দুচাকায় দুনিয়া – ১২

১২

এই সময় দলে দলে উত্তর ইউরোপের লোক ইতালি ও সিসিলি ভ্রমণে আসে, কোনও হোটেলে তাই ঠাঁই নেই। অগত্যা বড় এবং দামি হোটেল ভিলা ইজিয়াতে উঠলাম। আকাশের নিচে গ্রিক থিয়েটার দেখতে গেলাম। সমুদ্রের ধারেই, পাথর কেটে বসবার জায়গা তৈরি হয়েছে। তিন হাজার লোক বসতে পারে বৃত্তাকারে। স্টেজের সামনে জলের পরিখা যাতে দর্শক ক্ষেপে গিয়ে কিংবা ক্রুদ্ধ হয়ে অভিনেতা অভিনেত্রীদের আক্রমণ না করে। স্টেজে কোনও সীন থাকত বলে মনে হয় না। স্টেজের পিছনেই নীল সমুদ্রের জল দেখা যায়। এই থিয়েটারটি অনুমান দুহাজার বছর আগেকার।

গ্রিকরা এককালে আশপাশের দেশ জয় করে যে বৃহৎ সাম্রাজ্য স্থাপন করে, সিসিলি তার মধ্যে ছিল প্রথম ও প্রধান। এই দ্বীপটি বেশ বড়। চারদিক ঘুরে ভালো করে দেশটি দেখবার সুযোগ হয়েছিল।

দ্বিতীয় ডিয়নিসাসের সময় সিরাকুশের মধ্যে ভূগর্ভে খনি ছিল, নানা রকম পাথর কেটে ধাতু বার করা যেত। আমাদের হোটেলটা ছিল ওই রকম একটা খনির ওপরে। বিস্তীর্ণ বাগানে নানা রঙের ফুল গাছ। একদিন সকালে একটা বেঞ্চে বসে আমি বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করছি, এমন সময় আরেক ভদ্রলোক এসে বেঞ্চের অপর প্রান্তে বসলেন। হঠাৎ মনে হল ভদ্রলোকের মুখ যেন পরিচিত। কেমন করে তা সম্ভব, ভাবছি। আরেকবার মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে এবার নিশ্চিত হলাম। দাঁড়িয়ে উঠে অভিবাদন জানালাম, ইওর ম্যাজেস্টি বলে। ভদ্রলোক তখনই দাঁড়িয়ে উঠে আমার দিকে হাত বাড়ালেন করমর্দন করবার জন্য। ইনি স্পেনের রাজা, প্রথম অ্যালফানসো। পরিষ্কার ইংরিজি বলেন। ইংরেজ রাজ পরিবারের মেয়ে, খুব সম্ভব রানি ভিক্টোরিয়ার এক কন্যাকে বিয়ে করেন। বর্তমানে ইনি রাজ্যচ্যুত।

আমরা দুজনে বেঞ্চে বসে সারা সকাল গল্প করলাম। রাজা বললেন যে ইউরোপের মধ্যে সিসিলির বিশেষ স্থান আছে। সাতটি সাম্রাজ্যের উত্থান পতন হয়েছে এই দ্বীপে। গ্রিস থেকে আরম্ভ করে রোমান, গথ, ভ্যান্ডাল, স্প্যানিশ, ইতালিয়ানরা পালাক্রমে রাজত্ব করেছে এই দেশে। স্পেনের অধীনে এখানে খুব উন্নতি হয় এবং সর্বত্র বড় বড় বাড়ি, গির্জা তৈরি হয়।

আমাকে রাজা বললেন যে যদি আমি তাঁর সঙ্গে বেড়াতে যাই গাড়িতে, তাহলে শহরে যত স্প্যানিশ স্থাপত্যের বাড়ি আছে তা তিনি দেখাতে পারবেন। ঠিক হল পরদিন সকালে প্রাতরাশ খেয়ে রওনা হব। শহর থেকে দূরে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত মনরিয়ালে গির্জা ও ক্লয়স্টার দেখতে যাব। সিরাকুস শহরে এত স্প্যানিশ ধরনের বাড়ি, ক্যাসল আছে তা না দেখিয়ে দিলে আমি চিনতে পারতাম না। মনরিয়ালের কারুকার্য এবং স্থাপত্য দেখে আমি মুগ্ধ। স্পেনের লোকের তৈরি বলে মুরীশ স্থাপত্য স্পষ্ট চেনা যায়।

এটা অলিভ তেল ও ছোট কমলালেবুর দেশ। সমুদ্রের ধারে সুন্দর বাঁধানো রাস্তা আছে। তার মাঝখানে সার বাঁধা অলিভ গাছ। একটা জায়গায় রাজার গাড়ি থামল। আমরা নামলাম।

অ্যালফানসো বললেন, এইখান থেকে আর্কিমেডিস বুদ্ধি করে আয়নায় সূর্যের আলো ফেলে শত্রুর জাহাজের পালে আগুন লাগিয়ে দেন এবং গ্রিকরা জয়লাভ করে। আজকে আমরা একসঙ্গে ডিনার করব, তখন অনেক গল্প শুনো।

এখানে ট্যানজারিন কমলালেবু খুব মিষ্টি ও সুস্বাদু। রাজা এই দ্বীপে মাঝে মাঝে বেড়াতে আসেন এবং সমস্ত দেশটা তাঁর নখদর্পণে।

যীশুখ্রিস্টের জন্মের ৫০ বছর আগে রোমানদের বিশাল সাম্রাজ্য ছিল। পূর্বে তুর্কি ও এশিয়া মাইনর, পশ্চিমে ইংল্যান্ড পর্যন্ত সে রাজত্ব করেছে। দক্ষিণে আফ্রিকার মিশর দেশও তার করায়ত্ত ছিল।

সিরাকুস ছেড়ে এটনা আগ্নেয়গিরি দেখতে গেলাম। আগ্নেয়গিরি মাঝে মাঝে লাভা উদিগরণ করে। লাভা যেখানে পড়ে সেটা অনেক বছর পরে ঠান্ডা অবস্থায় আঙুর চাষের পক্ষে উর্বর জমিতে পরিণত হয়। সেজন্য আগ্নেয়গিরির ভয় থাকা সত্ত্বেও আগ্নেয়গিরির বিপদসীমার মধ্যে গিয়েও লোকেরা আঙুর চাষ করে। বিখ্যাত মার্শালা মদ এই অঞ্চলে হয়।

এটা মুসোলিনির রাজত্বকাল। সর্বত্র ভালো রাস্তা ও নিয়মানুবর্তিতা বজায় রাখার চেষ্টা হচ্ছে। এটনা প্রায় ৮,০০০ ফুট উঁচু। পাহাড়ের চূড়ায় বরফ। সেখানে স্কিইং ও স্কেটিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। দুয়েক হাজার ফুট নিচে বরফ নেই।

এটনা থেকে নেমে কাটানিয়া শহর এবং সেখান থেকে বড় রাস্তা চলে গেছে। এই সময় আমন্ডস বাদামের গাছে ফুল হয়। এ এক অদ্ভুত দৃশ্য। দুধারের গাছে ভর্তি গোলাপি রঙের ফুল, ফুলের কিছু পাপড়ি রাস্তার ওপর পড়েছে, ওপর নিচ ডাইনে বাঁয়ে ঘন গোলাপি রঙে অপূর্ব সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়েছে।

আগ্রিগেন্টো পৌঁছলাম। ভারি সুন্দর শহর। সমুদ্রের ওপর। রোমানরা এখানে একটা মুক্তাঙ্গন থিয়েটার তৈরি করেছিল। সেটা আজও রয়েছে, এখানেও পিছনে সমুদ্র। ইউরোপের কত লোক যে এই শহরটি দেখতে আসে তার ঠিক নেই।

রাজা আমাকে আরও দুটো জায়গা দেখতে বলেছিলেন, এন্না ও পালের্মো। সিসিলি পাহাড়ের দেশ। উঁচু নিচু রাস্তা দিয়ে এন্না পৌঁছলাম কয়েক হাজার ফুট ওপরে। এন্নার অন্য নাম কাস্ত্রো জিওভান্নি। শহরটা পাহাড়ের ওপর বলে মনে হয় সমস্ত দেশটা পায়ের নিচে। এখানের সবচেয়ে বড় দ্রষ্টব্য হল গির্জা। ২,০০০ বছর আগে গ্রিকরা একটা বিরাট মন্দির তৈরি করেছিল, উত্তরকালে খ্রিস্টানরা সেটি অল্প পরিবর্তন করে গির্জায় পরিণত করে।

এন্নাতে খুব কম ট্যুরিস্ট বেড়াতে আসে। প্রথম কথা এখানে পৌঁছনো কষ্টকর। ভালো রাস্তা নেই। বাস চলাচল করে না। তাছাড়া সমুদ্র উপকূলবর্তী সব শহর থেকে অনেক দূরে। তৃতীয় কারণ হচ্ছে এই যে এখানে সিসিলিয়ান ডাকাতদের জগৎজোড়া নাম। আজকালকার মাফিয়ারা যাদের বংশধর, তাদের আদি বাসস্থান হচ্ছে এন্নার কাছে দুরারোহ পাহাড়ের আশপাশে। কেউই সাধ করে এদের খপ্পরে পড়তে চায় না।

এন্না ছেড়ে উত্তর-পূর্বদিকে দ্বীপের রাজধানী পার্লেমো শহরে গেলাম। মস্ত বড় শহর। সমুদ্রের জলপথ বেশি দীর্ঘ নয়। দূরে মেশিনা শহর দেখা যায়। ছোট-বড় নানা জাতীয় জাহাজ স্ট্রেটের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করছে।

অনেক বছর আগে মেশিনা শহর ভূকম্পে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। তারপর শহর নতুন করে গড়ে উঠেছে। জলপথ পার হয়ে পরদিন ইতালি পৌঁছলাম।

নেপলসের পথ ধরলাম। এক সপ্তাহ লাগল ৫০০ মাইল পথ অতিক্রম করতে। রাস্তা খুব ভালো। দিনে ৬০-৭০ মাইল চলেছি। রাস্তার অবস্থা দেখে স্পষ্টই বোঝা গেল আমি উন্নত দেশে, ইউরোপে পৌঁছেছি।

নেপলস এক বিরাট শহর। বোধহয় ইতালির সবচেয়ে বড় শহর। পাহাড় সমুদ্র গাছপালা মিলে নেপলসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব। তাতে যোগ দিয়েছে ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি। সমুদ্রের জলের ধারেই পাহাড়ের ওপর আগুন ও ধোঁয়া লোককে চমৎকৃত করে। ইংরিজিতে কথায় বলে ‘মরবার আগে নেপলস দেখো’ কথাটার সত্যতা নিজের চোখেই দেখলাম। নেপলসের ন্যাশনাল মিউজিয়াম জগদ্বিখ্যাত। কত সুন্দর ভাস্কর্য দেখলাম তার তুলনা হয় না। গ্রিক যুগ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে, প্রাক্সিটেলিস ও মাইরোনের তৈরি মহামূল্য স্ত্রী ও পুরুষের মূর্তি দেখে মুগ্ধ হলাম। রোমান যুগের অনেক প্রস্তর মূর্তি রয়েছে। সেগুলিও কারুকার্যের দিক থেকে অমূল্য। দুদিন মিউজিয়ামেই কাটালাম। ইচ্ছা করছিল আরও দুদিন কাটিয়ে ভালো করে দেখি।

বড় বড় জাহাজ এখান থেকে আমেরিকা ও দূর দূর দেশে যাত্রা করে। ছোট একটা স্টিমারে উঠলাম স্বর্গপুরী, কাপ্রি দ্বীপ দেখবার উদ্দেশে। পথে সুন্দর সুন্দর গ্রামে স্টিমার থামল, যেমন আমালফি ও সোরেন্টো।

কাপ্রি একটা ছোট্ট দ্বীপ। বে অব নেপলসের ঘন নীল জলের ওপর কাপ্রি অপূর্ব সুন্দর দেখায়। পৃথিবীর সব জায়গা থেকে ট্যুরিস্ট আসে এই দ্বীপে। চারদিকে হোটেল ও রেস্তোরাঁর ছড়াছড়ি।

স্টিমার থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে অনেক ওপরে উঠতে হয় কাপ্রি শহরে পৌঁছবার জন্য। লিফটও আছে সাধারণের সুবিধার জন্য।

মাঝপথে একটা রেস্তোরাঁতে খেয়ে নিলাম ও অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করলাম। রেস্তোরাঁটি পাহাড়ের গায়ে এবং নিচের দিকে চাইলে দেখা যায় বন্দরে ছোট-বড় নৌকো নীল জলের ওপর ভাসছে।

কাপ্রি শহরটা কিন্তু এমন কিছু সুন্দর নয়।

কাপ্রি থেকে একটা ডিঙি বোট নিয়ে একটি গ্রটো দেখতে গেলাম। একটা অপরিসর ফাঁকের ভেতর দিয়ে বোটটা ঢুকল যেখানে জল মাটির নিচে অল্পদূর গিয়েছে। ভেতরে ঢুকলে দাঁড়াবার মতো উচ্চতা আছে। বোটে বসে জলের নিচে নীল রঙের খেলা দেখলাম। এজন্য এটিকে নীল গ্রটো বলা হয়।

কাপ্রিতে ফিরে সলফাটারা নামে একটি পুরনো গ্রামে গেলাম। এখানে দ্রষ্টব্য জিনিস হচ্ছে এক জায়গায় বালি গরম হয়ে ফুটছে, যেমন জল ফুটলে দেখা যায়। অনেকের মতে, এই বালির নিচে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি আছে।

নেপলসে ফিরে একদিন পরেই জীবন্ত মাছের মিউজিয়াম দেখতে গেলাম। কাচের বড় বড় চৌবাচ্চা সমুদ্রের লোনা জলে ভরা। এমনকী অক্টোপাসও রয়েছে। একটি ভারতীয় ছাত্রের সঙ্গে দেখা হল। সে মাছ ও মৎস্য জীবন সম্বন্ধে গবেষণা করছে। নাম মেহেতা, বোম্বাইয়ে বাড়ি।

সকালে উঠেই রওনা হলাম ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির ৩,০০০ ফুট চূড়ায় ওঠবার জন্য। চূড়া থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছিল। সেই ধোঁয়ার সঙ্গে গন্ধক মিশ্রিত ছিল, নিশ্বাস প্রশ্বাসের কষ্ট হয়। দুপুরবেলায় আগ্নেয়গিরির একেবারে ওপরে পৌঁছলাম, সেখান থেকে সামনেই গলিত পদার্থ ফুটন্ত অবস্থায় স্পষ্ট দেখা গেল। একটা ইতালীয় তামার পয়সাকে লাভা দিয়ে যখন মুড়ছি, হঠাৎ পায়ের নিচে জমিটা দুলে উঠল। সাবধান হয়ে দূরে নিরাপদ জায়গায় ছুটে পালালাম। কিন্তু ইতিমধ্যে একটা কাণ্ড ঘটে গেল। ভিসুভিয়াসের চূড়া ভীষণ শব্দ করে ওপরে কয়েক শত ফুট উঁচুতে উঠে গেল এবং যখন আমি দৌড়ে পালাচ্ছি তখন আমার চারপাশে ছোট এবং বিরাট বড় পাথরের চাঁই ছড়িয়ে পড়ল। কী ভাগ্যি যে আমি কোনও পাথরের আঘাত পাইনি।

সন্ধেবেলা চূড়া থেকে নিচে নেমে এলাম। লক্ষ বাড়ির আলো জ্বলে উঠেছে। গাঢ় নীল জলের ওপর আলোর প্রতিচ্ছবি চারদিক মনোরম করেছিল। নেপলস যে খুবই সুন্দর সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

আমার হোটেলের সামনেই বে অব নেপলসের জলপথ, ওপারেই ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি। প্রথমেই আমার নজরে পড়ল যে আগ্নেয়গিরির ত্রিকোণ সরু মুখটা, কালকের বিস্ফোরণের ফলে উঠে গিয়েছে এবং তার চেহারার পরিবর্তন ঘটেছে।

এটনায় চড়বার সময় যেমন দেখেছিলাম ভিসুভিয়াসেও তেমনই আগ্নেয়গিরি বিপজ্জনক জেনেও ইতালিয়ানরা পাহাড়ের গায়ে আঙুর চাষ করছে। বলা বাহুল্য যে এই আঙুরের মদের চাহিদা খুব বেশি।

পরদিন ভিসুভিয়াস পার হয়ে প্রথমেই পম্পেই শহর দেখতে গেলাম। এই শহরটি ২,০০০ বছর আগে ধ্বংস হয়ে যায়। আগ্নেয়গিরি থেকে উদ্‌ীর্ণ গরম ছাই এবং বিষাক্ত গ্যাস শহরের সব লোককে মেরে ফেলে। বহুকাল কেটে গেছে তারপর। প্রত্নতত্ত্ববিদরা পম্পেই শহর মাটি খুঁড়ে ছাই সরিয়ে তাকে আবিষ্কার করেছে। ছাই ঢাকা ছিল বলে ঘরবাড়ি জিনিসপত্র ভালোভাবেই রক্ষিত হয়েছিল। পুরো শহরটাই পুনরুদ্ধার হয়েছে। বড় বড় মন্দির, নাট্যশালা, সাধারণ লোকের বসতি, দোকান, রাস্তা ভালোভাবে দেখা যায়। দুহাজার বছর আগেকার দোকানে সাজানো পাউরুটি আজও যথাস্থানে রয়েছে, গরম ছাইয়ে পুড়ে গিয়েছে মাত্র।

মানুষ ও জন্তু দমবন্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল, যে যেমন অবস্থায় মারা গিয়েছে আজ তেমনই অবস্থায় মানুষ ও কুকুর ইত্যাদি দেখা যায়। সব পুড়ে মমি হয়ে গিয়েছে।

রাস্তার ওপর দিয়ে এক কালে চ্যারিয়ট যাতায়াত করত, সে জন্য মাটি ও পাথরের ওপর চাকার দাগ সুস্পষ্ট দেখা যায়। বাড়ির ছাদ থেকে জল নিকাশের জন্য সীসার পাইপ দেখলাম। জীবনধারা উন্নতমানের ছিল সন্দেহ নেই। একটা বড় বাড়ি অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় দেখলাম। এর নাম ভেট্টি ব্রাদার্সের বাড়ি। এটি মদ খাওয়া ও আমোদ-প্রমোদের জায়গা ছিল। পম্পেই শহরের ওপর মাথা খাড়া করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভিসুভিয়াস পাহাড় ও আগ্নেয়গিরি।

আরেকটি ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর এরকুলানিয়াম অনতিদূরে রয়েছে। সেটা আমার দেখা হবে না। ইতালিতে এত প্রত্নতত্ত্বের জিনিস আছে দেশ জুড়ে যে আমি এই ভ্রমণে দেখে শেষ করতে পারব না।

পম্পেই শহরের কাছেই একটি ভালো ব্যবসা গড়ে উঠেছে। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে শাঁখ এনে তার ওপর নরুন দিয়ে কেটে চিত্রবিচিত্র করা। যত লোক ধ্বংসাবশেষ দেখতে আসে তারা শাঁখের ছোট-বড় কিছু না কিছু জিনিস কিনে নিয়ে যায়। এই শাঁখের বিশেষত্ব এই যে সুন্দর গোলাপি, গেরুয়া রঙের হয় এবং তা দিয়ে বাতিদান, কানের গয়না, গলার হার ইত্যাদি তৈরি হয়।

শহরে খুব জবর খবর যে আগামীকাল সেন্ট জেনরে অর্থাৎ সেন্ট জানয়ারের রক্ত দেখা যাবে। পরদিন গির্জার দিকে গেলাম। সেখানে এত স্ত্রী পুরুষের ভিড় যে অতি কষ্টে গির্জার সামনে উপস্থিত হলাম। হঠাৎ লোকেদের হর্ষধ্বনি শুনলাম, রক্ত দেখা গেছে, রক্ত দেখা গেছে রব সবার মুখে। একজন পাদ্রী গির্জার সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং একটা কাচের টিউব উঁচু করে তুলে ধরে বললেন, এই দেখ রক্ত, সেন্ট জেনরের, বিরাট জনতা একসঙ্গে উল্লাস প্রকাশ করল। এইরকম গরম রক্ত ওই টেস্ট টিউবে ভরা, দুবার বছরে দেখা যায়। যতদিন রক্ত দেখা যায় ততদিন দেশের কোনও বিপদ নেই, নেপলসবাসীদের এই ধারণা।

এখানে আর্ট গ্যালারি অনেকগুলি আছে। আমি ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারিতে অনেক বিখ্যাত ইতালিয়ান চিত্রকরদের ছবি দেখলাম। একদিন টারম্ভেলা নাচও দেখা গেল।

নেপলস, যার আসল নাম নাপোলিতে, সেখানে আরও দুদিন কাটিয়ে সান্তামারিয়া ও সান্তালুচিয়া অঞ্চলে ভালো ভালো ইতালিয়ান রান্না খেলাম। এখানে বাচ্চা অক্টোপাস ভেজে খাওয়ার রেওয়াজ সর্বত্র। খেতে সুস্বাদু এবং মনে হয় চিংড়ি মাছ ভাজা খাচ্ছি।

নেপলস ছেড়ে ইতালির রাজধানী রোমের দিকে রওনা হলাম। রাস্তাটা সমুদ্রের ধার দিয়ে গিয়েছে। খুব সুন্দর চওড়া রাস্তা। তিনদিন পরে অস্ট্রিয়া শহরে পৌঁছলাম। রোম শহর সমুদ্রের ওপর নয়। রোমের স্ত্রী-পুরুষ অস্ট্রিয়াতে যায় আট মাইল দূরে সমুদ্রস্নান করতে। এই আট মাইল পথে এত আলো দেওয়া হয়েছে যে মনে হয় দিন হয়ে গেছে।

রোম বা রোমা পৌঁছলাম বেলা তিনটের সময়। একটা জায়গা পেলাম হোটেল রতশে, ভিলা বোর্গেশের খুব কাছে। অদূরে ভিয়া আপ্পিয়া এবং পিয়াজা দেল পোশেগালো অনতিদূরে। রোমের বয়স দুই হাজার বছরের ওপর। আজও সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। কত বাড়ি, টেম্পল, প্রাসাদ হাজার হাজার বছরের সাক্ষ্য দিচ্ছে, ভাবলে অবাক লাগে। প্রাক খ্রিস্টীয় যুগের তৈরি কলসিয়াম, আর্ট অব টিট্টস, পায়েন এমনই কত কীর্তি মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। ভিয়াডেল ইম্পেরো হচ্ছে পুরনো রোমের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একটি রাস্তা। একদিকে বিরাট কলসিয়াম অন্য দিকে আধুনিক রাজা ভিক্টর এমানুয়েলের স্মৃতিসৌধ, সুন্দর সাদা মার্বেল দিয়ে তৈরি। বাড়িটি মস্ত বড় কিন্তু খুব সৌন্দর্যের পরিচয় দেয় না।

রোমানদের পার্লামেন্ট বা ফোরাম যেখানে ছিল সেটি ভিয়াডেল ইম্পেরোর ডানদিকে, যদি কলসিয়ামের দিকে যাই। ‘ব্রুটাশ তুমিও’ যেখানে সিজার বলেন, সেই জায়গাটি ট্যুরিস্টদের আজও দেখানো হয়।

ডোরিয়া চিত্রশালা দেখতে গেলাম, সুন্দর ছবি ও প্রস্তর মূর্তি দিয়ে সাজানো। একটা ভিনাসের মূর্তি এমন ভাবে রাখা হয়েছে যে দেখলেই মনে হয় ভিনাস স্নান সেরে জল থেকে সবেমাত্র উঠেছে।

একদিন পান্থেয়ন দেখতে গেলাম। দেশের বিখ্যাত এবং কৃতী লোকের মৃত্যুর পর তার মরদেহ এখানে আনা হয়। এর চেয়ে বড় সম্মান আর কিছু নেই। পান্থেয়ন দু হাজার বছরের পুরনো পাথরের বাড়ি।

সেদিন সিজারের জন্মদিন ছিল। ভিয়াডেল ইম্পেরোর ফুটপাথে ব্রোঞ্জের অনেক মূর্তি আছে। হঠাৎ দেখলাম সিজারের মূর্তির সামনে কয়েকটা গাড়ি থামল এবং মুসোলিনি নামলেন। অল্পক্ষণের মধ্যে দেখলাম যে প্রপাগান্ডার জন্য স্টেজ তৈরি হল। মুসোলিনি বেঁটে ছোট্ট সাইজের লোক। কিন্তু গলাটা ভারিক্কি চালের

তিনি বললেন, আজ সিজারকে সম্মান দেখাতে এসে আমরা নিজেদের সম্মানিত করছি কেননা আমরা সেই বিরাট পুরুষের বংশধর। আমরাও রোমান, আজকের দিনের। সেদিনের রোমানদের প্রকাণ্ড সাম্রাজ্য ছিল তুর্কি থেকে ইংল্যান্ড পর্যন্ত। কিন্তু আমাদের কী আছে? কিছুই না। ইংরেজ ও ফরাসি চক্রান্ত করে সমস্ত পৃথিবীটা ভাগ করে নিয়েছে। আমাদের কর্তব্য হল এবিসিনিয়া জয় করে আমার লোকেদের স্থানাভাব ঘোচানো। ফটোগ্রাফাররা ছবি তুলল, চেষ্টা হল আমাকেও ছবির অন্তর্ভুক্ত করবার।

পিয়াসা ভেনেসিয়ার ওপর মুসোলিনির অফিস। একদিন বক্তৃতা শুনতে গেলাম। ওপরের বারান্দা থেকে নিচের জনতাকে লক্ষ করে এক দীর্ঘ বক্তৃতা শুনলাম। তার সারমর্ম হল সেই একই কথা যে পৃথিবীটা সবাই ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিয়েছে। এমনকী আফ্রিকাতে পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের বিস্তার করেছে। ইতালিতে ঠাঁই নেই। ভবিষ্যৎ বংশধরেরা যাবে কোথায়?

আবার উল্টো আরেক সুরের বক্তৃতা শুনলাম, ইতালি যদি পৃথিবীর বড় বড় জাতির সঙ্গে এক পংক্তিতে বসতে চায় তবে তার আর্মি অনেক বড় করতে হবে। অনেক লোক চাই। আমি চাই ইতালি তার যোগ্যস্থান অধিকার করুক। তোমরা অনেক সন্তানের জননী হও এই কামনা করি। শ্রোতারা হাসতে হাসতে যে যার কাজে চলে গেল।

ইতিমধ্যে কয়েকটা ছোট যুদ্ধ জাহাজ তৈরি করেই মুসোলিনি ভূমধ্যসাগরে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছেন। এখন ইংরেজরা মাল্টাতে ঘাঁটি করেছে, নৌবহরের সার নিয়ে। জিব্রাল্টার, আলেকজান্দ্রিয়া ও মাঝখানে মাল্টাকে ঘাঁটি রেখে ইংরেজ ভূমধ্যসাগরকে সুরক্ষিত করেছে। মাল্টা ইতালির খুবই কাছে এবং সেই কারণে মুসোলিনির গাত্রদাহ। ইতালিয়ানরা ভূমধ্যসাগরের আরেকটা নামকরণ করেছে নস্ত্রামারে অর্থাৎ আমাদের সমুদ্র। তবে আমাদের সমুদ্র বলে চেঁচালেই বা লিখলেই তো ভূমধ্যসাগরের কর্তৃত্ব ইতালির হাতে পড়বে না।

স্পষ্ট বোঝা যায় ইতালি আফ্রিকার আবিসিনিয়া সাম্রাজ্য দখল করতে চায়। তার সপক্ষে জনমত তৈরি করবার চেষ্টা হচ্ছে ফতোয়া ঝেড়ে আর গুণ্ডাবাজি করে।

আমি ইতালিতে দেখেছি, মুসোলিনির চেষ্টায় নিয়মানুবর্তিতা মেনে সবাই চলেছে। পথঘাট পরিচ্ছন্ন। ট্রেন সময়মাফিক আর কলকারখানা পুরোদমে চলে। সবাই মুসোলিনির এসব সাফল্যে মুগ্ধ।

এমনকী ওই সময় আমিও।

ইতালি মিউজিকের জন্য বিখ্যাত, অপেরা দেখতে গেলাম, খুব ভালো গান শুনলাম এক টেনর, লউরি ভল্লির গলায়। টেনর হচ্ছে পুরুষের মিহি গলা। ইউরোপের দক্ষিণে গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলির শ্রেষ্ঠ গায়করা টেনর, তেমনই উত্তরের শীতপ্রধান দেশের গায়কদের মোটা গলার বলে বেশ কিংবা বারিটোন। বেশ- বারিটোন রাশিয়ান গায়ক চালিয়াপিনের গান শুনেছি। গভীর মোটা সুন্দর গলার গান অপূর্ব। ভোলগা নদীর, গান যে শুনেছে সে ভুলতে পারবে না। আমেরিকান পল রোবসনের গলা এই ধরনের ডিপ বেশ, তার গান ওল্ডম্যান রিভার পৃথিবীর সব দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। তেমনই ইতালির টেনররা বিখ্যাত কারুশো, জিলি, ভল্পির গান রেকর্ডের মাধ্যমে দেশে দেশে পরিচিত।

অপেরার নাম ডন জিওভান্নি, খুব ভালো লাগল।

ইতালির দক্ষিণ-পূর্ব কোণের দেশে কালাব্রিয়ার লোকেরা বেশ রোদে পোড়া এবং কালো হয়। আমাকে অনেকে জিজ্ঞাসা করেছে আমি কালাব্রিয়া কিংবা সিসিলির লোক কিনা।

দুদিন পরে রবিবার। ঠিক হল ঐতিহাসিক জায়গাগুলি দেখব। এডেন্টাইন হিলসে বাথ অব কালিগুলা দেখলাম। নেরো কোথায় দাঁড়িয়ে রোমকে পুড়তে দেখেছিল সেই জায়গাটি একজন নির্দেশ করল। ইতিহাস যেন বাস্তবে এসে থেমেছে। রোম শহর সাতটা পাহাড়ের কোলে অবস্থিত। বাইরে থেকে একোয়াডাকট বেয়ে জল সরবরাহ হত, আজও একোয়াডাকটগুলি অতীত দিনের সাক্ষ্য দিচ্ছে।

ইতালিয়ানরা সবাই রোমান ক্যাথলিক। পোপ তাদের ধর্মগুরু। পৃথিবীর মধ্যে সেরা গির্জা, সেন্ট পিটারের বিরাট গির্জার সামনে বিশেষ দিনে ধর্মগুরু পোপ সাধারণকে দেখা দেন। সামনের চত্বরটা প্রকাণ্ড। এক লক্ষ লোক একসঙ্গে পোপের আশীর্বাদ নিতে পারে। পোপের বাড়ি সেন্ট পিটার্স গির্জার সংলগ্ন। বাড়ি বললে ভুল বলা হয়, সে একটা মস্ত রাজপ্রাসাদ, নাম ভ্যাটিকান। ভ্যাটিকান অনেক জায়গা জুড়ে এবং সেটি ইতালি রাজ্যের মধ্যে একটি স্বাধীন রাজ্য। বড় বড় মিউজিয়াম, চিত্রশালা এমনকী দূতাবাসও আছে।

এককালে পোপরা ধর্ম সিকেয় তুলে, দেশ জয় করতে এবং রাজত্বের আয়তন বাড়াতে মনোনিবেশ করেছিল। তাদের মধ্যে খুব অবনতি লক্ষ করা যায়। কিন্তু ক্ষমতা ছিল অনেক দেশ জুড়ে এবং অপ্রতিহত।

এখনকার দিনেও পৃথিবীর যত রোমান ক্যাথলিক ক্রিস্টান আছে তাদের নেতা এবং সব ধর্ম বিষয়ে পোপের নির্দেশ হচ্ছে শেষ কথা।

সেন্ট পিটার্স গির্জা তৈরি করেছিলেন মিকেল এঞ্জেলো। গির্জার ওপরে, ভেতরে ও বাইরে অগণিত পাথরে ভাস্কর্য মূর্তি তাঁর তৈরি।

সিঁড়ি বেয়ে সেন্ট পিটারের ওপরে উঠলাম। ডোমটা আসলে দুটো, একটার ভেতরে আরেকটা ছাদে পৌঁছলাম। এখান থেকে নিচের ও সামনের দৃশ্য খুব সুন্দর। ছবি তুললাম। অদূরে টাইবার নদী, নদীর মাঝখানে একটা দুর্গ। দুধারে শহর, দুই হাজার বছর তার বয়স।

ভ্যাটিকান চিত্রশালা ও আর্ট সংগ্রহ দেখতে গেলাম। শত শত বছর ধরে পোপকে যে যা উপহার দিয়েছে সেগুলি সাধারণের দেখবার জন্য সাজানো রয়েছে।

পোপের বাগানাবাড়ি রোম শহর থেকে কুড়ি মাইল দূরে। দেখতে গেলাম। বিরাট কেয়ারি করা নানা ফুল গাছে সজ্জিত কাস্টেল গন্ডলফো বাগান। মস্ত প্রাসাদ। পোপকেও দেখা গেল। বাগানের একটা পথ ধরে কোনও একটা বই পড়তে পড়তে পায়চারি করছেন।

মিকেল এঞ্জেলোর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ক্যাপেলা সিস্টিনে অর্থাৎ সিস্টিনে চ্যাপেল বললে ভালো হয়। এই চ্যাপেলের ভেতরে সিলিং ও দেওয়ালে আঁকবার জন্য মিকেল এঞ্জেলাকে কয়েক বছর বন্দী করে রাখা হয়। সিলিংয়ে আদম ও ইভের জন্মকথা পূর্ণাবয়ব ছবি দিয়ে আঁকা রয়েছে। কয়েক শত বছর পরে ছবিগুলিতে রঙের ফাটল দেখা যায়। তাতে ছবি তারিফ করবার পক্ষে কোনও অসুবিধা হয় না। ওপরের দিকে চেয়ে চেয়ে ঘাড় ব্যথা হয়ে যায় বলে চ্যাপেলের ভেতর ট্যুরিস্টদের হাতে আয়না দেওয়া হয়। তাতে ঠিক দেখে যেন আশ মেটে না। বরং ইচ্ছা করে মাটির ওপর শুয়ে পড়ি এবং ভালো করে দেখি। দেওয়ালের সমস্তটা জুড়ে একটা প্রকাণ্ড ছবি দি ডে অব জাজমেন্ট শত শত চরিত্র নিয়ে আঁকা। সুন্দর এবং বিশাল কাজ সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

মিকেল এঞ্জেলোর তৈরি অনেক শ্বেত পাথরের মূর্তি নানা জায়গায় দেখলাম। তাদের মধ্যে ফ্লোরেন্সের ডেভিড এবং সেন্ট পিটার্স গির্জার ল্যা পিয়েটা সর্বোৎকৃষ্ট। ক্যাপিটালের ওপর উঠে মিউজিয়াম দেখলাম। এখানেও একটা প্রাসাদের ওপর দুটি মর্মরমূর্তি দেখা যায়। একটির নাম দিন, অন্যটির নাম রাত্রি। এ দুটিও মিকেল এঞ্জেলোর তৈরি।

পুরনো রোমের নানা জায়গায় বড় বড় ফোয়ারা আছে। একটি খুব সুন্দর ফোয়ারা স্টেশনের কাছেই দেখলাম। এটিও মিকেল এঞ্জেলোর তৈরি। আরেকটি ফোয়ারা দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে, ফন্তানা ডেল ট্রেভি। একটা বাড়ির দেওয়ালের গায়ে এই ফোয়ারা। অনেক সুন্দর সুন্দর পাথরের মূর্তি দিয়ে ফোয়ারাটি সাজানো। জলের মধ্যে দেখা গেল অসংখ্য পয়সা পড়ে রয়েছে। লোকে পয়সা ফেলে এই বিশ্বাসে যে আবার রোমে বেড়াতে আসতে হবে। আমাদের দেশে মেয়েরা যেমন গাছে ইট পাথর বাঁধে এবং আশা করে তাই দিয়ে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে।

শহর থেকে দূরে হাদ্রিয়ানের সমাধি দেখে এলাম। ইউরোপে কখনও ইউক্যালিপ্টাস গাছ দেখিনি। এইখানে সার বাঁধা ছটা খুব উঁচু ও বড় ইউক্যালিপ্টাস গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেখলে মনে হয় তারা অনেক দিন ধরে মাথা উঁচু করে খাড়া আছে। আরেকদিন শহর থেকে দূরে ফ্রাস্কাটি ও টিভোলি দেখে এলাম। এমন বিচিত্ৰ ফোয়ারা দিয়ে জলের শোভা আগে কখনও দেখিনি। রোমানরা খুব আরামপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল। এইসব তারই নমুনা। প্রথম দিকে এরা গ্রিকদের দেব-দেবী পূজা করত।

কলসিয়াম শ্বেত পাথর দিয়ে তৈরি এক বিরাট সৌধ। আজকালকার স্টেডিয়াম যাকে বলে। ৩০,০০০ লোক বসতে পারত। প্রথম যারা খ্রিস্টান হয়েছিল তাদের ওপর রোমান সম্রাটদের এত রাগ ছিল যে তাদের কলসিয়ামে রক্ষিত সিংহের সামনে ছেড়ে দিত। অনেকে এমনিভাবে প্রাণ দিয়েছে। আরেকটি স্পোর্টস ছিল, অপরাধীদের মধ্যে দুজনের আমরণ যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়া। যোদ্ধাদের গ্ল্যাডিয়েটর বলা হত। অনেক সময় দুজন খুব গায়ে জোরওয়ালা লোককে লড়তে বলা হত এবং যতক্ষণ না একজনের মৃত্যু হত ততক্ষণ লড়াই চলত।

রোমে এত দেখবার জিনিস আছে যে তা দেখেই জীবন কাটানো যায়। মিকেল এঞ্জেলো যেমন ভাস্কর্যে সবচেয়ে পারদর্শী ছিলেন, তেমনই রাফেল ছিলেন ছবি আঁকায়। এত পরিচ্ছন্ন, সুন্দর কাজ সহজে দেখা যায় না।

লা ফার্নেসিনা নামে একটা ছোট প্রাসাদ আছে। শুনলাম সেখানে রাফেলের অনেক ছবি দেখা যায়। লা ফার্নেসিনা বন্ধ ছিল। সবসময় বন্ধই থাকে। গেটের কাছে একটা বাড়ি ছিল। সেখানে একজন লোক জল গরম করছিল। তাকে বললাম যে ভারতবর্ষ থেকে এসেছি রাফেলের কাজ না দেখতে পেলে খুবই দুঃখিত হব। লোকটি বলল, আচ্ছা চল তবে। এই বলে চাবির তাড়া নিয়ে এগিয়ে এল।

ফার্নেসিনা দোতলা ছোট্ট প্রাসাদ। বাড়ির চারদিকে প্রশস্ত বাগান আছে কিন্তু অযত্নের জন্য বড় বড় ঘাস জন্মেছে। এত সুন্দর সুন্দর ছবি দেখলাম যে র‍্যাফেলের প্রতি আমার শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে গেল। একজন নিখুঁত আর্টিস্ট। লোকটি দয়া করে খুলে না দিলে লা ফার্নেসিনা দেখা হত না এবং রোম পরিদর্শনে একটা খুঁত থেকে যেত।

মুসোলিনি নিজের নাম অক্ষয় করবার জন্য একটা স্টেডিয়াম করলেন, তার নাম দিলেন ফোরো মুসোলিনি। ইতালির যত বিখ্যাত শহর আছে তাদের নামে একেকটি নয় ফুট লম্বা মর্মরমূর্তি দিয়ে বাঁধানো গ্যালারি সাজালেন। প্রত্যেক মূর্তির ভেতর দিয়ে ইতালির প্রত্যেকটি অঞ্চলের বিশেষত্ব ফুটিয়ে তোলবার চেষ্টা হয়েছে। ফোরো মুসোলিনি এখন খেলার স্টেডিয়াম। মনে হয় সাত থেকে দশ হাজার লোক ধরে।

রোম ছেড়ে লেগহর্নের পথ ধরলাম। তৃতীয়দিনে এই সমুদ্র উপকূলবর্তী শহরে পৌঁছলাম। কাছেই পিসা, পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম, লিনিং টাওয়ার অব পিসা দেখা আমার উদ্দেশ্য। একটি গোলাকৃতি নিখুঁত সুন্দর টাওয়ার যুগ যুগ ধরে হেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এমনিতেই টাওয়ারটি দেখার মতো। তার ওপর এক পাশে হেলে অত বড় ইমারত দাঁড়িয়ে রয়েছে এ এক আশ্চর্যের জিনিস। টাওয়ারটার ব্যাস হবে ২০ ফুট, উচ্চতায় ৭০-৮০ ফুট। টাওয়ারের চারদিকে বারান্দা, প্রত্যেক তলায় একটি গোল বারান্দা, নিখুঁত শ্বেত পাথরের কাজ

লর্ড বায়রন এখানে অনেকদিন বাস করেছিলেন। স্থানীয় লোকেরা বলে যে তিনি লেগহর্ন বন্দরের সামনে খুব সাঁতার কাটতেন।

বন্দরে বড় একটা জাহাজ দাঁড়িয়ে ছিল। সেটা বোঝাই করা হচ্ছিল বস্তা বস্তা সোডা অ্যাশ দিয়ে, এ দিয়ে কাচের বাসন তৈরি হয়। তাদের গন্তব্যস্থল ভারতবর্ষ। তখনই ইচ্ছা করল আমি যদি সোডা অ্যাশের বস্তা হয়ে একবার চট করে স্বদেশে ঘুরে আসতে পারতাম। একটা ইতালিয়ান রেস্তোরাঁতে গেলাম ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য। এক প্লেট স্পাঘেটি ও মাংসের কিমা খেতে দিল। তখন কলকাতার বাড়ির কথা ও মা-বাবা ভাইবোনের কথা ভাবছিলাম অনেকদিন পরে।

লেগহর্ন ছেড়ে উত্তরের পথ ধরলাম। রাত্রে একটা মস্ত পাহাড়ের নিচে, নাম না- জানা গ্রামে পৌঁছলাম। পাঁউরুটি, সসেজ ও কফি দিয়ে রাতের খাওয়া সারলাম।

সকালে উঠে দেখি পাহাড়টার রং সাদা। এই সেই বিখ্যাত কারারা মার্বেল। পৃথিবীর যত শ্রেষ্ঠ কাজ এই পাথরের তৈরি। এর বিশেষত্ব হল এই যে খুব মসৃণ এবং সাদার মধ্যে অন্য দাগ নেই। পাথরের গ্রেন্সও আরও সূক্ষ্ম মনে হয়। আমার ধারণা তাজমহল এবং অন্যান্য মর্মর প্রস্তরের তৈরি ইমারত কারারা থেকে সংগৃহীত পাথরেই হয়েছিল। পাথরের গায়ে হাত দিলে মনে হয় মাখন মাখানো।

যেখানে পাথর কাটছে এমন একটা কোয়ারি দেখলাম। সে জায়গাটা ৪,০০০ ফুট উঁচু। উত্তরের পথ ছেড়ে এবার পুবে ফ্লোরেন্সের দিকে মুখ ঘোরালাম। ইতালিতে সমস্ত গ্রাম, সমস্ত শহর ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য ভর্তি। তাদের মধ্যে রোম প্রথম। ফ্লোরেন্সের স্থান তার নিচেই। আর্ট, ইতিহাস, স্থাপত্য ও সাহিত্যে সব জায়গাই চিরস্মরণীয়। ইংরিজি পাঠকদের কাছে শেক্সপিয়ার তাঁর অনেক নাটকের পৃষ্ঠপট হিসাবে এ শহরকে অমর করেছেন।

খুব সুন্দর শহর এই আর্নো নদীর ওপর। একটা দোতলা সেতু শহরের দুটো অংশকে যোগ করেছে। সেতুর ওপর দোকান আছে অনেক। লোকেরা দামি দামি জিনিসপত্র কেনাবেচা করে। হীরা মণি মুক্তো থেকে কাচের ফুলদানি, আলাবাস্টারের মূর্তি ইত্যাদি চারুকলার জিনিস পাওয়া যায়।

ফ্লোরেন্সের নামের সঙ্গে ইতালির অনেক বিখ্যাত লোকের জীবন জড়িত। এইখানে দান্তে ও বিয়াত্রিচে, চেলিনি, মিকেল এঞ্জেলো, লিওনার্ডো দা ভিঞ্চি, টিশিয়ান, রাফায়েল পায়ের ছাপ রেখেছেন। দুটো জগদ্বিখ্যাত চিত্রশালা পাশাপাশি রয়েছে। উফিক্সি ও পিটি। দুটোই অতুলনীয়। পালাৎসো ভেক্কিওর সামনে ডেভিডের মর্মর মূর্তি মিকেল এঞ্জেলোর তৈরি, বোধ হয় পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাস্কর্যের নিদর্শন। দুটো চিত্রশালা ভর্তি ইতালিয়ান শ্রেষ্ঠ আর্টিস্টদের কাজ রয়েছে। আমার দুদিন লাগল সবগুলি পেন্টিং ভালো করে দেখতে।

তারপর গির্জা দেখতে লাগলাম। স্থাপত্যে নিখুঁত। গির্জাটিতে অনেকে টালির ছাদ দেখে ক্ষুণ্ণ বোধ করেন। মনে হয় তাঁদের সৌন্দর্য বোধ কম। ইতালির অনেক গির্জা ও রাজপ্রাসাদ টালির ছাদের। মাকিয়াভেল্লির কবর এখানে।

গির্জার সামনেই ব্যাপটিস্ট্রি। এখানে শিশু অবস্থায় খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষা দেওয়া হয়। দুখানা বিশাল দরজায় নিখুঁত কাজ করা ব্রোঞ্জের ওপর মিকেল এঞ্জেলোর অক্ষয় কীর্তি।

ফ্লোরেন্স শহর পাহাড়ের নিচেই বলে অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা। এবার আমাকে ইতালির শিরদাঁড়া, আপেনাইন পাহাড়ে চড়তে হবে। ওপারে বোলোইনা শহর। দুদিন লাগল পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে বোলোইনা পৌঁছতে। রাস্তা ভালো, দক্ষিণ ইতালির বড় একটা সংযোগস্থল এটা, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শহরগুলিতে যাবার জন্য।

বোলোইনা পুরনো শহর। শহরের মাঝখানে একটা চত্বর রয়েছে যেটি ভাষণদান ও বেড়াবার জায়গা হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

বোলোইনাতে মাত্র একদিন থেকে পাদুয়ার পথ ধরলাম। মাঝে ইতালির অন্যতম বড় নদী, পো পেলাম। আমাদের দেশের গঙ্গা বা ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে অবশ্য তুলনা করা উচিত নয়। এইসব নদী, কবিতা-গানে ও লেখায় বিখ্যাত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আসলে খুব অপরিসর, প্রায় একটা নালার মতো। বরফ গলা জল বলে কাচের মতো স্বচ্ছ।

পাদুয়া ইউনিভার্সিটি দেখবার খুব ইচ্ছা ছিল। এটি একটি বহু পুরনো শিক্ষাকেন্দ্ৰ। পাদুয়ায় পৌঁছলাম দুদিন পর। এখানে সারা বছর ধরে ট্যুরিস্টরা আসে যায়, তবু আমার পিছনে মস্ত একদল ছেলে-মেয়ে আঁটুলির মতো সঙ্গে লেগে রয়েছে। অনেকে কথা বলবার ইচ্ছায় আমাকে থামিয়ে নানা রকম প্রশ্ন করে।

ইউনিভার্সিটির এক কর্তাব্যক্তি, মিস্টার বার্টোরিনির অনুরোধ একদিন পরে একটা বক্তৃতা দিতে হবে আমার ভ্রমণ সম্বন্ধে। ভদ্রলোক খুব উৎসাহী। আমাকে তাঁর বাড়িতে খাবার নেমন্তন্ন করলেন। ইতালিয়ান রান্না আমার খুব পছন্দ, রিসোট্রো, রাভিওলি ইত্যাদি আমার বিশেষ প্রিয়। মনে হয় একটু একটু প্রাচ্যের ছোঁয়াচ আছে তার মধ্যে।

গৃহকর্ত্রী বেশ উচ্চশিক্ষিতা। কলেজে দর্শনশাস্ত্র পড়ান। নিজেই রেঁধেছেন এবং আমাকে সাদরে গ্রহণ করলেন। বাটোরিনিদের একটি ছেলে আছে, সে আমেরিকাতে পড়াশুনো করে। ছেলে আমেরিকান এক ছাত্রীকে বিয়ে করতে চায়। ভদ্রমহিলা তাই উঠে পড়ে লেগেছেন ইংরিজি শিখতে।

পরদিন সন্ধ্যায় ইনস্টিটিউট অব কালচারের উদ্যোগে মিটিং হল। বিষয় ‘রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন’। মিটিং শেষ হবার পর অনুরোধ পেলাম যে গান্ধীজির জীবন সম্বন্ধে বলতে, বিষয়: ‘গান্ধীজি ও স্বাধীনতা’। স্বাধীনতা মানে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা। দ্বিতীয় দিন যখন আমার ডাক পড়ল, আমার ধারণা হল যে শান্তিনিকেতন সম্বন্ধে যা বলেছি তা ভালোই হয়েছে।

গান্ধীজির কথায় সবাই মুগ্ধ। শেষে একজন প্রশ্ন করল যে গান্ধীজি সাধুপুরুষ না রাজনীতিবিদ? আমি বললাম তিনি একজন সত্যদ্রষ্টা, সত্যের ওপর রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করেছেন। তিনি অবশ্যই সাধু প্রকৃতির। তিনি নিজের ঐহিক সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ভুলে সমাজে যারা অবহেলিত ও পদদলিত, নিজেকে তাদেরই একজন বলে মনে করেন। জাতিভেদ প্রথার মূলে তিনি আঘাত হেনে তাকে নির্মূল করতে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন।

পাদুয়া ছেড়ে ভেনিসের পথ ধরলাম। রাস্তা খুব ভালো। শেষ হল একটা জলপথের সামনে। জলপথ পার হয়ে ভেনিস শহরে ঢুকলাম। সব শহরে যানবাহন ও মানুষ চলাচলের জন্য বড় ছোট সবরকম রাস্তা থাকে, আশ্চর্যের বিষয় যে ভেনিসে জলপথই রাজপথ। বাড়িগুলি একেবারে জলের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যেতে হলে নৌকো বা গন্ডোলা নিতে হয়। দূরের জায়গার জন্য বড় বড় স্টিমার ক্যানালের ওপর এদিক ওদিক চলেছে।

কলকাতায় ভীষণ বৃষ্টির ফলে কখন কখনও রাস্তা জলে ভরে যায়। বাড়ির দরজা পর্যন্ত জল ওঠে। ভেনিসে এই অবস্থা সারা বছর। নৌকো অর্থাৎ গন্ডোলা বাঁধবার জন্য সব বাড়ির সামনে বড় বড় কাঠের খোঁটা পোতা আছে।

গন্ডোলার চালকরা দাঁড়িয়ে নৌকো চালায়। সাধারণত এরা খুব স্ফূর্তিবাজ লোক হয়।

শহরের ভেতরে ভেতরে গলি দিয়ে পাকা রাস্তা আছে। জলে যেমন সহজে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া যায়, স্থলপথে সেখানে অনেক ঘুরতে হয় এবং দূরত্ব বেড়ে যায়। আমাদের দেশের বাসের মতো স্টিমার সব বড় বড় ক্যানাল দিয়ে যাতায়াত করে। বিশেষ কোনও অসুবিধা হয় না।

পৃথিবীর মধ্যে এই রকম জলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা শহর আর দুটি নেই। এ এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার।

ভেনিস বেশ পুরনো শহর, যুগে যুগে সে ইতালির ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। ইট পাথর কাঠ দিয়ে প্রথমে সার সার বড় বড় বাড়ি তৈরি হয়েছে। তারপর খাল কেটে সমুদ্রের জল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেইগুলি এখন জলপথ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সানমার্কো চত্বরের এক কোণে জলের ওপর একটি হোটেলে উঠলাম। ভেনিসের বিশেষ দ্রষ্টব্য হচ্ছে সানমার্কো গির্জা, কাম্পানিল ও পাশেই ডোজের প্রাসাদ, গির্জার সামনে চত্বরটা বিরাট। চারদিকে এক ধরনের থামওয়ালা বাড়ি, একতলায় দোকান

চত্বরের এক প্রান্তে মস্ত গির্জা। যেন একটি জুয়েলারি বাক্স। আদ্যোপান্ত পাথর ও কাচ দিয়ে ভেতর বাইরে মোজেক করা। এটি বাইজান্টাইন-স্থাপত্যের স্বাক্ষ্য দেয়। গির্জাটি সেন্ট মার্কের নামে উৎসর্গীকৃত।

যুগ যুগ ধরে ট্যুরিস্টরা তীর্থযাত্রীর মতো এখানে এসেছে হাজারে হাজারে এবং অবসর সময়ে গন্ডোলায় চড়ে গান শুনেছে অথবা চত্বরের অগণিত পায়রা খাইয়েছে। মানুষকে পায়রা ভয় পায় না। হাতে খাবার ঠুকরে তোলবার চেষ্টা করে। চমৎকার দৃশ্য।

কাম্পানিল ইটের গাঁথনি করা প্রকাণ্ড উঁচু চতুষ্কোণ ইমারত। পাশেই সমুদ্র এবং অদূরে সেন্ট জর্জ দ্বীপ স্পষ্ট দেখা যায়। সবচেয়ে বড় ক্যানালটাকে গ্র্যান্ড ক্যানাল বলা হয়।

গ্র্যান্ড ক্যানাল সমুদ্রে এসে মিশেছে। এখানটা খুব চওড়া, দূরে মার্বেল দিয়ে তৈরি সুন্দর গির্জা জলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। নাম মারিয়া দি লা সালুতে।

প্রায় সানমার্কো গির্জা ও কাম্পানিলের মাঝামাঝি ডোজদের প্রাসাদ, ডোজরা ভেনিসে রাজত্ব করতেন। কখনও কখনও তারা উত্তর ইতালি জয় করেছে এবং বিস্তীর্ণ এলাকার ওপর প্রভুত্ব চালিয়েছে।

ডোজরা বড় একটা হলঘরের মাঝখানে বসে দেশ শাসন করত। যারা আইন লঙঘন করেছে তাদের তারা শাস্তি দিত। বিচারের পর দুষ্কৃতকারীদের পাশের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হত। দুটো বাড়ির মাঝখানে একটা সেতু আছে জলপথের ওপরে। সেতুটির নাম ব্রিজ অব সাই। দণ্ডিত লোকেরা সেতুটির ওপর দিয়ে কারাগারে যাবার সময় বহির্জগতের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলত, কেননা কবে যে কারাগার থেকে বেরোবে কে জানে।

ডোজদের বাড়ি এখন চিত্রশালা হয়েছে। পাশের প্রাসাদে এখন রয়্যাল দানিয়েলি হোটেল হয়েছে। ট্যুরিস্টদের রাজকীয় যত্নে থাকতে ও খেতে দেওয়া হয়।

জগদ্বিখ্যাত অনেক ইতালিয়ান চিত্রকরদের মাস্টারপিস আছে এই শহরের বিভিন্ন সংগ্রহশালায়।

ভেনিসের আরেক বৈশিষ্ট্য অতি পুরনো আমল থেকে কাচ ও কাচের যাবতীয় জিনিস, যেমন ঝাড়লণ্ঠন, আলোর ডোম, এখানকার শৌখিন জিনিসপত্র রাখবার নানা ধরনের আধার, প্লেট, বাটি ও গেলাস যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। খুব সুন্দর রং দিয়ে তৈরি হয়, অতি মনোরম দেখতে। সেই পুরনো কাচ প্রস্তুতকারকদের মধ্যে মুরানো আজও রয়েছে। এদের সুনাম খুব। মুরানোর কারখানা দেখতে গেলাম! আমার সামনে একটি কাচের কারুকার্য করা মালা তৈরি করে আমাকে উপহার দিল।

লর্ড বায়রন যে বাড়িতে থাকতেন সেটা দেখাল গন্ডোলাচালক। আমি খুব তারিফ করলাম। আমাদের দেশের কজন ঘোড়ার গাড়িচালক মাইকেলের নাম শুনেছে বা বিদ্যাসাগরের বাড়ি কোথায় জানে! ট্যুরিস্টদের কাছে বলা তো দূরের কথা।

ভেনিসে চারটি বড় চিত্রশালা, অনেকগুলি গির্জা ও দুটো প্যালেস দেখলাম। এই অদ্ভুত শহরটি দেখে খুব ভালো লাগল, আবার আসবার ইচ্ছা মনে পুষে রাখলাম।

ভেনিস ছেড়ে এবার পথ ধরলাম মিলানের

প্রথম রাতে ভেরোনা শহরে থামলাম। ইতিহাস প্রসিদ্ধ পুরনো শহর ঘরবাড়ি পথঘাট আরেককালের কথা বলে। পরদিন শহরটা ঘুরে দেখলাম।

ভেরোনা পার হয়ে পশ্চিমে এগোতে লাগলাম এবং কাছেই লাগো ডি গার্ডা পৌঁছলাম। বেশ বড় হ্রদ, বড় স্টিমারে যাত্রীদের নিয়ে একপ্রান্ত থেকে অন্য দিকে নিয়ে যায়। কাচের মতো পরিষ্কার জল। মাঝে একটা দ্বীপ আছে। এখানে কবি- সৈনিক দ্যানজিও থাকেন। কবি প্রথম মহাযুদ্ধের শেষে ট্রিয়েস্ত শহর দখল করেছিলেন।

মুসোলিনি তাঁকে পুরস্কারস্বরূপ দ্বীপটি দান করেন। দ্যানজিওকে দেখতে গেলাম। বাড়িঘর সব বন্ধ। চারদিকে কামান দিয়ে সাজানো, যেমন মিলিটারি হেড কোয়ার্টারে দেখা যায়। তিনদিন পর ব্রেসিয়া শহরে পৌঁছলাম। রাস্তা ভালো কিন্তু পাহাড়ের জন্য ওঠানামা করতে হচ্ছে। এদিকে দৃশ্য খুব সুন্দর। লম্বার্ডির একপ্রান্তে ব্রেসিয়া অন্যদিকে মিলান। পিছনে আল্পস মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে।

ব্রেসিয়া ছেড়ে পাঁচদিন পরে মিলান পৌঁছলাম। ইতালির অন্যতম বড় শহর বড় বড় কারখানা, বড় আকাশচুম্বী বাড়ি, রাস্তায় গাড়ির ভিড় দেখলে মনে হয় একটা ব্যস্তসমস্ত শহরে এসেছি।

ইতালির উত্তরাঞ্চলের লোকেদের মধ্যে অনেক ফ্লাকসে বা ফেয়ার হেয়ারের ছেলেমেয়ে দেখা যায়। সাধারণত লোকেরা খুব সুশ্রী। এখানে ফিয়াটের মস্ত কারখানা দেখতে গেলাম। স্বীকার করব যে ইতালিয়ানরা ছোট ছোট মেশিন ও নিত্যব্যবহারের জিনিসপত্র খুব নিখুঁতভাবে করতে পারে। ছোট গাড়ির মধ্যে ফিয়াট গাড়ির স্থান অনন্য। পৃথিবীর সর্বত্র তার চাহিদা বাড়ছে বই কমছে না।

মিলান শহর ইতালির মুক্তিযোদ্ধা মাৎসিনি ও গ্যারিবল্ডির নামের সঙ্গে জড়িত।

সন্ধ্যাবেলায় সব অফিস কারখানা বন্ধ হল। স্ত্রী-পুরুষ ছুটেছে ট্রাম, বাস ও রেলওয়ে স্টেশনের দিকে।

মুসোলিনির আদেশে, মিলান রেলওয়ে স্টেশন ভেঙে নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। মার্বেল পাথরের বিরাট সৌধ দেখবার মতো। বড় রেস্তোরাঁ দেখে ঢুকলাম। খুব ভালো খাবার পেলাম সস্তায়। খাবার পর আমি কয়েক মিনিট বিশ্রাম নিচ্ছি এমন সময় একজন কালো শার্ট পরা লোক এসে জিজ্ঞাসা করল, আমি খাবার ঠিক পেয়েছি কি না, দাম দেবার পর রসিদ দিয়েছে কিনা ইত্যাদি। বুঝলাম, মুসোলিনির রাজত্বে নিয়মানুবর্তিতা শেখাবার খুব চেষ্টা হচ্ছে। এই সম্বন্ধে আমার মনে পড়ল, একটা গল্প শুনেছিলাম, এক ইংরেজ ভদ্রমহিলার হাতঘড়ি চুরি হয় হোটেল থেকে। কারও কাছে সদুত্তর না পেয়ে মহিলাটি একটি চিঠিতে ঘটনার বিবরণ দিয়ে মুসোলিনির কাছে সেই চিঠি পাঠালেন। পরদিনই পুলিশের এক কর্তাব্যক্তি এসে হাজির। বলা বাহুল্য তিনদিনের মধ্যে ঘড়ি ফিরে পেলেন ইংরেজ ভদ্রমহিলা।

মিলানের ৫০ মাইল দূরে লেক কোমো এবং কাছেই লেক মাঞ্জিরে। অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। লেকের সামনেই আল্পস ১২,০০০-১৫,০০০ ফুট উঁচু, আমার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। বরফের ওপর দিয়ে রাস্তা এঁকেবেঁকে উঠেছে। কিছুটা বিপদের সম্ভাবনা আছে। পথ ছেড়ে পাহাড়ের নিচে সুড়ঙ্গপথে ওপারে সুইজারল্যান্ডে ব্রিগে পৌঁছলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *