমধ্যসাগর। এখানে জলের দুরকম রং স্পষ্ট দেখা যায়। নাইলের জল ফিকে সবুজ, ভূমধ্যসাগরের গাঢ় নীল জলে নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছে।

বিদেশি ও মিশরি বড়লোকদের সমুদ্রসৈকতে স্নানের ব্যবস্থা আছে। লাইনবন্দী ছোট ছোট নানা রঙের কাঠের ঘর। তার ভেতর কাপড় ছাড়ে।

এদেশ আলেকজান্ডার জয় করবার পর এই বন্দরের নাম রাখা হয় আলেকজান্দ্রিয়া। পশ্চিম দেশের উপকূলে একটা ছোট বন্দর আছে। একই কারণে তার নাম রাখা হয় ইস্কাট্রুন। তুর্কিতে ঢোকবার সময় আমরা ইস্কান্দ্রনে গিয়েছিলাম।

আলেকজান্দ্রিয়াতে অনেক গ্রিকের বাস। উত্তর মিশরের প্রায় সব শহরে গ্রিকরা আছে অল্পবিস্তর সংখ্যায়। গ্রিক ও মিশরি রমণীর সংমিশ্রণে যারা জন্মেছে তারা বেশ সুন্দর দেখতে।

এখানে সব কিছু পাওয়া যায়। অনেক টিনের খাবার সঙ্গে নিলাম। আমার কাঁধের ওপর, সাইকেলের ওপর এত বোঝা বইতে হয় যে ইচ্ছা থাকলেও আর মাল বইতে পারব না।

এবারে পশ্চিমে এগোতে শুরু করলাম লিবিয়ার মধ্যে। সমুদ্রের ধারে একটা রাস্তা বেনগাসি পর্যন্ত চলে গেছে। মাঝে মাঝে মরুভূমির বালি রাস্তা ঢেকে দিয়েছে। ভূমধ্যসাগর থেকে মৃদু বাতাস সব সময়ই বইছে। এটা আফ্রিকার শ্রেষ্ঠ বীর হানিবলের দেশ, যিনি দক্ষিণ ইউরোপ জয় করেছিলেন খ্রিস্ট জন্মাবার ২৪৮ বছর আগে। কার্থেজ থেকে তিনি স্পেন, দক্ষিণ ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ও ইতালি জয় করেন। বিরাট সৈন্য সমাবেশের সঙ্গে তাঁর অশ্বারোহী ও হাতির সাঁজোয়া বাহিনী ছিল। আল্পস ও পিরেনিস পার হবার সময় শীতে অনেকে মারা পড়ে!

পথে কার্থেজ গেলাম। আজও দুর্গ, প্রাসাদ ইত্যাদির ভগ্নাবস্থা অতীত গৌরবের সাক্ষ্য দিচ্ছে। পাথর দিয়ে সব তৈরি হয়েছিল বলে কালের কবলে পুরোপুরি যায়নি।

বেনগাসি আধুনিক শহর। দেখলেই বোঝা যায় যে ইউরোপের কাছে এসে যাচ্ছি। ভূমধ্যসাগর পার হলে ইতালি। এখানে ব্যবসাদার ও হোটেলের মালিক সব ইতালিয়ান।

দ্বিতীয় বড় শহর ট্রিপোলিতে পৌঁছলাম। এককালে সারা দেশটাকেই ট্রিপোলি বলা হত।

পশ্চিমে আরও একশো মাইল চলবার পর টিউনিস দেশের সীমানায় পৌঁছলাম। এটা ফরাসিদের অধীনে ছোট একটা দেশ, মুসলমান প্রধান।

টিউনিসের রাজধানীর নামও টিউনিস, চারদিকে ফরাসিরা ঘোরাফেরা করছে। টিউনিসিয়ান মেয়েরা বোরখা পরা। ফরাসিদের সঙ্গে টিউনিসবাসী মেয়েদের সংমিশ্রণ হয়েছে খুব। মিশ্র জাতের ছেলেমেয়েরা আরও সুশ্রী দেখতে। এ দেশের লোকেরা ইউরোপীয়দের মতো ফর্সা। ফরাসিরা রাজত্ব চালায়। টিউনিসের লোকেদের মধ্যে স্বাধীনতার চিন্তা এখনও আসেনি। তবে চিরদিন এমনই যাবে না। ছাত্ররা উচ্চ শিক্ষার জন্য ফ্রান্সে পড়তে যায়। তারাই একদিন স্বাধীনতা দাবি করবে যেমন আমার দেশের নেতারা করেছেন। স্বাধীন দেশে গেলে স্বাধীনতার মর্ম হৃদয়ঙ্গম হয় নিশ্চয়ই। ভারতবর্ষের বেশিরভাগ স্বাধীনতাকামী নেতা বিলেতে জীবনের একাংশ কাটিয়েছেন দেখা যায়।

টিউনিস শহর সমুদ্রের ওপর। উত্তরে ভূমধ্যসাগর অল্প পরিসর। অদূরে সিসিলি দ্বীপ দেখা যায়। আমি একটা মাঝারি ধরনের ফরাসি হোটেলে উঠেছি। হোটেলের মালিক ভালো লোক, সাদা কালোর পার্থক্য তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে আমার মনে হল না। একদিন ফরাসি দেশেও যাব শুনে সে খুব খুশি।

বন্দরে গিয়ে খোঁজ করলাম যদি ইউরোপগামী স্টিমার পাওয়া যায়। বেশি কষ্ট করতে হল না। একটা স্টিমার পেলাম টিউনিস থেকে সিসিলি দ্বীপের সিরাকিউস শহরে যায়, মাত্র ছয় ঘণ্টার পথ। ইতালির দক্ষিণে এই প্রকাণ্ড দ্বীপটি, ইতালিরই অংশবিশেষ। সিরাকিউস অতি প্রাচীন গ্রিক শহর। পথে মাল্টা দ্বীপ পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *