৩
পুবদিকে ইউরোপ দেখে মনে হল প্রগতির হাওয়া এখানে পৌঁছয়নি। পথঘাট কাঁচা, বেশিরভাগ বাড়ি মাটি কাঠ ও পাথর দিয়ে তৈরি, একতলা। সব বাড়ির সামনে ঝুলছিল আঁটি করা ভুট্টা, পেঁয়াজ এবং খাটের নিচে সব জায়গায় দেখেছি সারা বছরের মজুত আলু এবং লাউ। মাঠে গম কাটা হয়ে গিয়েছে। সব মজুত করতে ব্যস্ত।
বুলগেরিয়া প্রবেশের ছাড়পত্র দেখিয়ে চলতে আরম্ভ করলাম। এদেশে লক্ষ করলাম ব্যাপকভাবে সর্বত্র আঙুরের চাষ হয়েছে। ঝুড়ি ঝুড়ি আঙুর তুলে নিয়ে যাচ্ছে এবং একেকটা পিপের (ব্যারেল) মধ্যে ঢালছে। সাধারণত কোনও তরুণকে ভার দেওয়া হয় পিপের ভেতর ঢুকে আঙুর মাড়াতে। পিপের একদিক কাটা অন্যদিকে মেঝেয় একটা ফুটো আছে— সেখান দিয়ে আঙুরের রস বেরিয়ে পাত্রে পড়ছে।
সর্বত্র আমাদের ডেকে খুব খুশি হয়ে বুলগার দেশের লোকেরা আঙুরের রস খেতে দিত। আঙুর থেকে মদ তৈরি করে এবং সারা বছরের নিজেদের ব্যবহারের জন্য ছোট ছোট পিপে ভরে মজুত রাখে। তারপর যা উদ্বৃত্ত থাকে তা বিক্রি করে অনেক টাকা পায় এবং সেই টাকায় সারা বছর সংসার চলে, কাপড়চোপড় কেনে ইত্যাদি।
পূর্ব ইউরোপের প্রায় সব দেশ ড্যানিয়ুব নদীর জল পায়। নদীর দুধার ঢালু হয়ে জলের ধার থেকে ৪৯০-৫০০ ফুট উঁচু হয়ে উঠে গেছে। মোট এক ফার্লং চওড়া হবে। এই জমি আঙুর চাষের পক্ষে খুব উপযুক্ত। মাইলের পর মাইল বুলগেরিয়া, যুগোস্লাভিয়া, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া, অস্ট্রিয়াতে লক্ষ লক্ষ একর জমি জুড়ে আঙুরের চাষ হয়।
আমাদের অর্থাভাবে খাবার জোগাড় করার সঙ্কট খানিকটা মিটত পাকা বড় বড় আঙুর খেয়ে। রাস্তার দুধারে যত ইচ্ছা খাও কেউ কিছু বলবে না। অল্পদিনের মধ্যে টপাটপ আঙুর খাবার স্পৃহা চলে গেল। বেশি আঙুর খেলে নেশার মতো হয়, তাতে খিদে আরও বেড়ে যেত। তখন একটা রুটি একটু চিজ পাবার জন্য ব্যাকুল হতাম। কৃপণের মতো একটা এক পাউন্ড রুটি কিনে চারভাগ করতাম এবং গরম জলে কোকো দিয়ে বেশিরভাগ দিন রাতের ডিনার সারতাম। ভীষণ খাটুনি হত সারাদিন সাইকেল চালিয়ে, খিদে পেত খুব। গরম জলে কোকো গুলে খেয়ে দেখেছি আমাদের খিতে মেটাতে না পারলেও কর্মক্ষমতা বজায় রাখতে সাহায্য করত। পরে এমন দিন এল যে রোজ খাবার মতো রুটি বা কোকো পর্যন্ত জোগাড় করতে পারতাম না।
বুলগেরিয়ার মেয়েরা মাথায় সিল্ক কিংবা পশমের স্কার্ফ বেঁধে বাইরে বের হত। যুগোস্লাভিয়া ও হাঙ্গেরির মেয়েরাও মাথায় টুপি না পরে স্কার্ফ বেঁধে ঘুরে বেড়ায়। সেই বছর ফসল ভালো হয়েছে বলে সবার মনে খুব স্ফূর্তি। প্রায়ই বেহালা হাতে একজন এগিয়ে যেত, অন্যরা তার সুরে সমস্বরে গান ধরত। এমনিভাবে গ্রামের সব পাড়ায় ঘুরত এবং গানের লোকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ত।
দুটো জিনিস আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করত। প্রথমটা হচ্ছে যে, ছেলেরা অনেকে হলুদ-বাটা কপালে (সামান্য) মাখত— তিলক কাটার মতো। মনে হয় হলুদ মাঙ্গলিক চিহ্ন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে যে, ছেলেরা অনেকে স্যুটের ওপর ভাঁজকরা বড় চাদর ঝুলিয়ে যেত। দুটোই আমাদের দেশে চিরাচরিত প্রথা। বুলগেরিয়া নামে ইউরোপে ইউরোপিয়ানত্ব বিশেষ কিছু দেখিনি। চাষবাস করে লোকেরা দিন কাটায়। চামচের ব্যবহার খুব কম। খাটা পায়খানা তো আছেই। ঠান্ডার দেশ বলে জলের পরিবর্তে কাগজ ব্যবহার হয়। বছরের ছয় মাস শীতের কবলে থাকে। আমাদের দেশের চাষীরা যেমন ছন্নছাড়া এদের অবস্থা তেমন নয়।
শোবার ঘরের বিছানাপত্র খুব মোটা পশম ও পালক দিয়ে তৈরি। সব পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন ও গোছানো। বেশিরভাগ লোকের একটা বড়, ভালো পর্দা লাগানো শোবার ঘর। তার পাশেই রান্নার ও বসবার ঘর একসঙ্গে। উনুনে রান্না হয় এবং বসবার ঘর গরমও রাখে। বসবার ঘরের জন্য আলাদা আগুন জ্বালাতে হয় না। সংসার বড় হলে, যদি অবিবাহিতা কন্যা থাকে তো তার জন্য বসবার ঘরে শোবার ব্যবস্থা হয়। সব পরিবারই ছোট, একটি-দুটি সন্তান। তারা বড় হলেই আলাদা হয়ে যায়।
ক্বচিৎ কখনও বড়লোক চাষীর বাড়িতে পিয়ানো ও রেডিও দেখেছি। একটু অবস্থাপন্ন যারা তাদের বাড়িতে আমাদের খাবার নেমন্তন্ন হত। সীমের বিচি, টমাটো দিয়ে মাংস রান্না প্রায়ই খেতে পেতাম, কোনও মশলার বালাই নেই। তাই খাবার সহজেই হজম হয়ে যায়। টকদই খাওয়ার রেওয়াজ সর্বত্র। দইকে ইয়োর্ত বলে।
গত প্ৰথম মহাযুদ্ধে বুলগেরিয়া শত্রু পক্ষে অর্থাৎ জার্মানির হয়ে লড়েছিল। হেরে যাবার পর তার দেশের বেশ বড় একটা অংশ নিয়েছিল গ্রিস ও যুগোস্লাভিয়া। রাজা ফার্দিনান্দের ছেলে এখন রাজত্ব চালান। তিনি সাধাসিধে লোক, ট্রেন চালকের কাজ করতে খুব শখ।
রাজধানী সোফিয়া শহরে পৌঁছলাম। ছোট্ট শহর, রাজার বাড়ি ও ছোট অপেরা হাউস দ্রষ্টব্য। কোনও শিল্প নেই। জার্মানরা মনে করত বলকান দেশের বাজারে তার মাল একচেটিয়া রপ্তানি করার অধিকার আছে।
আমাদের কাছে একটা বিশেষ পরিচয়পত্র ছিল সোফিয়ার এক ভদ্রমহিলার নামে। তাঁর বাড়িতে থাকবার জন্য। আমাদের সঙ্গে আলাপ করবার জন্য কয়েকজন বিশিষ্ট স্ত্রী ও পুরুষকে ডিনারে নেমন্তন্ন করলেন। ভদ্রমহিলার পুরো পরিচয় আগে পাইনি। ইনি একজন শ্রেষ্ঠ অপেরা-সঙ্গীতজ্ঞ যাকে ‘প্রিমা ডনা’ বলে। দেশ জোড়া নাম, সবাই শ্রদ্ধার চোখে দেখে।
আমরা শহর দেখে বেড়ালাম, তারপর দুপুরে একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁতে রুটি চিজ ও কফি দিয়ে লাঞ্চ সারলাম।
আমাদের টপবুট ব্রীচেস ছাড়া অন্য সাজপোশাক ছিল না। সন্ধ্যায় সেই অবস্থাতে বড় বসবার ঘরে উপস্থিত হলাম। ঘরভর্তি নিমন্ত্রিত লোক। আমাদের গৃহকর্ত্রী আলাপ করিয়ে দিলেন। গ্রামোফোনে মিউজিক বাজছিল। সবাই নাচ শুরু করে দিল। আমার হস্টেস প্রথমে আমার কাছে এসে নাচবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আমি তো প্রমাদ গুনলাম। জীবনে একদিন আলেপ্পো শহরে এক কার্নিভালে নেচেছিলাম— রুশ ভদ্রমহিলার পাল্লায় পড়ে। তাঁর টপবুট ছিল। আর এখানে ভদ্রমহিলার পায়ের সব আঙুল দেখতে পাচ্ছিলাম, মাড়িয়ে ফেলবার ভয়ে ইতস্তত করছি। এমন সময় তিনি আমার হাত ধরে টানলেন ও উৎসাহ দেখালেন। কী আর করা যায় মাঝখানে দুহাত ব্যবধান রেখে নাচ শুরু করলাম— সন্তর্পণে। ভদ্রমহিলা কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ‘বলরুম ড্যান্সিং দেশে করোনি বুঝি?’ আমি তৎক্ষণাৎ ‘না’ বললাম এই আশায় যদি নাচ থেকে রেহাই পাই। কিন্তু ফল উল্টো হল। গৃহস্বামিনী বললেন যে, ‘ঠিক আছে আমি শিখিয়ে দেব’। পাশ্চাত্যজগতে আমোদ-আহ্লাদ সামাজিক সংস্কৃতির অঙ্গ। তা না গ্রহণ করলে জীবন দুর্বিষহ বোধ হবে।
আমি ভাবলাম যে হস্টেস স্বনামধন্যা, সেই মারিয়ার সান্নিধ্য পাবার জন্য, তাঁর সঙ্গে নাচবার সুযোগ পাবার জন্য দেশসুদ্ধ লোক উদগ্রীব— আমি তাকে প্রত্যাখ্যান কেমন করে করি। ভাববার বেশি সময় পেলাম না। অল্পক্ষণের মধ্যে দেখি নাচ শুরু করে দিয়েছি। সাহসের জোরে অনেক কিছু করা যায় কিন্তু নাচের তাল খুব পরিষ্কার বুঝতে পারছি না।
নাচ শেষে ধন্যবাদ জানালাম। তখন হস্টেস বললেন যে সবাই চলে গেলে তিনি আমাকে ভালো করে নাচ শেখাবেন। দেশের গণ্যমান্য অনেক স্ত্রী-পুরুষ এসেছিলেন। আমাদের সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। আরও দুই বাড়িতে খাবার নেমন্তন্ন পেলাম পর পর দুই দিন।
সব বাড়িতেই এক সমস্যা উঠবে আমরা নাচতে জানি না বলে। ঠিক করলাম আজই ভালো করে গোড়াপত্তন করব। ফল বোধহয় ভালোই হয়েছিল, আড়ষ্ট ভাব কেটে গেল, এমনকী তালের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলার মধ্যে আনন্দ উপভোগ করা যায় এই সত্য বুঝলাম।
পরে এটা আমার নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। অন্যান্য দেশে কলেজের ছাত্রছাত্রীদের পার্টিতে কখনও সারারাত নেচেছি কিন্তু ক্লান্তিবোধ করিনি। বন্ধুদের বললাম নাচ শিখতে, তারা হেসেই অস্থির, শেখা তো দূরের কথা।
দুদিন পর রওনা হলাম। সামনে শীত আসছে। বরফে ও ঠান্ডায় আমরা বিপদে পড়তে পারি। চলাফেরা হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। নেমন্তন্ন খেয়ে নেচে গেয়ে পৃথিবী ভ্রমণ একটুও এগোবে না।
রাস্তা কাঁচা বলে আরামে সাইকেল চালাতে পারছিলাম না। পাহাড়ের গায়ে গ্রামগুলি পরিপাটি। লোকেরা সর্বত্র খুব উৎসাহ দিত আমাদের। এদেশের লোকেদের ধারণা যে, বুলগেরিয়া থেকে দইয়ের উৎপত্তি। এজন্য ‘বুলগেরিকুশ ল্যাক্টিকুশ’ বলা হয় এর বীজাণুর নামকে। দইয়ের উপকারিতা সম্বন্ধে এরা নিঃসন্দেহ। প্রায়ই শুনতাম দই ও চিজ খায় বলে এদেশের লোকেরা দীর্ঘায়ু।
বুলগেরিয়ার সীমানা পার হয়ে যুগোস্লাভিয়া দেশে ঢুকে পড়েছি। কোনও ঝামেলা হয়নি। মহাযুদ্ধের আগে যুগোস্লাভিয়া, হাঙ্গেরি ও চেকোস্লাভাকিয়া প্রভৃতি দেশের স্বাধীন অস্তিত্ব ছিল না। প্রথমে দুটি দেশ- অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল আর তৃতীয় দেশটি ছিল জার্মানির অংশবিশেষ। স্বাধীন হবার পর এইসব দেশের লোকেরা প্রাণপণ চেষ্টা করছে তাদের পুরনো অভাব-অভিযোগ দূর করবার, শিক্ষার প্রসার এবং ডাক্তারখানা, হসপিটাল ইত্যাদি বাড়াতে। রাস্তার উন্নতি এখনও হয়নি এইজন্য যে আরও অনেক বড় বড় জরুরি কাজ হাতে নিয়েছে। যুগোস্লাভিয়া ও বুলগেরিয়ার লোকেরা স্লাভনিক জাতি। এদের ভাষার পার্থক্য খুব সামান্যই। ইতালির কিছু অংশ যুগোস্লাভিয়া পেয়েছে যেটা আড্রিয়াটিক সমুদ্রের ধারে। ট্রিয়েস্ট বড় বন্দর, এখন যুগোস্লাভিয়ার অন্তর্গত। এই অঞ্চলে অনেক নতুন শিল্প গড়বার খুব তোড়জোড় হচ্ছে। বিশেষ করে জাহাজ তৈরি করতে যুগোস্লাভিয়া খুবই দক্ষতা দেখাচ্ছে। স্লাভদের কর্মকুশলতা এত বেশি যে আশা করা যায় একদিন এরা শিল্প ও চাষবাসে সমান সাফল্য লাভ করবে।
যুগোস্লাভিয়ায় এখন রাজতন্ত্র। নভেম্বর মাস এসে গেল। হাঙ্গেরিতে মোটামুটি রাস্তা খারাপ। বরফ পড়লে না জানি কেমন হবে। সমস্ত হাঙ্গেরি একটা সমতল জমির ওপর বলে খুব ভালো গমের চাষ হয়। এই দেশের রুটি স্বাদের জন্য বিখ্যাত। এখানে মদ ‘টোকাই’ বিশেষ আদৃত সকলের কাছে।
পথের ধারে প্রায়ই ঘোড়ায় টানা বড় বড় গাড়ি দেখতাম, তার মধ্যে জিপসি পরিবার বাস করত। তারা ম্যাজিক দেখিয়ে, গান গেয়ে ও বাজনা, বিশেষ করে বেহালা বাজিয়ে রোজগার করে। এক জায়গায় থাকে না। চিরদিন এদের যাযাবরের জীবন। গাড়ির ভেতর রান্নাঘর, বাথরুম, শোবার ঘর ইত্যাদি সব আছে। ঠান্ডা দেশে এরকম জীবন মোটেই কষ্টকর নয় বরং আরামের। যেখানে ভালো লাগে সেখানেই কয়েকদিন থেকে যায়। জিপসিরা সব নাকি ভারতবর্ষ থেকে ইউরোপে এসেছে। এদের ছেলেমেয়েদের চুল মিশকালো ও চোখের মণিও কালো। গায়ের রং ফর্সা যদিও রোদে পোড়া। খানিকটা কৃচ্ছ্রসাধন করে থাকে বলে আমার ধারণা হয়েছিল জিপসিরা কিছুটা নোংরা। হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, যুগোস্লাভিয়া ইত্যাদি দেশে কত শত গল্প- গান এদের নিয়ে লেখা হয়েছে তার ঠিক নেই। বড় বড় রেস্তোরাঁয় জিপসি মিউজিক আমোদ আহ্লাদের একটা বিশেষ অঙ্গ। যুদ্ধের সময় জিপসিদের একত্র করে রাখে— তারা কোনও দেশবাসী নয় বলে, একরকম ‘ইন্টার্ন’ করার মতো
জিপসিদের মেয়েরা খুব সুন্দর, বাচালতার জন্যও এরা বিখ্যাত। সাধারণত এদের বিয়ে হয় নিজেদের মধ্যে অর্থাৎ অন্য জিপসির সঙ্গেই।
জাতিতত্ত্ববিদরা বলেন, ইউরোপে দুটি জাত এরিয়ান নয়, পীত বংশধর। হয়তো একদিন ফিনল্যান্ড ও হাঙ্গেরির লোকেরা এশিয়া থেকে গিয়ে ইউরোপে বসবাস আরম্ভ করেছিল। সেটা এতদিন আগে যে সংমিশ্রণের ফলে আজ তা খুঁজে বের করা যায় না— যদিও পিতৃপুরুষের ধমনীতে একদা পীত জাতির রক্ত বইত। আজ এদেশের লোকেদের রং জার্মান কিংবা ফরাসিদের মতোই। মাথার চুলেও সোনালি খড়ের রং দেখা যায়। ‘নর্ডিক ফিচারই’ বরং বলা যায়।
হাঙ্গেরির লোকেরা মনে করে তাদের এশিয়াতে একদিন দেশ ছিল এবং সেই কারণে আমাদের প্রতি খুব সহানুভূতিশীল। মেয়েরা রূপের জন্য বিখ্যাত। একদিন রাত্রে দেখলাম খুব বরফ পড়েছে। আমরা এতদিন প্রায়ই খড়ের গাদায় শুয়ে রাত কাটিয়েছি। এবার গ্রামের মধ্যে কোথাও রাত্রিবাস করতে হবে। একদিন রাতের অন্ধকারে একটা ছোট্ট গ্রামে পৌঁছলাম। রাস্তায় লোকজন নেই। কোথায় রাত কাটাব ভাবছি, হঠাৎ একটা ঘোড়ার আস্তাবল দেখলাম। চারটি ঘোড়ার থাকার জায়গা ছিল কিন্তু ঘোড়া ছিল তিনটি। আমাদের দেশে যেমন গরু লাঙল টানে, ইউরোপে তেমনই ঘোড়া লাঙল দেয়। ঘোড়াদের মালিক-চাষীর কাছে হুকুম নিয়ে আমরা অনুপস্থিত চতুর্থ ঘোড়ার খাটাল অধিকার করলাম। আস্তাবল খুব পরিষ্কার। অনেক খড় নিয়ে আরাম করে শুয়ে পড়লাম। শীতের দেশে আস্তাবল পুরোপুরি বন্ধ করা হয় রাত্রে, তা না হলে গরু, ঘোড়া, শুয়োর ও মুরগি শীতে জমে যাবে।
ঘুম ভাঙতেই দরজা খুলে সকালবেলায় এক নতুন জিনিস দেখলাম যার অভিজ্ঞতা আগে আমাদের একেবারেই ছিল না। পেঁজা তুলোর মতো ঝিরঝির করে সমানে বরফ পড়ে যাচ্ছে। রাস্তার ওপারে বাড়ির জানলার কোলে চার্চের ছাদ, সব সুন্দর সাদা হয়ে গিয়েছে। দেশে থাকতে আমরা বরফ কুলফি, আইসক্রিমে কিংবা সরবতের গ্লাসে দেখেছি। তাই প্রথমটা মজা লাগল বরফের মধ্য দিয়ে যেতে হবে ভেবে।
বাস্তবিক যখন বরফের মধ্যে চলতে আরম্ভ করলাম তখন সাইকেল নিয়ে চরম দুর্দশা শুরু হল। সাইকেলসুদ্ধ কেবলই আছাড় খেলাম, রাস্তা যেহেতু খুব পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছে। অবশেষে আমরা হেঁটে চলতে লাগলাম। ক্রমে ক্রমে হাঁটাও অসম্ভব হয়ে উঠল। যতই পাহাড়ের উঁচু জায়গায় চড়লাম ততই বরফ পড়া বাড়তে লাগল। পেঁজা তুলোর মতো নয়, একেবারে দো-বারা চিনির মতো।
ভারতবর্ষ ছাড়ার পর থেকে আমরা যত দেশের ভেতর দিয়ে গিয়েছি সর্বত্র লোকেরা কফি পান করে, চা খাওয়ার অভ্যাস নেই। সেই কনস্তান্তিনোপলে বহুদিন পর ইংরেজ অ্যাম্বাস্যাডর আমাদের চায়ের নেমন্তন্ন করে চা খাইয়েছিলেন, ব্যস ওই পর্যন্ত। দিনেরবেলায় কফি ও রাত্রে মদ সব বাড়িতে ও রেস্তোরাঁয় ব্যবহার হয়। মদের নামে আমাদের সাধারণত মনে যে ছবি জাগে আসলে তা নয়, ইউরোপীয়দের কাছে মদ হচ্ছে স্বাস্থ্যকর পানীয়।
অনেক উগ্র ধরনের মদ আছে যা বাড়িতে তৈরি হয় না, বিশেষ দিনে বা রাত্রে একটু হইহল্লা করার জন্য। বাড়িতে ব্যবহার হয় বাড়ির তৈরি মদ এবং তা দেওয়া হয় পরিমিতভাবে, খাবারের সঙ্গে পানীয় হিসাবে, পারতপক্ষে কেউই জল খায় না!
একদিন হঠাৎ সব বরফ গলে গেল একটু গরম হাওয়া বইল বলে। তখন মাঠেঘাটে কী ভীষণ বরফের কাদা।
আমরা তখন চাষীদের সঙ্গে বেশিরভাগ সময় কাটাই। চাষীরা সর্বত্র লোক ভালো, সবসময়ই আমাদের সাহায্য করার জন্য উৎসুক। রাত্রের শোবার জায়গা কেউ দিতে পারে না। এইসব ঠান্ডার দেশে জীবনপ্রণালী ভিন্ন রকমের, শুতে দিতে হলে আলাদা একটা ঘর দরকার। শীতকে যথেষ্ট তাড়াবার জন্য অনেক পালকের লেপ কম্বল ও বিছানা এবং খাটের প্রয়োজন। গরিব চাষীদের পক্ষে সম্ভব নয় এইসব জোগাড় করা। বিশেষ করে চারজনের জন্য। এই কারণে আমরা কোনও বাড়িতে শীতের রাত্রে আশ্রয় পাবার আশা করিনি। তবু লোকেদের মন খুব ভালো, তাই চিন্তা করত দারুণ শীতের রাত্রে ভারতবর্ষের মতো গরম দেশের লোকেদের কোথায় রাখা যায়। গ্রামে হোটেল নেই, তাছাড়া আমাদের পকেট প্রায় খালি। হোটেলের খরচ দেবার সঙ্গতিও ছিল না।
একদিন দিনের শেষে একটা রুটির দোকানে গেলাম। সেখানে গ্রামের বুড়োরা ‘বিয়ার’ খাচ্ছিল এবং খোশগল্প হচ্ছিল। রুটি কেনবার সময় একজনকে জিজ্ঞেস করলাম রাত কাটাবার মতো কোনও জায়গা যদি জানা থাকে। বার্ন হাউস বন্ধ জায়গা। সেখানে খড়ের গাদায় শীত কাটে না তবে কম্বল মুড়ি দিয়ে কোনওমতে রাত কাটালাম। যে জুতো-মোজা জামা-কাপড় পরে থাকতাম দিনেরবেলায় তারা নিত্যসঙ্গী হয়ে রাত্রেও শরীরের ওপর রয়ে যেত।
দারুণ শীতের মধ্যে আমাদের গায়ের পোকা সব মরে গেল। আমরা নিশ্চিন্ত হলাম। সেই মেসোপটেমিয়া থেকে তাদের ‘অন্তরতম’-র মতো বহন করে এতদূর এনেছিলাম।
রুটিওয়ালার দোকানে— অবশ্য গ্রামে একটিই দোকান— সবই পাওয়া যেত বিয়ার থেকে কেরোসিন তেল, কাপড়, জামা কিছু বাদ নেই, এমনকী লাঙলের ফাল পর্যন্ত। এক আধাবয়সী চাষী আমাদের বলল, ‘চলো আমার বাড়িতে থাকবে তোমরা, একটা কিছু ব্যবস্থা করব’। তখনও দিনের আলো ছিল। দিনটা অপেক্ষাকৃত গরম ছিল বলে লোকজন চলাফেরা করছিল।
একটা বাড়ির সামনে উপস্থিত হলাম। চাষীভাই স্ত্রীকে ডেকে বললেন ‘দ্যাখো, আমি কাদের এনেছি, এদের কোথাও থাকতে দেবে তুমি? এই চারজন যুবক পৃথিবী ভ্রমণ করছে’। এক নিশ্বাসে এতগুলো কথা বলল। এক ভদ্রমহিলা বা চাষী-বৌ বাইরে বেরিয়ে আমাদের রোদে পোড়া ভূত-ভূত চারটে চেহারা দেখে স্বামীকে জিজ্ঞেস করল, ‘এই চারটে ভূতকে কোথা থেকে জোগাড় করলে?” আমরা সন্ত্রস্ত হয়ে দেখলাম চাষী-বৌয়ের হাতে সম্মার্জনী। তৎক্ষণাৎ আমরা মুখ ফিরিয়ে চললাম বলে রওনা দিলাম। যাবার সময় চাষীভাইয়ের কানে কানে বললাম অনেক ধন্যবাদ।
আমরা রাস্তা দিয়ে চলেছি। উল্টোদিক থেকে পাড়ার বৃদ্ধরা যারা রুটির দোকানে বিয়ার খাচ্ছিল তারা বাড়ি ফিরছিল। আমাদের দেখে একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এল এবং সহজেই বুঝে ফেলল আমাদের অবস্থাটা। আরেকজন বলল, আমি তাই ভাবছিলাম যে, জানের কি মনে ছিল না ওর স্ত্রী ভালো মনে নেবে না ভূপর্যটকদের? বৃদ্ধ তাড়াতাড়ি বলল, আমাদের বাড়িতে অসুবিধা হবে, তবু খুব খারাপ নয়। সবাই তারিফ করে মন্তব্য করল, “তোমার বাড়ি থেকে এদের ফিরতে হবে না এটা সুনিশ্চিত।’
আমরা বৃদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে দুরুদুরু বক্ষে কম্পিত চরণে চলছি আর ভাবছি যে, বৃদ্ধের কপালেও হয়তো নিগ্রহ আছে। সে আশঙ্কা অল্পক্ষণে দূর হয়ে গেল। একটি মেয়ে বয়স কুড়ি-বাইশ হবে ও তার মা আমাদের সাদরে গ্রহণ করলেন যখন শুনলেন যে আমরা সেখানেই রাত্রিবাস করব।
সেদিন ঠিক করেছিলাম পাঁউরুটির সঙ্গে আলু-পেঁয়াজের তরকারি তৈরি করে নিয়ে ডিনার সারব। মণীন্দ্র স্টোভ চড়াল। এই পরিবারের নাম ডেনিশ। কর্তার নাম বাটা, মেয়েটির নাম আনা মারিয়া, মিসেস ডেনিশ হাসিখুশি। ডেনিশদের বাড়িতে একটা বুরুশের কারখানা আছে। কারখানার কাজ মেয়ে দেখে। দু-চারজন কর্মী তখন বাড়ি চলে গিয়েছিল। সামনের বড় ঘরটায় কারখানা। আমাদের সেখানে বসবার ব্যবস্থা হল। আমাদের সঙ্গে যে পঙ্গপাল ছেলেমেয়েদের দল এসেছিল তারাও ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
গৃহিণী বললেন যে আগন্তুকরা যখন ভারতবর্ষের লোক তখন পাদ্রীকে ডাকা যাক। তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা তর্জমা করে শোনাবেন। যথাসময়ে রোমান ক্যাথলিক পাদ্রী এলেন হাতে একখানা চটি বই। আমাদের নমস্কার জানিয়ে নিজের পরিচয় দিলেন যে গ্রামের গির্জার পরিচালক তিনি। আমরা ভারতবর্ষের লোক শুনে পাদ্রী খুব খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কি বাঙালি? উত্তর পেয়ে গর্বের সঙ্গে আবার বললেন যে আর কোন দেশের লোক ‘তাগোর’কে কবিতায় তর্জমা করেছে হাঙ্গেরি ছাড়া, তা তিনি জানেন না। সেই কবিতা তিনি ‘মাজার’ ভাষায় পড়বেন। হাঙ্গেরিকে ‘মাজার’ দেশ বলা হয়।
ছন্দ মিলিয়ে কবিতা লেখা বলে আমরা সহজেই বুঝতে পারলাম কোন বাংলা কবিতার তর্জমা পড়লেন। তিনি শেষ করলেন, আমি আমার ঝুলির ভেতর থেকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের দেওয়া বই ‘চয়নিকা’ বের করে একই ছন্দে পড়লাম ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মতো নাচেরে’। ঘরে ভীষণ সাড়া পড়ে গেল। আরও কবিতা পড়লাম। পাদ্রীও ছন্দোবদ্ধভাবে তাদের তর্জমা কবিতায় পড়লেন
দেখতে দেখতে অনেক রাত হয়ে গেল, তখন আনা মারিয়াকে ‘মাজার’ গান গাইতে বললেন। কোনও বাহুল্য না করে গাইল, সরু মিষ্টি গলা। বাংলা গানের মতো শোনাচ্ছিল।
বাটা ডেনিশ সবাইকে বাড়ি যেতে বললেন। আমরা মুখ-হাত ধুয়ে রুটি আর তরকারি খাব মনস্থ করছি, এমন সময় মিসেস ডেনিশ আমাদের চার কাপ গরম সুপ এনে দিলেন। তখন আমরা আমাদের তরকারি অর্ধেক ভাগ ওঁদের দিলাম অনেক অনুনয় করে। মণীন্দ্রর রান্না খুব স্বাদের হয়। ওঁরা স্বামী, স্ত্রী ও মেয়ে, পেঁয়াজ-আলুর গরম তরকারি খেয়ে বেশ তারিফ করলেন।
সন্ধ্যার অন্ধকারে খেয়াল করিনি বাড়িটা কত বড় বা তাতে কটা ঘর আছে। শীতের রাতে মস্ত খাটে পালকের তৈরি গরম বিছানায় আরামে রাত্রিযাপন করলাম। পরদিন ভোরে রওনা হব ঠিক করে ঘর থেকে বেরিয়েছি। খাবার, বসবার এবং রান্নাঘরের সামনে এসে পড়লাম। যা দৃশ্য দেখলাম, তাতে আমাদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। উনুনের আগুন রাতভর জ্বলছে। স্বামী-স্ত্রী দুটো বেঞ্চ জোড়া দিয়ে কম্বল মুড়ির মধ্যে শুয়েছিলেন। সেই ঘরের একাংশে মেয়ের খাট ও বিছানা ছিল। এরকম ত্যাগ স্বীকার আমার ভবঘুরে জীবনে আমি কম দেখেছি। নিজের বিছানা অজানা- অচেনা পরিব্রাজককে ছেড়ে দিয়ে বেঞ্চে শুয়ে রাত কাটালেন ওঁরা!
তাড়াতাড়ি বন্ধুদের ডেকে ঘটনাটা সব বললাম। সবাই অবাক। তখন ঠিক করলাম বাড়িসুদ্ধ সবাইকে ভোররাতে না ঘুম ভাঙিয়ে আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে যাব।
পাশের ঘরে কথাবার্তা শুনে আমরা উঠে পড়লাম এবং বুটজুতো পরে তৈরি হলাম যাবার জন্য কিন্তু তা হবার নয়। কফি ও গরম রুটি খাইয়ে ছাড়লেন। এরকম আতিথেয়তা খুব বিরল।
সারাদিন পথে চলতে চলতে আনা মরিয়ার মিষ্টি মুখটা ও তার গান মনে পড়ছিল। একজনের বাড়িতে ঝাঁটার সম্বর্ধনা, আরেকজনের বাড়িতে আদর-যত্ন ও আন্তরিকতা, দুনিয়ার নিয়মই এই
হাঙ্গেরির ভীষণ দুঃখ যে তার পূর্বের আয়তন ছোট করে তার অংশবিশেষ যুগোস্লাভিয়াকে ও চেকোস্লোভাকিয়াকে মিত্রপক্ষ যুদ্ধের পর দান করে। নোভিসাদ, সেগেড শহর আসলে হাঙ্গেরির অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত ছিল, ওই অঞ্চলের লোকেরা পুরোপুরি মাজার ভাষাভাষী।
হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট অতি সুন্দর। ডানিয়ুব নদী মাঝখানে বয়ে যাচ্ছে। দুপারে দুটো বড় বড় শহর। ‘বুদা’ এবং ‘পেস্ট’, চমৎকার সেতু মাঝখানে। ফরাসি ইঞ্জিনিয়ার লেসেন্সের তৈরি। আইফেল টাওয়ার এবং সুয়েজ ক্যানাল করে তিনি অমর হয়ে গেছেন।
আমরা ওয়াই এম সি এ-তে উঠলাম এবং একটা লেকচারের ব্যবস্থা হল।
পৌঁছবার দুদিন পরেই হাঙ্গেরির মুক্তি যোদ্ধা এবং কবি কোসুথের বিরাট প্রস্তরমূর্তি উন্মোচন করা হবে। আমাদের নিমন্ত্রণ হল। প্রথম সারিতে বসে খুব ঘটা করে মর্মরমূর্তির অভিষেক দেখলাম।
হাঙ্গেরি চাষবাসের দেশ। চারদিকেই তার সাজ-সরঞ্জাম। দেশের লোকেরা তখন চেষ্টা করছে বড় বড় খেতখামারগুলি যন্ত্রচালিত করবার, তাহলে আরও বেশি ফসল পাবার সম্ভাবনা।
রাত্রে ওয়াই এম সি এ-তে ছোটখাটো জনসমাগম হয়েছিল আমাদের অভিজ্ঞতা শোনবার জন্য। পয়সা রোজগার হল সামান্য— ১৫০ টাকা। সেই টাকার মূল্য এই দুর্দিনে অনেক। সামান্য টাকার ওপর ভরসা করে অনেকদূর বহু কষ্টকর পাহাড়ি পথে অস্ট্রিয়া পার হয়ে জার্মানিতে বার্লিন শহরে পৌঁছতে হবে। তখনও আমাদের খুব আশা যে বার্লিনে গিয়ে কমিটির চিঠি ও টাকা পাব। ইতিমধ্যে জাতীয় চিত্রশালা বা আর্ট গ্যালারি দেখতে গেলাম।
সামনে কঠিন শীত আসছে, তা সে যে কত কঠিন হতে পারে আমাদের তা ধারণার বাইরে। কাপড়চোপড় এত কম যে কী করে শীতের সঙ্গে যুদ্ধ করে এগোব তার হদিশ জানা নেই।
আমাদের কাপড়চোপড়ের মোট হিসাব দিলে এখানে মন্দ হবে না। জুট ফ্লানেলের শার্টের নিচে হাতকাটা গেঞ্জি। পাতলা কাপড়ের ব্রীচেসের নিচে আন্ডারওয়ার (ব্রিফ টাইপের) সেগুলি পাতলা সুতির বরং মরুভূমিতে পরবার উপযুক্ত। ভীষণ শীতের দেশে তাদের পরা না পরা সমান। গরম মোজা বা শীতে ব্যবহারের একটা জিনিসও আমাদের ছিল না। গলা ঢাকবার জন্য স্কাউটের স্কার্ফ (সুতির) ব্যবহার করতাম। পরে পশমের স্কার্ফ একটা উপহার পেয়েছিলাম।
ডানিয়ুব নদী পার হয়ে আমরা অস্ট্রিয়ায় প্রবেশ করলাম। এখানে সীমান্তে কোনও বিশেষ ঘাঁটি ছিল না যাত্রীদের জিনিসপত্র বিশদভাবে পরীক্ষার জন্য। একদিন বিকালে সীমান্তের কাছে প্রায় এসেছি এমন সময় ঘন কুয়াশায় রাস্তা ঢাকা পড়ে গেল। সবই অস্পষ্ট। একঘণ্টা প্রাণপণ জোরে সাইকেল চালাবার পরও সীমান্ত ঘাঁটির কোনও খোঁজ পেলাম না। অন্ধকার হয়ে এল চারদিক। কোনও বাড়ির আলো দেখছিলাম না যে কাউকে জিজ্ঞেস করব আমরা কোথায় আছি। আরও আধঘণ্টা চলবার পর রাস্তার অদূরে একটা বাড়িতে আলো জ্বলছে দেখলাম। চাষীর বাড়ি। কাছে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে দেখি চাষীরা জার্মান ভাষায় উত্তর দিল এবং বলল যে আমরা ১১ মাইল দূরে সীমান্ত পার হয়েছি। খিদে-তেষ্টায় এবং ক্লান্তিতে তখন দেহ অবসন্ন, তবু সীমান্তে ফিরে যেতে হল। ছাড়পত্র চাই পাসপোর্টের ওপর তা না হলে দেশ ছাড়বার সময় বহু বিপদ হবে। শুল্ক বিভাগের লোকেরা আমাদের সাইকেল, ক্যামেরা ও বন্দুকের ছাড়পত্র দিলে তবে অন্যদিকের সীমান্তে আমাদের এগোতে দেবে।
শীতের রাত, টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে রাস্তায় জনমানব নেই। কোনও গাড়িও নেই। দশটার সময় সীমান্তে পৌঁছলাম। ঘাঁটিতে দুই দলে পাসপোর্ট এবং আবগারি বিভাগের মোট চারজন লোক ছিল। তারা ঝাঁপ বন্ধ করে সেই রাতের মতো বাড়িতে শুতে যাচ্ছিল। আরেকটু দেরি হলেই সারারাত রাস্তায় কাটাতে হত।
আমাদের কাগজপত্র সব ছাপ মেরে ছেড়ে দিল। কিন্তু এত রাতে যাব কোথায় ভেবেই পেলাম না। একটা বুদ্ধি এল মাথায়। সীমান্তরক্ষীদের অনুরোধ করলাম তাদের ছোট্ট অফিসঘরে আমাদের থাকতে দেবার। তারা রাজি হল।
হাঙ্গেরি পার হয়ে অস্ট্রিয়ায় পৌঁছেছি। অস্ট্রিয়ার ভাষা জার্মানদের ভাষা এক, ভালো উচ্চারণ ও ভদ্রভাষা বলে অস্ট্রিয়ানরা গর্ববোধ করে। লোক হিসাবে অস্ট্রিয়ানরা অনেক অমায়িক ও মিশুকে। মেয়েরা জার্মানদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত সুশ্ৰী এবং অতিথিপরায়ণ।
যুগোস্লাভিয়াতে থাকতে প্রথম লক্ষ করেছিলাম যে তাদের রাজধানীর নাম, ‘বেওগ্রাড’ যাকে আমরা অর্থাৎ যারা ইংরিজির মাধ্যমে নাম শুনেছি, সবাই বেলগ্রাড বলে অভিহিত করি। তেমনই ইউরোপের প্রায় সব দেশের ও শহরের যা আসল নাম তা ইংরেজরা বদলে অন্য নামে ডাকে। যেমন অস্ট্রিয়ার নাম জানলাম ‘ওয়েস্তারাইখ’। ভিয়েনার নাম ‘ভীন’। যথাস্থানে তাদের কথা লিখব
রক্ষীরা আমাদের বিশ্বাস করে ঘাঁটি ছেড়ে কাছেই বাড়িতে গেল। আমরা চেয়ার- টেবিল জোড়া দিয়ে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করলাম। এরকম প্রায়ই হত যে খাটুনির জন্য পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমের হাতে নিজেদের সমর্পণ করতাম, খাওয়া জুটুক আর নাই জুটুক।
ভোররাত ৪টের সময় কে বা কারা দরজায় ধাক্কা দিতে আরম্ভ করল। কম্বল ছেড়ে দরজা খুললাম। দেখি দুজন ভদ্রলোক, পিছনে মোটরগাড়ি দাঁড়িয়ে। গাড়ির নম্বর প্লেটে জি বি লেখা, দুই ইংরেজ ভদ্রলোককে জানালাম যে অফিস খুলবে না।
সকাল সাতটার সময় চারজনের জন্য একপাত্র কফি নিয়ে রক্ষীরা এল। আমরা গরম কফির জন্য অনেক ধন্যবাদ দিচ্ছি, এমন সময় সেই দুই ভদ্রলোক গাড়ি থেকে বেরিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত। কফি আরও দুভাগ করে দিলাম।
সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে রওনা হলাম। গতরাত্রের বৃষ্টিতে রাস্তা ভিজে। রাস্তার অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো। দুঃখের বিষয় অচিরে বরফ পড়তে আরম্ভ হল। সাইকেল চালানো এক বিভীষিকার সামিল হল।
রাস্তা ক্রমে উঁচুর দিকে উঠতে আরম্ভ করল। তখন হাঁটা ছাড়া অন্য কোনও গতি রইল না। বেলা বারোটার সময় একটা ঝরনার সামনে পৌঁছলাম। খিদে পেয়েছে। মণীন্দ্র পরামর্শ দিল খিচুড়ি খাওয়া যাক। একটা ভালো জায়গা দেখে আমরা বসে পড়লাম। শীতের রাতে ধড়াচূড়া পরে চেয়ার সাজিয়ে শুয়ে ভালো ঘুম হয়নি। খিচুড়ি তৈরি হবার আগেই একটু ঘুমিয়ে নিলাম পাহাড়ের গায়ে ঠেস দিয়ে। বেশি করে বরফ পড়তে আরম্ভ করল। দেখতে দেখতে ছয় ইঞ্চি পুরু বরফ জমে গেল রাস্তার ওপর।
যে দুজন ইংরেজ গাড়ি নিয়ে সীমান্তে এসেছিল তারা এতক্ষণে খুব সাবধানে গাড়ি চালিয়ে আমাদের কাছে এল। গাড়ির সব চাকায় লোহার চেন বাঁধা যাতে রাস্তা থেকে ছিটকে চলে না যায়। এবার পরিচিতের মতো আমাদের সঙ্গে ব্যবহার করল। তারপর কী ভেবে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী খাচ্ছ তোমরা?’ আমরা বুঝিয়ে বললাম খিচুড়ি। কী বুঝল জানি না। গাড়িতে গিয়ে একটা সালামি রোল নিয়ে এল এবং আমাদের দিল। ধন্যবাদ জানালাম। সেদিনটা ভালোই কাটল ভোজনের দিক দিয়ে। অগ্রগতির দিক থেকে কিন্তু ফল সন্তোষজনক নয়। আল্পস পাহাড়ে ও রাস্তায় বরফের ওপর দিয়ে হেঁটে সাইকেল নিয়ে উঠতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল।
বিকাল চারটের পরই অন্ধকার নেমে এল। একটা পোড়া কাঠের বাড়িতে উঠলাম রাত কাটাবার মতলবে, দরজা-জানলা কিছুই নেই। সারারাত বরফ পড়ে গেল। সসেজটা শেষ করে কম্বল মুড়ি দিলাম। মেঝেতে মনে হল ভেড়া বা গাধাজাতীয় জীবের ময়লা পড়ে আছে। কম্বলের একাংশ নাকের ওপর টেনে দিয়েও গন্ধ এড়াতে পারলাম না। নেহাৎ ক্লান্তি ছিল। বাইরে ঠান্ডা ঝোড়ো বাতাস, তার চেয়ে এই দুর্গন্ধও শ্রেয় ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম।
তার পরদিন আমরা গ্রাস শহরে পৌঁছলাম। এখানে বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি আছে। ছাত্রাবাসে উঠলাম রাত কাটাবার জন্য। ছাত্ররা আমাদের দেখে এবং কথা বলে আশ্চর্য ও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের নিমন্ত্রণ জানাল তাদের সঙ্গে খাবার জন্য।
মধ্য ইউরোপের ছাত্ররা খুব বিয়ারের ভক্ত। কোনও একটি নির্দিষ্ট হোটেলের হলে ছাত্ররা মিলিত হয় এবং গান ও ফুর্তি করতে করতে বিয়ার খায়। বাড়ি যাবার সময় একটা লম্বা শেলফ-এ কলেজের বিশেষ কারুকার্য করা টুপি রেখে যায়
আমাদের বিয়ার, সসেজ ও রোল খাওয়াল। সেখানে আমাদের কিছু বলতে বলল, আমরা কোন পথে ভারতবর্ষ থেকে অস্ট্রিয়া পৌঁছেছি সবিস্তারে বললাম। কী কষ্ট স্বীকার করে আমরা চলেছি তাদের দেশের মধ্য দিয়ে সে তো তারা দেখতেই পাচ্ছিল নিজেদের চোখে
সকালে দেখলাম রাস্তার ওপর আঠেরো ইঞ্চি বরফ। সব বাড়ির ছাদ ও জানলার কোল সাদা বরফ ঢেকে দিয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে সাইকেল টেনে নিয়ে ক্রমশই আরও উঁচু পাহাড়ে উঠতে লাগলাম। প্রায় ৫,০০০ ফুট উঠলাম। বরফ পড়তে পড়তে রাস্তার ওপর ৭ ফুট বরফ জমে গেছে। রাস্তার দুপাশে দিনে দুবার করে বরফ ঠেলে ফেলার ব্যবস্থা আছে। রাস্তার ধারে টেলিফোন পোস্ট আছে। বরফ টেলিফোনের তারে পর্যন্ত জমে উঠেছে। এ এক অদ্ভুত দৃশ্য। চারদিকে সাদা বরফ ছাড়া কিছু দেখা যায় না। তার ওপর দিয়ে চলা বিপজ্জনক। প্রতি মুহূর্তে মনে হয় পা পিছলে কোথায় নেমে যাব তার ঠিক নেই। একজন অস্ট্রিয়ান পরামর্শ দিল জুতোর ওপর মোজা পরতে, তাহলে উল্টেপাল্টে আছাড় খাওয়া কমবে। আমাদের কাপড়চোপড় ও মোজা ইত্যাদির খুব অভাব, কী করা যায় মোজা খুলে জুতোর ওপর পরলাম, তাতে পড়া অনেক কমে গেল। কিন্তু পা শীতে অসাড়।
বরফঢাকা রাস্তার ওপর দিয়ে যখন একটু গরম হাওয়া বয়ে যায়, তখন বরফ গলে যায়। রাস্তা শক্ত হয়ে যায় ঠান্ডা হাওয়া লেগে। তারপর পিছল উঁচু-নিচু রাস্তায় চলা যে কী কষ্টসাধ্য তা বর্ণনায় কুলোয় না। তখন কি আর জানতাম এর চেয়ে কত বড় কষ্টের সম্মুখীন হতে হবে, দুদিন পরে যখন বরফের ঝড় আরম্ভ হয়ে! ঝোড়ো বাতাস মাইনাস ৩০ ডিগ্রি ঠান্ডা। চোখ চেয়ে সে ঠান্ডা সহ্য করা যায় না। কনকনে হাওয়া লাগলেই চোখ দিয়ে জল পড়ে। নিশ্বাসের সঙ্গে আমাদের সবার নাক সাফ করলে পরমুহূর্তে রুমাল খড়মড়ে কাগজের মতো শক্ত হয়ে যেত। সর্দি জমে নাকে ও দুই চোখে আই সিকল-এর মতো ঝুলত। নাক ও চোখের পাতার সাড় নেই কিন্তু বরফের ছোট ছোট কাঠি চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারতাম না।
অস্ট্রিয়ানরা বলত যে, সেরকম তাণ্ডব বরফের ঝড়ে তারা বাড়ির বাইরে বার হয় না। আমরা নিশ্চয় মরে যাব যেহেতু আমাদের যথেষ্ট গরম জামাকাপড় নেই। আরেকটা জিনিস যা তারা জানত না সেটা হচ্ছে যে পুষ্টিকর খাবার আমাদের অনেকদিন জোটেনি। পুঁজি কয়েকটা টাকা মাত্র। সেইজন্য আমাদের কোথাও বরফের ঝড়ে বসে থাকার অবস্থা ছিল না। যেমন করে হোক চলতেই হবে বার্লিন পর্যন্ত। নিশ্চয় চিঠির জবাব ও টাকা পাব সেখানে।
হায়েলিগেন ব্লুট-এর কাছাকাছি একদিন সকালে আমরা বরফের ঝড়ে এগোতে পারছিলাম না। সাইকেল টেনে নিয়ে যেতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। পাঁচ মিনিট পর পর একহাত পকেটে ঢুকিয়ে গরম করে নিতে হচ্ছিল। হাতের আঙুলের মাথা রক্তশূন্য নীল রং হয়ে গেছে। একবার এ-হাত একবার ও-হাত পকেটে পুরে খুব কমই এগোতে পারছিলাম। এই অবস্থায় আমাদের সবার শরীর অবসন্ন ও চলচ্ছক্তি-রহিত হয়ে পড়েছিল। তার ওপর খাওয়া তো জোটেনি।
বন্ধু আনন্দ বরফের ঝড় আর সহ্য করতে না পেরে বসে পড়ল। তার কাছে এগিয়ে দেখলাম সঙ্গীন অবস্থা। কী করব বা কোথায় আশ্রয় নেব ভাবছি, এমন সময় পুলিশ ঘোড়ায় টানা চাকাহীন স্লেজ গাড়ি নিয়ে এসে থামল। রাস্তায় লোকেরা বিপদে পড়লে স্লেজে উঠিয়ে নিয়ে যায় এবং পুলিশ বিপদগ্রস্ত লোকেদের বা ছোট ছেলেমেয়েদের শুশ্রূষা করে বাঁচায়।
আনন্দর দেহটা ক্রমে অনড় হয়ে আসছিল। স্লেজের ওপর তাকে উঠিয়ে রওনা করে দিলাম। ঘোড়ার গলায় ছোট ছোট ঘন্টা টিংটিং করে বাজতে আরম্ভ করল যখন থপথপ করে ঘোড়া স্লেজটাকে বরফের ওপর টানতে টানতে চলে গেল। পুলিশ ভদ্রভাবে বলল যে তার বাড়ি খুব কাছেই। যদিও এখন সম্পূর্ণ বরফে ঢাকা, তবু সেখানেই যেতে।
আমরা পুলিশের বাড়ি গিয়ে যা দেখলাম তাতে চক্ষু চড়কগাছ। আনন্দর জামাকাপড় খুলে স্বামী-স্ত্রী দুজনে তার দেহের ওপর বরফ ঘষছে। আমাদের ঘরে বসতে বলল, আরও বলল সেখানে আগুনের খুব কাছে যেন না বসি।
আমাদের পা অসাড়। মনে হচ্ছিল বোধহয় ফ্রস্ট বাইট হয়েছে পায়ের আঙুলে। ঘরের ভেতর না গিয়ে আমরা দেখলাম কী অসীম যত্ন ও ভালোবাসা দিয়ে পুলিশ ও তার স্ত্রী আনন্দকে চাঙ্গা করে তুলল। তারপর আমাদের সবাইকে ঘরে নিয়ে গেল এবং একটু ব্র্যান্ডি খেতে দিল। একটু পরে চিজ-এর টুকরো আমাদের সবাইকে দিল। এবং দুজনেই বলল যে এমন দিনে বাইরে না বেরোতে। তাদের আশ্বস্ত করে চারজনে রাস্তায় বরফের স্তূপের ওপর চলতে আরম্ভ করলাম। সারাদিন এমনিভাবে কাটল বরফের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে। খাবার জুটল না। বিকেল সাড়ে তিনটের সময় অন্ধকার নেমে এল। দীর্ঘ রাত্রি কেমন করে কোথায় কাটবে ভাবতে ভাবতে চলেছি। একটা বরফ ঢাকা ছোট গ্রামে পৌঁছলাম। এতদিন আমরা বাইরে যেখানে-সেখানে শুয়ে রাত কাটিয়েছি কিন্তু আর তা সম্ভব নয়। একটা পাব হাউস অর্থাৎ সাধারণের মদ খাবার জায়গায় আমরা উপস্থিত হলাম। এইরকম পাব হাউসে ভবিষ্যতে আমাদের অনেক রাত কাটাতে হয়েছে। পাব-এর মালিককে অনুরোধ করলাম যে ঘরের অনুমতি দিতে। অন্য কোথাও যাবার জায়গা নেই দেখে সে রাজি হল। আমরা চার কাপ গরম জল করে কোকো রুটি দিয়ে রাত্রের ডিনার সারলাম।
এদেশে যত বরফ পড়ে নেশাখোরদের ততই উৎসাহ বাড়ে মদ খাবার। অনেকে ভদ্রতা দেখাবার জন্য আমাদের মদ খেতে দিত। তার বদলে খাবার জল চাইলে সবাই হাসত এবং বলত যে জল খাওয়ার অভ্যাস নেই। তার বদলে আমাদের বিয়ার খেতে দিত। আমরা স্টোভ-এর ওপর একতাল বরফ একটা পাত্রে বসিয়ে খাবার জল করে নিতাম।
সকলেই আমাদের বিষয়ে জানতে চাইত। ঘুম ও ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসত কিন্তু বসে থাকা ছাড়া উপায় থাকত না। যখন সকলে মদ খেয়ে গভীর রাত্রে বাড়ি যেত তখন আমরা কাঠের মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে স্টোভ-এর কোল ঘেঁসে শুয়ে পড়তাম। কয়লার অভাবে আগুন নিভে যেত, বাকি রাত্রি কম্বল মুড়ি দিয়ে টেনে ঘুম দিতাম। পরদিন খুব সকালে পরিচারিকা সিগারেটের টুকরো ও করাতের গুঁড়ো (যাতে সবাই জুতোর বরফ মুছতো) সাফ করতে করতে হঠাৎ আমাদের সামনে এসে দেখত তখন অবাক হয়ে নিজের মনে বলত, ‘আহা গরিব বেচারা, এদের শোবার জায়গা পর্যন্ত জোটেনি।’ আমরা পাশ ফিরে আরেকটু শুয়ে নিয়ে উঠে পড়তাম। এই হয়ে দাঁড়াল আমাদের দৈনিক জীবন। অশেষ কষ্ট সহ্য করে সামান্য এগোতে পারতাম। সারাদিন চেষ্টা ও বরফের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এইভাবে ভিয়েনায় পৌঁছলাম। প্রকাণ্ড শহর সবটা বরফে ঢাকা, সবাই স্কি ঘাড়ে নিয়ে কাছেই গ্রিনসিং পাহাড়ের অসমতল জায়গার দিকে চলেছে। অনেকে শহরের রাস্তায় স্কেট পরে বেড়াচ্ছে। মোটরগাড়ি চলাচল বন্ধ।
ওয়াই এম সি এ-তে গিয়ে খোঁজ করলাম কোথায় দু-চারদিন বিশ্রাম করতে পারি। এক ভদ্রলোক— নাম ব্যোমগার্টনার। আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে তার নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল। যেতে যেতে প্রথমেই মনে হল কমিটির কাছ থেকে হয়তো টাকা এসেছে। পোস্ট অফিসে খোঁজ করতে যেতে হবে সব কাজের আগে। আমাদের ঢাল-তলোয়ার অর্থাৎ জিনিসপত্র বন্দুক ইত্যাদি ব্যোমগার্টনারের দেওয়া একটা ঘরে রেখে বেরিয়ে পড়লাম। অনেক উৎসাহ এবং আশা নিয়ে গেলাম জেনারেল পোস্ট অফিসে। সেখানে যথারীতি হতাশ হয়ে ফিরলাম। কেবল আমার মা-র একটা চিঠি পেলাম।
পোস্ট অফিস থেকে ফেরবার সময় ভাবছিলাম কমিটি কেন কথা রাখল না। আমরা তো শীত-গ্রীষ্ম ও সবরকম কষ্টের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছি। মরুভূমির ১৫০ ডিগ্রি উত্তাপ আর এখন মাইনাস ৩০ ডিগ্রি শীতে নাস্তানাবুদ হচ্ছি। কেন এমন হল। আমাদের শেষপর্যন্ত কি পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে না খেয়ে মৃত্যু হবে! দেশভ্রমণের ইচ্ছা পুরো থাকলেও সন্দেহ জাগছে পরিণতির কথা ভেবে। আমি নিজে ভাবলাম ঘরের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং সুনিশ্চিত জীবন ছেড়ে আমরা কোথায় চলেছি জানি না। নেহাৎ অদম্য উৎসাহ ও অটুট ভালো স্বাস্থ্য, তাই এত কষ্টেও টিকে আছি এখনও। হিসেব করলাম কয়দিন দিবারাত্রি আমরা বুটজুতো খুলিনি। জুতো পরেই ঘুমনো অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।
ভিয়েনায় বাড়ি ফিরে গিয়ে দেখি ইহুদি সন্তান ব্যোমগার্টনার অনেকগুলি হ্যাম স্যান্ডউইচ ও একপাত্র কফি নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। অনেক ধন্যবাদ দিয়ে গোগ্রাসে খেলাম। বিকালে সেন্ট স্টিফেন গির্জা দেখতে গেলাম। তারপর দ্রষ্টব্যের মধ্যে ছিল আর্ট গ্যালারি ও বিখ্যাত সঙ্গীতরচয়িতা বিঠোভেনের বাড়ি।
অনেকদিন পর গরম জলে স্নান করে নিজেদের ঘসে মেজে পরিতৃপ্ত হলাম। আবার কবে স্নান করতে পারব জানি না। আমাদের জীবন তখন অনেকটাই উটের মতো হয়ে উঠছিল। যখন খাবার পাচ্ছি বেশি করে খেয়ে নিই— কবে আবার পেট ভরে খেতে পাব কে জানে। ইতিমধ্যে আমাদের কয়েকদিন উপবাসে কেটেছে যদিও চলা এবং পরিশ্রম কিছু কম হয়নি।
ব্যোমগার্টনারকে বললাম ওয়াই এম সি এ-তে পরদিনই আমাদের ভ্রমণকাহিনী শোনাবার ব্যবস্থা করতে, সে খুব খুশি হয়ে ব্যবস্থা করল।
মিটিং-এ আমাদের সাজ-সরঞ্জাম ও দারুণ শীতের সঙ্গে যুদ্ধ করবার সব হাতিয়ার দেখে সবাই আশ্চর্য হয়ে গেল। সবাই বলল যে এত সামান্য জামা-কাপড় নিয়ে আর আমরা বেশিদূর এগোতে পারব না। মৃত্যু সুনিশ্চিত। ভয় পাইনি এই কথায়। এটা বোঝাবার জন্য আমরা বললাম যে ভারতবর্ষ থেকে অনেক সূর্যরশ্মি আমাদের দেহে নিয়ে এসেছি। আমরা সব সহ্য করতে পারি। কেউ বিশ্বাস করতে চাইছিল না। আমরা পর্বতপ্রমাণ বরফ ঠেলতে ঠেলতে ভিয়েনা পর্যন্ত পৌঁছেছি এটাই ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় যুক্তি।
হাতে তখন আমাদের একটা পয়সা ছিল না। একটুকরো রুটি আর দু চামচ কোকো খাবার মতো পয়সাও ছিল না। চিনি খাওয়া অভাবের তাড়নায় অনেকদিন ছেড়ে দিয়েছিলাম, যদিও শীতে এইরকম পরিশ্রমের জন্য মিষ্টি খাওয়া বিশেষ প্রয়োজন।
শীত সহজেই অসহ্য হয়ে পড়ে যদি মাঝে মাঝে শরীরটাকে বিশ্রাম দিয়ে গরমে নিজেদের পুনরুজ্জীবিত করতে না পারি। পেট খালি থাকলে শীতও বেশি লাগে।
তিনদিন ভিয়েনায় কাটিয়ে রওনা হলাম— আবার বরফের ঝড়ের মধ্যে।
ব্যোমগার্টনার-এর সহৃদয়তা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। ইহুদিদের বিরুদ্ধে সবাই যে বদনাম দেয় তা বেশিরভাগ মিথ্যা এবং হিংসাপ্রণোদিত। ব্যোমগার্টনার বার্লিনে তার এক আত্মীয় মিসেস আর্নহাইম-এর সঙ্গে দেখা করবার জন্য একটা চিঠি দিল। ভবিষ্যতে সেই পরিচয়পত্র আমার অশেষ উপকার করেছিল।
ডানিয়ুব নদী যখন পার হলাম তখন নদীর জলের ওপরে বরফ জমে গিয়েছে। তার ওপর দিয়ে সবাই যাতায়াত করছে এমনকী গাড়ি পর্যন্ত। ব্রিজের ওপর উঠতে কেউ চায় না। যার যেখানে দরকার সেইখানে নদী পার হচ্ছে। কত অসংখ্য ছেলেমেয়ে এমনকী বয়স্করাও বুটের ওপর স্কেটিং শ্য পরে মনের আনন্দে নাচছে, দৌড়চ্ছে এবং খেলছে। ছোটদের খুব প্রিয় খেলা বরফ দিয়ে মানুষ তৈরি করা তারপর দূর থেকে তাকে লক্ষ্য করে বরফ ছোড়া।
এরপর আমাদের লক্ষ্যস্থান হল স্টেয়ার শহর। শিল্পের জন্য বিখ্যাত বিশেষ করে ওই নামেই সেখানে ভালো মোটরগাড়ি তৈরি হয়। আগে অস্ট্রিয়া এত ছোট দেশ ছিল না।
স্টেয়ারে কারখানার গেস্টহাউসে আশ্রয় পেলাম। গেস্টহাউসে কোনও গেস্ট বহুকাল থাকেনি— থাকবার উপযুক্ত ব্যবস্থাও নেই। যাহোক ঘরটায় আসবাবপত্র না থাকলেও আমাদের একান্ত নিজেদের ব্যবহারের জন্য সেটা একরাত্রির জন্য পেলাম বলে খুব ভালো লাগল। বহুদিন পরে বেলা চারটে থেকে রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত বসে থাকার হাত থেকে রেহাই পেলাম।
শীতের রাত এত দীর্ঘ যে মনে হয় সাত ঘণ্টার বেশি দিনের আলো দেখতে পেতাম না। বাকি সতেরো ঘণ্টা আলো জ্বেলে থাকলে ভালো হয়।
পরের বড় শহর লিন্স-এ পৌঁছলাম। এককালে এখানেও অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল। লোকেরা অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন মনে হল। লিস শহরের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অনেক বরফ ঢাকা উঁচু পাহাড় আছে। এই পাহাড়ের নাম বোহেমিয়ান মাউন্টেন্স (আল্পসের অন্তর্গত)। আমাদের গন্তব্যপথ ওই পাহাড়ের গা দিয়ে উঠে গিয়েছে। এর পরেই আমরা জার্মানি পৌঁছব, যদি বরফ ঢাকা পাহাড় পার হতে পারি।
ডানিয়ুব নদী পাহাড়ের মধ্যে সরু উপত্যকা ধরে, চলেছে— এখানেও বেশ চওড়া যদিও দুধারে উঁচু পাহাড়
সীমান্তের বড় শহর পাশাউ-এ পৌঁছলাম। পাহাড়ের ওপর শীতের দিনে চারদিকে ধোঁয়াটে কুয়াশা, তারই মধ্যে ডানিয়ুব নদীকে অস্পষ্ট আলোয় গলিত রুপোর স্রোতের মতো দেখাচ্ছিল।