দুচাকায় দুনিয়া – ১৮

১৮

পরদিন টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। জাহাজ বন্দরে লাগল। লিজবেথের মা, বাবা ও দাদা তাকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছে। আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল।

আমি ও জেমস দুজনে একসঙ্গে ইওকোহামা বন্দরে নামলাম। জেমস সোজা একটা সাইকেল হ্যাভারস্যাক কিনতে গেল। আমরা একটা ছোট পরিষ্কার হোটেলে উঠলাম। আমার সঙ্গে যথেষ্ট টাকা আছে তাই রোজগারের দিকে মন নেই। খুব আশা যে খরচ করতে করতে সব টাকা ফুরোবার আগেই মা বাবার কাছে বাড়িতে পৌঁছে যাব।

জাপানি হোটেলে যেখানে বিদেশিরা থাকতে যায় এমন সব জায়গায় দুই রকম খাবার পাওয়া যায়। একটা জাপানি অন্যটাকে আমেরিকান বলা যায়।

তাইয়ো মারু জাহাজে একদিন জাপানি ডিনার হয়েছিল। সুকিয়াকি রান্নার নাম। চারজন মিলে একেকটি দল হল। প্রত্যেক দলের সামনে একটি কাঠকয়লা চুলা, মাংস ও সব্জি পরিপাটি করে কাটা। জাপানে খুব কাঠকয়লা ব্যবহার হয় রান্নার জন্য অথবা ঘর গরম করবার জন্য। আমাদের সয়াবিন সস দিল। একটি ফ্রক পরা জাপানি মেয়ে আমাদের কাছে এসে বুঝিয়ে দিল রান্নার প্রণালী। এত সোজা যে বলা যায় না।

উনুন ধরিয়ে সসপ্যানে সয়াবিন সস ঢেলে দিলাম। গরম হবার পর পাতলা করে কাটা মাংস ও সব্জি ছেড়ে দিলাম। ব্যস, আধঘণ্টার মধ্যে খানা তৈরি।

একটি জাপানি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তার নাম ওনো। আমি ডাকতাম ও ইয়েস বলে। শুনে মুক্তোর মতো দাঁত বের করে হাসত। যেদিন সুকিয়াকি ডিনার হল সেদিন ওনো একটা চমৎকার কিমোনো পরে, চুলের প্রসাধন অন্য রকম করে আমাদের সামনে উপস্থিত। তার চলা বদলে গিয়েছে। তাকে দেখলে কে বলবে যে আধঘণ্টা আগে সেই কর্মপটু ফ্রক পরা মেয়েটি আর কিমোনো পরা মেয়েটি একই।

কলে কারখানায় অফিসে লক্ষ লক্ষ মেয়ে কাজ করে, তারা মনে করে কিমোনো পরে তৎপর হওয়া যায় না। তাছাড়া কিমোনোর দাম এত বেশি হয়েছে যে ভাড়া করে কখনও সখনও ব্যবহার করা অনেক সুবিধা ও কম খরচের।

ইওকোহামা শহরে স্ত্রী-পুরুষের বেশভূষা একেবারে ইউরোপীয় বা আমেরিকান ধরনের।

জাপানে এমন কয়েকটি জিনিস লক্ষ করেছি যা অন্য দেশে নেই। জাপানিরা ভীষণ দেশপ্রেমিক হয়, ভদ্রতায় জাপানিকে কোনও জাত হারাতে পারবে না, ভাত দিয়ে কাঁচা মাছ খাওয়া, কর্মকুশলতা তাদের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে।

শেষোক্ত গুণটির জন্য জাপানিরা পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ জাতিদের মধ্যে উচ্চ স্থান অধিকার করেছে।

আমাদের হোটেলের সব জানলায় কাচের বদলে সাদা পার্চমেন্ট কাগজ দিয়ে ঢাকা। জাপানে খুব ভূমিকম্প হয়। সেজন্য কাচের জায়গায় কাগজের ব্যবহার বেশি। কাগজের ভেতর দিয়ে দেখা যায় না, কিন্তু বৃষ্টির জল আটকায়।

তিনদিন ইওকোহামায় সব দ্রষ্টব্য দেখে রওনা হলাম ফুজিয়ামার দিকে। জেমসের খুব ভালো লাগছে। এরকমভাবে দেশ দেখার উপকারিতা অনেক বেশি। নানা অবস্থার লোকের সঙ্গে একত্র থেকে যে জ্ঞান আহরণ করা যায় তার তুলনা হয় না।

খুব সকালে উঠে জানলা খুলে এক অপূর্ব দৃশ্য দেখলাম। ফুজিয়ামার চূড়ার একধারে কে যেন এক লরি আবির ঢেলে দিয়েছে। জেমসকে বললাম, তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠতে এবং জানলার কাছে আসতে। প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করবার জন্য ভোরে উঠতে হবে এটা জেমসের মনঃপূত নয়। সে সমস্ত বিছানা কম্বল মুড়ি দিয়ে জানলার কাছে এক মিনিট দাঁড়িয়ে ভেরি নাইস বলে আবার বিছানায় আশ্রয় নিল।

বরফের ওপর প্রভাতের প্রথম সূর্যরশ্মি পড়ে কত রকম রঙের বিচিত্র শোভা দেখাল। সকালে যেখানে হলুদ, লাল রং দেখেছি, রাত্রে চাঁদের আলোয় দেখলাম নীল, সাদা। এ আরেক রূপ, জাপানিরা ফুজিয়ামাকে পবিত্র মনে করে। কত গান, কবিতা, গল্প এই ফুজিকে অবলম্বন করে লেখা তার ইয়ত্তা নেই।

জাপান শীতপ্রধান দেশ। এশিয়ার উত্তরাঞ্চলে তার অবস্থান। চারদিকে সমুদ্র বলে শীত অপেক্ষাকৃত সহনীয়। ভৌগোলিক অবস্থা ইংল্যান্ডের সঙ্গে তুলনা করা চলে। দেশটার আশি ভাগ পাহাড়ে ভর্তি। বড় ছোট ৩,০০০ দ্বীপ মিলে জাপান দেশ। মাথাপিছু জায়গা খুব কম। সেজন্য সর্বত্রই মানুষের ভিড়। ১১২ মিলিয়ন লোকের বাস অথচ দেশটা গ্রেট ব্রিটেনের চেয়ে বড় নয়। চারদিকে বোঝা যায় স্থানাভাব। লোকেরা প্রাণপণ পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করে। তবে সবাই পরিপাটিভাবে ছোট ঘর, ছোট বাড়িতে থাকতে ভালোবাসে। জাপানিদের সৌন্দর্যবোধ দেখবার মতো। ঘরের কোথাও একটি ফুল, নয়তো আর্টের জিনিস রাখা আছে। সর্বোপরি নিয়মানুবর্তিতা জাপানির সহজাত, ট্রেন ছাড়বার বা আসবার সময়ের ব্যতিক্রম হতে পারবে না এতটুকু। সময়ের মূল্যবোধ যাতে বজায় থাকে তার জন্য সবাই ব্যস্ত।

জাপানের আরেক বৈশিষ্ট্য সৌজন্য প্রদর্শন। এতেও জাপানি অদ্বিতীয়। একজন আরেকজনকে সামনে হেঁট হয়ে অভিবাদন জানাল, পরমুহূর্তে অন্যজন হেঁট হয়ে তা স্বীকার করল। তারপর স্বীকারের পর স্বীকার এমনই চলতে থাকে। আমার মতো একজন যুবককে যখন বৃদ্ধরা বারবার হেঁট হয়ে সামনে নুয়ে নমস্কার জানাত আমি তখন প্রতি নমস্কার জানিয়ে মনে মনে বলতাম থামলে বাঁচি।

জাপানে সর্বত্র জাহাজ তৈরি করছে পুরোদমে। যেন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি চলছে। লোকেদের সঙ্গে যখন আলোচনা করছি যে জাপানিরা তো বৌদ্ধ, তবে যুদ্ধ ও হিংসার মনোবৃত্তি কেন। বেশিরভাগ লোক উত্তর দিত যে তারা যুদ্ধ বিগ্ৰহ চায় না, শান্তিতে থাকাই তাদের উদ্দেশ্য। একথাও স্বীকার করত যে আর্মি এখন গভর্নমেন্টের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে এবং তাদের খুশিমতো অনেক কিছু হচ্ছে সাধারণ মানুষের সমর্থন থাক, আর নাই থাক।

জায়গাটার নাম অমিয়ামাচি। কাওয়াগুচি হ্রদের ওপারে একটা জাপানিদের বাড়িতে আমাদের নেমন্তন্ন ছিল। জেমস ক্লান্ত হয়ে পড়েছে বলে আমার সঙ্গে গেল না, হোটেলে বসে তার অভিজ্ঞতা টাইপ করতে লাগল। যাদের বাড়ি যাচ্ছি তাদের বাড়ির মেয়ে আমাদের সঙ্গে এক জাহাজে তাইয়ো মারুতে প্রশান্ত মহাসাগর পার হয়েছিল। আগেই বলেছি তার নাম ওনো। আমাকে খুব আদরে গ্রহণ করলেন ওনোর বাবা এবং সেইসঙ্গে ওনো নিজে। তার মা নেই।

একদিন থাকব ঠিক করেছিলাম কিন্তু ওনো নাছোড়বান্দা। সে আমেরিকায় বিজনেস ম্যানেজমেন্ট শিখে এসেছে। শীঘ্রই টোকিওতে একটা কাজে যোগ দেবে। ওনোর সঙ্গে সাধারণ ইংরিজিতেই কথাবার্তা বলেছি। এত ভালো বিদেশি ভাষা বলতে পারে শুনে ওনোর বাবা খুব গর্বিত বোধ করছিলেন।

দুদিন ওনোর বাড়িতে থাকলাম। রোজ কয়েক মাইল দুজনে হেঁটেছি ফুজিয়ামার ছায়ায়। ওনো খুব ধর্মভাবাপন্ন। ভারতবর্ষ বুদ্ধের দেশ বলতে সে পঞ্চমুখ। খুব ইচ্ছা একদিন বুদ্ধের দেশে গিয়ে লুম্বিনি, গয়া, সারনাথ, সাঁচি দেখবার। আমি বলতে পারব না সে কখনও আমাদের দেশে এসেছিল কিনা। সে চিঠি লিখলেও আমি কখনও পাইনি।

পরদিন বিদায় নেবার সময় ওনোর বাবা বারবার হেঁট হয়ে আমাকে বিদায় জানালেন। আমিও তেমনই করলাম।

পাহাড়ের দেশ থেকে নিচে নামলাম। আমাদের গন্তব্যস্থল টোকিও, পৃথিবীর বৃহত্তম শহর। এগারো মিলিয়ন লোকের বাস। যে হারে লোকসংখ্যা বেড়ে চলেছে মনে হয় অল্পদিনের মধ্যে বারো মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে।

জেমস দুদিনে অনেক টাইপ করেছে বলল। বোধহয় একটা লেখবার মতো রসদ তার জোগাড় হয়ে গেছে।

টোকিও শহরে সিনজিকু-কু পাড়ার ছোট হোটেলে ফিরে এলাম। পরদিন মিকাডোর অর্থাৎ জাপানি সম্রাটের বাড়ি ও বাগান দেখতে গেলাম। সেখান থেকে গেলাম জাপানের বিখ্যাত জু দেখতে। তবু আমার কাছে কলকাতার জু অতুলনীয় মনে হয়। একজন বিখ্যাত ভারতীয়, রাসবিহারী বোসের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি খুব খুশি হয়ে আমাকে গ্রহণ করলেন এবং মধ্যাহ্নভোজের নেমন্তন্ন করলেন।

শ্রীবোসের কেক, পেস্ট্রি ইত্যাদি তৈরি করবার একটা উচ্চাঙ্গের কারখানা আছে। আমাদের দেশে ফ্লুরি ও ত্রিনকার মতো। সেই সঙ্গে তিনি একটা চা পানের রেস্তোরাঁ চালান। সুদূর টোকিওর একটা রেস্তোরাঁতে রবীন্দ্রনাথের বড় একটা অয়েল পেন্টিং দেখলাম। শ্রীরোস যদিও জাপানের বাসিন্দা এবং তাঁর স্ত্রী একজন বড় ঘরের জাপানি মহিলা, তিনি মনেপ্রাণে ভারতীয়। গান্ধীজির কথা, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার কথা এই মুক্তিযোদ্ধা বারবার জিজ্ঞাসা করলেন।

পরদিন কামাকুরাতে দাইবুতু অর্থাৎ ভাইবুদ্ধের বিরাট ব্রোঞ্জমূর্তি দেখতে গেলাম। সকলের মতো আমিও খালি পায়ে, শ্রদ্ধাবনত চিত্তে মূর্তির সামনে মাথা নিচু করে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম।

এবার রওনা হলাম দক্ষিণ পশ্চিম দিকে। জাপানের দ্বিতীয় বড় শহর, ওসাকাতে পৌঁছলাম। পথে মোটর গাড়ি ছাড়া অন্য যানবাহন নেই, আমেরিকার মতো। তবে সেখানে বাড়ি বড়, এখানে সব ছোট ছোট। ছোট বাড়ি, ছোট গাড়ি, ছোট ফার্নিচার এদেশের সাইজ অনুপাতেই স্টাইল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ওসাকায় বহু টেক্সটাইল কারখানা আছে। সমস্ত পৃথিবী জোড়া কাপড়ের কারবার। ভারতবর্ষ, চিন, আফ্রিকা ও সুদূর আমেরিকায় জাপানি কাপড় রপ্তানি হয়। একটা কারখানা দেখতে গেলাম। বেশিরভাগ মেয়েরা কাজ করছে। মেয়েদের মাইনে কম অথচ প্রাণপণ পরিশ্রম করতে পারে। কাজে সবারই আগ্রহ। খাবার জন্য আধঘণ্টা ছুটি। কারখানা কিন্তু চলতে থাকে। মেয়েরা পালা করে খেতে যায়। খাবার খুব সাধাসিধে। ভাত ও কাঁচা মাছ কিংবা কাঁচা সব্জি, ভাত খেয়ে মানুষের ভালো স্বাস্থ্য হতে পারে এবং সে কর্মঠ জীবন গড়তে পারে, এ ধারণা আমাদের দেশের লোকের নেই। যারা পরিশ্রমী তাদের কাছে ভাত পুষ্টিকর খাদ্য। কায়িক কাজকর্ম না করে লোকে যখন স্তূপাকারে ভাত খায় তখন উপকারের চেয়ে তার অপকার বেশি হয়।

রাতে থিয়েটার দেখতে গেলাম। তখন কোনও প্লে হবে না, কেননা চেরি ডান্সের বা মিইয়াকো ও দোরির সময় আরম্ভ। সেদিন প্রথম নাচ হবে। আমার অনেক কালের ইচ্ছা চেরি ডান্সে যাবার ও দেখবার, সেটা এবার অপ্রত্যাশিত ভাবে পূর্ণ হতে চলেছে।

জাপানি স্টেজ একটু অন্য ধরনের। স্টেজের দুপাশ দিয়ে সরু রাস্তা শ্রোতাদের মধ্যে অনেক দূর চলে গেছে। থিয়েটারে চেয়ার বেঞ্চ নেই। ফরাশ পাতা আছে, তার ওপর আমরা বসলাম।

চোখের সামনে দৃশ্য দেখলাম, কখনও ভুলতে পারব না। সমস্ত স্টেজভর্তি চেরি ফুল। অতি সুন্দর গোলাপি রং। আরও ফুল মাথায় ও সর্বাঙ্গে লাগিয়ে মেয়েরা নাচল। আমি যেন চেরি ব্লসমের রাজ্যে উপস্থিত হয়েছি।

মধ্যপথে আধঘণ্টা বিরতি। আমরা জাপানি প্রথায় চা খাবার নিমন্ত্রণ পেলাম। একটা হল ঘরে নিচু ছোট ছোট টেবিল পাতা আছে। তার এক পাশে বসলাম। একজন গে–সা মহিলা সুশ্রী, কিমোনো-পরা আমাদের সামনে এসে অভিবাদন জানালেন। মুখে যথেষ্ট ক্রিম ও পাউডার মাখা এবং কেশ প্রসাধন সনাতন প্রথায় ফুল দিয়ে সজ্জা, হাঁটু মুড়ে আমাদের সামনে বসলেন। তারপর চা তৈরি করতে প্রবৃত্ত হলেন। চা করার ধরন একেবারে চিরাচরিত, আমাদের হাতে ছোট ছোট কাপে দিলেন। দুধ নেই, চিনি নেই। তারপর গেসা মহিলা উঠে গেলেন এবং শীঘ্রই দুই বাটি জাপানি হালুয়া নিয়ে ফিরলেন। হালুয়া খেতে ভালো। চা হালকা বলে ভালোই লাগল, যদিও চিনি দুধ ছাড়া

গে-সা অল্প ইংরিজি বলতে পারেন। সেজন্য আমাদের টেবিলে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল। যুবতী ও সুন্দরী সে বিষয় সন্দেহ নেই। তবে অত মেকআপ মুখের ওপর নিষ্প্রয়োজন মনে হল। চায়ের সঙ্গে খুব হাসিও বিতরণ করলেন। কথায় কথায় থ্যাঙ্ক ইউ।

হালুয়া চা খাবার পর, গে-সা কাপ দুটি পরিপাটি করে ধুয়ে মুছে একটি কাপড়ে বেঁধে আমাদের হাতে দিলেন। এই সন্ধ্যার মিয়িয়াকো ও দোরি নাচ এবং চা অনুষ্ঠানের কথা মনে করিয়ে দেবে বলে। এই জাপানি প্রথাটি আমার বেশ ভালো লাগল।

ওসাকা থেকে নারাতে গেলাম। কোবে ও ওসাকা দুই ব্যস্ত শিল্প প্রধান শহরের মাঝখানে নারা। একেবারে কোলাহল শূন্য সুপ্ত পরিবেশে এই ধর্মস্থানটি অবস্থিত। যথেচ্ছ হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছোট ছোট মন্দিরের মতো পাথরের খোদাই করা স্তূপ পথের দুধারে রয়েছে। ভক্তরা তার মধ্যে বাতি বা প্রদীপ দেয়। জায়গাটার প্রতি মনে শ্রদ্ধা জাগে।

দুদিন নারাতে থেকে কোবে শহরে গেলাম। জাপানের প্রাচীনতম রাজধানী কিয়োটা শহর দেখে মুগ্ধ হলাম। এখানেও চেরি ডান্স আরম্ভ হয়েছে। কিয়োটোর মিনামিজ থিয়েটারে নো প্লে দেখতে পেলাম। নো প্লে শেষ হবার সময় সব নীরব নিস্তব্ধ হয়ে যায়। অভিনেতা, অভিনেত্রী ধীর পদক্ষেপ স্টেজের বাইরে চলে যায়। তখন মনে হয় যে গভীর ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়েছিল তা ধীরে ধীরে স্থির হয়ে গেল।

একটা চিত্রশালায় জাপানি পেন্টিং ইয়ামাটো-এ দেখতে গেলাম। জাপানিরা রঙের রাজা, এত সুন্দর রঙের এত সূক্ষ্ম ব্যবহার খুব কম দেখা যায়। পুরাকাল থেকে রঙের চাতুর্য জাপানি পেন্টিংয়ে দেখা গেছে। আজ কমার্শিয়াল আর্টের মধ্যেও তার পরিচয় পাওয়া যায়। একজন জাপানি যতই রং ব্যবহার করুক না কেন তার পেন্টিং কখনও বিসদৃশ দেখতে হয় না।

হিরোসিমায় পৌঁছে লিজবেথকে টেলিফোন করলাম। তারপর শেষবারের মতো বিদায় নিয়ে হিরোসিমা শহর দেখতে বেরোলাম। জেমসের খুব ভালো লেগেছে। দুদিন পরে কিউইস দ্বীপের দিকে এগোলাম। এই দ্বীপটি বিশেষভাবেই সৌন্দর্যমণ্ডিত। পথে মোজি বন্দরে খোঁজ করে জানলাম যে চারদিন পর একটা জাপানি জাহাজ চিনদেশে টিনসিন বন্দরের দিকে যাবে। জেমস ও আমি টিকিট কিনে অপেক্ষা করলাম। জাহাজের নাম হাকোনে মানু, বিশ হাজার টন ভারবাহী জাহাজ। এখানেও আমরা দুজন মাত্র যাত্রী।

সমুদ্রের উত্তাল অবস্থা। আমার কিছু আসে যায় না। সহজে সী সিকনেস আমাকে ধরে না। বস্তুত আমাকে কোনও দিনই ধরেনি। জেমস বিছানা নিয়েছে। অফিসারদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আমি খাই। আমার জন্য আমেরিকান প্ল্যানে খাবার তৈরি হত। যখন সমুদ্র অপেক্ষাকৃত শান্ত হল, জেমস শুকনো মুখে আমাদের সঙ্গে ডাইনিং হলে খেতে এল তিনদিন পরে।

আরও তিনদিন পর মহাচিনের বন্দরে টিনসিনে পৌঁছলাম। টিনসিন বড় শহর। পিকিং শহরের যাবতীয় আমদানি ও রপ্তানি হয় এখান থেকে।

প্রথমেই চোখে পড়ল লোকেদের দৈন্য দশা। মানুষেরা গাড়ি ঠেলছে। নোংরামি খুব। মনে হল শহরে ঝাঁটপাট কেউ দেয় না। একটা দুর্গন্ধ বাতাসে সব সময় ঘুরছে।

টিনসিনে দুদিন থেকে হাকোনে মানুর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। দুদিন পর পৌঁছলাম পিকিং। খুব বড় শহর। এই উত্তর দেশের চিনারা বেশ লম্বা। লোকেদের দারিদ্র্য সহজেই নজরে পড়ে। ওয়াই এম সি এ হস্টেলে উঠলাম। এখানে মস্ত আমেরিকান ইউনিভার্সিটি আছে। জেমস এক বন্ধুকে খুঁজে বের করল। তিনি ইংরিজির প্রফেসর। নাম মিস্টার বীভার।

ওয়াই এম সি এর হস্টেলে একজন ইংরেজ যুবকের সঙ্গে ভাব হল। নাম রজার্স সে মনেপ্রাণে চিন দেশকে ভালোবাসে। একটি চিনা মেয়েকে সে বিয়ে করতে চায়। রজার্স আমাদের পথপ্রদর্শক হতে চাইল। আমরা দুজনে খুশি মনে রাজি হলাম। পিকিংয়ে এত দেখবার জিনিস আছে যা দেখতে অনেক দিন সময় লাগে। প্রথমে শহরটা প্রদক্ষিণ করলাম। গরিব লোকেদের শীতের দিনেও মাথার ওপর আচ্ছাদন নেই। পার্কে সারারাত বেঞ্চে বসে কাটায়। গরম রাখবার জন্য খবরের কাগজ বুকে পিঠে বেঁধেছে এবং মাথার টুপি করেছে। কী অসহ্য কষ্টকর জীবন ভাবলেও কষ্ট হয়।

টেম্পল অব হেভেন শহরের বাইরে বারো মাইল দূরে। গালার কাজ ও মার্বেল দিয়ে এই আশ্চর্য মন্দিরটি তৈরি হয়েছে। আগেকার দিনে চিন সম্রাট সপরিবারে অথবা একা মাঝে মাঝে এই মন্দিরে আসতেন। পাল্কি বা ঝাঁপানের মতো ব্যবস্থা ছিল। অনেক লোকে মিলে বহন করে এই সুদীর্ঘ পথ আসত এবং যেত। রাস্তার দুধারের বাড়ির লোকেদের ওপর আগে থেকে কড়া হুকুম জারি হত, যাতে তারা পথে বার না হয়, এমনকী সম্রাটের দিকে চেয়ে দেখাও বারণ।

মন্দিরের কাছেই একটা সরোবর আছে, তার একদিকে মার্বেলের তৈরি এক দোতলা প্রকাণ্ড নৌকো। রাজ পরিবারের লোকেরা গরমের দিনে পুরাকালে নৌকোর ওপর বিহার করতেন— চায়ের আড্ডা বা পান ভোজনের ব্যবস্থা হত। মিং যুগের টুম্ব দুটো দেখবার মতো। এই সব দেখে আমার মনে হচ্ছিল যেন আগ্রা কিংবা ফতেপুর সিক্রি দেখতে গিয়েছি। এত সুন্দর কারুকার্য মার্বেলের ওপর কম দেখা যায়। নৌকো মার্বেলের হলেও ভাসমান।

চিনারা চারুকলায় পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ জাতি। তার নিদর্শন চারদিকে। ইউরোপ ও আমেরিকার বিত্তশালী লোকেদের বাড়ি ঠাসা চিনা কারুশিল্পের তৈরি অসংখ্য কাঠের, জেডের, অন্যান্য পাথরের কাজে যা, দেখলে মুগ্ধ হতে হয়। বড় বড় চিনা মাটির কাজের সূক্ষ্ম কারুকার্য ও বর্ণবৈচিত্র সত্যিই আশ্চর্য।

১৯১১ সালে যখন ইংরেজ ভারতবর্ষে দরবার করে পঞ্চম জর্জ সাম্রাজ্য বিস্তার সুদৃঢ় করেছেন ঠিক সেই সময় চিনের চার হাজার বছরের সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ল। সম্রাট সম্রাজ্ঞীদের পালা শেষ করে সুন ইয়াতসেন দেশ শাসনের ভার গ্রহণ করলেন।

অল্প কয়েক বছরের মধ্যে সুন ইয়াতসেনের মেয়াদ ফুরাল, তার জায়গায় এলেন চিয়াং কাইসেক। ইনি সুন ইয়াতসেনের ভায়রাভাই। দেশসুদ্ধ লোক আশা করেছিল চিয়াং কাইসেকের রাজত্বকালে দুস্থ পদদলিত চিনা জাতি আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু, সে আশা পূর্ণ হয়নি বরং দুঃখ দুর্দশা অবমাননা বেড়েই চলল। চিয়াং আর্মির লোক। আর্মি ও পুলিশ বাহিনী দিয়ে দেশ শাসন করতে লাগল। সর্বত্র অসন্তোষ ও অরাজকতা দেখা দিল। বিদেশি, ক্ষমতাপন্ন দেশগুলির আধিপত্য অক্ষুণ্ন রইল সারা দেশে।

পাছে চিনদেশও কমিউনিস্ট হয়ে যায় সেই ভয়ে আমেরিকা চিয়াংয়ের দমন নীতি অনুমোদন করতে লাগল এবং বিরাট অর্থ সাহায্য দিল। অল্পকালের মধ্যে চিয়াং আমেরিকার ক্রীড়নকে পরিণত হল। উত্তরাঞ্চলে পিকিংয়ে রাজধানী বাতিল করে দক্ষিণে স্থানান্তরিত করা হল।

চিনা সম্রাট সম্রাজ্ঞীরা পিকিং শহরের যে অংশে বাস করতেন তাকে ফরবিডন সিটি বলা হয়— অর্থাৎ সেখানে সাধারণ লোকের প্রবেশ নিষেধ। এখন আমার মতো সাধারণ লোক নিষিদ্ধ শহরের ভেতর প্রবেশ করতে পারে এবং অসংখ্য মিউজিয়াম ইত্যাদি দেখতে পারে।

রাজবাড়িগুলির চেহারা দেখলে মনে হয় সেখানে লুঠতরাজ হয়ে গিয়েছে। যার যা খুশি চারুকলার অমূল্য সব জিনিস তুলে নিয়ে গিয়েছে এবং বিদেশিদের কাছে বিক্রয় করেছে।

লন্ডনের ভিক্টোরিয়া ও এলবার্ট মিউজিয়ামে একটা সতেরো শতাব্দীর তৈরি চিনা সিংহাসন (গালার) শোভা পাচ্ছে। এত সুন্দর নিখুঁত কাজ চিনারাই করতে পারে। সে সব কাজ আজ দেশ ছাড়া।

মাও-সে-তুং নামে একজন চিনা, চরম অবস্থার দিনে, রাশিয়ার সাহায্য নিয়ে দল সংগঠন করতে লাগলেন। মাঝে মাঝে চিয়াংয়ের ফৌজের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ লাগত, ফলে দেখা গেল ফৌজের লোকেরা মাওয়ের দলে যোগ দিচ্ছে।

পিকিংয়ের উত্তরে রওনা হলাম। সেদিকের চাষীরা দিনেরবেলায় চাষবাস করে, রাতে তারা মাওয়ের অনুগামী। যত উত্তরে যাই ততই ঠান্ডা বাড়তে লাগল। পথের ধারে পান্থশালা বা হোটেল খুঁজে পেতাম না। চাষীরা গরিব হলেও সদাশয় এবং অতিথিপরায়ণ। ঘরের মাঝখানে ফায়ার প্লেস আছে। আমি ও জেমস সেটা ঘেঁসে মাটিতে কম্বল পাততাম এবং শুয়ে বসে রাত কাটাতাম। কষ্ট হলেও আগুন যতক্ষণ জ্বলত, আরাম পেতাম। আল্পসের ওপর সারাদিন স্বল্প গরম কাপড় পরে প্রচণ্ড শীতে বরফের ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছিল, তারপর ভুঁটিখানার মেঝেয় বসে রাত কাটানোর চেয়ে এখানে অপেক্ষাকৃত কম কষ্টে আছি।

জেমস এরকম ভাবে অন্যের কৃপার ভিখারি হয়ে রাত কাটাতে রাজি নয়। কিন্তু হোটেল কোথায় পাব?

চাষীরা তাদের সামান্য খাবারের অংশ দিত আমাদের। তারা স্যুপ, নুডল, শাক ইত্যাদি দিয়ে রাত্রের ভোজন সারে। আমরা টাকা দিলে কোনওদিন তা নিত না। রেস্তোরাঁ নেই যে খাবার কিনে খাব। এমনিভাবে আমরা চারশো মাইল এগিয়েছি।

পাহাড়ি দেশ। সাইকেল ঠেলতে কষ্ট হচ্ছিল। প্রায়ই বিখ্যাত চাইনিজ ওয়াল বা চিনের প্রাচীর দেখতাম। এ এক অদ্ভুত কীর্তি। প্রাচীরের রক্ষণাবেক্ষণ এবং শত্রুর যাতায়াত লক্ষ করবার জন্য, কত যে বড় বড় সুন্দর বাড়ি আছে তার লেখা-জোখা নেই। এক কালে চিনারা দেশকে বহিরাগতদের আক্রমণ থেকে বাঁচাবার জন্য এই বিরাট প্রাচীর তৈরি করেছিল। আজকাল এরোপ্লেনের যুগে প্রাচীরের মূল্য খুবই কম। নানকো পাস পার হলে ওপারে মঙ্গোলিয়া। অল্পদূরে মাঞ্চুরিয়া দেশ। আমাদের সঙ্গে মঙ্গোলিয়ার সম্বন্ধ অবিচ্ছেদ্য। মোগলরা এইখান থেকে দক্ষিণে রাজ্য জয় করতে করতে ইউরোপে ছেয়ে গিয়েছিল কিন্তু পরে অন্তরে গ্রহণ করেছিল ভারতবর্ষের বুদ্ধকে।

চিনের চার হাজার বছরের গৌরবময় ইতিহাস। মঙ্গোল মাঞ্চুরা পালাক্রমে পিকিং জয় করে চিন দেশে আধিপত্য বিস্তার করেছে। কিন্তু দেখা গেছে শেষ পর্যন্ত তারা নিজেরাই চৈনিক হয়ে গেছে।

আঠারো শতাব্দী থেকে চিনের অবনতি শুরু হল। সেই সুযোগে ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, রুশ ও জাপান দেশের অংশ বিশেষ অধিকার করে ব্যবসা বাণিজ্য পুরোদমে চালাতে লাগল। তারাই চিনের আসল মালিক হয়ে শোষণ নীতি শুরু করে দিল। চিনাদের দুর্দশা উঠল চরমে। পদে পদে অপমান ও লাঞ্ছনা।

আমার খুব ইচ্ছা হল মঙ্গোলিয়ার ভেতর দিয়ে গোবি মরুভূমি, তিব্বত পার হয়ে উত্তর পশ্চিম কোণ দিয়ে হিন্দুকুশ পর্বতমালার ভেতর দিয়ে ভারতবর্ষে পৌঁছব। কিন্তু চারদিকে বরফ ও শীতের প্রকোপ দেখে সে পথ ছাড়তে হল। জেমস বলল, অসম্ভবের পথে গিয়ে আটকে পড়ে থাকতে হবে, তখন না পারব এগোতে, না পারব পেছোতে। সেই সম্ভাবনাই খুব বেশি। ঘোড়া বা উটের ওপর গেলে আলাদা কথা।

মোড় ঘুরে দক্ষিণে এগোতে লাগলাম। যেদিকে যাই সেদিকে চাষীদের মধ্যে যুদ্ধের প্রস্তুতি লক্ষ করলাম। রাত হলে দল বেঁধে বন্দুক নিয়ে পুলিশের কিংবা আর্মির ঘাঁটি আক্রমণ করে। দিনেরবেলা একমনে চাষবাস করে।

চেংটো একটা ছোট শহর। বড় গ্রাম বললে ভালো হয়। এখানে নানা এলাকার মানুষ মিলিত হয় ব্যবসার জন্য। লোমসুদ্ধ পশুর চামড়ার তৈরি জামা খুব ক্রয় বিক্রয় হয়। এত সস্তা যে বলা যায় না। লেপার্ডের চামড়ার কোট আশি টাকা দাম। পঞ্চাশ টাকা দিয়ে কেনবার খরিদ্দার পাওয়া যায় না। ঘরের মেঝেয় পাতবার জন্য বড় বড় উশুরি বাঘের চামড়া অল্পদামে বিক্রি হচ্ছে।

একজন চিনা ভদ্রলোকের সঙ্গে বাজারে আলাপ হল। নাম হোপিং। অনেক প্রশ্ন করছিল জানবার জন্য আমরা কে, কোথায় যাচ্ছি। দেশ বিদেশের কথা জানবার আগ্রহ খুব। অবশেষে আমাদের নিমন্ত্রণ করল তার বাড়িতে খাবার ও থাকবার জন্য। হোপিংয়ের বৃদ্ধ পিতা আছেন। তিনি ব্যাঙ্কার হয়ে প্রচুর অর্থোপার্জন করেছেন। এখন হোপিং ব্যাঙ্কের কাজ দেখাশুনা করে।

হোপিংয়ের মস্ত বড় দুমহল বাড়ি। অতিথি রাখবার ভালো ব্যবস্থা আছে। আমরা দুজনে একটা ঘর পেলাম। গরম চা এল। বৃদ্ধ আমাদের ঘরে আলাপ করতে এলেন। সাইকেলে পৃথিবী ভ্রমণ করে কী লাভ হবে তা সঠিক বুঝতে পারলেন না। আমরাও বোঝাতে পারলাম না যতক্ষণ না হোপিং এল। সে ইংরিজি থেকে তর্জমা করে বাবাকে আমাদের কথা বলল। তখন বুড়ো খুশি হয়ে তুলোর জামার ভেতর থেকে হাত বার করে আমাদের হাত ধরলেন এবং আনন্দ প্রকাশ করলেন। তখনই গরম তোয়ালে এল আমাদের জন্য। চিন দেশে অতিথির জন্য একটি ফুটন্ত জলে ভেজা ছোট তোয়ালে নিয়ে আসে। তা দিয়ে খুব আরামে মুখ হাত মুছে পরিষ্কার করে ফেলা যায়। চা এল এবং সেই সঙ্গে হালুয়ার মতো মিষ্টিও এল। চিনা চা দুধ চিনি ছাড়া, তাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। খুব ভালো লাগল। আমাদের দেশে দার্জিলিং চা যেমন সুগন্ধী, তেমনই চিনদেশে সুচং লপচং।

বাড়ির অদূরে আমাদের দেশে যেমন গোয়াল থাকে এখানে শুয়োর রাখবার ব্যবস্থা আছে। বলা বাহুল্য, তারা নোংরা খাবার ও রোগে আক্রান্ত হবার সুযোগ পায় না। একপাল পিকিং ডাক পুষছে তার পাশেই। পিকিং ডাক বড় হাঁস বিশেষ। তাদের একটি বিশিষ্ট উপায়ে বড় করানো হয়, যার ফলে মাংস নরম ও আশ্চর্য রকম সুস্বাদু হয়। সেদিন আমাদের সম্মানে যে ভোজের আয়োজন হয়েছিল তাতে পিকিং ডাক খেলাম। এত অপূৰ্ব খেতে যে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

শুয়োরের মাংসের রান্না কত রকম হয়েছিল তা গুনতে ভুলে গিয়েছিলাম। শেষে মিষ্টি-টক একটা প্লেট-ভর্তি মাংস দিল। সামান্য মাত্র খাবার মতো অবস্থা ছিল আমাদের। জেমস আমার সঙ্গে খাবারের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় যোগ দিল। সে স্বীকার করল যে রন্ধন শাস্ত্রে চিনাদের তুলনায় আমরা মধ্যযুগে বাস করছি।

হোপিং আমাদের কাছে ভূয়সী প্রশংসা শুনে বলল এ তো কিছুই নয়। সত্যিকারের বড় বড় ডিনারে কম করে একশো ধরনের মাংস রান্না হয়। স্বীকার করি যে দেশের যা রীতি।

বৃদ্ধ হোপিং বলল যে কয়েক বছরের মধ্যে তার ধনরত্ন সৰ্বস্ব চলে যাবে কমিউনিস্টদের কাছে। চিয়াং কাইসেকের রাজত্বকালে এই সুদূর উত্তর চিনের লোকেরা কমিউনিস্ট গেরিলাদের হাত থেকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ট্যাক্স দেয়। আমরা এখন দুই নৌকোয় দুই পা দিয়ে আছি বলে বৃদ্ধ হোপিং দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

আমরা অসংখ্য রকম রান্না খেয়ে যত না খুশি হয়েছিলাম তার চেয়ে বেশি চিনা মাটির অর্থাৎ পোর্সেলেনের কারুকার্য করা বাসনপত্রের ব্যবহার করতে দেখে। এত পাতলা চিনা মাটির ওপর সূক্ষ্ম কাজ দেখে অবাক হয়েছি। যে চেয়ার ও টেবিল আমাদের ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছিল সেগুলি রোজ উড কাঠের ওপর মাদার পার্লের ফুল ফল বসানো। তেমনই কাঠের ওপর খোদাই করা কাজ। পৃথিবীতে অন্য কোনও জাত এত সুন্দর কাঠের কাজ করতে পারে, বিশ্বাস হয় না।

ঘুরতে ঘুরতে আবার পিকিংয়ে ফিরে এলাম। ফিরেই রজার্সকে ডাকলাম আমাদের সঙ্গে দেখা করবার জন্য। পিকিং ডাক খাওয়ালাম একটা রেস্তোরাঁতে। অনেকক্ষণ ধরে আমাদের অভিজ্ঞতার কথা বললাম। রজার্স বলল যে সে আমাদের মঙ্গোলিয়া বা মাঞ্চুরিয়ার পথে যেতে বারণ করবে ভেবেছিল কিন্তু পরে মনে হয়েছিল আমি ভারতবাসী বলে হয়তো ততটা খারাপ কিছু হবে না। জেমস আমার মতোই শত প্রশংসা করল চিনাদের। রজার্স বলল, চিনে অনেকদিন অরাজকতা চলছে। জাপানিদের শোষণনীতি থেকে পার পাবার জন্য চিনারা দক্ষিণে পালিয়ে যাচ্ছে। চিয়াং কাইসেকের ছন্নছাড়া রাজত্বে তারা কোথাও শান্তিতে বসবাস করতে পারছে না। অবশেষে মাও-সে-তুং সৈন্যদলে যোগ দিয়ে লুঠতরাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে লেগেছে।

আমরা একদিন পরেই বিরাট পিকিং শহর ছেড়ে দক্ষিণে সাংহাই বন্দরের দিকে রওনা হলাম। রজার্স আমাদের দলে যোগ দেবে বলেছিল কিন্তু ব্রিটিশ লিগেসন থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটি পেল না। চিনা ভাষা থেকে ইংরিজিতে তর্জমা করতে রজার্স সিদ্ধহস্ত। তাকে ছাড়া লিগেসনের কাজ একদিন চলে না। যদিও আরও পাঁচজন দোভাষীর কাজ করে সেখানে।

চিনাদের সুদিনে এককালে বড় বড় বাঁধ, খাল, প্রাসাদ ইত্যাদি তৈরি হয়েছিল। দেশের সমস্ত শহরগুলিকে যুক্ত করবার মতো রাস্তা কিন্তু তৈরি হয়নি। যেটুকু রাস্তা আছে তা পুবদিক থেকে পশ্চিম দিকে গিয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্য চলে বড় বড় নদীপথে যেমন হোয়াংহো, সিকিয়াং এবং দক্ষিণে সী নদী পুব পশ্চিমে বিস্তারিত।

বিরাট চিন দেশে গাড়ি চলাচলের কাঁচাপাকা রাস্তা মাত্র এক লক্ষ মাইল। তুলনায় আমাদের দেশে রাস্তা এর বিশ গুণ বেশি, যদিও ভারতবর্ষের আকার তার চাইতে অনেক ছোট।

পিকিং ছাড়বার পর পঞ্চাশ মাইল ভালো বাঁধানো রাস্তা পেলাম যেটা টিনসিনের দিকে চলে গিয়েছে। তারপর কাঁচা রাস্তা কখনও কখনও মাঠের ওপর দিয়ে চলেছে। আমাদের লক্ষ চেংচাও শহর। এই অঞ্চলে সাইকেলের ব্যবহার খুব দেখা গেল।

চিন অত্যন্ত গরিব নিপীড়িত দেশ। গাড়ি দূরের কথা, লোকেরা সাইকেল চালাতে পারলে খুশি হয়। সাইকেল যে কোনও রাস্তা ধরে চলতে পারে। শতকরা আশি জন লোক চাষবাস দ্বারা গ্রাসাচ্ছাদন করে। আমাদের দেশে গরু দিয়ে লাঙল টানানো হয়। চিন দেশে গরুর কাজ মোষে করে। চিনারা ভাত খায়, ধান চাষ তাই ব্যাপক।

চিনা পুরুষরা আগে বড় চুল রাখত। মেয়েরা কাঠের জুতো পরে পা ছোট করে ফেলত। যে জন্য চলতে ফিরতে খুব অসুবিধা হত। আজকাল খুব কম মেয়েরই ওই অবস্থা দেখা যায়। আমি পিকিংয়ে এক রমণীর বাঁধা-পা দেখে শিউরে উঠেছিলাম।

অনেক বিষয় ভারতবর্ষ ও চিন দেশের মধ্যে মিল দেখা যায়। দুইই গরিব, অশিক্ষিত ও স্বল্পায়ুর দেশ। অথচ দুই দেশেই হাজার হাজার বছর পর্যন্ত সভ্যতার বিস্তার হয়েছিল যখন ইউরোপ অজ্ঞতায় অন্ধকারাচ্ছন্ন।

চিনদেশে আমাদের দেশের মতো জয়েন্ট ফ্যামিলি অর্থাৎ একান্নবর্তী পরিবার নিয়ম ছিল। এই নিয়মে সব চেয়ে বড় যিনি সেই পুরুষ সর্বেসর্বা। তার হুকুম সবাই মেনে চলবে। বড় ছেলের ওপর সব দায়িত্ব একদিন পড়বে বলে তাকে পরিবারের অন্যরা খাতির করে। সমাজে বা পরিবারে স্ত্রীলোকের কোনও স্থান নেই। সবাই বোঝে যে বিংশ শতাব্দীতে এই অবস্থা অশোভন, অন্যায় এবং অচল কিন্তু সামাজিক পরিবর্তন ঘটাবার মতো তেমন বড় কোনও চেষ্টা হয়নি। মনে হয়, অদূর ভবিষ্যতে স্ত্রী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। যে সব মেয়েরা স্কুলে কলেজে পড়ছে তারাই দাবি করছে স্ত্রী স্বাধীনতা।

চাষ আবাদ প্রথম ও প্রধান কাজ বলে চিন দেশে কাঁচামাল জন্মায় এবং বিদেশিরা সেই সব জিনিস তুলে নিয়ে যায়। শিল্পের সংখ্যা এত কম যে মুষ্টিমেয় বললে ভালো হয়। বিদেশিরা তাদের কলকারখানায় কাঁচামাল দিয়ে নিত্য ব্যবহার্য জিনিস তৈরি করে এবং চড়া দামে সে সব চিনাদের কাছে বেচে।

সাতশো মিলিয়ন লোককে দুবেলা খাওয়াতে হলে যত ফসল উৎপন্ন হওয়া দরকার সে রকম হয় না। তবু খাবার জিনিসের দাম ভীষণ সস্তা। অনেকে বলে যে এবার থেকে একটার জায়গায় দুবার ধান বুনে দুটো ফসল তোলবার চেষ্টা করা যাক। কিন্তু সেটা সংকল্পই রয়ে গেছে, এখনও কাজে পরিণত হয়নি। আমাদের ভারতবর্ষেও সে চেষ্টা নিশ্চয় সুফলপ্রসূ হতে পারে।

ইউরোপে কাঁটা চামচ দিয়ে যেমন খাওয়ার রীতি, জাপান ও চিনে তেমনই কাঠি দিয়ে খাওয়ার চল।

তেরোদিন পরে সাংহাই পৌঁছলাম। সাংহাই প্রকাণ্ড শহর। জলের ধারে বেশিরভাগ বড় বড় বাড়ি ইংরেজদের অফিস, হোটেল কিংবা থাকবার জায়গা।

পাঁচটা জাত— ইংরেজ, জার্মান, ফ্রান্স, রাশিয়া ও জাপান একসঙ্গে প্রাণপণ চেষ্টা করছিল চিনদেশ গ্রাস করতে। তাই কেউই দেশটাকে পুরোপুরি হাত করতে সক্ষম হয়নি। সাংহাই শহরটাকে পাঁচভাগে ভাগ করে উঁচু পাঁচিল দিয়ে নিজের নিজের এলাকা সুদৃঢ় করা হয়েছিল। চিনের সাংহাই হয়ে গেছে বিদেশিদের সাংহাই। শিখ পাঞ্জাবি পুলিশ শহর পাহারা দেয়, যানবাহনের গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত করে

মুষ্টিমেয় শিক্ষিত বড় লোক এ দেশে আছে যাদের মান্দারীন বলা হয়। এরা পাল্কিতে বসে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় আরামে যাতায়াত করে। অবশ্যি পাল্কি বাহকেরা চিনা।

মান্দারিনদের ভাষা চিনদেশে সর্বত্র চলে কিছুটা মার্জিত ভাষা বলে।

প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে কনফুসিয়াসের চৈত্য, তাও-ই-জন ও বৌদ্ধ ধর্ম প্রায় একই সময়ে এ দেশে বিস্তার লাভ করে। অনেক পরে কিছু সংখ্যক লোক মুসলমান ধর্মও গ্রহণ করে। এদেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বিরোধ নেই।

কনফুসিয়াসপন্থীরা বিশ্বাস করে সেই দেশ সকল দেশের সেরা যেখানে মানুষে মানুষে বিরোধ নেই। দেশের রাজা রাজত্ব চালাবেন, তাকে পণ্ডিত ও প্রধান লোকেরা সাহায্য করবেন সব সময় প্রজাদের মধ্যে সমতা বজায় রাখতে।

তাও-ই-জন বিশ্বাসী লোকেরা মনে করে মানুষের জীবন ধারা যেমন ভাবে চলছে সেটা পরিবর্তন করা ঠিক নয়। মানুষ যদি স্বভাবের বিরুদ্ধে প্রকৃতির বিরুদ্ধে কাজ করে তো কুফল দেখা দেয়, যেমন মড়ক, বন্যা ইত্যাদি। এ কারণে চিনারা রক্ষণশীল হয়ে পড়ে এবং পৃথিবীর অন্যত্র যেমন পরিবর্তন ও উন্নতির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা দেখা গেল তেমন এদেশে হল না।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। বুদ্ধ পৃথিবীতে শান্তি ও সত্যের পথ প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। এই কারণে চিনা ও জাপানিরা ভারতবর্ষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী লোকেরা কিন্তু নিজ নিজ গৃহদেবতাদের নিয়মিত পূজা করে, ভূত, প্রেত, ড্রাগন ইত্যাদি মেনে চলে, তা সে যে ধর্মেই তার আসল বিশ্বাস থাকুক। এমনকী মুসলমানরা পর্যন্ত চিনদেশে গৃহদেবতাদের পূজা করে।

চিনের মতো ভারতবর্ষে বিশেষ করে দক্ষিণে, অনাবৃষ্টির সময় কোটি কোটি লোক প্রার্থনা করে। অনেক সময় গৃহস্বামী খাবার হাতে নিয়ে পাহাড়ের ওপর কিংবা মন্দিরে যায় এবং প্রার্থনার পর খাবার রেখে চলে আসে। পাখিরা সেই সব খায়।

অনেক সময় আবার তারা দুর্দিনে পূর্বপুরুষদের কবরে খাবার নিয়ে যায় এবং প্রার্থনা জানায় ‘বৃষ্টি দাও, ফসল বাঁচাও, দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা কর’। তারপর কিছুক্ষণের জন্য দূরে সরে যায়। তারপর ফিরে এসে সেই খাবার নিয়ে বাড়ি চলে যায় এবং সবাই ভাগ করে খায়।

চিনারাই সর্বপ্রথম আবিষ্কার করে কাগজ, কালি, প্রিন্টিং, কম্পাস, গান পাউডার ইত্যাদি। তারা সিল্ক ও পটারির ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত। এক সময় বড় বড় জাহাজও তারা বানাত।

ইউরোপিয়ানরা গান পাউডারের জোরে চিন ও ভারতের মতো দেশে রাজত্ব বিস্তার করে এবং অশেষ দুর্দশা ঘটায়।

এই দুই দেশের লোকসংখ্যা পৃথিবীর অর্ধেক। সবাই দেখতে চায় চিন ও ভারতবর্ষ আবার স্বাধীন ও উন্নতির পথে অগ্রসর হোক। দুই দেশেই অপর্যাপ্ত কাঁচামাল আছে। যেদিন শিল্প প্রতিষ্ঠা হবে সেদিন ইউরোপিয়ান, জাপানি ও আমেরিকানদের শোষণ নীতি রোধ করা যাবে।

চিনারা ভাত ও মাছ যথেষ্ট খায়। সমুদ্র ও নদী থেকে অপর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যায়। সীমের বীচি এবং নানা রকম বীনের ব্যবহার খুব দেখা যায়। তেলের বদলে বীনের নির্যাস দিয়ে অনেক রান্না হয়। সয়াবীন সস তো আজ যথেষ্ট চালু।

সাংহাইয়ের একেক অংশে জার্মান, ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান রেস্তোরাঁতে খেয়ে খেয়ে বেড়ালাম সময় মতো পর্যাপ্ত খাবার না পাওয়ার শোধ তুলে নেবার মতো। পূর্বেই লিখেছি যে চিনা রান্না পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ। তবে সব সময় ঠিক স্বাদ যেন পাইনি।

আমাদের দেশেও বিদেশিদের কি আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক সব রান্না ভালো লাগে? আমাদের অভিজ্ঞতায় এর ব্যতিক্রম দেখেছি কিন্তু সেটা ব্যতিক্রমই বলব। একজন ইংরেজ ভদ্রমহিলা প্রায় তিরিশ বছর আমার কলকাতার বাড়িতে প্রতি রবিবার দুপুরে খেতেন। তিনি চচ্চড়ি, সুক্ত, ঘণ্ট ইত্যাদি খেয়ে ততখানি আনন্দ প্রকাশ করেছেন যতখানি করেছেন মোগলাই খাবারে। তিনি আবার জিজ্ঞেস করতেন, কিসে কী ফোড়ন ব্যবহার করা হয়। যখন ব্যাখ্যা করা হত, আমি হাসি চাপতে পারতাম না।

সাংহাই শহরে পশ্চিমদেশের নাচের চল আছে কিছুটা। চিনা মেয়েরা এই অঞ্চলে বেশ লম্বা ও সুশ্রী দেখতে। তাদের বেশিরভাগের বিদেশি বাবা ও চিনা মা। অনেকেই ভালো নাচতে পারে। আমি তাদের সঙ্গে নাচতাম।

জেমস বেসুরো গান ধরেছে। সে চায় মোটর সাইকেল নিয়ে ভ্রমণ করতে, শারীরিক পরিশ্রম কমাবার জন্য, তা ছাড়া সময় বাঁচাতে পারা যাবে বলে। পাছে খরচের আপত্তি করি সেজন্য সে প্রথমেই বলেছে যে সে নিজেই দুটো মোটর সাইকেল কিনবে। একটা অবশ্য আমার জন্য। অনেক ওজর আপত্তি জানালাম। চিন দেশে রাস্তা নেই সে কথা মনে করিয়ে দিলাম। পেট্রোলও মেলে না কয়েকটি জায়গা ছাড়া।

কলকাতা ছাড়বার আগেই এই প্রশ্ন উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়েছিল যে নিজেদের কায়িক পরিশ্রম দিয়ে ভ্রমণ করতে হবে। অ্যাডভেঞ্চার ও সাহসের ঠিক পরিচয় তবেই পাওয়া যাবে। কঠিন পথে চলতে হবে এ সঙ্কল্প ছিল আমাদের।

জেমসের উদ্দেশ্য দেশ দেখা; যে দেশে রাস্তা আছে, যেটা সহজে ভ্রমণ করা যাবে সেই সব দেশে সে যেতে চায়। যেখানে পথ নেই, সেখানে নাই বা গেলাম। আমাদের মতানৈক্য মেটবার নয়।

আমি যখন সাইকেলে বা পদব্রজে ছাড়া পৃথিবী পর্যটন করব না তখন আমাদের মধ্যে একমত হওয়া সম্ভব নয়। জেমস সাংহাই থেকে আমেরিকা ফেরৎ গেল। আমি যেমন একা ছিলাম, আবার তেমনই একা হলাম। জেমসের কাছে আমি অনেক জিনিস জেনেছি ও শিখেছি। সে ছিল আমেরিকান যুব সমাজের প্রতিনিধি। সব সময় মনে হত যে সে ছিল এমন একজন তরুণ যে সারাক্ষণ তার নিজের অস্থিরতা, চঞ্চলতা দিয়েই মূল্যায়ন করতে চাইত সব কিছুর।

জেমস তার টাইপরাইটার দিয়ে সমস্ত অবসর সময় খটখট লিখত। অনেক পাতা লিখেছিল। আমার খুব ইচ্ছা ছিল পুস্তকাকারে তার লেখা দেখব একদিন। কিন্তু আমি আজ পর্যন্ত দেখতে পাইনি।

এবার আমি ন্যানকিং শহরের দিকে চলতে আরম্ভ করলাম। ন্যানকিং মানে দক্ষিণের রাজধানীতে, এদিকে মোটামুটি রাস্তা আছে। কখনও পাকা কখনও কাঁচা পথ। আমার উচিত ছিল প্রথমে ন্যানকিং শহরে যাওয়া এবং তারপর সাংহাই। কিন্তু জেমস জিদ করেছিল প্রথমেই সাংহাই যাবার জন্য। এখন বুঝি তার উদ্দেশ্য কী ছিল। আমাকে একটা মোটর সাইকেল কিনে দেবার ও নিজের জন্য একটা কেনবার।

ন্যানকিংয়ে প্রধান দ্রষ্টব্য হচ্ছে আধুনিক যুগের তৈরি সুনয়াত্-সেনের সমাধি সৌধ। শ্বেত মর্মর দিয়ে তৈরি। দেখতে সুন্দর এবং সুরুচিপূর্ণ।

ন্যানকিংয়ে মাত্র একদিন থেকে ফুচোর পথ ধরলাম। সামনেই ইয়াং-সি-কিয়াং নদী। বোটে নদী পার হলাম। তারপর উহান ও চাংশার পথ ধরলাম, বা ধরবার চেষ্টা করলাম, কেননা প্রায়ই ধান জমির ওপর দিয়ে মেঠো রাস্তা দিয়ে অতি কষ্টে এগিয়েছি। মোটর সাইকেল থাকলে এ জায়গায় চলাফেরা অসম্ভব হত।

আমার লক্ষ্য ছিল মস্ত শহর, ক্যান্টন। উত্তর দিক অপেক্ষাকৃত কম লোক দেখা যেত। যত দক্ষিণে যাচ্ছি ততই মনে হচ্ছে জনারণ্য বেড়েই চলেছে। ক্যান্টন শহর খুব পুরনো। সরু রাস্তা এবং চারদিকে লোকের ভিড়, অসংখ্য ছোট ছোট দোকান। কলকাতায় যে চিনাদের আমরা দেখি, তারা বেশিরভাগ ক্যান্টন অঞ্চলের লোক। সাধারণত এরা বেঁটে এবং খুব কর্মতৎপর। তবে এরা প্রধানত পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করে। মোটর গাড়ির প্রচলন হয়নি ভালো রকম। তবে রিকশা প্রচুর। বেশিরভাগ কাঠের বাড়ি। সাইকেল ব্যবহারও চালু হয়েছে।

ক্যান্টনে দুদিন থেকে হংকংয়ের পথ ধরলাম। এই দুই শহরের মধ্যে লোক চলাচল ও খাবার জিনিস আমদানি রপ্তানি খুব হয়। অফুরন্ত লোক দুদিকে চলেছে। কেউ কেউ ঠেলাগাড়ি নিয়ে যাচ্ছে।

হংকং শহর একটা ছোট্ট দ্বীপের ওপর। ইংরেজদের ঘাঁটি, তাদের অধীনে এই শহর গড়ে উঠেছে। চিনে অনেকখানি ইংরেজের হাতে গড়া আরেকটি শহর সাংহাই।

পৃথিবীতে সুন্দর দেখতে যত বড় শহর আছে তাদের মধ্যে হংকং অন্যতম। সান- ফ্রান্সিস্কোর সঙ্গে অনেকটা মিল আছে। দুই শহরই পাহাড়ের ওপর এবং সমুদ্রের ধারে। সন্ধ্যায় যখন লক্ষ বাতি জ্বলে ওঠে জলে তার ছায়া পড়ে, মনে হয় স্বপ্নপুরী। ইংরেজরা বড় বড় হোটেল করেছে জলের ধারে। সারাক্ষণ ‘মেনল্যান্ড’ বা চিনদেশ থেকে স্টিমারে লোকজন, জিনিসপত্র হংকং দ্বীপে যাচ্ছে আসছে। মেনল্যান্ডের দিকটাকে ‘কোউলুন’ বলা হয়। জলপথে পার হতে অল্প কয়েক মিনিট লাগে।

ক্যান্টনের মতো হংকংয়ের চারদিকে অসংখ্য ছোট নৌকো জলে ভাসছে। লোকেরা পরিবার নিয়ে নৌকোর ওপর ঘর সংসার করে। অনেক সময় দেখা যায় ডাক পিয়ন চিঠি নিয়ে নৌকোর পর নৌকোর ওপর দিয়ে চলেছে নির্দিষ্ট বোটে চিঠি বিতরণ করতে।

একজন চিনা যুবকের সঙ্গে ওয়াই এম সি এ-তে আলাপ হল। তার নাম সিন ফু সবাই ফু বলে ডাকে, ফুর খুব ফটোগ্রাফির শখ। সহজেই আমার চেলা হয়ে গেল। তার বাড়িতে ডিনার খাবার নেমন্তন্ন পেলাম। ফুর স্ত্রী মনে হয় কলেজের ছাত্রী। সুন্দর ও সুশ্রী দেখতে। আমাকে ফু বলল যে আমার ছবির এগজিবিশন তার স্ত্রী দেখেছে এবং খুব প্রশংসা করেছে। প্রদর্শনীটি দশদিন হংকংয়ে থাকবে, তারপর ছবি দেখানো হবে সিঙ্গাপুর শহরে।

ফু পরিবারের সঙ্গে এত ভাব হল যে রোজই দেখা হত এবং নতুন কোনও না কোনও জায়গা আমাকে দেখাতে নিয়ে যেত।

ইতিমধ্যে একটা চিনা জাহাজে নেমন্তন্ন পেলাম হাইনান দ্বীপে বেড়াবার। আমি রওনা হলাম। জাহাজটা শুয়োর নিয়ে আসা-যাওয়া করত। জাহাজে একদিন চলবার পরই মনে হল গন্ধে ভরপুর হয়ে গেছি।

হাইনান জনসমাকীর্ণ একটি দ্বীপ। দুদিন দ্বীপে ঘোরার পর আবার জাহাজে হংকং- এ ফিরে গেলাম।

অনেকদিন পর রেডিওতে আমার ভ্রমণকাহিনী বলবার আমন্ত্রণ পেলাম।

হংকং থেকে দক্ষিণ দিকে ম্যাকাওর দিকে চলতে আরম্ভ করলাম। ম্যাকাও শহর পর্তুগিজদের অধীনে একটি দ্বীপের ওপর অবস্থিত। চিনে অনেক জায়গায় দেখেছি আফিং খানা। ম্যাকাও মনে হল জুয়া খেলবার জায়গা ও আফিং-খানার দেশ জোড়া কারবার। কিছু সংখ্যক পর্তুগিজ এখানে বাস করে। বাজারে বিদেশি মাল বলতে একমাত্র পর্তুগালের জিনিস।

আমাদের দেশে পর্তুগিজদের অধীনে এখনও তিনটে জায়গা গোয়া, দমন ও দিউ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *