দুচাকায় দুনিয়া – ২

হায়দ্রাবাদে দুদিন কাটিয়ে আমরা পথ ধরলাম করাচির। মোটামুটি চলবার রাস্তাই পেলাম। এদিকে বাবলা গাছ, ঝাউ ও ইউক্যালিপ্টাস যথেষ্ট। বাবলার কাঁটা আমাদের অস্থির করে তুলল। একটু পর পর টায়ার অর্থাৎ টিউব ফুটো হয়ে যেত এবং না সারিয়ে সাইকেল চড়া সম্ভব নয় বলে ধৈর্য ধরে টিউব সারাতে লেগে যেতাম।

ক্রমে ক্রমে এগিয়ে আমরা সিন্ধুনদ বা ইন্ডাস-এর বিস্তীর্ণ জলরাশির সামনে পড়লাম। তবে কোনও নৌকো দেখতে পেলাম না। কেমন করে বিশাল নদী পার হব ভাবছি, এমন সময় দূরে রেলওয়ে ব্রিজ দেখলাম। সেদিকে এগোতে লাগলাম নদীর পাড় ধরে। ব্রিজটা কেবলমাত্র রেলগাড়ি পারাপার করে – স্লিপারের মাঝখানে ফাঁক। মানুষের চলার পথ ছিল না। দুটো লাইন ছিল ঠিকই কিন্তু পাশাপাশি নয় বলে ট্রেন এসে পড়লে রক্ষা ছিল না। এইরকম বিপদের সম্ভাবনা দেখেও কেমন করে সাহস হল জানি না, আমরা সাইকেল কাঁধে নিয়ে স্লিপারের ওপর দিয়ে এগোতে আরম্ভ করলাম। প্রায় আধ মাইল অতি কষ্টে চলার পর মনে হচ্ছিল স্লিপারের মাঝের ফাঁকে বোধহয় পা পড়বে তারপর নিচে ঘূর্ণায়মান নদীর জলে সব শেষ!

নিচের দিকে চাইতেই হচ্ছিল কিন্তু প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল আমাদের পরমায়ু ফুরিয়ে এসেছে। খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম সাইকেলটা দুটো স্লিপারের সংযোগস্থলে রেখে। তার ফলে সুস্থ বোধ করলাম কিছুটা। ভারের বোঝায় বোধহয় আমাদের মাথায় রক্তের চাপ সৃষ্টি করেছিল। কোনও ট্রেন ওই লাইনে এলে আমাদের অনিবার্য মৃত্যু অথচ সেই অফুরন্ত ব্রিজের শেষ নেই। অন্যপার বহুদূর। আবার বোঝা তুলে চলতে আরম্ভ করলাম। অতিকষ্টে দীর্ঘ সেতু পার হলাম, তারপর একসময় হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ভাগ্য ভালো প্রায় দুই ঘণ্টা কোনও ট্রেন আসেনি আমাদের পথে। এলে কী করতাম! পৃথিবী ভ্রমণের ওইখানেই ইতি হয়ে যেত। আমাদের উচিত ছিল নৌকোর জন্য বসে থাকা।

ওপারে অদূরে করাচি শহর। তখনকার করাচি পরিষ্কার চকচকে, ঝকঝকে চওড়া রাস্তা ও দোকান দিয়ে সাজানো ছিল। তবে এখনকার মতো শহর অত বড়-বড় ছিল না আর অত নোংরাও ছিল না। করাচিতে তখন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ এয়ারপোর্ট ছিল। এখন তা পাকিস্তানের অন্তর্গত। আমরা নিমন্ত্রণ পেলাম মিঃ এ সি চ্যাটার্জির বাড়িতে ওঠার। সে বাড়ি থেকে সমুদ্র দেখা যেত। আমাদের করাচি যাবার উদ্দেশ্য ছিল, যেখান থেকে জাহাজ নিয়ে ইরান বা ইরাকের বন্দরে পৌঁছনো।

চারদিন অপেক্ষা করার পর বি আই কোম্পানির জাহাজ পেলাম। ডেক প্যাসেঞ্জার হিসাবে যাব আর তার পরিবর্তে আমরা জাহাজ সাফ করব ও যাতে সবাই খাবার ঠিকমতো পায় সেদিকে সাহায্য করব। ডেকের ওপর আমরা সব শুয়ে থাকতাম। আমার বিছানা আড়াই ফুট চওড়া ও সাড়ে ৬ ফুট লম্বা। আমার ডাইনে- বাঁয়ে থাকত অন্য লোকেরা। বিছানা বলতে একটা ক্যানভাসের টুকরো মাত্র।

খাবার মধ্যে ছিল দুবেলা থালাভর্তি ভাত ও ঝাল তরকারি। জাহাজ থামল বাসরা বন্দরে। প্রথম মহাযুদ্ধে এখানে অর্থাৎ মেসোপটেমিয়ায় তখন ৪৯ নম্বর বেঙ্গলি রেজিমেন্টের অনেক বাঙালি যুদ্ধের পর বাড়ি ফিরে না গিয়ে এদেশেই বসবাস করছিলেন। তাছাড়া অনেক বাঙালি এসেছিলেন বাসরা বন্দর থেকে ঐতিহাসিক বাগদাদ পর্যন্ত রেললাইন পাতার কাজ নিয়ে। কয়েকজন আবার আরব দেশের মেয়েকে বিয়ে করে ঘরসংসার পেতেছেন দেখলাম। এইরকম বাঙালি ও আরবি বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে খুব আদর-যত্ন পেয়েছি। অনেক আরবি স্ত্রী, বাংলা ধরনের রান্না শিখেছেন যা আমরা তারিফ করেছি খুবই। এঁদের বেশভূষা আরবি ধরনের, তবে পর্দার কোনও বালাই নেই। সবার রং খুব ফর্সা। যারা রোদে পুড়ে সবসময় কাজ করে বা খেটে খায় তারা অবশ্য মিশকালো। মধ্যবিত্ত আরব যুবক-যুবতীর রং বেশ উজ্জ্বল।

এই দেশে জলের অভাব ও তারই ফলে নোংরার জন্য মাছির উপদ্রব খুব বেশি। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সারাক্ষণ মাছির সঙ্গে লড়ে উঠতে পারে না। সবসময় দেখা যেত তাদের মুখের ওপর মাছি বিড় বিড় করছে। মাছি কচি ছেলে-মেয়েদের গালে ও চোখের কোলে ঘা করে দিত। সেই ঘা জন্মের মতো গালের ওপর দাগ বা ছাপ রেখে যেত। শিক্ষার অভাব ও অযত্নের ফলে এইরকম ক্ষতিকর চিহ্ন মেয়েদের মুখে প্রায়ই দেখতাম।

কফি খাওয়ার রেওয়াজ আরবসমাজে চিরাচরিত। শহরের লোকেরা কফিখানায় বসে মেয়েদের নিয়ে পরচর্চা করত যেমন সব শহরেই হয়ে থাকে। সেই কফি যেমন আমরা খাই তেমনই, কেবল দুধ ছাড়া। উটের দুধ দিয়ে কফি করলে, কফির সুগন্ধের বদলে উটের গায়ের বোটকা দুর্গন্ধে মনে হত কাপভর্তি। কেউ কেউ দুধ দিয়েই খায়। উটের গায়ের দুর্গন্ধ আমাদের কাছে যতই অসহ্য লাগুক, এদেশের লোকেদের কাছে তা গা-সওয়া হয়ে গেছে।

এবার বেদুইনদের কথা বলি। বেদুইনরা যাযাবর, দেশময় ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু যেখানেই তারা বসে সেখানেই বালির ওপর একটা ছোট্ট চুলার মতো করে নেয়। তার মধ্যে ঘুঁটের (উটের) আগুন জ্বলে সারাক্ষণ, সেই আগুনের ওপর কফির কেটলিতে সুস্বাদু কফি তৈরি করে— খুব ঘন কালো সিরাপের মতো। অনেক চিনি দিয়ে মিষ্টি করে ছোট-ছোট চুমুক দেয়। কফির স্বপক্ষে আরবরা হলফ করে বলে যে, তাদের মরুভূমির দেশে এটা নাকি তৃষ্ণা নিবারণ করে। কথাটা ঠিক। অল্প অল্প কফি খেলে তেষ্টা তেমন পায় না।

বাসরার সমস্ত ভারতীয়রা— তার মধ্যে শতকরা নম্বইজনই বাঙালি। এক সন্ধ্যায় মস্ত ভোজের আয়োজন করেছিলেন আমাদের সঙ্গে আলাপ করার জন্য। অনেক আপ্যায়নের পর বাংলা শুরু হল। তখনকার দিনে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রবাসী বাঙালির কাছে তেমন প্রিয় ছিল না যেমন ছিল দ্বিজেন্দ্রগীতি। বেশিরভাগ থিয়েটার হত দ্বিজেন্দ্রলালের নাটক নিয়ে। সেজন্য এখন মনে হয় গানগুলি থিয়েটারি ঢঙে সুর দেওয়া, যদিও কয়েকটি গান অতুলনীয় লাগত আমার কাছে যেমন— ‘মেবার পাহাড় শিখরে যাহার…… এবং ‘পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গে….’ প্রভৃতি।

বাসরা বন্দর বলে সেখানে অনেক জাহাজ আসে-যায়। রপ্তানির মধ্যে প্রধান হচ্ছে খেজুর এবং পেট্রোল জাতীয় খনিজ পদার্থ, যা ‘মোশাল’ (Mosul উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত) অঞ্চল থেকে আসে। খেজুর এত চমৎকার ফল যে মানুষ এর মধ্যে যথেষ্ট পুষ্টি লাভ করতে পারে। পৃথিবীর কম দেশেই এইরকম উন্নতমানের পরিষ্কার ও সুস্বাদু খেজুর পাওয়া যায়। এদের খেজুর আমাদের দেশে ও পশ্চিমের নানা জায়গায় রপ্তানি হয়। শুধু সেই রোজগারেই অবশ্য একটা দেশ চলে না। একটা বড় সংখ্যক লোক শহরের বাইরে জীবনভর ভেড়া ও ঘোড়া পালন করে। আরবি ঘোড়া জগদ্বিখ্যাত। ভেড়া, যাকে আরবরা বলে দুম্বা, তাদের স্বাস্থ্য খুব ভালো, লোমও যথেষ্ট। আমার অবাক লাগত যে আমাদের শস্যশ্যামলা বাংলা দেশের ভেড়া যথেষ্ট ঘাস খেয়েও শীর্ণকায়, বিরল-লোম, দুধ তো তাদের প্রায় থাকেই না। আরব দেশের দুম্বা কী খায় তার একটা হিসাব দিই— মেসোপটেমিয়ার ভেতর দিয়ে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদী বয়ে গেছে। নদীর ধারে খুব সামান্য চাষ-আবাদ হয়। বাকি দেশটা ধুলোর মতো বালি-ভর্তি মরুভূমি। কিন্তু বালির নিচে এককালে খুব সরস চাষোপযুক্ত জমি চাপা পড়েছে। বৃষ্টি খুব কদাচিৎ হয়। বৃষ্টির পরেই দেখা যায় সহজেই আপনি সবুজ ঘাস গজিয়েছে। তারপর আগুনের ভাঁটার মতো সূর্য সেই ঘাস পুড়িয়ে সরু কাঠির মতো করে দেয়। মরুভূমির রঙের সঙ্গে মিলে যায় ঘাসের রং।

যাযাবর বেদুইন জাতির সম্পদ হচ্ছে ভেড়া। ভেড়াদের নিয়ে শুকনো ঘাসের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় সারাদেশ। ওই ঘাসের মধ্যে খাদ্যের সারবস্তু যথেষ্ট থাকে। কিন্ত কোথায় সে ঘাস পাওয়া যাবে তা কোনও বেদুইন জানে না। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ মিলে যায় একটা ঘাসওয়ালা জায়গা। সেই জায়গাটা হয়তো পাঁচ বর্গমাইল জুড়ে। যদি অন্য একদিকে আরেক বেদুইন তার ভেড়ার পাল নিয়ে চরাতে আসে তো দুই দলে মারামারি, গুলি ছোড়াছুড়ি অবশ্যম্ভাবী। যে দল জিতবে সে অন্যদের ভেড়া-ঘোড়া, স্ত্রী ও তাঁবু সব দখল করে নেয়। চাষবাসের যখন সুবিধা নেই তখন ভেড়াই বেদুইনদের সম্বল। যথেষ্ট দুধ পায়— যা থেকে বাচ্চাদের খাওয়ায় এবং দই তৈরি করে। দই তৈরি করে অভিনব উপায়ে— একটা মশকের ভেতর। ভেড়া মেরে তার পায়ের চামড়া বেঁধে দেয় এবং গলার ভেতর দুধ ঢেলে দিলে তা অল্প সময়েই দই হয়ে যায়। আমরণ সেই মশকের ভেতর দুধ ঢেলে যায় ও দই পায়। সে দই রাম টক। চারদিকে এত প্রচণ্ড গরম যে দই খেতে ভালোই লাগে, সে যতই টক হোক। ১৩৫-১৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট গরম, ছায়াবিহীন দেশ। ভেড়ার মাংস কখনও কখনও ওরা ঝলসে খায়— খুব সুস্বাদু এবং নরম। ভেড়ার পশম বেচে অনেক টাকা পায়। এবং এই পশম থেকে নিজেদের কাপড়-জোব্বা তৈরি করে, তাঁবুও পশম থেকে বানায়। এই থেকে বোঝা যায় ভেড়া কত বড় সম্পদ বেদুইনের কাছে। এই ভেড়া রাখার তাগিদে তারা বন্দুক ঘাড়ে সবসময় ঘুরে বেড়ায়। বেদুইনদের মধ্যে অনেকে হজযাত্রীদের সঙ্গে ক্যারাভ্যানে যোগ দেয়— তারপর মরুভূমির মধ্যে হঠাৎ খুন ও লুটতরাজ আরম্ভ করে দেয়

ওখানে সকাল দশটার পর সাইকেলের লোহা এত গরম হয়ে যেত যে দস্তানা ছাড়া হ্যান্ডেল ধরা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। দুপুর রোদে বালির ওপর দিয়ে চলা বেশিরভাগ সময়েই কঠিন। বৃষ্টির কোনও নির্দিষ্ট মরসুম নেই। হঠাৎ বৃষ্টির পর রোদ উঠলে ধুলোর মতো বালি জমে শক্ত হয়ে যেত। তখন তার ওপর দিয়ে সাইকেল চড়েও যেতে পারতাম।

এককালে পৃথিবীর খুব সভ্য লোকেরা এই অঞ্চলে বাস করত। আমরা যে ‘গার্ডেন অব ইডেন’ এবং ‘হ্যাঙ্গিং গার্ডেন অব ব্যাবিলনে’র কথা বইয়ে পড়েছি তা এই দুই নদীর সঙ্গমস্থলে— জায়গাটার নাম করুণা। আজও লোকেরা একটা শুকনো গাছ দেখিয়ে বলে যে সেটা নাকি ‘ট্রি অব নলেজ’। মোট কথা, ব্যাবিলন এককালে সমৃদ্ধ এবং চাষোপযুক্ত দেশ ছিল। কোনও এক ভৌগোলিক কারণে সার মাটি নিচে চলে গেছে এবং বালি ওপরে উঠেছে। রাতারাতি বৃষ্টিতে ঘাস গজিয়ে ওঠার কারণ এই। এদেশের সবাই, ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত বিনা জিনে ঘোড়ায় চড়তে পারে, সবাই বন্দুক ব্যবহার করতেও জানে অল্প বয়স থেকেই আত্মরক্ষার তাগিদে।

বৃষ্টি যদি কদাচ হয় তখন ধুলো-বালির মরুভূমিতে এমন কাদা হয় যে একেবারে চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ে। কাদা শুকিয়ে গেলে সমতল মাটি শক্ত হয়ে ওঠে।

যখন দুপুর রোদে ভীষণ গরম তখন প্রায়ই আমাদের চলার পথে দেখেছি দূরে দিগন্তরেখার কাছে যেন জলাশয় রয়েছে। আরেকটু কষ্ট করে, আরও এগিয়ে গেলে সেই দুষ্প্রাপ্য জল অনেক পাব ভাবতে ভালো লাগে। তাই বিশ্বাস হয় জল ঠিকই দেখছি, আসলে সেটা মরীচিকা।

বাসরা ছেড়ে বাগদাদের দিকে রওনা হলাম। চলার নির্দিষ্ট কোনও পথ নেই— কম্পাস বা দিকনির্ণয় যন্ত্রের সাহায্যে চলা।

বাসরা শহরের বাইরে দেখলাম উটের ‘ক্যারাভ্যান’ দাঁড়িয়ে আছে হজযাত্রীদের নিয়ে। তারা দলে ৩০০-৪০০ হলে রওনা হবে।

আমরা উটের ও মানুষের ভিড় ঠেলে চলেছি। আমাদের টুপি ও সাজগোজ এবং সাইকেল ও বন্দুক দেখে সবাই ভাবত আমরা বুঝি সৈনিকের দল, বেদুইনদের শায়েস্তা করতে মরুভূমিতে চলেছি। শায়েস্তা করা তো দূরের কথা, বেদুইনদের কীর্তিকলাপ দেখে মনে হচ্ছিল এদের হাত থেকে কেমন করে আমরা রক্ষা পাব ও এগিয়ে যেতে পারব। ‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন’ পড়ে যে লোভনীয় রোম্যান্টিক কল্পনা হয়েছিল তা বাষ্পের মতো উবে গেছে। তবু বেদুইনের ভয়ে পৃথিবী ভ্রমণ ছাড়লে চলবে না। এদের সঙ্গে এদের মধ্যে আমাদের বোঝাপড়া করেই চলতে হবে— কেমন করে জানি না। বোধহয় সাহসে ভর করেই।

সঙ্গে অনেক জল নিয়ে রওনা হয়েছিলাম। সাংঘাতিক গরমে তেষ্টায় সেসব শেষ করে ফেলেছি। আর মাত্র সামান্য জল ছিল পরদিনের জন্য। মরুভূমির মধ্যে সারাদিন প্রায় বিশ মাইল পথ অতিক্রম করেছি। সূর্যাস্ত হবার আর বেশি দেরি নেই। বালির পাহাড়ের ছায়া দীর্ঘতর হয়ে যাচ্ছে। রাত্রে মরুভূমির মধ্যে কোথায় থাকব কোনও ধারণা ছিল না। এমন সময় হঠাৎ একদিক থেকে দিনান্তের নমাজ পড়া শুনতে পেলাম। সাবধানে দেখলাম একজন ‘শেখ’ মাটিতে হাঁটুর ওপর বসে নমাজ পড়ছে পশ্চিমের দিকে মুখ করে। তার পিছনে চারজন বেদুইন (সবাই সশস্ত্র ও বন্দুকধারী) নমাজ পড়ছিল একই সঙ্গে। আরও পিছনে পাঁচটা আরবি ঘোড়া ছাড়া ছিল।

আমরা বুঝতে পারলাম যে এদের এড়িয়ে মরুভূমিতে চলতে পারব না, সেজন্য আমাদের উচিত বেদুইনের সঙ্গে বোঝাপড়া, এমনকী সম্ভব হলে ভাব করে চলা। আমাদের প্রত্যেকের গলায় স্কাউটের সবুজ রঙের রুমাল ছিল। পরে বুঝেছিলাম সেগুলি আমাদের খুব সাহায্য করেছে।

যারা একবার ‘হজ’ অর্থাৎ মক্কা এবং মদিনায় তীর্থ করে এসেছে, কেবলমাত্র তারাই সবুজ রঙের গলবস্ত্র বা রুমাল ব্যবহার করার অধিকারী।

পাছে বেদুইনরা সন্দেহ করে আমরা তাদের ধরতে গিয়েছি, সেজন্য আমরা বন্দুকটা আনন্দর কাছে দিয়ে আমি শেখের সামনে গিয়ে অদূরে দাঁড়ালাম। নমাজ শেষ হওয়া মাত্র আমি তার দিকে এগিয়ে গিয়ে ও দেশি কায়দায় বুকের ওপর হাত রেখে বললাম ‘মরহব্বা—আন্তিলি রফিক’ অর্থাৎ তুমি আমার বন্ধু, আমি তোমাকে সখ্য জানাই’। শেখ চমকে উঠেই ফিরে দেখল তার চারজন দেহরক্ষীরা টোটাভরা বন্দুক হাতে প্রস্তুত। তখন আশ্বস্ত হয়ে নিরস্ত্র আগন্তুককে অভিবাদন করল। আমি আমার ভাঙা আরবি ভাষায় (যা অ্যান্টনিবাগান লেনের এক মৌলবির কাছে শিখেছিলাম) বোঝাতে চেষ্টা করলাম আমরা কে বা কোথায় যাচ্ছি। ‘পৃথিবীটা’ কী সেটা বোঝানো যেমন শক্ত ছিল তার চেয়ে কম কঠিন ছিল না আমরা ভারতীয় পর্যটক একথা বোঝানো। প্রত্যেক অশিক্ষিত বেদুইনের ধারণা আরব দেশ হচ্ছে সারা পৃথিবী এবং আরবরা ছাড়া অন্য জাতির লোক আর নেই। একটু জল খেতে চাইলাম। শেখ বলল, কফি খাও, আমাদের সঙ্গে ‘খবুজ’ অর্থাৎ রুটি খাও। তখন আমি আর দেরি না করে বোঝালাম যে আমার তিন বন্ধু সঙ্গে আছে। অনুমতি পেলেই তাদের নিয়ে আসি, শেখ নিজেই আমার সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে তিন বন্ধুর সামনে দাঁড়াল, বন্ধুরা বালির ওপর বসেছিল, সবার সঙ্গে আলাপ হলে আমরা শেখের দলের রক্ষীদের কাছে গেলাম। বালির ওপর বসে ছোট ছোট পেয়ালায় কফি খেতে খুব ভালো লাগল। দু-তিনজন আরব একত্রিত হলেই কফির কেটলি আগুনের ওপর বসিয়ে দেয় এবং কালো খুব মিষ্টি কফি একটু পর পর চুমুক দেয়।

একটু পরেই চাঁদ উঠল। যে আগুনের ভাঁটা পৃথিবীর এই দিকটায় সারাদিন আমাদের দগ্ধে মারল গরমে, তার অবসানে মরুভূমির রূপ বদলে যেতে আরম্ভ করল। চাঁদের আলো যখন স্পষ্ট হয়ে উঠল তখন চারদিকে সে এক অপরূপ দৃশ্য। ঠান্ডা পড়তে পড়তে এত বেশি মাত্রায় ঠান্ডা হল যে আমরা কম্বল মুড়ি দিয়ে আরাম পেলাম। বালির গরম প্রায় রাত দশটা পর্যন্ত গরম বিছানার কাজ করে। মরুভূমিতে খাবার জোটে না কিন্তু যেখানে-সেখানে বালির ওপর শুয়ে পড়ায় কোনও অসুবিধা নেই। বালির ওপর কম্বলটা পাতবার সময় দেখে নিতে হয় সাপ (হর্নড ভাইপার) ) কাছে কোথাও আছে কিনা। তারা বিষাক্ত সন্দেহ নেই। আমাদের সঙ্গে লেক্সিন ছিল বলে বিশেষ ভয় ছিল না। মরুভূমিতে পোকামাকড়, গিরগিটি, মাছির অভাব নেই। তবে মশা একেবারে নেই।

বেদুইনদের ভেড়ার পশমের জামা পরে এই প্রচণ্ড গরমের দেশে থাকতে দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। একদিন আমি খালি গায়ে কাটিয়ে দেখলাম যে সেই গরম আরও বেশি কষ্টকর। গায়ের চামড়া যেন ঝলসে যায় ১৩৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট উত্তাপে। এর চেয়ে অনেক ভালো আগাগোড়া মুড়ি দিয়ে গা ঢেকে রাখা পশম দিয়ে, তা হলে সামান্য একটু ঘাম হয় এবং তখন আরাম লাগে। মাথা ও ঘাড় ঢেকে না রাখলে সান-স্ট্রোক হয়, সেজন্যই বেদুইনদের বেশভূষা অদ্ভুত রকমের।

শেখের সঙ্গে ভাব জমাবার জন্য গল্প আরম্ভ করলাম। তার অফুরন্ত প্রশ্নের জবাব দিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম কয়েকটা কথা। কেন জানি না, সে বন্ধুর মতো অনেক উপদেশ দিল, যখন দেখল আমরা তার দেশ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। তার প্রথম উপদেশ ছিল যে রাত্রে ঠান্ডা পাবে, তাই ওই সময় চলবে না। বেদুইনের জীবন সূর্যের আসা-যাওয়ার সঙ্গে বাঁধা। সূর্য ওঠে খুব ভোরে। তখন থেকে ওরা দৈনন্দিন জীবনের কাজে লেগে যায়। সূর্যাস্তের সঙ্গে খাওয়া শেষ করে নিদ্রার ব্যবস্থা হচ্ছে রীতি। বুড়ো এবং অসুস্থ যারা তারাই অনেক রাতে ঘুমায়।

যদি রাত্রে কেউ চলাফেরা করে তবে সে বিদেশি বা বিজাতীয়, তাদের ওপর বন্দুক চালাতে ওরা দ্বিধা করে না। কাজেই চাঁদনি রাতে ঠান্ডায় ঠান্ডায় চলবার বুদ্ধি ছাড়লাম।

দ্বিতীয়ত, তেষ্টা পেলেও তাকে অগ্রাহ্য করতে শিখবে। যখন অসহ্য হবে তখন কফি খাবে। খেজুর প্রধান খাবার হবে যখন আমরা মরুভূমির গভীরে পৌঁছব। প্রাতরাশ থেকে ডিনার পর্যন্ত খেজুরই পুষ্টি জোগাবে। আমাদের হাত থেকে বন্দুক নিয়ে দেখল খুব মন দিয়ে। তার প্রধান জিজ্ঞাসা ছিল যে, কতদূর পাল্লায় কার্তুজ সক্রিয় থাকে। বেদুইনদের বন্দুক আরবদের তৈরি— দামাস্কাস থেকে আসে। বেশিরভাগ হাতে তৈরি এবং খুব লম্বা নলওয়ালা। কার্তুজ তৈরি করতে অনেকেই জানে।

অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর শেখ বলল যে, একজন বেদুইন অকাতরে তার স্ত্রী কিংবা ছেলের প্রাণ দিতে পারে যদি পরিবর্তে একটা ভালো জাতের রাইফেল পাওয়া যায়। অর্থাৎ আমাদের বন্দুকগুলি বিপদের কারণ হতে পারে।

শেখের অনুচরদের ওপর হুকুম হল আমাদের জন্য খাবার তৈরি করতে। রুটি ও ভালো চালের ভাত এবং ভেড়ার দুধের দই দিয়ে আমরা ডিনার সারলাম। খাবার আরম্ভ করার পূর্বে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল। শেখ একটা রুটি নিয়ে আমার দিকে হাত বাড়াল। রুটির একাংশ তার হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা। আমি একটু ছিঁড়ে নিলে শেখ বলল যে আমরা আমরণ বন্ধু। অর্থাৎ আরব যার সঙ্গে রুটি ছিঁড়ে খায় তাকে বন্ধু বলে স্বীকার করে— কখনও তার প্রাণহানি করে না। আমরা শুনে আশ্বস্ত হলাম।

একটু পরেই শোবার পালা। আমি শেখের পাশেই শুলাম। একটু দূরে শেখের অনুচররা বিশ্রাম করবার জন্য বালির ওপর কম্বল বিছাল। গভীর নিদ্রায় শেখের নাসিকা গর্জন আরম্ভ হল। আমি তখনও ভাবছি সেটা বুঝি একটা ছল। সারারাত একচোখ খুলে ও আরেক চোখে ঘুমের প্রলেপ লাগিয়ে অতন্দ্র প্রহরীর মতো জেগে থাকবার চেষ্টা করলাম। বন্ধুদের বলেছিলাম অন্তত রিভলভারগুলো তাদের যেন প্রস্তুত থাকে। এমনিভাবে না ঘুমিয়ে না জেগে শীতের রাত কাটালাম। পরদিন ক্লান্তিবোধ করলেও মনে মনে বেশ স্ফূর্তি লাগছিল এই কথা ভেবে যে বেদুইনের পাশে শুয়ে রাত কাটিয়েছি এবং আমাদের গায়ে একটা আঁচড় পর্যন্ত লাগেনি। এই ঘটনার পর আমাদের সাহস খুব বেড়ে গেল। যতই যমদূতের মতো চেহারা হোক আমরা বেদুইনের আতিথ্য স্বীকার করতে আর দ্বিধা করিনি।

বেদুইনরা কেন যে খুনে ও লুটবাজ হল, সেকথা ভাবলে এদের প্রতি সহানুভূতি হয়। দেশে কোনও শিল্প নেই, বালির দেশে চাষবাসও নেই। একমাত্র মেষপালন করে জীবিকা নির্বাহ করা ছাড়া অন্য উপায় নেই।

শেখ তার জীবনের অনেক কথা আমাদের শোনাল। চারজন বন্দুকধারী অনুচরদের দেখিয়ে বলল যে প্রথম জীবনে সেও অনুচরদের মতো একজন ছিল। তারপর নিজের দল তৈরি করে একটা যাত্রীর দলকে লুঠ করে এত টাকা পেয়েছিল যে সে সর্দার বা শেখ বনে গেল। চারজন রক্ষী তার সঙ্গে সবসময় থাকে। আরও বলল যে, কোনও একজন রক্ষী তাকে খতম করে দিয়ে শেখ হতে পারে। পুরোপুরি ওদের বিশ্বাস করা যায় না। জীবনটা এমনই অনিশ্চিত। এইসব শোনা সত্ত্বেও কেমন করে জানি না আমাদের বেদুইন-ভীতি একেবারে কেটে গেল। অনেক খুন ও লুঠের গল্প শুনেও আমরা দিনের পর দিন বেদুইনের তাঁবুতে রাত কাটাবার জন্য আশ্রয় নিয়েছি। দিনের আলোয় সঙ্গে সঙ্গে চলতে শুরু করতাম। দিনে মরুভূমিতে ১০-১২ মাইল এগোতে পারতাম।

বাসরা থেকে বাগদাদের পথে চলেছি। তিনদিন পরে আমরা তিনটে নদীর সঙ্গমস্থলে পৌঁছলাম। নদীর নাম ইউফ্রেটিস, টাইগ্রিস ও সাত-এল-আরব। তার মানে আমরা ‘গার্ডেন অব ইডেন’-এ পৌঁছে গেছি। এই জায়গার কাছেই কোথাও একদিন ব্যাবিলন ও তার ‘হ্যাঙ্গিং গার্ডেন’ ছিল। ব্যাবিলনের সভ্যতা ঐতিহাসিক। সেজন্য এটা সুনিশ্চিত যে একদিন এখানে দেশটা শস্যশ্যামল ছিল এবং বাগান করাও সম্ভব হয়েছিল। তারপর কোনও এক অনিশ্চিত কারণে হয়তো ভূমিকম্পে মরুভূমি সব গ্রাস করল। এখন যেখানে ‘গার্ডেন অব ইডেন’ বলে সেটার সঙ্গে সৌন্দর্যমণ্ডিত বাগানের কিছু মিল নেই। বরং হাসি পায় কানা ছেলের নাম পদ্মলোচনের মতো।

হঠাৎ বৃষ্টি হয়ে গেল এক পশলা এবং তারপরই আমাদের চলাফেরা একদিন বন্ধ রাখতে হল এমনই কাদা জমে গেল। রোদ উঠতে পরদিন সব শুকিয়ে সাইকেল চালানোর উপযুক্ত হল।

হারুন-অল-রশিদের জগদ্বিখ্যাত বাগদাদ শহর দেখে আমরা খুব হতাশ হয়ে গেলাম। মাটির বাড়ি ও কাঁচা ইটের গাঁথনি দিয়ে দোতলা বাড়ি বড় রাস্তার দুধারে দেখলাম। রাস্তা কখনও জল দিয়ে ধোওয়া হয় না বলে মাটি মাটি দেখায়। শহরে পৌঁছেই প্রথমে আমরা ক্যাপ্টেন ডি এন চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি তখন ইংরেজদের বিমানঘাঁটির একজন উচ্চপদস্থ অফিসার। আমাদের সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেল। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম যে ইংরেজ সৈনিক ও পাইলটরা যেতে আসতে ক্যাপ্টেনসাহেবকে সেলাম করে চলছে। আমাদের জন্য গার্ড অব অনারের ব্যবস্থা হল।

পরদিন তিনি আমাদের হাসপাতাল (আর্মির) দেখাবার কথা বললেন। আমরা সেখানে গিয়ে দেখলাম চারজন লোক বেদুইনের হাতে ঘায়েল হয়েছে। তারা সেকালের একটা ফোর্ড গাড়িতে চড়ে বাগদাদে আসছিল। বেদুইনরা টিপ করে একটা টায়ার-এ গুলি মারল, তারপর গাড়ি অচল হয়ে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে বেদুইনরা বন্দুক চালিয়ে গাড়ির যাত্রীদের প্রথমে জখম করল, তারপর সব লুঠপাট করে যাত্রীদের বন্দুকগুলি নিয়ে মরুভূমির গভীরে ঘোড়া চালিয়ে অন্তর্হিত হল। ভাগ্যে বাগদাদ শহরের প্রান্তে এই ঘটনা হয়েছিল, তাই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ক্যাপ্টেন চক্রবর্তীর চেষ্টায় শুশ্রূষা সম্ভব হয়েছিল।

বাগদাদ একটা মস্ত ঘাঁটি হজযাত্রীদের। শত শত যাত্রী ও তাদের উট শহরের প্রান্তে জোট বেঁধে অপেক্ষা করে যতক্ষণ না তারা দলে ভারি হয়, যাতে বেদুইনরা আক্রমণ করতে সাহস না পায়।

ক্যাপ্টেন চক্রবর্তী উত্তরকালে অনেক উঁচু পদে উন্নীত হন সাহস ও কর্তব্যনিষ্ঠার জন্য। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি ‘ডিরেক্টর জেনারেল হেলথ সার্ভিসেস (ওয়েস্ট বেঙ্গল)’ পদ গ্রহণ করেন ডাঃ বিধান রায়ের আমন্ত্রণে।

বাসরার মতো বাগদাদেও অনেক বাঙালির বসবাস ছিল। অনেকে রেললাইন পাততে গিয়েছিলেন, আরও অনেকে তুর্কি-সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। জার্মানদের দলে চলে গেলে দেশ স্বাধীন হবে, এই বিশ্বাসে বাঙালিরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধ শেষ হলে এঁরা কেউ দেশে ফিরে যাননি তাঁদের ভেতর কেউ কেউ আমাদের নিমন্ত্রণ করে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গেলেন এবং স্ত্রী ও ছেলেপুলের সঙ্গে আলাপ করালেন। কোনও কোনও আরব-বাঙালি স্ত্রী বোরখা ছেড়ে বেশ সপ্রতিভভাবে বাংলায় গল্পগুজব করলেন।

মরুভূমিতে ক্যারাভ্যান দীর্ঘদিন চলার পর বিশ্রামঘরে দুয়েকদিন কাটায়— এদেশের লোকেরা বলে হান, সেখানে আমরাও থেকেছি। মাটির দেওয়াল দিয়ে ঘেরা একটা বড় জায়গার মধ্যে অনেকগুলি পাশাপাশি ছোট্ট ঘর আছে। জানলা নেই, কেবলমাত্র একটি দরজা যাতায়াতের পথ। সেই ঘরে প্রচণ্ড রোদের প্রকোপ থেকে বাঁচা যায় কিন্তু সেখানে মাছির অত্যাচার পাগল করে দেয়। আমি মাছির হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য সর্বাঙ্গে মাথায় ও মুখে কেরোসিন তেল ঢালতাম। কেরোসিন তেল যথেষ্ট সস্তায় পাওয়া যায়। এই হানগুলি নোংরার ডিপো। উট ঘোড়া ও মানুষ যত রাজ্যের ময়লা ফেলে ঘরের সামনে। শত শত বছর ধরে লোকেরা এই নোংরামি বাড়িয়েই চলেছে। সেখানে প্রয়োজনীয় জিনিস কয়েকটা পাওয়া যায়, যেমন খেজুর, খেজুরের ময়দা, দেশলাই, লুঙ্গি, বাতি ইত্যাদি।

একদিন একটা হানের দোকানে এক টিন সার্ডিন দেখে কিনে ফেললাম। সার্ডিনের টিন বিগত মহাযুদ্ধে (প্রথম) ইংরেজরা এনেছিল আট-দশ বছর আগে। পথে এই সার্ডিন প্রায় আমাদের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল।

খেজুর খেতে খেতে যখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি, এমন সময় মণীন্দ্র বলল যে আমাদের মতলবটা কী? সার্ডিন টিন গলায় ঝুলিয়ে আমরা কি কলকাতায় ফিরব? সেইদিনই যেটুকু চাল ছিল তা দিয়ে ভাত রান্না হল কোনওমতে। আমরা খুব উৎসাহের সঙ্গে সার্ডিন মাছ ও তার তেল দিয়ে খুব তৃপ্তি করে ভাত খেলাম। ফলে ফুড পয়জনিং হয়। বালির ওপর ঘুমিয়ে পড়লাম। অন্যান্য দিন সাধারণত সকাল চারটে-পাঁচটায় উঠতাম কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সেদিন আমাদের কারও বেলা দশটা- এগারোটা পর্যন্ত ঘুম ভাঙল না। প্রচণ্ড রোদে ৬ ঘণ্টা পোড়ার ফলে হয়তো আমাদের মধ্যে বিষ কেটে যাচ্ছিল। ভীষণ মাথাধরা নিয়ে উঠলাম। নড়বার চড়বার ক্ষমতা ছিল না, সবার একই অবস্থা দেখে আমরা পরামর্শ করলাম কেমন করে অমন হল। অনেক গবেষণার পর সিদ্ধান্ত করলাম যে প্রথম মহাযুদ্ধের টিনে সার্ডিন আট-দশ বছর পরে নিশ্চয় বিষিয়ে উঠেছিল। আমাদের স্বাস্থ্য খুবই ভালো ছিল বলে দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে বিষ কাটাতে পেরেছিলাম।

মরুভূমিতে দিনের পর দিন চলেছি। সে গরমের কথা ভাবলে আজও মনে হয় উট কিংবা ঘোড়া ছাড়া এদেশে চলা উচিত নয়। সবসময় সাইকেল চড়তে পারি না। অনেকদিন ধরে বোঝা টানতে টানতে হেঁটে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। আরও কতরকম অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছি তার ঠিক নেই, সবচেয়ে বড় একটা অসুবিধার কথা ভাবলে আজও গা শির শির করে। গরমে ঘাম হত। স্নান নেই, মুখ ধোয়া নেই, দাঁত মাজব এমন জল পাই কোথা। আমাদের গায়ে পোকা হল। চোখে স্পষ্ট দেখা যায় না। কিন্তু জামার রন্ধ্রে রন্ধ্রে তারা হাজার হাজার ডিম পাড়ল। সেই ডিম ফুটে আমাদের অস্বস্তি বাড়িয়ে চলল। একদণ্ডও পোকার কামড় ও সুড়সুড়ি থেকে বিরাম নেই। জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। পোকাগুলো অনেকটা চালের পোকার মতো কিন্তু রক্ত শুষে খায়।

একসময় পোকার কামড় খেয়ে স্থির থাকতে না পেরে আমাদের পথচলা বন্ধ রেখে, কাপড়চোপড় খুলে পোকা মারার কাজে ব্যস্ত হয়ে যেতে হত। এই উকুন মেরে শেষ করা যায় না। এমনকী সাবান দিয়ে ধুয়ে কিংবা গরম জলে সেদ্ধ করে ওদের উচ্ছেদ করা যায় না। এদের হাত এড়ানোর একমাত্র উপায় জামাকাপড় পুড়িয়ে ফেলা। আমরা তা পারতাম না বলে অনেকদিন পর্যন্ত গায়ে পোকার অত্যাচার সহ্য করতে বাধ্য হয়েছি, এমনকী ইউরোপে পৌঁছবার পরেও, বুলগেরিয়া পর্যন্ত

চলতে চলতে আমরা যখন নদীর ধারে গিয়ে পড়েছি তখন দেখেছি যে দলে দলে আরবরা কাপড় ছেড়ে উকুন মারতে ব্যস্ত। যথেষ্ট মারা হলে, তারপর জলে নামে, কিন্তু পোকার হাত থেকে নিস্তার নেই। স্নান করতে পারে না বলে, বেশিরভাগ আরবের গায়ে পোকা। এবং একজন আরেকজনকে মনের আনন্দে (নিজের অজ্ঞাতসারে) পোকা বিতরণ করে। হয়তো অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় থাকার জন্য পোকা আপনি জন্মায়।

নদীর ধারে পৌঁছলে আরব মেয়েরা বোরখা খুলে ফেলে দেয় এবং তখন লজ্জার বালাই থাকে না। টাইগ্রিস নদীর জল কলকাতার গঙ্গার মতো ঘোলা ব্রাউন রং ইউফ্রেটিস নদীর জল পরিষ্কার, বাগদাদ শহরে যার বাড়িতে গিয়েছি সেখানেই দেখেছি বড় বড় মাটির কলসি একটার পর একটা সাজানো। নিচে মাটি থিতিয়ে যাবার পর জল অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায়। তখন সেই জল দ্বিতীয় কলসে রাখা হয়। তৃতীয় বা চতুর্থ কলসির জল যখন স্বচ্ছ কাকচক্ষুর মতো হয় তখন পানের উপযুক্ত বলা যায়।

নদীর কিনারে পথ ছেড়ে আমরা যখন মরুভূমির পশ্চিমদিকে যাত্রা শুরু করলাম তখন সেখানে দিকনির্ণয়-যন্ত্রই ভরসা। বিকালের দিকে সূর্যের পানে মুখ রেখে চললে, বিপথে যাবার অবকাশ থাকে না।

মেসোপটেমিয়া ছেড়ে আরবদেশের উত্তর দিয়ে আমরা সিরিয়ার মধ্যে প্রবেশ করলাম। সিরিয়া ফরাসিদের দখলে, যেমন মেসোপটেমিয়া ছিল ইংরেজদের আয়ত্তে— দুটো দেশই এককালে তুর্কির অধীনে ছিল। যুদ্ধের সময় ইংরেজ ও ফরাসিরা আরবদের বলেছিল যে তাদের হয়ে তুর্কির বিরুদ্ধে লড়লে যুদ্ধের পরে দেশ স্বাধীন করে দেবে— যদি জয় হয়।

যুদ্ধে তুর্কি হারল এবং তার আয়তন এশিয়া মাইনরেই সীমাবদ্ধ রইল। ইউরোপে তাদের সাম্রাজ্য যতদূর বিস্তার করেছিল তার মধ্যে সামান্য একটুকরো অনুর্বর জমি ও একটি শহরের (এড্রিয়ানোপলের) মালিকানা নিয়েই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হল। যুদ্ধের শর্ত অনুসারে এশিয়া ও আফ্রিকায় তুর্কির অধীনস্থ দেশগুলি ইংরেজ ও ফরাসিরা ভাগ করে নিল।

পথে একদিন আনন্দ অসুস্থ হয়ে পড়ে, তার জ্বর হয়। আমরা এক বেদুইন পরিবারের বড় তাঁবুতে আশ্রয় নিলাম। তাঁবুর একদিকে বেদুইন স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, মাঝখানে ভেড়ার পাল ও আরেক প্রান্তে আমরা। সব বেদুইন যে ডাকাত ও খুনে নয়, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলাম বেদুইন পরিবারের সঙ্গে একসঙ্গে থাকার সুযোগ পেয়ে

সাতদিন একাদিক্রমে জ্বরভোগ করল আনন্দ। বেদুইন পরিবার তখন আমাদের শুধু তাঁবুতে থাকতে দেয়নি, চেষ্টা করেছে সহানুভূতি দিয়ে সাহায্য করতে।

মরুভূমিতে নানারকম পোকামাকড় দেখা যায়— মাছির কথা আগেই বলেছি। এক রাত্তিরে বালির ওপর শুয়ে রাত কাটাবার পর হঠাৎ লক্ষ করলাম পা দিয়ে রক্ত পড়ছে। একটা পোকা আমাকে ব্যথা না দিয়ে চামড়া ফুটো করেছিল, তারপর সামনে হাড় পেয়ে মোড় ঘুরে পা থেকে বেরিয়ে গেছে। এত কাণ্ড ঘটেছে অথচ আমি টের পাইনি। গর্ত করবার আগে পোকাটা লালা দিয়ে স্থানটা অসাড় করে দেয়।

দেখতে দেখতে আমার পা ফুলতে আরম্ভ করল। কাছেই একটা ছোট্ট আরবি শহর ছিল। কোনওমতে সেখানে পৌঁছে এক হাকিমের বাড়িতে চিকিৎসার জন্য আশ্রয় নিলাম। চিকিৎসার ব্যবস্থা খুব অভিনব। সমস্ত পায়ে হাঁটু পর্যন্ত পুরনো ভেড়ার চর্বি মাখিয়ে একটা দড়ি দিয়ে বেঁধে আমাকে একরকম ঝুলিয়ে রাখল— ট্র্যাকশনে রাখলে যেমন হয়। এখানে আমার একটা পা উঁচুতে এবং শরীরের ওপরদিকটা মাটিতে ঠেকে রইল। আশ্চর্যের বিষয় যে তিনদিন পরেই আমার পা সাধারণ রূপ ধারণ করল- ফোলা ও ব্যথাও নেই। হাকিম কিন্তু কোনও টাকা-পয়সা নেননি আমাদের কাছ থেকে।

একদিন হঠাৎ অবাক হয়ে সামনে দেখলাম এক বিরাট অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ। একটা প্রকাণ্ড আর্চ, প্রায় আশি ফুট উঁচু দুটি দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এর নাম ‘স্টেশিফোন’—আলেকজান্ডারের ভারতবর্ষ পর্যন্ত সব দেশ জয় করার স্বাক্ষর হিসাবে দুহাজার দুশো বছর আগে এটা তৈরি হয়েছিল। এই অট্টালিকা তৈরি করবার মালমশলা কোথা থেকে এসেছিল কে জানে! এখন চারদিকে বালি আর বালি।

বালির ওপর যত না সাইকেল চালাচ্ছি তার বেশি ঠেলছি আমাদের বাহনদের। বালির পাহাড়ে বোঝা নিয়ে ওঠানামা যে কী কষ্টকর তা মর্মে মর্মে বুঝেছিলাম। হঠাৎ কী যেন একটা জন্তু আমাদের দেখে ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে গেল। হরিণের মতো দেখতে অথচ মাপে অনেক ছোট্ট। মনে হল ভুল দেখেছি, হয়তো কুকুর, হয়তো খরগোশ। তখনই সাইকেল ফেলে পিছু নিলাম দেখবার জন্য, কেমন জীব বালির দেশে থাকে। দুটো বালির পাহাড় পার হতে এবার স্পষ্ট দেখলাম সুন্দর দেখতে একটা গ্যাজেল আমার সামনে। ধরবার জন্য লোভে পড়ে অনেক উঁচু-নিচু বালির ওপর দিয়ে গ্যাজেলের পিছু নিলাম। সোনার হরিণের মতো যেন ধরা দিচ্ছে, এমন ভান করে হঠাৎ ছুট দিয়ে আমাকে অনেক দূরে নিয়ে গেল। অবশেষে আমি হাল ছেড়ে আমার বন্ধুরা যেখানে ছিল সেখানে ফিরে গেলাম। অবাক হয়ে ভাবলাম কেমন করে মরুভূমিতে বেঁচে আছে। উত্তর সহজেই পেলাম— যেমন করে ভেড়ারা থাকে, রোদে- পোড়া শুকনো ঘাস খেয়ে।

বালির ওপর ঘুরপাক খেতে খেতে কখন মেসোপটেমিয়ার (এখনকার ইরাক) সীমানা পার হয়ে সিরিয়াতে ঢুকে পড়েছি তা টের পাইনি। একদিন দুপুরে পুব আকাশে প্রচণ্ড বালির ঘূর্ণিঝড় আসছে দেখে আমরা তাড়াতাড়ি কম্বল খুলে মুড়ি দেবার ব্যবস্থা করছি এমন সময় মাথার ওপর দিয়ে কাছেই একটা এরোপ্লেন উড়ে গেল। মনে হল, কাছেই কোথাও ঘাঁটি আছে, সেখানেই নামল। ঝড়ের পূর্বাভাস ততক্ষণে এসে পড়েছে। বালির কী রুদ্রমূর্তি! প্রায় আধঘণ্টা পরে ঝড়ের প্রকোপ থামল। তারপর দেখি দুজন ফরাসি ঘোড়ায় চড়ে আমাদের দিকে আসছে। তারা বিমানচালক। ওপর থেকে আমাদের স্কাউট টুপি পরা দেখে ভেবেছিল, আমরা হয়তো কোনও ইউরোপীয় ভ্রমণ পার্টি ঝড়ের মধ্যে বিপদে পড়েছি। আমাদের যখন দেখল প্রাচ্যের লোক তখন তাদের খুব স্ফূর্তি। ফরাসিভাষা জানতাম না তখন, তবু ওদের নিমন্ত্রণ বুঝতে দেরি হল না। আধঘণ্টা পরে বিমানঘাঁটিতে পৌঁছলাম। এখানে ‘ফ্রেঞ্চ ফরেন লিজিয়নে’র লোকেরা মরুভূমিতে বেদুইনদের ওপর খবরদারি করে। বেদুইনরা সহজে ধরা দেয় না। ঘোড়া ছুটিয়ে মরুভূমির মধ্যে দূরে, আরও দূরে চলে যাবার সহজ ক্ষমতা রাখে। অন্য লোক যদি তাড়া করে যায় তবে জলের অভাবের কথা ভেবে অচিরে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। ততক্ষণে বেদুইন সবার নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে। মরুভূমির মধ্যে অনেক গুপ্তস্থান আছে যেখানে জল পাওয়া যায়। এইরকম দু-তিনটি জলাধারের সন্ধান পেয়েছিলাম। ক্যানভাসের বালতিতে অনেক লম্বা দড়ি দিয়ে গর্তের মুখ থেকে ঝুলিয়ে জল তুলতে হয়। পাহাড়ি জায়গাতে বিশেষ করে দেখেছি যে বহু নিচে স্বচ্ছ, সুমিষ্ট জল পাওয়া যায়। মাত্র একটি সংকীর্ণ সুড়ঙ্গপথে সেই জলে পৌঁছনো যায়।

ফরাসিরা মরুভূমির মধ্যে বিমানঘাঁটি তৈরি করে বেদুইনদের বিপদে ফেলেছিল। বিমানের হাত থেকে নিস্তার ছিল না। তাছাড়া ফ্রেঞ্চ ফরেন লিজিয়নের সৈনিকরা ভীষণ ভালো যোদ্ধা। প্রাণের মায়া করে না, বেদুইনদের মতো ঘোড়া চড়ে মরুভূমিতে শত্রুদের তাড়া করে যায় এবং প্রাণ হারাবার ভয় করে না বলেই জয়ী হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।

একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। বেদুইন স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা, ছোট-বড় সবাই ভালো ঘোড়া চড়তে পারে— জিন লাগাম ছাড়াই। ঘোড়ার মুখে বরং বলা উচিত থুতনিতে একটা ছোট দড়ি বাঁধা থাকে সেটা দিয়ে বুঝিয়ে দেয় কোনদিকে মালিক যেতে চায়। আরেকটা জিনিস, বন্দুক ব্যবহার করতে বেদুইন আবালবৃদ্ধবনিতা সবার অসাধারণ পারদর্শিতা। বিপদে পড়লে সবাই বন্দুক নিয়ে লড়ে যেতে পারে। বন্দুকগুলো সাধারণত বেশি লম্বা নলের হয়। তাদের টিপ অসাধারণ।

ফরাসিদের বিমানঘাঁটিটা একটা নিচু উপত্যকায় অবস্থিত। আমাদের নিয়ে গেল কমান্ড্যান্টের কাছে। ভদ্রলোক একটু-একটু ইংরিজি বলতে পারেন। আমাদের কাগজপত্র পড়ে এবং কথা বলে একেবারে মুগ্ধ। খুব খাতির করে চার মগ কফি খেতে দিলেন এবং হুকুম হল সবচেয়ে ভালো গেস্টরুমে আমাদের চারজনের বিছানা পাতার। কমান্ড্যান্টের ঘরের বাইরে বেশ ভিড় জমে গেল লিজিয়নারদের। তারা জানতে চাইছিল আমরা কে এবং কোথা থেকে সেখানে এলাম। কমান্ড্যান্টকে সবাই এরা কাপিতেন বলে ডাকে— আরবি কায়দায়। সবাইকে ডেকে ক্যাপ্টেনসাহেব আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং সবাইকে বললেন আমাদের যোগ্য সম্মান দেখাতে। তারা একসঙ্গে চিৎকার করল— লং লিভ ইন্ডিয়া, লং লিভ দ্য ইন্ডিয়ানস। তারপর একসঙ্গে হাততালি। একজন ইংরেজ যুবক সৈনিক আমাদের দোভাষীর কাজ করতে এগিয়ে এল। আমি ছোট্ট একটা বক্তৃতা করে জানালাম আমাদের ভ্রমণ, করার উদ্দেশ্য— সারা পৃথিবী ভ্রমণ করব সাইকেলে। থামবার সঙ্গে সঙ্গেই আবার হর্ষধ্বনি। সবাই একসঙ্গে চাইছিল আমরা তাদের ঘরে যাই এবং পানভোজন করি। এইরকম মরুভূমির মাঝখানেও সৈনিকরা ভালো ভালো খাবার ও মদ পায় যা প্যারিস থেকে পাঠানো হয় নিয়মিতভাবে। প্লেনে করে আনা খাবার ও মদের পিপে বালির ওপর গড়িয়ে দেয়।

ঘাঁটিটা বেশ বড়, দেড়শো লোকের বাস, এরোপ্লেন চালু ছিল চারখানা— অকেজো অনেকগুলি এমনভাবে সাজানো যে মনে হয় ওড়বার জন্য তৈরি। বড় বড় কাঠের বাক্সের মধ্যে সব এরোপ্লেন আনা হয়েছিল। সৈনিকরা বাক্সের কাঠ দিয়ে সুন্দর সুন্দর ঘর, এমনকী শাওয়ার দেওয়া বাথরুম পর্যন্ত বানিয়েছিল। এরা অনেকেই ভদ্রসন্তান, উচ্চশিক্ষিত। কোনও বিশেষ কারণে সংসারে বীতরাগ হয়ে তারা লিজিয়নে যোগ দেয় এবং দূর দূর দেশে চলে যায়। একজন সৈনিকের ঘর দেখে আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম— এমন সুন্দর সব ছবি আঁকা রয়েছে। সেগুলি সব ওর নিজের আঁকা।

আমাদের যেহেতু অফিসাররা আবিষ্কার করেছিল, সেজন্য আমরা তাদের সঙ্গেই বেশিক্ষণ কাটাতে বাধ্য হলাম। সন্ধ্যাবেলায় আটটার সময় কাপিতেন-এর টেবিলে ডিনার খেতে গেলাম— অনেকদিন পর মুখ-হাত ধুয়ে। ডের-এর-জোরে ঘাঁটি করার উদ্দেশ্য এই যে এখানে জল পাওয়া যায়। শাওয়ারে নিজে জল ঢেলে নিজেই উপভোগ করলাম।

অফিসাররা যেখানে বসে তার অল্প দূরে সাধারণ সৈনিকের টেবিল। দেখতে দেখতে ঘর ভরে গেল। খাবারের আগে এক বোতল লাল ফরাসি ‘বোজোলে’ মদ সবার সামনে রেখে গেল। সৈনিকরা মগে কিছু ঢেলে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠল এবং আমাদের স্বাস্থ্য শুভকামনা করল। অফিসাররা তাতে যোগ দিল। মদ খেতাম না, তাই আমাদের মগে একটু ঢেলে তুলে ধরলাম এবং দুই দিকে আমাদের (টোস্ট) অভিবাদন জানালাম।

তারপর সবাই মিলে গান ধরলাম সমস্বরে। বেশ স্ফূর্তি দেখলাম চারদিকে, খুব ভালো ডিনার খেলাম— যা মরুভূমিতে ভাবা যায় না হ্যাম ও বীনস, টমাটোর রসে রাঁধা। চমৎকার রুটি –ফরাসিদের বিশেষত্ব। তারপর ‘সুফ্লে’ দেখে আমাদের তাক লেগে গেল। সব আমদানি প্যারিস থেকে এরোপ্লেনে, কিছু কিছু কাঁচা বাজার প্লেনে আসে ‘হালেব’ বাজার থেকে।

সৈনিকরা সবাই অনুরোধ করল দুদিন তাদের সঙ্গে কাটাবার জন্য। কমান্ড্যান্টকে জানালাম আমাদের আপত্তি নেই এবং আমরা আনন্দিত।

কয়েকজন সৈনিক বলল যে আমাদের জন্য ঘোড়া তৈরি আছে যদি তাদের সঙ্গে আমরা আরেকটা ঘাঁটি দেখতে যাই। না বুঝে রাজি হলাম এবং তিন মাইল যাবার পর দেখলাম কয়েকটা ‘হ্যাজাক’ এক জায়গায় জ্বলছে। সৈনিকরা আসছে জেনে কয়েকটি যুবতী এগিয়ে এল এবং ফরাসি প্রথায়— লিজিয়নারদের শুভেচ্ছা জানাল। এরা হচ্ছে ‘ক্যাম্প ফলোয়ার’। সৈনিকরা যেখানে ক্যাম্প উঠিয়ে নিয়ে যাবে— সেই মহিলারাও তাদের নতুন ক্যাম্পের কাছে থাকবে। এতে ফরাসি গভর্নমেন্টের অনুমোদন তো আছেই, বরং মেয়েদের দেখাশোনা করা ও ওষুধপথ্য দেওয়া এবং স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সক্রিয়ভাবে তারা সাহায্য করে।

মেয়েদের সবাইকে ওরা ‘ফতেমা’ বলে ডাকে, এবং আমাদের সঙ্গে পরিচয় করাবার জন্য সৈনিকদের ভীষণ উৎসাহ দেখলাম। একঘণ্টাকাল অনিচ্ছাসত্ত্বেও ‘ফতেমা’ দেখে বেড়ালাম। তারপর ক্যাম্পে ফিরে দেখলাম আমাদের জন্য সাদা ধবধবে চাদর ও বালিশ দিয়ে বিছানা তৈরি। আরামে ঘুমোলাম। পরদিন ভোরে দুজন সৈনিক ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় টোকা মারল। ‘আন্ত্রে’ বলে চেঁচালাম। আমরা তখনও বিছানায় শুয়ে। সৈনিক দুজন চার মগ কফি নিয়ে এল, আমাদের জন্য ‘বেড টি’র পরিবর্তে টেবিলের ওপর কফি রেখেই দুজনে প্রচণ্ড ‘স্যালুট’ দিল এবং পিছন ফিরে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। এইসব ব্যাপারে সবার ঘুম ভেঙে গেল। আমরা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে ভাবলাম আমরা বুঝি বাগদাদের হারুন-অল-রশিদ বনে গেছি— এত খাতির! সাহেব কফি হাতে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, ভাবতেই পারা যায় না!

আমরা এরকম আরাম করে শুয়ে এবং খেয়ে যেন পুনর্জীবন লাভ করলাম। আমাদের সাইকেলগুলিও ফরাসি ইঞ্জিনিয়ারদের হাতে পড়ে একেবারে নতুন রূপ ধারণ করল। ওরা সব সাইকেল খুলে, তেল দিয়ে ঠিকঠাক করল, আমাদের মত না নিয়েই।

প্রাতরাশ খাবার সময় আবার কফি এবং সুন্দর রুটির সঙ্গে (ক্রোয়াসাঁ) পরিচয় হল। দেখা গেল ঘাঁটিতে খাবার সুখ খুব আছে। সব ঘাঁটিতেই ভোজনবিলাসী ফরাসিরা নানারকম খাবারের জোগাড় রাখে।

বেলা দশটার সময় ক্যাপ্টেনের অনুরোধ এল আমাদের ভ্রমণ সম্বন্ধে কিছু বলবার। মিটিংয়ে একজন আমেরিকান সৈনিক পাশেই দাঁড়াল এবং যা গল্প করলাম তা তর্জমা করে দিল। যেই বলেছি, যে প্যারিসে যাব, অমনি সবাই একসঙ্গে চিৎকার করল “লং লিভ প্যারিস’। আমার বলা শেষ হওয়ামাত্র একজন ফরাসি সৈনিক ‘মাউথ অরগ্যান’ দিয়ে বাজাল ‘মঁ পেয়ি পারি’ অর্থাৎ প্যারিস আমাদের দেশ।

দুপুরবেলায় খেতে বসে বারবার সৈনিকদের হর্ষধ্বনি ও টোস্ট শুনলাম। বুঝতে পারলাম আমরা ফ্রেঞ্চ ফরেন লিজিয়নারদের কাছে খুব প্রিয় হয়ে উঠেছি। ভাষা না জানার জন্য যদিও আমরা বিনয় করেছিলাম খুব। এই অভিজ্ঞতার পর মনে মনে ঠিক করলাম ফরাসি ভাষা শিখতেই হবে। আমেরিকান সৈনিক তৎক্ষণাৎ একটা ইংরিজি-ফরাসি বই উপহার দিল। প্রথম ‘লেসন’ তার কাছেই নিলাম। কয়েকটি কথা শিখলাম তখনই ব্যবহার করবার মতো। ‘ধন্যবাদ’ কথায় কথায় কাজে লাগবে যখন বিদায় নেব। বই পেয়ে এবং প্রথমদিনে শিক্ষার পর আমি খুব উৎসাহ বোধ করলাম। বিদেশে বেড়ানোর কোনও অর্থ হয় না, যদি বিদেশি ভাষা না বলতে পারি বা তাদের সংস্কৃতি বোঝবার চেষ্টা না করি। আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে লাগালাম ভাষা শিখবার কাজে।

ফরাসিরা দুদিনের মধ্যে আমাদের সমস্ত কাপড় ভালো করে ধুয়ে ইস্ত্রি করে দিল। আমাদের মনে হচ্ছে নতুন জীবন আরম্ভ করেছি। কেবল গায়ের পোকাগুলো আমাদের সুখে বাদ সাধছিল।

যা হোক অনেকদিন পর সুখে থাকার আস্বাদ নিয়ে ফরাসিদের কাছ থেকে আমরা বিদায় নিলাম এবং ‘ও রেভোয়ার’ শুনতে শুনতে আমরা মরুভূমির মধ্যে বালির পাহাড়ে মিলিয়ে গেলাম। দুপুর রোদে মরুভূমি সবসময়েই অসহ্য মনে হত। প্রায়ই মিরাজ দেখতাম, মরু-মরীচিকা যাকে বলে। স্পষ্ট দেখেছি সামনে জলাশয়, দূরে খেজুর গাছ। সবই কল্পনার চোখে দেখা। যখন প্রচণ্ড রোদের তাপ বাড়ে তখন খুব ছোট-ছোট বালুকণা মরুর ওপর ভেসে বেড়ায়, যা দূর থেকে জলাশয় বলে ভুল হয়।

গন্তব্যপথ ছেড়ে পিছনে ছুটলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। মরুদেশের সবই খারাপ নয়। দুটো ভালো জিনিসের নাম করতে পারি : ১) ক্বচিৎ কখনও ওয়েসিস বা মরূদ্যান পেয়েছি, আরবদের সঙ্গে পরামর্শের ফলে। ২) খেজুর মহা পুষ্টিকর খাদ্য। খেজুরকে রোদে শুকিয়ে এবং তা পিষে ওরা ময়দা বা আটা তৈরি করে, তার নাম “খবুজ’। আটার রুটি মিষ্টি লাগে, একটু ‘চিজ’ দিয়ে খেতে খারাপ লাগত না, তবে একঘেয়ে। ‘উঠিতে খেজুর, বসিতে খেজুর, খেজুর করেছি সার’ মাঝে-মাঝে কীর্তনের সুরে গাইতে ইচ্ছা করত।

একদিন একটা মরূদ্যানের খোঁজ পেলাম। সব ক্যারাভ্যান, উটের সার সেইদিকে চলছে। আমরা সবার শেষে চলেছি। তখন সূর্য প্রায় অস্তাচলের পথে। হঠাৎ লক্ষ করলাম বালির ওপর ওদেশি রুপোর সিকি। কাছেই আরও সিকি পড়েছিল। মহানন্দে কুড়োতে-কুড়োতে পকেট ভর্তি করলাম, মরূদ্যানের দিকে যতই এগোতে লাগলাম। তারপর অন্ধকার হয়ে এল। ‘হরির লুট’ কুড়োবার আর সময় ছিল না। তখন কিন্তু আমাদের আনন্দের আর সীমা ছিল না। তখন অপ্রত্যাশিতভাবে অনেক টাকা মরুর বালির থেকে পেলাম। কেমন করে সিকি সেখানে এল ভাবতে ভাবতে মনে হল, কোনও উটের ক্যারাভ্যান থলে-ভর্তি টাকা নিয়ে মরুভূমি পার হচ্ছিল, উটের পিঠে থলে ঘষে ঘষে নিশ্চয়ই ফুটো হয়ে যাওয়াতে সিকি পড়ে গিয়েছে। হয়তো আমাদের ওইখানে পৌঁছবার ঠিক আগেই ফুটো থলি খালি করতে করতে উট এগিয়ে গিয়েছে। বালির ওপরে সিকি যা পেলাম তাই তাড়াতাড়ি উঠিয়ে নিলাম। কত সিকি বালির মধ্যে ঢুকে জন্মের মতো রয়ে গেল তার ইয়ত্তা নেই। তাদের পেতে হলে মরুভূমির বালি ছাঁকবার ব্যবস্থা করতে হয়। যা পাইনি তার জন্য দুঃখ না করে, যা পেয়েছি সেজন্য মনে মনে স্ফূর্তি লাগছিল।

দেশ ভ্রমণে বেরিয়েছি একটা পয়সা সঙ্গে না নিয়ে। পয়সা না থাকার কষ্ট মর্মে মর্মে টের পাচ্ছিলাম। আশা ছিল বাগদাদে পৌঁছে দেশের কমিটির পাঠানো টাকা ও চিঠি পাব। কিছু না পেয়ে পুরোপুরি হতাশ হইনি। তখনও আশা যে কনস্তান্তিনোপলে গেলে টাকা পাব।

মরূদ্যানের কাছে যখন পৌঁছলাম, সেখানে একশো-সোয়াশো উট বিশ্রাম করছিল মালপত্র নামিয়ে। পরদিন সকালে জল খেয়ে, জলের পাত্র ভরে নিয়ে ক্যারাভ্যান রওনা হবে। অল্প চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম একটা শীর্ণ জলের রেখা। ধারে ধারে খেজুর গাছ। আমরা খুব কষে জল খেলাম এবং উটের ভিড়ের মাঝখানে গিয়ে শুলাম। মরুভূমির পর মরুভূমি পার হয়ে চলেছি অথচ ‘শিপ অব দ্য ডেজার্ট’ অর্থাৎ উট সম্বন্ধে কোনও কথা বলিনি। চেহারার কথা বলতে হলে প্রথমেই মনে হয় ভগবানের সৃষ্ট সব জীবের মধ্যে উট বোধহয় সবচেয়ে খারাপ দেখতে। মুখটা আরও বিকট। যখন চলে তখন মনে হয় উটের হাড়গুলো সব খুলে যাবে এবং দেহটা বালির ওপর পড়ে যাবে। এমনই ত্রিভঙ্গ-মুরারীর মতো চলে যে দেখলে হাসি পায়, গায়ে তেমনই বোটকা গন্ধ। জন্ম থেকে আমরণ তার জলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে না। উটের দুধ হয় অনেক। আরবরা সেই দুধ খায়। আমাদের কফিতে যদি দুধ দিত তো বমি আসত। পরে তাতেও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।

উটের বিশ্রী দিকটাই বললাম এবার গুণের কথা লিখি। পৃথিবীতে যত জীব আছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে কষ্টসহিষ্ণু উট। বালির ওপর দিনের পর দিন চলতে পারে, জল না খেয়ে। খাবার মধ্যে বুনো ছোট গাছ, তা কাঁটাসুদ্ধ হলেও ভালোবেসে খায়। শহরে গাছ পায় না তাই সে অল্প ভুসি খেয়ে সন্তুষ্ট। উটের লোম অনেক হয় এবং বেশি দামে বিক্রি হয়। বড়লোক ছেলেমেয়েরা ইউরোপ ও আমেরিকায় শীতের দেশে দেখেছি উটের পশমের নরম ওভারকোট ব্যবহার করে। উটের মোটা চামড়ায় জুতো ও বড় ব্যাগ তৈরি হয়। উটের মাংস সর্বত্র খায় ও উট দিয়েই ‘কোরবানি’ সারে। উটের মতো মানুষের উপকারী জীব পৃথিবীতে কম আছে। ভারবাহী যেমন তেমনই গরমে কষ্ট সহ্য করতে পারে। যুদ্ধের সময় আবার উটবাহিনী নিয়ে আরবরা লড়তে নামে।

মরুভূমিতে নদীর ধারে যদিও একটু-আধটু চাষবাস করবার চেষ্টা হয় তাকে লোকাস্ট বা পঙ্গপাল অল্পক্ষণে নিঃশেষ করে দেয়। পঙ্গপাল কবে কখন কোন পথে যাবে সেকথা কেউ জানে না কিন্তু তাকে সবাই ভয় পায়। একদিন আমরা পঙ্গপালের ভীষণ আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম আমাদের টুপি ও মুখের ওপর জাল ছিল বলে। সর্বাঙ্গ ভালোভাবে ঢাকা ছিল তাই সে ‘যাত্রা বাঁচলাম। পঙ্গপাল লক্ষ লক্ষ (বড় ফড়িংয়ের মতো দেখতে) আমরা যেদিকে যাব সেইদিক থেকে ভীষণ জোরে আসছিল। এত জোরে লাগছিল যে, যেখানে লাগছিল মনে হচ্ছিল যেন বুলেট বা বন্দুকের গুলির মতো কষ্টকর। আমরা যদি চলাফেরা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম, পঙ্গপাল আমাদের ওপর দিয়ে চলে যাবে এই আশায়, তা হলে মৃত্যু সুনিশ্চিত। দেখতে দেখতে মানুষের ওপর পঙ্গপাল বসে এত তাড়াতাড়ি কাটতে আরম্ভ করবে যে হাড় কখানা পড়ে থাকবে। চলতে হবে যতই অসুবিধা হোক। অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল। একটা গাছের পাতা মুড়িয়ে খেয়ে যেতে পঙ্গপালের দলের একঘণ্টার বেশি লাগে না। একটা উটের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাকে অল্প সময়ে কাবু করে ফেলে। তারপর মাটিতে শুয়ে পড়লে পঙ্গপালের পাহাড় তার ওপর জমে খেতে আরম্ভ করবে। দুঘণ্টা পরে কয়েকটা হাড় ফেলে পঙ্গপাল তার গন্তব্যপথে চলে যাবে। শোনা যায়, পঙ্গপালরা মরুভূমি পার হয়ে, সমুদ্র পার হয়ে ভীষণ জোরে যেতে পারে। শুনেছি তারা ভূমধ্যসাগর পার হয়ে আফ্রিকা থেকে এশিয়া ও দক্ষিণ ইউরোপে যাতায়াত করে। যেখানেই যায় তাদের আসতে দেখলেই লোকেরা খুব ভয় পায়। সব সবজি, গাছপালা নির্মূল করে খেয়ে পঙ্গপালরা ঝড়ের গতিতে উধাও হয়ে যায়। ভাগ্যে পঙ্গপালরা ক্বচিৎ দেখা দেয়। আমাদের দেশে দিল্লি ও রাজপুতানায় কখনও কখনও পঙ্গপালের উপদ্রব হয়।

আমরা চলতে চলতে হঠাৎ পশ্চিমমুখো ক্যারাভ্যান চলার পথে এসে পড়েছিলাম। হজযাত্রীরা যাতে বিনা অত্যাচারে যাতায়াত করতে পারে সেজন্য ১৫ মাইল পর পর একটা মাটির বাড়ি ফরাসি গভর্নমেন্ট থেকে তৈরি করেছে। প্রত্যেকদিন ফরাসি সশস্ত্র রক্ষীবাহিনীর আরবরা ঘোড়ায় চড়ে সাত মাইল মরুভূমির মধ্যে টহল দেয়, যখন অন্য ঘাঁটির পুলিশের সঙ্গে দেখা হয় তখন পাঞ্জা বিনিময় হয়, তারপর দুই দলই নিজ নিজ ঘাঁটিতে ফিরে যায়। দিনের মধ্যে অন্তত এইরকম একটা ঘাঁটি রোজই পেতাম। ছোট্ট মাটির ঘর। মাথার ওপর একটু ছায়া দেয় বলে ঘাঁটিগুলি দেখলেও আনন্দ হত। সিরীয় বেদুইনরা অপেক্ষাকৃত শায়েস্তা হয়েছে বলে মনে হয়। আমরা বিনা দ্বিধায় তাদের সঙ্গে দিনরাত কাটিয়েছি। একদিন সন্ধ্যায় এক বড়লোক বেদুইন (‘শেখ’ যাকে বলে)-এর তাঁবু লক্ষ্য করে আমরা চারজন উপস্থিত হলাম সেখানে। শেখ খুব ভদ্রভাবে আমাদের অভ্যর্থনা জানাল এবং তার সঙ্গে আরবি ডিনার খাবার নিমন্ত্রণ জানাল। সাধারণ আরবরা অতিথি সৎকার করতে ভালোবাসে। খুব সামান্য অবস্থা হলেও খাবার ভাগ করে খায়।

শেখের তাঁবুর কাছেই আরও দুটো তাঁবু ছিল। প্রথমটা জানানা মহল বা স্ত্রী- পুত্রদের জন্য। দ্বিতীয়টা বন্দুকধারী অনুচরদের জন্য। প্রত্যেক শেখের জীবনে একটা অতীতের রহস্যময় কাহিনী প্রায়ই লেগে থাকে। মোটামুটি বুঝতাম যে শেখরা যেমন অসীম সাহসী তেমনই তাদের উদার মন

এই নিমন্ত্রণের খবর লেখবার মতো। বহুদিন পর ডিম (মুরগির) খেলাম মরুভূমির মাঝখানে। সেদ্ধ ডিম। রং হলদে এবং কুসুমটা কালো। একটি বিশেষ প্রথায় সেদ্ধ ডিম অনেকদিন খাবার উপযুক্ত থাকে। ডিম সেদ্ধ করেই খোলাসুদ্ধ একরকম তেলের মধ্যে ডুবিয়ে দেয়। ডিমের খোলার ওপর যে ছিদ্র (Pores) আছে সেগুলি বন্ধ করে তেল। তারপর উষ্ট্রবরের অর্থাৎ গোবরের তালের মধ্যে একটা ডিম রেখে বাকি সবটা ঢেকে দেয়। গোলাকার বলকে বালির ওপর কয়েক ঘণ্টা রাখলেই বলটা শক্ত হয়। ডিম ঘুঁটের বলের মধ্যে থাকে বলে তার খোলা ভাঙে না বা নষ্ট হয়ে যায় না। তখন ঘোড়ার পিঠে করে ডিমসুদ্ধ ঘুঁটের বল যেখানে খুশি নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ওপরের ঘুঁটের খোলস ছাড়িয়ে, তারপর ডিমের খোলা খুলে ফেলে ডিম স্বচ্ছন্দে খাওয়া যায়। কতদিনের পুরনো ডিম বিশেষ করে তার হলদে রং যখন কালো হয়েছে, খাবার উপযুক্ত কিনা সন্দেহ জাগল মনে। শেখ দেখলাম একটা ডিম নিজে খেয়ে আমাকে একটা দিল। যা থাকে বরাতে বলে খেলাম। মুখে নিয়ে কিন্তু ভালোই লাগল। আরও একটা খেলাম।

শেখ তার ঝুলির ভেতর থেকে একটা আরকের বোতল বের করে আমাকে একটু ঢেলে দিল এবং নিজেও একটা ছোট গ্লাসে নিল। (ওষুধের মিক্সচার খাওয়ার গ্লাস বলা যেতে পারে) কিছুটা আরক ঢেলে ইঙ্গিত করল খাবার জন্য। একটুখানি গলা পর্যন্ত পৌঁছতেই আমার নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমার অবস্থা দেখে শেখ তাড়াতাড়ি ঝুলির ভেতর থেকে আদ্যিকালের একটুকরো ‘চিজ’ বা শক্ত ‘পনির’ বের করে আমাকে খেতে দিল। আমি তৎক্ষণাৎ এক কামড় দিলাম কিন্তু কী বিকট গন্ধ। না পারি গিলতে, না পারি ফেলতে। বন্ধুদের দিকে আরকের গ্লাসটা এগিয়ে দিলাম। তারা জিভে সামান্য ঠেকিয়ে অন্যের হাতে ফেরৎ দিল। আরক মানে বুঝলাম রাশিয়ানদের ভদকা যেমন, তেমনই কড়া এবং প্রিয় মদ আরবদের কাছে।

আমাদের সম্মানার্থে শেখ একটা দুম্বা (ভেড়া) কাটার হুকুম দিয়েছিল। আমরা ‘হালাল’ করা দেখলাম এবং আরও দেখলাম কী অভিনব উপায়ে সামান্য চামড়া কেটে পায়ের দিকে সমস্ত চামড়াটা গা থেকে খুলে নিতে সক্ষম হল। কেবল জোরে জোরে ফুঁ দিয়ে। ভিস্তিরা যে মশকে জল নিয়ে যায়, তা এমন ভাবেই তৈরি, চারটে পা বাঁধা, গলা দিয়ে জল ভরে পিঠে জল বয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। তারপর গলার মুখ খুলে জল যেখানে দেবার সেখানে উজাড় করে দেয়।

অনেক রাত পর্যন্ত শেখ আরক খেল। তারপর এসে গেল প্রকাণ্ড এক তামার থালা। প্রথমেই একটা পানের ডাবা ধরনের পাত্রে এল সুরুয়া। শেখ এক চুমুক খেয়ে আমার দিকে পাত্রটা এগিয়ে দিল। আমিও এক চুমুক দিলাম এবং বন্ধুদের দিকে সুরুয়া এগিয়ে দিলাম। সুরুয়া মুখে নিয়েই বুঝেছিলাম যে অনেক ভেড়ার লোম সুরুয়ার ওপরে ভাসছিল। অল্প আলোতে বোঝা যায় না, কোনওরকমে দাঁত দিয়ে লোম ছাঁকলাম এবং একটু একটু করে গলাধঃকরণ করলাম। দ্বিতীয়বার খাবার আগে শেখের দেখাদেখি একটা আঙুল পাত্রের ধারে রেখে চুমুক দিলাম। বন্ধুদেরও বলে দিলাম সুরুয়া খাবার ছোট্ট কায়দাটা। গরম সুপ ভালোই লাগছিল। তারপর রুটি ছেঁড়ার পালা এবং তারপরই দুম্বার নরম ঝলসানো মাংস খেলাম। দুর্ভিক্ষ- পীড়িতদের মতো অনেকটা মাংস খেলাম। ভেজিটেবল বা তরকারি শাক-সবজির বালাই নেই। শেষকালে দইয়ের (রাম টক) পাত্র থেকে শেখ খেয়েই আমার দিকে পাত্রটি ধরল। একটা বড় থালার চারপাশে বালির ওপর গোল হয়ে বসে খাওয়ার নিয়ম। প্রত্যেকটি খাবার শেখ প্রথমেই একটু চেখে প্রমাণ দেয় যে খাবারে বিষ মেশানো নেই। অলিখিত নিয়ম অনুসারে অতিথি খাবে পাত্রের সেখান দিয়ে যেখানে শেখ খেয়েছে। মনে মনে জানি যে শেখ মুখ ধোয় না, তাই ঘেন্না লাগত প্ৰথম প্ৰথম, তারপর সব সয়ে গেল যখন ভাবলাম যে আমাদেরও তো আরবি বনতে বাকি নেই। কতদিন আগে স্নান করেছি তার ঠিক নেই। মুখ ধোয়ার বালাই ছিল না জলের অভাবে। তাছাড়া গায়ের পোকা তো গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। শেখের কাছে বিদায় নিয়ে আমরা পরদিন সূর্য ওঠার পর রওনা হলাম।

তারপর একদিন আমরা হঠাৎ আবিষ্কার করলাম যে সিরিয়ার গভর্নমেন্ট অর্থাৎ ফরাসিরা মরুভূমির মধ্যে একটা পাকা রাস্তা করবার চেষ্টা করছিল। বালিতে ঢাকা পড়লেও আমরা সেই রাস্তার সন্ধান পেয়েছিলাম যেটা প্রায় তিনশো মাইল লম্বা

রাস্তাটা কিছু মাইল যাবার পর বালিমুক্ত দেখলাম। মনের আনন্দে অনুকূল বাতাসে ভর করে জোরে সাইকেল চালাতে আরম্ভ করলাম। প্রায় ৬০ মাইল পর রাস্তার ধারে পাহাড়ের গায়ে গুহায় দেখলাম একদল আরব আশ্রয় নিয়েছে। এরা গুহাবাসী। তার অনতিদূরে একদিন এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম। একটা কবরের ওপর মাথা রেখে এক তরুণী কাঁদছে। আমাদের কাছে আসতে দেখে কান্না থামাল। তার স্বামী অল্পদিন আগে মারা গিয়েছে। চারদিক ফিরে তাকালাম কিন্তু কোথাও মানুষের বসবাস তাঁবু বা বাড়ি চোখে পড়ল না। কোথা থেকে সেখানে এল এই রমণী এবং কোথায় যে সে যাবে বুঝতে পারলাম না। এইরকম আমার মনে হত শান্তিনিকেতন যাবার সময় যখন ট্রেনটা ‘বনপাশ’ বা ‘তালিত’ স্টেশনে থামত। কয়েকজন যাত্রী ট্রেনে উঠত, কয়েকজন বা নামত। কোথাও ঘরবাড়ি চোখে পড়ত না। যে যাত্রীরা স্টেশনে নামল তারা কোথায় যাবে কে জানে? তেমনই নিশ্চয়ই কোথাও আরবদের বসবাস আছে, মেয়েটির কান্না ফুরোলে সেখানে সে চলে যাবে।

কবরের কথায় মনে পড়ল যে আমরা একদিন হারুন-অল-রশিদের স্ত্রী জুবেদার কবরখানা হঠাৎ খুঁজে পেয়েছিলাম বাগদাদের থেকে অনেক দূরে মরুভূমিতে। যে বৃদ্ধ সেই কবর দেখাশোনা করত সে মনে করত জায়গাটা পীঠস্থান। তার যতদিন সাধ্যে কুলাবে ততদিন কবরে সন্ধ্যায় বাতি দেবে।

কয়েকদিন পরেই আমরা হালেব শহরে পৌঁছলাম। করাচি ছাড়বার পর এই প্রথম বড় শহর দেখলাম। পাকা বাড়ি, পাথরে বাঁধানো রাস্তা এবং দুপাশে দোকান, কফিখানা ইত্যাদি পর পর বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে রয়েছে।

আমরা একটা সিরীয় আরবি হোটেলে আশ্রয় নিলাম। মোটামুটি পরিষ্কার। আমাদের ঘরটা রাস্তার ওপরেই। একটা বিশেষত্ব দেখলাম এই যে, ঘরের এক ধারে দড়ি ঝুলছে, সেটা টানলে কুয়ো থেকে বালতি ভর্তি জল উঠে আসে। ঘরটার ভাড়া ১৫ টাকা। চারটে খাট ছিল। বিছানা চাইলে পাওয়া যায়, কিন্তু তারজন্য আলাদা দাম দিতে হয়। কফি ছাড়া কোনও খাবার পাওয়া যায় না। আমরা শহর ঘুরে যেখানে ভালো লাগত সেখানেই খেতাম। গ্রিস থেকে আরম্ভ করে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব ও পূর্ব- উত্তর কোণে খাওয়ার পদ্ধতি একই ধরনের: বেগুন কিংবা টমাটোর ভেতর কিমা মাংসের পুর— দিয়ে ভাজা প্রায় সব জায়গায় রাঁধতে দেখেছি এবং খেয়েছি। বেশ সুস্বাদু। মশলা খুব কম ব্যবহার করে। দইয়ের চলন খুব।

রাত্রে একটা কার্নিভ্যাল দেখতে গেলাম। সিরিয়ার ফরাসি শাসক ও তাঁর স্ত্রী এলেন একটু পরেই। সবাই উঠে দাঁড়াল। ভাইসরয় ও তাঁর স্ত্রী জনসাধারণের অভিবাদন গ্রহণ করে তাদের দিকে দুহাত তুললেন। একটা একটু উঁচু জায়গায় দুটো বড় বড় চেয়ার সাজানো ছিল, সেখানে বসলেন। ভারতবর্ষ থেকে সাদা-কালোর পার্থক্য দেখার পর এরকম অবাধ মেলামেশা দেখে আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ব্যান্ডপার্টি নাচের একটা সুর ধরতেই ভাইসরয় একজন সিরীয় আধুনিকা মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে তার সঙ্গে নাচবার ইঙ্গিত করলেন। নাচ শুরু হল। ইতিমধ্যে একজন যুবক, আরব আর্মি অফিসার ভাইসীরিনের সামনে এগিয়ে এল এবং ‘স্যালুট’ করে নাচবার আমন্ত্রণ জানাল। বিনা দ্বিধায় ভদ্রমহিলা নেমে এসে আর্মি অফিসারের এক হাত ধরলেন এবং অন্য হাত তাঁর কাঁধের ওপর রেখে অবাধে নাচতে আরম্ভ করলেন। আমার কাছে এদৃশ্য এত অদ্ভুত মানবতাপূর্ণ ও স্বাভাবিক মনে হল যে তাতে ফরাসি জাতির ওপর আমার শ্রদ্ধা আরও বাড়ল। যখন ‘হাঁ’ করে সব কীর্তিকলাপ দেখছি, তখন একটি রুশ ভদ্রমহিলা, আমাদেরই বয়সী, কাছে এসে দাঁড়ালেন এবং নাচবার নিমন্ত্রণ জানালেন। আমি তৎক্ষণাৎ বললাম : মাফ করবেন, আমি নাচতে জানি না। আমার কথায় কান না দিয়ে একরকম জোর করে হাত ধরে টানলেন। কখনও বলরুম ড্যান্সিং করিনি। দেখতে অবশ্য খুব ভালো লাগছিল। রুশ ভদ্রমহিলা নিজের পরিচয় দিয়ে জানালেন যে আমরা একই হোটেলে থাকি এবং আমাদের কথা তিনি জানেন। খেয়াল করিনি কখন আমার হাত ধরে টানতে টানতে আসরের মাঝখানে নিয়ে ফরাসি ভাষায় আমায় নাচতে বললেন। আমি টপ বুট পরে, রুশ মহিলাটিও লাল চামড়ার টপ বুট পরে। কাজেই পা মাড়াবার ভয় ছিল না। তবু নাচ বিশেষ এগোচ্ছিল না। না বুঝি গানের ভাষা, না তার সুর ও ছন্দ। তালটা একটু- একটু মাথায় ঢুকছিল এবং তার সঙ্গে পা মিলিয়ে চলবার চেষ্টা করতে লাগলাম। মনে হল বোধহয় শিখতে পারব। নাচের বাজনা থামল, নাচও থামল। সবাই হাততালি দিল এবং তখনই বাজনা আবার বাজতে শুরু করল। আগের তাল থেকে অন্য ধরনের। একে ‘ওয়াল্টস’ বলে। আমার মনে মনে যে ভরসা হয়েছিল এই কথা ভেবে যে আমি নাচ শিখতে পারব, তা নিমেষে উবে গেল। কিন্তু ভদ্রমহিলার উৎসাহে ভাঁটা পড়ল না। বরং আরও উৎসাহের সঙ্গে আমাকে টানতে এবং ঠেলতে ঠেলতে বলতে লাগলেন ফরাসি ভাষায় ‘এক দুই তিন, এক দুই’ ইত্যাদি। এই তাল বোঝা খুব সোজা। তাই একটু সাহসে ভর করে নাচতে আরম্ভ করলাম, তখনই দেখি লাল বুটের ওপর দু-চারবার মাড়িয়ে দিয়েছি। নাচ শেষ হবার পর আমি ধন্যবাদ দিয়ে ভদ্রমহিলার টেবিলে পৌঁছে দিতে গেলাম। সেখানে এক রুশ যুবক, আমাদের থেকে দু-চার বছর বড় হবে, দাঁড়িয়ে উঠে হাত বাড়িয়ে আমার হাত ধরল এবং পরিষ্কার ইংরিজিতে বলল— এস, তোমরা আমাদের টেবিলে যোগ দাও। আজ ১৪ জুলাই— ফরাসিদের সবচেয়ে বড় পরব। বুঝলাম, রুশ দম্পতি আমাদের হোটেলে লক্ষ করেছে। আমি বন্ধুদের ডেকে তাদের সঙ্গে যোগ দিলাম। বেশ গল্প জমে উঠল। জানলাম রুশ যুবকের নাম মিখায়েল ও তরুণীর নাম রেনে। এই নামেই তারা পরিচয় দেয় বিখ্যাত নাচিয়ে হিসাবে। এদের অবস্থা এককালে ভালো ছিল, ইংরেজ গভর্নেসের কাছে তাদের ইংরিজি ভাষা শিক্ষা। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর দেশ ছেড়ে বিদেশে বিদেশে কসাক নাচ দেখিয়ে জীবিকার্জন করত। নাচ দেখবার জন্য নিমন্ত্রণ পেলাম আমরা। মিখায়েল বলল যে তাকে সারাদিন এত নাচ অভ্যাস করতে হয় যে তারপর বলড্যান্স না করে বরং একটুক্ষণ বিশ্রাম করতে ইচ্ছা করে। ওদের দুজনের বাড়ি ছিল লেনিনগ্রাদ শহরের কাছেই একটা শহরতলিতে। মনে মনে ভাবলাম যে যতদিন রেনের রূপ ও যৌবন আছে ততদিনই নেচে বেড়ানো সম্ভব, তারপর ইস্তফা। মিখায়েল স্থপতিবিদ্যায় ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে বেরিয়েছে, এমন সময় যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেল। ১৯১৭ সালে রুশ দেশে বিপ্লব এবং লেনিন জয়ী হলে কমিউনিজমের ধাঁচে গভর্নমেন্ট গড়বার তোড়জোড় যখন পূর্ণোদ্যমে চলছে, তখন অনেক অবস্থাপন্ন লোকেরা দেশ ছেড়ে চারদিকে পালায়। মিখায়েল পরিবারও দক্ষিণ তুর্কি দেশে আশ্রয় নিয়েছিল! ওইরকমভাবে নাচ দেখিয়ে তারা ইরান পর্যন্ত যাবে, তারপর কী করবে ওরা জানে না। হয়তো তুর্কি কিংবা সিরিয়াতে বাড়িঘর তৈরি করবার কাজ নেবে।

পরদিন সকালে বারান্দায় বসে কফি ও রুটি খেতে খেতে এক আশ্চর্য ঘটনা দেখলাম। রাস্তার ওপারে ফুটপাথে বসে দুজন ফরাসি ও দুজন সিরীয় আরব সৈনিক তাসে জুয়া খেলছিল। আমাদের দিকে পিছন ফিরে বসা ফরাসি সৈনিকটি তাসের মধ্যে চালাকি করে অন্য তাস গুঁজে দিচ্ছিল এবং যখন ধরা পড়ল, তখন আরব সৈনিকটি দাঁড়িয়ে উঠে লাথি মারতে লাগল ফরাসি সৈনিককে। লোকের ভিড় জমে গেল। একজন ফরাসি অফিসার সেখান দিয়ে যাচ্ছিল, সে সব কথা শুনে আবার একটা লাথি মেরে চলে গেল।

আমাদের কল্পনার বাইরে কালাধলার কতটা সমান অধিকার ফরাসি উপনিবেশে। ফরাসিদের মধ্যে বর্ণবৈষম্যবোধ সত্যিই খুব কম দেখলাম। ফরাসি ভাষা শেখবার ইচ্ছা হল। রেনের সঙ্গে দেখা হতে বললাম আমার ইচ্ছার কথা। কী উৎসাহ তার! তখনই একটা বই কিনতে বেরল এবং বিকালের মধ্যে দশটা অতি আবশ্যকীয় চলতি কথা শিখে ফেললাম।

এলেপ্পো শহরের আরবি নাম হচ্ছে হালেব। বহু পুরনো ঐতিহাসিক শহর। বাইবেলের যুগ থেকে এই শহরের নাম পাওয়া যায়। অনতিদূরে দামাস্কাস আরেকটি বড় শহর। সেখানে বাজারে বিশেষ করে চামড়া, পেতলের জিনিস এবং সুতির কাপড় খুব বিক্রি হয়। হালেব শহরের বাজারও বিখ্যাত, যদিও দামাস্কাসের সঙ্গে তুলনা হয় না। বায়রুত আরেকটা নামি শহর, সমুদ্রের ওপরই ৩০ মাইল দূরে। সেখানে বালবেক নামে একটি গ্রিক মন্দিরের (জুপিটারের) ধ্বংসাবশেষ পুরনো দিনের বৃহত্তম গ্রিক ঐতিহ্যের সাক্ষ্য দেয়। একেকটি পাথরের থাম এত বিরাট যে বলা যায় না। ৭৫০ টন ওজন হবে প্রত্যেকটির। সেই আদি যুগে যখন ক্রেন, গাড়ি, লোহার যন্ত্রাদি কিছুই ছিল না তখন কেমন করে খনি থেকে পাথর উঠিয়ে তার ওপর নানাবিধ কাজ করে উঁচুতে যথাস্থানে তাদের তুলেছিল এবং জুপিটারের মন্দির করেছিল, তা অতি বিস্ময়কর জিনিস। এই শহরে আমেরিকানরা একটা ইউনিভার্সিটি করেছে। বেশিরভাগ প্রফেসর আমেরিকান। আধুনিক টেকনোলজি এবং কারিগরিবিদ্যা শেখানোর জন্য এই ইউনিভার্সিটি সর্বত্র সুবিদিত।

কয়েকদিন হালেবে থেকে কলকাতার সদ্য প্রকাশিত ‘বিচিত্রা’ মাসিক পত্রে আমাদের ভ্রমণকাহিনী সম্বন্ধে লিখে ছবি সমেত পাঠালাম। আমার সাহিত্যসেবী ভগ্নীপতি জ্যোতিপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। আমার সঙ্গে উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয়ের আত্মীয়তা ছিল। তার ভাগলপুরের বাড়িতে কয়েকবার গিয়েছি। একবার মাত্র অল্পক্ষণের জন্য শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেও দেখেছিলাম সেই বাড়িতে।

‘বিচিত্রা’ তখন সাহিত্য আসরে খুব সুনাম অর্জন করেছিল রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’ প্রথম প্রকাশ করে ও প্রায় সেইসঙ্গে উপেন্দ্রনাথের আবিষ্কৃত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘পথের পাঁচালি’ও নিয়মিত বার করে। উপেন্দ্রনাথ পৃথিবী ভ্রমণের কাহিনী প্রথম প্রকাশ করে আমাদের সম্বন্ধে সাধারণের কৌতূহল খুব বাড়িয়েছিলেন ১৯২৭ সালে।

যতটুকু অবসর সময় পেতাম আমি ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’তে শনিবারের দুপুরবেলায় যাযাবরের ভ্রমণকাহিনী ধারাবাহিকভাবে বলবার জন্য লিখতাম। বীরেন রায় সেটা পড়তেন কলকাতায়।

সেই সময় একটি সিরীয় যুবকের সঙ্গে আলাপ হল। ভারতবর্ষ থেকে এসেছি জেনে খুব অবাক হয়ে গেল। একটি স্কুলের সঙ্গে সে জড়িত ইংরিজি শিক্ষক হিসাবে। সে আমাকে নিমন্ত্রণ জানাল তার স্কুলে আমাদের ভ্রমণ সম্বন্ধে কিছু বলতে। আমি রাজি হলাম এই শর্তে যে, দুআনা প্রবেশমূল্য লাগবে যদি কেউ শুনতে চায়। পরদিন বিকালে স্কুলে গেলাম। অনেক ছাত্রের ভিড় হয়েছে দেখে মনটা আশ্বস্ত হল। অশোক ও আমি দুজন বললাম। শিক্ষক কথাগুলি আরবিতে তর্জমা করে ছেলেদের সামনে ধরলেন। সবার খুব উৎসাহ দেখলাম। আমাদের যথেষ্ট লাভ হল, প্রায় পঁচিশ টাকা রোজগার করে ভীষণ স্ফূর্তি লাগল, অনেকদিন ‘পকেট গড়ের মাঠ’ ছিল। প্ৰথম আয় হয়েছিল যখন মরূদ্যানের কাছে রুপোর সিকি বালি থেকে কুড়িয়ে চারজনে পেয়েছিলাম। সেটা টাকায় হিসাব করলে প্রায় ১৭৫ টাকা হবে। তারপর এই ২৫ টাকা।

ফরাসি ভাষা শেখা আরম্ভ করলাম আমরা চার বন্ধু। দুঃখের বিষয় যে বন্ধুরা দুদিন পরেই হাল ছেড়ে দিল। তখন আমার আরও জিদ চাপল যে নানা বিদেশি ভাষা শিখতেই হবে। সহজে শেখবার ক্ষমতা আমার আছে, তা আমি জানতাম না। অন্যদের সঙ্গে একটু-একটু করে কথাবার্তা বলতে পারছি এবং তারা তা বুঝতে পারছে দেখে ভীষণ উৎসাহিত বোধ করলাম। সময়ের অভাবে রেনের কাছে যতটুকু শিখতে পারলাম তা সযত্নে সঞ্চিত করে রাখলাম, ভবিষ্যতে আরও ভালো করে শেখবার ও ব্যবহার করবার জন্য।

সিরীয় দেশের শেষ ঘাঁটি উত্তর-পশ্চিমদিকে ঠিক তুর্কির নিচেই ‘ইস্কাদ্রুন’ বা আলেকজান্দ্রেটা শহর অভিমুখে চলেছি। আরেকটি বড় শহর আছে প্রায় একই নামে, আরেকজান্দ্রিয়া, মিশর দেশে। লোকেদের বলতে শুনেছি যে, গ্রিক যোদ্ধা আলেকজান্ডার দুই হাজার বছর আগে এইসব জায়গা জয় করেছিলেন ভারতবর্ষ অভিযানের পূর্বে। আমরা মোটামুটি আলেকজান্ডারের সৈনিকরা যে পথে যাওয়া- আসা করেছিল সেই পথে— ‘বিপথে’ বললেই ভালো হয়— চলেছি।

ফরাসি সীমান্তবাহিনীর একটি দলের মধ্যে আমরা গিয়ে পড়লাম। মাঝখানে ২-৩ মাইল ‘নো-ম্যানসল্যান্ড’, ওপারে তুর্কি। ফরাসিরা এমন আমোদপ্রিয় যে সহজেই আনন্দ প্রকাশ করে, বিশেষ করে এমন দূর দেশ থেকে যদি কোনও লোক তাদের মধ্যে গিয়ে পড়ে। দু-চারটি ফরাসি কথা বলতেই ঘাঁটির ক্যাপ্টেন ও অন্যান্যদের মুখে দেখলাম এক গাল হাসি। আসলে ‘ডের-এর-জোর’ থেকে ফরাসিরা বেতারে আমাদের খবর আগেই এদের জানিয়ে দিয়েছিল। তার ফলে আমাদের জিনিসপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে পাসপোর্টে স্ট্যাম্প মেরে বলল ‘সব ঠিক হ্যায়’, কিন্তু একটা শর্ত ছিল, ফরাসিদের সঙ্গে এক সপ্তাহ থেকে তাদের আতিথ্য স্বীকার করতে হবে। এক সপ্তাহ খুব বেশি হবে বলে অনেক তোষামোদ করে তিনদিন থাকবার কথা দিলাম।

এই সীমান্ত-ঘাঁটির নাম ছিল ‘ডের তিয়ল’। সেখানে প্রচুর মজুদ খাবার রাখা ছিল। জেনারেটর দিয়ে ইলেক্ট্রিক আলোর বন্দোবস্ত ছিল। সেটা তাদের মস্ত গর্বের বিষয়। সীমান্তের ওপারে তুর্কির ঘাঁটি যখন রাতের অন্ধকারে, এপারে ফরাসিরা তখন আলো দিয়ে আর নাচ, মিউজিক দিয়ে সরগরম রাখত। আমাদের ফরাসিরা বোঝাল যে কখনও ট্যুরিস্ট বা ব্যবসাদার এই ঘাঁটিতে আসেনি পূর্বদিক থেকে। যে কজন লোক এসেছে তারা পশ্চিম থেকে পুবদিকে যাত্রা করেছে। তুর্কির লোকেরা

আমাদের বেগ দেবে সে কথা জানাল। আমাদের তখন ‘নান্যপন্থা’র অবস্থা। ফরাসিদের সঙ্গে খুব হই হই করে ভালো ভালো খেয়ে তিনদিন পরে সকালবেলায় রওনা হলাম তুর্কির দিকে। আমাদের পিছনে ফরাসি ব্যারাকের সব সৈনিকরা দাঁড়িয়ে রইল ও শুভেচ্ছা জানাল। কেউ কেউ বলল অসুবিধা হলে চলে এস’, অর্থাৎ পৃথিবী ভ্রমণ জলাঞ্জলি দিয়ে সিরিয়ার সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে বাকি জীবন কাটাই, এই যেন তাদের ইচ্ছা।

তুর্কি সীমান্তের দিকে যতই এগোতে লাগলাম ততই স্পষ্ট হয়ে উঠল তুর্কিরা আমাদের কীরকম অভ্যর্থনা দেবে। ঘাঁটির সব সৈনিক রাইফেল উঁচিয়ে আমাদের লক্ষ্য করে দাঁড়িয়ে ছিল, আমরা যেন ঘাঁটি দখল করতে যাচ্ছি। যেহেতু আমাদের সঙ্গে প্রত্যেকের দুটো করে বন্দুক ছিল। আমাদের বন্দুক খাপের ভেতরেই ছিল, তবু এমনই কড়া মেজাজে তুর্কি সৈনিকরা আমাদের গ্রহণ করল। আসল ব্যাপারটা মনস্তাত্ত্বিক। সিরিয়া তুর্কির অধীনে একটা প্রদেশ ছিল। বিগত মহাযুদ্ধে (প্রথম) তুর্কি হেরে গেল, তার অধীনস্থ সব দেশ যেমন মিশর, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া (এখন ইরাক), মিত্রদলের মধ্যে ইংরেজ, ফরাসিরা সব ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিল। বিরাট তুর্কিকে কেটে-ছেঁটে ছোট করাই উদ্দেশ্য ছিল। সেইজন্যই তুর্কি এই দুই জাতিকেই বিশ্বাস করে না। তাদের ভয়, ইংরেজ বা ফরাসি যে কোনও অছিলা করে তুর্কি গ্রাস করবে। তারপর চালাবে ভারতবর্ষ পর্যন্ত একচ্ছত্র রাজত্ব।

আমাদের ওপর তুর্কি সেনানীদের রাগ হবার একটা কারণ আমরা পরে আবিষ্কার করি। আমাদের নিয়ে ফরাসিরা আমোদ-আহ্লাদ করেছে। তারা লক্ষ করেছে এবং আমাদের মনে করেছে তাদেরই একটা ছোট দল।

আমরা এক হাতে সাইকেল ধরে অন্য হাত উঠিয়ে এগোতে লাগলাম, আমাদের মনোভাব অর্থাৎ আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছি এই ভাব জানালাম। ওরা বন্দুক নামাল না— আমাদের দিকে লক্ষ্য করে একটা হুঙ্কার ছাড়ল। আমরা বুঝলাম আমাদের চ্যালেঞ্জ করছে। একটু থেমে হাতে সাদা রুমাল ওড়াতে ওড়াতে আমরা তুর্কি ঘাঁটিতে পৌঁছলাম। তুর্কি ও ফরাসি ভাষায় ওরা নানারকম প্রশ্নবাণ ছাড়ল। আমরা ফরাসি বুঝি না, জানালাম, তবে শেখবার ইচ্ছা রাখি। একটা বই সঙ্গে আছে, সেটা ফরাসি প্রাইমার। পরিচয় দিলাম যে আমরা ভারতবর্ষ থেকে আসছি, সমস্ত পৃথিবী সাইকেল ঘুরব। কিছু বুঝল না, ইন্ডিয়া বলে একটি দেশ আছে নাকি কোথায়, কে জানে। আমরা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের দেশের লোক বাংলা, হিন্দি ও ইংরিজিতে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ফল হল না। পাসপোর্ট দেখালাম, উল্টো করে ধরেই পড়তে আরম্ভ করল। যখন ছবিটা উল্টো দেখল তখন বুঝল হরফগুলো সব উল্টো পড়ে ফেলেছে। ফলে নিজেদের নির্বুদ্ধিতার জন্য হাসাহাসি হল। এমন সময় ওদের নজরে পড়ল তুর্কি ভাষায় লেখা ছাড়পত্র সম্বলিত স্ট্যাম্পের ওপর। ক্যাপ্টেন সাহেব বললেন, যে বন্দুক সাইকেল ও সমস্ত মালপত্র তাঁদের দিতে যাতে ভালো করে পরীক্ষা করতে পারে আমরা কে, কী উদ্দেশ্য আমাদের ইত্যাদি। ব্যস, শুরু হল সব তন্নতন্ন করে খোঁজার পালা, একজন বন্দুক খুলে দেখল টোটা ভরা আছে কিনা, ক্যামেরার ভেতর কী আছে দেখবার জন্য সেটা খুলতে বলল অর্থাৎ নেগেটিভের বারোটা বেজে গেল। জিনিসপত্র খুলে সব জিনিস খুঁটিয়ে দেখল। আমাদের জামাকাপড় ভালো করে পরীক্ষা করল। আমরা জানতাম অশেষ ধৈর্য সহকারে সব সইতে হবে, ওদের সন্দেহ তো আছেই, তার কোনও বাস্তব কারণ দেখলে তো আর রক্ষা নেই, কাছেই গাছের কাছে নিয়ে বলবে ‘হাত তুলে পিছন ফিরে দাঁড়াও’। তারপর একটা বুলেট জানিয়ে দেবে পৃথিবী ভ্রমণ কোথায় এবং কতদূর!

ওরা যতই কঠিন ব্যবহার করুন না কেন, আমরা ঠিক করেছিলাম যে আমরা সারাক্ষণ হাসিমুখে সব প্রশ্নের জবাব দেব। বললাম, কামাল পাশাকে আমার দেশের লোকেরা কত শ্রদ্ধা করে। আরেকটু হলে নজরুল থেকে কবিতা আওড়াচ্ছিলাম ‘কামাল তুনে কামাল কিয়া ভাই’।

সৈনিকরা আমাদের মুখে কামালের নাম শুনে আরও সন্দিগ্ধভাব প্রকাশ করল। সারাদিনব্যাপী পরীক্ষা যখন শেষ হল ভাবছি, ক্যাপ্টেন বলল যে আমাদের আলাদা ইন্টারনাল পাসপোর্ট লাগবে। সেটা আদানা শহর (৩০০ মাইল দূরে) থেকে আনতে হবে। আগামীদিনের প্রথমেই একজন লোক বা সৈনিক সেখানে যাবে এবং ছাড়পত্র নিয়ে আসবে। ১০-১৫ দিন দেরি হবে। এতদিন আমরা কোথায় থাকব জিজ্ঞাসা করাতে গাছতলা দেখিয়ে দিল।

Internal Passport আসার অপেক্ষায় আমাদের এরপর গাছতলায় বসবাস শুরু হল। আমাদের কাছ থেকে ক্যামেরা আপাতত কেড়ে নিল। কোথায় তিন মাইল দূরে ফরাসিদের নৃত্য আমাদের নিয়ে, আর সীমান্তের এপারে শুরু হল নিগ্রহ। জল কোথায় পাওয়া যাবে জিজ্ঞাসা করাতে ঝরনা দেখিয়ে দিল। আমি হুকুম চাইলাম অদূরে গ্রামের বাজার থেকে কিছু খাবার আনবার। সৈনিকরা আবেদন মঞ্জুর করল এবং সঙ্গে একজন তুর্কি যুবক আমার সঙ্গে চলল। গ্রামে সিরীয় টাকা বদলে কিছু তুর্কির টাকা নিলাম। হাতরুটি ও কিছু ঝলসানো মাংস ও এপ্রিকট নিয়ে ফিরলাম। যুবকটি আমার সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করল, যদিও অন্যরা সবাই আমাদের দেখছিল সন্দেহের চোখে।

কাছেই উত্তরদিকে উঁচু পাহাড় বেশিরভাগ আকাশ জুড়ে ছিল। আমাদের গন্তব্যপথ ছিল টরাস পর্বতশ্রেণীর মধ্য দিয়ে। অল্প দূরে পাহাড়ের ওপর কোনও এক গ্রামের ভেতর দিয়ে জল নিচে নেমে যাচ্ছিল। তারপর ঝরনায় পরিণত হচ্ছিল। বলা বাহুল্য, সে জলের প্রাচুর্য দেখে খুব তৃপ্তি করে স্নান করলাম ও খেলাম। ফলে আমাদের চারজনের অল্পবিস্তর শরীর খারাপ হল। তুর্কি ঘাঁটির এক ডাক্তার এসে ওষুধ দিলেন এবং ঝরনার জল খেতে বারণ করলেন। ডাক্তার অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত লোক। ফরাসি ভাষা জানেন। সে ভাষা ছিল শিক্ষিতদের জন্য, যেমন আমাদের কাছে ইংরিজি। তখনকার দিনে ইউরোপের অনেক দেশে ফরাসি ভাষা ব্যবহার হত। অনেক দেশের কোর্ট ল্যাঙ্গুয়েজ বা রাজদরবারের ভাষা ফরাসি ছিল, এমনকী জার্মানি ও রাশিয়ায়। সবাই জানে যে বিখ্যাত ফরাসি লেখক ভলটেয়ার, জার্মানিতে গিয়ে অনেকদিন তাঁর বন্ধু, সম্রাট ফেডরিক দ্য গ্রেটের কাছে ছিলেন।

তুর্কি ডাক্তার আমাদের ভ্রমণের সব কথা শুনে বললেন যে ‘হিন্ডলি’ নামেই তাঁরা ভারতবাসীকে জানেন। অনেক হিন্ডলি গত যুদ্ধে তুর্কির হয়ে লড়েছিল ইংরেজের বিরুদ্ধে। ব্যস, ওই পর্যন্ত। ডাক্তারের আর কোনও জ্ঞান ছিল না আমাদের দেশের কোনও বিষয়ে।

সাতদিন কেটে গেল, আমরা সীমান্ত ঘাঁটিতে যেতাম ও আমাদের ইন্টারনাল পাসপোর্ট বা পারমিট-এর খোঁজখবর নিতাম। আদানা থেকে লোক তখনও ফেরেনি। দশদিন পর আমরা গাছতলায় জিপ্সিদের মতো দিন কাটাচ্ছি দেখে ক্যাপ্টেন বলল যে আমরা আদানা যেতে পারি। সেখানে পুলিশ অফিসে হাজিরা দিতে হবে। বন্দুক ছাড়বে যে দিন আমরা তুর্কি ছেড়ে যাব। ক্যামেরার বেলায়ও একই অবস্থা

অবশেষে বন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে আমরা সৈনিকদের ধন্যবাদ দিয়ে তুর্কির গভীরে প্রবেশ করতে শুরু করলাম। পাহাড়ি পথ যদিও তবু বেশ চওড়া। যুদ্ধের সময় বড় বড় গাড়ি ও কামান চলেছিল এই পথে। তারপর সারানো হয়নি। যেখানে সেখানে বড় বড় পাথর পড়েছিল। আমরা দেখতে দেখতে অনেক উঁচুতে উঠেছি। সীমান্ত ঘাঁটি ডের তিয়ল অস্পষ্ট দেখা গেল। পথে আলেকজান্দ্রেটা শহরে গিয়েছিলাম যখন সমুদ্রের ধারে ধারে যাচ্ছিলাম। সামনে ভূমধ্যসাগরের পূর্বপ্রান্ত। কাপড়চোপড় ফেলে আমরা সমুদ্রের নীল জলে লাফ দিলাম। কিন্তু বহুদূর জলের ওপর হাঁটার পর গভীরতা বাড়ল না দেখে ভয় হল। সৈকত অনেক চওড়া। জনমানব নেই। অগভীর জল কোমর পর্যন্ত তাইতে স্নান করে উঠলাম। ভূমধ্যসাগর দেখে বিশ্বাস হল যে ইউরোপ আর বেশি দূর নয়।

সারাদিন পাহাড়ি পথ ধরে একটা ছোট্ট গ্রামে পৌঁছলাম। গ্রামের লোকেরা ভালো। থাকবার জন্য ব্যবহারের উপযুক্ত একটা ঘর পেলাম। কাঠের ওপর কম্বল বিছিয়ে শুলাম। খাবার জন্য হাতরুটি ও বেগুনের তরকারি আমরা জোগাড় করে নিলাম।

পরদিন সকালে উঠে ঝরনার জলে মুখ-হাত ধুয়ে কফির চেষ্টায় বেরোলাম। এক বৃদ্ধ রোদ পোয়াচ্ছিল, তার নাতনি এক কেটলি কফি ও চারটে কাপ এনে আমাদের দিল। অনেকদিন পর আবার কফি খেয়ে আমরা তৃপ্ত হলাম।

আমি লক্ষ করলাম যে তুর্কি ভাষা শেখা খুব সহজ, বিশেষ করে ওরা আরবি অক্ষর ফেলে রোমান লেটার ব্যবহার করছে বলে। খুব মন দিলাম তুর্কি শেখবার জন্য।

বহুযুগ ধরে তুর্কিরা নিশ্চিন্ত ছিল যে পুবদিক থেকে তাদের কেউ আক্রমণ করতে পরবে না। বলে রাখা ভালো যে, তুর্কিদের ভালো যোদ্ধা বলে সুনাম আছে। টরাস পাহাড়কে তুর্কিরা পবিত্র বলে মনে করে। ফরাসি ইঞ্জিনিয়াররা এই কঠিন পাহাড়ে একটা রেলপথ তৈরি করেছে। সেটা সুড়ঙ্গের ভেতর ঢুকছে ও বেরোচ্ছে। এই পথ তৈরি করায় খুবই বাহাদুরি আছে। বেনারসে পৌঁছবার সময় যখন ট্রেন গঙ্গার ওপর দিয়ে যায় যাত্রীরা একসঙ্গে বলে ‘গঙ্গামায়ী কি জয়’, ‘কাশী বিশ্বনাথ কি জয়’। তেমনই টরাস-এর যাত্রীরা সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়েই পাহাড়ের মাহাত্ম্য স্বীকার করে তার জয়গান করে। আমরা আমাদের সাইকেল সহ সেই টরাস পাহাড়ের ওপর দিয়ে চলেছি। যার উচ্চতা কয়েক হাজার ফুট তো বটেই। আজ টরাস পর্বতমালা লোকবিরল বটে কিন্তু ৪,০০০ বছর আগে নিশ্চয় বহু লোকের বাস ছিল ওখানে যখন দ্বিতীয় ফেরো আমেন এসহেটের সৈন্যরা হারান থেকে নিনেভা পর্যন্ত যত ভ্রাম্যমাণ ইহুদি জাতি ছিল সবাইকে বশ্যতা স্বীকার করিয়ে পশ্চিম এশিয়ার প্রায় সবটাই জয় করেছিল। তারপর অনেক রাজত্বের উত্থান-পতন হয়েছে এইখানে। গ্রিক, রোমান, ইহুদি, এসিরিয়ান, ইজিপ্সিয়ানরা পর পর এসেছে এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।

এককালে ইহুদি ও ইজিপ্সিয়ানরা বেশ সদ্ভাবের সঙ্গে এই অঞ্চলে সহাবস্থান করেছে বহু শতাব্দীর পর শতাব্দী। একজন আরেকজনের বিপদে সৈন্য অস্ত্র ইত্যাদি দিয়ে রক্ষা করেছে। ৭২৪-৭২১ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে এই অঞ্চলে ইহুদিদের বিখ্যাত রাজা ডেভিড ও পরে সোলেমান রাজত্ব করেন। বাইবেলে লিখিত আছে যে, সোলেমান তাঁর বংশানুক্রমিক রাজত্ব রক্ষা করবার জন্য ইজিপ্টের রাজকন্যাকে বিবাহ করেন।

ইজিপ্সিয়ানদের সঙ্গে ইহুদিদের চিরকাল মারামারি কাটাকাটি ছিল না। একবার ইহুদিরা, চতুর্থ আমেনোফিস ইজিপ্টের রাজার কাছে সামরিক সাহায্য চাইতে কয়েকজন বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী লোককে পাঠিয়েছিলেন। রাজা আমেনোফিস আগন্তুকদের সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধ হন। কেবলমাত্র সামরিক সাহায্য দিয়ে ক্ষান্ত না হয়ে, রাজা নিজের ধর্মমত পর্যন্ত বদলে একেশ্বরবাদী হয়ে গেলেন।

রোমানরা দেশ জয় করে দুহাজার বছর আগে ইহুদিদের ওপর প্রচণ্ড অত্যাচার করে। প্রায় শতাধিক বছর পরে কালিগুলার রাজত্বে আবার ভীষণ অত্যাচার হয়।

অনেক ভাগ্য বিপর্যয়ের পর ইহুদিরা শান্তিতে বাস করতে পায় যখন ১৫১৮ খ্রিস্টাব্দে অটোমান তুর্কিরা রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হল। অটোমানদের অবনতির সঙ্গে সঙ্গে ইহুদিদের অবস্থা আবার খারাপ হয় কিন্তু তারা সর্বত্র অর্থকরী বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করে। আজও যে কোনও অবস্থার লোকই হোক না কেন, ইহুদি সহজেই ভাগ্যোন্নতি করে এবং অর্থবান হয়। সবাই এই জন্য অন্যায়ভাবে এদের প্রতি ঈর্ষা করে। সবার ধারণা, ইহুদি মাত্রেই কৃপণ এবং স্বার্থপর। এটা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে ইহুদিদের মধ্যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষী অনেক জন্মেছেন। সাহিত্য, কলা, বিজ্ঞান ও সঙ্গীতে এঁদের বিরাট অবদান আছে।

আমি পরে অনেক ইহুদিদের বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়েছি এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো বাস করেছি। তারা আমাকে ভাষা শিখিয়েছে, খাইয়েছে, সাদরে পরিবারের সবার মধ্যে আপনার করে নিয়েছে। এজন্য আমি কৃতজ্ঞ।

কামাল পাশার হুকুমে একদিনে সমস্ত তুর্কি মেয়েরা বোরখা বর্জন করে সাধারণভাবে বাঁচবার ও পুরুষের সমতুল্য কাজের অধিকারী হল! মুসলমান জগতে এর চেয়ে বড় বিপ্লব হয়েছে বলে জানি না।

পরদিন সকালে মণীন্দ্র একটা খুব সুখবর দিল। বড় বড় গাছের ওপর দিয়ে বিস্তৃত জালের মতো বিছিয়ে ছিল আঙুরের লতাগাছ। অজস্র পাকা আঙুর (ছোট সাইজের) ভর্তি ছিল গাছে। এই আঙুর থেকে কিসমিস হয়। সম্পূর্ণ বুনো কিন্তু মিষ্টি ফল আমরা পাড়তে ও খেতে আরম্ভ করলাম। আঙুর দিয়ে পেট ভরালাম, আরও অনেক সঙ্গে নিয়ে চলতে লাগলাম।

যেখানে উতরাই সেখানে সাইকেলে চড়ে মাইলের পর মাইল পার হয়েছি। তারপর হেঁটে, সাইকেল টানতে টানতে ও শরীরের ওপর বোঝা বইতে বইতে কত মাইল চড়াই উঠেছি তার ইয়ত্তা নেই।

দুদিন পর জঙ্গলের মধ্যে আনন্দ আরেকটি জিনিস আবিষ্কার করল। গাছভরা আখরোট। এবং অনতিবিলম্বে আমরা পাকা এপ্রিকট গাছভর্তি পেলাম। হাতে সামান্য টাকা সম্বল, সেটা খরচ না করে ঠিক করলাম যে ফল খেয়েই যতদিন পারি চলব। আদানা তিনশো মাইল দূরে, পৌঁছতে অনেকদিন লাগবে।

সেই নির্বান্ধব স্থানে যেখানে জঙ্গল ও পাহাড়ের মধ্যে কোনও লোক দেখিনি, সেখানে একদিন ঘোড়ায় টানা একটা মালগাড়ি দেখলাম। এই গাড়িতে পোস্ট অর্থাৎ চিঠিপত্র বহন করা হয় বলে চালকের ডানদিকে একটা তুর্কির পতাকা উড়ছিল। মালের মধ্যে ছিল গম ও চিনি ইত্যাদি, আলেকজান্দ্রেটা থেকে আদানা নিয়ে যাচ্ছে।

কয়েকটি এইরকম মালটানা পোস্টাল ঘোড়ার গাড়ি দেখলাম। শরৎকাল, পাহাড়ি জায়গায় ঠান্ডা জলের কোনও অভাব ছিল না। প্রচুর ঝরনা দেখেছি এবং উৎকৃষ্ট জল খেয়েছি এবং স্নান করেছি। মরুভূমিতে স্নান শিকেয় উঠে গিয়েছিল। ফলে গায়ে পোকা হয়েছিল, এখনও তাদের আমরা দেহেই বহন করে চলেছি।

পাহাড়টা মনোরম কিন্তু লোকজনের দেখা নেই। কত উপত্যকা পার হলাম, চড়াই ও উতরাই সারাদিন ধরে যাচ্ছি। মাঝে-মাঝে দুয়েকটা গ্রাম দেখেছি। নাগাজাতির লোকেরা যেমন পাহাড়ের চূড়ায় বাড়ি করে যাতে শত্রু কোনদিক থেকে আসছে তা ওপর থেকে দেখতে পারে, এও ঠিক তেমনই। তিনশো মাইলের বেশিরভাগ এবড়োখেবড়ো পাহাড়ি রাস্তা অতিকষ্টে পার হলাম।

আদানা বেশ বড় শহর, নদীর ওপর সার সার পাকা বাড়ি। ব্রিজ পার হয়ে শহরে ঢুকবার মুখে একজন সৈনিক আমাদের থামাল। ইন্টারনাল পারমিট দেখাতে পারলাম না বলে আমাদের পুলিশ হেড কোয়ার্টারে নিয়ে গেল। অফিসার-ইন-চার্জ তখন ছিল না। তাঁর অধীনস্থ একজন পুলিশ অফিসার বলল যে তার ওপরওয়ালা না আসা পর্যন্ত আমাদের হাজতে বাস করতে হবে। ব্যস, লোহার দরজা দিয়ে আমাদের আটকে রাখল। সারাদিন খাটুনির পর কোথায় থাকব এবং কী খাবার জোগাড় করতে পারব না ভেবে চুপচাপ খাঁচায় বসে রইলাম। শহরের বহু লোক আমাদের পিছন পিছন আসছিল। তারা ভিড় করে সামনে দাঁড়িয়ে রইল। ক্রমে তাদের সংখ্যা বাড়তে লাগল। এদিকে খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছিল। অফিসার বিকালে অফিসে এলেন। আমাদের দেশের পুলিশের মতো নিয়মিত হাজিরা বোধহয় দিতে হয় না।

প্রথম প্রশ্ন, আমরা গ্রিক কি না। দ্বিতীয় প্রশ্ন, পারমিট কোথায়, পাসপোর্ট কোথায় আমরা কোনও মতে বোঝালাম যে ডের তিয়ল সীমান্ত ঘাঁটিতে আমরা পাসপোর্ট দিয়েছি। আদানায় পারমিট দেওয়া হবে শুনেছি।

ওরা বলল, আগামীকাল সিকিউরিটি অফিসে গিয়ে খোঁজ করতে হবে কে আমাদের পারমিট দেবে এবং কে পাসপোর্টগুলি ফেরৎ দেবে।

দেখতে দেখতে অন্ধকার হয়ে এল। হাজতে রাত্রিবাস করতে হবে হুকুম এল। খাবার জোগাড় করবার জন্য একজন পুলিশ সঙ্গে নিয়ে শহরে খাবার কিনতে গেলাম। হাতরুটি ও কিমার তরকারি নিয়ে ফিরলাম, মনে মনে খুবই বিরক্তি। আমাদের কোনও অপরাধ না থাকা সত্ত্বেও আসামীদের মতো হাজতে বাস করতে হল। যা হোক ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। অফিসার তাঁর কর্তব্য করছেন। আমাদের প্রতি অভদ্রতা বা খারাপ ব্যবহার করেননি।

পরদিন আমাদের চারজনের সঙ্গে ছয়জন পুলিশ দিয়ে— কী ভাগ্যি হাতকড়া কিংবা দড়ি বেঁধে নিয়ে যায়নি— সিকিউরিটি অফিসে পাঠাল। বেলা এগারোটার সময় আমরা খুঁজে পেলাম আমাদের পাসপোর্ট ও পারমিট। ক্যামেরা ফেরৎ পেলাম, কিন্তু বন্দুক নয়। সেগুলি পাব ইউরোপে, এড্রিয়ানোপল শহরে।

পারমিট পাবার পর হাজতবাস বন্ধ হল। সর্বত্র লোকেরা ভদ্র ব্যবহার করত। এই অঞ্চলে ফলের প্রাচুর্য বেশ, সেজন্য লোকেরা আমাদের এপ্রিকট ও আখরোট খেতে দিত।

আদানায় একদিন থেকে আমরা পশ্চিম-উত্তরদিকের রাস্তা ধরলাম। রাস্তার ওপর বড় বড় পাথর সর্বত্র। খুব সাবধানে চলতাম, পাছে পাথরের গায়ে ধাক্কা লেগে সাইকেল চুরমার হয়।

দেশের লোকের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো দেখলাম না। কামাল পাশা গ্রিকদের যুদ্ধে হারিয়ে তুর্কির স্বাধীনতা বজায় রাখতে পেরেছেন এবং সেইসঙ্গে আর্মির লোকেদের নানারকম রসদভরা জাহাজ ধরতে পেরে তুর্কির লোকেদের অশেষ উপকার করেছেন। যত ভালো ইউনিফর্ম পরা লোক দেখলাম তারা গ্রিকদের কাপড়চোপড় পরে রয়েছে। তুর্কির ইউনিফর্ম বেশিরভাগ শতচ্ছিন্ন এবং তাপ্পি দেওয়া ও পুরনো।

টরাস রেঞ্জ পার হলেও তুর্কির বেশিরভাগ পাহাড় আমাদের পথ যেন রোধ করে দাঁড়িয়েছিল। আনাতোলিয়া পাহাড়ি দেশ। অনেকগুলির বর্ধিষ্ণু গ্রাম দেখলাম, কিন্তু এখন খালি পড়ে রয়েছে। কিছুদিন আগে এখানে আর্মেনিয়ান, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের ওপর হামলা করে সব বাড়িতে তুর্কিরা আগুন লাগিয়ে দেয়। সব লোক প্রাণের দায়ে এ দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। বাড়িগুলো ও আসবাবপত্র দেখে মনে হল অল্পদিন আগে পুড়েছে— নাড়াচাড়া করলে তখনই আগুন ও ধোঁয়া বেরোবে। গ্রিস যখন তুর্কি আক্রমণ করে কয়েক বছর আগে তখন দেশের অভ্যন্তরে লোকেরা খ্রিস্টান বসবাসকারীদের ওপর অনর্থক অত্যাচার করে। ইহুদিরা খ্রিস্টানপাড়ায় মিলেমিশে থাকত। তাদের ওপরও তাল গিয়ে পড়ল অকারণে।

একদিন সকালে আমরা একটা ছোট্ট গ্রামে পৌঁছেছি। সবসময় আমাদের ঘিরে লোকেরা হাঁ করে দেখত এবং নানারকম জল্পনাকল্পনা করত। আমি তুর্কিদের কথা স্পষ্ট না হলেও খানিকটা বুঝতে পারতাম। একটা কালো মেয়ে, বড় বড় চোখ, ফ্রক পরা বারো বছর বয়স হবে, কী যেন বলতে চাইছিল আমাদের। বুঝলাম, আমাদের বলছে, তার বাড়িতে যাবার জন্য। কেমন করে জানি না, মেয়েটি আমাদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা শুনে চিনেছিল আমরা ভারতীয় এবং বাঙালি। বাড়ি যেতে খুব খুশির ভাব দেখিয়ে বলল, যে তার বাব। বাঙালি। প্রথম মহাযুদ্ধে তুর্কির হয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। নাম বিনয় বোস। বীরত্ব দেখিয়েছিলেন বলে সবাই তাঁকে খুব শ্রদ্ধা করত। একজন তুর্কি রমণীকে বিয়ে করে সংসার পেতেছিলেন। একটি কন্যারত্ন হয়। স্ত্রীকে বাংলা শিখিয়েছিলেন এবং শাড়ি কিনে দিয়েছিলেন। সম্প্রতি মারা গিয়েছেন। মিসেস বোস বুদ্ধিমতী রমণী। আদানার একটা কাগজে আমাদের ছবি ও ভ্রমণবৃত্তান্ত পড়ে মেয়েকে (নাম রীনা) বলেছিলেন যে আমার বাড়ির কাছ দিয়েই পশ্চিমে যাবে। যদি সম্ভব হয় আমাদের ধরে বাড়িতে নিয়ে আসতে।

মিসেস বোসের ছোট্ট কাঠের বাড়ি, তিনখানা ঘর। সামান্য আসবাব দিয়ে সাজানো। বসবার ঘরে মিস্টার বোসের আর্মি ইউনিফর্ম পরা একটা ছবি। গৃহিণী সলজ্জভাবে আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন তাঁর আতিথ্য স্বীকার করতে অন্তত একদিনের জন্য। আর্মি পেনসনের ওপর নির্ভর করে এবং তাতে নিজের শিক্ষকতা করার সামান্য আয় যোগ দিয়ে কোনওমতে সংসার চলে। অনুরোধ এড়াতে না পেরে রাজি হলাম যে বিকালে রওনা হব। মিসেস বোস পরিষ্কার বাংলায় বললেন, অনেক ধন্যবাদ।

আমরা প্রথমটা বাংলা শুনে চমকে উঠেছিলাম। উচ্চারণ ও অর্থ পরিষ্কার। দেখলাম বাংলা যা শিখেছিলেন তা ভুলতে বসেছেন ব্যবহার নেই বলে। মেয়েকে শেখাবার ইচ্ছা খুব কিন্তু দুঃখের বিষয় কোনও বই পাওয়া যায় না। মনে মনে ভাবলাম বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ ও ‘দ্বিতীয় ভাগ’ কোথায় পাব এখানে।

দুপুরে পোলাও ও মাংস এবং শেউই ও দুধ দিয়ে পায়েস খুব তৃপ্তি করে খেলাম। মাংসের কোর্মা, ভারতীয় ধরনে রাঁধা। মিঃ বোস ভোজনবিলাসী ছিলেন। দু-চাররকম প্রায়ই রাঁধতেন। যুদ্ধে একটা মোক্ষম চোট খেয়েছিলাম আর সেজন্য তুর্কিদের কাছে খুব বাহবাও পেয়েছিলেন। একটা স্ন্যাপনেল শরীরের মধ্যে ঢুকেছিল। বহু বছর পরে সেটাই মৃত্যুর কারণ হয়। রীনাকে আমাদের একটা পোস্টকার্ডের ছবি দিয়ে, মিসেস বোসকে ধন্যবাদ জানিয়ে রওনা হলাম।

ক্রমে ক্রমে আনাতোলিয়ার শস্যশ্যামল দিকে আমরা এগোতে শুরু করলাম। এদিকে আগে যেসব ফলের কথা লিখেছি তা তো পেতামই, তার ওপর অপর্যাপ্ত তরমুজ পেয়েছি বেশ বড় কুমড়োর মাপের। খেতে খুব সুস্বাদু এবং সস্তা, দু-চার আনা, দিলেই পাওয়া যেত।

এই অঞ্চলের রাস্তা বিশেষ ভালো নয়। মনে হয় অর্থাভাবে কেউ কখনও রাস্তার বড় বড় পাথর সরায় না বা গর্ত বোজায় না। অনেক লোকের বাস আনাতোলিয়াতে। একটু পর পর বর্ধিষ্ণু গ্রাম পেতাম। আগেকার মতো তেমন জনবিরল নয়।

একদিন একটা মজার কাণ্ড হল। আমরা একটা পান্থনিবাসে উঠেছি। কাঠের দোতলা বাড়ি। ঘর বলতে কিছু নেই, কেবল ওপরে একটা বড় খোলা জায়গা। কাঠের মেঝে। আমরা পরিষ্কার করে কম্বল বিছিয়ে সব গুছিয়ে ফেলেছি রাত কাটাবার মতলবে; এমন সময় একজন জার্মান যুবক, নাম হেরম্যান কোলব আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এল। পথে শুনেছে যে একদল ভারতীয় পর্যটক পান্থশালায় উঠেছে। কখনও ভারতীয় কাউকে দেখেনি, তাই আমাদের সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছা। কম্বলে বসতে দিলাম।

মহা মুশকিল হল। হেরম্যান ইংরিজি জানত না। আমি জার্মান জানতাম না তখনও। অবশেষে তুর্কি ভাষায় আমাদের দুজনের কথাবার্তা আরম্ভ হল। হেরম্যানের হাতে এক ঠোঙা আঙুর ছিল। আমাদের দিকে বাড়িয়ে ধরল। বুঝলাম আঙুর ওর ভীষণ প্রিয়। সেই রাত্রে শোবার আগে দুটো আঙুর মাথার কাছে নিয়ে রাখল। আমি জিজ্ঞেস করাতে ঠাট্টা করে বলল, সোংরা ঢোক গুজাল ওলসুং অর্থাৎ রাত্রে এই দুটো অনেক বাচ্চা দেবে!

রুটির সঙ্গে খাবার জন্য মুসুর ডাল ও আলু পেঁয়াজের তরকারি মণীন্দ্র রেঁধেছিল। হেরম্যানকে সামনে রেখে খাওয়া যাবে না বলে তাকেও আমাদের খাবারের ভাগ নিতে বললাম। বাঙালি রান্না খেয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিল হেরম্যান।

হেরম্যান আমাদের মতো নেটিভ ধরনে মাটিতে না শুয়ে দড়ির হ্যামক টাঙিয়ে তিন ফুট উঁচুতে ঝুলে ঘুমল

রাত তখন তিনটে হবে, বজ্রপাতের শব্দ হল কাঠের তক্তার মেঝের ওপর। তাড়াতাড়িউঠে পড়লাম আমরা। বাতি জ্বেলে দেখি হ্যামক ছিঁড়েছে। আসলে ইঁদুর দড়ি কেটে দিয়েছিল, ফলে হেরম্যান ধরাশায়ী। শরীরে বেশ লেগেছিল। আওয়াজে মনে হল যেন সব হাড়গোড় ভেঙে গিয়েছে। ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন অবস্থায় হঠাৎ আছাড় খেলে মানুষ যেমন হতভম্ব হয়, হেরম্যানের তেমনই অবস্থা। আমাদের কিন্তু তখন ভীষণ হাসি পেয়েছিল। কোনওমতে হাসি চেপে তাকে ওঠালাম। পড়ার কারণ কী জানবার জন্য হ্যামকটা নিয়ে দেখি কে একদিকের দড়ি কেটে দিয়েছে। নিশ্চয় ইঁদুর ভেবে হেরম্যান আর হ্যামক টাঙাল না। সুড়সুড় করে মেঝেয় পাতা আমার কম্বলের একপাশে এসে শুল। আমরা মুখে সহানুভূতি জানালাম, সে নিজের হাত-পা যখন টিপতে আরম্ভ করল। বেশি ভাব থাকলে হয়তো আমরাই টিপে দিতাম। ওর মেদহীন দেহ। তখনও ইউরোপীয় ও ভারতীয়দের আচারগত পার্থক্যের কথা ভেবে আমরা একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলছিলাম। একবারও ভাবিনি যে অনতিবিলম্বে হেরম্যান আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে যাবে ঘটনাচক্রে। রীতিমতো ভাব হয়ে গেল তার সঙ্গে।

পরদিন ভোরবেলায় হেরম্যান যাত্রা শুরু করল। পায়ে হেঁটে সমস্ত আনাতোলিয়া (যেটা তুর্কির মেরুদণ্ড) ভ্রমণ করে কনস্তান্তিনোপলে ফিরে যাচ্ছ।

আমরা একটু পরে প্রাতরাশ সেরে কম্বল ও লোটা গুটিয়ে দেখি রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ, একে পাহাড় তার ওপর সারাটা রাস্তায় পাথর ও নুড়িভর্তি। দুঘণ্টা পরে বেরিয়োম। সাইকেল জোরে চালিয়ে অনেক দূর চলে যাব ভেবেছিলাম কিন্তু তা আর হল না। একটু সাইকেল চড়ি তো অনেক হাঁটতে হচ্ছিল। সারাদিন প্রাণপণ খেটে পনেরো মাইল দূরে একটা পান্থশালায় আশ্রয় নিলাম। পরের পান্থশালা পনেরো- ষোল মাইল দূরে। সেখানে পরদিন যাওয়া ঠিক করে পান্থশালার ভেতর ঢুকলাম। প্রথমেই দেখি হেরম্যান দাঁড়িয়ে সামনে, খুব হাসছে। আমাদের সেই কচ্ছপ ও খরগোশের কথা মনে হল। দিনের শেষে আমাদের দুজনের ফল লাভ হয় একই।

হেরম্যানের স্ফূর্তির প্রধান কারণ ছিল আবার ইন্ডিয়ান কারি খাবার লোভ। মণীন্দ্রর রান্না তার দারুণ ভালো লেগেছিল।

হেরম্যানের ঘরে আমরা আস্তানা নিলাম। একটিমাত্র পরিষ্কার ঘর ছিল। গ্রামটি ছোট হলেও রাস্তার দুপাশে তরমুজের স্তূপ রয়েছে দেখলাম। হেরম্যান যথারীতি আঙুর কিনেছে। সন্ধ্যার সময় চায়ের বদলে তরমুজ খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করলাম।

হঠাৎ লক্ষ করলাম যে হেরম্যান একমুঠো মুসুর ডাল নিয়ে মাটির ওপর ছক কেটে কি একটা বাঘবন্দি খেলছিল, এত তন্ময় হয়ে যে আমাদের আসা টের পায়নি। পরে বুঝেছিলাম যে ওটা মানুষবন্দি খেলা। জার্মানরা জানতাম সৈনিক সৈনিক খেলতে ভালোবাসে। ইংরিজিতে এইরকম একটা কথাও আছে। আবার যদি যুদ্ধ হয় তো আনাতোলিয়া রক্ষা করতে কত কামান, ট্যাঙ্ক ও মানুষ লাগবে হেরম্যান সেই খেলা মুসুর ডাল সাজিয়ে খেলছিল।

পরে একদিন আমাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে সে বলেছিল জার্মানি কোনও মতে ইংল্যান্ডের চেয়ে কম নয়, অথচ আজ পৃথিবীর সব জায়গায় ব্রিটিশ পতাকাকে সেলাম করে জার্মান জাহাজ চলাফেরা করে। যেমন জিব্রাল্টার, মাল্টা, পোর্ট সৈয়দ, এডেন, সিঙ্গাপুর, হংকং, সাংহাই আর ওদিকে কেপহর্ন তো আছেই। হেরম্যানের দুঃখ বুঝলাম এবং আমরা পরাধীন জাতি— ইংরেজের অধীনে আছি বলে, সহজেই তাকে সহানুভূতি দেখাতে পারলাম। হেরম্যান ভারতবর্ষ সম্বন্ধে উঁচু ধারণা পোষণ করত এবং আমাদের পুরনো সভ্যতা ও কৃষ্টির প্রতি সম্মান জানাত।

দুদিন পরপর দেখলাম যে আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করে যতদূর এগোতে পারছি, হেরম্যান ঠিক ততখানিই পায়ে হেঁটে এগোচ্ছে। খারাপ রাস্তার জন্য সাইকেল আমাদের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

অগত্যা স্থির হল দিনের শেষে আমরা কোনও এক নির্দিষ্ট পান্থশালায় সবাই মিলব।

কয়েকদিনের মধ্যে আমরা বুঝতে পারলাম যে হেরম্যানের টাকাকড়ি সব ফুরিয়ে গিয়েছে। আমাদের ওপর নির্ভর করে সে চলছিল। সারাদিন কিছু খেত না একটু চিজ ও রুটি ছাড়া, তাও কয়েকদিনের, কি সপ্তাহের পুরনো। যখন সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে গেল তখন আমাদের সাহায্য চাইল একসঙ্গে থাকার ও খাবার। পান্থশালায়ও দু-চার টাকা ঘরভাড়া দিতে হল। আমরা রাজি হলাম এই শর্তে যে সে কনস্তান্তিনোপলে গিয়ে সব ঋণ শোধ করে দেবে, কারণ আমাদের সম্বল ছিল কয়েকটা টাকা। তবে আমরা আশা করেছিলাম কনস্তান্তিনোপল শহরে পৌঁছলে দেশ থেকে কমিটির পাঠানো টাকা ও চিঠি পাব। হেরম্যান বলল যে তার দেশবাসীর একজন টাকা ধার নিয়েছে, দেবার নাম নেই। সে এম্ব্যাসিতে কাজ করে সেজন্য টাকা মার যাবে না, আপাতত তাকে কষ্টভোগ করতে হচ্ছে।

পথে আদা, বে-বাজার হয়ে আঙ্কারার কাছে পৌঁছলাম। কামাল পাশা নির্দেশ দিয়েছেন আঙ্কারায় নতুন রাজধানী করতে। কনস্তান্তিনোপল ইউরোপের ভীষণ কাছে এবং জলপথে যে কোনও বড় শক্তির পক্ষে তাকে হস্তগত করা সহজ। আঙ্কারা চারদিকে পাহাড়ে সুরক্ষিত। আমরা যখন নতুন রাজধানীতে পৌঁছলাম, শহর বলতে তখন দুয়েকটা বাড়ি। চারদিকে পাথর ও মাটির পাহাড়। রাস্তা ছিল না। ইলেক্ট্রিক আলো নেই। একটা ফুড স্টোর তৈরি হয়েছে। হ্যাজাকের আলোয় দেখলাম সেখানে গম, আটা, চিনি, তেল ইত্যাদি পাওয়া যায়।

তারপর সমস্ত আনাতোলিয়া পার হয়ে আমরা কনস্তান্তিনোপলের সোজা পথ ধরতেই সৈনিকরা বাধা দিল— বলল, অন্যপথে ওই শহরে যেতে, যেহেতু একটা নৌবাহিনীর ঘাঁটি সেখানে তৈরি হচ্ছিল।

ইতিহাসে চার্চিলের নাম অমর হয়ে থাকবে, কিন্তু দুটি অপকর্মের জন্য, তুর্কি ও রাশিয়া তাকে কখনও ক্ষমা করবে না:

১) মুস্তাফা কামাল পাশাকে হত্যা করে তুর্কিতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তার করার মতলবে একজন তুর্কিবাসী ভারতীয়কে— নাম মুস্তাফা জিগির, ষড়যন্ত্রে লিপ্ত করা হয়। সৌভাগ্যক্রমে সে ধরা পড়ে এবং তার ফাঁসি হয় তুর্কি পার্লামেন্ট ভবনের সামনে। এই কারণে এদেশের লোকেরা ভারতীয়দের ওপর খাপ্পা, ইংরেজদের ওপরও রাগ কম নয়। তুর্কির শাসনকর্তারা আমাদের প্রতি যতই দুর্ব্যবহার করেছিল তার কারণ একমাত্র এই। আর চার্চিলই দায়ী এজন্য।

২) ১৯১৭ সালে রাশিয়াতে যখন রেভোলিউশন আরম্ভ হয়েছে চারদিকে তখন অরাজকতা। এই সুযোগে চার্চিল উত্তর রাশিয়ার মারমানস্ক জলপথে নেভি ও আর্মি পাঠায়। তারা সুবিধা করতে পারেনি। চার্চিল রাশিয়ার মতো বিরাট অজগরকে গ্রাস করতে চেয়েছিল। বিফলমনোরথ হয়ে ব্রিটিশ নেভি ফিরে যায়। ইংরেজরা এই ঘটনাটাকে ধামাচাপা দেয়। চার্চিল একদিন এই ঘটনা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল।

অন্য রাস্তায় অনেক ঘুরে সী অব মারমারা হয়ে জাহাজে যেতে হবে। জাহাজে উঠলাম। আমাদের সামান্য পুঁজির অনেকটা হেরম্যানের পিছনে খরচ হয়েছিল। জাহাজ ভাড়া দেড় টাকা মাথাপিছু দেবার সঙ্গতি ছিল না। জাহাজে ক্যাপ্টেনের কাছে হেরম্যান বলল যে কনস্তান্তিনোপল পৌঁছে সে টাকা পাবে এবং ভাড়া দিতে পারবে। ক্যাপ্টেন জার্মানির হয়ে লড়েছিল বিগত মহাযুদ্ধে। তার জার্মানদের প্রতি একটা প্রীতি সম্পর্ক ছিল। হেরম্যানের কথায় সে রাজি হল।

কনস্তান্তিনোপল শহরটার একটু বর্ণনা দেওয়া ভালো। আসলে একটা জলপথের দুধারে দুটো বড় বড় শহর। একটার নাম স্তাম্বুল, অন্যটির নাম পেরা। বেশিরভাগ ইউরোপীয় থাকে পেরাতে। খুব সুন্দর শহর। কলকাতার পর এত বড় শহর আমরা পথে পাইনি। গোল্ডেন হর্ন নামে জলপথটা দুটো শহরের মাঝখানে। নীল জল, দূরে পাহাড়ের কোলে যেন মিলিয়ে গেছে। পেরা ও স্তাম্বুলের মাঝখানে একটা সেতু।

আমাদের জাহাজ পৌঁছল স্তাম্বুলে, তখন সব যাত্রীরা নেমে গেল। হেরম্যানও গেল। আমরা জিম্মায় থাকলাম ভাড়ার জন্য। সবে সন্ধ্যা হয়েছে দূর শহরের লক্ষ বাতির ছায়া জলে পড়েছে। মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। একটু পরে জাহাজের মাঝিমাল্লা, ক্যাপ্টেন সবাই নেমে গেল। জাহাজ থেকে নামা-ওঠার কাঠের সিঁড়িও নিচের বন্দরে রাখল। জাহাজটা খুব মোটা একটা লোহার শেকল দিয়ে বাঁধা। জাহাজে দু-তিনজন লোক ফিরে এল।

বিকাল ও সন্ধ্যা থেকে হেরম্যানের অপেক্ষায় আমরা বসে আছি। জার্মান যুবকের দেখা নেই, ওদিকে খিদেয় প্রায় অস্থির। তিনঘণ্টা পরে অতিষ্ঠ হয়ে পায়চারি করছি, এমন সময় পাগলামি বুদ্ধি এল, আমি শহরে গিয়ে হেরম্যানকে খুঁজে নিয়ে আসব।

লোহার শেকল ধরে বন্দরে নামলাম তারপর উঁচু পাঁচিল টপকে বন্দরের সামনের চত্বরে পৌঁছলাম। কতরকম খাবার বিক্রি হচ্ছিল এবং লোকেরা কিনে খাচ্ছিল। লোভীর মতো রান্না চিংড়ি মাছ, কাঁকড়া ইত্যাদি সাজানো হয়েছে আড়চোখে দেখলাম।

বন্দর থেকে বেরিয়েই সেতুর ওপর পৌঁছলাম। আমি স্তাম্বুলের দিকে সেতুতে আছি। আমাকে যেতে হবে ইউরোপীয় পাড়ায়, পেরাতে। দুঃখের বিষয়, নতুন সেতুতে তখনও মানুষের মাথাপিছু এক পয়সা কর আদায় করছিল। আমি তো প্রমাদ গুনলাম। পকেটে এক পয়সাও ছিল না।

সামনে একটা ঘোড়াটানা মালগাড়ি আসছিল আমি তার পিছনদিকে উঠে লুকিয়ে বসলাম। পেরাতে পৌঁছে নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। বিরাট শহরের মধ্য থেকে হেরম্যানকে খুঁজে বের করব, কিছুই জানি না। জার্মান এম্ব্যাসিতে প্ৰথমে গেলাম। অত রাতেও ভদ্রতা করে খবর দিল যে হেরম্যান কোলব সন্ধ্যায় এসেছিল এবং এক বন্ধুর খোঁজে ঘুরছে, বোধহয় যে পাড়ায় রেস্তোরাঁগুলি আছে সেখানে তাকে পাব। ঘুরতে ঘুরতে প্রায় রাত দশটার সময় একটা ফুটপাথের ধারে একটা আয়নায় হঠাৎ দেখলাম এক টেবিল খাবার ও টেবিলের দুপাশে দুজন ইউরোপীয় বসে আছে, তার মধ্যে একজন হেরম্যান। আমার ভীষণ রাগ হল যে হেরম্যান আমাদের কথা ভুলে গেছে এবং নিজে ভূরিভোজ করছে। রেস্তোরাঁর ভেতর ঢুকলাম এবং সোজা হেরম্যানের সামনে উপস্থিত হলাম। ও আমাকে দেখে খুব আশ্চর্য হয়ে গেল। এবং আমি ওর শুকনো বুভুক্ষু মুখ দেখে বুঝলাম যে সামনের ভোজনরত লোকটি আসলে ওকে বসিয়ে রেখেছে টাকা ফেরৎ দেবে এই আশ্বাস দিয়ে। যা হোক আমার উপস্থিতি হেরম্যানের কথার সত্যতা প্রমাণ দিল অন্য জার্মানির কাছে। শীঘ্র টাকা দেবার তাগাদা এবার হেরম্যান করলে বন্ধু নেশায় আচ্ছন্ন হলেও কথাটা ঠিক বুঝল এবং বেশ কিছু টাকা পকেট থেকে বের করে হেরম্যানকে দিল। আমরা দুজনে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে খাবার কিনতে বেরোলাম। রুটি, কাব এবং চিজ কিনে সেতুর ওপর দিয়ে (এবার কর দিয়ে) ইস্তাম্বুলে পৌঁছলাম। তখন রাত এগারোটা। বন্দরে পাঁচিল পার হয়ে আমরা দুজন শেকল বাঁধা জাহাজের সামনে উপস্থিত হলাম। অনন্যোপায় হয়ে সেই চেন ধরে ঝুলতে ঝুলতে কোনওমতে জাহাজে উঠলাম। বন্ধুরা আমার আশা ছেড়ে দিয়েছিল। অকাতরে ঘুমোচ্ছে তিনজন। অনেক কষ্টে ওদের তুলে আমরা পাঁচজনে মাঝরাতে জাহাজের ওপর খবরের কাগজ পেতে ফিস্ট শুরু করলাম। পেরাতে কোথায় যাব ঠিক করতে না পেরে এবং জাহাজ থেকে নামবার উপায় ছিল না বলে পরদিন সকালে ভাড়া মিটিয়ে আমরা কনস্তান্তিনোপলে অর্থাৎ ইস্তাম্বুলে উপস্থিত হলাম।

এবার হেরম্যান আমাদের কাছে বিদায় চাইল। সে খুবই আমুদে লোক ছিল, তাছাড়া আমাকে জার্মান শিখতে খুব সাহায্য করেছিল। সে গোড়াপত্তনটা এত ভালোভাবে করেছিল যে পঞ্চাশ বছর পরে আজও আমি সেই ভাষা ভুলিনি।

আমরা ওয়াই এম সি এ হস্টেলে উঠলাম এবং স্যার দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারীর চিঠি নিয়ে সকালেই ব্রিটিশ অ্যাম্বাস্যাডরের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি ভদ্রতা করে বিকালে চায়ের নেমন্তন্ন করলেন। একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে চা খেতে গেলাম। অ্যাম্বাসাডার ও তাঁর স্ত্রী গল্প শুনতে চাইলেন। ম্যাপ ইত্যাদি সামনেই রেখেছিলেন রুট বুঝবার জন্য। ভ্রমণকাহিনী শোনাতে আমার চা খাওয়া ও টা খাওয়া একরকম হলই না। মোটামুটি অ্যাম্বাস্যাডর খুশি হয়েই বললেন যে গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়াকে তিনি আমাদের পৌঁছনোর খবর দেবেন। আর পথে কাজে লাগতে পারে এমন লোকের কাছে কয়েকটা চিঠি দিলেন।

পরদিন এখানের বিশেষ দ্রষ্টব্য শান্ত শেফিয়া ও আয়া শেফিয়া মসজিদ দেখতে গেলাম। রাস্তার ধারে জেলখানা দেখলাম। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা নয়। অনেক মহিলা জেলখানা পরিষ্কার রাখতে ও বিছানা গুছিয়ে দিতে সাহায্য করছে। আমরা শুনলাম যে মহিলারা দুষ্কৃতকারীদের স্ত্রী। যার শাস্তি হবে জেলে যাওয়া, তার স্ত্রী সমস্ত খাবার জোগাড় দেবে এবং ইচ্ছা করলে কখনও কখনও রাত্রিবাসও করতে পারে। এ মন্দ ব্যবস্থা নয়। একজনের জেলবাস হুকুম হলে তার পরিবারের ওপর খাওয়া-পরার দায়িত্ব। দেশে টাকার অভাব সেজন্য বসে লোক খাওয়ানোর নিয়ম নেই। কেন যে কয়েদিদের অর্থকরী কাজে নিয়োগ করে টাকা রোজগারের পথ করে না, তা বুঝলাম না।

কনস্তান্তিনোপলের মতো সুন্দর জলের ধারে পাহাড়ের গায়ে শহর কম দেখা যায়। এককালে দ্বিতীয় রোমান রাজত্বে সম্রাট কনস্তানতাইন রোম থেকে সরে দূরে এই সুন্দর শহর স্থাপন করেন এবং বহুকাল এটাই রাজধানী ছিল। পরে রোম, গথ ও ভ্যান্ডালদের ঘন ঘন আক্রমণে বিব্রত হয়ে পড়েছিল। কনস্তান্তিনোপল শহরের দুটি বিশেষত্ব। প্রথমটি হচ্ছে এটি পাহাড়ের ওপর অবস্থিত এবং তার চারদিকেও পাহাড়। দ্বিতীয়ত, সঙ্কীর্ণ জলপথে নৌবাহিনী বিপদে শহর রক্ষা করতে পারে। এই শহর ইতিহাস প্রসিদ্ধ। প্রায় দুহাজার বছর পুরনো।

জেনারেল পোস্ট অফিসে পোস্ট রেস্তান্তে খোঁজ করলাম আমাদের নামে কোনও টাকা বা চিঠি আছে কিনা। যখন উত্তর এল না, তখন খুবই মর্মাহত হলাম। দেশের থেকে কতদূরে চলে এসেছি। কেউ আমাদের কোনও খোঁজখবর পর্যন্ত নেয় না। কমিটিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল টাকা পাঠাবে। কিন্তু কোথায়। ভ্রমণ সম্পূর্ণ হবে কিনা এই প্রথম আমাদের মনে সন্দেহের রেখাপাত ঘটল। বাড়ির চিঠি মা-বাবা এবং ভাইদের লেখা পেলাম। তাতে হতাশা অনেকটা কেটে গেল। বন্ধুদের বললাম যে ভিয়েনা কিংবা বার্লিন পৌঁছে নিশ্চয় কমিটির চিঠি ও টাকা পাব, কিন্তু সে তো বহুদূর। তাছাড়া সে পর্যন্ত পৌঁছতে পারব কিনা সন্দেহ। সামনে হাড়ভাঙা শীত, ঝড় ও বরফের দিন আসছে। শেষপর্যন্ত ঠিক হল এগোতেই হবে বার্লিন পর্যন্ত। কমিটিকে বিশেষ করে সেক্রেটারি শ্রীকুমারকৄষ্ণ মিত্র মহাশয়কে আমাদের দুর্দশার কথা জানালাম। বার্লিনে রসদ না পেলে শীতে গরম জামাকাপড়ের অভাবে এবং খেতে না পেয়ে মারা যাব। ওয়াই এম সি এ-র সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করলাম আর অনুরোধ করলাম একটা মিটিং ডাকবার যেখানে প্রবেশমূল্য দিয়ে আমার কাছে লোকে ভ্রমণকাহিনী শুনবে। তিনি রাজি হলেন এবং পরদিন খবরের কাগজে মিটিংয়ের কথা জানিয়ে মেম্বারদের আহ্বান করলেন।

এই প্রথম সাধারণের সামনে সরাসরি আমি বলবার নেমন্তন্ন পেলাম। মরুভূমির ভেতর দিয়ে চলার কথা এবং আমরা কোন পথে পৃথিবীর কত দেশে যাব সেসব বললাম। আর কী বলব ভাবছি এমন সময় একজন জিজ্ঞাসা করল কতদিন পরে আমাদের ভ্রমণ শেষ হবে। তার উত্তর দিয়ে, আমি বললাম যে আরও প্রশ্ন পেলে আমি খুশি হয়ে জবাব দেব। এমনিভাবে মিটিং জমে উঠল। আমরা সেদিন প্রায় দুশো টাকা রোজগার করলাম।

আমরা ইউরোপের একপ্রান্তে পৌঁছেছি। যুদ্ধে হারার পর তুর্কির রাজত্ব অনেক খর্ব হয়ে গিয়েছে। ইউরোপে কেবল নামমাত্র জমি তুর্কির অধীনে রয়েছে। সেখানে বড় শহর একমাত্র এড্রিয়ানোপল আছে। আমরা সেখানে আমাদের বন্দুক ফিরে পাব।

বিকালে সুলতানদের প্যালেস দেখতে গেলাম। নাম দোলমাবাগজি। এখানে মুস্তাফা কামাল পাশা থাকেন। যুদ্ধের সময় তুর্কির রাজা বা খলিফ ছিলেন দ্বিতীয় সুলতান আহমেদ, হেরে যাবার পর তিনি মাল্টায় থাকতে গেলেন। তাঁর মেয়ের বিয়ে হয়েছিল ভারতবর্ষের নিজামের বড় ছেলে প্রিন্স অব বেরারের সঙ্গে। খলিফ বলা হয় মুসলমান জগতের ধর্মগুরুকে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের একজোট করবার জন্য গান্ধীজি খিলাফৎ আন্দোলন শুরু করেছিলেন।

এরপর ইউরোপের পথ ধরলাম। রাস্তা এখনও ব্যবহারের উপযুক্ত নয়। লোকেদের বেশভূষা ইউরোপীয় হয়েছে পুরোপুরি। স্ত্রী-পুরুষ হ্যাট ব্যবহার করে। অবাধে মেলামেশা। চারদিন পরে আদ্রিয়ানোপলে পৌঁছলাম। ঘরবাড়ি দেখে মনে হয় একটু অন্য ছাঁচে তৈরি। শহরের নামটাও বিদেশি, রোমান মনে হয়

সীমান্তে এসে বন্দুক ফেরৎ পেলাম। আমাদের অন্নসংস্থান নেই অথচ প্রত্যেকে দুটো করে ভারি বন্দুক বইছি। সেগুলি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমস্ত ইউরোপে তারা কোনও কাজে লাগবে না বরং পদে পদে বাধা সৃষ্টি করবে, করছে বলে স্বীকার করাই শ্রেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *